১১
সকালের কাঁচা সোনা রোদের উত্তাপ গায়ে মেখে আহিরা সারা উঠোন ঝাঁটা দিয়ে চমৎকারভাবে পরিষ্কার করে ফেললো। অবশ্য দুপুরের মধ্যেই আবার যে-কে-সেই অবস্থাতেই ফিরে যাবে। কেন-না চারপাশের গাছগাছালির শুকনো পাতা প্রায় সারাক্ষণই ঝুরঝুর করে পড়ে উঠোনটাকেই ভরিয়ে দিতে চায়। বাতাসের দোলা পেয়ে সেগুলো আবার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত সোহাগী চালে লুটোপুটি করে বেড়ায়। তবুও পরিষ্কার তো রাখতেই হয়। আহিরা এখানে থাকলে উঠোন ঝাঁট দেওয়াটা তার প্রতি দিন, প্রতি বেলার কাজ। ছাগল লীলা ও গরু লক্ষ্মীর দুধ দোয়ানো তো রয়েছেই। ওই দুটো কাজের জন্য আহিরার বোধহয় আলাদা একটা টান রয়েছে। তাই অন্যান্য কাজ করতে তার একটু গড়িমসি ভাব ফুটে উঠলেও সকালের ওই কাজে কোনোরকম আলস্য দেখা যায় না।
উঠোনটা এখন ঝকঝক করছে। তেঁতুলগাছের গোড়াটা মাটি দিয়ে সামান্য একটু উঁচু করে বাঁধানো। প্রয়োজনে সেখানে বসাও যেতে পারে। বাইরে রোদের যতোই ঝলকানি থাক না কেন, তেঁতুলগাছের নীচে সদাই ঘন ছায়া। আহিরা তার দৈনন্দিন কাজকর্মের কিছুটা সেরে ওখানেই বসে আছে। আসলে গোপাল মনোহর হাটে গিয়েছেন বাজার করতে। দু’হাতে দুটো, তিনটে থলে নিয়ে তিনি যখন বাড়ি ফিরবেন, আহিরা দেখা মাত্র বাবার কাছে ছুটে যাবে। বাবার কাছ থেকে থলেগুলো প্রায় কেড়ে নিয়ে সে নিজেই টেনে আনবে। বাবার কষ্টটুকু সামান্য একটু লাঘব করার চেয়েও তাঁর পাশে থেকে তাঁকে মমতা দিয়ে ঘিরে রেখে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোটাই আহিরার কাছে বড়ো কাজ।
লক্ষ্মীর বাচ্চার ডাকাডাকিতে আহিরা হঠাৎ চমকে উঠলো। আরে এখনও তো ওর দুধই দোয়ানো হয়নি। এমন একটা কাজ ভুলে গেল কেমন করে? আহিরা আর সময় নষ্ট না করে লক্ষ্মীর দুধ দুইতে বসে গেল। শূন্য বালতিতে দুধ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ উঠলো, চ্যা-চো, চ্যা-চো! এ যেন বর্ষার রিমঝিম। বেশ লাগে শুনতে। আহিরা ডুবে গেল নিজের কাজে।
কঞ্চি বেড়ার গেটের কাছে সাত্যকি তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। আসলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে তখন আহিরার গরুর দুধ দোয়ানো দেখছে। ‘একজন তরুণী অধ্যাপিকা গরুর দুধ দুইছে’ এমন ছবি বা দৃশ্য এর আগে সাত্যকি কখনও দেখেনি। তার জানাশোনা কাছের লোক, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মুখেও এমন গল্প শোনেনি। ফলে বৈপরীত্যের এমন করিশ্মা যে মেয়েটা দেখাচ্ছে সাত্যকি মুগ্ধ হয়ে তাকেই দেখতে লাগলো। তবে তার প্রথম লক্ষ্যটা ছিল আহিরার হাতে কাচের সবুজ চুড়িগুলো আছে তো? আহিরার ডান হাতটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। আড়ালে রয়েছে। তবে বাঁ হাতটা অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। এবং সাত্যকি নিশ্চিন্ত হলো, দুধ দোয়ানো অধ্যাপিকা মেয়েটির বাম অঙ্গ যেন সবুজ জলে ধুয়ে দেওয়া হয়েছে।
হঠাৎ সাত্যকি পকেটে হাত রাখতে গিয়ে অনুভব করলো, তার মানিব্যাগটা নেই। বুকে যেমন বড়ো সড়ো একটা ধাক্কা খেলো, মাথায়ও আকাশ ভেঙে পড়লো। প্রচুর টাকা সেই ব্যাগের ভেতরে রাখা। অতএব দুশ্চিন্তা তো হবেই। কিন্তু ব্যাগটা…. ব্যাগটা কোথায় হারাতে পারে? বাস থেকে নামার পরেও তার পকেটে ওটা ছিল। তারপর রাস্তার পাশেই একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দাম দিয়েছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সিগারেটটা ধরাবার সময় সাত্যকি মানিব্যাগটা ওর প্যান্টের পকেটে না রেখে দোকানের সামনের সারির কাচের বয়ামের ওপর রেখে কাজটা সেরেছিল। পরে ব্যাগটা পকেটে ঢোকাতেই ভুলে যায়।
সাত্যকি তখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। সে ওই কঞ্চি বেড়ার গেট থেকে আহিরাদের কিছু না জানিয়েই ঊর্দ্ধশ্বাসে প্রায় দৌড়তে লাগলো। মানিব্যাগটা কি এখনও ওই বয়ামের ওপরেই আছে? থাকা সম্ভব? এতো লোক দোকানে কেনাকাটা করতে যাচ্ছে, তারা কি সব তুলসীপাতা ছুঁয়ে বসে আছে? সাত্যকি পরের অধ্যায়টা নিয়েও একটু ভাবাভাবি করতে লাগলো। মানিব্যাগটা পাওয়া যাবে না এটা প্রায় নিশ্চিত। তারপরে সে কীভাবে টাকার জোগাড় করবে? দু’দিনের আলাপে একজনের কাছে হাত পাতা যায়?
হাঁপাতে হাঁপাতে সাত্যকি গিয়ে বড়ো রাস্তার সেই দোকানটায় গিয়ে উঠলো। তার প্রথম কথাটাই হলো, আমার মানিব্যাগটা দেখেছেন? এখানে রেখেছিলাম…. আটাত্তর বছরের বৃদ্ধ দোকানদার কুপুস্বামীর চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ঘোলাটে দৃষ্টি তুলে তিনি বলে উঠলেন, আমি আপনার ব্যাগট্যাগ কিছু দেখিনি।
অনেক অনেক টাকা ছিল সেই ব্যাগে। সাত্যকি যেন প্রার্থনা জানালো।
টাকা ছিল তো আমার কী? অনেক টাকা থাকলেই আমাকে আপনার ব্যাগ দেখতে হবে? আমি কি আপনার ব্যাগের ঠিকা নিয়েছি?
আপনি অহেতুক….সাত্যকি কাতর ভঙ্গিতে বলে উঠলো, আমি আপনাকে ওই অর্থে বলিনি। আপনার দোকান থেকে আমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিলাম…এই একটু আগেই….. সেটা মনে আছে তো?
আছে।
আমার মানিব্যাগটা আপনার এই বয়ামের ওপর রেখেছিলাম।
হতে পারে। আমি সে সব দেখিনি।
ওহ! সাত্যকি স্পষ্টতই হতাশ। এরপর আর ওই বুড়ো দোকানদারকে কোনো প্রশ্ন করা চলে না। সেটা আরও খারাপ। সে চূড়ান্ত বিষণ্নতায় ডুবে গিয়েও কুপুস্বামীর সঙ্গে সামান্য জেরা করার ভঙ্গিতে কথা বলার জন্য বারবার মাফ চেয়ে নিল। ক্ষমা- ঘেন্নার পর্ব শেষ হওয়ার পর সাত্যকি দোকান ছেড়ে যখন ঠিক চার পা এগিয়েছে, তখনই কুপুস্বামী পেছন থেকে ডাকলেন, এই যে যুবক মহাশয়, একবার শুনুন—
বলুন। সাত্যকি পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়ালো।
এই মানিব্যাগটা কী আপনার?
আরে এটাই তো আমার….সাত্যকির চোখে মুখে খুশির রেণু যেন লুটোপুটি খাচ্ছে। কৃতজ্ঞতায় বুজে আসছে গলা। তবুও সে কোনোরকমে শুধু বলেছে, আপনাকে কী বলে যে….
আটাত্তর বছরের কুপুস্বামী ঘোলাটে দৃষ্টি হেনেই ধমকে উঠলেন, একদম আমড়াগাছি করবেন না। এইটুকু পুঁচকে ছেলের এতো নেশাই বা হবে কেন? সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আপনার আর তর সইছিল না—সঙ্গে সঙ্গেই ধরাতে হবে। আর সেটা করতে গিয়ে আপনি কী করলেন না মানিব্যাগটাকেই যেমন তেমনভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখলেন। বলিহারি নেশা! সেই নেশায় বুঁদ হয়ে আসল জিনিসটাকে নিতেই ভুলে গেলেন
খুবই অন্যায় হয়ে গেছে। সাত্যকি যথেষ্ট লজ্জিত গলায় বললো।
সেটা বুঝেছেন? না কি বলতে হয় বলছেন?
না না, বুঝেই বলছি। লজ্জায় সাত্যকির মাথা ঝুঁকে পড়েছে। সেই অবস্থাতেই সে বললো, এবং আপনি যে শিক্ষাটা আমাকে দিলেন বুঝেছি সেটাও।
হ্যাঁ ওই ধাক্কাটা আপনার প্রাপ্য ছিল। কুপুস্বামী এ বারে সামান্য একটু হাসলেন। বললেন, প্রথমেই যদি ব্যাগটা ফেরত দিতাম তা হলে আপনার মনে কোনো দাগই কাটতো না। আশা করি এরপর থেকে নিজের দামি বস্তুটিকে আগলে রাখার মানসিকতা নিয়ে চলবেন।
.
উঠোনের তেঁতুল গাছের গোড়ায় আহিরা চুপচাপ বসে। সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সাত্যকি কঞ্চিবেড়ার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও ওকে সে দেখতেই পেল না। আসলে আহিরা গভীরভাবে কী যেন একটা ভাবছে। ভেবেই চলেছে। যার ফলে অন্য কোনো দিকেই তার খেয়াল নেই।
স্থির এবং শান্ত পায়ে সাত্যকি আহিরার অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাত চারেক দূর থেকেই সে আস্তে অথচ স্পষ্ট গলায় বললো, এই মুহূর্তে আপনাকে ঠিক অশোক বনে সীতার মতো লাগছে।
চমকে উঠে চোখ ফেরাতেই আহিরা দেখলো, মাত্র হাত কয়েক দূরেই সাত্যকি দাঁড়িয়ে নিশ্চুপে হাসছে। যাক, তা হলে কোনো বিপদ-আপদ হয়নি। অথচ সে সমস্ত রাত ধরেই এক উৎকণ্ঠা নিয়ে থেকেছে। না আসার সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়ে কতোই না চিন্তা করেছে। আর যাকে নিয়ে ভাবনা সেই সাত্যকি কি না হাসি মুখে কথার রামধনু এঁকে দিল, ‘এই মুহূর্তে আপনাকে ঠিক অশোক বনে সীতার মতো লাগছে।’
সীতার উপমাটা কেন দিলেন?
তা তো জানি না। সাত্যকি একটু উচ্ছ্বল হলো। যেন অনেক দিনের চেনা-জানা এমনই উষ্ণ সুরে উত্তর দিল, দেখুন, আপনি যদি এখন আমাকে কি এবং কেন ইত্যাদি প্রশ্ন করেন তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। আপনাকে চিন্তামগ্ন দেখে সীতার কথাটা মনে এলো বলে ফেললাম। সুতরাং যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে নিজের গুণে ক্ষমা করে নেবেন।
যার কোনো গুণ নেই সে কী করে ক্ষমা করবে?
ব্যাপারটা কী বলুন তো? সাত্যকি মজা করার মেজাজ নিয়ে বললো, কথায় আমাকে জব্দ করবেন এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই বসে আছেন না কি?
মোটেও তা নয়। আহিরা সাত্যকির চোখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বললো, গতকাল আপনার আসার কথা ছিল। এলেন না কেন?
আপনি চিন্তা করেছেন?
করবো না?
কেন? সাত্যকি আহিরার চোখের ওপর থেকে নিজের চোখ দুটোকে এক মুহূর্তের জন্যও সরালো না।
দেখুন, আপনি যদি এখন আমাকে কি এবং কেন ইত্যাদি প্রশ্ন করেন তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবো না—
আহিরা ওই পর্যন্ত বলতেই সাত্যকি হেসে ফেললো। বললো, আমার কথাই আমাকে ফেরত দিলেন?
আমরা দু’জনেই যে দুটো প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম—বাইরে তার চেহারাটা দু’রকমের হলেও অন্তর্নিহিত অর্থটুকু বোধহয় এক। চুড়ির রিনরিন শব্দের মতো হাসির কুলকুল শব্দ ছড়িয়ে আহিরা চাপা সুরে বললো, আর সেই কারণেই সঠিক উত্তরটা না দিয়ে নিজেদেরকে ফাঁকি দিয়েছি। সম্ভবত সূক্ষ্ম কোনো লজ্জা এড়াতে অহেতুকভাবেই কি এবং কেন ধরনের দেওয়াল তুলে আলাদা আলাদা পরিমন্ডল গড়ে তুললেও আসল ব্যাপারটা হলো দায়িত্ব এড়ানো। সুতরাং আপনার কথাটা যে আপনার কাছেই ফেরত যাবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আহিরা যখন ওর ওই ছোট্ট ভাষণটা দিচ্ছিলো সাত্যকি সত্যিই অবাক হয়ে শুনছিল। ভেতরের খড়ো চেহারাটাকে কী চমৎকার রং তুলির ব্যবহারে এক নির্জন দ্বীপের দুই বাসিন্দাকে এঁকে দিল যা সহজেই মনকে নিবিষ্ট করে রাখে। সাত্যকি এ বারে আর কোনো ঘুরপথে গেল না। সহজ কথাটা আরও সহজভাবে বললো, জানেন হঠাৎ দেখছি সারা শরীর কেঁপে জ্বরের উত্তাপ বেড়ে চলেছে। ওষুধপত্র খেয়ে সেই জ্বর কমলো বটে কিন্তু শরীর থেকে যেন ক্লান্তি অবসাদ আর কাটতেই চায় না। হঠাৎ যে কী হলো বুঝতেই পারলাম না। গতকাল তাই আসতে পারিনি। একটু থেমে গাঢ় গলায় সাত্যকি আরও বললো, আমি সারাক্ষণ শুয়ে শুয়ে একটা কথাই ভেবেছি, আপনি চিন্তা করবেন। একবার চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, পুরো দিনটা বিশ্রাম নেওয়াই ভালো।
এখন কেমন আছেন?
ভালো। ছোট্ট উত্তরটা দিয়েই সাত্যকি নিচু গলায় প্রশ্ন করলো, আপনার বাবা এসেছেন?
হ্যাঁ। আহিরার দুই ঠোঁটে আলগা হাসির রেখা। ভ্রু দুটো কপালে তুলে বললো, আজকে বাবার দেখা পাবেন। উনি হাটে গিয়েছেন। ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। আহিরার অভ্যর্থনায় কোনো ত্রুটি নেই। সে যথেষ্ট আবেগ নিয়ে আরও বললো, আপনি ভেতরে এসে বসুন।
উঠোন ছেড়ে দাওয়ার দিকে পা বাড়িয়েও সাত্যকি হঠাৎ থেমে পড়লো। বিশাল তেঁতুল গাছটা তখন বাতাসের সঙ্গে মাথা দোলানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেই পাতার দুলুনিতে হালকা একটা শনশন শব্দে যেন সঙ্গীতের মূর্ছনা। সাত্যকি আহিরার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, শুধু মাত্র তেঁতুল গাছটাকে উঠোনের মাঝখানে রেখে চারপাশে বেদী তৈরি করার মধ্যে কি কোনো মাহাত্ম্য আছে? গাছটাকে আপনারা যে ভাবে যত্নে রেখেছেন প্রথম দিন থেকেই আমার সে কথাই মনে হয়েছে।
আপনার অনুমান মিথ্যে নয়। আহিরা মৃদু হাসির পাপড়ি মেলে ধরে বললো, আমাদের এখানে ধনী-দরিদ্র, মধ্যবিত্ত-নিঃস্ব যার যেমন বাড়িই হোক না কেন, নিজেদের জমিতে একটা তেঁতুল গাছ থাকা বেশ আভিজাত্যের লক্ষণ।
অর্থাৎ তেঁতুল গাছটা এখানে মর্যাদার প্রতীক তাই তো?
হুঁ। ব্যাপারটা তাই-ই। এবং মঙ্গলেরও প্রতীক। আর….
আর কী?
না জানিয়ে কেউ যদি ছোট্ট একটা তেঁতুলও গাছ থেকে পাড়ে সেটাকে মোটেও ভালো চোখে দেখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ঝগড়া-ঝাঁটি পর্যন্ত হয়ে যায়।
এর পেছনে কারণটা কী?
কারণ বলতে কিছু সংস্কার কিছু…. আহিরা থেমে পড়লো। নাগমা ও বল্লরী- তার দুই বান্ধবী হাসির ঢেউ আর শরীরের দোলায় যেন ভাসতে ভাসতেই গেট পেরিয়ে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হলো। এবং যথারীতি আড়চোখে দুই যুবতী সাত্যকিকে দেখে নিয়ে আহিরাকে দু’পা টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো, ছেলেটা কে রে? দারুণ দেখতে তো!
বাল্যের বন্ধুদের এড়ানো যায় না। তাতে বিপদ আরও বাড়ে। আহিরা নিচু গলায় বললো, কলকাতা থেকে এসেছে। বাবার কাছে।
বাঙালি? নাগমা মুগ্ধকন্ঠে জানতে চাইলো।
হ্যাঁ।
তোদের বাড়িতে থাকবে? বল্লরীর অসীম আগ্রহ আগন্তুকের ব্যাপারে।
কোন দুঃখে? আহিরা হেসে ফেললো।
এই আহিরা—নাগমা চাপা হেসে জিজ্ঞেস করলো, তোরা দু’জনে তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে কী করছিলি রে?
প্রেম করছিলাম। আহিরা ওদের কৌতূহলের বেলুনে বাতাস না ভরে ধমকে উঠলো, যা শুনতে চেয়েছিলি শুনলি তো! এ বারে তাড়াতাড়ি বলে ফ্যাল এই আসাটা তোদের কী দরকারে?
কি রে তুই যেন আমাদের তাড়াতেই ব্যস্ত। খেদের সুরে বল্লরী বলে উঠলো, আমরা যে তোকে কতো ভালবাসি তা বুঝি জানিস না?
ওসব ভালোবাসা-বাসি পরে হবে। এখন আয়।
নাগমা ঠোট টিপে জিজ্ঞেস করলো, সাদ্মা মেলায় যাবি না?
এখন কী? সে তো বিকেলে।
সেটাই জানতে এলাম—
হ্যাঁ-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো। অনবদ্য ভঙ্গিতে হেসে উঠলো আহিরা।
বল্লরীর দুই চোখে দুষ্টুমির মেঘ তখনও খেলা করে বেড়াচ্ছে। সে ঠোঁট কামড়ে বললো, এই আহিরা ওই বাঙালি ছেলেটার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিবি না?
ও মা! আলাপ করিয়ে দেবো কি রে—ওর সঙ্গে আমারই তো তেমন আলাপ- পরিচয় নেই।
সাদ্মা মেলায় ওকেও নিয়ে চল না, গোদাবরী নদীর পাড়ে একবার বসলে আর চোঙ্গামালা অরণ্যে ঢুকলে আলাপ হতে কতক্ষণ?
আহিরা এ বারে সত্যি সত্যিই ধমকালো, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না। সাত্যকিকে একা ফেলে রেখে আমরা তিনজন যে ভাবে ফিসফিস করছি এটা ভালো দেখাচ্ছে না। খুবই দৃষ্টিকটু লাগছে। একজন বাইরের অতিথির সামনে এই উদাহরণ রাখাটা…
যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। আমরা ঠিক তিনটের সময় পুন্নিতাদের বাড়িতে থাকবো নাগমা আর বল্লরী এ বারে আর আড়চোখে নয়, সরাসরি সাত্যকিকে দেখে নিয়ে ফের আহিরার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে হাসতে লাগলো। আরও সত্যি কথাটা হলো ওরা যেন হাসির পালক ছড়াতে ছড়াতে কঞ্চিবেড়ার গেট পেরিয়ে চলে গেল।
বল্লরী, নাগমা ওরা সত্যি সত্যিই চলে গেল, নাকি আবার একটা অজুহাত নিয়ে ফিরে আসতে ব্যস্ত সেটার আঁচ পেতে আহিরা গেটের দিকে দু’পা এগিয়ে সোজা রাস্তার দিকে চোখ রাখতেই দেখতে পেল গোপাল মনোহর আসছেন। সাত্যকির উদ্দেশে ‘এক মিনিট দাঁড়ান’ বলেই সে প্রায় ছুটেই এগিয়ে গেল। গোপাল মনোহরের কাছ থেকে বাজারের থলেগুলো কেড়ে নিয়ে নিচু গলায় বললো, সাত্যকি মৈত্র নামের ছেলেটা এসে গেছে।
কখন এলো? গোপাল মনোহর যেন কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে হয় তাই করলেন। আসলে ওই প্রশ্নটাই অর্থহীন।
কিছুক্ষণ আগে।
.
গোপাল মনোহর সাত্যকির মুখোমুখি হয়েই বেশ কিছুটা চমকে গেলেন। নিখিলের সঙ্গে যে হুবহু মিল—তেমনটা না হলেও অমিলও খুব বেশি একটা নেই। যৌবনের নিখিলের চেহারার সঙ্গে এই ছেলেটির আশ্চর্য সাদৃশ্য রয়েছে। সাত্যকি নিখিলের ছেলে এটা দারুণভাবে বোঝা যাচ্ছে বলেই গোপাল মনোহর এক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
বয়স্ক মানুষটাকে দেখছিল সাত্যকিও। সে বুঝতে পারা সত্ত্বেও স্বাভাবিক নিয়মেই ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনিই গোপাল মনোহর বালযোগী?
হ্যাঁ।
আমার নাম সাত্যকি মৈত্র। কলকাতা থেকে এসেছি। কথাটা বলতে বলতে সাত্যকি গোপাল মনোহরের পায়ে হাত রেখে প্রণাম করলো।
গোপাল মনোহর খুশি যে হলেন না তা নয়। তবে তাঁর মুখের ভার ভার ভাবটা কাটলো না। মৃদু গলায় শুধু বললেন, থাক থাক আর প্রণাম করতে হবে না।
ইতিমধ্যে আহিরা রান্নাঘর থেকে এক গেলাস জল এনে গোপাল মনোহরের হাতে তুলে দিয়েছে। স্বামী এবং সাত্যকির জন্য চা নিয়ে বারান্দায় উপস্থিত মন্দাকিনীও। মূল ব্যাপারটা হলো, সাত্যকি জিজ্ঞাসাবাদ যাই করুক না কেন, তাদের এখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। আসলে মন্দাকিনী এবং আহিরা দু’জনেরই ওই এক চিন্তা তাদের প্রিয়, আপন প্রিয় মানুষটি এক সময় কলকাতায় চাকরি করেছেন—এই ব্যাপারটা কেমন যেন বিস্ময়ের মতো মনে হয়।
সাত্যকি গোপাল মনোহর বালযোগীর মুখের ওপর নিষ্কম্প দৃষ্টি মেলে ধরে বললো, আমার বাবার নাম নিখিল মৈত্র। তিনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
নিখিল মৈত্র! গোপাল মনোহর দীর্ঘ দিন রোগে ভোগা এক দুর্বল মানুষের কন্ঠস্বর যেন কিছুক্ষণের জন্য ধার চেয়ে নিলেন। খুব আস্তে আরও একবার উচ্চারণ করলেন, নি-খি-ল!
হ্যাঁ, নিখিল মৈত্র। আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
কিন্তু…. গোপাল মনোহর একটু অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁকে অনেকটা উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। তাঁর দুই চোখের দৃষ্টিতে ক্ষোভের ছায়া নেমে এসে কালবৈশাখীর আসন্ন প্রকাশ ঘটাতে পারে। তবে তিনি অতি মাত্রায় সজাগ থেকে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। কেন না তাঁর যাবতীয় বোঝাপড়া ওই নিখিল মৈত্র নামের লোকটার সঙ্গে হলেও এই নব্য যুবককে তিনি কী কথা শোনাতে পারেন? শুধু ‘ছেলে’ হওয়ার সুবাদে সাত্যকিকে কতোটুকু কথা শোনানো যেতে পারে? বাবার অপরাধ ছেলের মাথায় এইভাবে চাপানোটাও তো মানানসই নয়। ফলে সাত্যকিকে ছাড় দিতেই হয়। তা ছাড়া…. নিখিল মৈত্রর ব্যাপারটা নিয়ে এই আঠাশ-তিরিশ বছর পর কোনোরকম আলোচনাতেই তাঁর বিশেষ আগ্রহ নেই। যেটা অতীত তাকে নতুন করে টানাটানি, খোঁচাখুঁচির কী দরকার? এখন কে ক্ষমা চাইলো, কে হাতে- পায়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসালো এ সবে তাঁর কোনো হেলদোল নেই। কারণ তিনি যা হারিয়েছেন, এ জীবনে তা আর ফেরত পাবেন না। গোপাল মনোহর অত্যন্ত উদাসীন গলায় বললেন, যে নিখিল আমার বন্ধু ছিল সে তো মারা গেছে।
সাত্যকির মধ্যে এখনও শিশুর সরলতা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো এক নিষ্পাপ বালক বাস করে। গোপাল মনোহরের ‘মারা গেছে’ কথাটার তাৎপর্য সে বুঝেও বুঝতে পারলো না। সাত্যকি কিছু প্রমাণ করার তাগিদে বলে ফেললো, আপনি হয়তো ভুল করছেন। উনি মারা যাননি।
আমি কোনো ভুল করিনি। গোপাল মনোহর সম্ভবত পুরো ব্যাপারটাকেই অস্বীকার করার বাসনায় স্পষ্টই বলে উঠলেন, নিখিল মৈত্র মারাই গেছে। কথাটা বলার সময়ে আরও একমাত্রা তীব্রতা দেখালেও সাত্যকি ছেলেমানুষের মতোই অবুঝ হয়ে উঠলো। সে তার মানি-ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট সাইজের একটা ফটো বের করে গোপাল মনোহরের হাতে তুলে দিয়ে বললো, যে নিখিল মৈত্র আপনার বন্ধু ছিলেন তিনি বেঁচেই আছেন।
গোপাল মনোহর আশ্চর্য নির্লিপ্ত থেকে ছবিটা দেখতে লাগলেন। ছবিতে তিনজন রয়েছে। বিশেষ একজনকে দেখেও কিন্তু গোপাল মনোহরের এতোটুকু চাঞ্চল্য দেখা গেল না। ছবিটা হচ্ছে পুরো একটা ফ্যামিলির। মাঝখানে সাত্যকি। ওর ডানপাশে নিখিল এবং বাঁ পাশে বিজয়া। মন্ত্রমুগ্ধের পরিবর্তে গোপাল মনোহর যেন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে, আরও পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় ঘৃণার দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখেই ওটা সাত্যকির হাতে ফেরত দিয়ে দিলেন।
সাত্যকি ছবিটা আবার ওর মানিব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়ে কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করলো, এই বুঝি গোপাল মনোহর কিছু বলবেন। উনি কিন্তু একটা কথাও বললেন না। আসলে মানুষটা বোধহয় তার আসাতে বিশেষ একটা খুশি হননি। অবশ্য না হওয়াই তো স্বাভাবিক। সাত্যকি এ বারে নিজেই উদ্যোগ নিল কথার বাতাবরণে ওই গম্ভীর মানুষটাকে একটু সহজ করে তোলা যায় কি না। সাত্যকি সহজ সুরে বললো, বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন দিন কয়েক হলো। কিন্তু হঠাৎ করেই দারুণ বিষণ্ণ হয়ে পড়ে অবসাদে ভুগছেন। কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না।
ওসব কথা শুনে আমার কী লাভ?
আপনার বন্ধুর কথা শুনবেন না—সাত্যকি আবেগের সঙ্গে উচ্চারণ করলো, কলকাতায় এক সঙ্গে একই অফিসে চাকরি করেছেন, এক থালায় খেয়েছেন এক…..
বন্ধ করো। বন্ধ করো মন ভুলানো কথা। গোপাল মনোহর কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কর্কশ গলায় বললেন, আসল ব্যাপারটা কী বলো তো? নিখিল তোমাকে এতো বছর বাদে হঠাৎ আমার কাছে পাঠালো কেন?
সেটা বলতেই তো আপনার কাছে এসেছি।
তোমার ভূমিকা শোনার ধৈর্য আমার নেই, বক্তব্যটা তুলে ধরতে পারো।
সাত্যকি চমৎকার শান্ত মেজাজে এবং ঠান্ডা দৃষ্টিতে গোপাল মনোহরকে দেখে নিয়ে এক ফাঁকে আহিরার মুখের ওপর দিয়েও চোখ দুটোকে ঘুরিয়ে নিল। সামান্য একটু ইতস্তত করে সে আবার গোপাল মনোহরের চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো, বাবা আমার কাছে স্বীকার করেছেন, আপনার সঙ্গে তিনি দারুণ একটা অন্যায় করেছেন— যেটা করা অবশ্যই উচিত হয়নি। যে অন্যায়ের ক্ষমা নেই বলে তিনি বারবার নিজেকে অপরাধী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেও পারছেন না। এবং এখন তাঁর দিনরাত্রি কাটছে সেই দুর্বিষহ আফসোসের মধ্যে—যা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। তবুও….তবুও তিনি আপনার কাছে মার্জনা চাইতে আমাকে পাঠিয়েছেন। প্রয়োজন হলে বাবা নিজেও এখানে আসবেন। কিন্তু সবার আগে আপনার সম্মতিটা তো পাওয়া দরকার।
তুমি জানো, নিখিল আমার সঙ্গে কী করেছে? এতো সুদীর্ঘ বছর পরেও গোপাল মনোহর যেন রাগে, আক্রোশে, অপমানে বেদনায় ফুঁসছেন। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তিনি প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলেন, জানো সে সব?
জানি। সাত্যকি নিস্তেজ সুরে বললো, অফিসের টাকা চুরির মিথ্যে বদনাম দিয়ে বাবা আপনার নামে একটা সাজানো কেস তৈরি করেছিলেন। যার ফলে আপনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। ইচ্ছাকৃতভাবে এই কলঙ্কময় বোঝাটা আপনার মাথায় চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা আজ অনুশোচনায় দুঃখে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। মানসিক দিক দিয়ে বাবা এমনভাবে ভেঙে পড়েছেন যে আপনার কাছে ছুটে না এসে আমার আর অন্য কোনো পথ ছিল না।
আমাকে হত্যা করে এখন আমার স্মৃতিসৌধ বানাতে চাইছো?
আজ আপনি যতো কঠিন এবং কঠোর কথাই বলুন না কেন, চূড়ান্ত অপমান করে তাড়িয়ে দিলেও আপনার প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ থাকবে না। সাত্যকি অত্যন্ত সংযমের সঙ্গে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, আপনি যে সম্মান খোয়ানোর শিকার হয়েছেন তাতে আমাকে এবং আমার বাবাকে যা খুশি তাই বলতে পারেন। আপনার সেই ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু অনুতপ্ত হওয়ারও কি কোনো মূল্য নেই?
অনুতপ্ত! ব্যঙ্গের এক টুকরো হাসি গোপাল মনোহরের ঠোঁটে লেগে রইলো। বিদ্রূপের ছররা চালিয়ে তিনি পরিষ্কারই বলে উঠলেন, না, এই অনুশোচনার কোনো মানে হয় না। অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য কেউ যদি অনুতপ্ত হয় তার একটা মানে বোঝা যায়। কিন্তু বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম থেকেই কেউ যদি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা মাফিক একজনকে হত্যা করে, সম্মানের পাহাড়চূড়া থেকে একেবারে খাদে নামিয়ে আনে—সেই মানুষটা সহস্ৰ অনুনয়-বিনয় এবং হাজারোবার ক্ষমা চাইলেও তোমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন সে অপরাধের মাফ হয় না। নয়তো ‘অমার্জনীয়’ শব্দটার সৃষ্টি করার কোনো দরকার ছিল না। তুমি এখন কতোটুকু বুঝবে আমার সেই সময়ের মানসিক যন্ত্রণা? টাকা আত্মসাতের শিরোপা পরিয়ে নিখিল আমাকে ধুলোয় নামিয়ে দিয়েছে—সেই ব্যথার উপশম ছিল একমাত্র আত্মহত্যা করা। নিখিলের হাত তাতে আরও শক্ত হবে বলে আমি সেটাও করতে পারিনি। কী দুঃসহ অবস্থার মধ্যে আমার দিনগুলো কেটেছে সে তুমি….
আমি সবই বুঝতে পারছি।
না, কিছুই পারছো না। গোপাল মনোহর ঝাঁঝের সুরে বললেন, তোমার বাবা মানে ওই নিখিল মৈত্র তো তোমাকে অনেক কথাই বলেছে, বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমার সঙ্গে বেইমানি করেছে, চোর সাজিয়ে চাকরি থেকে তাড়িয়েছে, কিন্তু…. কিন্তু আসল কথাটা জানিয়েছে কী?
আসল কথা বলতে? সাত্যকির বিমূঢ় প্রশ্ন।
আমার প্রতি নিখিল একতরফা অন্যায় করেছে এটাই তোমাকে বলেছে। তাই তো?
হ্যাঁ।
কিন্তু এই ইচ্ছাকৃত অন্যায়টা সে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গেই করতে গেল কেন? এ প্রশ্নটা তোমার মনেও উঠছে না? এর উত্তরটাই বা তোমার বাবা কী দিয়েছে? বলেছে কিছু?
ওই প্রশ্নটা আমিই বাবাকে করেছিলাম। সাত্যকি নম্র সুরে ছোট্ট উত্তর দিল, জবাব পাইনি। বাবা শুধু জানালেন, ‘ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার অতোটা জানার দরকার নেই। ‘
জানাবার মুখ থাকলে তো জানাবে। একটা কাওয়ার্ড! গোপাল মনোহর রীতিমতো গর্জে উঠলেন।
সাত্যকির দৃষ্টিটা কঠিন হয়ে উঠলো। সত্যিই তো সে তার বাবার কাছে ওই প্রশ্নটাই রেখেছিল, এমন কী কারণ থাকতে পারে যে তুমি তোমার প্রিয় বন্ধু গোপাল মনোহর বালযোগীর বিরুদ্ধে ওই মিথ্যে অভিযোগ এনে তাকে দোষী সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে? কেন? কেন তোমাকে এই অমানবিক কাজটা করতে হলো? নিখিল মাথা নিচু করে নিয়েছিলেন। ছেলেকে সেই ‘কেন’-র উত্তর দিতে পারার ক্ষমতা এবং ইচ্ছে দুটোই তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। দায়সারা গোছের একটা কথা বলে তিনি মূলত ওই প্রসঙ্গটাকেই এড়াতে চাইলেন, “ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ সেই ব্যক্তিগত ব্যাপারটা যে কী— সাত্যকি অনেক কিছু ভাবাভাবি করেও সম্ভাব্য একটা যুক্তিও দাঁড় করাতে পারলো না। উন্নতির এস্কালেটরে চড়ার জন্য মসৃণ জমি তৈরি করা ছাড়া অন্য আর কী হতে পারে? বাবা তার কাছে লুকিয়েছেন কিন্তু গোপাল মনোহর কারণটা নিশ্চয়ই লুকোবেন না। ছেলের সামনে বলতে বাবার যতোটা বাধো বাধো লেগেছে তেমনটা অস্বস্তি হওয়ার কথা নয় গোপাল মনোহরের। আর সেই ঢাকা-চাপা দেওয়ার ব্যাপারটা নেই বলেই তো তিনি সরাসরি সেই রহস্যের উন্মোচনের দিকটা তুলে ধরতে চাইছেন। বয়সের তুলনায় সাত্যকিকে ওই সময় অনেক বেশি গম্ভীর অথচ অসহায় এক পথ-হারানো শিশুর মতো দেখাতে লাগলো। সে অনেক অজানা তথ্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে শক্ত করে, কেটে কেটে জিজ্ঞেস করলো, বাবার কাছে ওই ব্যবহারটা আপনি কেন পেলেন? অনুগ্রহ করে সেই কারণটা বলবেন কী?
এই উত্তরটা যখন তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে পাওনি তখন এটা তো বুঝতে পারছো যে কী পরিমাণ অপরাধবোধ নিখিলের ভেতরে কাজ করে চলেছে!
পারছি! সাত্যকি ছোট্ট শব্দটার সাহায্যে গোপাল মনোহরকে শান্ত করতে চাইলো। জানার আগ্রহ নিয়ে সে মোহাবিষ্টের মতো তাঁর চোখের দিকে এক সম্মোহন দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো।
সাত্যকির ওই গভীরভাবে তাকিয়ে থাকার মধ্যে গোপাল মনোহর কেমন যেন অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে লাগলেন। এই ছেলেটা নিখিলের সন্তান। তারচেয়েও বড়ো কথাটা হলো ও বিজয়ার সন্তান। আরও বিস্তৃতভাবে আপনত্বের সূক্ষ্ম টান যদি দেওয়া যায় সাত্যকি তারও সন্তান হতে পারতো। তা ছাড়া ছেলেটার মুখটা এতো নিষ্পাপ যে রূঢ়ভাবে কিছু একটা বলাও যাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হলো, নিখিল যে কারণটা ছেলের কাছে খুলে বলেনি, সেই কথাটাই তিনি সাত্যকিকে বলেন কীভাবে? রাগে- ক্ষোভে এবং নিখিলকে মাটিতে টেনে নামাতে তাঁর পক্ষে বলে দেওয়াটা এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। বরং সেটাই স্বাভাবিক। তবুও এক বিচক্ষণতা নিয়ে, তীক্ষ্মতা নিয়ে গোপাল মনোহর নিজেকে শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখলেন। এটা ঠিক যা হবার তা তো আঠাশ-তিরিশ বছর আগেই হয়ে গেছে। নিখিল তাঁর সঙ্গে অসদাচার করেছে, তাঁকে মানসিক দিক দিয়ে একেবারে পঙ্গু বানিয়ে ছেড়েছে। তা হলেও নিখিলকে তার ছেলের কাছে ছোট করে কী লাভ? নিখিল শত্রুতা করেছে তাঁর সঙ্গে। তাঁর জীবনকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। সেই জায়গায় নিখিল অবশ্যই দোষী। এবং তাকে ক্ষমা করার কোনো প্রশ্নই নেই। কিন্তু ছেলের কাছে তারও তো একটা সম্মান রয়েছে। বাবা হিসেবে নিখিল ছেলের কাছে নিচু হয়ে গেলে সম্পর্কের দেওয়ালগুলো খুবই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। নিখিল পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যাবে। ওকে এ ভাবে ‘উলঙ্গ’ করাটা ঠিক নয়। গোপাল মনোহর ধীর গলায় বললেন, নিখিলকে আমি কোনো দিনই ক্ষমা করতে পারবো না। তুমি ফিরে যেতে পারো।
সেটা তো অন্য প্রশ্ন। সাত্যকির কাটা কাটা কথা। কিন্তু আমাকে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের জাঁতাকলে রেখে দিলেন তাতে তো আমাকে সারা জীবন টালমাটাল হয়ে থাকতে হবে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কোন প্রেরণা এরপর থেকে পাবো বলতে পারেন?
ওটাই আমার আসল কথা। গোপাল মনোহর আরও একটু জোর দিয়ে বলে উঠলেন, অতীতকে নিয়ে আমি এই মুহূর্তে আর কোনো পোস্টমর্টেম করতে চাই না।
ওই কথাটার কী হলো?
কোন কথা আবার? গোপাল মনোহর সাত্যকির চোখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ঘামতে লাগলেন।
কী কারণের জন্য বাবা আপনাকে ওইভাবে অপদস্থ করেছিলেন?
ওটা আমার ব্যাপার। গোপাল মনোহর বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার সব কথাও কী তোমাকে জানাতে হবে? আমার একান্তই ব্যক্তিগত বলে কোনো কিছু থাকতে পারে না?
আমি অবশ্যই তেমনটা শুনতেও চাই না। সাত্যকি প্রচন্ড শান্ত থেকে উত্তর দিল, আমার জানার ব্যাপারটা শুধু….
সেটা তোমার না শোনাই ভালো।
কেন?
ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে অথবা গহনা পরা কথাবার্তা বলতে গোপাল মনোহর একেবারেই অভ্যস্ত নন। যেটা বিশ্বাস করেন সেটা সাফ সাফ বলতেই পছন্দ করেন। তাতে তাঁকে কে কী মনে করলো, তাঁর সম্পর্কে কী ভাবলো কিছু আসে যায় না। অতএব হেঁয়ালির ছায়া না মাড়িয়ে তিনি পরিষ্কারই বললেন, বাবাকে শ্রদ্ধা করার জন্য অবশিষ্ট কিছু রেখে দাও। তা ছাড়া নিখিল আমার কাছে খারাপ হতে পারে, আমার অভিজ্ঞতা তিক্ততম হতে পারে কিন্তু তোমার কাছে তো সে আদর্শ! বাবা এবং ছেলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ানোটা আমার কাজ নয়।
আপনার প্রতি শ্রদ্ধা আমার আরও বেড়ে গেল। কিন্তু….
এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই। গোপাল মনোহর একেবারে খোলামেলা বলে ফেললেন, কলকাতায় ফিরে গিয়ে তুমি নিখিলকে বলো—মাফ টাফ ক্ষমা টমার প্রশ্ন আর আসে না। তবে সে যে সত্যিই তার অপরাধের গুরুত্ব বুঝে অনুতপ্ত হয়েছে এটা আমার বাকি জীবনে অবশ্যই মনে থাকবে। এর বেশি আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়।
এর অর্থ আপনি এখনও ক্ষমা করলেন না—
না করিনি। সেটা সম্ভব নয়।
অনুগ্রহ করে বলবেন, কীসে ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে? একজন মানুষ প্রার্থনা জানিয়ে রীতিমতো আপনার করুণা ভিক্ষা করছেন। আপনাকে সম্মান জানাতে তার ছেলেকে পর্যন্ত আপনারই দুয়ারে পাঠিয়েছেন—এরপরেও কী আপনি দূতকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সেই মুমুর্ষু মানুষটাকেই বঞ্চিত করবেন? আপনি কী নতুন করে তাঁকে কোনো স্বপ্নই দেখাতে পারেন না?
পারি না।
হতাশায় ভেঙে না পড়ে সাত্যকি তখনও বলে চলেছে, আমি যদি আপনাকে কলকাতায় আমাদের যোধপুর পার্কের বাড়িতে….. ওই পর্যন্ত বলে সে ইচ্ছে করেই থেমে পড়লো। তার ভেতরে একটা সহজ হিসেব ছিল। তাদের আদি বাড়ি চেতলা পার্কে। যেখানে গোপাল মনোহর বহুবার গিয়েছেন। অন্তত বাবা সেই রকমই বলেছেন। এখন যোধপুর পার্কের কথায় গোপাল মনোহর পুরানো স্মৃতিতে আক্রান্ত হয়ে চেতলার বাড়ি সম্পর্কে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু বলে ওঠেন কি না সেটাই দেখার। বললে এটা অন্তত বোঝা যাবে তাঁর আগ্রহ এখনও মরেনি। অতএব চেষ্টা চালিয়ে ওপরের কঠিন আবরণটুকু একবার সরাতে পারলে মানুষটার ভেতরের মনটাকে অবশ্যই ছোঁয়া যাবে।
কিন্তু কোথায় কী? সাত্যকি স্পষ্টই অনুভব করলো, গোপাল মনোহরকে আর ঘাঁটাঘাটি করে কোনো লাভ নেই। বন্ধুর সম্পর্কে তিনি এখন এতোই নিরাসক্ত, নিস্পৃহ, উদাসীন এবং নির্জীব যে নতুন করে প্রীতির সেতু রচনা করা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। গোপাল মনোহর কিছুতেই ফেলে আসা অধ্যায়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইছেন না। তাঁর একমাত্র কাজ এখন সব কিছুকে ভুলে থাকা। সুতরাং অভিমানী মানুষটাকে বেশি বিরক্ত করলে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে। সাত্যকি এ বারে নীরবে আহিরাকে দেখতে লাগলো। আশা, সে যদি তার প্রভাব ফেলে গোপাল মনোহরকে দ্বিতীয় চিন্তা করতে পথ দেখায়। যদিও সেটা প্রায় অসম্ভব। কেন না আহিরা নিশ্চয়ই তার বাবার দুঃখের গভীরতার একটা সম্যক উপলব্ধি না করে মতামত চাপিয়ে দেবার মতো সাধারণ মেয়ে সে নয়। মন্দাকিনীও যথেষ্ট গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে চুপচাপ বসে আছেন।
সাত্যকি এ বারে ধীরে ধীরে গোপাল মনোহরের মুখের দিকে তাকালো। মানুষটা বিরক্ত হলেও তার কিছু করার নেই। কেন না নিখিল যাই করে থাকুন না কেন, ছেলে হিসেবে সাত্যকি তার বাবার গ্লানিটুকু মুছিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেই। ফলে তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে সব দিক বিবেচনা করেই প্রতিটা মুহূৰ্ত যুদ্ধ করে এগোতে হচ্ছে। সাত্যকি ফিরে গেল তার আগের কথায়। সে নতুন করে আবার বলতে শুরু করলো, যাবেন আপনি আমাদের যোধপুর পার্কের নতুন বাড়িতে—যেখানে দোতলার ব্যালকনিতে একটা আরাম কেদারায় আপনার বন্ধু নিখিল মৈত্র বোবা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছেন আপনারই পথ চেয়ে। সেই দৃষ্টিতে খুশির প্রদীপ জ্বালাবেন না?
আমার ভেতরে আলোর অবশিষ্ট বলে আর কিছুই নেই।
না থাকতেই পারে। তাতে কোনো ক্ষতি নেই। সাত্যকি এক অদ্ভুত মাধুৰ্যময় কণ্ঠে বলে উঠলো, আমি যদি আজকেই আপনাকে কলকাতায় উড়িয়ে নিয়ে যাই? আমিও তো আপনার একজন সন্তানের মতোই, আমাকেও ফিরিয়ে দেবেন?
গোপাল মনোহর বিড়বিড় করে কী যে বললেন ঠিক বোঝা গেল না।
ওই সময়ে সাত্যকি মানুষটার পায়ে হাত রেখে গভীর সুরে বললো, আমি আপনার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। অনুগ্রহ করে আর না বলবেন না।
আমার শেষ কথাটা কিন্তু আমি অনেক আগেই বলে দিয়েছি। তারপরেও তুমি এ ভাবে কেন কথা বলছো আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। গোপাল মনোহর নিজের পা দুটো টেনে নিলেন। তাঁকে যথেষ্ট অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে।
সাত্যকি মরিয়া হয়ে মেরামতের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে বললো, আমি যদি বাবাকেই এখানে নিয়ে আসি?
ওসবের কোনো দরকার নেই। গোপাল মনোহরের চাঁচাছোলা কথা।
ওই সময়ে সাত্যকি নতুন করে আর কোনো কথাই খুঁজে পেল না। বস্তুত তার অনুরোধ-উপরোধের যাবতীয় কথাই শেষ হয়ে গেছে। আর কী বলার আছে? মুহূর্তের সেই নীরবতায় অস্বস্তির কাঁটা। কতোক্ষণ এ ভাবে মুখ বুজে বসে থাকা যায়? প্রত্যেকেই যেন একই সঙ্গে সমস্ত কথা হারিয়ে ফেলেছেন। গোপাল মনোহর, মন্দাকিনী, আহিরাকে পাথরের মূর্তি ছাড়া অন্য কিছু মনেই হচ্ছে না। গোপাল মনোহর যেখানে তাঁর শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছেন— সেখানে নিঃশব্দের সেই শীতল স্রোতে কতোক্ষণ ভেসে থাকা যায়? সাত্যকি নম্র সুরে বললো, আমি তা হলে আসি?
আসতে পারো।
সাত্যকি উঠে দাঁড়িয়ে গোপাল মনোহর এবং মন্দাকিনীকে এক পলক দেখে নিল। তাকালো আহিরার ঘন পালকে ঘেরা উজ্জ্বল দুই কালো চোখের দিকে। না, সেখানে কোনো প্রশ্রয়ের ছায়া ছিল না। বাবাকে অমান্য করে সে অবশ্য কীই বা বলতে পারে? কতোটুকুই তার এক্তিয়ার? আহিরার সেই নিষ্কম্প দৃষ্টির সামনে সাত্যকি তখন সত্যিই এক অসহায় মানুষ। মেয়েটা যে যুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে তার বাবাকে শান্ত করবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আবার সাত্যকির পাশে দাঁড়িয়ে যে ওকে একটু সমর্থন করবে তেমন আভাসও নেই। তারচেয়েও বড়ো কথাটা হলো আহিরার চোখের তারায় কি আগুনের হলকা? তার মুখ থেকে সৌন্দর্য যেন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সাত্যকির বাবা তার বাবাকে অসম্মানের শেষ পেরেকটি মেরে যে ভাবে আলোর জগৎ থেকে অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে খুব সম্ভবত সে সেটাই ভাবছে। কিন্তু সাত্যকি তো নির্দোষ। এক্ষেত্রে তাকে আসামী বানিয়ে তার প্রতি কঠোরতা দেখানো কতোটা যুক্তিসঙ্গত? তবুও একটা রেশ তো থেকেই যায়। সাত্যকি যতোই নিরপরাধ এবং কোমল হৃদয়ের মানুষ হোক না কেন— সে ওই নিখিল মৈত্ররই ছেলে। সুতরাং তাকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখার ইচ্ছে থাকলেও সব সময়ে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কেউ যখন আর কোনো কিছু বলছেন না তখন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে কতোক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? গোপাল মনোহর যখন বলেই দিলেন ‘আসতে পারো’ তারপর আর কী কথা থাকতে পারে?
তিন নিশ্চল মূর্তির নির্বাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে সাত্যকি ধীর এবং অলস ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রথম ঘোর কাটলো মন্দাকিনীর। তিনি বিহ্বল দৃষ্টিতে গোপাল মনোহরের দিকে তাকালেন। অস্ফুট গলায় বললেন, এই ভর দুপুরে ছেলেটা না খেয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল। আসলে বলা ভালো আমরাই ওকে তাড়িয়ে দিলাম। এটা কী ঠিক হলো?
ওর বাবা কী আমার সঙ্গে ঠিক কাজ করেছিল? সহসা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন গোপাল মনোহর। প্রায় চিৎকার করেই বললেন, আমি তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। কাউকেই মুখ দেখাতে পারছি না। সেই দিনগুলোর কথা তোমরা এখন কতোটুকু অনুভব করবে? আমি চোর না হয়েও চোরের মতো চিরদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে এলাম। বিজয়ওয়াড়াতে ফিরে এসে নিজেদের বাড়িতেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। বড়দা, মেজদা সেই সময় আমার সঙ্গে তো রীতিমতো অসহযোগিতা শুরু করে দিলেন। নির্জন দ্বীপের এক বাসিন্দা হয়ে আমি দিন কাটাতে লাগলাম। বছর দুয়েক বাদে তুমি এলে। তারও দু’বছর পরে তোমার কোলে আহিরা এলো। কিন্তু তখনও আমাদের বাড়িতে আমাকেই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছিলো। বড়দা, মেজদার সঙ্গে সংঘাত এড়াতে ঘর-বাড়ির মায়া ছেড়ে বেশ কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থেকে অবশেষে এই সুমিঠ্ঠাগুরমে এসে স্থায়ী আশ্রয় করে নিলাম। সে সব কী তুমি ভুলে গেলে?
আমি কিছুই ভুলিনি। আশ্চর্য ঠাণ্ডা গলায় মন্দাকিনী বললেন, শুধু কারণটাই বুঝতে পারতাম না, তোমার দাদারা কেন তোমার সঙ্গে অমন নিষ্প্রাণ ব্যবহার করতেন? তবে তাঁরাও কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তোমার কলকাতার চাকরির উল্লেখ করেননি। আর তুমি তো ভুলেও কোনোদিন…….. কথাগুলো বলতে বলতে মন্দাকিনী থেমে পড়লেন। তারপরেই হঠাৎ একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠলেন, নিখিল মৈত্র কী কারণে তোমার বিরুদ্ধে ওই সাজানো অভিযোগটা আনলেন—সেটা যেমন তুমি কিছুতেই প্রকাশ না করার ধনুক ভাঙ্গা পণ নিয়ে বসে আছো, আমরাও ওটা শোনার জন্য বিশেষ আগ্রহী নই। এই তিরিশ বছর বাদে সেটা শুনেই বা কী করবো? আমাদের বর্তমান জীবনধারায় এই বিষয়টা এখন সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। তোমার বন্ধু না হয় তোমার সঙ্গে একটা বিরোধিতার রাস্তায় গিয়েছেন, আর তার ফল ভোগ করবে সাত্যকি? এটা কেমন কথা? ওই ছেলেটা কী দোষ করলো? বরং দুই বন্ধুর মধ্যে বন্ধুত্বের রুপোলি রেখার ঝিলিকটা আবার যাতে দেখা যায়, সাত্যকি তো সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কলকাতা থেকে সুমিঠ্ঠাগুরমে ছুটে এসে পাঁচ দিন ধরে এখানেই পড়ে আছে! ওর এই আন্তরিকতার ছবিটা তোমার চোখে একটুও পড়বে না? শান্তির দূতকে কী কেউ বধ করে? তুমি যা করলে সেটা ও-ছাড়া আর অন্য কিছুই নয়। কী করেনি ছেলেটা? কী করেনি—আগাগোড়া তোমাকে সম্মান দেখিয়ে চমৎকারভাবে অনুরোধ করেছে, বুঝিয়ে গেছে, সমস্ত তিক্ততা ভুলতে তোমাকেও কলকাতা নিয়ে যেতে চেয়েছে তোমারই পায়ে ধরে। আর কী, আর কী তুমি আশা করতে পারো একজন আধুনিক যুবকের কাছ থেকে? তোমার অটল মান ভাঙাতে সাত্যকি কী বাকি রেখেছে সেটা আমাকে একবার বলবে? আর কী করলে তুমি প্রসন্ন হতে? হ্যাঁ, ওর বাবা একটা মারাত্মক ভুল করেছেন, তোমার তাতে যথেষ্টই ক্ষতি হয়েছে। লোকটা তো সেই আত্মগ্লানিতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন বলেই না ছেলেকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন, এরপরেও আর কোনো কথা থাকতে পারে? শুধু এক তরফা রাগারাগি না করে, নিজের জেদাজেদিতে পড়ে না থেকে অন্য দিকগুলো নিয়েও একটু ভাবো। নিজের অপরাধ কবুল করে নিখিল মৈত্র তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে তোমাকে এই মুক্তির স্বীকৃতিটুকু তো না দিলেও পারতেন—এটা একবারও ভেবে দেখেছো? আঠাশ-তিরিশ বছর যে ভাবে কেটেছে বাকি জীবনটাও না হয় সে ভাবেই কাটতো। সেধে ক্ষমা চাইবার তাঁর কীসের প্রয়োজন? প্রয়োজনটা এই কারণেই নিখিল মৈত্র তোমাকে তাঁর মন থেকে সরাতে পারেননি। আজও তিনি তোমাকে সমান ভালোবাসেন! আর তাঁরই ছেলেটাকে তুমি অভুক্ত অবস্থায় ……..
মন্দাকিনীর একটানা কথার চাপে গোপাল মনোহর একটু বিব্রত হলেন। বুঝি বা একটু নরমও। আসলে তিনিও যে অবুঝের মতো বোধ-বুদ্ধি হারাচ্ছিলেন ঠিক তা নয়। মূল কথাটা হলো, নিখিলের এই ব্যাপারটা নিয়ে সামান্যতম আলোচনাতেও তাঁর বিন্দুমাত্র প্রবৃত্তি নেই। সাত্যকিকে ফিরিয়ে দিলেন ঠিক সেই কারণেই। নয়তো নিখিলের ছেলেটা যে নিরপরাধ সেটুকু সুস্থ চিন্তা কী তাঁর নেই? তবে হ্যাঁ, এটা একটা স্পর্শকাতর ঘটনাই বটে। দুপুরবেলা একটা ছেলেকে না খাইয়ে-দাইয়ে চলে যেতে বলাটা সত্যিই অন্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে ভদ্রতা সম্পর্কে সাত্যকি যদি সন্দিহান হয় অথবা বিরূপ ধারণা নিয়েই থাকে সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। তবে ত্রুটিটা যদি সঙ্গে সঙ্গে শোধরানো যায় তা হলে হয়তো অভিযোগটা বড়ো হয়ে দেখা দেয় না। গোপাল মনোহর ক্লান্ত গলায় বললেন, ওকে তা হলে ডেকে আনো।
ওই দায়িত্বটা কী আমাদের? মন্দাকিনী স্বামীর দিকে চেয়েই রইলেন।
আমার এখন নিজেরই অস্বস্তি লাগছে। গোপাল মনোহর নিস্তেজ সুরে বলতে লাগলেন, সাত্যকি হয়তো ভাবছে প্রতিশোধটা আমি ওর ওপর দিয়েই নিলাম। সেই কারণে ওর সঙ্গে সহজ হতে আমার দীর্ঘ সময় লাগবে। এই অবস্থায় ওকে ডাকতে যাওয়াটাও আমার পক্ষে আরও বেশি লজ্জার। আমি ওসব এই মুহূর্তে করতে পারবো না। দুপুরবেলা খাওয়ার প্রশ্নে ছেলেটাকে ডেকে আনার দায়িত্বটা আহিরা নিতে পারে। আমার আপত্তি নেই। গোপাল মনোহর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, যা ভালো বুঝিস কর।
না হয় আমি গেলাম। কিন্তু ……
আবার কীসের কিন্তু?
যদি ফিরে আসতে না চায়—
যে ভাবে অপমানিত হয়েছে শুধু খাওয়ার জন্য ভিখারির মতো ফিরে না আসতেও পারে—মন্দাকিনী সাফ সাফ বললেন, তেমন হলেও একবার অনুরোধ তো করিস। বলিস, মা ডেকেছে।
ছেলেটা নিশ্চয়ই অতোটা অভদ্র হবে না। গোপাল মনোহর দ্বিধার সঙ্গে কথাটা শেষ করেছেন কী করেননি, মন্দাকিনী স্পষ্টই বলে ফেললেন, যেহেতু অভদ্র হওয়াটা তোমারই একচেটিয়া সুতরাং অন্য কেউ……
ব্যাপারটা তা নয়। গোপাল মনোহর স্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বললেন, তুমি সব সময়েই আমার কথার দ্বিতীয় একটা মানে করবেই। কিন্তু নিজেদের মধ্যে এই মুহূর্তে আর বেশি বাতাবরণের কি দরকার আছে? তারপরেই গলা নামিয়ে শান্ত নির্দেশ দিলেন, তুই আর দেরি করিস না আহিরা। ছেলেটাকে তো গিয়ে ধরতে হবে।