গল্প নয় ২
শুরুতেই কবুল করি এটি বানানো গল্প নয়; আমার জীবনের আশ্চর্য একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঠিক কেমন, কোথায় কীভাবে ঘটেছিল তা বলার আগে ছোটখাটো একটি ভূমিকা করে নেওয়া যাক। নইলে পড়তে পড়তে খাপছাড়া মনে হবে।
সাতান্ন কি আটান্ন বছর আগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আমি আন্দামানে যাই। যে জাহাজটিতে গিয়েছিলাম তার নাম এস এস মহারাজা। এস এস হল স্টিমশিপ। তখনকার দিনে বেশির ভাগ জাহাজই কয়লা জ্বালিয়ে বাষ্প তৈরি করে তার জোরে চালানো হত।
কিশোর ভারতী পত্রিকার কিশোর পাঠকরা জানে আন্দামান একটি মাত্র দ্বীপ নয়। আড়াই শোরও বেশি ছোটবড় দ্বীপ মিলিয়ে বিশাল এই আর্কিপেলাগো বা দ্বীপপুঞ্জ। অজস্র এই দ্বীপগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হল তিনটি দ্বীপ–দক্ষিণ আন্দামান, মধ্য আন্দামান আর উত্তর আন্দামান। এগুলোর প্রতিটি চল্লিশ বেয়াল্লিশ মাইল লম্বা, প্রস্থ কম করে তিরিশ বত্রিশ মাইল। আন্দামানের সমস্ত দ্বীপ জুড়ে শুধু পাহাড় আর গভীর জঙ্গল। তবে পাহাড়গুলো খুব উঁচু নয়; বড় জোর সাড়ে তিন কি চার হাজার ফিট উঁচু।
এই পত্রিকার পাঠকরা আরও জানে উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরোই অগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল আর সেই একই তারিখে অখণ্ড ভারত টুকরো হয়ে আলাদা আলাদা দুটো দেশের সৃষ্টি হল–পাকিস্তান এবং বাকি অংশটার নাম ভারতই থেকে গেল। ভারতের পশ্চিম দিকে পাকিস্তানের একটা অংশ পড়ল; তার নাম পশ্চিম পাকিস্তান আর পুব দিকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ঘেঁষে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে যার নাম বাংলাদেশ)। পূর্ব পাকিস্তানে সেই সময় এমনই ভয়ংকর দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি যে বাঙালি হিন্দুদের পক্ষে সেখানে থাকা আর সম্ভব ছিল না। লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে সীমান্তের এপারে পশ্চিমবাংলায় চলে এল। তাদের একটা তকমা দেওয়া হল উদ্বাস্তু। নরম করে বলা হত শরণার্থী।
পশ্চিমবঙ্গ তো খুব বড় রাজ্য নয়। এখানে অসংখ্য উদ্বাস্তু কোথায় থাকবে? কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? তাই সরকারের উদ্যোগে আন্দামানে বনজঙ্গল নির্মূল করে উদ্বাস্তুদের চাষের জমি-টমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল।
এই যে আমি হুট করে আন্দামানে চলে গেলাম তার একটি উদ্দেশ্য হল উদ্বাস্তুদের সঙ্গে থেকে স্বচক্ষে পুনর্বাসনের কাজ দেখা।
কিশোর পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য, ঘটনার লক্ষণই তো দেখা যাচ্ছে না। তাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে বলি। আন্দামানে যাওয়ার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।
সারা পৃথিবী দক্ষিণ আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার শহরের কুখ্যাত সেলুলার জেলের কথা জানে। সেই ইংরেজ আমলে উনিশ শো পঁয়ত্রিশ সাল অবধি ব্রহ্মদেশ বা বার্মা (এখন মায়ানমার) ছিল অখণ্ড ভারতের একটি অংশ। বার্মা থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত এই বিশাল দেশের ভয়ংকর খুনিদের কালাপানির সাজা দিয়ে সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া হত। এদের প্রায় সবাই যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আসামী। তখনকার আইনকানুন অনুযায়ী কালাপানিতে যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু আসামীদের আন্দামানেই কাটাতে হত। এই কয়েদিদের মধ্যে বাঙালি, বিহারি, ইউপিওয়ালা, শিখ, মারাঠি, পাঠান, জাঠ, তামিল, বর্মী, কারেন, এমনি সব রাজ্যের মানুষ ছিল।
অনেকেই জানেন না, সেলুলার জেলের মতো আরও একটা মস্ত জেনানা ফাটক ছিল পোর্টব্লেয়ারে। তার নাম সাউথ পয়েন্ট জেল। এই কয়েদখানা পুরোপুরি মেয়েদের জন্য। সেই আমলে বর্মা মুলুক থেকে সুদূর নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স পর্যন্ত নানা প্রদেশে এমন অনেক মহীয়সী মহিলা ছিল যারা দায়ের কোপে দু-তিনজনের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে সাউথ পয়েন্ট জেলে এসে উঠত। পুরুষ কয়েদিদের মতো এই মেয়েদেরও দেশে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।
ইংরেজ সরকার এক দিক থেকে বেশ সদাশয়ই ছিল বলা যায়। কোনও পুরুষ কয়েদি যদি আন্দামানে এসে দুবছর আর মেয়ে কয়েদি এক বছর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকত, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হত। জাতিগোত্র ঠিকুজি কুলুজি মিলিয়ে বিয়ে নয়। একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বর্মী বা কারেনের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুর, জাঠের সঙ্গে তামিলের, পাঠানের সঙ্গে শিখের–এইভাবে বিয়ে হত। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ, কোনওরকম বাছবিচার ছিল না।
বিয়ের পর এই কয়েদিদের আর জেলখানায় থাকতে হত না। সরকার থেকে পোর্টব্লেয়ার এবং আশপাশের নানা দ্বীপে তাদের থাকার জন্য কাঠের ছোট ছোট অনেক বাড়ি আর নানা ধরনের কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই সব বাড়ি এবং তার বাসিন্দাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল অগুনতি পেনাল কলোনি।
আমার দুনম্বর উদ্দেশ্য ছিল, এই পেনাল কলোনিগুলোতে দু-তিন মাস কাটিয়ে পুরোনো কয়েদিরা দেশের স্বাধীনতার পর কীভাবে দিন কাটাচ্ছে তা জানা।
ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার ধীরে ধীরে সেই আশ্চর্য ঘটনার কথায় আসা যাক।
স্টিমশিপ মহারাজার কথা আগেই জানিয়েছি। দশ বারো হাজার টনের সেই জল্যানটিতে টানা তিন দিন তিন রাত কাটিয়ে চতুর্থ দিন সকালে পোর্টব্লেয়ারের চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে নামলাম।
আমার বন্ধু বিশ্বজিৎ রাহা (নাম পরিবর্তিত) ছিলেন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং আন্দামানের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগের একজন জাঁদরেল অফিসার। তখনও পর্যন্ত অবিবাহিত এই মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য চাযের জমি, বাড়িঘর এবং রোজগারের নিখুঁত বন্দোবস্ত করে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে দ্বিতীয় বঙ্গভূমি গড়ে তোলা। এজন্য বেছে বেছে কয়েকটি টিম তৈরি করেছিলেন। এই অফিসারদের প্রচণ্ড উদ্যম, প্রচুর কর্মক্ষমতা। যেখানে যেখানে উদ্বাস্তু কলোনির কাজ চলছে সেই সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা কাজকর্ম তদারক করতেন। এসব খবর আমি কলকাতায় বসেই শুনেছিলাম।
বিশ্বজিৎ একটা জিপ হকিয়ে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য চ্যাথাম জেটিতে এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁর আর্দালি।
জাহাজ থেকে নেমে আসতেই অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। বিশ্বজিৎ হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললেন, ওয়েলকাম টু আন্দামান আইল্যান্ডস। চলুন—
আমি হাসলাম।
জেটির বাইরে কার পার্কিং এরিয়া। বিশ্বজিৎ আমাকে নিয়ে একটা নীল অ্যামবাসাডরের ফ্রন্ট সিটে উঠলেন। আমার স্যুটকেস-টুটকেস নিয়ে ব্যাকসিটে উঠল তাঁর আর্দালি হরিপদ।
শো ফার ছিল না। বিশ্বজিৎ নিজে ড্রাইভ করে গাড়িটাকে চ্যাথাম পোর্টের বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর সোজা এগিয়ে চললেন।
পোর্টব্লেয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি শহর। কাঠের বাড়িঘর বেশি। দালানকোঠা কম। ভিড়টিড় নেই বললেই হয়।
মাইল তিনেক দৌড়ের পর অ্যামবাসাডর সেলুলার জেলের কাছাকাছি সমুদ্রের ধারে একটা মস্ত কাঠের বাংলোর সামনে এসে থামল। বিশ্বজিৎ বললেন, এই আমার আস্তানা। নেমে আসুন।
বাংলোয় ঢুকে একটা সাজানো গোছানো ড্রইংরুমে আমাকে বসিয়ে বিশ্বজিৎ মুখোমুখি বসলেন। বেশ কয়েকজন কাজের লোককে দেখা গেল। তাদের একজনকে ডেকে বললেন, আমাদের চা-টা দে
শুধু চা-ই নয়, ঘরে তৈরি প্রচুর খাবার দাবারও এল। খেতে খেতে নানারকম কথাবার্তা চলল। বিশেষ করে কলকাতায় উদ্বাস্তুরা কী অবস্থায় আছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও কত মানুষ আসতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় বিশ্বজিৎ বললেন, বে অফ বেঙ্গল খুবই বদমেজাজি সমুদ্র। আসার সময় নিশ্চয়ই রোলিং হয়েছে?
তা হয়েছে। আমি মাথা কাত করি।
হালকা সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, তার মানে হাড়গোড় সব আলগা হয়ে গেছে, কী বলেন?
উত্তর না দিয়ে আমি একটু হাসি।
বিশ্বজিৎ বললেন, এক উইক ভালো করে রেস্ট নিয়ে গায়ের ব্যথা কমান। তারপর যে জন্যে আসা
তাঁকে শেষ করতে দিলাম না—-না না না, আজ আর কাল, এই দুটো দিন বিশ্রাম করলেই চাঙ্গা হয়ে যাব।
ঠিক আছে। আগে পেনাল কলোনিতে যাবেন, না উদ্বাস্তু কলোনিতে?
উদ্বাস্তু কলোনি।
একটু ভেবে বিশ্বজিৎ বললেন, দেখুন, এই দক্ষিণ আন্দামানে অনেক জায়গায় পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। জেফ্রি পয়েন্টে সবে শুরু হয়েছে। হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কীভাবে কলোনি বসানোর কাজ হয়, শুরু থেকে দেখলে আপনার পরিষ্কার একটা আইডিয়া হয়ে যাবে। আমার মনে হয় যে কারণে আপনার আসা, প্রথমে ওখানে যাওয়াটাই ঠিক হবে।
জেফ্রি পয়েন্টটা কোথায়?
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল সাউথ-ওয়েস্টে। একেবারে বে অফ বেঙ্গলের ধারে। একদিকে সমুদ্র, আর তিন দিকে পাহাড় আর ডিপ ফরেস্ট। এই ফরেস্টে কারা থাকে জানেন?
কারা?
জারোয়াদের নাম শুনেছেন?
শুনেছি। ওরা তো ভীষণ হিংস্র নিগ্রোয়েড একটা টাইপ।
ঠিক শুনেছেন। সভ্য জগৎ থেকে কেউ ওদের ধারে-কাছে যাক, সেটা ওরা একেবারেই চায় না। এর মধ্যে তির-ধনুক দিয়ে দু-তিনবার উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা করেছে। ভেবে দেখুন, যাবেন? রিস্ক কিন্তু আছে।
অ্যাডভেঞ্চারের নামে চিরকালই আমার শিরায় শিরায় রক্ত নেচে ওঠে! আন্দামানে আসার বছর দুই আগে আমি উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা হিলসে গিয়েছিলাম। সেখানে জীবনের ঝুঁকি কম ছিল না। চার পাঁচ বার অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছি। বললাম, রিস্ক নিতে ভয় পাই না। লাইফে অনেকবার বিপদের মুখে পড়েও দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি। এ নিয়ে ভাববেন না।
বিশ্বজিৎ রাহা খুব সম্ভব খুশিই হলেন।–ঠিক আছে। তবে ওখানে গিয়ে সাবধানে থাকবেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, দু-দিন পর আমার সহকর্মী সুকুমার পাল জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন। উনি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের একজন বড় অফিসার। চমৎকার মানুষ। পালবাবুকে আজই বলে রাখব। তিনি আপনাকে জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যাবেন। ওখানে মাস দেড় দুই থাকলে আপনার ভালো রকম অভিজ্ঞতা হবে।
.
দিন দুই পর বিকেলবেলায় সুকুমার পাল চলে এলেন। আমি স্যুটকেস হোল্ড-অল গুছিয়ে তৈরি হয়ে ছিলাম। বিশ্বজিৎ রাহা আজ কোর্ট বা তাঁর পুনর্বাসন দপ্তরের অফিসে যাননি। আমি জেফ্রি পয়েন্টে যাব, তাই বাংলোতেই থেকে গেছেন। সুকুমার পালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সুকুমারের বয়স চল্লিশ একচল্লিশ। চোখেমুখে ভালোমানুষ ভালোমানুষ ভাব। চেহারাটা ভারী গোছের। সাজগোজের দিকে নজর নেই। পরনে ঢোলা ফুল প্যান্টের ওপর ফুল শার্ট, যেটার দুটো বোতাম নেই। পায়ে চামড়ার ফিতে বাঁধা চপ্পল।
জানা গেল, তাঁদের দেশ ছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগের পর কলকাতায় এসে অন্য সব উদ্বাস্তুর মতো খুব কষ্টে কয়েকটা বছর কেটেছে। সুকুমারদের সংসারটা খুব ছোট নয়। বাবা, মা, সুকুমার এবং ছোট আরও তিন ভাইবোন।
দেশে থাকতে আই এটা পাশ করেছিলেন। তার জোরে এপারে এসে একটা ছোটখাটো কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। দিনের বেলা চাকরি, রাত্তিরে নাইট ক্লাস করে বি-এ পাশ করার পর পুনর্বাসন বিভাগের এই চাকরিটা পেয়ে আন্দামানে চলে এসেছেন। ফ্যামিলির বাকি সবাই কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকে। ভাইবোনেরা কলেজে পড়ছে। সংসারের সব দায় সুকুমারের। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, সরল মানুষটির সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল।
যাই হোক, জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়ার সোজা কোনও রাস্তা নেই। বিশ্বজিৎ রাহা তাঁর গাড়িতে আমদের দুজনকে চ্যাথাম জেটিতে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে লঞ্চে সমুদ্রের খাড়ি পেরিয়ে ওধারে বাম্বু ফ্ল্যাটের (?) জেটিতে চলে এলাম। জেটির বাইরে পুনর্বাসন বিভাগের একটা জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। যে ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে এসেছে তার নাম লতিফ। সে কিন্তু আমাদের জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে না। রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের একটা জরুরি কাজে যে লঞ্চটায় আমরা ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে এসেছি সেটায় উঠে তাকে পোর্টব্লেয়ারে যেতে হবে। জিপটা চালিয়ে আমাকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন সুকুমার পাল।
লতিফ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বাঙালি মুসলমান। কাঁচুমাচু মুখে সুকুমারকে বলল, স্যার, পোর্টব্লেয়ারে আমাদের হেড অফিসে আজ আমাকে যেতেই হবে। নইলে আমি আপনাদের জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যেতাম। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে।
সুকুমার বললেন, কীসের কষ্ট। আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তিন-চার মিনিটের মধ্যে লঞ্চ চ্যাথামে চলে যাবে। যাও-যাও
লতিফ প্রায় দৌড়াতে দৌড়োতে জেটির দিকে চলে গেল।
সুকুমার পাল বললেন, উঠে পড়ুন
ফ্রন্ট সিটে আমরা পাশাপাশি বসলাম। সুকুমারের হাত স্টিয়ারিংয়ে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাট জেটির প্রায় গা থেকেই পাহাড়ি রাস্তা। ক্রমশ সেটা চড়াইয়ের দিকে উঠে গেছে। দু-ধারে খাদ আর গভীর জঙ্গল। বিরাট বিরাট প্রাচীন সব গাছ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ঝোপছাড়, মাথা সমান উঁচু বুনো ঘাসের জঙ্গল।
রাস্তাটা কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে, কখনও নীচে নামছে। আমাদের জিপটা একের পর এক চড়াই উতরাই ভেঙে পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।
বিকেলবেলায় আমরা বিশ্বজিৎ রাহার বাংলো থেকে বেরিয়েছিলাম। এখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। সূর্যটাকে আকাশের কোথাও আর দেখা যাচ্ছে না। যেদিকে যতদূর চোখ যায়, সব ঝাপসা ঝাপসা। কোথাও মানুষজন চোখে পড়ে না। সব নিঝুম। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিদের কোরাস আর গাছের আড়াল থেকে অজানা বুনো পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। মনে হয় আমাদের চেনাজানা এই পৃথিবীর বাইরে সৃষ্টিছাড়া জনমনুষ্যহীন এক গ্রহে এসে পড়েছি। কেমন যেন গা ছমছম করে।
আন্দামানে আসার পর লক্ষ করেছি, বছরের এই সময়টা সন্ধে নামার অল্প কিছুক্ষণ পরেই চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে জিপে ওঠার পর প্রথম দিকে কথা বলছিলেন সুকুমার পাল। হঠাৎ তিনি চুপ করে গেছেন।
সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে জিপের দুটো হেডলাইট জেলে দিয়েছিলেন সুকুমার। স্পিডও কমিয়ে দিয়েছেন। হেডলাইটের আলোয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন।
আমরা এমন একটা জায়গায় চলে এসেছি যেখানে পাহাড় কাটা বেশ কটা রাস্তা নানা দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অনেকটা গোলকধাঁধার মতো।
জিপের ভেতর একটা লম্বাটে বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোয় লক্ষ করলাম সুকুমার পালের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।
জিপের স্পিড দ্রুত কমে আসছে। একসময় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো?
বলে কী লোকটা? আমি তাঁর দিক থেকে চোখ সরাইনি। জিগ্যেস করলাম, ভুল রাস্তায় চলে এসেছেন নাকি?
খানিকটা সামলে নিতে চাইলেন সুকুমার।-না, না, ভুল হয়নি।
তাঁর কথাগুলো খুব জোরালো মনে হল না। যেন আমাকে ভরসা দেবার জন্যে বলা।
সুকুমার ফের বললেন, কতবার গাড়ি ড্রাইভ করে জেফ্রি পয়েন্টে গেছি। ভুল হবে কেন? আপনিই বলুন
তিনি ভুল পথে যাচ্ছেন, না ঠিক পথে, সেটা আমি বলব! মাত্র দুদিন আগে এই প্রথম আন্দামানে এসে পোর্টব্লেয়ারে কাটিয়ে দিয়েছি। বিশ্বজিৎ রাহা এ কার সঙ্গে আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে পাঠিয়েছেন। অবাক হয়ে সুকুমার পালের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আরও খানিকটা চলার পর সুকুমার বললেন, মনে হচ্ছে ডান দিকের রাস্তাটায় গেলে জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়া যাবে না; বাঁ দিকের রাস্তাটাই ধরা যাক, কী বলেন?
একেবারে থ হয়ে যাই। এই দ্বীপে আমার মতো আনকোরা একজনকে সুকুমার পাল কি পথপ্রদর্শকের দায়িত্বটা দিলেন। উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকি। এ ছাড়া আমার আর করারই বা কী আছে!
রাত আরও বাড়ছে, অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। আকাশে ফ্যাকাশে চাঁদ দেখা দিল, তার নির্জীব আলো দক্ষিণ আন্দামানের এই নিঝুম এলাকাটাকে কেমন যেন রহস্যময়, এবং ভীতিকর করে তুলেছে। চারপাশে আবছা আবছা পাহাড়গুলিকে দেখতে দেখতে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক বিশাল বিশাল আদিম সব প্রাণী যেন ওত পেতে আছে।
আমি মুখ বুজে বসেই আছি। গাইড হিসেবে আমাকে খুব সম্ভব পছন্দ হল না সুকুমার পালের। একটু বেপরোয়া হয়ে তিনি পাকদণ্ডি বেয়ে জিপটাকে পাহাড়ের মাথায় তুলছেন, তৎক্ষণাৎ নামিয়ে আনছেন। ডাইনে বাঁ-য়ে, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে জিপটাকে দৌড় করালেন। এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। তা কম করে ঘণ্টা দেড় দুই।
একসময় রীতিমতো ক্লান্ত এবং হতাশই হয়ে পড়লেন সুকুমার পাল। বললেন, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো? কখন জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে যাবার কথা। আর আমরা কিনা, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছি।
আমারও খুব ক্লান্তি লাগছিল। বললাম, শেষ পর্যন্ত আজ রাত্তিরে জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছোতে পারব তো?
আমার কথায় খুব সম্ভব একটু খোঁচা ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে কয়েক সেকেন্ড লক্ষ করে সুকুমার পাল কণ্ঠস্বরে বেশ জোর দিয়ে বললেন, আলবত পারবেন। আমি আছি না?
বলতে যাচ্ছিলাম, আপনি তো কয়েক ঘণ্টা ধরেই আছেন। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল যেতে চার পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে নাকি? কিন্তু বলা হল না।
এখন গাড়িটা একটা পাহাড়ের মাথা থেকে অনেকটা নেমে এসেছে।
হঠাৎ সুকুমার বললেন, দেখুন তো বাঁ দিকে একটু আলো দেখা যাচ্ছে না? ওই যে তিনি আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
ওঁর আঙুল বরাবর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কোথায় আলো? সুকুমার পালের মতো দিব্যদৃষ্টি আমার নেই। বললাম, কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।
সুকুমার পাল মানুষটি ভদ্র, বিনয়ী, খুবই শান্তশিষ্ট। কিন্তু এখন বেশ চটে উঠলেন।রায়বাবু, কলকাতায় ফিরে গিয়ে চোখ দেখাবেন। ওখানে নিশ্চয়ই আলো আছে। তার মানে মানুষজনও রয়েছে। ওদের জিগ্যেস করলে জেফ্রি পয়েন্টের রাস্তা দেখিয়ে দেবে, কী বলেন?
তিনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করে বেশ জোরেই জিপটা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু আলোর চিহ্নমাত্র চোখে পড়ল না। হতাশা তখন সুকুমার পালের ওপর চেপে বসেছে। বললেন, এই আলো দেখলাম। এখন আর দেখছি না। তা হলে কি আমার চোখটাই গেছে?
এ প্রশ্নের জবাব হয় না। আমি মুখ বুজেই থাকি।
আরও কিছুক্ষণ এলোপাতাড়ি জিপটাকে ছোটানোর পর আচমকা একটা অঘটন ঘটে গেল। বোমা ফাটার মতো প্রচণ্ড আওয়াজ করে জিপের একটা চাকা ফেঁসে গেল। ফস ফস করে হাওয়া বেরিয়ে চাকাটা চুপসে গিয়ে খানিকটা এগিয়ে থেমে গেল। জিপটাও খানিকটা কাত হয়ে গেছে।
সুকুমার পাল হাহাকার করে উঠলেন।-সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। রায়বাবু গাড়িতে এক্সটা চাকা নেই যে বানচাল চাকাটা পালটে দেব। সারারাত এই গাড়ির ভেতর বসে থাকতে হবে। কাল সকালে আলো ফুটলে রাস্তায় লোকজন দেখা গেলে একটা উপায় হতে পারে।
সুকুমার যা যা বললেন তার কোনওটাই সুখকর নয়। এই নিঝুম, জনমানবহীন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা দক্ষিণ আন্দামানে সমস্ত রাত বিকল জিপে বসে বসে জেগে কাটাতে হবে, ভাবতেই ভীষণ দমে যাই।
সুকুমার এবার বললেন, একটাই সমস্যা। মারাত্মক খিদে পেয়েছে। পেটের ভেতর একেবারে খাণ্ডবদাহন চলছে।
তাঁর কথায় খেয়াল হল, আমারও খিদেটা চনচনে হয়ে উঠেছে। বাকি রাতটা না জুটবে এক টুকরো রুটি বা একমুঠো ভাত। ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু কী আর করা?
সুকুমার পাল থামেননি, দেখুন ভাই, গান্ধীজি মাঝে মাঝেই অনশনে বসতেন। দেশপ্রেমী যতীন দাস একটানা ছাপ্পান্ন না সাতান্ন দিন অনশন করেছিলেন। পট্টি রামালু ষাট না বাষট্টি দিন অনশন করে সেকালের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিটা ভেঙে তেলুগুভাষীদের জন্যে আলাদা অন্ধ্রপ্রদেশটা আদায় করে ছেড়েছিলেন। আর আমরা একটা রাত উপোস দিয়ে থাকতে পারব না? খুব পারব! এরপর ফি মাসে দু-চারদিন উপোস করলে শরীরস্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা কতটা উপকারী সে সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া একটা ভাষণ দিলেন।
বানচাল জিপে বসে সময় কাটতে থাকে। ঘণ্টাখানেক পর সুকুমার পাল হঠাৎ বলে ওঠেন, নাহ, পেটের ভেতর খিদেটা জ্বালিয়ে মারলে দেখছি। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আর তো পারি না। কিছু একটা না করলেই নয়।
এই লোকটাই না খানিকক্ষণ আগে উপবাসের উপকারিতা সম্পর্কে সাতকাহন কেঁদে বসেছিলেন? জিগ্যেস করলাম, এই নির্জন জায়গায় কী করতে চান?
সুকুমার পাল সামান্য ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কী আবার করব? খাবার-দাবারের খোঁজ করতে হবে না?
কিছুক্ষণ আগে যা যা বলেছিলেন বেমালুম ভুলে গেছেন সুকুমার পাল। বললাম, এখানে। খাবার কোথায় পাবেন?
চেষ্টা করতে হবে। কথায় বলে না যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। গাড়ির ভেতর বসে বসে অনাহারে প্রাণত্যাগ করাটা কাজের কথা নয়। নামুন নামুন। দেখা যাক আশেপাশে কোনও বসতি পাওয়া যায় কিনা।
সুকুমার নেমে পড়লেন। অগত্যা আমাকেও নামতে হল। মেটে মেটে চাঁদের আলোয় আমাকে পাশে নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন সুকুমার। বললাম, গাড়িটা রাস্তায় পড়ে রইল। আমার স্যুটকেস-ট্যুটকেস যে থেকে গেল। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে তো সর্বস্ব খোয়া যাবে।
সুকুমার আমার দুশ্চিন্তা প্রায় তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিলেন।-আরে ভাই, আন্দামান আর যাই হোক, বম্বে দিল্লি কলকাতা নয়। এখানে দু-চারটে খুনখারাপি হতে পারে কিন্তু চুরিচামারির মতো ছ্যাচড়া কাজ কেউ করে না। চুরি-টুরিকে এখানকার লোক ঘেন্না করে। কেউ এসে পড়লেও জিপ বা আপনার জিনিসপত্রের দিকে ফিরেও তাকাবে না—
উঁচু নীচু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাঁটু আর গোড়ালি আলগা হয়ে যাবার উপক্রম। কোমর টনটন করছে। যে পথটা ধরে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হাঁটছি সেটা এক জায়গায় এসে দু ভাগে ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, আর যে চলতে পারছি না।
সুকুমার বেশ দমে গেছেন। তিনিও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বললেন, আমারও তো একই হাল। শরীর যেন ভেঙে পড়ছে।
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, আচমকা ডান ধারের রাস্তাটা থেকে এক পাল কুকুরের ডাক ভেসে এল।
মরা মরা জ্যোৎস্নায় সুকুমার পালের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বিপুল উৎসাহে বলে উঠলেন, আছে আছে আলো আছে। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। এত হাঁটাহাঁটির রিওয়ার্ড এবার পাওয়া যাবে।
তাঁর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে লোকটার মাথা কি খারাপ হয়ে গেল! হাঁ করে সুকুমার পালের মুখের দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে থেকে বললাম, কীসের আলো? কীসের রিওয়ার্ড?
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলোর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না?
কুকুরের ডাকের মধ্যে কতটা আশা, কতটা রিওয়ার্ড জড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছি না। ধন্দ-ধরা মানুষের মতো বললাম, তা তো পাচ্ছি। কিন্তু
আরে ভাই, একসঙ্গে এতগুলো কুকুর যখন চেঁচাচ্ছে তখন কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনও বসতি-টসতি আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে কটা মাঝারি হাইটের ডালপালাওয়ালা ঝাঁকড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমার দুটো ডাল ভেঙে নিয়ে একটা নিজের হাতে রাখলেন, অন্যটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
জিগ্যেস করলাম, এই ডাল দিয়ে কী হবে?
লাঠির কাজ করবে।
মানে?
যেখানে কুকুর ডাকছে আমরা সেদিকে যাব। ওরা তো এই মাঝরাতে আমাদের আদর করে অভ্যর্থনা জানাবে না। তখন লাঠির দরকার হবে। চলুন–
বিশ্বজিৎ রাহা মনে হয় এক বদ্ধ উম্মাদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। সুকুমার পালের পাশাপাশি ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।
বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হাঁটার পর এক দঙ্গল কুকুর তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হল না। সুকুমার পাল বাই বাই করে হাতের ডালটা ঘোরাতে লাগলেন। আর আদুরে সুরে বলতে লাগলেন, হট-হট। কেন চেল্লাচিল্লি করছিস? আমরা ডাকু না খুনি? দেখছিস না ভদ্দরলোক।
কিছুক্ষণ এই রকম চলল। কুকুরগুলো কী ভাবল, কে জানে। তাদের মারমুখো তেরিয়া মেজাজ আর নেই। চিৎকারও থেমে গেছে; দূরে সরে গিয়ে তারা কুই কুঁই করতে থাকে।
সারা জীবনে কত জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কুকুর বশ করার এমন কায়দা আর কারোর দেখিনি।
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলো বেয়াড়া, বেআদব নয়। মানুষের সঙ্গে থাকে তো। তাই আমার কথাগুলো বুঝতে পেরে সরে গেছে।
লোকটাকে যত দেখছি, তার কথা যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি।
সুকুমার পাল এবার সামনের দিকে একটু দূরে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।–ওই দেখুন!
সেই সন্ধের পর থেকে অল্প অল্প কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। এখন তা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। কুয়াশা ভেদ করে যে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পড়েছে সেটা রীতিমতো ঘোলাটে। সেই আলোতে কুড়ি বাইশটা কাঠের বাড়ির অস্পষ্ট কাঠামো চোখে পড়ল। সেগুলো কাছে-দূরে ছাড়া ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সুকুমার পাল বললেন, কপাল ভালো, তাই কুকুরগুলো ডেকে উঠেছিল। নইলে এত রাত্তিরে বসতিটার কথা জানতে পারতাম না।
কুকুরের হল্লা শুনে যিনি একটি লোকালয়ের হদিস পেতে পারেন তাঁকে আমি কিনা বদ্ধ পাগল ভেবেছিলাম। ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করলাম। ওইরকম ভাবাটা অন্যায় হয়ে গেছে।
সুকুমার বললেন, চলুন যাওয়া যাক। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি।
বললাম, আলো-টালো তো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
এই মাঝরাতে ঝাড়লণ্ঠন জ্বালিয়ে কেউ ঘুমোয় নাকি?
পায়ে পায়ে সুকুমার পালের সঙ্গে এগিয়ে যাই। খাবার-দাবারের আশা যে নেই সে ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত। শরীর ভেঙে আসছে। বাকি রাতটুকুর জন্য যদি একটা আস্তানা জোটে তাই যথেষ্ট। জুটবে যে এমন ভরসা নেই।
প্রথম যে বাড়িটা পাওয়া গেল সেটার রাস্তার দিকে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কুকুরগুলো খুব সম্ভব এই এলাকার পাহারাদার। তারা পিছু পিছু এসে একটু দূ রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ করতে লাগল। কিন্তু কোনও রকম চিৎকার জুড়ে দিল না। কুকুরের মনস্তত্ত্ব আমার জানা নেই। মনে হয়, আমাদের হাল দেখে তাদের কিঞ্চিৎ সহানুভূতি হয়ে থাকবে।
একটু ইতস্তত করে সকুমার পাল দরজার কড়া নাড়লেন। প্রথম দিকে আস্তে আস্তে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
অগত্যা জোর লাগাতে হল। একটানা খটখটানি চলছেই।
আচমকা দরজার পাল্লা ভেদ করে তীব্র বাজখাঁই একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।–কৌন রে কুত্তা? কৌন হো?
একসঙ্গে দশটা জগঝম্পর সঙ্গে দশটা ফাটা কাঁসর পেটালে যে শব্দ বেরোয়, অনেকটা সেইরকম।
আঠারোশো সাতান্নয় সিপাহি বিদ্রোহের পর মিরাট, কানপুর, লখনৌ ইত্যাদি শহর থেকে বিদ্রোহী সেনাদের ধরে ইংরেজরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়ে কালাপানি অর্থাৎ আন্দামানে পাঠায়। তারা হিন্দি আর উর্দু মেশানো যে ভাষাটি বলত সেটাকে বলা হয় হিন্দুস্থানী বুলি। স্বাধীনতার পর অনেকদিন পর্যন্ত সেই বুলিটি চালু ছিল।
বাড়ির ভেতর থেকে সেই কণ্ঠস্বরটি মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসছে।আবে উল্লুকা পাঠঠে, খামোস কিউ? বাতা-বাতা
গলাটা কোনও পুরুষ না মহিলার বুঝতে পারছি না। তবে এর আগে এমন তীব্র বিকট কণ্ঠস্বর আর কখনও শুনিনি। ইহজন্মে আর শুনব কিনা, জানি না। আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে সুকুমার পাল দরজার কড়া দুটো ধরে রেখেছিলেন ঠিকই, তবে তাঁর হাত থর থর কাঁপছিল। মিয়োনো গলায় তাঁর ভাঙা ভাঙা ফরিদপুরি হিন্দিতে সুকুমার জবাব দিলেন, আমরা দু-লোক হ্যায়। তারপর তড়বড় করে যা বললেন তা এইরকম। তিনি এবং আমি পাহাড়ি রাস্তায় পথ হারিয়ে এদিকে চলে এসেছি। এত রাত্তিরে দরজা খটখটিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে তখলিফ দেওয়া হয়েছে, সেজন্য মাফি মাঙছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
থোড়েসে ঠহর যা
মিনিট তিনেক পর দরজা খুলে গেল। গলা শুনে আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। তাকে দেখে আচমকা হৃৎপিণ্ডটা এক লাফে গলার কাছে উঠে এল। প্রায় দু-ফিটের মতো লম্বা এবং ইয়া চওড়া তাগড়াই একটি মেয়েমানুষ। হাতের পাঞ্জা দুটো যেন বাঘের থাবা। কাঁচা পাকা, উশকো খুশকো, রুক্ষ চুল ঝুঁটিবাধা। চোখের তারা দুটো কটা। পরনে ঘাঘরা আর ঢলঢলে ব্লাউজ। দুটোই কোঁচকানো মোচকানো। ঘুম থেকে উঠে এসেছে তাই পোশাকের হাল ওইরকম।
মেয়েমানুষটির হাতে একটা হ্যারিকেন। তার আলোয় দেখা গেল তার বাঁ-গালের ঠোঁট থেকে প্রায় কানের কাছাকাছি অবধি গালের আধাআধি অংশের মাংস নেই। ফলে ওই দিকটার দু-পাটির সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
মনে হল রামায়ণ কি মহাভারতের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে কোনও অতিমানবী বা দানবী আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমার একটু আগে ছিলেন সুকুমার পাল। তাঁর গলা থেকে আঁক করে একটা আওয়াজ বেরুল। পরক্ষণে লাফ দিয়ে তিনি আমার পেছন দিকে চলে এলেন। আমার এমন বুকের পাটা নেই যে ওই দানবীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। লাফ দিয়ে আমিও সুকুমারের পেছনে চলে গেলাম। তিনি পাক খেয়ে আমার পেছনে চলে গেলেন। এইভাবে সামনে-পেছনে বারকয়েক লাফঝাঁপ চলল।
মেয়েমানুষটির বোধহয় মজা লাগছিল। কটা চোখ দুটো কৌতুকে চিকচিক করছে। এবার সে ভারী নরম গলায় বলল, ডারো মাত্ বেটা, অন্দর আও
যার গলার ভেতর থেকে এই কিছুক্ষণ আগে বিকট বাজখাই স্বর বেরিয়ে আসছিল তার গলা কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন মোলায়েম হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল।
আমার কানের কাছে মুখ এনে সুকুমার পাল ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, ভেতরে যাবেন নাকি। যা মূর্তি দেখছি আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। চলুন, সরে পড়ি।
সুকুমার যা বললেন, আমারও সেই একই হাল। তবু কেন যেন মনে হল মেয়েমানুষটি আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। তা ছাড়া হাত-পায়ের জোড়গুলো ঢিলে হয়ে গেছে; অনেক চড়াই-উতরাই ভেঙেছি, তাই শিরদাঁড়া যন্ত্রণায় টনটন করছে। ফিরে যে যাব, শরীরে তেমন এক ফোঁটা এনার্জি আর নেই।
মেয়েমানুষটি হিন্দুস্থানীতে কথা বলছিল। কিশোর পাঠকদের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হবে। তাই দু-চারটে হিন্দি উর্দু রেখে বাকিটা বাংলাতেই লিখছি।
মেয়ে মানুষটি আমাদের লক্ষ করছিল। দুজনের মনোভাবটাও আন্দাজ করে নিয়েছিল। বলল, বেটারা, কী ফুসুর ফুসুর করছিস? বললাম তো ডর নেই। আ যা–আ যা–
আমি খানিকটা সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম। সুকুমার পাল আর কী করবেন, তিনিও আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন। তাঁর আসার ভঙ্গিটা দেখে মনে হল যেন বধ্যভূমিতে চলেছেন।
বাড়ির ভেতর ঢোকার পর মেয়েমানুষটি আমাদের যে ঘরটায় নিয়ে এল সেটার মেঝে থেকে চাল অবধি সব কাঠের। দু-ধারের দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের চওড়া দুটো মাচা; তার ওপর তোশক; তোশকের ওপর পরিপাটি করে চাদর পাতা। দুই মাচার মাঝখানে চারটে বেতের চেয়ারের মাঝখানে বেতেরই সেন্টার টেবিল।
সেই সময় দক্ষিণ আন্দামানে পোর্টব্লেয়ার ছাড়া অন্য কোথাও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। কেরোসিন তেলের হ্যারিকেনই ভরসা। হ্যারিকেনটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে মেয়েমানুষটি বলল, বেটারা, তোদের দেখে মালুম হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে থকে গেছিস। বৈঠ বৈঠ, আগে থোড়েসে আরাম কর
নিঃশব্দে আমরা দুটো চেয়ারে বসে পড়ি। এতটাই ক্লান্ত যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।
হঠাৎ পাশের কোনও কামরা থেকে ঘুম-জড়ানো গমগমে একটা গলা ভেসে এল।-এ সুলতানা, ইতনি রাতে কাদের সঙ্গে বড়র বড়র করছিস?
মেয়েমানুষটির নাম জানা গেল-সুলতানা। শব্দটার মানে সম্রাজ্ঞী। পৃথিবীর কোনও দেশে এমন চেহারার সম্রাজ্ঞী আদৌ ছিল কিনা, এখনও আছে কিনা, আমার জানা নেই।
সুলতানা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, আরে জনাব, ভইসের মতো ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছ। ইতনা নিদ, ইতনা নিদ! বাইরের কামরায় এসে দেখ, কারা এসেছে।
একটু পরেই ভেতর দিকের একটি ঘর থেকে বিপুল আকারের একটি লোক চলে এল। সুলতানার চেয়ে আরও চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বুকের পাটা কম করে চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি। হাত দুটো জানু অবধি নেমে এসেছে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির বেশির ভাগই সাদা। পরনে প্রচুর কুচি-দেওয়া ঢোলা ইজের, তার ওপর ফতুয়া ধরনের জামা। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, আধবোজা। বোঝা যায়, ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি।
সুলতানা এইভাবে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। এ হল দিল্লিবালা ধরম সিং; হিন্দু। আর আমি হলাম পাঠান। তিশ সাল ধরম সিংয়ের ঘরবালী হয়ে সংসার করছি। –এরা রাস্তা ভুল করে ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে।
আগেই জেনেছি আন্দামানে নানা রাজ্যের এবং নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু নিজের চোখে এমন একজোড়া স্বামী-স্ত্রী দেখলাম। কিছুটা অভব্যের মতো অবাক হয়ে দুজনকে দেখতে থাকি।
ধরম সিং আমাকে লক্ষ করছিল। তার ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেল। ডান ধারের দেওয়াল ঘেঁষে তোশক-পাতা যে কাঠের মাচাটা রয়েছে তার ওপর জম্পেশ করে বসে বলল, আরে ভেইয়া তাজ্জব বন গিয়া কিয়া? লেকিন তাজ্জবের কারণ নেই। আংরেজ সরকার এরকম হাজারো শাদি দিয়েছে। এই যেখানে এসেছ এটার নাম টুগাপুর। এখানে পঁচিশটা ফ্যামিলি আছে। হিন্দু-মুসলমানে ঘর করছে, খ্রিস্টান শিখে ঘর করছে, বঙ্গালি বর্মীর ঘর আছে। এ এক আজীব জাজিরা (দ্বীপ)। সমঝ লো, এখানে সব হয়।
দু-এক মিনিটের আলাপেই টের পেলাম ধরম সিং মানুষটা বেশ মজলিশি ধরনের। জমিয়ে গল্প করতে ভালোবাসে। সে বলতে লাগল, বত্তিশ সাল আগে আমি দায়ের কোপে তিন আদমির মুন্ডি নামিয়ে সেলুলার ফাটকে কালাপানি খাটতে আসি। ওই যে সুলতানাকে দেখছ, সে-ও দো মুন্ডি নামিয়ে জেনানা ফাটক সাউথ পয়িন্ট এসেছিল। চাকুর ঘা খেয়ে তার বদনের কী হাল হয়েছে দেখেছ তো; গালের একদিকের সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কালাপানি এসে আমরা কেউ ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করিনি। তাই আংরেজ সরকার আমাদের সাথ আরও বহোৎ আদমির শাদি দিয়ে ফরিন ডিপাটে (ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে) নৌকরি দিয়ে টুগাপুরে পাঠাল। নৌকরির মিয়াদ খতম। আমরা দুজন এখন পুরা পাঁচ হাজার রুপাইয়া পেনশন পাই।
আমাদের ব্যাপারে ধরম সিংয়ের এতটুকু আগ্রহ নেই। সে নিজেদের সম্বন্ধে, পুরোনো দিনের আন্দামান সম্বন্ধে সাতকাহন ফাঁদতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সুলতানার কী খেয়াল হতে ধরম সিংকে থামিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল।–বেটা, তোমরা তো পুটবিলাস (পোর্টব্লেয়ার) থেকে আসছ। কখন ওখান থেকে বেরিয়েছিলে?
সুকুমার পাল বললেন, বিকেলে
এখন তো আধি রাত। কুছু খানা টানা জুটেছে?
করুণ চোখে সুলতানার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে লাগলেন সুকুমার।
ব্যস্তভাবে উঠে পড়ল সুলতানা। ধরম সিংকে বলল, বড়র বড়র না করে বেটাদের পানি এনে দাও। হাতমুখ ধুয়ে নিক। আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসছি। সে বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
.
আধ ঘণ্টাও কাটল না, তার আগেই সুলতানা দুটো বড় স্টেনলেসের থালায় গরম গরম ঘি-মাখানো চাপাটি, আলুর ডোকা, আমলকীর আচার আর এক লাস করে ঘন দুধ আমাদের সামনে সাজিয়ে দিয়ে কাছে বসে মায়ের মতো যত্ন করে খাওয়াতে লাগল। খা লে বেটা সামান্য আয়োজন। গনগনে খিদের মুখে মনে হল অমৃত।
আমাদের খাওয়া চলছে। নানা কথা বলছিল সুলতানা। হঠাৎ একসময় জিগ্যেস করল, তোদের গাড়ির চাকা তো ফেঁসে গেছে। কোথায় রয়েছে গাড়িটা?
ঠিক কোথায় আছে বলতে পারব না। কাল দিনের বেলা খুঁজে বের করতে হবে।
ধরম সিং কাছেই রয়েছে। জিগ্যেস করল, ফিকর মত কর। আমরাই ছুঁড়ে বের করে দেব। কী গাড়ি তোদের?
কখনও আমাদের তুমি বলছে ধরম সিং, কখনও তুই। সুকুমার পাল বললেন, জিপ–
ধরম সিং বলল, টুগাপুরের এই পেনিল কলুনিতে (পেনাল কলোনিতে) আমার এক দোস্ত আছে। মান্দ্রাজি খ্রিস্টান যোশেফ। বত্তিশ সাল আগে আমরা এক জাহাজে কল্পকাত্তা থেকে কালাপানি এসেছিলাম। সে আরও জানায়, যোশেফ খুব ভালো মোটর মেরামতি করতে পারে। তার কাছে হরেক কিসিমের মোটরের চাকা আছে। নসিব ভালো হলে জিপের চাকা তার কাছে পাওয়া যাবে। কাল সুবেহ তাকে ডেকে আনা হবে।
ধরম সিংয়ের কিছু খেয়াল হওয়ায় ব্যস্তভাবে জিগ্যেস করল, তোরা কোথায় যাবি সেটাই তো জানা হয়নি।
সুকুমার বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে। এখান থেকে কতদূর?
নজদ্গি। খুব বেশি হলে ছ-সাত মিল। দরিয়ার কিনারে ওই জায়গাটায় জঙ্গল সাফ করে পাকিস্তানে বঙ্গালি রিফুজদের (রিফিউজিদের) কলুনি বসানো হচ্ছে না?
হ্যাঁ। আমরা সেই কলোনিতেই যাব।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সুলতানা ঘরের দু-ধারের কাঠের মাচানে পরিপাটি করে বিছানা পেতে গায়ে দেবার জন্য পাতলা দুটো চাদর দিয়ে বলল, শো যা বেটারা। রাতে যদি কিছু জরুরত হয় তো আমাদের ডাকি। বলে চাবি ঘুরিয়ে হ্যারিকেনটা নিবু নিবু করে রেখে ধরম সিংকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল।
.
আগের দিন আমাদের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে। তাই পরেরদিন ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল।
আমাদের অনেক আগেই জেগে গিয়েছিল সুলতানা আর ধরম সিংহ। তারা খুব সম্ভব লক্ষ রাখছিল। আমরা বিছানা থেকে নামতেই ধরম সিং এসে বলল, চল, তোদের নানা ঘরে নিয়ে যাই।
বাড়ির ভেতর দিকে চানের ঘর বা বাথরুম। সেখানে কয়েক বালতি জল ধরা আছে। সুকুমার পাল আর আমি একে একে গিয়ে গিয়ে মুখ-টুখ ধুয়ে এলাম। যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ল রসুইঘরে অর্থাৎ কিচেনে ছাক ছোঁক আওয়াজ করে ভীষণ ব্যস্তভাবে কী সব করছে সুলতানা।
আমাদের জামাকাপড় সবই রয়েছে সেই জিপটায়। তাই বাথরুমে কাজ সেরে এসে বাসি পোশাকেই থাকতে হল।
ধরম সিং আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে। সুকুমার পাল তাকে বলল, এবার তো আমাদের যেতে হবে।
ধরম সিং বলল, যাবি যাবি। এখন বোস্। আমার ঘরবালী আসুক। তার হুকুম ছাড়া যাওয়া চলবে না।
কয়েক মিনিটের ভেতর চলে এল সুলতানা। তার হাতে দুটো থালায় মুলোর পরোটা, হিং-দেওয়া ঘন অড়র ডাল, নানারকম আনাজ দিয়ে একটা তরকারি আর এক লাস করে ঘোল। বুঝতে পারছি, এ-বাড়িতে চায়ের ব্যবস্থা নেই। বুঝতে পারলাম, ভোরবেলা উঠে আমাদের জন্যে এইসব খাবার তৈরি করেছে।
থালা দুটো আমাদের সামনে রেখে সুলতানা বলল, খা, বেটারা। বলে একটা চেয়ার টেনে কাছে বসল।
ধরম সিং সুলতানাকে বলল, তুই তোর বেটাদের খাওয়া। আমি যোশেফকে ডেকে আনি। সে চলে গেল।
মিনিট কুড়ি বাদে ধরম সিং একটা বেঁটে খাটো, কালো, মজবুত চেহারার লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এল। নিশ্চয়ই তার বন্ধু যোশেফ। লোকটার কাঁধে একটা টায়ার আর হাতে চটের ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। খুব সম্ভব মোটর মেরামতির যন্ত্রপাতি। সে ধরম সিংয়েরই সমবয়সি হবে। তবে মাথার চুল খুব একটা পাকেনি।
ধরম সিং লোকটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সুলতানাকে বললাম, এবার যাই
ভারী গলায় যে বলল, ধরে তো রাখতে পারব না। ঠিক হ্যায়। চল, আমিও তোদের সঙ্গে গিয়ে গাড়িটা খুঁজি।
কাল মাঝরাতে সুলতানাদের বাড়িতে এসেছিলাম, এখন সকাল আটটা কি সাড়ে-আটটা। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় এই পাঠান রমণীটি, যে বত্রিশ বছর আগে দায়ের কোপে দুটো লোকের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে কালাপানি এসেছিল যাবজ্জীবন সাজা খাটতে, সে আমাদের কত আপন করে নিয়েছে। আমার বুকের ভেতরটাও ভারী হয়ে উঠল।
.
একসময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সুলতানা, ধরম সিং, যোশেফ, সুকুমার পাল এবং আমি।
ঘণ্টা দেড়েক খোঁজাখুঁজি চলল। শেষ পর্যন্ত তিনটে পাহাড় পেরিয়ে চার নম্বর পাহাড়ের একটা রাস্তার বাঁকে আমাদের বানচাল জিপটা পাওয়া গেল। সামান্য কাত হয়ে সেটা পড়ে রয়েছে। লক্ষ করলাম আমার স্যুটকেস হোল্ড-অল কাল রাতে যেমন রেখে গেছি তেমনই আছে। এই পথ দিয়ে যদি কেউ গিয়েও থাকে সেসব ছুঁয়েও দেখেনি।
যোশেফ কাজের লোক। আন্দাজ করে যে চাকাটা নিয়ে এসেছিল, সেটার মাপ জিপের অন্য চাকাগুলোর মতোই। আমাদের ফেঁসে যাওয়া চাকাটা খুলে দশ মিনিটের মধ্যে তার চাকাটা লাগিয়ে বলল, এবার তোমরা চলে যাও
সুকুমার পাল বললেন, কিন্তু আপনার চাকাটা ফেরত দেব কী করে?
কোঈ জরুরত নেই। আমি তো তোমাদের চাকাটা নিলাম।
ওটা তো ফেঁসে গেছে।
ও আমি মেরামত করে নেব। ফিকর মাত্ কর।
সুকুমারের মুখ দেখে মনে হল, যোশেফকে কিছু টাকা দেবার কথা ভাবছেন কিন্তু সে কথা বলতে তাঁর সাহস হল না।
হাতজোড় করে ওদের তিনজনকে, বিশেষ করে সুলতানাকে বললাম, যাচ্ছি–
সুলতানা বলল, বেটা, তোদের ভালো করে খাওয়াতে পারলাম না। আমাদের লেড়কা লেড়কি নেই। কভি কভি দো-চার রোজ এসে তোরা থাকলে আমাদের দিল খুশ হয়ে যাবে। আসবি তো?
আসব। আস্তে মাথা নাড়লাম। কিন্তু টুগাপুরে আর কখনও যাওয়া হয়নি।
গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম। সুকুমার পাল স্টার্ট দিলেন। জিপ চলতে শুরু করল। তিনটি মানুষ পাহাড়ি পথের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ঘাড় ফিরিয়ে শুধু সুলতানার দিকে তাকিয়ে থাকি। ওই পাঠান মহিলাটি সুন্দরী নয়, তাকে দেখলে আঁতকে ওঠার কথা। কিন্তু মায়ায় মমতায় স্নেহে সহানুভূতিতে পৃথিবীর সেরা সেরা সম্রাজ্ঞীরা তার পায়ের নখের যোগ্য নয়।
সুলতানার মতো জননীদের ভারতবর্ষের নানা জায়গায় আমি দেখেছি। বম্বের (এখনকার মুম্বই) চওল-এ, দণ্ডকারণ্যের কেশকাল পাহাড়ে, কোঙ্কন উপকূলের জেলেপাড়ায়, বিহারের অস্ফুটুলিতে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের কথা পরে কখনও বলা যাবে।