গাড়লমুড়ির চর

গাড়লমুড়ির চর

হ্যাঁ, জায়গাটার নাম গাড়লমুড়ির চর। গাড়ল শব্দটা যদিও মার্জিত নয়, তবু জায়গাটার নাম ওই। হুগলি জেলার একান্তে এই স্থানে একসময় নাকি গালব মুনির আশ্রম ছিল। সেই গালব মুনির নাম থেকেই গালব মুড়ি এবং তারই অপভ্রংশ গাড়লমুড়ি। তা এই গাড়লমুড়ির চর বা শ্মশানের কুখ্যাতি নতুন নয়। রাতভিত ভুলেও কেউ যায় না ও-পথে। তবু একবার কী একটা কাজে বোধ হয় কিছু সওদা করতেই চোপার আবদুল হামিদকে জৌগ্রামে যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে ফিরতে রাত হয়ে গেল অনেক। সবাই বারণ করেছিল আবদুলকে, “এত রাতে গাড়লমুড়ির চর দিয়ে যেও না গো আবদুল মিয়া। তার চেয়ে রাতটা এখানে কাটিয়ে দাও। কাল বরং ভোর ভোর রওনা হবে। পথে লোকও পাবে অনেক।” তা আবদুলের ছিল কাজের তাড়া। বলল, “সে হয় না গো। যা আছে কপালে, এই রাতেই আমাকে যেতে হবে।” এই বলে আল্লার নাম স্মরণ করে রওনা হল আবদুল।

সওদার মাল গোরুর গাড়িতে বোঝাই করে ধীরগতিতে গাড়ি নিয়ে মেঠো পথে চোপার দিনে চলল আবদুল। বিশ্বস্ত গোরু। এ-পথে অনেকবার গেছে, এসেছে। আর পথও একটাই। কাজেই ভুল হওয়ার কিছু নেই।

আবদুল দিব্যি গোরুর গাড়িতে আধশোয়া হয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে চলল। আসমানের চাঁদ পূর্ণিমাপক্ষে জ্যোৎস্নায় হাসছে। চারদিকে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না ফিনফিন করছে যেন! মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।

হঠাৎ এক জায়গায় এসে গাড়ি আর নড়ে না।

আবদুল ওই অবস্থাতেই মুখে বিচিত্র শব্দ করল, “হুর্ হ্যাট হ্যাট। হিত্তা মারি কিটি হেঁই…।”

কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।

আবদুল এবার সজাগ হয়ে উঠে বসল। তারপর যা দেখল তাতেই তো চক্ষুস্থির! দেখল, কখন যেন গাড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে গাড়লমুড়ির চরে এসে পৌঁছে গেছে। ডান দিকে শ্মশান, শ্মশানের বিশাল বটগাছের একটা ডাল রাস্তার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। আর সেই ডাল ধরে কলরব করে দোল খাচ্ছে অসংখ্য শিশুর মেলা। তারা কেউ আবদুলের দিকে তাকিয়েও দেখছে না। হুটোপাটি ছুটোছুটি করে এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে যে, কোনওমতেই তাদের অতিক্রম করে গোরুর গাড়িকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না।

শ্মশানের যে প্রান্তে মৃত শিশুদের মাটিচাপা দেওয়া হয়, সেখান থেকে পিঁপড়ের সারির মতো শিশুর দল পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে। কেউ-বা খেলাধুলো করছে, আবার কেউ-বা ছুটে গিয়ে আবার সেই মাটির বুকে মিলিয়ে যাচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখে তো ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল আবদুলের। সে তখন গাড়িতে বসেই করজোড়ে আল্লার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে সেখানকার শ্মশানকালীকে ডাকতে লাগল, “মা! মা গো! আমি জেতে মোছলমাল। তুই হিঁদুর দেবী। তোর কাছে কি জেতের বিচার আছে?

আমিও তোর এক অধম সন্তান। তোর শিশুদের তুই সামাল দে। আমাকে রক্ষা কর মা।” আবদুল কতক্ষণ এইভাবে ডেকেছিল কে জানে? হঠাৎ এক সময় শুনতে পেল শ্মশানের ভেতর থেকে নারীকণ্ঠে কে যেন ডাকল ‘আয়।’ ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সেই শিশুর দল খেলা ফেলে ছুটে ঢুকল শ্মশানে। তারপর আধো-আলো আধো-অন্ধকারে মাটির বুকে মিলিয়ে গেল।

আবদুল দু’ হাত জোড় করে শ্মশানকালীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে আবার ফিরে চলল নিজের গ্রামে। এই অলৌকিক ঘটনার কথা সে কখনও ভুলবে না। আর ভুলবে না এখানকার শ্মশানকালীকে। তাই জাতে মুসলমান হয়েও এক ভর্তি অমাবস্যায় গাড়লমুড়ির শ্মশানকালীকে সে ডালা সাজিয়ে পুজো এনে দিয়েছিল। আর বৎসরান্তে ধান বেচার টাকায় বাঁধিয়ে দিয়েছিল মায়ের মন্দিরের চাতাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *