গহ্বরতীর্থের কুশীলব

খাজুরাহো মন্দিরের দেয়াল থেকে মাটিতে লাফাবার সময়, ঘুরঘুরে পোকার মুখে পাঠানো আদেশ তামিল করার জন্যে, বাতাসের মাঝপথে, নিজেকে পাষাণ মূর্তি থেকে রক্তমাংসের মানুষে পালটে নিয়েছিল কুশাশ্ব দেবনাথ নামে স্বাস্হ্যবান যুবকটি, যে কিনা হাজার বছরেরও বেশি চাণ্ডেলাবাড়ির একজন গতরি, ভারি-পাছা, ঢাউসবুক উলঙ্গ দাসীর ঠোঁটে ঠোঁট, যোনিতে লিঙ্গ, আর স্তনে মুঠো দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল ।

এতকাল কত রোদ রোদিয়েছে, কত মেঘ মেঘিয়েছে, কত শীত শীতিয়েছে, কত বৃষ্টি বৃষ্টিয়েছে, কত ঝড় ঝড়িয়েছে, কত ধুলো ধুলিয়েছে, তার গোনাগুনতি নেই।

—-অ্যাই, তোকে তফতরে ডেকে পাঠিয়েছে। অমাবস্যার রাতে কানের ওপর এসে, হুকুম শোনাবার মতন হেঁড়ে গলায়, বলেছিল কেঁদো কালো ঘুরঘুরে পোকাটা।

হাজার বছরেরও বেশি অমন পোজ দিয়ে থাকার দরুণ শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও, গায়ে কিন্তু একদম ব্যাথা নেই কুশাশ্ব দেবনাথের। আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যে একটু ওঠবোস লাফালাফি ছুটোছুটি করে নিল। পাথর হয়ে সঙ্গমরত থাকলেও, ‘দফতর’ শুনে ছাঁৎ করে উঠেছিল নিরেট বুক। মাটিতে দাঁড়িয়ে, রক্তমাংসের দেহে, যদিও উলঠ্গ, ছাঁৎ-ছাঁতানিটা কাটতে সময় লাগল।

—-এভাবে যাওয়া অ্যালাউড? জিগ্যেস করল কুশাশ্ব।

—-নিজেকে নগন্য করে নে, তিন-চার সেন্টিমিটারের মতন, তাহলে প্রবলেম হবে না। মাপ না বাড়লে লোক-লজ্জার ভয় নেই। কন্ঠস্বরে আদেশ মিশিয়ে বলল ঘুরঘুরে পোকাটা, যার ঠাকুমা আদর করে ওর নাম রেখেছিলেন পচা; আর এখন তো পচাঞ্জন সরদার নামে পুরো গোভারতে বিখ্যাত। এক দুর্গন্ধে সবাই চেনে।

—-যাব কী করে? শরীরের পেশিগুলো ম্যাসাজ করতে-করতে, যাতে একটু ঢিলে-ঢালা হয়, জানতে চাইল কুশাশ্ব।

—-তোর সেই জলফড়িং বন্ধুটা কোথায়? তার তো বেশ হাওয়াইজাহাজের মতন বডি, চার ডানার ইনজিন, চাদ্দিকে দেখার মত ডুমো-ডুমো চোখ। ওটার ওপর বসে চলে যা।

মনে পড়ল কুশাশ্বর। পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা নামে এক জলফড়িং এসে প্রতিদিন নাকের ডগার ওপর বসে ডানা ঝাপটানির আদর দিচ্ছে মাসখানেক যাবত। পতঙ্গিনীও বলছিল, মন্দিরের গা থেকে নেমে, জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে দেশঅদেশ দেখতে, ভালমন্দ খেতে, রক্তমাংসের মেয়ের আহ্লাদ নিতে। পতঙ্গিনীর পরিবার নাকি কয়লাযুগের সময় থেকে রয়েছে। তখন ওরা অনেক অবস্হাপন্ন ছিল। এত অবস্হাপন্ন যে ওর পূর্বপুরুষদের বলা হত দৈত্যফড়িং, আর সময়টাকে লোকে বলত রেনেসঁস।

রেনেসঁসের সময়ে ছিলেন ফোরোরাকোস, টিরানোসরাস, ডিপলোডোকাস, ইগুয়ানাডন, ট্রাইসেরাটপাস, মাস্টোডোনসরাস, স্টেগোসরাস, রয়ামোফোরিনকাস, টেরানোডন, ব্লনটোসরাস, আরকিওপটেরিক্স, ট্রাকোডোন, মোসোসৌর প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্ব; একদিন বিকেলবেলায় বলেছিল পতঙ্গিনী, যখন বিকেলেরচ সোনারঙআ হাওয়া ওর স্বচ্ছ চারটে ডানাকে ফরফরিয়ে হাওয়াতে চাইছিল। কয়লা-উৎপাদী বনজঙ্গল যখন ফেলে-ছড়িয়ে চারপাশ জংলাচ্ছে, তখন জলে অভিভূত জলায়-জলায় ডানাবাজনার প্রবচন শুনিয়ে সংস্কারের কাজ করতেন ওর তিন ফিট লম্বা পূর্বপুরুষরা।

আর এখন? পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা বলে, এখন সবই খুদে-খুদে। ছয়ফুটকি কাঁচপোকা, গোবরঠেলা গুবরে, ডোরাকাটা তেলাপোকা, কালীঝিঁঝি, গন্ধকীট, কেঁচো, কির্মি, মঃকুন, বল্মীক, কিটিভ, জালিক, উচ্চিঙ্গে, ডেঁয়ো, পুতিকা, লুমবিষ, শলভ, শুঙ্গা, কেঁদরাই, জলৌকা, ঘুণ আর চুলচেরারা সমাজ চালায়।

অচেনাসুলভ অচেনাদের একটা জমঘত আছে যাকে খুদেরা বলে দফতর। যারা ইনজিরি ভাষা জানে তারা বলে পার্টি- ঘর। ওই দফতরে হাজির হতে বলেছে ঘুরঘুরে। আদেশ দিয়ে, গায়ের ঢাকনা তুলে, গোপন ডানা বের করে, মুখের সামনে কালাশনিকভ উঁচিয়ে চলে গেল স্পেশাল রিজার্ভ ফোর্সের ঘুরঘুরে কমান্ডার।

পতঙ্গিনী বলেছিল, কাঁচপাখনার খুনসুটিমার্কা কাঁপন তুলে, দফতরের অছিসিংহাসনের মালকিনির সামনের দিকটা সুয়োরানি আর পেছনদিকটা দুয়োরানি; কিন্তু তুমি টেরটি পাবে না কোনটি সুয়ো আর কোনটি দুয়ো।

—-সে কি? আমাদের মন্দিরের গায়ে যে উলঙ্গ যুবতীরা অমর হয়ে রয়েছে তাদের তো সামনে দিক আর পেছনদিক একেবারে আলাদা, অথচ সুয়ো-দুয়োর ব্যাপার নেই।

—-তোমার মন্দিরে যা আছে তা হল স্হপতি আর ভাস্করের কল্পনা। আমি রূঢ় বাস্তবের কথা বলছি ভায়া। কখনও যদি দফতর শহরে যাও, নিজের চোখে দেখতে পাবে।

—-শুধু চোখ কেন আমি তো সব অঙ্গ দিয়েই দেখব। চোখ দিয়ে সবকটা ডাইমেনশান ধরা যায় না। তাছাড়া তোমার মতন চোখ তো আমার নেই।

দফতরের ডাকে সে-কারণেই সাড়া দিল কুশাশ্ব দেবনাথ।

এদিকে অমাবস্যার অমিয় অন্ধকার, তারায় তেরিয়ে আকাশ, শীতে শীতোচ্ছে ঝোপঝাড়, বাঁশিয়ে রয়েছে বাঁশবন, হিমে হিমোচ্ছে হালকা হাওয়া; কখন দুজোড়া ডানার কপাট খুলে পতঙ্গিনীর ঘুম ভাঙবে কে জানে।

নগণ্য হবার আগে একবার জঘন্য হয়ে দেখা যাক, ভাবল কুশাশ্ব। বলা তো আর যায় না। যদি দফতর শহরের কাজে লাগে। যদি অছি-সিংহাসনের কাজে লাগে। যদি মালকিনির সুয়ো দ৮ইকের কাজে লাগে। যদি মালকিনির দুয়ো দিকের কাজে লাগে।

যামন ভাবা তেমনি কাজ।

সারা গায়ে চুল আর শুঁড়োলো মুখ দিয়ে দাঁত বেরোনো শাকাহারী ম্যমথ হয়ে গেল কুশাশ্ব। গাছে-গাছে গেছো পাখিদের চেঁচামেচিতে লজ্জা পেয়ে আবার ফিরে এলো নিজের চেহারায়। ট্রায়ালটা দিয়ে অবশ্য ফুরফুরে প্রাণে ফুরসত এলো।

সকালে, পতঙ্গিনী এসে যখন রক্তমাংসের কুশাশ্বকে দেখল, ওর তো হেসে-হেসে ডানা ব্যথা হবার যোগাড়। সব শুনে বলল, নগণ্য-জঘন্য বা ধন্যধন্য যা-ই হও, অত দূরে ফ্লাই করার প্রযুক্তি আমার নেই ভায়া। অত এভিয়েশান ফুয়েলও ক্যারি করতে পারি না।

—-তাহলে কী হবে? কেমন করে যাব?

তুমি নগণ্য হয়ে আমার পিঠে দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসো, আমো কোনো শঙ্খচিলের পিঠে বসিয়ে দেবো তোমায়। ওরা কেউ-কেউ দফতর-শহরের দিকে যায়।

নগণ্য হয়ে, উঠে বসার সময়ে পিছলে যাচ্ছিল কুশাশ্ব। ভোর-ভোর পরাগ মাখাবার ডিউটিতে বেরিয়েছিল পতঙ্গিনী, যাতে বেশি-বেশি হাইব্রিড জন্মায়।

—-হাইব্রিড? জানতে চাইল কুশাশ্ব। অচেনাসুলভ অচেনা?

হ্যাঁ, হাল আমলে আমরা ফড়িংরা অনেক ধরনের হাইব্রিড তৈরিতে সফল হয়েছি।

—-তাই বুঝি?

—-হ্যাঁ তো! গান্ধির পরাগের সঙ্গে মার্কসের পরাগ, গান্ধির পারাগের সঙ্গে রজনিশের, মাও-এর সঙ্গে মোরারজির, মার্কিনের সঙ্গে চিনা, জেহাদের সঙ্গে সাম্যবাদ, লাউ-এর সঙ্গে লঙ্কার, রবারের টুপির সঙ্গে চামড়ার টুপি; সে-সব হাইব্রিড তুমি দফতর শহরে গেলেই দেখতে পাবে।

—-হাফ-চেনার সঙ্গে উড়ুক্কু হাফ-চেনা মিশিয়ে পুরো একখানা অচেনাসুলভ অচেনা? পিঠের ওপর যুৎ করে বসে বলল কুশাশ্ব। এভাবেই ঘোড়ায় চাপত হাজার বছর আগে।

ঝিলের ঝিলমিলে কিনারায় যে শঙ্খচিলটা বসেছিল তাকে, জলে পোঁতা কঞ্চিতে বসে জিগ্যেস করল পতঙ্গিনী, একজনকে দফতর-শহরে নিয়ে যাবেন? ওর ডাক পড়েছে, খুব জরুরি।

ঠোঁটে শুকনো ঘাসের নুটি নিয়ে পেতলের একটা ছোট মূর্তি ঘষেমেজে ফর্সা করছিল শঙ্খচিল, এক মনে, মাথা নিচু করে। বলল, গোপালের এই তো সবে ঘুম ভাঙল। দাঁত মাজিয়ে, চান করিয়ে, ব্রেকফাস্ট করিয়ে, তারপর ওকে নিয়ে একটু বেরোব।

—-আপনি যতটা যাবেন অন্তত ততদূর পৌঁছে দেবেন নাহয়। তারপর কোনো যানবাহনে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। প্রস্তাব দিল পতঙ্গিনী।

—-ঠিকি আছে, আগে গোপালের সেবাটা করে নিই। এক হাতে গোপালকে, অন্য হাতে তোমার অতিথিকে ধরে নিয়ে যাবো।

শঙ্খচিলের পায়ের কাছে কুশাশ্বকে নামিয়ে, টা-টা করে চলে গেল পতঙ্গিনী। কুশাশ্ব দেখল গোপাল একটা পুতুল, হাতে নাড়ু নিয়ে বসে আছে। ও নিজে ছিল পাথরের আর নাড়ুগোপাল নিরেট পেতলের।

শঙ্খচিলের পরামর্শ মেনে, যে-হাতে গোপালকে আঁকড়ে ধরল পাখিটা, সেই হাতটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কুশাশ্ব। একটা হাত আমার খালি থাকা দরকার, নয়তো নামার সময়ে অসুবিধা হবে, বলেছিল শঙ্খচিল।

দু-তিনবার পাক খেয়েই আকাশের চেয়ে উঁচু আকাশে উঠে পড়ে শঙ্খচিল যখন ফুল স্পিড নিয়েছে, ধাতব হাসি হেসে পেতলের মূর্তিটা ফিসফিস করে কুশাশ্বকে বলল, এত নিচু স্বরে যাতে শঙ্খচিল শুনতে না পায়, এই নিন, নাড়ু খান, আপনার তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।

সত্যিই বেশ জোরে খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বাঁ-হাতে নাড়ুটা নিয়ে খেয়ে নিল কুশাশ্ব। এমন খিদে পেয়েছিল যে প্রশ্ন করার মানে হয় না, গোপাল ছোকরাটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না হওয়া সত্বেও।

খেয়ে নিলে, গোপাল বলল, আরো নিচু স্বরে, দফতর থেকে আমারও ডাক পড়েছে, কিন্তু আমার সেবাইত তো ছাড়তেই চায় না, সব সময়ে সঙ্গে থাকে, এমনকি রাত্তিরে ঘন্টা বাজিয়ে মশারি টাঙিয়ে, আমাকে ঘুম পাড়ায় আর নিজে আমার সামনে মাটিতে শুয়ে মশার কামড় খায়।

এরকম উজাড় করে সেবা করছে লোকটা, অথচ আপনি দফতরের ডাকে সাড়া দিতে চাইছেন? কুশাশ্ব বিস্মিত। গলায় নাড়ুর চুরো আটকে আরেকটু হলেই জোরে কেশে ফেলত। সূর্য উঠে গিয়ে থাকলে কী হবে, আকাশ ব্যাপারটাই একেবারে ঠান্ডা, পাথরিনী চান্ডেলা দাসীর চেয়েও। তার ওপর খুচরো মেয়েলি মেঘগুলো মাঝে-মধ্যে সুড়সুড়ি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

বন্দী জীবন কাটাচ্ছি, বুঝলেন, চব্বিশ ঘন্টা নজরে-নজরে, একেবারে একপাখিতন্ত্রী যাপন। বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, একটু পরেই আমার সেবাইত ছোঁ মেরে নাড়ু তোলার জন্যে একজায়গায় নামবে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাবে। বাঁ হাতটা তাই ফাঁকা রেখেছে। মাটির কাছাকাছি যেই নামবে, আপনি ওর হাতের বগলে কাতুকুতু দিয়ে মাটিতে ঝাঁপ দেবেন, আমিও দেবো সেই সঙ্গে।

কিন্তু পতঙ্গিনী তো বলেছিল ও-ই দফতরে যাবার গাড়িতে তুলে দেবে।

প্রশ্ন করবেন না। সেবাইতদের বলা যায় না। কিছু না পেলে আপনাকেই টুক করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি তো পেতলের, আমায় খেতে পারে না। হয়ত আমি ধাতুর বলেই আমার সেবাইত হয়ে রয়েছে।

দোটানায় পড়ল কুশাশ্ব।শঙ্কচিল গোঁতা মেরে নামা আরম্ভ করেছিল নিচে। ভাবার আর সময় ছিল না। হালুইকরের বাড়ির ছাদে নাড়ুর থালার কাছাকাছি হতেই কাতুকুতু দিয়ে লাফ মারল কুশাশ্ব। গোপাল নাড়ু মাখার পাত্রের মধ্যে পড়ল। তুলে নেবার জন্যে শঙ্খচিল পেছনে বাঁক নিয়ে নেমে এসেছিল বটে, হালুইকরের মা একটা লাঠি নিয়ে ‘এই পালা এই পালা’ চেঁচিয়ে তাড়াল পাখিটাকে। না পালিয়ে ওপরে চক্কোর মারছে দেখে হালুইকরের মা লোকজন ডেকে নাড়ুর থাল, যার ফাঁকে কুশাশ্ব লুকিয়ে, আর নাড়ু মাখার বিরাট পাত্রটা, যার মধ্যে গোপাল লুকিয়ে, মাথায় তুলে নিচের তলার ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে রাখল।

কর্মীরা বাইরে বেরিয়ে গেলে, কুশাশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখল, গোপাল প্রমাণমাপের মানুষের চেহারা নিয়ে ফেলেছে।

—-করছ কী? করছ কী? ধরা পড়ে গেলে ভীষণ কেলেংকারি হবে। আমার মতন খুদে হয়ে যাও না। পরে সুযোগ পেলে কেটে পড়ব। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।

গোপাল বলল, আমি নগণ্য হতে পারি না। সে-ক্ষমতা আমার নেই। আমি যে ঈশ্বর। আমি কেবল বড়, আরও বড়, তার থেকেও বড় হতে পারি। বা ধাতু, কাঠ, মাটি, পাথরের।

মনে হল এ-ঘরে কেউ আসছে। পায়ের শব্দ শোনা গেল। দ্রুত শুয়ে থাকা পেতলে রূপান্তরিত হল গোপাল। উত্তেজনায় কুশাশ্ব নিজের ছয়ফিট দীর্ঘ প্রকৃত চেহারা নিয়ে ফেলল। হাতে, বাহুতে, পায়ে, গলায় স্বর্ণালঙ্কার সুদ্ধ। কিন্তু দেহে যে পোষাক নেই। খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে ওভাবে পোশাকহীনই ছিল হাজার বছর।

যে যুবতী-বধু ঘরে ঢুকেছিল, সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুশাশ্বর ওপর। টাল সামলাতে না পেরে, ডািঁ-করা মিষ্টির পাহাড়ের ওপর পড়ল দুজনে। তাই আওয়াজ গেল না বাইরে।

সকাল থেকে আমার বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি । সম্বিত ফিরে না পেলেও বলল কুশাশ্ব।

বাঁ হাত দিয়ে কুশাশ্বর মুখে চোখে নাকে মিষ্টি গুঁজে দিতে লাগল যুবতী, আর দান হাতে খুলতে লাগল নিজের পোশাক। মিষ্টির নানা রকম ঢিবির ওপর চলল ওদের দুজনের স্বয়ংক্রিয় সৃজন-কম্মের হুটোপাটি । মিষ্টির বিছানায় ওদের খেলা স্তিমিত হয়ে এলে, কুশাশ্ব বলল, দফতর শহরে যাবার জন্যে ওকে সাহাজ্য করতে। গোপালের কথাটা চেপে গেল, কেননা এরাও যদি গোপালকে বন্দী করে ফ্যালে তাহলে মুশকিল। বলা যায় না; হয়ত ক্যাশ-বাক্সের ওপর রেখে এরাও গোপালের সেবাইত হতে চাইবে।

মেয়েটি কুশাশ্বর জন্যে একটা থলে, ফুলপ্যান্ট, শার্ট, জুতো আর সোনার এক হাজার সরকারি মুদ্রা এনে দিতে, কুশাশ্ব নিজের সবকটা অলঙ্কার দিয়ে দিল খুলে, স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে। যুবতী যখন দেখতে গেল খিড়কি দরজার দিক ফাঁকা আছে কিনা, গোপালকে তুলে ঝোলায় পুরে নিল কুশাশ্ব।

পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখল, তখনও আকাশে চক্কোর দিচ্ছে শঙ্খচিল। ঝোলা থেকে গোপালকে বের করলে ও-ও প্রমাণ মাপের মানুষের চেহারা নিল , আর মাথা থেকে ময়ূরের পালকটা খুলে ফেলে দিল ছুঁড়ে।

ঈশ্বর হয়েও আপনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি? আমার নগণতার সুযোগ নিতে হল? গাড়ি-ঘোড়ার খোঁজে হাঁটতে-হাঁটতে গোপালের দিকে প্রশ্ন দুটো ছুঁড়ে দিল কুশাশ্ব।

ঈশ্বরদের অনেক হ্যাপা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল গোপাল। ঈশ্বররা পাওয়ার শেয়ারিঙে বিশ্বাস করে না, আকাশে উড়ন্ত শঙ্খচিলের দিকে তাকিয়ে বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, ঈশ্বররা ভক্তদের দিয়ে অপরাধ করাতে বাধ্য হয়, কেননা তারা নিজেরা নিজেদের হাতে অপরাধ তুলে নিলে ঈশ্বরগিরি হারাবে। গোপিকাদের নিয়ে লীলে খেলায় আমি তো অনেক বেশি অভিঞ্জ। এমন কি যতই যাই করি কৌমার্য অটুট থাকে। তবু ওই যুবতীকে সন্মোহনে ডেকে পাঠালুম যাতে ওর বাঁজা বরের বদনাম ঘোচাবার অপরাধটা আপনি করেন, আর সেই সঙ্গে যুবতীটি আমাদের পালাবার সুযোগ করে দ্যান।

—-ঈশ্বর হওয়া দেখছি বেশ ঝকমারি!

হ্যাঁ, যে ঈশ্বরই হোন না কেন, যে সম্প্রদায়ের বা যে দেশেরই হোন না কেন, এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নেই। নিরাকার হয়েও পার পাওয়া যায় না।

—-তার চেয়ে তো না হওয়াই ভাল।

—-সেই জন্যেই তো পচাঞ্জন সরদারের কথামতন দফতর শহরে যাচ্ছি।

—-পচাঞ্জন কি আপনার সঙ্গেও তুইতোকারি করেছে?

—-হ্যাঁ, কেন বলুন তো? গায়ের রঙ কালো, উস্কোখুস্কো চুল আর হাটুরে ধুতি দেখে ওনারা তো এমনিতেই তুইতোকারি করেন। কেনই বা আমায় বিশেষ ছাড় দেয়া হবে?

অসহায় গোপালের দিকে তাকাল কুশাশ্ব। পথে, রেডিমেড জামাকাপড়ের প্রথম দোকানটা থেকে দুজনের জন্যে এক সেট করে ট্রাউজার, টি শার্ট আর ট্যাংক জাঙিয়া কিনল। গাময় মিষ্টির রস লেগে চটচটে, স্নান করে পোশাক পালটাতে হবে। নাড়ুঅলার খিড়কি দরজা ছাড়ার সময় থেকে একদল কীর্টনীয়া মাছি ডানার খঞ্জনি বাজিয়ে একঘেয়ে গেয়ে যাচ্ছিল, ‘জামাটা খোল না রে রসিক নাগর, দেহসুধা পান করি…’।

এসব মিষ্টিখোর মাছিদের জানা আছে কুশাশ্বর। এরা ঘোড়া মাছি, এদের ড্যাবডেবে নেশা-করা চোখ দুটো এমন যে মাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাদিগুলো রক্ত খায়। যখন পাথর হয়ে মন্দিরের গায়ে স্হায়ি সঙ্গমকারীর চাকরিতে ছিল, মরদগুলো লিঙ্গের ওপর বসে মধুরস খাবার তালে থাকত; মাদিগুলো এসে বসত পোঁদের ওপর। কিছু না পেয়ে, ভুল বুঝতে পেরে, কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে উড়ে যেত।

তিতকুটে-সবুজ বনবাদাড়ে ঘেরা একটা ঝলমলে-টলমলে সোমথ্থ ঝিলের কাছে পৌঁছলে, গোপাল বলল, আমি নিজেকে একটু লাঘব করে আসছি, আপনি ততক্ষণ স্নানটা সেরে ফেলুন।

হ্যাঁ, হয়ে আসুন, বলল কুশাশ্ব। তারপর খটকা লাগল, ঈশ্বররা কি হাগেন-মোতেন! কে জানে, হয়ত অমন অবিনশ্বর সমস্যার কারণেই ওনারা হয় নিরাকার হয়ে যান, বা পাথর-মাটি-ধাতু-বরফ কোনো আধারকে আশ্রয় করেন। এও কম ঝকমারি নয়। ও নিজেও যখন পাথর ছিল, তখন হাগা-মোতার সমস্যা ছিল না। পান-ভোজনের দরকার হত না তো মলের প্রশ্নই উঠত না।

জামা-প্যান্ট খুলে ঝিলকিনারায় রাখার পর, ওর পোশাক নিয়ে যখন কীর্তনীয়া মাছিরা ‘মিছা মায়া মধুরসে, বন্দী হয়্যা মায়াপাশে, হরিপদে না রহে ভকতি’ গাইতে-গাইতে কাড়াকাড়ি করছে নিজেদের মধ্যে, ওদিকে খেয়াল দিতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল, ব্যাস, সেই ফাঁকে একটা চিকনচাম ঠান্ডাবদন ময়ালসাপ ওকে জড়িয়ে বলে উঠল, এইবার বাগে পেয়েছি তোমায়, আর কোথাও যেতে দেব না, তুমি আমায় শেখাবে কী ভাবে বহুক্ষণ নিজের ল্যাজের ডগায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

—-আঃ ছাড়ুন ছাড়ুন, কাতরে উঠল কুশাশ্ব, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আপনার অশ্লীল আলিঙ্গনের চাপে।

—-ছাড়বই যদি তো এই সাড়ে তিন পাকে ধরেছি কেন? জিভ দিয়ে কুশাশ্বর গাল চাটনির মতন চেটে নিয়ে বলল দাগড়া পোশাকের রয়াল বেঙ্গল ময়াল, মুখ দিয়ে বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে পালকসুদ্ধ দেশি মুর্গি খাবার।

—-আরে, অদ্ভুত মশাই, চিনি না জানি না, গলা টিপে ধরে এ কেমন প্রস্তাব! টু-পিস জিমনাস্টদের কাছে যান না শেখার জন্যে। গোপালের এসে পড়ার প্রত্যাশায় এদিক-ওদিক তাকেয়ে, গলার জাপট ছাড়ারাবার চেষ্টা করতে-করতে বলল কুশাশ্ব। দাঁড়াতে শিখে করবেনটাই বা কী? এই তো বেশ আছেন, সারা জীবন কেবল শুয়ে থেকেই চালিয়ে দ্যান।

—-জানিস না মানে? আমার পেটে যাবার আগে শ্বেতকেষ্ট সিংহ নামের শঙ্কচিলটা বলছিল যে তুই হাজার বছর ধরে অশ্লীল ঢঙে দাঁড়িয়েছিলিস, তুইই ওকে ঠকিয়ে ওর সোনার গোপাল হাতিয়ে পালিয়েছিলিস; সেইটে খোঁজার জন্যে ও মাঠে এসে নেমেছিল, আর আমি ওকে খপ করে ধরে গপ করে খেয়ে টপ করে হজম করলুম, যাতে ইয়ে করার আগে গায়ে একটু গত্তি লাগে।

—-তার মানে তো আমি আপনার উপকার করেছি।

—-আমাকে ভড়কি দিসনি। আমার নাম স্বপ্ননীল বাজারি, বুঝলি। সব বাজারের সব্বাই আমাকে এক হাঁকে চেনে। এখন ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে প্রেম করার তরকিবটা বল।

গায়ে মিষ্টি রস লেগে থাকের দরুণ স্বপ্ননীল বাজারির জাপটটা যে পিছলে যাচ্ছে তা টের পাচ্ছিল কুশাশ্ব। এ-ব্যাটার সাড়ে তিন পাক থেকে ছাড়ান পাবার একটাই উপায়। সেটাই করল ও। আচমকা নগণ্যা হয়ে গেল। ফলে আলিঙ্গনের প্যাঁচ ফসকে টুপুস করে পড়ল গিয়ে ঝিলের জলে।

আশেপাশে কিলবিলে চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল যে নীলচেসবুজ ব্যাঙাচিদের জলহুল্লোড়ে গিয়ে ও, কুশাশ্ব, পড়েছে। আমাদের উত্তমকুমার, আমাদের সৌমিত্তির, আমাদের বুম্বাদা, আমাদের জিৎ, আমাদের শারুখ, আমাদের সালমান, আমাদের আমির, আমাদের অভিষেক, আমাদের ইমরান, আমাদের শাহিদ, আমাদের রণবীর বলে-বলে লুকুচিগান করতে লাগল মারমেইড ব্যাঙাচিবৃন্দ।

শিতকালে ব্যাঙাচি! বিস্মিত হল কুশাশ্ব। স্বপ্ননীল বাজারীরও তো শীতে কম্বল চাপা দিয়ে গর্তের পালঙ্কে বা ঝাড়ের দোলনায় ঘুমোবার কথা। ঋতুগুলো হয়ত সবাইকে বোকা বানিয়ে ক্যালেন্ডারে জায়গা বদল করে নিয়েছে।

ভাগ্যিস ময়ালের স্টকে ছোবল নেই। নইলে আর দেখতে হত না। জলেতে এক কোপ ছলাৎ মেরে কপাৎ দিলেই তো এক ঝাঁক ভারজিন মারমেইড ব্যাঙাচিদের সঙ্গে স্বপ্ননীল বাজারির এসি মার্কেটে, যেখানে মাথায় রেডইন্ডিয়ানদের মতন পালকের মুকুট পরে রাঙাচোখো শঙ্খচিলটা, শ্বেতকেষ্ট সিংহ, রেগে হালুয়া হয়ে বসে আছে।

ব্যাঙাচি মারমেইডগুলো হাত-ধরাধরি করে নগণ্য কুশাশ্বকে বৃত্তাকারে ঘিরে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গাইতে থাকে পানা-বীথিকার সবুজ টলটলে ছায়ায়। গানটার এমনই অলস নিশিডাক যে ব্যাঙাচি মারমেইডদের বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান কুশাশ্বর হাতদুটো একবার বাঁদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায় তো একবার ডানদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায়। ভালই চলছিল ওর জলনাট্য। একটা দশ কিলো কাৎলা ওকে বিনা বঁড়শির টোপ মনে করে মুখে ঢুকিয়েই ফেলে দিল, থু-থু করে; বলল, শালা তেতো মনুষের বাচ্চা কোথাকার! এদিকে বিনা নোটিসে অমন ঝপাং তোলায় মারমেইডরা যে যার ল্যাজ-লজ্জা বাঁচিয়ে ছত্রভঙ্গ।

থু-থু করে দূরে ছোঁড়ার ফলে কুশাশ্ব পড়বি তো পড় একটা গর্তের একেবারে ভেতরে। ভয়ে কাঁটা। ভাবল, নিশ্চই কোনো ছোবলধারী সাপের বা দাঁতবের-করা শেয়ালের আড্ডায় গিয়ে পড়েছে, আর সে-ব্যাটা দাঁত বের করে জব্বর ঘুম দিচ্ছে। যে-দিক থেকে আলো আসছিল, সেদিক দিয়েই বেরোবার পথ আঁচ করে ল্যাংটো পোঁদে পড়িমরি দেদ্দৌড় লাগাল। ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই; শুনতে পেল লোকজনের কথা বলার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে, ওই দিকেই গমগম করছে আলো।

গর্তটা হয়ত কোনো বদলি-হওয়া সরকারি বা বেসরকসরি প্রাণির। কিংবা ভুতুড়ে ছমছমিয়া টানেল মনে করে একমাংসবর্তী জীবরা ছেড়ে চলে গেছে নতুন নিকোনো গর্তে। কিংবা সুন্দরী লুমলুমে শেয়ালনির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া যুবরাজ শেয়ালের। কিংবা পুলিশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গিরগিটির, যে সন্ন্যাসী হয়ে খাইবার পাসের পাথুরে ডেরায় ছররা-মালা জপতে গেছে। যাই হোক, গর্ত থেকে মাথা বের করে কুশাশ্ব দেখল যে ওপরে জায়গাটায় মেলা বসেছে, আর গর্তের হাঁ-মুখের এপাশে-ওপাশে-চারিপাশে নানা রকমের নানা রঙের নানা মাপের খেলনা সাজানো, বেশির ভাগই একটা পেল্লাই-ভুঁড়ি টাকমাথা লোকের ছোট-ছোট চেহারা।

সবকটা মূর্তিতেই চিকনা-টেকোটা গাল ফুলিয়ে হাসছে। দু-হাত ওপরে তুলে নিতাই-গৌর হয়ে, পাশবালিশে হাঁটু রেখে বসে, বাবু হয়ে ভুঁড়ি ঝুলিয়ে বসে, তা সে যত রকমের পোজ হতে পারে তেমন করে, কায়দা করে গাল ফুলিয়ে হাসছে ভুঁড়িদাস থলথলে টাকলুটা। হাসছে তো হাসছেই।

কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে কি না জানার জন্যে বুক পর্যন্ত গর্ত থেকে বেরিয়ে ইতিউতি দেখছিল কুশাশ্ব। ভেবেছিল কারোর নজর না পড়লে বেরিয়েই পৌ২পা ছুট মেরে গিয়ে লুকোবে সামনের টিপ নখপালিশ লিপস্টিক শ্যাম্পু ডেওডোরেন্ট ময়েশ্চারাইজার বিক্রির মেয়েভুলোনো দোকানটায়। তারপর এক ফাঁকে কোনো দোকানে লুঙ্গি বা পাজামা বা নিদেন একটা হাফপ্যান্ট যোগাড় করে প্রমাণ-মাপের মানুষ হয়ে মেলার ভিড়ে মিশে যাবে।

তা আর হল না। কাছাকাছি যে টেকো গালফোলা ভুঁড়িদাস খেলনাটা ছিল সেটা খপ করে ধরে ফেলল কুশাশ্বকে। আর ও, কুশাশ্ব, ভয়ে কেলিয়ে গিয়ে, ভৎ করে নিজেকে আবার গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। তার ফলে যা হল তা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।

গালফোলা হাসিমুখ টেকোটা, যে কুশাশ্বর চুলের মুঠি ধরেছিল, ডিগবাজি খেয়ে সরুসুড়ঙ্গে পড়ল গিয়ে কুশাশ্বর ঘাড়ের ওপর। দুজনে গড়াতে-গড়াতে বেশ খানিকটা ঢুকে গেল টানেলেরভেতর। গড়ানো থামলে, কুশাশ্ব শুনতে পেল টেকোটা অট্টহাসি হাসছে। সে কী জোরে-জোরে হাসি। গমগম করতে লাগল গর্তপথ। হাসছে তো হাসছেই। হাসছে তো হাসছেই।

কুশাশ্ব প্রথমে ভেবেছিল যে ও উদোম ল্যাংটো বলে ভুঁড়িদাসটা বসে-বসে হাসছে। কিন্তু আবছা আলোয় লক্ষ করল যে টেকোটার গায়েও এক চিলতে কাপড় নেই। কেবল ঝোলা ভুঁড়িতে ওর লেংটুটা ঢাকা পড়ে গেছে।

—-আপনি কে? আমাকে বেরোতে দিলেন না কেন? কোনো মানে হয় এ রকম আচরণের? বিরক্ত কুশাশ্ব জবাবদিহি চাইল।

জবাব দেবার বদলে লোকটা নিজের অট্টহাসি বজায় রাখল।

—-আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। আমি কথা বলছি আর আপনি শুধু বোকার মতন এনামেল হাসি হাসছেন।

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আরে। কী মুশকিল। এরকম হাসাহাসির আবার কী ব্যাপার হল?

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-দেখুন, আপনার মাওসেতুঙি হাসিটা এবার থামান। আপনি কে মশাই? আমাকে বিপদে ফেলে হাসছেন। আপনার তো দাঁতও নেই দেখছি যে বলব দাঁত বের করে হাসছেন।

—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

কুশাশ্ব ভাবল হাসছে হাসুকগে। এক সময় তো চোয়াল ব্যাথা হয়ে থামবে। মাটির দেয়ালে ঠেসান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ফোকলাটার হাসি থামার নাম নেই। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, তিরিশ মিনিট, চল্লিশ মিনিট, পঞ্চাশ মিনিট, কতক্ষণ ধরে টেকোটা টানা হেসে গেল কে জানে।

—-চুপ করুন, ফুলকো হাসি থামান। ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।

জোরে-জোরে হাসি থামাল বটে লোকটা, কিন্তু ফিকফিকে মেটেল হাসি বজায় রাখল গাল ফুলিয়ে।

—-আপনি কে? কী চান? সরাসরি জানতে চাইল কুশাশ্ব।

—-লাঃ ফিং বু ঢ ঢো ঢা। লোকটা এমনভাবে দমফাটা হাসি মিশিয়ে কথাগুলো বলল যে কী বলছে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না কুশাশ্ব।

—-বুঢঢা বুঢঢো, কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-বুঢঢো? বুদ্ধ? না বুঢঢা?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-গৌতম বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-বামিয়ান বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-হীনযানের বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-মহাযানের বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-শাক্যমুনি বুদ্ধ?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-এই যে বললেন লাফিং বুঢঢা?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-লাফিং বুঢঢাই শিওর তো?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-একশো ভাগ নিশ্চিত?

—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আমাকে আটকে দিলেন কেন?

—-গোপাল এই পথ দিয়ে যাবার সময় বললেন আপনি এই গর্ত দিয়ে বেরোবেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-তাতে কী? আমি বেরোতে চাইছিলুম। আপনি অযথা বাগড়া দিলেন।

—-আমাকেও দফতরে ডেকে পাঠিয়েছে। পচাঞ্জন সরদার হুকুম জানিয়ে গেছে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….

—-আপনাকেও? স্তম্ভিত কুশাশ্ব চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে ফ্যালে। এখন বের হব কেমন করে? পোশাকই বা যোগাড় হবে কী ভাবে? আপনি তো এমন থপথপে যে আপনার দ্বারা কিছু হবে বলে মনে হয় না।

পাকা সন্ধ্যার থকথকে অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। হাসি বজায় রেখে বলল লাফিং বুঢঢা। তারপর মেঝেয় শুয়ে, বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকতে লাগল। নাক ডাকা শুনে ভয় হল কুশাশ্বর। ব্যাঙাচিগুলোর মা-মাসি-পিসিরা আবার মেটিং-কল মনে করে না হপহপ ফপফপ করতে-করতে চলে আসে।

এক সময়ে কুশাশ্বও ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল যখন, তখন একটা মেঠো মাদি ইঁদুর পায়ে চিমটি কেটে বলল, এই আপনারা এভাবে যাতায়াতের রাস্তা ব্লক করে রেখেছেন কেন? আর এটা তো দেখছি অকম্মের ঢেঁকি লাফিং বুঢ়ুয়া, ও আবার এখানে কী করতে এসেছে? তারপর কুটিপাটি ইঁদুরদেঁতো হাসি হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, আজকে তো যতদুর জানি দফতর থেকে অবরোধের হুকুম জারি হয়নি, রাস্তায়-রাস্তায় তাহলে তো ক্লাবের ছেলেরা ঝান্ডার ডান্ডা নিয়ে জনমনিষ প্যাঁদাতে বেরোত!

ইঁদুরের পেছন-পেছন ওরা দুজন গর্তের মুখ পর্যন্ত গিয়ে দেখল মেলাচত্বর ভোঁভাঁ, বাইরে শীত-রাতের শীতে কাহিল আঁধিয়ারি অন্ধকার ঘুটুরঘুটুর করছে। ঝিঁঝিরা বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঝিঁঝিট-রাগে খেয়াল গাইছে। বাইরে বেরিয়ে দুজনেই একসঙ্গে প্রমাণ মাপের মানুষ হয়ে উঠতে, ‘তাজ্জব ব্যাপার’ বলে চলে গেল মাদি ইঁদুরটা, কেননা মানুষের শরীর থেকে ইঁদুরলিঙ্গহীন ইঁদুর ঝুলতে ও-ও নিজের এত বছরের ধান চুরির অভিজ্ঞতায় দেখেনি।

দূরে দপদপে অথচ টিকিসটিকিস আলো জ্বলতে দেখে, ভৌতিক অন্ধকারের মেঠো সুযোগ নিয়ে, দুজনে সন্তর্পণে সেই দিকে এগোল। আলো জ্বলতে-থাকা প্রথম ঘরের জানলা দিয়ে ডেখল, একটা লোক খাটের ওপর দলীয় পতাকা বিছিয়ে আঙুলে মুচকি-হাসি মাখিয়ে নোটের থাক সাজাচ্ছে। এবাড়িতে খাওয়া-পরা-থাকার যোগাড়-যন্তর করা মুশকিল। পোশাক হাতানোটাও কঠিন।

পরের বাড়িটায় পৌঁছে জানলা দিয়ে দেখল, এক প্রৌঢ় দম্পতি সান্ধ্য-সঙ্গমে মশগুল। সঙ্গমকালীন পরিবেশ গড়ার জন্যে আলোও টিমটিমে লিকলিকে। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, দম্পতির খুলে-রাখা পোশাক টেনে নিল ওরা। প্রৌঢ় দম্পতির লীলেখেলা দেখে লাফিং বুঢঢা মুখে না হেসে কেবল ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসছিল। শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পরে নিল কুশাশ্ব। মহিলার শাড়ি লুঙ্গির মতন করে পরে গায়ে আলোয়ান চাপা দিয়ে নিল লাফিং বুঢঢা। তারপর যেদিক থেকে ভারি ট্রাক চলাচলের শব্দ আসছিল সেদিকে রওনা দিল দুজনে।

পৌঁছল জাতীয় সড়কে, কে জানে কত নম্বর, যাচ্ছে আসছে যানবাহন। সরকারি গাড়ি প্রায়ভেট গাড়ি। টেম্পো ট্রেকার জিপ। ডিজেল পেট্রল সিএনজি। কিন্তু কোন দিকে দফতর শহর? হাত দেখানো সত্বেও থামছে না কোনো গাড়ি। হেড লাইটের আলোয় ওদের দেখতে পেয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাতের বেলায় গণতন্ত্র আরও বেশি গণতন্ত্র হয়ে যায়। রাস্তার অন্য পারে গিয়ে হাত দেখিয়েও কোনো কাজ হল না।

—-দাঁড়ান, কোন দিকে হাঁটতে হবে আমি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্ণয় দিচ্ছি, হাসতে-হাসতে কথা কটা বলে আবার হাসতে-হাসতেই এই ফরমুলাটা বলল লাফিং বুঢঢ: ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি, রেল কম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম’। তারপর নির্ণয় নিল, এই দিকে গেলে পা পিছলে আলুর দম হবে, তাই আমাদের হাঁটতে হবে উল্টো দিকে।

যেমন বলা তেমনি কাজ। বজ্রবাঁটুল বিজ্ঞের বৈজ্ঞানিক বাতেলা বলে বাক্যি। ঢং-ঢাঙাতিদের থেকে বাঁচতে হলে বিজ্ঞানের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। কম্ম কেয়াল করতে হবে তো! অতএব বাগড়া-বাগড়ি না করাই ভাল। দুজনেই তো এখন সোঁতের শ্যাওলা । আরম্ভ হল হাঁটা দেয়া।

হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। কোনদিকে দফতর শহর তার নির্দেশবোর্ড নেই কোথ্থাও। খানিক পরে-পরে কেবল মাইলপাথর।তার ওপর যৌনরোগ সারাবার পোস্টার, যার দরুন কী লেখা পড়া কঠিন। যেটুকু বা পড়া গেল কয়েকটায় তাতে অচেনাসুলভ অচেনা জায়গার নাম। আরও হন্টন। লাফিং বুঢঢা রাস্তার পাশে বসে পড়ে বলল, আর পারছি না গো, আপনি বরং এগোন, আমার ভুঁড়ি আর ওজন বইতে পারছে না। মুখে গালফোলা অটুট, কিন্তু হাসি উধাও। ইচ্ছে তো কুশাশ্বরও হচ্ছিল বসে পড়তে। লাফিং বুঢঢার দেখাদেখি ও-ও বসে পড়ল। একটু পরে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ল দুজনে।

লাফিং বুঢঢা সতর্ক করল কুশাশ্বকে, ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন, শেষে জন্তু-জানোয়ার টেনে নিয়ে যাবে। বরং গল্প করা যাক, কী বলেন। আমি একটা গল্প বলছি। হয়ত গল্প শুনতে-শুনতে জেগে থাকবেন। রসিয়ে-রসিয়ে গল্প বলা আরম্ভ করল লাফিং বুঢঢা।

অনেক অনেক অনেকদিন আগেকার কথা। আমাদের দেশে এক নেতার চারটে ছেলে ছিল। তারা ছিল পরস্পরের জিগরি দোস্ত। সবসময় মিলে-মিশে থাকে। মলে যায়, মাল্টিপ্লেক্সে যায়, ডিসকোথেকে যায়, নাইট ক্লাবে যায়, বেশ্যালয়ে যায়, ভোট দিতে যায়, পিকনিকে যায়, বাজি পোড়াতে যায়, চিনা রেস্তোরাঁয় যায়, লং ড্রাইভে যায়, সালসা নাচতে যায়, সর্বত্র এক সঙ্গে যায়।

ওদেরও নেতা বানাবার আগে ওদের বাপ ট্রেনিঙে পাঠাল। নেতা বাপ দেশের টাকাকড়ি-সোনাদানা মেরে লুকিয়ে রেখেছিল; আর সব নেতারা যা করে এই নেতাও সেই সব কুকম্ম করে জীবনে উন্নতি করেছিল। তাই ভাবল ছেলেদের এবার পথ দেখানো দরকার। তাহলেই তো দপতর শহরে গদির আলো পাবে; নয়তো থাকতে হবে অন্ধকারে। ছেলেদের পাঠিয়ে দিল নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী।

যেতে যেতে, যেতে যেতে, যেতে যেতে, এক জায়গায় ছেলেগুলো দেখতে পেল জটায় শ্যাম্পু, গলায় মুক্তা-পান্না-চুনীর হার, গায়ে সিল্কের আলখাল্লা, মেট্রোসেক্সুয়াল পারফিউম মেখে, একজন লোক মাইক বাজিয়ে শিষ্য যোগাড় করছে। উপস্হিত শিষ্যরা জানাল যে উনি সিদ্ধযোগী।

চারজন প্রণামী দিয়ে বলল, মহারাজ, আপনি তো গুরু লোক, অনেককে পার পাইয়ে দিয়েছেন। আমারাও আমাদের বাপের মতন নেতা হয়ে নেম-ফেম-ব্লেম-শেম কামাতে চাই । আপনি একটু ট্রিকগুলো বাতলে দিন। গডম্যান সন্তুষ্ট হয়ে ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে টর্চ দিবে বলল, তোরা এক কাজ কর। চারজনে দফতর শহরের দিকে এগিয়ে যা। যেখানে যার টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে, সেখানে সে খোঁজ করলেই অঢেল লুকোনো টাকাকড়ি-সোনাদানা পাবে। ব্ল্যাক থেকে হোয়াইট করার টাকার পাহাড়।

গডম্যানের কথামতন চারজন মিলে যাত্রা আরম্ভ করল। তিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায় , হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। এক জায়গায় একজনের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সেখানে মাটি খুঁড়ে নতুন-পুরানো অঢেল তামার কয়েন পাওয়া গেল। সে অন্য ভাইদের বলল, চল, তামার কয়েনের এই স্টক নিয়েই দেশে ফেরা যাক। নতুন-পুরানো তামা বেচে প্রচুর মাল কামানো যাবে।

অন্য ভাইরা বলল, তুই এসব ফালতু তামার কয়েন নিয়েই থাক। আমরা দেখি আরও দামি জিনিস পাওয়া যায় কিনা। যে তামার কয়েন পেয়েছিল, সে সেগুলো ট্রাক বোঝাই করে বাড়ি ফিরে গেল।

বাদবাকি তিন ভাই এগিয়ে চলল। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আরেকজনের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে সেখানে পেল রূপোর গয়না আর কয়েনের অঢেল স্টক। সে বলল, ভালই হল রে, চল রূপোর কয়েন গয়না আর বাসনকোসন ট্রাকে লোড করে দেশে ফিরি। অন্য দুই ভাই বলল, দূর বোকা, তোর যাবার হয় যা, আমরা আরও বেশি মালকড়ির জন্য এগোচ্ছি। দ্বিতীয় ভাই একাই ফিরে গেল গোটাকতক ট্রাকে লোড করে।

আরও কিছুটা যাবার পর তৃতীয় ভাইয়ের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে জায় গাটা খুঁড়াখুঁড়ি করে পেল সোনার অজস্র কয়েন আর অলংকার। চতুর্থ ভাইকে সে বলল, চল, আর কি, এ-জিনিস তো মালামাল করে দেবে আমাদের, নেতাগিরিতে ফেল মারলেও ক্ষতি নেই। চার নম্বর ভাই বলল, তুই ফিরে যা, এরকম এক-এক করে পাচ্ছি যখন তার মানে আরও দামি-দামি হীরে-জহরত ঘয়নাগাটি পাবো। তৃতীয় ভাই ফিরে গেল ট্রাক লোড করে।

চার নম্বর ভাই একলা এগিয়ে চলল টর্চ হাতে। অনেক দূর চলে গেল। টর্চ নেভার নাম নেই। শেষে টর্চ যখন নিভু-নিভু, দেখতে পেল বিটকেল চেহারার একজন লোক তার সামনে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে। লোকটার মাথার ওপর একটা নীল রঙের চাকা, যাতে স্পোক রয়েছে, আর তা লোকটার মাথার ওপর বাঁই-বাঁই করে আপনা থেকে ঘুরছে । চতুর্থ ভাই অবাক। জিগ্যেস করল, মশাই আপনি কে? আপনার মাথার ওপর আপনা থেকে ঘুরছে ওটা কী? চার নম্বর ভাইয়ের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই লোকটার মাথা থেকে চাকাটা ছুটে এসে ওর মাথার ওপর বনবন করে ঘুরতে লাগল।

মাথার ওপর অসহ্য চাপ বরদাস্ত করতে না পেরে আর্তনাদ করে উঠল চার নম্বর ভাই, ওরেব্বাপ, এতো ভিষণ ভারি,মাথা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়, গা গুলোচ্ছে, সইতে পারছি না।

লোকটা বলল, আমার কিছু করার নেই, তোমার আদর্শবাদী সর্বনাশ তুমি নিজেই ডেকে এনেছ। আমিও এককালে তোমার মতন টর্চ হাতে আদর্শের নেশায় এখান অব্দি এসেছিলুম। এবার বাঁচা গেল। আমার জায়গাটা তুমি পেলে। এখন মাথার ওপর ওই চক্র নিয়ে মজা করো। যদ্দিন না কোনো রাজনৈতিক আদর্শবাদী এসে তোমার কাছ থেকে চক্রটা নিজের মাথায় তুলে নিচ্ছে, তদ্দিন ওখানে দাঁড়িয়ে দুঃখকষ্ট জ্বালাযন্ত্রণা আত্মগ্লানি ভোগ করো। আমি চললুম, টা-টা, বাই-বাই।

গল্প শেষ হতে চারিদিক থেকে ঝিঁঝিপোকাদের সুরেলা গান ভেসে আসতে লাগল, ‘ঘুমঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মায়ায়ায়াবি রাত….’। ঘুমিয়ে পড়ল কুশাশ্ব। পরের দিন রোদ যখন রোদাতে-রোদাতে ওর গায়ে এসে ছিস করে ঠেকল, তখন ওর ঘুম ভাঙল। উঠে বসল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল। লাফিং বুঢঢা আবার কোথায় গেল। ও-ও কি হাগতে বেরোল গোপালের মতন? ধাতু বা চিনামাটির স্হায়ীত্বের মল বলে কথা, এঁটে এঁটেল হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু রাস্তার দুপাশ তো ফাঁকা। খেতগুলোয় কোথাও আড়াল করার মতন ঝোপজঙ্গল নেই। হঠাৎ নজর গেল পায়ের কাছে পড়ে থাকা চারটে পেনসিল টর্চ ব্যাটারির দিকে। তুলে দেখে চারটে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাটারি, এক্সপায়ার করে গেছে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আগেই, তলার দিকটা সবকটার গলে গেছে।

জুতো-চটি কিছু নেই পায়ে। শীতকাল হলে কী হবে, চলার পথ তেতে গেছে এর মধ্যে। কয়েক-পা হাঁটল কুশাশ্ব। বেশ গরম। হাঁটা মুশকিল। কী করা যায়! খিদেও পাচ্ছে। সড়কের পাশ দিয়ে ধুলোর ওপর হেঁটে এগোল যতটা পারা যায় । বহুদূর থেকে কিছু আসছে দেখে দাঁড়িয়ে থাকল। কাছাকাছি হলে টের পেল, দশ-বারোটা উট নিয়ে এদিকেই আসছে একটা লোক, পরনে নোংরাটে মেটরঙা ধুতি আত কোঁচদেয়া হাফ-পাঞ্জাবি, মাথায় হলদে রঙের পাকানো কাপড়ের পাগড়ি।

উটগুলোকে আর লোকটাকে হাত দেখিয়ে থামাল কুশাশ্ব। জিগ্যেস করল, আচ্ছা আপনি কি একজন টাকমাথা গালফোলা ভুঁড়িদাস বেঁটেমতন ফর্সা লোককে দেখেছেন?

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যে বোঝা গেল না হ্যাঁ বলছে, না, না বলছে।

বছর কুড়ির একটা অতিবৃদ্ধা উট যার পিঠে দুটো কুঁজ, বলল, বাবু, আমাদের এখানে সবাই পাগড়ি পরে, কারোর টাক দেখার উপায় নেই, পাগড়ি হল টাকের অন্তর্বাস।

উদ্বিগ্ন কুশাশ্ব জিগ্যেস করল, দফতর শহরটা কোন দিকে বলতে পারেন? ওই দিকে যাবো, না, এদিকটায়?

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে জানে না হতে পারে, আবার জানেও হতে পারে।

দুকুঁজো উট বলল, বাবু আমি দফতর শহরটা জানি না, কিন্তু দফতর শহরের দেশটা জানি। একবার আমায় চুরি করে ওই দেশে তাড়িপার করাতে নিয়ে গিয়েছিল।

—-তাড়িপার?

—-হ্যাঁ বাবু, আমাদের তাড়িয়ে-তাড়িয়ে ওই পারে পাঠাচ্ছিল, ওই পারের লোকেরা পরবের দিন খাবে বলে। কিন্তু গোপনে খবর পেয়ে পুলিসে আমাদের আর সেই সঙ্গে আরও সাতজন উটকুমারীকে বর্ডারের ব্রথেল থেকে উদ্ধার করেছিল।

—-উটের মাংস খাওয়া যায় নাকি? ও তো ছিবড়ে হবে।

—-না বাবু, উটের মাংস সুস্বাদু আর নরম। উটের দুধও কনডেন্সড মিল্কের মতন।

—-উটের দুধ খাওয়া যায়?

—-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ওই সোমথ্থ উটনির থনে মুখ লাগিয়ে দেখুন না।

মুখ টিপে হেসে সোমথ্থ উটনি বলল, ধ্যাৎ, আমার লজ্জা করে। বাবু আপনি চোখ বুজে খাবেন, আমার মুখের দিকে তাকাবেন না। লোকখিটি।

ছুটে গিয়ে ঠোঁটব্যাকুল বাঁট মুখে পুরে চুষতে-চুষতে পাথরজীবনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, যেন ঠোঁট চুষছে, পেট ভরে দুধ খেল কুশাশ্ব। কখন কোথায় খাবার-দাবার পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই।

ঢেঁকুর তুলে উটমালিককে কুশাশ্ব বলল, আমার পায়ে জুতো নেই, আমি কি কোনো উটের পিঠে বসতে পারি? পথে যে গঞ্জ হাট শহর গ্রাম স্টেশান খেয়াঘাট বা বাস ডিপো পড়বে সেখানে নামিয়ে দেবেন।

উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে হ্যাঁ-ও হয়, আবার না-ও হয়।

দু-কুঁজো উট মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, বাবু আসুন, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে জুতোর দোকান আছে। আপনি সেখান থেকে নানা জায়গায় যাবার গাড়ি পাবেন।

দুটো কুঁজের মাঝখানে বসে, সামনের কুঁজ আঁকড়ে ধরে, ধন্যবাদ জানাতে, দু-কুঁজো জিগ্যেস করল, বানুর কী করা হয়?

কুশাশ্ব: প্রেম করি।

দু-কুঁজো: প্রেম>

কুশাশ্ব: হ্যাঁ, অষ্টপ্রহর প্রেম।

দু-কুঁজো: এখন কী প্রেম করতেই যাচ্ছেন?

কুশাশ্ব: না, অমন প্ল্যান করে প্রেম হয় না, হঠাৎ-হঠাৎ হয়ে যায়ল

দু-কুঁজো: আমরা তো দিনকতকের জন্যে হিটে আসি, তখনই প্রেম করি। প্রেমের ঋতু হয়।

কুশাশ্ব: আমার প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে প্রেমের ঋতু।

উটের কাফিলা পৌঁছোল এক গঞ্জ-শহরে। জুতোর দোকান দেখতে পেয়ে নেমে পড়ল কুশাশ্ব। একজোড়া নাগরা জুতো কিনল, শুঁড়তোলা। তারপর, নানা লোককে জিগ্যেস করেও যখন দফতর শহরের হদিশ পেল না, তখন দাঁড়াল গিয়ে ডিপোর ছাউনিতে। লাফিং বুঢঢার ফরমুলা অনুযায়ী যে-দিকটা পা পিছলে আলুর দম হল তার উল্টো দিকে যাবার গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

ট্রাক আসে , যায়। বাস আসে, যায়। অটো আসে যায়।ট্যাক্সি আসে, যায়।টেম্পো আসে, যায়। রিকশা আসে, যায়। টাঙ্গা আসে, যায়। সবই পা পিছলে আলুর দমের দিকে। একবার কুশাশ্বর মনে হল, চলে যাই শালা আলুর দমের দিকেই। পরক্ষণেই মনে হল, বিজ্ঞানের নির্দেশিকা অমান্য করা অমানুষের কাজ।

একজন রোগা ডিগডিগে লোক এসে দাঁড়াল কুশাশ্বর পাশে। সাড়ে-পাঁচ ফিট লম্বা হবে।শাদা ফুল শার্ট কালো প্যান্ট। এত রোগা যে মনে হচ্ছিল লোকটার চেহারার শুধু দুটো ডাইমেনশান। সামনে আর পেছন। ঠিক যেন তালপাতার সেপাই। পুতুলনাচের পুতুলের মত অঙ্গভঙ্গী। মাইকেল জয়াকসন বা প্রভু দেবা নাচের সময় যে-ভাবে হাত-পা নাড়ায়। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। এর কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে ভেবে আলাপ শুরু করতে চাইল কুশাশ্ব।

—-আপনি কোথায় যাবেন?

—-আপনার তাতে দরকার?

—-না, মানে, আমি দফতর শহরে যাবো তো, তাই।

—-তা যান না, কে বারণ করেছে?

—-আসলে কেউ বলতে পারছে না।

—-আমি তাতে কী করব?

—-আপনি যদি একটু বলেন।

—-জানলে তো বলব।

—-এরকম রুষ্ট হচ্ছেন কেন?

—-আপনি বিরক্ত করছেন বলে।

—-আমি কিন্তু একজন প্রেমিক। আমার নাম কুশাশ্ব দেবনাথ। গুপ্তহাসি হেসে ও বলল।

—-আমার নাম গিলগামেশ। আমি দুই-তৃতীয়াংশ দৈব আর এক তৃতীয়াংশ নশ্বর। ইচ্ছেমতন ছোট-বড় হই।

কথাটা শুনে কুশাশ্ব স্তম্ভিত। লোকটা তো ওর চেয়েও দেড় হাজার বছর আগের। কিন্তু এই কি গিলগামেশের চেহারা, যে কিনা খালি হাতে সিংহ মেরে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। সারাজীবন বেঁচে থাকার জন্যে কত কত কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে গিলগামেশ; ম্যাজিক-ছোঁয়ানো লতাপাতা খুঁজে বের করেছিল, অমর হয়েছিল, অনেক টাকাকড়ি করেছিল। অথচ গিলগামেশ আসলে কাগুজে ল্যাংপ্যাঙে টিংটিঙে, দু-অবিনশ্বর ফুরিয়ে এর অবিনশ্বরে ঠেকেছে।

—-আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। আপনার অ্যাডভেঞ্চারের কথা অনেক শুনেছি। গিলগামেশকে প্রীত করার জন্যে ঠৌঁট টিপে হেসে বলল কুশাশ্ব।

মনে হল তেল লাগানোটা কাজে দিয়েছে। দাঁতখিঁচুনির বদলে দেঁতো হাসি হেসে গিলগামেশ বলল, দফতর শহরে আমারও কাজ আছে, সেখানেই যাব, কিন্তু কিসে চেপে কী ভাবে যাব জানি না।

আপনাকে কি পচাঞ্জন সরদার যেতে বলেছে? নৈকত্য বাড়াবার চেষ্টা করল কুশাশ্ব।

হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন? সিংহ-মারা তেজ বাদ দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল গিলগামেশ।

আমাকেও হুকুম করেছে। আপনার সঙ্গেও কি তুই-তোকারি করেছে?

হ্যাঁ, ওনারা দলতন্ত্রের অধিকার প্রয়োগ করছেন। অপহসিত হাসি হেসে বলল গিলগামেশ।

অবাক হল কুশাশ্ব। গিলগামেশ বলে কথা। যে কিনা খালি হাতে সিংহ মারে। তার সঙ্গেও তুইতোকারি। কত ক্ষমতা অছিসিংহাসনের, বাপরে বাপ, ওই ক্ষমতার জোরে কালো-কেল্টে ঘুরঘুরে পোকাও রোয়াব ঝাড়ছে।

কুশাশ্ব নিজের ফরমুলা শুনিয়ে কোনদিকে যেতে হবে সে-বিষয়ে মতামত জানাল। গিলগামেশ বলল, ও-ও ওই দিকটাই নিজের বৈজ্ঞানিক ফরমুলা প্রয়োগ করে বাছাই করেছে, যেটা ও সিংহ শিকারের আগে পরীক্ষা করে নিত। ফরমুলাটা হল, ‘গোদা নাটাটা পা ফাটাটা অড়ল বনের ধারে কুচুৎ করে কানটি কেটে নুনের ভাঁড়ে পোরে।’ আলুর দম আর ভাঁড়ে পোরা একটিই দিক নির্দেশ করছিল। সেদিকে যাবার একটা জিপ-ট্যাক্সি এসে থামল, প্যাসেঞ্জারে এমন গাদাগাদি যে কার মুখ কোথায় আর ঠ্যাঙ কোথায় টের পাবার উপায় নেই।

ওরা দুজনে পেছন থেকে ডাইভ দেবার ঢঙে গোঁতা মেরে জোরজবরদস্তি ঢুকল জিপ-ট্যাক্সির ভেতরের ঠাসাঠাসি ভিড়ে। হাফশয়নম-হাফপতিতম অবস্হা । ধাতস্হ হতে টের পেল, এটা মহিলাদের স্পেশাল ট্যাক্সি। ততক্ষণে কিল-চড়-থাপ্পড়-ঘুষি-লাথি আরম্ভ হয়ে গেছে। গিলগামেশ কানেকানে কুশাশ্বকে বলল, দেবনাথবাবু, যেতে তো হবেই, দফতরের হুকুমের টালাবাহানা করার যে কি বিপদ তা তো জানেন। তাই বলে মহিলাদের হাতে প্যাঁদানি খেলে ইতিহাস আমায় আস্ত রাখবেনা; আমার খালি হাতে সিংহ মারার খ্যাতি সব জলে যাবে। এমনিতেই ইতিহাসকাররা আমাকে কুরে-কুরে গবেষণা করে এরকম রোগাপাৎলা করে দিয়েছেন।

জুতো খুলে, গিলগামেশের কব্জি শক্ত করে ধরে কুশাশ্ব পরামর্শ দিল, আমি এক দুই তিন গুনছি। তিনের মাথায় একসঙ্গে ছোট্ট হয়ে যাবো দুজনে। ওকে? রেডি, এক…দুই…তিন ।

নিমেষে ছোট্ট হয়েই, খোলা স্প্রিঙের মতন বিঘত খানেক লাফিয়ে এক যুবতীর দুই স্তনের মাঝখানে দুজনে হাত ধরাধরি করে পিছলে পড়ল। কাতুকুতু হেসে যুবতীটি পাশের মেয়েটিকে বলল, অ্যাই, ভালো হবে না বলছি। পাশের মেয়েটা বলল, ওমা, আমি আবার কী করেছি!

স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ টপের ভেতরে পড়ে দুজনে পিছলে নেমে আটকে গিয়েছিল পুশ-আপ ব্রাতে। টপের কাপড় ধরে ঝুলতে-ঝুলতে ওরা উঠে বাঁধুনি আঁকড়ে শুনতে লাগল যুবতীদের কথাবার্তা। দেখতেও পাচ্ছিল যুবতীদের, উঁকি দেয়ে। বোধহয় স্নাতকোত্তর ছাত্রী। কিংবা মডেল-মেয়ের দল চলেছে কোনো হোটেলে র‌্যাম্পের ওপর বিল্লিহাঁটন দিতে।

—-জলজ্যান্ত দু-দুটো মরদ, বেমালুম উবে গেল যে রে। বলল, হল্টারনেক।

—-এরা দুজনে মিলে কিলোচ্ছিল-লাথাচ্ছিল। অভিযুগ তুলল সি-থ্রু আকাশি ব্লাউজ।

—-কিলোব না তো কি! লেডিজ স্পেশালে ঢুকবে আর পার পেয়ে যাবে! আবদার নাকি? বলল বাদামি ডাংগারি।

—-কারেক্ট। পিটিয়েছি, ঠিক করেছি। বিকটহাসি হেসে বলল জরিরকাজ শিফনশাড়ি।

—-দ্যাখ, তোরা দুজনে লেসবিয়ান-সতীত্ব ফলাসনি। বলল স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ। বুক দোল খাওয়ায় কুশাশ্বর হাত আরেকটু হলেই ফস্কে যাচ্ছিল।

—-ভালো বলেছিস, লেসবিয়ান-সতীত্ব! বাঁকা হাসি হেসে বলল প্লেনটপ সোয়ারস্কি জিনস।

—-সঁতীত্বেঁর শ্বেঁতপদ্ম। সামীচন্দ্র লীলাবতী। বলল ব্যাকলেস-চোলি।

—-সত্যি! দু-দুজন জোয়ান, দুরকম টাইপের জোয়ান, হাতছাড়া হয়ে গেল। একটু ফস্টামি-নষ্টামি তো করা যেত রাস্তার বোরডাম কাটাতে। একগাল হেসে বলল ডিপ-নেক অরগ্যান্ডি।

খুব জোর বেঁচেছি, বলল গিলগামেশ। তারপর যোগ করল, আমি যতরকম অ্যাডভেঞ্চার সম্ভব করেছি কিন্তু কখনও নারীগর্ভে ঢুকে অ্যাডভেঞ্চার করিনি। দেবনাথবাবু, এক কাজ করুন। দুজনে এক-একজন লেসবিয়ান সতীর গর্ভে ঢুকি। কী বলেন?

মনের মতন প্রস্তাব পেল কুশাশ্ব। বলল, আপনি ওই জরিরকাজ শিফনশাড়িতে আশ্রয় নিন। আমি যাচ্ছি বাদামি ডাংগারির ভেতরে। দুজনের একজন অন্তত তো যাবে দফতর শহরের দিকে।

চিলতে কাগজের মতন নিজেকে গুটিয়ে গিলগামেশ চলে গেল নিজের বাছাই করা সলোমান মাইন্সে অ্যাডভেঞ্চার করতে। পায়ের ধুলো ঝেড়ে, গুটিপোকার কায়দায় তিড়িকিনাচন দিয়ে কয়েক লাফে কুশাশ্ব পোঁছোল তীর্থক্ষেত্রের দরজায়।

খিলখিল হেসে জরিরকাজ শিফনশাড়ি বাদামি ডাংগারিকে: অ্যাই স্যাবি, করছিস কি?

দেয়ালা হাসি হেসে বাদামি ডাংগারি জরিরকাজ শিফনশাড়িকে: আমি আবার কী করলুম? আমি তো ভাবছিলুম তুই বুঝি আমাকে কিছু করছিস।

রগড়হাসি হেসে ব্যাকলেস চোলি: সাবিত্রী শীল আর কুন্তি সাহা, তোরা দুজনে কি সকাল থেকেই স্ম্যাক নিস? মডেলিঙের লাইনটাকে বদনাম করে দিলি তোরা।

প্যারাসাইট হিসাবে অনুপ্রবেশ শুরু করে দিয়েছিল কুশাশ্ব, তাই যুবতীদের পরবর্তী শ্লেষবচন কথাবার্তা, ঝগড়ারঙ্গ, খুচরো ছেকোক্তি, কেলিমুখ খেয়োখেয়ি আর কানে গেল না। তবে স্যাবি নামটা ওর ভালো লাগল। মিষ্টি।

ভেতরটা, ঢুকেই, স্নিগ্ধ ভিন্নাঞ্জনপ্রভায় আলোকিত দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। আইকম বাইকম ফরমুলা প্রয়োগ করে নির্ণয় নিল কুশাশ্ব। লেসবিয়ান সতীর টানেলও এরকম শ্লেষ্মা-পেছল হবে আশা করেনি। গুটি মেরে-মেরে এগোতে হচ্ছিল। স্যাবি যে বহুক্ষণ পেচ্ছাপ চেপে রেখেছে তা স্ফিংকটারের হালত থেকে টের পাওয়া গেল।

তেষ্টা পেয়েছিল বলে ফলিকিউলের শরবত খেল কুশাশ্ব। ডিম দেখতে পেয়ে সেটাও কপ করে গিলে নিল। ডিমটা টাতকা। ভালই হ।। মাসের শেষে মেয়াদি রক্তপড়া শুরু হচ্ছে না দেখে দৌড়বে ডাক্তারের বাড়ি আর রিপোর্ট পেয়ে আঁৎকে উঠবে।

ঝালরদেয়া পর্দা সরিয়ে জরায়ুঘরে ঢুকল কুশাশ্বল বেশ ওয়েল ফার্নিশড। বোঝা যাচ্ছে গৃহপ্রবেশ হয়নি। ক্লান্ত কুশাশ্ব ওভালরুমের পালঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে বুঝতে পারল স্যাবি কোথাও এঁকেবেঁকে হাঁটছে, বোধহয় মডেলিঙের শোতে বিল্লিহাঁটন দিচ্ছে। নিজেকে ফুলিয়ে একটু বড় করল কুশাশ্ব। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাইরের চেঁচামেচি। ক্ষীণ ভেসে এলো, অনেকে একসঙ্গে জানতে চাইছে, স্যাবি আর ইউ প্রেগন্যান্ট? আর ইউ প্রেগন্যান্ট?

স্যাবি ছুটে কোথাও গিয়ে বসল, অনুমান করতে পারল কুশাশ্ব। কেউ একজন বলল, গো টু টয়লেট, এই নাও, আমার প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে যাও। স্যাবি উঠল। হাঁটছে। স্ফিংকটার ঢিলে করছে। স্যাবির হাসি আর শরীরের হাসি-কাঁপুনি বোঝা যাচ্ছে। কুশাশ্ব আরেকটু ফোলাল নিজেকে। কেউ ওকে বলল, স্যাবি তুই কিছুদিনের জন্যে বাবা-মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আয়।

স্যাবি উঠল। বোধহয় কোনো মোটরগাড়িতে বসল। নামল। বিছানায় লাফিয়ে শুল। কাঁদছে। শরীর কাঁপছে। কুশাশ্ব নগণ্য করে ফেলল নিজেকে। কাঁপন থামল। কুশাশ্ব ওভালরুমে অ্যারোবিক্স করল। এত ছোট পরিসর যে ব্যায়াম করে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। বা হয়ত কয়েকদিন কেটে গেছে। রাত না দিন বোঝার উপায় নেই। পানভোজন আর ঘুমে টাইমপাস হচ্ছে কুশাশ্বর। স্যাবি বোধহয় অন্য কোথাও চলে এসেছে। ওভালরুমের দেয়ালে কান পাতল কুশাশ্ব। হ্যাঁ। সম্ভবত স্যাবির মা। অভয় দেয়া কন্ঠস্বর। শুনে, নিজেকে একটু বড় করল কুশাশ্ব। আতঙ্কিত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে চুপসে নগন্য হয়ে গেল।

ওভালরুম থেকে বেরিয়ে, আস্তে-আস্তে পিছলে, বাইরে মুখ বের করে সাবিত্রী শীলের কন্ঠস্বর স্পষ্টভাবে শুনতে পেল কুশাশ্ব, ডক্টর শাশ্বতী, তাহলে কোনো প্রবলেম ক্লিনিকালি পাননি তো? আমি এবারে কাজে ফিরে যেতে পারি? আমার কালকের ফ্লাইট বুক করা আছে।

ঠিকই। ডাক্তার দেখাতে এসেছে স্যাবি। কুশাশ্ব টুক করে লাফিয়ে, স্যাবির দুই পায়ের মাঝ দিয়ে হেঁটে পায়ের পাতার কাছে মুখ বের করল। মহিলা ডাক্তার কিছু লিখতে মগন। ঘরে আর কেউ নেই। ও ঘুটিপোকা লাফ দিয়ে ডাক্তারের টেবিলে রাখা কাঠের গ্রিক মূর্তিটার পেছনের ফুটো দিয়ে ঢুকে চুপচাপ বসে রইল। শুনতে পেল হাসতে-হাসতে ফিরছে স্যাবি।

ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে ফুটো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে টেবিলে নেমে একটু ছোটাছুটি করে যেই টেবিল থেকে নিচে লাফাবার জন্যে ঝুঁকেছে, কেউ গমগমে কন্ঠে বলল, এখন যাবেন না; বাইরে ডাক্তারের স্বামী আর কমপাউন্ডার বসে টাকা গুনছে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না কুশাশ্ব। কন্ঠস্বর আবার বলল, ওরা চলে গেলে বলব। ওপরদিকে তাকিয়ে সাউন্ডবক্স বা ক্লোজ সার্কিট টিভি দেখা গেলনা। ধন্দে পড়ে টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসল অগত্যা।

থঠাৎ কুশাশ্বর মনে হল উদপালিশ-করা কাঠের গ্রিক মূর্তিটা নয়তো, কেননা এর আগে পেতলের গোপাল আর চিনামাটির লাফিং বুঢঢা প্রথম পরিচয়ের সময়ে অমন ছোট মাপের ছিল। টেবিলের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল কাঠের মূর্তিটার সামনে। সুপুরুষ সুঠাম স্বাস্হ্যবান যুবক, একেবার গ্রিক চোখ-মুখ-নাক। ও যখন পাথরের ছিল তখন গ্রিস থেকে প্রতিবছর লোকজন এসে ওর ফোটো তুলে নিয়ে যেত। ওদের দেশে অনেক মূর্তিটুর্তি থাকলেও আমার দেয়া পোজের মতন মূর্তি ওদের ভাস্কররা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। চুমু খাবার কথাই জানত না ওদের দেশের লোকেরা। এদেশ থেকে শিখে তারপর নিজেদের সমাজে শুরু করেছে।

মেহগনি কাঠের মূর্তির ঠোঁট নড়ে উঠল। গমগমে কন্ঠে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম ওডিসাস, এককালে ইথাকায় অনেক জমিজমা ছিল; পরে, আমি যখন প্রবাসে, তখন সেখানকার দফতরের খুনেরা সেসব জমিজমা খাস ঘোষণা করে হড়পে নিয়েছিল। তবে অনেকে আমাকে ইউলিসিস বলে জানে।

ইউলিসিস? আপনি তো মশাই বিখ্যাত লোক, এক ডাকে সবাই চেনে, বিশেষ করে যারা কাব্যি-টাব্যি করে। আপনি তো আরবদের রাজা গিলগামেশের চেয়ে বেশি অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। উত্তেজিত হয়ে বলল কুশাশ্ব। ঈর্ষণীয় ছিল আপনার রাজনৈতিক মাগিবাজি; এদেশের মন্ত্রী-আমলা-ফিল্ম প্রযোজকরাও আপনার মাগিবাজির কাছে নস্যি।

গিলগামেশ? ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। উনি বোধহয় ট্রয়-যুদ্ধে আসেননি। আমার তো অনেক স্পাই মোহোল্লা কমিটি, লোকাল কমিটি, জেলা কমিটি, জোনাল কমিটি, রাজ্য কমিটি ইত্যাদি নানা ঘাঁতঘোঁতে ছিল; কিন্তু ওনার খবর কখনও কারোর মুখে পাইনি। কাষ্ঠহাসি হেসে বলল কাঠের ইউলিসিস।

আপনার বাবা সিসিফাসের লাইফলং পাথর ঠেলার ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। চৌকো পেপারও্য়েটের ওপর আরাম করে বসে বলল কুশাশ্ব।

আরে কারা সব ওসব গাঁজাখুরি গপপো লিখেছে। এসব বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। আমার বাবা ছিলেন লেরতস আর মা অ্যান্তিক্লিয়া। ক্ষুব্ধ ইউলিসিস বলল।

কুশাশ্ব আর বলল না যে অ্যান্তিক্লিয়াকে ধর্ষণ করেছিল সিসিফাস, তাই সিসিফাসই তো আসল বাবা, আর আপনি তো হাইব্রিড । হাইব্রিড না হলে কেউ কি আর অমন জগতখ্যাত নায়ক হয়! তার বদলে কুশাশ্ব বলল, ট্রয় থেকে অত যুবতী লুটে নিয়ে গিয়েছিলেন, তো আপনার স্ত্রী পেনিলোপি রাগারাগি করেননি?

সব তো আমি রাখিনি; পার্টির নিয়মতন্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিলি-ব্যবস্হা করে দিয়েছিলাম। সবাই তো আর আমার মতন যুদ্ধ করতে চায় না। অনেকে গুমখুন, সুপারি কিলিং, অপহরণ, বাসলুঠ, চাঁদাখেঁচাই, তোলাবাজি, মাস্তানি, গুন্ডামি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতন দিশি আর ছেঁদো কাজকারবার করে, বলল কাঠের মূর্তি।

কুশাশ্ব প্রসঙ্গ বদলে বলল, আচ্ছা পদ্মফুলের ফলফুল খেয়ে কি সত্যিই আপনার ফেলো-ট্র্যাভেলার সঙ্গীদের স্মৃতি লোপাট হয়ে গিয়েছিল? আর তারা নাকি কাজকর্ম করার ইচ্ছে হারিয়ে কেবল পা দুলিয়ে সময় কাটাচ্ছিল? যখন পাথরের মানুষ ছিলুম এদেশের লোকেদের আলোচনা থেকে টের পেতুম যে এখানে পদ্মফুলের ফলফুল না খেয়েই নিষ্কর্মা হয়ে থাকতে চায়, তা তাদের আপনি যতই বোনাস দিন না কেন, খেলে না জানি কী হবে!

হাঃ হাঃ, মুচকি হাসি হাসল কাঠের মূর্তি, তারপর বলল, তাইতো ওদের ভাগিয়ে নিয়ে গেলুম সাইক্লোপদের দেশে, যেখানে ওদের জোড়ায়-জোড়ায় খেয়ে ফেলছিল পলিফেমাস, যাকে আমি বলেছিলুম যে আমার নাম হল ‘কেউ না’। আপনি আপনার দেশের যাদের কথা বলছেন, তারা মনে হচ্ছে দল বেঁধে ‘কেউ না’ হয়ে গেছে। বাশির ভাগই তো ভাগানো ভাগেড়া নয়তো তাড়িপার।

কী আর করা যাবে! আপনার সঙ্গীরা যেমন এওলাসের দেয়া ঝড়ভর্তি চামড়ার থলের মুখের বাঁধন খুলে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল, এখানেও তাই। কত রকমের থলের মুখ খুলে কত রকমের যে ঝড়তি-পড়তি মাল হাওয়ায় ছেড়েছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। নৌকো একেবারে টালমাটাল, এই ডোবে কি সেই ডোবে। বলল কুশাশ্ব।

আমরা ঝড়ফড় তোয়াক্কা না করে উত্তাল সমুদ্রে ভেসে পড়েছিলাম। স্মিত হেসে বলল ইউলিসিস।

তা আপনার সঙ্গীরা এইয়াইয়া পৌঁছে সার্সির ছোঁয়ায় যেমন পশুতে পাল্টে গিয়েছিল, এখানেও তাই। সাংস্কৃতিক খোঁয়াড়-আস্তাবল ভরে গেছে মানুষপ্রতিম আজ্ঞাকারী জন্তু-জানোয়ারে।

—-আমায় ওসব গোলমাল অনেককাল পোয়াতে হয়েছে।

—-জানি। তারপর তো আপনার একেবারে ভিখিরির মতন ফাটিচার হাল। খিড়কি দরজা দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। যাকগে। এবার তাহলে আমি চলি। ওনারা টাকার বান্ডিল বানিয়ে নিয়ে এতক্ষণে চলে গেছেন নিশ্চই।

—-আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। দেখনহাসি হেসে বলল ইউলিসিস।

—-আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন কি দফতর শহরটা কোথায়?

—-আরে মশাই এটাই তো দফতর শহর। পথে বেরোলে যে কেউ বলে দেবে দফতর-পাট কোথায়।

—-ও কে, গুড নাইট, শুভরাত্রি, শব্বা খ্যায়ের।

—-গুড নাইট।

জানলার গ্রিল গলে রাস্তায় লাফ মারল কুশাশ্ব। ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখল। বেশ ফাঁকা। নিজেকে প্রমাণ মাপের মানুষে পাল্টে ফেলে ঝলমলে আলোর দিকে হনহন করে হাঁটা আরম্ভ করল। ব্যাস বিপত্তি।

খনখনে গলায় কেউ বলল, এই গান্ডু, দেখে চলতে পারিস না? আরেকজন চিঁ-চিঁ কন্ঠে বলে উঠল, দে বাঞ্চোৎটাকে ধোলাই। তৃতীয়জন ঘড়ঘড়ে স্বরে, দুই-চাইরডা লাথি দিয়া ছাইড়া দে। কুশাশ্ব নিচু হয়ে দেখল উইপোকা; ওই উইপোকাগুলোই ওকে হুমকি দেচ্ছে। চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে দেখল, সারাটা পথে হাইব্রিড ইউপোকার জাল বেছানো; এমন যে না মাড়িয়ে এগোনো যাবে না। কুশাশ্ব, ওহ সরি স্যার, ভেরি সরি বলতে, চতুর্থ উইপোকা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ঠিক আছে, যাঃ, ফের এ-পাড়ায় ঢুকবি তো তোর বাপের আসবাব আস্ত রাখব না। নিজেকে নগণ্যতর করে, যাতে মাড়াতে না হয়, পোঁ পাঁ পিট্টান দিল কুশাশ্ব।

তেমাথায়, যেখানে উইপোকাদের পথদখল শেষ হয়েছে, উঁচু বেদির ওপর একটা ফুটদশেক ভাস্কর্য, কালো রোমশ ব্রোঞ্জ গোরিলার, দু-হাতে বুক চাপড়াচ্ছে। বেদির নামপট্টে হয়ত পথ-নির্দেশিকা থাকবে, ভেবে, পড়ে দেখতে চাইল ও, কুশাশ্ব। লেখা রয়েছে ‘চেনাসুলভ চেনা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ অবিরাম ঢং’। গোরিলাদের উইপোকা খেতে ভাললাগে বটে, কিন্তু তাদের দোরগোড়ায় এমন বিশাল মূর্তি কেন? থ পেল না কুশাশ্ব। নগন্য আর প্রমাণ মাপের মাঝামাঝি করে তুলল নিজেকে।

দফতরপাট বা অছিসিংহাসনের পথনির্দেশ খুঁজতে-খুঁজতে এগোচ্ছিল কুশাশ্ব। অলিগলি সুনসান। দেখল একটা ফুলস্পিড ছুটন্ত ভাল্লুকের পিঠে বসে চারটে বেবুন এদিকেই আসছে। ওদের জিগ্যেস করে দেখা যাক। হাত দেখানো সত্বেও থামল না বাদামি ভাল্লুকটা । উল্টে একটা বেবুন ওর মাথায় জোরে চাঁটি কষালো, আর সবকটা খিঁখিঁ-খিঁখিঁ হাসতে-হাসতে উধাও হল।

বাঁ-দিকের রাস্তায় কিছুটা হাঁটার পর গুবরেদের নাইটক্লাব নজরে এলো কুশাশ্বর। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, জোড়ায়-জোড়ায় নাচছে বা গোবরমদ খাচ্ছে বাঘাগুবরে, লম্বাশিং-গুবরে, মেহিকানগুবরে, সবুজমাটি-গুবরে, গণ্ডারগুবরে, পরাগগুবরে, হার্লেকুইন-গুবরে, ক্লিক-গুবরে, খামার-গুবরে নারী-পুরুষ। দু-দাঁড়া গুবরে দারোয়ানটাকে দফতরপাটে যাবার রাস্তা জিগ্যেস করল কুশাশ্ব। জবাব দিল না গম্ভীর গুঁফো দারোয়ান।

এক-জোড়া পরাগগুবরে ছোকরাছুকরি নেচেকুদে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ছোকরাটা বলল, প্রথমে বাঁদিকে যান, তারপর ডানদিকে যান, তারপর সোজা, তারপর ডানদিক, আবার ডানদিক, বুঝলেন তো? হাসতে-হাসতে জড়াজড়ি করে গোবরমদে মাতাল দুজনে চলে গেল।

কুশাশ্ব বিমূঢ়। ওরা ঠিক-ঠিক বলল কিনা খটকা লাগল। হয়ত ওকে বিপথগামী করতে চেয়ে অমন পথনির্দেশ দিল ছোকরাটা। আবার না-ও করে থাকতে পারে। ওদের কথামতন না গিয়ে কুশাশ্ব এগোলো পা পিছলে আলুর দম বৈজ্ঞানিক ফরমুলা প্রয়োগ করতে-করতে। ‘আদর্শ ল্যাজকাটা হোটেল’ বোর্ড দেখে ভেতরে ঢুকে একটা ঘর চাইতে রিসেপশানে বসে হাই তুলতে-থাকা যুবতী বেবুন ওকে জেরা শুরু করল।

—-আপনার ল্যাজ যে কাটা তার প্রমাণ আছে?

—-হ্যাঁ। লজ্জার ল্যাজ খেয়ে পেছন ফিরে প্যান্ট নামিয়ে দেখাল কুশাশ্ব।

—-বাইরে থেকে আপনার প্রজাতির মেয়েমানুষ আনা যাবে না। এখানকার রেগুলার বা স্পেশাল স্টক থেকে নিতে হবে। মানবেন তো? নয়ত—

—-মানে?

—-রেগুলারগুলোকে আমরা বাইরে পাঠাই খদ্দের ধরে আনার জন্যে। স্পেশালগুলো নেতাদের জন্যে।

—-আমি তো নেতা নই।

—-নো প্রবলেম। স্পেশালরা আপনাকে নেতৃত্ব শিখিয়ে দেবে। ভেজ না ননভেজ?

—-ননভেজে আজকে কী আছে?

—-ল্যাজযুক্ত সমস্ত স্তন্যপায়ীর থন আছে।

—-রুমটা একটু দেখব।

—-নিজেই চলে-ফিরে দেখে আসুন না। কেবল কারোর কাজে ইন্টারফিয়ার করবেন না। মানবেন তো? নয়ত—

লাউঞ্জে ঢুকে কুশাশ্ব দেখল একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা ল্যাজকাটা হায়েনা ওয়াইনগ্লাসে চুমুক দিয়ে রক্ত-মার্টিনি খাচ্ছে; একটা টেবিল ঘিরে তাস নিয়ে বসেছে ল্যাজহীন ওরাংওটাংরা; ব্যাক-টু-ব্যাক হবার আগে সোফায় হেলান দিয়ে চুমু খাচ্ছে ল্যাজকাটা কুকুর-কুকুরী; একটা টেবিলে ছুরিছোরা রেখে গ্যাঁজাচ্ছে ল্যাজকাটা মেরিনো ভেড়া কারাকুল ভেড়া আর কানঝোলা ভেড়া। জায়গাটা সুবিধের নয় মনে হল কুশাশ্বর। রিসেপশানের বেবুনকে, যে কিনা ঘুমিয়ে পড়েছিল, ‘বড্ডো কনজেসটেড’ বলে বেরিয়ে এলো রাস্তায়।

গায়ে ‘কুইক সাকসেসের গারেন্টি’ লেখা একটা দু-শিং গন্ডার হেলতে-দুলতে যাচ্ছিল। কুশাশ্ব নিজেকে আরেকটু ছোট করে ফেলে গন্ডারকে বলল, স্যার, রাতটা কি আপনার পিঠে ঘুমিয়ে কাটাতে পারি? দিনের বেলায় তো কতশত পাখি পিঠে নিয়ে আপনি বেড়ান; সকাল হলেই চলে যাব। গন্ডার রাজি হয়ে গেলে, তার পিঠে শুয়ে কুশাশ্ব জিগ্যেস করল, আপনি কি করেন স্যার? গন্ডার বলল, আমি কোচিং-ক্লাসে পড়াই, সারা জগতে আমার শাখা-প্রশাখা আছে।

রোদ উঠে পরের দিন রোদাচ্ছে দিকবিদিক, ঘুমন্ত গন্ডারের পিঠে শুয়ে মহিলা জলহস্তির রাজনৈতিক বক্তৃতার বাজখাঁই শুনে ঘুম ভেঙে গেল কুশাশ্ব দেবনাথের। দেখল, জলহস্তির দুই পাশে বেশ কিছু ব্যাজারমুখো ছোট-ছোট জলহস্তি। মহিলা জলহস্তি হাঁ-মুখ খুলে ঘামতে-ঘামতে বলছে — “মানুষ চাইছে, মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, মানুষ কাঁদছে, মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, মানুষ হাই তুলতে পারছে না, মানুষ নাক খুঁটতে পারছে না, মানুষ কুলকুচি করতে পারছে না, মানুষ কান চুলকোতে পারছে না, মানুষের গোঁফদাড়ি বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের দাঁতে খাবার আটকে যাচ্ছে, মানুষ খোঁপা বাঁধতে পারছে না, মানুষকে এই দিতে হবে, মানুষকে সেই দিতে হবে, মানুষকে অমুক দাও, মানুষকে তমুক দাও………..”

গোরু বাছুর মোষ শেয়াল বেড়াল ভোঁদড় প্যাঙ্গোলিন ছাগল হাঁস মুর্গি কাক শালিখ পায়রা চড়ুই বাদুড় চামচিকে নীলগাই হরিণ বেঁজি ইঁদুর ছুঁচো কচ্ছপ খরগোশ মিলিয়ে ভিড় বাড়তে লাগল। বিরক্ত গন্ডার জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার উদ্দেশ্যে চার ঠ্যাঙ বাড়াতে, কুশাশ্ব প্রমাণ মাপের মানুষ হয়ে গেল। ও-ই একমাত্র অন্যরকম প্রাণী হওয়ায় পুরো ভিড়টা হঠাৎ ওর দিকে মুখ ফেরালো। ‘মার ব্যাটাকে’ বলতে-বলতে ধেয়ে এলো।

ভয়ে দৌড় লাগাল কুশাশ্ব। ওর পেছনে ভিড়। ও দৌড় লাগায়। ওর পেছনে ভিড়ও দৌড়োয় । দৌড়োতে-দৌড়োতে একটা বিরাট পোড়ো বাড়িতে ঢুকে গেল কুশাশ্ব। বাইরে থেকে ভেসে আসছে ভিড়ের গালাগাল, হুমকি, বিদপূপ, ধিক্কার, দুয়ো, খলোক্তি, ধাতানি, শাপান্ত-বাপান্ত, টিটকিরি– সব রকম জন্তু জানোয়ারের ভাষায়। প্যাডানির আতঙ্কে বাড়িটার সামনের ঘরগুলো পেরিয়ে একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে গিয়ে লুকোল কুশাশ্ব।

অন্ধকার চোখসহা হলে, ঘরের উঁচু সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ঝাড়লন্ঠন, ছেঁড়া ট্যাপেস্ট্রি দেখে কুশাশ্ব অনুমান করল যে এই খন্ডহরের মালিকদের এককালে প্রতিপত্তি ছিল। পরের আরও অন্ধকার ঘরটায় ঢুকল। দেয়ালময় ফোটো টাঙানো। কাছে গিয়ে দেখল সেগুলো সবই কংকালের। সম্ভবত যখন ফোটোগুলো টাঙানো হয়েছিল তখন স্বাভাবিক রূপ ছিল; কালের করাল গ্রাসে ফোটোগুলো কংকালে পালটে ফেলেছে। যার কংকাল তার নাম, জন্মদিন আর মৃত্যুদিন বছরসহ লেখা রয়েছে। ঘরটা ছেড়ে তাড়াতাড়ি পরের আরও বেশি অন্ধকার ঘরে ঢুকল কুশাশ্ব।

এই ঘরটা একেবারে কালোয় কালো অন্ধকার। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল, আসুন কুশাশ্ব দেবনাথ, আপনার জন্যে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছি আমরা। আপনার অভাবে সভার কোরাম পুরো হয়নি। পরিচিত, শোনা, কন্ঠস্বর মনে হল।

গলার আওয়াজটা যেদিক থেকে ভেসে এসেছিল, সেই দিকে এগোল কুশাশ্ব। পুরোনো ভাঙাচোরা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকজন বসেছিল। কুশাশ্ব তাদের কাছে যেতে, তাড়া উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে হাততালি দিতে লাগল। এবার চিনতে পারল কুশাশ্ব। পেতলের গোপাল, চিনামাটির লাফিং বুঢঢা, তালপাতার গিলগামেশ, কাঠের ইউলিসিস। এদের সামনে টেবিলে একটা করে টর্চ রাখা। আর টেবিলের মাঝখানে নীলরঙের একটা ভাঙা চাকা আর তার দোমড়ানো জংধরা স্পোকগুলো। সিংহাসনের মতন নকশাকাটা চেয়ারে এক জন মহিলা, যার দেহে এক দিকে সাবিত্রী শীলের মুখ, আর বিপরীত দিকে হালুইকরের বাড়ির সেই গৃহবধুর মুখ-বুক।

ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসল কুশাশ্ব দেবনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *