গাত্রহরিদ্রা – ১৪

১৪

কারও কারও জীবনে লাগাতার চমক লেগে থাকে। কারও কারও জীবনে আবার হঠাৎ করে দু’একটা সংযোজনেই পৃথিবীর রং পাল্টে গিয়ে একেবারে নতুন লাগে। আশা-আকাঙ্ক্ষা যেখানে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে মুছে যেতে বসেছিল, স্বপ্নের দ্বীপটা বুঝি সেখান থেকেই আবার জেগে ওঠে। আনেক্কাপল্লীর টিকিট কাটতে রাজামুন্দ্রি স্টেশনের টিকিট ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়েছিল আহিরা। কিন্তু সামনের ছবিটা দেখে এগোবে কী আশার অতিরিক্ত পাওয়ার আনন্দে সে রীতিমতো বিহ্বল হয়ে কয়েকটা মুহূর্তের জন্য পায়ে যেন বেড়ি পড়ে নিল। পুরুষোচিত চেহারা আর সারা মুখে নিষ্পাপ সারল্য নিয়ে টিকিটের লাইনে এগারো বারো জনের পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাত্যকি। যে ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সে প্রায় প্রাণের দায়ে দৌড়েছিল, গলা ছেড়ে ডাকাডাকি করার পর ধরতে না পেরে জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার শূন্যতা অনুভব করে যার জন্য দুই চোখ জলে ভরে উঠেছিল সেই সাত্যকি টিকিটের লাইনে। গত প্রায় চব্বিশ ঘন্টা নৈরাশ্যের চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবার নতুন দিনের সূর্যের মুখ দেখবে এটা আহিরার কল্পনার কোনো ক্যানভাসেই ছিল না। হঠাৎ পাওয়ার এই উষ্ণতায় একই সঙ্গে আর একটা ছবিও উঁকি দিচ্ছে। এটা তো ঠিক, সাত্যকি খুব একটা প্রসন্ন হয়ে তাদের বাড়ি থেকে ফিরে আসেনি। সেই দুঃখ এবং অভিমান, অপমান তার ভেতরে কতোটা আগ্নেয়গিরির উত্তাপ সৃষ্টি করেছে সেটা জানাও বিশেষ জরুরি। এমনও তো হতে পারে, তার সঙ্গে কথা বলার জন্য এরপর সাত্যকির কোনো গরজ নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘গায়ে পড়া’ ভাব দেখানোটা কতোটা উচিত হবে?

আর একটা সূক্ষ্ম প্রশ্নও থেকে যায়। যে ছেলেটার জন্য তার চোখে জল আসে সেই সাত্যকি প্ল্যাটফর্মের নতুন এই পরিবেশে তাকে দেখে কতোটা আগ্রহী হয়ে ওঠে সেটা পরখ করার একটা বাসনাও ক্রমশই জমা হচ্ছে বুকের ভেতরেরও ভেতরে। মেয়ে হিসেবে ওই বাসনা একটা সম্মানের জন্যও। আহিরা মনে করে প্রত্যেকটা মেয়ের মধ্যেই সযত্নে লুকানো রয়েছে একটা নরম, পেলব মোরগ ফুল যেটা সম্মানের প্রতীক। অসাবধানে কেউ সামান্য একটু অবজ্ঞা দেখালেও যা ঝরে যায়। সাত্যকি কি সেই ‘মোরগ ফুলটা’ বাঁচিয়ে রাখতে নিজে থেকে এগিয়ে আসতে পারে না?

টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে সাত্যকি একটা সিগারেট ধরাবে কি না ভাবছিল। ঠিক করলো হাওড়ার টিকিটটা কাটার পরেই সেটা ধরাবে। সে প্ল্যাটফর্মের এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। লাইনটা ঠিক মতো এগোচ্ছে না কেন—কাউন্টারের দিকে দৃষ্টি রাখতেই তার চোখে যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। সে ঠিক দেখছে কী? সবুজ সিল্কের শাড়ি আর সবুজে ভরা দু’হাতের হাতছানি নিয়ে দুরন্ত ছিপছিপে শরীরের আহিরাই কি কাউন্ডারের দিকে পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলেছে? এ কি বাস্তব না মায়া? দৃষ্টির ভ্রম নয়তো? না, ওই মেয়েটা আহিরা ছাড়া কেউ নয়। অন্য কেউ হতেই পারে না। কারণ সাত্যকি যাকে তাকে কাচের চুড়ি পরায়নি—সে পরিয়েছিল মাত্র একজনকেই, যার নাম আহিরা বালযোগী। এবং সেই মেয়েটা তার সামনেই

লাইন ছেড়ে সাত্যকি প্রায় ছুটে গেল আহিরার কাছে। তার চোখে-মুখে খুশির উজ্জ্বলতা। সে ওর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো, আপনি? ওই ছোট্ট শব্দটুকু উচ্চারণের মধ্যেই সাত্যকির গলা বুজে যায়। সে আর কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে হাসির পেখম ছড়াতে থাকে।

আমাকে আমার কাজের জায়গায় যেতে হবে না?

ওহ আপনি তো আনেক্কাপল্লীতে ফিরবেন—আপনি এক কাজ করুন, প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসুন, আমি টিকিটটা নিয়ে আসছি।

আহিরা ওখানে দাঁড়িয়ে ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাতেই সাত্যকি দারুণভাবে হেসে উঠলো, আমি জানি আপনার কাছে টাকা আছে। তবে কোনো কোনো বন্ধুর ওপর একটু না হয় আস্থাই রাখলেন—এমন বন্ধু যে অবশ্যই আপনার কোনো ক্ষতি চাইবে না।

প্ল্যাটফর্মের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে আহিরা একটু অন্যমনস্ক হলো। সাত্যকি হঠাৎ ‘ক্ষতি’-র কথাটা বললো কেন? যে কোনো কারণেই হোক নিখিল মৈত্র একটা ভুল করে ফেলেছেন বলে তাঁর ছেলের দ্বারা যে দ্বিতীয়বার সেটা হবে না এটা বোঝাতেই কী? না কি পরোক্ষে সেটা ভুলে এবং নতুন করে বিরোধিতায় না গিয়ে নতুন সম্পর্কের মসৃণ রাস্তায় হাঁটা যায় না? হাঁটা তো যায়ই। নিশ্চয়ই যায়। আহিরা এই মুহূর্তে দারুণ খুশি। তার সম্মানের মোরগ ফুলটা বুকের ভেতরের বাতাসে সমানে মাথা দোলাচ্ছে। এবং আরও সত্যিটা হলো, সে তো ঠিক এই ছবিটাকেই তার মনের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখে বাস্তবেও এটাই দেখতে চেয়েছিল।

সাত্যকি টিকিট দুটো নিয়ে আহিরার সামনে এসে দাঁড়াতেই সবুজ বসন্তের দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটা সৌজন্য দেখাতে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। খোলা চুলের একরাশ কালো মেঘমালা যেন ওকেই ঘিরে রেখেছে। প্রসাধন বলতে কপালে একটা বেশ বড়ো সবুজ টিপ। আর কিছুই নয়। অথচ এতো আকর্ষণীয়া লাগছে যে ভাবা যায় না। কালো চোখের গভীরতায় যেন মাস্কারার মোহময় রহস্য। সাত্যকি কথা বলবে কি, মুগ্ধ দৃষ্টিতে আহিরার চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। তারপর খেয়াল হতেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, আপনি উঠে দাঁড়ালেন কেন? বসুন—

আপনি আগে বসুন।

হ্যাঁ, বসতে তো হবেই। ট্রেন আসতে এখনও মিনিট পঁয়ত্রিশ বাকি। তার আগে আপনি আনেক্কাপল্লীর এই টিকিটটা রাখুন। সাত্যকি চমৎকার হেসে বললো, আর অনুগ্রহ করে এই টিকিটটারও দাম দেবার চেষ্টা করবেন না।

বিন্দুমাত্র সেই চেষ্টা করবো না।

ঠাট্টা করছেন না তো?

একদম না।

এটাই তো মনে হচ্ছে আপনি সেই ঠাট্টাই করছেন!

তা হলে আপনি আমার যাবতীয় টাকা-পয়সার এই সাইড ব্যাগটা আপনার কাছেই রেখে দিন। আহিরার হাসিতে ভালোবাসা, আকুলতা সব কিছুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সত্যি সত্যিই আহিরার ব্যাগটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে সাত্যকি সেটা নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে আরও খোলামেলা বললো, অনুগ্রহ করে আনেক্কাপল্লী স্টেশন আসার আগে এই ব্যাগ আর চাইবেন না।

বেশ চাইবো না। তবে পথে তো আমার কিছু …..

আহিরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সাত্যকি বলে উঠলো, ওসব আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু অনুগ্রহ করে শপথ নিন যে, ট্রেন থেকে নামার সময়েই ব্যাগটা নেবেন। তার আগে নয়।

এতো অনুগ্রহ করলে তো আমার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আহিরার খিলখিল হাসিতে ওর চোখ, মুখের যে অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে তাতে অবশ্যই বুকে কাঁপন ধরে।

ওকে দেখতে দেখতে সাত্যকির মধ্যে হঠাৎ একটা বিশ্বাস জন্মালো। এই আহিরা গোপাল মনোহর বালযোগী তার হৃদয় জিততেই এসেছে। তবে হাতে সময় আর বিশেষ নেই। সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য কিছু একটা বলতেই হবে যা স্থায়িত্বের সিঁড়িতে পা রাখার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেও মনে করা যেতে পারে। কিন্তু সেই কথাটা ঠিক এই মুহূর্তেই যেমন নয় তেমনই তাড়াহুড়ো করে কোনো ইমারত গড়া নয়। একটু ধৈর্য নিয়ে স্থিতিশীলতার মোড়কে সেই স্বপ্নকে জড়াতে সময়ের তো প্রয়োজন হবেই। সাত্যকি শুধু বললো, আপনার অস্তিত্ব বিপন্ন নয়, আপনি বাহারী, বিজেত্রী হয়ে উঠছেন।

লজ্জা পেয়ে আহিরা অনন্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো, কী যে বলেন না! ওর গলার স্বরে লুকিয়ে আছে মাতাল করা জাদু। অথচ আহিরা নিজেই জানে না, ওর ভেতরে কী আছে আর কী নেই। উল্টে লজ্জার শেষ প্রান্তে পৌঁছে আহিরার তখন নাজেহাল দশা।

সুমিঠ্‌ঠাগুরমের বাড়িতে কী হয়েছে না হয়েছে সে সব কোনো কিছুই মনে রাখতে চাইলো না সাত্যকি। আহিরার সঙ্গে নতুন করে এই দেখা হওয়ার প্রাপ্তিটুকুই অনেক বেশি। সেখানে ধুয়ে যাক পেছনের সব তিক্ততা। তা ছাড়া বড়োদের মধ্যে যা হয়েছে সেটাকে মেরামত করার একটা প্রচেষ্টা তো চলছেই, অহেতুক আহিরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকার মতো নির্বোধ সাত্যকি নয়। গোপাল মনোহর যখন তাকে একটানা বলে চলেছিলেন তখন মেয়েটা কী করবে? কী ওর বলার ছিল? সেই সময়ের অসহায়তাটুকু বোঝার জন্য বুদ্ধিমান বা বিজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। সাত্যকি জড়তাহীন গলায় বলে উঠলো, আগে আমাকে একটা কথা বলুন তো আপনার ওই আনেক্কাপল্লীতে পৌঁছাতে ট্রেনে কতোটা সময় লাগে?

ঠিকঠাক চললে সাড়ে চার ঘণ্টা। আহিরা সারা মুখে একটা হালকা হাসির আভা ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেন?

আপনার সঙ্গে থাকার আয়ু আর কতোক্ষণ সেটা আগে জেনে নিলাম।

কী লাভ তাতে?

দেখুন লাভ-লোকসান, রাগ-অনুরাগ, নৈকট্য-দূরত্বের সীমারেখা বা ভেদাভেদ নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি যা করতে চাই সেটা যেন নৈকষ্যের আবরণে আগাগোড়া মোড়া থাকে। আমি নিজে খাঁটি থেকে আমার পরিবেশটাকেও সজীব করে তুলতে চাই। সেই কাজটা করতে গিয়ে যদি আমার আয়ু ফুরিয়ে যায় ……

আমি আপনাকে আয়ু দেবো। আহিরার গলায় নির্ভরতার আশ্বাস।

আপনাকেই তো আমার আয়ুর দেবী বলে মনে হচ্ছে। সাত্যকি নিঃসঙ্কোচে কথাটা বলে আহিরার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।

ইতিমধ্যে সাত্যকি দুটো কফি নিয়েছে। কাগজের একটা কাপ আহিরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বেশ চিন্তিত মুখে বললো, এখন সওয়া এগারোটা বাজে। ট্রেন আসতে মিনিট কুড়ি বাকি। আমরা কি স্টেশনের উপাহার-গৃহে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেবো না কি ট্রেনে উঠে প্যান্ট্রিকারে……

এখন কী ভাত খাবো? ওসব ট্রেনেই হবে।

আপনি যা বলবেন—

মনে হচ্ছে আপনি যেন আমার সব কথা শুনেই চলবেন?

‘হচ্ছে’ বলে আবার একটা সন্দেহ রাখছেন কেন—আপনি যদি খুব একটা অন্যায্য কিছু না বলেন আপনার কথা শুনে চলতে আপত্তি কোথায়?

আমার সব কথা শুনবেন?

একবার বলেই দেখুন না!

আমার ওপর এতো আস্থা কেন?

এই কেন’র উত্তরটা আমার জানা থাকলেও ঠিক মতো বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা একেবারেই নেই। ওটার ফয়সালা পরে হবে।

অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আহিরা সরাসরি সাত্যকির চোখের দিকে তাকালো। কলকাতার ছেলেটাকে যেন চিনে নিতে চাইছে। এবং সেই চেনার মধ্যে কোনো ফাঁক-ফোকর রেখে আগামী দিনগুলো যাতে ভঙ্গুর হয়ে না ওঠে সেই আকাঙ্ক্ষাতেই ফিসফিস করে প্রায় নিরুচ্চার ভঙ্গিতে বলে উঠলো, পরে আর কখন?

আহিরার চোখে চোখে রেখে সাত্যকি হেসে ফেললো। একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বেশ গাঢ় গলায় বললো, আপনি কি মনে করেন, আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক ধুয়ে মুছে আমি কলকাতায় অগস্ত্যযাত্রা করছি? আমি তো আগামী মাসেই আবার সুমিঠ্‌ঠাগুরমে আসবো। আপনার বাবাকে আবারও বোঝাবো। আরও নত হবো। তাঁর ভেতরের শুখনো ক্ষতটা বুজিয়ে দেখুন না আমি কেমন মনোরম একটা উদ্যান বানাই! আর সেটা যদি দ্বিতীয়বারে না হয় তৃতীয়বারে, তৃতীয়বারে না হলে চতুর্থবার, চতুর্থবারে না হলে ……. আমি লাগাতার আমার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আপনার বাবা যদি দূর দূর করে তাড়িয়েও দেন আমি পড়ে থাকবো আপনাদের উঠোনের ওই তেঁতুলতলায়। উনি কতো বার তাড়াবেন? নিষ্ঠা এবং নৈতিকতা নিয়ে চলা গোপাল মনোহর বালযোগী একজন খাঁটি মানুষ। সেই কারণেই ওঁকে ভাঙতে এবং ভাসাতে সময় লাগছে। আর সেই কারণেই আমাকেও প্রতি মাসে এসে হাজিরা দিয়ে যেতে হবে শুধুমাত্র আমাদের আন্তরিকতা বোঝাতে। গোপাল মনোহর বালযোগী আমাদের চোখে কী—এটা বোঝাতে কলকাতা-সুমিঠ্‌ঠাগুরম করতেই হবে। আর সেটা করতে করতেই একদিন দেখবেন গোপাল মনোহর বালযোগী অন্য মানুষ হয়ে উঠছেন। তাঁর ক্রোধ, ক্ষোভ দূরে সরে যাচ্ছে—ফিরে আসছে ঔদার্য, নিবিড় ভালোবাসা, গভীর বন্ধুত্ব। আপনি দেখুন না, সুমিঠ্‌ঠাগুরমের তেঁতুলতলা আর যোধপুর পার্কের ব্যালকনিতে নিখিল মৈত্র ও গোপাল মনোহর বালযোগীর যুগলবন্দি আড্ডা যদি না বসাতে পারি তবে তো আর একটা স্বপ্নকেও মুছে ফেলতে হয়। আমি সেই লক্ষ্যেই আমার অশ্বমেধের ঘোড়া ছুড়িয়ে চলেছি।

সাত্যকির মায়া ভরা কথাগুলো শুনতে শুনতে আহিরা অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে শিরশিরিয়ে উঠলো। শুরু হলো তার ভেতরে ঝাউয়ের কাঁপন। ছেলেটা আবেগ ও বিশ্বাস নিয়ে কী অনায়াস ভঙ্গিতেই না একটানা বলে গেল। এতো দাপটে এবং এতোটা মাধুর্যে এর আগে আহিরা কখনও কাউকে কথা বলতে শুনেছে কী? সাত্যকির বোঝানোর ধরনে ও কথা বলার মুন্সিয়ানায় স্বপ্নের ঢেউগুলো বারবার তারই কাছে ফিরে আসছে। ওর চোখের সামনে তখন দুটো ঝিনুক। ঝিনুকের মধ্যে শুধু মুক্তো নয়—দুটো স্বপ্নের ছবিও রয়েছে। নিখিল মৈত্র ও গোপাল মনোহর বালযোগীর পারস্পরিক সৌহার্দের ছবিটা ছাড়াও আরও একটা ছবিতে রঙের মুকুল ধরতে শুরু করেছে।

.

ট্রেন আসার গুঞ্জন উঠতেই প্ল্যাটফর্মের চারপাশে ছোটাছুটি, ব্যস্ততা। মালবাহকদের হইচই, দৌড়ঝাঁপ শুয়ে হয়ে গেল। সাত্যকি নিজের এবং আহিরার ছোট স্যুটকেস দু’টো দু’হাতে তুলে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের অনেকটা গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই আহিরা করলো কী একটাও কথা না বলে পেছন থেকে ওর শার্টটাকেই টেনে ধরলো। দু’পা পিছিয়ে এসে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাত্যকি হেসে ফেললো। আহিরার উদ্বেগ তার মনকে বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে। সাত্যকি মৃদু হেসে শুধু বললো, ভয় নেই। এতো তাড়াতাড়ি আমি মরছি না।

সাবধান হতে দোষ কোথায়?

আগের মতোই হেসে সাত্যকি উত্তর দিল, সাবধানের গিঁট তো আমার সঙ্গেই বাধা রয়েছে।

একটা চব্বিশ বছরের ছেলে সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে এতো ভালো ভালো কথা কীভাবে বলতে পারে আহিরা সত্যিই ভেবে উঠতে পারে না। ও যেন প্রতিটা মুহূর্তে নিজেই নিজেকে অতিক্রম করে আরও এগিয়ে যেতে চায়। এই মানসিকতার নামই কি উত্তরণ? সাত্যকি তা হলে সারাক্ষণই উত্তরণের উন্মেষ ঘটিয়ে চলেছে।

ইতিমধ্যে হাওড়াগামী ট্রেনটা রাজামুন্দ্রি স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাত্যকিকে অনুসরণ করে আহিরা স্লিপার কোচের নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসতে না বসতেই ভাবনার একটা গুটিপোকা তার ভেতরে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ‘সম্মানের মোরগ ফুলটা’ তার প্রাপ্য মর্যাদা পেতেই আহিরা এখন অনেক বেশি উদার। সঙ্কোচ ও জড়তার বেড়া ভেঙে সে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেও প্রস্তুত।

সাত্যকি আবার দু’কাপ কফি নিয়েছে। একটা সাদা উর্দি পরা ছেলে এসেছিল দুপুরের খাবার অর্ডার নিতে। সাত্যকি তাকে বিরিয়ানি আর মুরগা মশল্লা আনার কথা বলেছে। আহিরা ইতস্তত করে একবার শুধু জানিয়েছে, এই দামটা অন্তত আমাকে দিতে দিন। আর কতো আমাকে …..

কফিতে চুমুক বসাতে বসাতে সাত্যকি স্বর্গীয় এক হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলো, আপনার টাকা কোথায়?

আপনার কাঁধে।

আমার কাঁধে তো আপনার দারুণ আস্থা দেখছি! সাত্যকি বেশ মজার সুরে বললো, তবে জেনে রাখুন, আমার কাঁধের ব্যাগটা আপনার হলেও আমার পকেটের ওপর আপনার আস্থাটা বেশি থাকলে আমি আরও খুশি হতাম।

প্রতিটি মেয়ের মনেই একটা করে আকাঙ্ক্ষার দ্বীপ রয়েছে। সেই দ্বীপে যে কেউ পা রাখতে পারে না। কাঁটাতারের বেড়ায় সেটা এমনই মোড়া যে হুটহাট কারও পক্ষেই সেখানে ঢোকা সম্ভব নয়। অথচ সেই নির্জন কুমারী দ্বীপের সতর্কতার সমস্ত বেড়া লোপাট করে সাত্যকি মৈত্র নামে তারই বয়সী ছেলেটা ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে ‘সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। এরপরে ওকে আগলাতে হলে ওরই কাছে প্রার্থনা জানাতে হবে। অবশ্য সাত্যকির যা মহিমা রক্ষাকর্তার ভূমিকায় ও নিজেই নিজেকে বারবার দেখতে চায়। কুমারী দ্বীপের দখল নেওয়ার পরেও এতোটা নিরাপত্তা কোন ছেলেটা দেবে?

আহিরা এ বারে একটু একটু করে ভেঙে পড়তে শুরু করলো। ভেঙে পড়া বলতে এতোক্ষণ যে কথাটা না জানিয়ে দিব্যি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল সেটা আর রক্ষা করতে পারলো না। সাত্যকি যা বোঝার বুঝুক। যা উপলব্ধি করার করুক। গোপাল মনোহরের সম্মানটুকু বাঁচিয়ে আহিরা ধীরে ধীরে বললো, আপনি হয়তো জানেন না ……

কোন ব্যাপারটা বলুন তো?

গতকাল দুপুরে ….. যেহেতু আপনাকে না খাইয়ে আমরা বিদায় দিয়েছিলাম সেটা আমাদের কারওরই ভালো লাগেনি। এই জায়গাতে আমরা অনুতপ্ত ছিলাম।

সেখানে আপনাদের দোষ কোথায়? চলে এসেছিলাম তো আমিই।

সে যাইহোক। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়াটা ….. আহিরা কুণ্ঠিত গলায় বললো, আমি অবশ্য আপনাকে ফিরিয়ে আনতে মানে দুপুরে খাওয়ার অনুরোধ জানাতে সেই বাস রাস্তা পর্যন্ত দৌড়েছিলাম। দেখলাম, আপনি যে বাসটায় উঠেছিলেন সেটা তখন স্টপেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি আপনার নাম ধরে ডাকলাম, অনেকটা ছুটলাম কিন্তু আপনি সে সব কিছু দেখতে পাননি, শুনতেও পেলেন না। খুব খারাপ লাগছিল তখন।

খারাপ লাগছে তো আমার! সাত্যকি আফসোসের সুরে বললো, আপনার সঙ্গে আপনাদের বাড়িতে ফিরতে পারলে হয়তো পুরো ব্যাপারটাই অন্য দিকে মোড় নিত। তবে আমি এ নিয়ে মাথায় অহেতুক বোঝা চাপাতে চাই না। কেন না আমার পরিকল্পনা আমি আপনাকে আগেই জানিয়েছি, প্রতি মাসে সুমিঠ্‌ঠাগুরমে এসে আমি ওই অভিমানী মানুষটার মান ভাঙাবার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমার যেটা লাগছে তা হলো, আপনি সেই বাস রাস্তা পর্যন্ত …..

আহিরা ক্ষীণ হেসে বললো, পরিস্থিতির চাপে পড়ে যেতে হয়েছিল। ছাড়ুন— আপনি যেটা ছাড়তে বলছেন আমার কাছে তো সেটাই দেবী আবাহনের মন্ত্রচ্চারণ! আপনার ওই কষ্টের মূল্য বলুন আর মর্যাদাই বলুন, আমি একদিন ঠিক দেবো।

কফির শূন্য গেলাসটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে আহিরা অস্ফুট গলায় কিশোরীর কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে?

সেটা তো এখন বলা যাবে না। সাত্যকির হাসিতে আন্তরিকতার সঙ্গে অদ্ভুত এক উষ্ণতারও ছোঁয়া। তবে সে গভীর গলায় পরে আবারও বললো, আমার কাজগুলো আগে আমাকে করতে দিন।

কাজগুলো? তার মানে অনেক কাজ–

কাজগুলোই। প্রচণ্ড এক জেদের উত্তাপ ছড়িয়ে সাত্যকি বলে উঠলো, প্রথম কাজ, গোপাল মনোহর বালযোগীর যন্ত্রণার ছবিটাকেই তাঁর মন থেকে সরিয়ে ফেলা। দ্বিতীয় কাজ, তাঁকে বোঝানো যে তাঁর চেয়েও বেশি যন্ত্রণা নিয়ে আরও একটা লোক হতাশায় তলিয়ে যাচ্ছেন। তৃতীয় কাজ, গোপাল মনোহর বালযোগীর ভেতরের যাবতীয় ক্ষোভকে ধীরে ধীরে প্রশমিত করা। চতুর্থ কাজ, ওই মানুষটার কাছে নিঃশর্ত প্রার্থনা জানানো—কেউ যদি একটা ভুল করেই বসে, আপনি কি আপনার সম্মানের জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই লোকটাকে ক্ষমা করতে পারেন না? এবং পঞ্চম ও শেষ কথাটা হলো, গোপাল মনোহর বালযোগীকে বিনয়ের সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া, নেপথ্যের সেই কারণটা কেন আপনিও বলতে পারছেন না? এর অর্থ একটাই— আপনার হৃদয়ে নিখিল মৈত্রর স্থান আছে, থাকবেও। কারণ মানুষই ভুল করে, মানুষই অপরকে ক্ষমা করতে শেখায়।

আহিরা নিজে একজন অধ্যাপিকা হলেও চারপাশের অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন, ছেঁদো এবং অসাড়, অর্থহীন, জোড়াতালি দেওয়া কথাবার্তা শুনতে শুনতে সে ক্লান্ত। সেই জায়গায় সাত্যকি সত্যিই বসন্তের দূত। কথার বসন্ত। ওর বাচনভঙ্গিতে ভেতরের অনেক না বলা কথাও যে ভাবে বেরিয়ে এসে সমস্ত মনকেই নাড়া দেয় তাতে সাত্যকিকে অনায়াসেই বাগ্‌বিদগ্ধ বলা যেতে পারে। ও আসলে বাগ্মী। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। আহিরা হঠাৎই মুষড়ে পড়লো। ওর মনের আকাশটা ঢেকে গেল কালো মেঘে। দৃষ্টিতে পর্যন্ত সেই বিষন্নতার ছায়া। আর সাত্যকির চোখে সেটা ধরা পড়বে না তাই কি কখনও হয়? সে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি কিছু ভাবছেন?

আমার ভাবনার আকাশটা অনেক বড়ো। আহিরা বেশ থেমে থেমে বলতে লাগলো, আর আমি কখনওই আগে ভালো কিছু দেখার সাহস পাই না। তা হলে ভীষণভাবে ভেঙে পড়তে হয়। সেটা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমি তাই প্রথমেই খারাপ দিকটা, খারাপ ছবিটা দেখার চেষ্টা করি। পরে বাজে কিছু হলে অতোটা কষ্ট পাওয়ার প্রশ্ন থাকে না।

অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন তো আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?

আপনার প্রচেষ্টাটুকু যদি ব্যর্থ হয়?

তার মানে?

যুগলবন্দি যে দৃশ্যটা আপনি আঁকতে চাইছেন সেটা যদি শেষ পর্যন্ত …..

দেখুন ভীরুতা, ব্যর্থতার কোনো স্থান নেই এখানে। ব্যর্থ মানুষকে কেউ মনেও রাখে না। হালকা হেসে সাত্যকি উত্তর দিল, একজন লেখক যদি বলেন তিনি গল্প লিখতে পারছেন না, একজন চিত্রকর যদি বলেন ছবি আঁকতে পারছেন না সে সব হলো উৎকর্ষতার প্রশ্ন। নিখুঁতে পৌঁছানোর জন্য খুঁতখুঁতে মনের নিবিড় অসন্তুষ্টির প্রকাশ। কিন্তু তার অর্থ তো এই নয় যে তাঁরা গল্প লিখতে পারেন না বা ছবি আঁকতে জানেন না। সাত্যকি আরও একটু উজ্জ্বল হেসে রীতিমতো ঘোষণার সুরে বললো, ওই কাজটা করার দায়িত্ব তো আমার—আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন। আর একটা কথাও মনে রাখবেন, দিশেহারা লক্ষ্য নিয়ে চলার মতো অতটা আত্মপ্রত্যয়হীন আমি নই। কথাটা শুধু মনে রাখবেন না, বিশ্বাসও করবেন।

ট্রেনের রান্না বলে অবজ্ঞা করার কিছু নেই। বস্তুত বিরিয়ানি ও মুরগা মশাল্লাটা বেশ ভালোই হয়েছে। সাত্যকি তো চেটেপুটে খেলো। অথচ এখানে আসার সময় কলাপাতায় মোড়া টক দই-ভাত মাখা কী যে একটা খেয়েছিল তা আর বলার নয়। তখন কেন বিরিয়ানি খায়নি সাত্যকি? একটা পার্থক্য অবশ্য বোঝা যাচ্ছে। সেদিন আসার সময় তার পাশে সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য নিয়ে আহিরা বালযোগী নামে কোনো অধ্যাপিকা ছিল না যাকে দেখে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়ার জন্য মনের প্রসারতাই বেড়ে যায়। এই অনুভূতিকে কী বলে সাত্যকি জানে না। এটুকু বোঝা যায় সে যথেষ্ট তৃপ্তি পাচ্ছে। গতকাল দুপুরে এক সঙ্গে না খাওয়ার হাহাকারটা কি একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে? যাচ্ছে আবার যাচ্ছেও না। গতকালের ব্যাপারটা ছিল গর্বিত হওয়ার। আজকেরটা সৌজন্যতার।

এক্সপ্রেস ট্রেনটার গতি কমে আসছে। যাত্রীদের মধ্যে নড়াচড়ার ব্যস্ততা। সম্ভবত সামনেই কোনো স্টেশন হবে। সাত্যকি একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিলো। তার আগেই দেখলো আহিরা ওর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঠিকঠাক শাড়িটাকে অভ্যাসবশত নতুনভাবে একটু টানাটানি করে গুছিয়ে নিল।

সাত্যকি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনি উঠে পড়লেন যে—

নামতে হবে না? আহিরা একরাশ মায়া ছড়িয়ে হাসলো।

নামতে হবে মানে? জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে সাত্যকি আবার আহিরার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, আনেক্কাপল্লী কি এসে গেল না কি?

হ্যাঁ।

এরি মধ্যে? আপনি যে বললেন সাড়ে চার ঘণ্টা লাগবে, সেই সময়টা কি ট্রেনে চড়েই পালালো?

বেশ বলেছেন। সময়টা ট্রেনে চড়েই পালালো।

এতো তাড়াতাড়ি সাড়ে চার ঘণ্টা সময় শেষ হতে আমি আমার জীবনে এর আগে দেখিনি। কী সব ভৌতিক ব্যাপার শুরু হলো বলুন তো? আমি তো কিছু বুঝে উঠতেই পারছি না। সাত্যকি হঠাৎ করে নিজের বাঁ হাতের ঘড়িতে চোখ রেখে স্তিমিত সুরে বলে উঠলো, তাই তো…. যাই বলুন, টাকার মতো আজকাল সময়েরও কোনো দাম নেই।

আহিরা লক্ষ্য করলো, এতো হাসি-খুশি এবং বাক্‌পটু ছেলেটা নিমেষে সব কথা হারিয়ে কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ওর সারা মুখটাকেই অসম্ভব ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। কথা বলবে কী, অসহায় এক দৃষ্টি নিয়ে সাত্যকি তারই দিকে চেয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় আহিরা নিজেই বা কী বলতে পারে? হতাশা কাটাতে ওর মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে একবার সান্ত্বনা জানাবে? আহিরা এর আগে কখনও কোনো ছেলেকে স্পর্শ করেনি। স্বভাবতই ওর ভেতরে প্রচণ্ড এক লজ্জা কাজ করে চলছে। আহিরার ইচ্ছে থাকলেও তেমনটা করতে পারলো না। সঙ্কোচ, আড়ষ্টতা তাকে অন্য জগতে পৌঁছে দিয়েছিল। যদিও রাজামুন্দ্রি স্টেশনে পেছন থেকে সাত্যকির শার্টটা একবার টেনে ধরেছিল—কিন্তু ওটা কী কোনো স্পৰ্শ?

ইতিমধ্যে ট্রেনটা আনেক্কাপল্লী জংশনে থেমেছে। মিনিট পাঁচেক দাঁড়াবে। আহিরার সঙ্গে সঙ্গে সাত্যকিও প্ল্যাটফর্মে নেমে কাঁধে ঝোলানো টাকার ব্যাগটা ফেরত দিয়ে সামান্য একটু হাসবার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই ভাবে হাসতেও পারলো না। সাত্যকির অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে ও সম্ভবত ওর সর্বস্ব হারাতে চলেছে। অথবা আগেই হারিয়ে বসে আছে। সময়ের টানাটানিতে ধ্বংসস্তূপের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় সে সেই কথাটা জানাতে চাইলো, আপনি আগামী মাসের কতো তারিখে সুমিঠ্‌ঠাগুরমে ফিরবেন?

আঠাশ তারিখ।

থাকবেন কতো দিন?

তিনটে দিন বাড়িতে থাকবো।

কী যেন একটা ভাবতে ভাবতে সাত্যকি বললো, আমি আঠাশ অথবা উনত্রিশ তারিখে পৌঁছে যাবো। আপনি কিন্তু

আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।

বাড়িতে আগে থেকে কিছু জানাবেন না।

জানাবো না। মুখ নিচু করে আহিরা সম্ভবত নিজের সঙ্গেই একটা হিসাব-নিকাশ নিয়ে মাতলেও গার্ডের বাঁশির শব্দ তার কানে গেছে। সে চোখ তুলে সাত্যকির মুখের দিকে কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকালো। ছোট্ট গলায় বললো, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। উঠে পড়ুন।

ট্রেনের দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সাত্যকি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আহিরাকে দেখতে দেখতে যথেষ্ট আবেগের সঙ্গে বললো, আমার বাবার জন্য তো আমাকে অনেক কিছু করতেই হবে, অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে—আপনাকে একটাই অনুরোধ, নিখিল মৈত্র ওই একটা ভুল ছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের একটা ছেলেকে যে ভাবে বুকে টেনে নিয়েছে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নিজেদের বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়িরই ছেলের মর্যাদা দিয়েছে, এক থালায় ভাত খেয়েছে, এক খাটে দু’জনে শুয়ে আগামী দিনের কথা ভেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে এ সবই কি মিথ্যে? এতোগুলো সত্যি মিথ্যে হয়ে গেল আর একটা ভ্রান্তিই সত্যি হলো? এটাই আপনি আপনার বাবার সঙ্গে নরম সুরে একটু আলোচনা করবেন। শুধুই আলোচনা, প্রস্তাব রাখা। গোপাল মনোহর বালযোগীর ভেতরের নিভু নিভু প্রদীপটাকে উসকে দিয়ে আমার ফিরে আসার ভিতটাকে আপনিও পারেন ….. আহিরা আপনিও পারেন ….. ট্রেনটা আনেক্কাপল্লী জংশন ছেড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরে চলেও গেছে। দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে সাত্যকি অনেকটা ঝুঁকেও আহিরাকে দেখতে লাগলো। আর আহিরা? বেশ কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসা চোখ নিয়েও সে হাত নাড়িয়ে ইশারায় সমানে বলে চলেছে, ভেতরে ঢুকে পড়ুন। অতোটা ঝুঁকবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *