১৩
গোপাল মনোহর দাবা খেলতে চলে যাওয়ার পর হঠাৎই আহিরার মনে হলো, আজ বিকেলে তো তার সামা মেলায় যাবার কথা ছিল। বল্লরী, নাগমা ওরা নিশ্চয়ই পুন্নিতাদের বাড়িতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। আর এখন তো প্রায় ওদের ফিরে আসারই সময় হয়ে গেল। মেলায় যাবার ব্যাপারটা একেবারেই মনে ছিল না। আর থাকবেই বা কি করে? ওই সময়ের মধ্যে মনের ওপর একটা চাপ, ধকল তো কম হলো না। সে সব সামলে স্থির হওয়ার জন্য যে দৃঢ় মানসিকতার দরকার আহিরার তা ছিল না। সবচেয়ে যেটা খারাপ লাগছে তা হলো বাস রাস্তা পর্যন্ত সাত্যকিকে ডাকতে গিয়ে। ছেলেটা বাসে উঠে চলে তো গেলই, এমনকী জানতেও পারলো না তাকে ফিরিয়ে আনতে সে কীভাবে পড়িমরি করে দৌড়েছিল! যতোটা জোরে সম্ভব গলা ছেড়ে নাম ধরে ডেকেওছিল। ভনিতা করে লাভ নেই—এতো আবেগ এবং উষ্ণতা দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত হলোটা কী? সেই তো শূন্যতা। জেগে থাকা অন্ধকারে নিজেকে জড়িয়ে রাখা। এই অবস্থায় বান্ধবীদের সঙ্গে সামা মেলায় যাওয়া যায়?
সন্ধ্যে পার হয়ে যাওয়া আলো-আঁধারির প্রকৃতি তখন সমস্ত অঙ্গে শেষ আবিরটুকু মাখতে ব্যস্ত। আহিরা ওর দু’হাতের চুড়িতে চোখ রাখলো। কেমন যেন এক সবুজ মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আহিরার মনটা চলে গেল ভারতের পূর্ব প্রান্তে, কলকাতায়। কিন্তু যোধপুর পার্ক? সেটা কলকাতার কোন দিকে? আহিরা জানে না। আহিরা ওর মনকেও এখন চিনতে পারছে না। ওর অনুভূতিগুলো একেক সময় হারিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে, আবার কীভাবে যেন ফিরে আসছে। জীবনের এই ছন্দ এবং ছন্দপতন নিয়েই এগোতে হবে। দুঃখ পুষে রেখে দম ধরে থাকার সময় কোথায়?
দাবা-টাবা খেলে রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে গোপাল মনোহর দেখলেন আহিরা ওর ঘরে বসে ছোট স্যুটকেসটায় কীসব গোছগাছ করছে। মন্দাকিনী যথারীতি রান্নাঘরে। সেখান থেকে খুন্তি, কড়াইয়ের নাড়ানাড়ির শব্দের সঙ্গে রান্নার একটা ঘ্রাণও ভেসে আসছে। গোপাল মনোহর ঘরের চৌকাঠের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে স্যুটকেস গোছাচ্ছিস যে?
আনেক্কাপল্লীতে যেতে হবে তো
ও! তোর কি ফিরে যাবার সময় হয়ে গেল?
হ্যাঁ বাবা
ও! আমি ভাবলাম তুই বুঝি আগে আগেই ফিরে যাচ্ছিস?
আগে কেন ফিরবো? সময় মতোই যাচ্ছি। তারপরেই আহিরা আরও নরম গলায় বললো, আসলে তুমিই তো তিন-চারদিন বাড়িতে ছিলে না বাবা—তাই মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি।
গোপাল মনোহর অনিঃশেষ এক স্নেহ নিয়ে মেয়ের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা যে ভাবে মোচড় দিয়ে উঠলো তাতে তিনি যদি বেশ খানিকটা কাঁদতে পারতেন বুকটা অন্তত হালকা হতো। কিন্তু সেই উপায় নেই। তাঁকে দমবন্ধ হয়েই থাকতে হবে। এবং সেটা আবার বুঝতে দেওয়াও চলবে না। দূর ছাই! এতো চাপাচাপি, এতো রাখঢাক করে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়? গোপাল মনোহর এক সময় বলেই ফেললেন, এইবারটা সব কিছুই যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল তাই না রে আহিরা?
কিচ্ছু গোলমাল হয়নি বাবা, কিচ্ছু না। আহিরা স্যুটকেসের গোছানো টোছানো বন্ধ রেখে গোপাল মনোহরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দুই ঠোঁটে আবছা এক হাসি ধরে রেখেও শাসনের সুরে বলে উঠলো, তুমি কি গন্ডগোল পাকানোর লোক? বরং যথেষ্ট সততার সঙ্গে যা বিশ্বাস করেছো সামনাসামনি বলে দিয়েছো। তোমাকে ভুল বোঝার অবকাশ কোথায়? এক বুক অভিমান নিয়ে বসে থাকা তুমি মানুষটা কেমন সেটা তো পরিষ্কার বোঝা গেছে। এরপরেও তুমি নিজেই নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে এমন একটা ভগ্নস্তূপের দিকে নিয়ে চলেছো যেখান থেকে নতুন করে কিছু নির্মাণ করতে হলে তোমাকে এখনই সামনের দিকে তাকাতে হবে বাবা—নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাকাও, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আহিরার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে গোপাল মনোহর ধীরে ধীরে জেগে উঠলেন। জমাট একটা কুয়াশা রোদের ঝলকানিতে উধাও হওয়ার পর তাঁর ভেতরটা এখন বেশ পরিষ্কার। গোপাল মনোহর অনেকটাই হালকা বোধ করতে লাগলেন। এবং ওই হালকা হওয়ার আনন্দে ছেলেমানুষের মতো একটা আব্দারও করে বসলেন। বললেন, আরও দুটো দিন থেকে তারপর তোর কলেজের চাকরিতে যাস।
তা হয় না বাবা।
কেন হবে না? তুই থাকলেই হয়।
এমনিতেই এ বার কয়েকটা দিন বেশি থেকেছি—আহিরা স্নিগ্ধ হেসে বললো, তা ছাড়া আমি তো প্রতি মাসেই বাড়িতে আসছি, এরপরেও বেশি কামাই করলে প্রিন্সিপাল পরিষ্কার বলে দেবেন, বাবার মেয়ে বাবার কাছেই থাকুক। কলেজে অনিয়মিতভাবে এসে ক্লাস নেওয়ার দরকার কী?
তা হলে আমি একটা কথা বলি?
বলো-
রাজামুন্দ্রিতে গিয়ে আমি তোকে এ বারে ট্রেনে তুলে নিয়ে আসবো।
এই কাজটা তুমি আগে কবে করেছো? কপট শাসনের ভঙ্গিতে চোখ পাকালো আহিরা। আর তোলাতুলিরই বা কি আছে? দশ-বারো ঘন্টা বাস জার্নি করে তোমাকে ওই এক মিনিটের কাজটা না করলেও চলবে।
তা হলে বড়ো রাস্তায় গিয়ে বাসে তুলে দিয়ে….
আচ্ছা বাবা, তুমি কি শুরু করলে বলো তো? আহিরা হেসে ফেললো।
কি আবার করলাম? মেয়ের ওপর মায়া থাকবে না?
মায়া-মমতা থাকবে তার বাড়াবাড়িটা নয়। বুঝলে কিছু? আহিরা গোপাল মনোহরের মুখের দিকে তাকিয়ে সমানে হাসতে লাগলো। সেই হাসিতে শ্রদ্ধা আর আস্থা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।