গাছপালার ভূমিকা

গাছপালার ভূমিকা

ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে মাথা বের করে সাপটা দেখে চারদিকের ঘন গাছপালায় সকালবেলার রোদ খেলা করছে। ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে গাঁদা ফুলের পাপড়ির মতো রোদের টুকরো এসে ছড়িয়ে পড়েছে বনভূমিতে। চারদিকে পোকামাকড় ডাকছে, কীটপতঙ্গ ডাকছে। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে মধুপোকা, প্রজাপতি আর দু-একটা ফড়িং। কাছে কোথাও কোন ঝোপের আড়ালে কিংবা কোন গাছের ডালে, পাতার আড়ালে বসে মিষ্টি সুরে ডাকছে একটা পাখি। মোলায়েম বাতাসটা আছে। গাছের পাতায় মৃদু কাঁপন তুলে, ফুলের গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনময়। কোথাও কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই দেখে সাপটা তার প্রাচীন লম্বা শরীরটা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে টেনে বের করে। সামনে কোমল দুর্বাঘাসের ছোট্ট একটা মাঠ উদাস, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে পড়ে আছে। মাঠের পাশে হলুদ ফুলের ঝোপটার কাছে দীর্ঘকায় কী একটা প্রাণী খানিক এদিক যাচ্ছে খানিক ওদিক যাচ্ছে। স্থির হয়ে প্রাণীটার দিকে তাকায় সাপটা। তারপর বুঝতে পারে, প্রাণীটা মানুষ। মানুষ দেখে মেজাজটা বিগড়ে যায় তার। এই সময় অন্য কোনও বিপজ্জনক জীব দেখলে মাথায় রগ চড়ে যায়। খানিকটা ভয়ও হয়। মানুষকে বিশ্বাস নেই।

সাপটা তবুও ধীরমন্থর গতিতে দুর্বাঘাসের মাঠটা পাড়ি দেয়। খানিক চলেই থামে সে। মাথা তুলে মানুষটার গতিবিধি লক্ষ্য করে। এক সময় দেখে, ফুলের ঝোপ পেরিয়ে গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। দেখে বড় নিশ্চিন্ত হয় সে, বড় খুশি হয়। মাঠ ভেঙে, একটা ঝোপের আড়াল দেখে, বুকের তলায় নরম ঘাস এবং মাথার ওপর মিঠেল ছায়া দেখে লম্বা শরীরটা বিছিয়ে দেয়। বয়স হয়েছে। খানিক চলাচলেই ক্লান্তবোধ করে সে। বসন্তকালেও সকালবেলার রোদে বেশ তেজ। মাথাটা ঘাসের ওপর রেখে পড়ে থাকে সাপটা। বনভূমির ভেতর কোথায় কী ঘটছে খেয়াল করে না সে।

.

বুড়ো মানুষটা কাল রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছে। ভোররাতের দিকে। দেখে, মাথার কাছে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীকে দেখে স্বপ্নের ভেতরও চমকে ওঠেছে সে। স্ত্রী মারা গেছে সাত বছর। তাহলে মাথার কাছে এসে দাঁড়াল কোত্থেকে!

মানুষটা অবাক হয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি?

মাথার ঘোমটা টেনে স্ত্রী বলেছে, তুমি আমাকে চিনতে পার না! সাত বছরেই আমার কথা ভুলে গেছ?

মানুষটা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। কতকাল হয়ে গেল তোমাকে দেখি না। বয়স হয়ে গেছে, চোখে ছানি, কোনও কিছুই ঠিকঠাক চিনতে পারি না আজকাল।

শুনে স্ত্রী হাসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মানুষটার। তোমাকে ফেলে আমি একদম থাকতে পারছি না। বড় অশান্তি, বড় মন খারাপ। তুমি কেমন আছ গো?

শুনে স্বপ্নের ভেতরেই মানুষটার চোখে জল এসে গেছে। সংসারে বড় অশান্তি। ছেলেরা দেখতে পারে না। ছেলের বউরা দূর দূর করে। নাতি নাতনিরা গালাগাল দেয়। খেতেপরতে গঞ্জনা, ওঠতে বসতে গঞ্জনা। সংসারের বাড়তি মানুষ হয়ে গেছি আমি। কাজকাম করতে পারি না। দুটো টাকা কামাবার মুরোদ নেই। ছেলেদের ঘাড়ে বসে খাই। কী করব বল, গায়ে জোরবল নেই। চোখে ছানি। দশ কদম হাঁটলে জান বেরিয়ে যায়। এইভাবে বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না। আমাকে তুমি নিয়ে যাও।

স্ত্রী বলল, দুঃখ কর না। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

তখন হাসি ফুটে ওঠেছিল মানুষটার মুখে। স্ত্রীর একটা হাত টেনে এনে দুহাতে নিজের বুকে চেপে ধরেছে। সত্যি বলছ তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?

 তারপরই ঘুম ভেঙে গেছে। তখন সকালবেলার আলো মাত্র ফুটেছে।

ছেলেরা গাইগরু নিয়ে, লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে চলে গেছে। বউরা ওঠে সংসারকর্মে মন দিয়েছে। নাতি নাতনিরা কেউ ওঠেছে কেউ ওঠেনি। মানুষটা তখন বিছানা ছেড়েছে। তারপর ঘাট সেরে পুকুরে গিয়ে অজু করেছে। নামাজ পড়ে, টুপিটা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে বাড়ির কাছের এই নিরালা বনভূমিতে। জায়গাটা খুব প্রিয়। তার। চারদিকে গাছপালা ঝোপঝাড়। ঘাস ফুল প্রজাপতি পাখি। সর্বোপরি অগাধ নির্জনতা। এখানটায় এলেই বুকভরে শ্বাস টানা যায়। সংসারের জটিলতার কথা, দুঃখ দারিদ্রের কথা, গঞ্জনা ও একাকিত্বের কথা মনে পড়ে না। মানুষটা বড় স্বস্তি পায়। কিন্তু আজ এখানটায় এসেও স্বস্তি পাচ্ছে না মানুষটা। স্বপ্নের কথা মনে পড়ছে। স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। স্ত্রী বলেছে, তাকে নিয়ে যাবে। এ কথার মানে কী!

মনের ভেতরে কু-ডাক ডাকে। বুকটা আনচান করে মানুষটার। স্থির থাকতে পারে না সে। বয়সী দুর্বল শরীরেও বনভূমিটা চষে ফেরে সে। মাথার ওপর পাখি ডাকে, চারদিকে ডাকে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সে শুনতে পায় না। বনে অনেক ফুল ফুটেছে, ফুলে ফুলে উড়ছে মধুপোকা, প্রজাপতি, সে দেখতে পায় না। মোলায়েম বাতাসে ফুলের মৃদু গন্ধ, সে টের পায় না। তার মনের ভেতর বসে স্ত্রী কেবল বলছিল, তোমাকে আমি নিয়ে যাব। এই দুঃখী সংসারে তোমাকে আমি আর রাখব না।

.

বনের গাছপালা দেখে পৃথিবীতে ভারী সুন্দর একটা সময় শুরু হয়েছে। বসন্তকাল। সূর্যের মিষ্টি তেজ পড়েছে তাদের ওপর। চমৎকার হাওয়া বইছে। ঝোপঝাড়ে ফুটেছে ফুল, ফুলে উড়ছে মধুপোকা, প্রজাপতি। ঘাসবনে মন খুলে ডাকছে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ। তাদের ডালে বসে ডাকছে পাখিরা। বনের বয়সী একটা সাপ সুন্দর একটা ঝোপের মিঠেল ছায়ায় শুয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে। বসন্তকালীন রোদও সইতে পারে না সাপটা। আর আছে, প্রায়ই বনে আসে যে বুড়ো মানুষটা, সে। মানুষটা বুঝি আজ খানিকটা অস্থিরচিত্ত। বনময় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখে গাছপালারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আহা বাছা, তোমার মনে কিসের দুঃখ!

তারপর মন খারাপ করে গাছেরা তাকায় দূরপ্রান্তে। দেখে পরস্পর পরস্পরের হাত ধরাধরি করে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে অল্পবয়সী একজোড়া মানব-মানবী। চেহারায় স্বপ্ন আর উদভ্রান্তির চিহ্ন তাদের। বনভূমির কাছাকাছি এসে মেয়েটি বলল, আমি আর হাঁটতে পারছি না। চল বনের ভেতরে, গাছপালার ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেই। ছেলেটি মৃদু হেসে মেয়েটির দিকে তাকায়। ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার মেয়েটি। তীব্র লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। তার বেণী করা লম্বা চুল কালনাগিনীর মতো পড়ে আছে পিঠে। কোমল পা দুটো ধুলোয় ধূসরিত। ছেলেটির একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে। মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। তার সুন্দর চোখ দুটো রাত্রি জাগরণের ফলে বসে গেছে।

মেয়েটির মুখে তাকিয়ে গভীর ভালোবাসায় ছেলেটির বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। ছেলেটির পরনে সাদা পাজামা আর নীল রঙের ফুলহাতা শার্ট। মাথার কোঁকড়া চুল উসকো-খুসকো। বেশ কয়েকদিন ক্ষৌরকর্ম করা হয়নি বলে মুখের দাড়িগোঁফ বনভূমির দুর্বাঘাসের মতো। এসবের ফাঁকফোকর দিয়েও তার চেহারায় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন, দুশ্চিন্তা আর উদভ্রান্তির মিশেল দেখা যায়। হাতে তার বেতের একটা স্যুটকেস। ধুলোবালি লেগে পাজামার পায়ের কাছটা মলিন। দেখে বোঝা যায়, বহুদূর পাড়ি দিয়ে এসেছে, বহুদূর যাবে। মেয়েটির মতো সেও ছিল অতিশয় ক্লান্ত।

তবুও ছেলেটি বলল, লঞ্চঘাট খুব একটা দূরে নয়। একবার লঞ্চে ওঠে বসতে পারলে নিশ্চিন্তে জিরানো যেত।

মেয়েটি বলল, লঞ্চঘাট খুব একটা দূরে নয়। বহুদূর চলে এসেছি আমরা। এখানে আমাদের কেউ চিনবে না। তাছাড়া ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।

রাতে কিছু খাওনি?

ওরকম দুশ্চিন্তায় খেতে পারে কোনও মানুষ!

কিসের দুশ্চিন্তা?

এবার মেয়েটি খুব সুন্দর করে হাসে। তুমি বলেছিলে দুপুররাতে আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাগানে থাকবে। আমি খুব সাবধানে, মা বাবা ভাইভাবীদের চোখ এড়িয়ে আমার স্যুটকেস গুছিয়েছি। তারপর নিজের ঘরে শুতে গেছি। খেতে বসেছিলাম ঠিকই, খেতে পারিনি। আমার ঘরে আবার আমাদের বাড়ির কাজের বুড়িটা থাকে। যুবতী মেয়ে একলা ঘরে থাকে কেমন করে। কিন্তু চিন্তা হল ঘর থেকে স্যুটকেস হাতে বেরুবার সময় বুড়িটা যদি টের পেয়ে যায়। তুমি তো জানোই আমাদের বাড়িতে এমনিতেই ম্যালা লোকজন। বাবা বড় গেরস্ত, ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। রাত-দুপুরঅব্দি লোকজন আসা-যাওয়া করে তার কাছে। তুমি বাগানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমি যদি না বেরুতে পারি! কেউ যদি ব্যাপারটা জেনে যায়, তাহলে তো আর রক্ষা নেই। ঘরে তালাবন্ধ করে দুদিনের মধ্যে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় থাকবে না। জীবনে যদি তোমাকেই না পেলাম তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কী। বল এরকম অবস্থায় মুখে খাবার রোচে কারো!

ততক্ষণে বনভূমির ভেতরে ঢুকে গেছে দুজনে। মেয়েটি বলল, বা কী সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। এখানে কিন্তু অনেকক্ষণ জিরাব।

ছেলেটি আমতা আমতা করে বলল, লঞ্চ!

তুমি না বললে ওই স্টেশনে দুতিন ঘন্টা পরপর একটা করে লঞ্চ আসে।

তা আসে।

তাহলে আর কি! এখনতো আর আমাদের কোনও তাড়া নেই। যে কোনও একটা লঞ্চ পেলেই হবে। যখন ইচ্ছে শহরে গিয়ে পৌঁছুলেই হবে।

কিন্তু

কী?

তোমার বাবা যদি এই স্টেশানেও লোক পাঠায়।

এতদূরে কাউকে পাঠাবে না। আমরা যে এই পথে যাচ্ছি তা সে অনুমানই করতে পারবে না। তাছাড়া

কী?

 লোক পাঠালেই আমাকে ধরে নিতে পারবে নাকি! তুমি তো আর জোর করে আমাকে নিয়ে পালাচ্ছ না। আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে এসেছি। একবার যখন তোমার হাত ধরে পথে নেমেছি, মরে গেলেও আর ফিরে যাব না।

তোমার বাবার অনেক ক্ষমতা। যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন তিনি।

এখন আর কিছুই করার নেই তার। আমি তো একবার ভেবেছিলাম, বিয়ে ঠিক করলে সোজা তোমাদের বাড়ি গিয়ে ওঠব। সেখানেই তোমার বউ হয়ে থেকে যাব। তুমি সাহস পেলে না।

একটা বনফুলের ঝোপ দেখে তার ছায়ায় হাতের স্যুটকেসটা নামিয়ে রাখল ছেলেটা। মেয়েটাও বসে পড়ল। কিন্তু ছেলেটা দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকে তাকাচ্ছিল। তারপর কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সেও বসে পড়ল মেয়েটির পাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওভাবে তোমাকে নিয়ে গ্রামে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তোমার বাবা আমাকে ধরে নিয়ে, গলা কেটে লাশটা গুম করে ফেলত। কেউ টেরও পেত না। তাছাড়া, আমার মতো একটা ছেলের কাছে তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দেবেনই বা কেন বল! কোনও কারণ তো নেই।

ওময়েটি অবাক হয়ে বলল, কীরকম?

আমি গরিবঘরের বেকার ছেলে। লেখাপড়া যেটুকু শিখেছি তাতে শহরে গিয়ে যে চাকরি করব, হবে না। আবার মাঠে গিয়ে যে চাষাবাস করব, তাও পারি না। দেশের সবচে খারাপ শ্রেণী হল আমার মতো এই শ্রেণীটা। এই শ্রেণীর লোকের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয় না। এদের প্রেম-ভালোবাসায় যাওয়াই উচিত নয়।

মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, এখন ওসব কথা বল না তো। আমার ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে।

ছেলেটি দুঃখী গলায় বলল, কিন্তু এখানে তোমাকে আমি কী খাওয়াব।

মেয়েটি কোনও কথা বলে না মুচকি হেসে স্যুটকেস খোলে। তারপর একটা পোটলা বের করে ছেলেটির পায়ের কাছে মেলে দেয়। তাতে কিছু সুস্বাদু পিঠা, নারকেলের নাড়, চালকুমড়োর মোরব্বা। দেখে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে ছেলেটির। কাল রাতে তারও কিছু খাওয়া হয়নি। এখন পায়ের কাছে সুস্বাদু খাদ্য দেখে খিদে নাড়িভুঁড়ি লাফিয়ে ওঠে।

ছেলেটি বলল, এগুলো।

স্যুটকেসে ভরে রেখেছিলাম। পথে যদি খিদে পায়!

তুমি খুব সংসারী মেয়ে হবে।

 মেয়েদের এসব বুঝতে হয়, বলে একটা পিঠা তুলে ছেলেটিকে খাইয়ে দেয় মেয়েটি। ছেলেটিও খাইয়ে দেয় তাকে। দুজনের চেহারায় ফুটে ওঠে পরিতৃপ্তির একটা চিহ্ন! ক্লান্তি দূর হয়ে যেতে থাকে।

খাওয়া শেষ হলে ছেলেটি বলল, এখন পানি পাব কোথায়?

মেয়েটি কোনও কথা না বলে স্যুটকেসের ভেতর থেকে পানিভর্তি একটা বোতল বের করে। দেখে ছেলেটি বলল, তাই তো, স্যুটকেসটা এত ভারি ছিল কেন এখন বুঝতে পারছি।

তারপর ঢকঢক করে বোতল থেকে পানি খায় সে।

মেয়েটি বলল, পেটে খাবার থাকলে যে কোনও বিপদে মানুষ খানিকটা শক্তি পায়। বলে নিজেও বোতল থেকে পানি খায়।

ছেলেটি বলল, তুমি সত্যি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। তারপর ঝোপের একটা ডাল টেনে, কয়েকটা বনফুল ছিঁড়ে মেয়েটিকে দেয়। নাও।

 মেয়েটি পেছন ফিরে বলল, পরিয়ে দাও।

 ফুলগুলো মেয়েটির বেণীর ভেতর গেঁথে দিল ছেলেটি।

মেয়েটি তারপর ছেলেটির কোলে মাথা দিয়ে গুটিসুটি শুয়ে পড়ে।

 ধীরে মেয়েটির মাথায় ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দেয়।

মেয়েটি বলল, কি ভাবছ?

ভাবছি শহরে গিয়ে বন্ধুর বাসায় ওঠব। কিন্তু কতদিন একজনের ঘাড়ে থাকা যায়। এই বিদ্যেয় চাকরি জুটবে না। কেমন করে চলব তোমাকে নিয়ে!

ওসব এখন ভাবতে হবে না।

না ভেবে উপায় কি বল। ঝোঁকের মাথায় তোমাকে নিয়ে পালালাম, শেষটা যদি সামলাতে না পারি।

শেষটা মানে!

যদি তোমাকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে না পারি।

সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কেমন করে হবে?

 আমি আমার সব গয়নাগাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বেশকিছু টাকাও আছে। ওই টাকা আর গয়না বিক্রি করে মোটামুটি ভালো একটা টাকা হবে তোমার। তোমার বন্ধুর বাসায় মাসখানেক থাকতে পারব না আমরা?

তা পারব।

ওই একমাসের মধ্যে তুমি সব গোছাবে।

 কি গোছাব?

গয়না বেচার টাকা, আমার নগদ টাকা একত্র করে তুমি একটা ছোটখাটো দোকান করবে। তারপর একটা বাসা ভাড়া করে আমরা সেই বাসায় ওঠে যাব। আমরা কোনও পাপ করিনি সুতরাং আল্লাহ আমাদের সহায় হবে। দেখো তুমি খুব উন্নতি করবে। প্রচণ্ড আবেগে ছেলেটি কোনও কথা বলতে পারে না। চোখে জল আসে তার। মেয়েটি তখন আস্তেধীরে ঘুমিয়ে পড়ছিল।

.

মাথার ওপর দাঁড়িয়ে প্রেম-ভালোবাসার একটা মনোরম দৃশ্য দেখে বনের গাছপালা। বনফুল ঝোপটার আড়ালে, ছায়ায় বসে আছে একজন যুবা পুরুষ। আর তার কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে যুবতী এক নারী। একপাশে রাখা আছে বেতের স্যুটকেস। সামনে অবহেলায় পড়ে আছে খাদ্যদ্রব্য বাঁধার ন্যাকড়াটা, জলের খালি বোতল। বহুদূর থেকে এসেছে তারা, বহুদূর যাবে। দেখে গাছপালাদের বলতে ইচ্ছে করে, সুখে থাকো। বাছারা, সুখে থাকো। কিন্তু গাছপালারা কথা বলতে পারে না। ঈশ্বর তাদের কথা বলতে বারণ করেছেন।

মন খারাপ করে অন্যদিকে মুখ ফেরায় গাছেরা। তখন দেখতে পায়, দীর্ঘকায় বুড়ো মানুষটা ক্লান্ত হয়ে জিরাতে বসেছে একটা ঝোপের মিঠেল ছায়ায়। দেখে চমকে ওঠে তারা। বিষধর প্রাচীন সাপটা যে ওখানেই নিদ্রামগ্ন। শব্দ পেলেই, শরীরে স্পর্শ পেলেই মাথায় রাগ চড়ে যাবে তার, দংশাবে।

গাছপালাদের ইচ্ছে করে মানুষটিকে ওখান থেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু তারা চলাফেরা করতে পারে না। ঈশ্বর তাদের চলাফেরা করতে বারণ করেছেন। ভয়ে ঝিম মেরে থাকে বনের সব গাছপালা।

.

অনেকক্ষণ হাঁটাচলার ফলে ভারী একটা ক্লান্তি বোধ করে বুড়ো মানুষটা। ঝোপের আড়ালে বসে হাত পা মেলে দেয় সে। তখনি ডানহাতে শীতল একটা ছোঁয়া পায়। কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের জল শীতকালে যেমন হিম হয়, স্পর্শটা সেরকম। চমকে হাতটা টেনে নেয় সে। তার আগেই সুখন্দ্রিায় বিপ্ন দেখে ফুঁসে ওঠেছে সাপটা। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে তার। মাথায় রাগ চড়ে গেছে। পাতার মতো ফনা তুলে মুহূর্তেই রাগটা ঝেড়ে দিল সে।

তারপর বুড়ো মানুষটার দীর্ঘ চিৎকারে কেঁপে ওঠে বনভূমি। দুঃখে নীরব হয়ে থাকে অসহায় গাছপালা। ভয় পেয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় সাপটা। বসন্তকালীন মোলায়েম বাতাসটা মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। একটাও পাতা নড়ে না। কোথাও রোদ থাকে স্থির হয়ে। ফুল কোন গন্ধ দেয় না। মধুপোকা, প্রজাপতি ওড়ে না। ঘাসবনের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায়। যুবাপুরুষের কোলে শুয়ে থাকা যুবতীটি ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। ছেলেটি একহাতে স্যুটকেস অন্য হাতে মেয়েটির একটা হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করে।

নিরীহ গাছপালা নীরব দর্শক হয়ে জগৎসংসারের এইসব খেলা দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *