গহন রাতের সূর্য
হায় হায় করে উঠল রজত। কোনও মানে হয়! ঠিক যেন সময় বুঝে লোডশেডিংটা হল। বেয়াড়া রসিকতার মতো।
কী গো ছোটকা! তুমি যে এত বলছিলে, এ কি তোমাদের কলকাতা! তোমাদের এখানে নাকি লোডশেডিং-এর বালাই নেই! সঞ্জু বিছানার ওপর থেকেই বলে উঠল।
পইপই করে বললুম, আগে মাংসটা নিয়ে আয়। এতক্ষণে কবে রান্না হয়ে যেত। রজত রাগ সামলাতে পারে না। সবে প্রেশার কুকারের ঢাকনিটা লাগিয়ে হিটারে বসাতে যাবে… তিন মাস বাদে মুরগির মাংস খাবার সুযোগ পেয়েও এরকমভাবে বানচাল হবার উপক্রম হলে কার না রাগ হয়! কম কসরত করতে হয়েছে! সঞ্জুটা পুজোর ছুটিতে বেড়াতে না এলে অবশ্য মা-কে ম্যানেজ করা সম্ভব হত না। হিদুর ঘরে মুরগি! ডাক্তারের ভুয়ো সার্টিফিকেট দেখিয়ে বোঝাতে হয়েছে মুরগির মাংস না খেলে বংশের কুলপ্রদীপ একমাত্র নাতির প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে। এতে আর কোন ঠাকুমার না মন ভেজে। কিন্তু মন ভিজলেও হিটার কিনে আনতে হয়েছে। প্রেশার কুকার আলাদা হয়ে গেছে। এখন যদি লোডশেডিং ঘণ্টাদুয়েক চলে তাহলেই চমৎকার। এই ছোট শহরে চাকরি নিয়ে আসাটাই কাল হয়েছে। সারাক্ষণ মায়ের নজরে নজরে–এমন একটা রেস্তরাঁ নেই
অ্যাই, অ্যাই সঞ্জু–ও কী হচ্ছে! মোমবাতি খাটের ওপর উলটে পড়লে ধমকে উঠল রজত। বই বই করেই ছেলেটার দফা গয়া হয়ে যাবে। মোমবাতি জ্বেলে লেপের মধ্যে ঢুকে বই পড়ার চেষ্টা! ইয়ারকি। রজতের সব রাগ গিয়ে পড়ে বইয়ের ওপর। ওই বইটা নিয়ে মশগুল না হয়ে সঞ্জুটা যদি এক ঘণ্টা আগে মাংসটা নিয়ে আসত! দূর-দূর–কোনও কম্মের নয়–
এই, বই ছাড় বলছি–এই অন্ধকারে পড়ে আর চোখের মাথা—
প্লিজ, প্লিজ ছোট্রা–আর দুটো পাতা-ভীষণ, ভীষণ ইন্টারেস্টিং ব্র্যাডবেরির গল্পগুলো
একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে হাল ছেড়ে দিল রজত। সঞ্জুটা গোল্লায় গেছে। ট্যাঁশ স্কুলে পড়লে এই হয়। দিনরাত মুখে ইংরেজি বই। জঘন্য। কে বলবে ক্লাস টেনে পড়ে। দাদা-বউদির ওপরে রাগ হয় রজতের। তারপর মায়ের ওপর; যত দোষ মুরগির মাংসের, ওদিকে মুরগির মাংসখেকোদের স্কুলে নাতির পড়ানোর ব্যাপারে তো কই…
বারান্দায় বেরিয়ে এল রজত। মা-কে একবার বলবে নাকি কেরোসিনের স্টোভটা দেবার জন্য? কাল না-হয় নতুন একটা… উঁহু, কী কনকনে হওয়া! রজত ঘরে ঢুকে আলনা থেকে ব্যাপারটা টেনে নিতে গিয়ে চেয়ারটার সঙ্গে ধাক্কা খেল। উফ
লাগল? লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে নাও না ছোটকা সঞ্জু বইয়ের পাতা থেকে মুখ না খুলেই অ্যাডভাইজ করল।
কড়ে আঙুলে হাত বোলাতে বোলাতে রজত চেঁচিয়ে উঠল, অয়েল ইয়োর ওন হুইল! ঠান্ডার দিনে লাগলে একেবারে নিয়ে ওঠে। কিন্তু লণ্ঠন জ্বেলে হবেটা কী! লণ্ঠনের আলোয় কি মাংস সেদ্ধ হয়?
মার গুলি! কারওই যখন কোনও ইন্টারেস্ট নেই। শুধু আমিই বা ভাবি কেন! মনে মনে বকবক করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল রজত। থাক আজ ভাত আর ডাল খেয়ে! নাঃ কলকাতার সব রেস্তরাঁ উঠে যাবে। শিয়োরলি উঠে যাবে–লাহোর, নিজাম, সাবির! সব! নেক্সট জেনারেশন যদি সঞ্জুদের মতো হয়, না উঠে উপায় আছে!
মায়ের ঘরটা অন্ধকার। শুয়ে পড়েছে তাড়াতাড়ি। আজ মায়ের খাওয়ার পাট নেই। অমাবস্যার উপোস। পারেও। রজত ভাবল, একবার ঢুকে দেখা যেতে পারে, ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। যদিও সেটা একটা ইমপসিবল অ্যাজাম্পশন! রাত বারোটার আগে কখনওই মায়ের চোখে ঘুম আসার সম্ভাবনা নেই। সারাদিন তো উপোস করেছে, তারপরেও যে কেন চোখে ঘুম আসে না, বুঝতে পারে না রজত।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই রজত চমকে গেল। এমন আলো আলো লাগছে কেন? আজ অমাবস্যা না? নাকি আকাশে মেঘ ছিল এতক্ষণ, এখন কেটে যাচ্ছে বলে… না না, মোটেই তা নয়–এত আলো
রজত রেলিং দিয়ে বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ওই তো চাঁদ উঠেছে–একেবারে পরিষ্কার গোল থালার মতো। অমাবস্যা কোথায়, বরং পূর্ণিমা বলে মনে হচ্ছে। নারকেল গাছটার ছায়া এসে পড়েছে বারান্দায়। বেশ জবরদস্ত ছায়া। মানে সাদা-কালোর ভেদরেখাটা বেশ স্পষ্ট। টিকিতে ফুল-গোঁজা পুরুতটা নিশ্চয় ভুল করেছে।
রজত ঘরে ঢুকে মা-কে ডেকে বলল, ও মা! তুমি যে বললে আজ অমাবস্যা!
তাতে ক্ষতি কী হল শুনি?
আহা, ক্ষতির কথা কে বলছে! অমাবস্যার রাতে ফুটফুটে চাঁদ উঠছে, সেই কথাটাই বলছি। না হলে আর কী?
পূর্ণিমা হলেও তোমার উপোস, অমাবস্যা হলেও…
মেলা বকবক করিসনি তো! সবসময় ইয়ারকি না! মা লেপ সরিয়ে উঠে বসে।
আমি ইয়ারকি করছি! নিজে এসে দেখে যাও! তোমার তো যত ভক্তি ওই ভণ্ড পুরুতটার ওপর…।
চুপ কর। পুরুতটা ভণ্ড হল, আর তুই কী–
মা উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার জানলার দিকে তাকিয়েই থমকে গেল। এত বড় ভুল হল! আশ্চর্য! এই রজা, হারিকেনটা জ্বালা তো, ক্যালেন্ডারটা একবার দেখি—
রজত হারিকেনটা জ্বালিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে উঁচু করে ধরল।
এই তো–২৩শে অমাবস্যা
তা-ই তো! রজতও অবাক।
ক্যালেন্ডারে ভুল! কিন্তু তা-ই বা হবে কী করে! পূর্ণিমার উপপিস তো এই সেদিন–ওরে দে দে, পাঁজিটা দে তো একবার
রজত পাঁজিটা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে লণ্ঠনটা পাশে নিয়ে আসার আগেই দেখল, ঘরের আলোতেই পাঁজির খুদে লেখাগুলোও দিব্যি পড়া যাচ্ছে। লণ্ঠনের দরকার হচ্ছে না।
ছোটকা–ছোটকা– বারান্দা থেকে সঞ্জুর চীৎকার কানে আসতেই রজত বারান্দায় ছুটে এল।
ভোরের আকাশের মতো উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁদনি রাতের সেই নীলাভ ফ্লুরোসেন্ট আলো নয়।
সঞ্জু আকাশের দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল, এটা চাঁদ হতে পারে না!
কথাটা মিথ্যে বলেনি সঞ্জু। চাঁদের দিকে তাকালে কি কখনও চোখ ধাঁধিয়ে যায়?
সঞ্জুর কথায় সায় দেবার জন্যই যেন পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে সেই ঝগড়টে কোকিলটা গলা ছেড়ে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দূরের কোনও গাছ থেকে তার সঙ্গী উত্তর দিল। কা কা করে দু-একটা কাক এ গাছ-ও গাছ করতে শুরু করেছে।
ঘড়ির দিকে তাকাল রজত। এখন সকাল সাতটা হলেই সব ল্যাটা চুকে যেত। অবাক হবার আর কিছু থাকত না। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা নয়। রাত নটা পনেরো। এবং আজ অমাবস্যা।
ছোটকা! নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন! পালাও! পালাও! রেডিয়ো-অ্যাকটিভ ফলআউট হবে! হঠাৎ বিকট চিৎকার করে ছুট লাগাল সঞ্জু। রজতও ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে গেল তার পেছন পেছন।
সঞ্জু দরজা খুলে একছুটে নিচে চলে গেল। শিগগির নেমে এসে ছোট্রা! ঠাম্মা, ঠাম্মা– ছুটে এসো! প্রাণ বাঁচাতে হলে এই চৌবাচ্চার মধ্যে।
রজত দেখল, সঞ্জু উঠোনের চৌবাচ্চার মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ল।
কী দেখছ দাঁড়িয়ে হাঁ করে! হাইড্রোজেন বোম টেস্ট হচ্ছে–হ্যারি আপ!
রজত ছুটে এল ঘরের মধ্যে। চারপাশের বাড়ি থেকে শাঁখ বেজে উঠেছে। কান্না চিৎকার-আর্তনাদে সারা পাড়া জেগে উঠেছে। মা-ও শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে।
শিগগির চল মা!
কোথায় যাব?
চৌবাচ্চার জলের মধ্যে। সঞ্জু বলছে—
ভগবানের নাম নে বাবা। ভগবানের নাম নে। সব শেষ, সব শেষ হয়ে যাবে–প্রলয়, মহাপ্রলয়–কলিযুগের মহাপাপে–
বাজে না বকে চল তো মা! রজত অস্থির হয়ে পড়ে। ঠাকুর-দেবতার অশেষ ভক্তির এই দোষ। সঞ্জু নিজে যখন যা-ই হোক, ছেলেটার পড়াশোনা আছে–
তুই যা বাবা। আমাকে শেষ ক-টা মুহূর্ত ঠাকুরের পায়ে মাথা রাখতে দে।
মা জপের মালা হাতে ঠাকুরের পায়ে মাথা নিচু করেছে দেখে রজত বুঝল, আর কিছু করার নেই।
সারা ঘর এখন যেন দুপুরের রোদে ভাসছে। রাস্তা দিয়ে লোক ছুটছে আর চিৎকার করছে ভয়ে। সব মরবে সব! ভাগ্যিস সঞ্জু জলের ভেতর নামবার বুদ্ধিটা বাতলেছে, নিশ্চয় বইয়ে পড়েছে। রজত শেষ চেষ্টা করল, মা–পাগলামি করো না, চলা
মা কোনও উত্তর দিল না।
নিচের থেকে আবার সঞ্জুর ডাক কানে এল। রজত ছুটে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সরকারদের গাড়িটার স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এল। তা-ই তো! কথাটা একেবারে খেয়াল হয়নি। এ পাড়ায় ওদেরই শুধু গাড়ি আছে। সরকার সাহেবের বুড়ি মা র সঙ্গে তো মায়ের বেশ আলাপ আছে। মা বললে এখুনি ওরা গাড়িতে তুলে নেবে।
সিঁড়ির জানালা দিয়ে মুখ বার করে চেঁচিয়ে উঠল রজত, সরকার সাহেব! আমাদের নিয়ে নিন। আমরাও যাব! সরকার সাহেব!
রজতের গলা কিন্তু হাজারখানেক লোকের চিৎকারে ডুবে গেছে। গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সকলে। গাড়ির ছাদ, বনেট, ক্যারিয়ার কোনও জায়গা বাকি নেই। সবাই পালাতে চাইছে। কিন্তু গাড়ি যাবে কোথা দিয়ে? মানুষের সমুদ্রে আটকা পড়ে আছে। আর সেই সমুদ্র গাড়ির মধ্যে স্থান পাবার জন্যে ব্যাকুল। গাড়ির ইঞ্জিনের রেস বাড়িয়ে ঘোঁং ঘোঁং গর্জন ছেড়ে ও ক্রমান্বয়ে হর্ন চেপে ধরেও সরকার সাহেব এক ইঞ্চি এগতে পারছেন না।
রজত গাড়ি চড়ার আশা ছেড়ে নিচে নেমে এল।
হারি আপ ছোটকা। এনি টাইম এখন–ঠাম্মা! ঠাম্মা এল না?
চৌবাচ্চার মধ্যে লাফিয়ে পড়েই রজতের খেয়াল হল, র্যাপারটা অবধি খোলা হয়নি গা থেকে। অত শখের ব্যাপারটা। শাল মিউজিয়ামের হাজারখানেক শাল নেড়েচেড়ে তারপর পছন্দ করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য, এখন ব্যাপারটার জন্য একটুও দুঃখ হচ্ছে না! এমনকী হাড় কাঁপানো ঠান্ডার কথাও যেন বিস্মরণ!
ছোটকা, টাইম কত হল?
এক বুক জলে দাঁড়িয়ে রজত ঘড়ি দেখল, ন-টা চল্লিশ
তার মানে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে। ইন্টারেস্টিং
সঞ্জুর কথা শুনে রজত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, হোয়াট ডু ইউ মিন?
এটা কখনওই পারমাণবিক বিস্ফোরণের ব্যাপার হতে পারে না। তার জন্যে এতক্ষণ সময় লাগবে কেন? ছবি দেখনি হিরোশিমা-নাগাসাকির?
নে নে, আর বিদ্যে ফলাতে হবে না!
চল–বাইরে গিয়ে দেখা যাক, ব্যাপারটা কী!
না, না, অত বাহাদুরিতে কাজ নেই!
ধ্যাত, তুমি না! কোনও স্পিরিটই নেই। এই ঠান্ডায় চৌবাচ্চার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকাটা কি কাওয়ার্ডলি ব্যাপার বল তো। সঞ্জু ছোটকার পারমিশন না নিয়েই উঠে পড়ল।
ভিজে র্যাপারটা গা থেকে খুলে রজতও তার পেছনে পেছনে ওপরে উঠে এল। বৈশাখের রোদ্দুরের মতো আলোর তেজ। বারান্দায় বেরিয়ে চোখ তুলে তাকানো যাচ্ছে না। একটা আগুনের বিশাল গোলা যেন মাঝ-আকাশে জ্বলছে। আকারে বোধহয় দ্বিপ্রহরের সূর্যের চেয়েও বড়।
এটা আর যা-ই হোক, সুর্য নয়। রজত মন্তব্য করল।
কারেক্ট। অনেক কাছে রয়েছে জিনিসটা। তাই অত বড় লাগছে।
রজত দেখে, তার কপাল দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। কনকনে শীতের রাতে ঠান্ডা জলে ভিজে গিয়েও… ভাবলেই মাথা খারাপ! রাস্তার কোলাহলে কিছুটা ঝিম ধরছে। চরম উত্তেজনাও একনাগাড়ে বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখা যায় না।
আধ ঘণ্টা ধরে এই বিচিত্র অক্ষিগোলক আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু তাপমাত্রাই যা ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দি আইডিয়া! সঞ্জুর সঙ্গে থাকতে থাকতে রজতেরও ইংরেজি বলার বদ অভ্যেস তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এবার বুঝতে পেরেছি
সঞ্জু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, কী বুঝতে পেরেছ?
হুঁ-হুঁ–বলতে তো পারলি না–এটা আসলে বিরাট একটা উল্কা। বিশালতম–অন্য গ্রহ থেকে ছিটকে
মাই গড! তোমার মতো ননসেন্স
কী বললি?
মানে বিজ্ঞানে তোমার সেন্স নেই। উল্কা কখনও মাঝ-আকাশে দাঁড়িয়ে হাওয়া খায়?
রজত অনেক কষ্টে তার ডান হাতটাকে আটকে ফেলল সময়মতো। ওই পাকা ছেলেটার মাথায় রামচাঁটি মারতে পারলে বোধহয়… কিন্তু সেটা কি ঠিক হত? কথাটা তো সঞ্জু মিথ্যে বলেনি। উল্কারা ছুটতেই অভ্যস্ত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলো ছড়ানো আর তাতানো–এসব অপকম্ম তারা করে না।
বুঝলে ছোটকা, ডেফিনিটলি এটা একটা ইউএফও। ক্যামেরা আছে?
ইউএফও মানে?
তা-ও জান না? আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লায়িং অবজেক্ট। একটি অজানা উড়ন্ত বস্তু। অন্য কোনও গ্রহ থেকে–মহাকাশ থেকে এসেছে–এইচ জি ওয়েলসও পড়নি? ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস?
মেলা পণ্ডিতি ফলাসনি! মোটেই এসব ভালো লাগছে না।
ভালো না লাগলে কী হবে? দেখো তুমি, আমার কথা সত্যি হয় কি না। হয়তো দেখবে, কাঁকড়ার মতো আট হাত-পা-ওয়ালা সব জীব বেরচ্ছে কিংবা মানুষের মাথা বসানো পাখি… কিন্তু চেহারা যা-ই হোক, আমাদের থেকে তারা অনেক ইন্টেলিজেন্ট! ওহ্, ভাগ্যিস তোমার এখানে এসেছিলাম, না হলে তো…।
সঞ্জুর কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ অগ্নিগোলকটা যেন দপ করে লাফিয়ে উঠে নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঝাঁপ দিয়ে পড়ল আকাশ থেকে। ভয়ার্ত আর্তনাদে ফেটে পড়ল মানুষ। ডিসেম্বরের এক অমাবস্যার রাতে সূর্যোদয় যেমন অলৌকিক, তেমনই অলক্ষুনে ব্যাপার সেই সূর্যের এইভাবে নিবে যাওয়া। মোমবাতির শিখার মতো। চোখের নিমেষে।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই বিজলি আলো জ্বলে ওঠাতে সবাই যেন কিছুটা হাঁপ ছাড়ল। তবু তো পাঁচজনের মুখগুলো দেখা যাবে। ভৌতিক কাণ্ডকারখানা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু রাস্তায় কেউ নেই। যে যার বড়িতে। কে বলতে পারে, আবার ওই বিদঘুটে আগুনের গোলাটা জ্বলে উঠবে কি না? কিংবা আরও নিচে নেমে আসবে কি না?
সঞ্জু ছুটে বেরিয়ে গেল সরকার সাহেবদের বাড়িতে। ওদের ফোন আছে। যদি কিছু খবর পাওয়া যায়। রজত হিটার জ্বালিয়ে মাংস চড়িয়ে দিয়ে পাশের ঘরে এসে দেখল, মা তখনও জপের মালা হাতে বসে।
সারারাত জপ করে কাটিয়ে দেবে নাকি? শোবে না?
মা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রজতের দিকে। তারপর মাথা নিচু করে প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল।
আরও নিষিদ্ধ জিনিস খাও। ছি ছি–এসব ম্লেচ্ছগিরির ফল। বুঝলে? এত পাপ ধরিত্রীর সইছে না। পইপই করে বারণ করলুম, কোনওদিন ওসব জিনিস আমাদের চৌকাঠ পেরয়নি–।
যাক বাবা। যত দোষ গিয়ে পড়ল ওই মুরগিছানাটার ওপর! ওর সঙ্গে… আর বলার কিছু নেই। নাও, নাও, শুয়ে পড়–এই আমি নাকে খত দিচ্ছি, আর কোনওদিন খাবার ব্যাপারে নাক গলাব না। সেদ্ধ ভাত খেয়ে যে কটা দিন বাঁচা যায়–
সঞ্জুর পায়ের আওয়াজ শুনে রজত বেরিয়ে এল, কী রে, কিছু খবর পেলি?
নাঃ। কেউই কিছু বলতে পারছে না। নিউজপেপার, আবহাওয়া বিভাগ কিছু জানে না। তবে শুনলাম, টেলেক্সে খবর পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যাতে ইমিডিয়েটলি ফিল্ড ইনভেস্টিগেশানে আসেন–ও, একটা কথা, এই আগুনের ডেলাটা নাকি মাইল দুয়েক দূরেও দেখা গেছে!
প্রেশার কুকারটা ফাঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়তেই সঞ্জু লাফিয়ে উঠল, করছ কী! আর ইউ ম্যাড ছোটকা?
তার মানে?
তুমি রান্না করছ?
তা রান্না করব না কেন? বেঁচে যখন আছি। খবরদার! আজ কোনও খাওয়াদাওয়া নয়। রিপোর্ট না-পাওয়া অবধি জলস্পর্শ করা। চলবে না। আগে রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটির মাত্রা নির্ধারণ করা দরকার, মানে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা–তারপর খাওয়াদাওয়া! আরে, বৃষ্টি পড়ছে নাকি? সঞ্জু এক মিনিট ভুরু কুঁচকে দাঁড়াল; তারপর ছুটে চলে গেল বারান্দায়। ঠিকই শুনেছে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।
সঞ্জু ঘরে ঢুকে বলল, তাড়াতাড়ি একটা খালি শিশি দাও তো! কুইক!
খালি শিশি?
সঞ্জু কোনওদিকে না তাকিয়ে কালির দোয়াতটা নিয়ে ছুটে গেল কলঘরে। ভরতি শিশিটা উপুড় করে ঢেলে দিল নর্দমায়। তারপর আবার জল ভরে বেশ ভালো করে ঝাঁকিয়ে পরিষ্কার করে ফেলল। রজতের আর বাধা দেবার শক্তি নেই।
শিশিটা কেমিক্যালি ক্লিনড হল না, কিন্তু উপায় নেই। যা পাওয়া যায়। সঞ্জু ফুলঝাড়াটাকে মাটিতে শুইয়ে তার মাথায় কালির শিশিটাকে সুতো দিয়ে বেঁধে নিল।
তারপর বারান্দায় এসে শিশিসুদ্ধ ঝুলঝাড়াটাকে বাড়িয়ে ধরল বাইরে। এখন বেশ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।
এই যে স্যাম্পল কালেক্ট করছি না, এরই মধ্যে সব রহস্য আছে। কাল সকালে বিজ্ঞানীদের টিম এলেই এটা তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। বৃষ্টির জল বিশ্লেষণ করলেই সব জানা যাবে।
তার জন্যে ঝুলঝাড়ার মুখে শিশি ঝোলাবার দরকারটা কী? রজত আর না বলে পারে না।
তুমি কি আমায় মারতে চাও? যদি কোনও পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটে থাকে বায়ুমণ্ডলে, তাহলে এই বৃষ্টির জল কী বিপজ্জনক হতে পারে, জান?
প্রেশার কুকারটা আবার শিস মেরে উঠতেই তটস্থ হয়ে গেল রজত। প্রেশার কুকারদের এই দোষ। ঢাকঢোল না পিটিয়ে কাজ সারতে পারে না।
তবু তুমি রান্না করছ? সঞ্জু বেশ কড়া গলায় ছোটকাকে ধমক দিল।
রজা, এই রজা! সঞ্জু যে তোকে বারণ করল। এত বয়স হল, তবু নোলা গেল না! অ্যাঁ!
মায়ের গলা কানে আসতেই রজত তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে হিটারটার সুইচ অফ করে দিল।
.
নকল সূর্য! নকল সুর্যা হকাররা কাগজ বেচছে।
একটা কাগজ নিয়ে চল্লিশ পয়সা দিতে হকার বলল, আজ পঞ্চাশ পয়সা। কাগজ কিনে বাড়ি এল রজত।
বিদ্যুৎ চুরি করে নকল সূর্য! বিরাট হেডলাইন।
রজত পড়তে শুরু করে, বোকারো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের হাইটেনশন লাইন থেকে বিদ্যুৎ চুরি করে কাল কোনও এক অজ্ঞাতনামা বিজ্ঞানী কোনও এক অজ্ঞাত গবেষণাগারে বসে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে রাতের আকাশে এক নকল সূর্য জ্বেলেছিলেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই অজ্ঞাতনামা বিজ্ঞানী চুরি করা বিদ্যুৎকে হাই ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটর ও বিকিরণকারী প্রতিফলকের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ঘনীভূত করেন।
এই তড়িৎ-চৌম্বক রশ্মির প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ থেকে পনেরো কিলোমিটার উঁচুতে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন অণুগুলো তেতে উঠে ঝলমল করতে শুরু করে। নকল সূর্যের শিখায় বায়ুমণ্ডলে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে তার ফলে নাইট্রিক অক্সাইড সৃষ্টি হয়। কাল রাত্তিরে বৃষ্টি হয়েছিল। সেই বৃষ্টির জল পরীক্ষা করেই এ কথা জানা গেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষের ভীত হবার কোনও কারণ নেই। এর থেকে কোনও ক্ষতি হবে না, উপরন্তু নাইট্রিক অক্সাইড সার হিসেবে অতি মূল্যবান। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অবিলম্বে এই অজ্ঞাতনামা বিজ্ঞানী ও তাঁর গবেষণাগারের হদিশ বার করবার জন্য। হাই ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটর ও রেডিয়েটর নির্মাণ করে এই অজ্ঞাত বিজ্ঞানী যেমন তাঁর বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি পরিচয় দিয়েছেন সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার। আমাদের দেশে যেখানে বিদ্যুৎসংকটে কল কারখানার কাজ অবধি ব্যহত হচ্ছে, সেখানে নকল সূর্য তৈরি করার কী প্রয়োজন? অবশ্য এই হাই ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটরকে নাকি পরিবহণ ও শক্তি স্থানান্তরের কাজেও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সে কাজ একটা জাতীয় গবেষণাগারের পক্ষেই শুধু গ্রহণ করা সম্ভব। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিজ্ঞান মানুষের উপকারে লাগতে পারে না।
রজত এক ধাক্কা দিয়ে সঞ্জুকে তুলল, পড়ে দেখ, কী লিখেছে। মহাপণ্ডিত হয়ে গেছিস তুই! রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি–রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি করে কাল সারারাত না খাইয়ে রেখেছিস!
সঞ্জু মুহূর্তের মধ্যে রিপোর্টটা পড়ে ফেলে বলল, রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি হোক বা না হোক, ওই বৃষ্টির জল পরীক্ষা করেই কিন্তু রহস্যভেদ হয়েছে। সেটা তোমায় স্বীকার করতেই হবে। আমার পদ্ধতিতে কোনও ভুল ছিল না।
রজত হিটারের সুইচটা তুলে দিয়ে বলল, আমার পদ্ধতিতেও ভুল নেই। ব্যবস্থা যা করে রেখেছি, তাতে মাংসটা এখন আরও জমবে।
[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, সেপ্টেম্বর ১৯৮১]