গাঁধী দর্শন – চিদানন্দ দাশগুপ্ত
বিরাট মাঠে জনারণ্য। দূরে নীলাভ পাহাড়। হাজারিবাগের কাছেই রামগড়ের কিছুটা পথ পেরিয়ে মাঠে গাঁধীজির বক্তৃতা। সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছি, এখন খানিক অবসর। বন্ধুবান্ধব মিলে স্থির হল গাঁধীজির বক্তৃতা শুনতে যেতে হবে। সাইকেল চেপে সদলে চললাম, কিন্তু পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল। ফলে বিশাল জনতার একেবারে শেষভাগে বাঁশের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে দেখার ও শোনার আশা লুপ্তপ্রায়। লোকের মাথার ফাঁক দিয়ে একবার দুবার দেখতে পেলাম, বহুদূরে দিগন্তরেখার ওপরে একটি ডাকটিকিট সাইজের ছবি যেন আঁটা রয়েছে। তিনিই গাঁধীজি। ১৯৩৭ সাল, মাইকের চল তখনও হয়নি। একটা চোঙা থেকে থেকে মুখে তুলে গাঁধীজি কথা বলেছেন। ছোট ছোট সরল বাক্য। একটি বাক্যের পর সময় দিচ্ছেন। সেই ফাঁকে জনসমাবেশের মুখে মুখে কথাগুলি আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছে। সামনের সারের লোকেরা যা শুনছে তা পিছনে লোকেদের বলে দিচ্ছে। এই করে শেষ পংক্তি অবধি কথাগুলো শোনা যাচ্ছে। একেবারে সঠিক কথাগুলি নিশ্চয় আসেনি। কিন্তু সরল বক্তব্য সরল ভাষায় মুখে মুখে প্রচার হয়ে আসছে। কথাগুলি এত সরলভাবে বলা যে তার বেশি পরিবর্তন না হওয়াই স্বাভাবিক। অন্তত কোনও কথা অস্বাভাবিক বলে বোধ হয়নি। ইংরেজশাসিত ভারতে পুলিশ মোতায়েন—করা মাঠে লাখখানেক শ্রোতার ভিড় শাসকদের তটস্থ করে রেখেছিল নিশ্চয়ই। আমরা তখন ইস্কুল ও কলেজের মধ্যবর্তী স্বাধীনতায় সাহসী পুরুষ। নইলে ছাত্রাবস্থায় পুলিশের নেকনজর একেবারে এড়িয়ে চলা যেত না। কে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী বই পড়ছে, কী কথা বলছে— সবেতেই পুলিশের অদম্য কৌতূহল। এহেন অবস্থায় গাঁধীজির শান্তকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক শুনে আমাদের মনে উৎসাহ এবং উৎকণ্ঠার একটি বিচিত্র বিমিশ্র অনুভূতি নাড়া দিয়েছিল।
আজকের দিনে ওই স্মৃতি আর উৎকণ্ঠা ছড়ায় না। কিন্তু, ভাবি শীর্ণদেহ ওই মানুষটি কী করে অগণিত লোকের সভায় বিনা মাইকে কীভাবে তাদের শান্ত রেখে নিজের বক্তব্য বহুদূর পর্যন্ত অবলীলাক্রমে পৌঁছে দিতেন। আজকের যন্ত্রসম্ভারের মধ্যে বসেও কি জনতার অত কাছে পৌঁছানো যায়, অত স্পষ্ট, সরল ভাষায়?
দ্বিতীয় গান্ধীজিকে দেখি একেবারে নিকট থেকে। ১৯৪৬ সাল। এম এ পরীক্ষার কিছুকাল পরে কোনও সূত্রে দিল্লিতে গেছি। আমাদের প্রিয় শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তী সেই সময়টা দিল্লিতে ছিলেন। সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে চলে যেতাম। আমাদের তখন যৌবনের প্রবলতা এমন যে আর তার ক্লাসে ঢুকতাম না। অমিয় চক্রবর্তী, তারকনাথ দাশ এঁদের ক্লাসে ভিড় জমাতাম। ইংরেজির ছাত্র হলে কী হবে, অন্যান্য বিষয়ে বিখ্যাত অধ্যাপকদের বক্তৃতা শুনতে যেতাম। যেমন ইতিহাসে সুশোভন সরকার। কিন্তু নিজের বিষয় ইংরেজি সাহিত্যে যে যে অধ্যাপকের বক্তৃতা ভাল লাগত না, তাঁদের দেখিয়ে দেখিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। এই দৃশ্য দেখে অন্যতম অধ্যাপক জোরে জোরে বসেছিলেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো নয়, বৃন্দাবন! বৃন্দাবন’। বাস্তবিক কয়েকটি অধ্যাপক যা পড়াতেন তা শুনলে লজ্জা পেতাম। কাজেই তাঁদের ক্লাসে যেতাম না। এর ফলও হাতে হাতে পেয়েছিলাম পরীক্ষার পরে।
যাই হোক অমিয় চক্রবর্তীর বক্তৃতা শুনতে অতি অবশ্য যেতাম। তিনি মাথা নীচু করে মাটির দিকে চেয়ে অনর্গল বলে যেতেন তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য, এত গোছালো ভাষায়, যে, যেমনটি বলতেন তেমনটি ছেপে গেলে কোনও সংশোধনের প্রয়োজন হত না।
কলকাতায় যেমন যেতাম তেমনই দিল্লিতেও সেই অমিয়বাবুর বাড়ি গেলাম একদিন। তিনি বললেন, ‘ভালই হয়েছে, আমি গাঁধীজির কাছে যাচ্ছি, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো’। সেখানে তখন ভারত সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল স্যার এস এন সেন মজুত। তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। আরও কয়েকজন ছিলেন, গণ্যমান্য হলেও তাঁদের নাম এখন আর মনে নেই। অনেক শলা—পরামর্শ চলছে। গাঁধীজিকে কী করে বোঝানো যায় যে বাংলা বিভাগ হওয়া দরকার, নইলে সমস্যার সমাধান হবে না। সত্যেন্দ্রনাথ সেন ঝানু উকিল, তিনি গাঁধীকে সব বোঝাবেন, তাঁদের বক্তব্য শোনাবেন। কয়েকটি গাড়িতে চেপে সদলে ভাঙ্গী কলোনী গেলাম। সেখানে ধাঙড়—মেথরদের বস্তিতে গাঁধীজি বাসা বেঁধে আছেন। মনে আছে আমার যখন গাঁধীজির ঘরে ঢোকার পালা এল তখন বাঁদিকে পর্দা তুলে দাঁড়িয়ে বল্লভভাই প্যাটেল, ডানদিকে সীমান্তগাঁধী। বার বার হৃদকম্প সত্ত্বেও মাস্টারমশায়ের ধামা ধরে সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। গাঁধীজি যথারীতি মাটিতে মাদুরের ওপর বসে। সামনে একদিকে চরখা, আরেকদিকে কাগজপত্র। গাধীজি সেগুলো দেখতে দেখতে কথা শুনছেন। বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। এই কাগজগুলি দেখতে দেখতেই আপনাদের বক্তব্য শুনতে হবে, কারণ সময় নেই, আমি আজ রাত্রে ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছি। স্যার এস এন, আপনি তো আমাকে বোঝাতে এসেছেন যে বঙ্গবিভাগ হওয়া উচিত। আপনার যুক্তিগুলি এবার বলুন’।
দু—তিনবার গলা পরিষ্কার করে সত্যেন্দ্রনাথ আমতা—আমতা বললেন, ‘গাঁধীজি, আমি সরি যে কখনও আগে আপনার কাছে আসিনি, এই প্রথম এলাম, অপরাধ ক্ষমা করবেন।’ স্যার এস এন এই কথার দুবার তিনবার ইনিয়ে বিনিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে গাঁধীজি স্পষ্ট সুরে বললেন : Come to the point Sir S.N. You think Bengal should be divided. Why?
সত্যেন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করলেন। প্রথম যুক্তি খাড়া করতে এত সময় লাগল যে গাঁধীজি সেটাকে দু—চার শব্দে সংক্ষিপ্তসার করে দিয়ে বললেন, এই তো আপনি বলতে চান? এত সরল, স্পষ্ট সেই ভাষা যে সত্যেন্দ্রনাথ যেন অকূলে ঠাঁই পেলেন, বললেন, হাঁ হাঁ, তা—ই তো আমি বলতে চেয়েছিলাম।
দ্বিতীয় বক্তব্যেও তদ্রূপ। সত্যেন্দ্রনাথের কথা যত ঘোরালো, জটিল, গাঁধীজির ততই সরল, সংক্ষিপ্ত, সুস্পষ্ট। বার তিনেক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে সত্যেন্দ্রনাথের চৈতন্যোদয় হল। বললেন, ‘গাঁধীজি, আপনি তো সবই ভেবে রেখেছেন, সব যুক্তিই জানেন, আপনাকে আর আমি কী বোঝাব। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আগে কখনও আপনার কাছে আসিনি, তবু খুশি যে অবশেষে আপনার দর্শন হল। আই অ্যাম ভেরি সরি। ভেরি ভেরি সরি আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি।’
বার বার এই সরি, সরি রব শুনে গাঁধীজির কৌতুকবোধ জাগল। তিনি হেসে বললেন, ‘Don’t be sorry sir S.N.. The sorrow belongs to Omea, who brought you here.’ বলেই সকৌতুকে অমিয় চক্রবর্তীর দিকে চেয়ে হাসলেন। অপ্রতিভ মুখে হাসি টেনে অমিয়বাবু উঠে পড়লেন। আমারও গাঁধীদর্শন শেষ হল। যাবার সময় আবার দরজার এক ধারে বল্লভভাই প্যাটেল আর একদিকে বিশালকায় সীমান্ত গাঁধী। তাঁরা সবই শুনেছেন। মনে হল বল্লভভাই—য়ের মুখেও একটু কৌতুকের রেখা যেন রয়েছে। সেটা আমার কল্পনা কিনা জানি না।
ভাঙ্গী কলোনিতে মেথরদের সাহচর্য থাকলে কী হবে, একজন বিরাট জননেতার জন্য যেমনটি দরকার তেমন পরিপাটি ব্যবস্থা ছিল গাঁধীজির জন্য। তাঁর সহকারীবৃন্দের বাসস্থান, তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, লেখার সরঞ্জাম, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চরখা, বসা—শোয়ার ব্যবস্থা, এমনকি কমোড পর্যন্ত মজুত থাকত। সাধে কি সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন যে বাপুকে গরিব অবস্থায় রাখতে কংগ্রেসের অনেক খরচ হয়! তা ছাড়া খালি গায়ে হেঁটো ধুতি পরে মাথা কামিয়ে মাটিতে বসে থাকলে কী হবে, গাঁধীজি ছিলেন মনেপ্রাণে সায়েব এবং অনেকাংশে আধুনিক তদুপরি ধর্মনিরপেক্ষ। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইংরেজের ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন লন্ডন থেকে। উত্তরশিক্ষাকালে বন্ড স্ট্রিটের বড় দোকান থেকে সুট বানিয়ে রুপো বাঁধানো ছড়ি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, নাচের হলে গিয়ে মেয়েদের হাত ধরে বলনৃত্য করতেন। ভাল নাচতে পারতেন না বলে যথেষ্ট খেদ ছিল। নাচতে গেলে মেয়েদের যেভাবে ঘনিষ্ঠ হতে শক্ত হাতে ধরে ঘোরাতে হয় তার সৎসাহস তাঁর মনে জোগাত না, ভারতীয় সুলভ ভীতু—ভীতুভাবে লজ্জাসঙ্কোচের সঙ্গে নাচতেন। তাতে মনের শান্তি হত না। ইংরেজি ভাষায় অসাধারণ দখল ছিল। ইংরেজিতে স্বল্পবাক হয়েও যে খুব কার্যকরী ভাবে মনের কথা স্পষ্ট করে বলা যায় তা তিনি জানতেন বিলক্ষণ। স্টাফোর্ড ক্রিপস যখন ক্যাবিনেট মিশন নিয়ে ভারতে এসে দ্বিতীয় যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা চান ও তার মূল্য হিসাবে যুদ্ধের পরে ভারতের স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন তখন গাঁধীজি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন একটি বাক্যে : Its a post-dated cheque. Which I can not accept.
গাঁধীজির অজস্র ছবি দেশে—বিদেশে নানা পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে। কিন্তু তাঁকে কখনও মন্দিরে প্রণাম করতে দেখা গেছে কি না সন্দেহ। কেবল হরিজনদের মন্দির প্রবেশ অধিকার নিয়ে আন্দোলনের সময় ছাড়া। প্রাচীন, পেশাগত বর্ণাশ্রমে বিশ্বাস রাখেন বলতেন বটে, কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রের জাতিভেদ মানতেন না। বিভিন্ন জাতির মধ্যে এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিবাহে তাঁর সায় ছিল। এর সমর্থনে ‘হরিজন’ পত্রিকায় তাঁর নানা প্রবন্ধ আছে। তবে হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন বলেই বোধ হয় ধর্ম বিষয়ে সরাসরি বিরোধিতা বা নাস্তিকতার প্রচার এড়িয়ে চলতেন। খানিকটা খ্রিস্টান ভাবে একেশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন। রাম নাম নিতেন কিন্তু রামমন্দিরে যেতেন না। রাম তাঁর কাছে সততার ও সৎ শাসনের প্রতীক মাত্র, ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক রামের ভক্ত তিনি ছিলেন না।
গাঁধীজির পরিহাসপ্রীতির সাক্ষাৎ পরিচয় পেয়েছিলাম ভাঙ্গী কলোনিতে। আমার গুরুস্থানীয় অমিয় চক্রবর্তীর সেদিন গাঁধীজির কৌতুকী মন্তব্যের শ্রেষ্ঠ পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সের সময়। গাঁধী যথারীতি হেঁটো ধুতি পরে সম্রাটের সঙ্গে দেখতা করতে গিয়েছিলেন। সম্রাট সমক্ষে তাঁর বস্ত্রের স্বল্পতা নিয়ে কেউ বক্রোক্তি করায় তিনি বলেন : He had enough on for both of us.