গাঁধী-ঘাট

গাঁধী-ঘাট

আজ যদি রাষ্ট্রসংঘ ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে চান, তা হলে আমাদের কোনও দুর্ভাবনা নেই। আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীত কী সে বিষয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সে সংগীত, সর্বাঙ্গসুন্দর করে কে কে গাইতে পারবেন সে বিষয়েও আমাদের মনে অত্যধিক দ্বিধা নেই। তার কারণ আমাদের সংগীত এখনও জীবন্ত– তার ঐতিহ্য কখনও ছিন্নসূত্র হয়নি।

কিন্তু স্থাপত্যের বেলা আমাদের মস্তকে বজ্রাঘাত হয়। এককালে ভারতবর্ষে যে অত্যন্ত নয়নাভিরাম ভবন অট্টালিকা ছিল সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ– সংস্কৃত কাব্য নাটক শিল্প-শাস্ত্রে তার ভূরিভূরি বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু ঠিক কী করে সেগুলো আবার নির্মাণ করা যায়, সে সম্বন্ধে আমাদের কারও মনে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। মোগল-পাঠান বাদশারা ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বুখারাস-মরকন্দ ইরানের শিল্পকলা মিশিয়ে এদেশে বিস্তর ইমারত গড়েছিলেন, কিন্তু তার প্রধান নিদর্শন পাওয়া যায় মসজিদ, কবর ও দুর্গ নির্মাণে। আজকের দিনে এসব ইমারতের আমাদের প্রয়োজন নেই, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ করতে গিয়ে আমরা তাজমহল বা জুমা-মসজিদের দ্বারস্থ হতে পারিনে।

ইংরেজ যখন নয়াদিল্লি গড়তে বসল তখন যে এ সমস্যা তার সামনে একেবারেই উপস্থিত হয়নি তা নয়। ঠিক সেই সময়েই রসজ্ঞ হ্যাভেল সায়েব ভারতীয় শিল্পকলা সম্বন্ধে একখানা প্রামাণিক পুস্তক প্রকাশিত করেন। তার শেষ পরিচ্ছেদে তিনি ভারতীয় ইংরেজ বড়কর্তাদের সাবধান করে দেন, তারা যেন নয়াদিল্লিতে শিব দিয়ে বাঁদর না গড়েন। হ্যাভেল স্পষ্ট ভাষায় ইংরেজ স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ারদের বলে দেন, ভারতবর্ষের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তোমাদের কর্ম নয়। যে শহরে দিওয়ান-ই-খাস, জুমা মসজিদ, কুতবৃমিনার রয়েছে, সেখানে ভারতীয় স্থপতিকে বাদ দিয়ে কোনও কিছু সৃষ্টিকার্য করার দম্ভ কর না।

কিন্তু হ্যাভেল যখন দেখতে পেলেন যে ইংরেজের স্বাধিকার-প্রমত্ততা তাকে সম্পূর্ণ বধির করে ফেলেছে, তখন তিনি ইংল্যান্ডের গণমান্য ইংরেজদের তরফ থেকে একখানা স্মারকলিপি তখনকার দিনে সেক্রেটারি অব স্টেটকে পাঠান। যতদূর মনে পড়ছে, সে স্মারকলিপিতে বার্নার্ড শ এবং এচ. জি. ওয়েলসের নামও ছিল।

চোরা ধর্মের কাহিনী শোনে না, কিন্তু ধর্মের কাহিনী না শুনলেই যে মানুষ চোর হবে তার কোনও মানে নেই। সে মূর্খ হতে পারে, শিশু হতে পারে অথবা ইংরেজ বড়কর্তাও হতে পারে। এস্থলে দেখা গেল, ইংরেজ বড়কর্তারা দিল্লিতে বসে শ” সায়েবকে সরাজ্ঞান করলেন– কথাবার্তা থেকে ধরা পড়ল লন্ডনি শর তুলনায় তারা নিজেদের এক একজনকে একশ মনে করেছেন। তার পর দিল্লিতে তারা চিজ প্রসব করলেন পণ্ডিতি ভাষায় তাকে বলে গর্ভস্রাব, ইংরেজিতে Muck, trash বললে তার খানিকটে অর্থ ধরা যায়– শিব গড়তে বাঁদর গড়ার জন্য কোনও জুৎসই কথা ইংরেজিতে নেই, পর্বতের মূষিকপ্রসবও অন্য জিনিস।

তারি অন্য নিদর্শন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ল। এ জিনিসটি ক্রিসমাস কে না শ্বেতহস্তী, এখনও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি। এটা নাকি বানানো হয়েছিল তাজমহলের সঙ্গে টক্কর দেবার জন্য। হবেও বা। শূর্পনখাও তো সীতার সৌন্দর্য দেখে হার মেনে নেয়নি। সেকথা থাক, তবে এইটুকু না বলে থাকা যায় না- তাজ দেখে মনে হয়, চেঁচিয়ে বলি, ধরু, ধর, এক্ষুনি ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ল দেখে চেঁচিয়ে বলি, বধূ বাঁধূ এক্ষুনি ডুবে যাবে।

***

গাঁধীঘাট নির্মাণ করতে গিয়ে তাই স্থপতিকে কোন সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল স্পষ্ট বুঝতে পারি। অজন্তাযুগে ফিরে যাবার উপায় নেই, মোগল স্থাপত্যে ঘাট নির্মাণের উদাহরণ নেই। আর ইউরোপীয় স্থাপত্যের বহু জিনিস আমাদের কাজে লাগে বটে, কিন্তু তা দিয়ে রসসৃষ্টি হয় না, আর হলেও আমাদের ভারতীয় মন চট করে তা দেখে সাড়া দেবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। (ইউরোপীয় সবকিছু বর্জনীয় সেকথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়– তা হলে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের নভেল বাদ দিতে হয়)।

তা হলে এক হতে পারে–সবকিছু বাদ দিয়ে নিছক কল্পনার হাতে লাগাম ছেড়ে দেওয়া। তাতে মন সাড়া দেয় না। আমরা কি তবে হটেনটট? আমাদের ভাণ্ডারের কি কোনও ঐশ্বর্য নেই যে আমরা শুধু দু খানা হাত দিয়ে ব্যবসা ফাঁদব?

আর হতে পারে প্রয়োজনমতো হিন্দু, পাঠান, মোগল ইংরেজ সকলের কাছ থেকে রসবস্তু ধার নেওয়া। যেখানে নিতান্তই অনটন, সেখানে স্থপতি চালাবেন তার কল্পনা। তার নৈপুণ্য তাকে শিখিয়ে দেবে কী করে ভিন্ন ভিন্ন রসবস্তুর সংমিশ্রণে এমন জিনিস নির্মিত হয়, যা রসস্বরূপ এবং শুধু তাই নয়– অখণ্ড রসম্বরূপ।

আমার মনে হয়, গাঁধীঘাট অখণ্ড এবং সার্থক রসসৃষ্টি হয়েছে। তার সম্পূর্ণতাটাই আমার চোখে পড়েছে প্রথম এবং আমি তাকে সম্পূর্ণভাবেই রসবস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছি। দেখে মুগ্ধ হয়ে যখন মনস্থির করলুম যে এ সম্বন্ধে আর পাঁচজনকে বলতে হবে, তখনই বিশ্লেষণ কর্ম আরম্ভ করতে হল এবং তাতেও স্থপতির পরিমাণ-জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়েছি। পাটটা মসলা একত্র করা কঠিন কর্ম নয়– হোটেলের পাঁচকেরা নিত্য নিত্য করে; কিন্তু সার্থক রান্না মা মাসিরই হাতে ফুটে ওঠে। জগাখিচুড়ি ও মধুপর্ক ভিন্ন জিনিস।

স্মৃতিসৌধ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তাই তাকে উচ্চ হতে হয়। স্থপতি সেখানে ঐতিহ্যগত মন্দিরের শরণাপন্ন হয়েছেন। ঘাটে মেয়েদের জন্য কাপড় ছাড়ার ভালো ব্যবস্থা করতে হয় এবং পর্দার কড়াক্কড়ি মোগল-পাঠানরাই করেছে বেশি। তাই পাষাণ-যবনিকা দিয়ে যে গর্ভগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে তার অনুপ্রেরণা এসেছে দিল্লি-আগ্রা থেকে। আর সর্বশেষে ঘাটে আশ্রয় পাবে বহু লোক; তাদের জন্য স্থপতি সৌধবক্ষ হতে যে পক্ষ সম্প্রসারিত করেছেন তার শৈলী ইয়োরোপীয় (এবং ইয়োরোপীয়ের আবিষ্কৃত কংক্রিটেই এ বস্তু সম্ভবপর)। আজকালকার দিনে কে না জানে প্রতীক্ষমাণ নরনারী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় প্লাটফর্মে এবং প্লাটফর্ম জিনিসটা যখন বিলিতি, তখন তার বেদনা-বোধটা কোথা থেকে আসবে তার জন্য বড় বেশি কল্পনাও খাটাতে হয় না।

কিন্তু প্লাটফর্ম দেখে মনে যদি কোনও রসের সৃষ্টি হয়, তবে সে তো বীভৎস রস। আমার মনে হয়, স্থপতি এখানে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এই পক্ষ সম্প্রসারণে এমন একটা সরল স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি বা sweep আছে। বামদিকের গর্ভগৃহ ও সৌধ-শিখরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই গতিভঙ্গি এতই সুষ্ঠু হয়েছে যে, সমস্ত স্মৃতিসৌধটি স্থাণুবৎ না হয়ে গতিবেগ পেয়েছে। মন্দিরটির খণ্ড গম্ভীর পাষাণ যবনিকা কারুকার্যময় পক্ষ সম্প্রসারণ পূর্বক আপন বৃক্ষলতা দিয়ে সম্পূর্ণ সৌধের ভারকেন্দ্র রক্ষা করেছে।

তাই মনে হয়, আড়ম্বরহীনতাই এ সৌধের প্রধান ধর্ম। আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, গাঁধীঘাটে যে আড়ম্বরহীনতার গোড়াপত্তন করা হয়েছে তার সঙ্গে মিল রেখে আমাদের ভবিষ্যতের সব স্থাপত্য প্রচেষ্টা আড়ম্বরহীনতায়ই আপন প্রধান সতর্কতা খুঁজে পাবে। শুধু বলতে চাই, মহাত্মাজির জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতেই হয় তবে তাকে আড়ম্বরহীন হতেই হবে।

কিন্তু আমাদের এসব বিশ্লেষণ হয়তো প্রয়োজন নেই। আমরা শহরে থাকি, গঙ্গাবক্ষের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র ক্ষীণ। মা গঙ্গার বুক বেয়ে যে জনপদবাসী উজান-ভাটা করে, তারা কী বলে সেই কথা জানবার জন্য আমরা উত্তষ্ঠিত হয়ে রইলাম।

শৈলীর প্রভাব এ স্মৃতিসৌধ কতটা বহন করছে বিশ্লেষণ তারা করবে না। তাদের শেষ কথা, ভালো-লাগা মন্দ-লাগা এবং কলা-বিচারে সেই শেষ কথা। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সম্পূর্ণ বিদেশি বন্ধু আমাদের জনসাধারণকে বেশিদিন রস দিতে পারে না। এ সৌধ আমাদের ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে যখন শিরোত্তোলন করেছে তখন আর যা হয় হোক, এ বস্তু নিন্দাভাজন হবে না।

অবিমিশ্র আনন্দের বিষয়, এ ঘাটের পরিকল্পনা করেছেন এক বাঙালি যুবক। তার নাম হবিবুর রহমান। ইনি শিবপুরের কৃতী ছাত্র ও পরে আমেরিকায় গিয়ে অনেক বিদ্যাভ্যাস, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। এই পুণ্যকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে শ্রীমান দেশবাসীর আশীর্বাদ লাভ করবেন।

এ ঘাটে গঙ্গাবক্ষে স্নান করে দেশবাসীর দেহ পবিত্র হোক, মহাত্মার জীবন স্মরণে তাদের আত্মা মহান হোক।

ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

[আনন্দবাজার পত্রিকা]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *