গাজীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ
“আর দিনকয়েক বাদে এস্থানে বড় শোভা হইবে–ক্রোশ ক্রোশ ব্যাপী গোলাপফুলের মাঠে ফুল ফুটিবে।” পদ্মফুলের মতো ভাসমান, রবিকিরণের মতো উজ্জ্বল দুটি চোখ, হাতে বিশাল একটি দণ্ড, শক্ত মুঠি, প্রশস্ত বক্ষদেশ, দৃঢ় দুটি চোয়াল, গৈরিকধারী দিব্য এক সন্ন্যাসী গাজীপুরের গোরাবাজারের পথ ধরে ধীর পদে হেঁটে চলেছেন। শীত এবার শেষ হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। সময় সময়ের নিয়মেই শতাধিক বর্ষের অতীতে সরে গেছে। তা যাক। ভক্তকে সময় বাঁধতে পারে না। স্মরণমাত্রেই স্মরণাতীতের আবির্ভাব।
অনুসরণ করি সেই একলা সিংহকে। সতীশবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলেছেন রায়বাহাদুর গগনচন্দ্র রায়ের বাড়ির দিকে। সম্মানিত, সাহেবধর্মী মানুষের এই পল্লীতে কে এই সন্ন্যাসী! তা আসেন অমন অনেকে। ১৮৯০-র ভারত। প্রাচীন যোগধর্মের ভূমিতে ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে পাশ্চাত্যের ভোগবাদের দারুমিশ্রিত জল ঢালা হচ্ছে। রাতবিরেতে দিশি ভেকের ডাকাডাকি। তবু এক সাধকের আকর্ষণে ভারতের সাধকরা এখানে আসেন। ঐ তো, শহরের দু- মাইল উত্তরে নদীতীরে তাঁর কুঠিয়া এবং গুহা। শরীরধারণের জন্য তিনি যা আহার করেন, তা অতি অদ্ভুত—এক মুঠো নিমপাতা অথবা গোটাকয়েক লঙ্কা। অর্থাৎ তিনি পবন আহারী। তাই তাঁর স্থানীয় নাম ‘পওহারী বাবা’।
সিংহবিক্রম এই রাজসন্ন্যাসী, কয়েক বছর পরেই যিনি হবেন বিশ্ববরেণ্য স্বামী বিবেকানন্দ, তিনি কেন তাঁর বাল্যবন্ধু সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আল ছেড়ে গগনচন্দ্রের বাংলোয় চলেছেন! ডাকবাক্সে একটি চিঠি ফেললেন। দূরে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার হাঁটা শুরু করলেন। ঐ চিঠির মধ্যেই আছে কারণ। কেন তিনি গাজীপুরে! চিঠিটি লিখছেন সেই ‘প্রাণাধিকেষু’কে, পরবর্তী কালে যাঁর সন্ন্যাসনাম হবে স্বামী অখণ্ডানন্দ। সন্ন্যাসী গুরুভ্রাতাকে লিখছেন নরেন্দ্রনাথ—”এখানে পওহারীজী নামক যে অদ্ভুত যোগী ও ভক্ত আছেন, এক্ষণে তাঁহারই কাছে রহিয়াছি। ইনি ঘরের বাহির হন না–দ্বারের আড়াল হইতে কথাবার্তা কহেন। ঘরের মধ্যে এক গর্ত আছে, তন্মধ্যে বাস করেন। শুনিতে পাই, ইনি মাস মাস সমাধিস্থ হইয়া থাকেন। ইঁহার তিতিক্ষা বড়ই অদ্ভুত। আমাদের বাঙলা ভক্তির দেশ ও জ্ঞানের দেশ, যোগের বার্তা একেবারে নাই বলিলেই হয়। যাহা কিছু আছে, তাহা কেবল বদখত দমটানা ইত্যাদি হঠযোগ—তা তো gymnastics (কসরত)। এইজন্য এই অদ্ভুত রাজযোগীর নিকট রহিয়াছি—ইনি কতক আশাও দিয়াছেন।”
চিঠিটি মনে হয় গত রাতে লিখেছেন, নির্জনে বসে। তখন বাতাসে উত্তর ভারতীয় শীতের কামড় না থাকলেও একটা শীত শীত ভাব ছিল। পরিব্রাজকের রিক্ততাই ভূষণ। পরিধানে একটি পুরোহাতা পশমের গেঞ্জি, গৈরিক উত্তরীয়। ছোট একটি টেবিল। মৃদু একটি আলো। সামনের জানালায় উত্তর ভারতের তারাভরা আকাশ। বহুদূরে কলকাতা, বরানগরের জীর্ণ মঠ, সিমুলিয়ার বাড়ি। এদিকে দক্ষিণেশ্বর, ওদিকে গুরুর প্রয়াণভূমি কাশীপুর উদ্যানবাটী। ত্যাগ। সমস্ত ত্যাগ। কলকাতার সমাজ, কলকাতার জীবন, যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা। কত মানুষের কত প্রকারের অন্বেষণ, এমন অন্বেষণ কার আছে—ধন নয়, অর্থ নয়, প্রতিপত্তি নয়, পদমর্যাদা নয়। ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত, অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী এক সুদর্শন যুবকের যে-পথে চলা উচিত, সে-পথ নরেন্দ্রনাথের নয়। তাঁর পথ সোজা নয়, খাড়া। তিনি উঠতে চান—আরোহণ। সেই মোহনায় উঠতে চান, যেখানে জীবাত্মা আর পরমাত্মায় মিলন হয়। এই গাজীপুর নরেন্দ্রনাথের সঙ্কল্পভূমি, রকেটের লাঞ্চিং-প্যাড। “বুদ্ধ ও কপিল কেবল বলেন—’জগতে দুঃখ, দুঃখ, পালাও, পালাও।’ সুখ কি একেবারেই নাই!” বুদ্ধ আর কপিল বলছেন, কেবলই দুঃখ, আবার ব্রাহ্মরা বলছেন, সব সুখ। দুটোর মধ্যে কোনটাতেই প্রকৃত জগদ্দর্শন নেই। নরেন্দ্রনাথ দুঃখকে ভয় পান না। সুখের ছলনায় বিভ্রান্ত হন না। “সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।” সত্য যা তা হলো— “সত্য তুমি মৃত্যুরূপা কালী।” মানুষ, ভীরু মানুষ “মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী।/প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিকবাস, বলে মা দানবজয়ী।।/মুখে বলে দেখিবে, তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে।/মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে।।”
গঙ্গাধর ভায়া! “কেহ যদি বলে যে সহিতে সহিতে অভ্যাস হইলে দুঃখকেই সুখ বোধ হইবে? শঙ্কর এদিক দিয়ে যান না, তিনি বলেন, ‘সন্নাপি, অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি’–আছে অথচ নেই, ভিন্ন অথচ অভিন্ন এই যে জগৎ, এর তথ্য আমি জানিব। দুঃখ আছে কি কী আছে, জুজুর ভয়ে আমি পালাই না। আমি জানিব, জানিতে গেলে যে অনন্ত দুঃখ তা তো প্রাণভরে গ্রহণ করিতেছি; আমি কি পশু যে ইন্দ্রিয়জনিত সুখ-দুঃখ, জরা-মরণ ভয় দেখাও?” গুরুদেব আমাকে দর্শন করিয়েছেন কৃপাসিন্ধু হয়ে। চৈতন্যে জরে আছে এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড। তিনি কণ্টকাকীর্ণ চলার পথকে সহজ করার জন্য পরিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানপাদুকা। “আমি জানিব—জানিবার জন্য জান দিব। এজগতে জানিবার কিছুই নাই, অতএব যদি এই relative-এর (মায়িক জগতের) পর কিছু থাকে—যাকে শ্ৰীবুদ্ধ ‘প্রজ্ঞাপারম্’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন—যদি থাকে, তাহাই চাই। তাহাতে দুঃখ আসে বা সুখ আসে I do not care (আমি গ্রাহ্য করি না)।”
জগতে থেকে, অনিত্য থেকে নিত্যের সন্ধান। সেই শক্তির সন্ধান, যা আর কয়েকদিন পরেই রাশি রাশি গোলাপ হয়ে ফুটবে এবং আবার ঝরবে। মৃত পত্র বৃক্ষে বৃক্ষে নবপত্রোদ্গম সম্ভব করবে। যে-শক্তির মধ্যে বিকাশ, ক্ষয় ও লয় গাণিতিক অভ্রান্তিতে নিহিত।
স্বামীজী যখন তন্ময় হয়ে লিখছেন, তখন যেন নিজের মনকে সামনের টেবিলের ওপর স্বতন্ত্রভাবে দেখতে পাচ্ছেন। গড়ে উঠছে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বসে আছেন, কিন্তু অনুভব করতে পারছেন কোমরের বাত গত দুমাস ধরে বড় ভোগাচ্ছে। দেহ থাকলেই ভোগাবে, মনে পড়ছে গুরুর শেষ কয়েক মাসের দেহকষ্ট। তিনি বলতেন—’হাড় মাসের খাঁচা’। প্রাণপাখির তাতে কি যায় আসে!
আর কয়েক ছত্রেই পত্র শেষ হবে। রাত এখন যথেষ্ট গভীর। লিখলেন : “আমার motto (মূলমন্ত্র) এই যে, যেখানে যাহা কিছু উত্তম পাই, তাহাই শিক্ষা করিব। ইহাতে বরানগরের অনেকে মনে করে যে, গুরুভক্তির লাঘব হইবে। আমি ঐকথা পাগল এবং গোঁড়ার কথা বলিয়া মনে করি। কারণ, সকল গুরুই এক এবং জগদ্গুরুর অংশ এবং আভাসস্বরূপ।”
কোথায় আছেন স্বামীজী কারোকে জানাতে চান না। একমাত্র গঙ্গাধরভাইকে জানানো যেতে পারে। “তুমি যদি গাজীপুরে আইস, গোরাবাজারের সতীশবাবু অথবা গগনবাবুর নিকট আসিলেই আমার সন্ধান পাইবে। অথবা পওহারী বাবা এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি যে, ইঁহার নামমাত্রেই সকলে বলিবে এবং তাঁহার আশ্রমে যাইয়া পরমহংসজীর খোঁজ করিলেই সকলে বলিয়া দিবে।” আবার সাবধান করছেন—”আমি গাজীপুরে আছি, একথা বরাহনগরে কাহাকেও লিখিও না।”
স্বামীজী চারপাশে তাকাতে তাকাতে ধীরে ধীরে হাঁটছেন। বড় প্রসন্ন সকাল। যেখানে এত গোলাপ, যেখানে তৈরি হয় বিখ্যাত গোলাপজল—সেখানকার শিক্ষিত মানুষদের চরিত্রে কেন সৌরভ নেই! বড়ই স্বধর্মবিমুখ। পাশ্চাত্য জড়বাদে প্রভাবিত। “এস্থানের সকলই ভাল, বাবুরা অতি ভদ্র, কিন্তু বড় westernized (পাশ্চাত্যভাবাপন্ন)। আর দুঃখের বিষয় যে, আমি western idea (পাশ্চাত্যভাব) মাত্রেরই উপর খড়্গহস্ত।… কি কাপুড়ে সভ্যতাই ফিরিঙ্গি আনিয়াছে। কি materialistic (জড়ভাবের) ধাঁধাই লাগাইয়াছে। বিশ্বনাথ এইসকল দুর্বল-হৃদয়কে রক্ষা করুন।… ভগবান শুকের জন্মভূমিতে আজি বৈরাগ্যকে লোকে পাগলামি ও পাপ মনে করে! অহো ভাগ্য!”
তবে “গগনচন্দ্র রায় নামক এক বাবু—আফিম অফিসের head (বড়বাবু), যৎপরোনাস্তি ভদ্র, পরোপকারী ও social (মিশুক)।” বাড়িতে নিয়মিত ধর্মসভা হয়। গগনবাবুই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পওহারী বাবার সঙ্গে। স্বামীজী গগনবাবুর উদ্যানশোভিত বাংলোয় প্রবেশ করলেন। গোলাপের সমারোহ। সাদা, লাল, ক্রিম। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণও উদ্যান ভালবাসতেন। দক্ষিণেশ্বরের উদ্যানে প্রাতে ফুলের সমারোহে দেবশিশুর মতো আনন্দে বিচরণ করতেন। এবছর তাঁর জন্মদিনে প্রচুর গোলাপ পাঠাতে হবে কলকাতায়। অদূরেই পওহারী বাবার আশ্রম। স্বামীজী এর আগেই একবার দেখেছেন—”অতি উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যান-সমন্বিত এবং চিমনিদ্বয়-শোভিত”, “ইংরেজদের বাংলোর মতো, … বড় বড় ঘর।” এই উদ্যানবাটীর কাছে গঙ্গার ধারে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গের ভিতর বাবাজী সমাধিস্থ হয়ে থাকেন। ভেতরে কারো প্রবেশাধিকার নেই।
ঠাকুরের যেমন হৃদয় ছিলেন, “এঁরও একজন ‘হৃদে’ আছে—সেও বাটীতে ঢুকিতে পায় না। তবে হৃদের মতো নহে।” বাংলোর ধাপে বসে গোলাপের শোভা দেখতে দেখতে স্বামীজী ভাবছেন, দিনের পর দিন যাচ্ছি, অপেক্ষা করে করে খানিক হিম খেয়ে ফিরে আসছি। কিছুতেই দেখা হচ্ছে না। কি করব! ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব! নরেন্দ্রনাথ তো পিছতে শেখেননি। তাঁর মন্ত্র তো onward, onward। অসম্ভব বলে তাঁর কাছে নেই কিছু। অতএব, ছোট্ট বাগানঘেরা এই সুন্দর বাংলোয় কিছুকাল বসবাস। বাবাজীর কুটির কাছেই। “বাবাজীর একজন দাদা ঐখানে সাধুদের সৎকারের জন্য থাকে, সেই স্থানেই ভিক্ষে করিব।” কিন্তু শরীর! বড় বিদ্রোহী। দুমাস হতে চলল কোমরের ব্যথা আর সারে না, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেট। কিসের শরীর! আত্মার আবার অসুখ কি!
স্বামীজী আবার উঠে পড়লেন। বাবাজীর কুটিরের দিকে চললেন। চলেছেন যেন সাক্ষাৎ শিব! সেই বহুকাঙ্ক্ষিত মিলন সম্ভব হলো। না, এই অভিজ্ঞতা তো জানাতে হবে সর্বাধিক বোধ্যা কোন প্রিয়জনকে! তিনি প্রমদাবাবু। “পূজ্যপাদেষু, … বহু ভাগ্যফলে বাবাজীর সাক্ষাৎ হয়েছে। ইনি অতি মহাপুরুষ… এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার অদ্ভুত নিদর্শন। আমি ইঁহার শরণাগত হইয়াছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়াছেন, সকলের ভাগ্যে ঘটে না।… ইঁহাদের লীলা না দেখিলে শাস্ত্রে বিশ্বাস পুরা হয় না।…” বলরামবাবুকে এই কথাটি অবশ্যই জানানো দরকার—”অতি আশ্চর্য মহাত্মা! বিনয় ভক্তি এবং যোগমূর্তি। আচারী বৈষ্ণব কিন্তু দ্বেষবুদ্ধিরহিত। মহাপ্রভুতে বড় ভক্তি। পরমহংস মহাশয়কে বলেন ‘এক অবতার থে’।… ইনি ২-৬ মাস একাধিক্রমে সমাধিস্থ থাকেন। বাঙলা পড়িতে পারেন। পরমহংস মশায়ের photograph রাখিয়াছেন। সাক্ষাৎ এখন হয় না। দ্বারের আড়াল থেকে কথা কহেন। এমন মিষ্ট কথা কখনো শুনি নাই।”
সেই সমাধি! পরমহংস মহাশয় চাবি কেড়ে রেখেছেন।
গগনবাবুর নির্জন বাংলো। গভীর রাত। শুয়ে আছেন স্বামীজী একটি ঘরে। চারপাশে গোলাপের বাগান। অদূরে গঙ্গা। পওহারী বাবার অলৌকিক সাধনক্ষেত্র অন্ধকারে থম মেরে আছে। রহস্যময় অদৃশ্য সেই সাধক গুহায় ধ্যানাসীন। স্বামীজী দীক্ষার দিন পেয়ে গেছেন। সেই বহুকাঙ্ক্ষিত যোগমার্গে এইবার নরেন্দ্রনাথের যাত্রা শুরু। অনন্তের কালহীন অসীমে সত্তার বিসর্জন
এই সুরে কোথাও একটা বেসুর আছে। একটা অস্বস্তি। কি সেটা! নিশ্চিন্ত আরামের প্রহরে দূরাগত সানাইয়ের বিষণ্ণ সুর। নিশ্ছিদ্র সেই অন্ধকারে হঠাৎ আলোর উদ্ভাস! ঘরের একপ্রান্তে একটি জ্যোতির্বলয়। স্বামীজী বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ সশরীরে উপস্থিত। উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে সেই অলৌকিক স্নেহ, নিষ্পলক দৃষ্টি, অশ্রু ছলছল, কোন কথা নেই, কোন তিরস্কার নেই, শুধু অপলকে তাকিয়ে।
নরেন্দ্রনাথ উঠে বসলেন নিঃশব্দে। সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত, ঘন ঘন কম্পিত। গলা শুষ্ক। কিছু বলতে চান, কিন্তু বাস্ফূর্তি হচ্ছে না। অবশেষে ঠাকুর অদৃশ্য হলেন। এইবার একা নরেন্দ্রনাথ আত্মসমীক্ষায়। মন আত্মগ্লানিতে পূর্ণ। বিশাল দুটি নয়নে অবিরল অশ্রুধারা।
পেছিয়ে দিলেন দীক্ষার দিন। “কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই…।” না, দীক্ষা আমাকে নিতেই হবে। আবার দিন ঠিক। আবার প্রভু শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যোতির্ময় আবির্ভাব। পর পর একুশ দিন।
“শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে,
নির্বাক আনন, ছলছল আঁখি,
চাহ মম মুখপানে।”
গোলাপ ফুটছে এবার। সব কুঁড়ি প্রস্ফুটিত। ক্রোশ ক্রোশ ব্যাপী বহুবর্ণের গোলাপ। গোলাপ আর গোলাপ। যেন শত শত শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেমসুরভিত মুখ জীবনের সমস্ত সাধন-সৌন্দর্য ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে।
“আর কোন মিঞার কাছে যাইব না।” আমার তিনিই সব। আমার জীবনের ধ্রুবতারা। “রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই।”
“দাস তোমা দোঁহাকার,
সশক্তিক নমি তব পদে।
আছ তুমি পিছে দাঁড়াইয়ে
তাই ফিরে দেখি তব হাসিমুখ।”
“দাস তব প্রস্তুত সতত সাধিতে তোমার কাজ।” “হে অপারদয়ানিধে, হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান!” বিদায় গাজীপুর। নরেন্দ্রনাথ চলেছেন। Roses—roses all the way. পওহারীজী দুটি তন্ত্র দিয়েছেন—”যন সাধন তন্ সিদ্ধি।” আর বলেছেন—”গুরুকে ঘরমে গৌকা মাফিক পড়া রহো।” গুরু- শ্রীরামকৃষ্ণ!