গল্প : দুর্বোধ্য

দুর্বোধ্য

সহর ছাড়িয়ে যে-রাস্তাটা রেল-স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার উপরে একটা তেঁতুল গাছের তলায় লোকটিকে প্ৰতিদিন একভাবে দেখা যায়- যেমন দেখা যেতে পাঁচ বছর আগেও। কোনো বিপর্যয়ই লোকটিকে স্থানচ্যুত করতে পারে নি— যতদূর জানা যায়। এই স্থাণু বৃদ্ধ লোকটি অন্ধ, ভিক্ষাবৃত্তি তার একমাত্র জীবিকা। তার সামনে মেলা থাকে একটা কাপড়, যে কাপড়ে কিছু না কিছু মিলতই এতকাল- যদিও এখন কিছু মেলে না। লোকটি অন্ধ, সুতরাং যে তাকে এই জায়গাটা বেছে দিয়েছিল তার কৃতিত্ব প্ৰশংসনীয়, যেহেতু এখানে জন-সমাগম হয় খুব বেশী এবং তা রেল-স্টেশনের জন্যেই। সমস্ত দিনরাত এখানে লোক-চলাচলের বিরাম নেই, আর বিরাম নেই লোকের কথা বলার। এই কথা বলা যেন জনস্রোতের বিপুল কল্লোলধ্বনি, আর সেই ধ্বনি এসে আছড়ে পড়ে অন্ধের কানের পর্দায়। লোকটি উন্মুখ হয়ে থাকে-কিছু মিলুক আর নাই মিলুক, এই কথাশোনাই তার লাভ। নিস্তব্ধতা তার কাছে ক্ষুধার চেয়েও যন্ত্রণাময়।

লোকটি সারাদিন চুপ করে বসে থাকে মূৰ্তিমান ধৈর্যের মতো। চিৎকার করে না, অনুযোগ করে না, উৎপীড়িত করে না কাউকে। প্ৰথম প্ৰথম, সেই বহুদিন আগে, লোকে তার নীরবতায় মুগ্ধ হয়ে অনেক কিছু দিত। সন্ধ্যাবেলায় অর্থাৎ যখন তার কাছে সূর্যের তাপ আর লোকজনের কথাবার্তার অস্তিত্ব থাকত না, তখন সে বিপুল কৌতূহল আর আবেগের সঙ্গে কাপড় হাতড়ে অনুভব করত চাল, পয়সা, তরকারী…। তৃপ্তিতে তার অন্ধ দু’চোখ অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে উঠত। তারপরে সেই অন্ধকারেই একটা নরম হাত এসে তার শীর্ণ হাতটাকে চেপে ধারত- যে-হাত আনতো অনেক আশ্বাস আর অনেক রোমাঞ্চ। বৃদ্ধ তার উপার্জন গুছিয়ে নিয়ে সেই নরম হাতে আত্মসমৰ্পণ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। তারপর ভোর হবার আগেই সেই হাতেই ভর করে গাছের তলায় এসে বসত। এমনি করে কেটেছে পাঁচ বছর।

কিন্তু দুৰ্ভিক্ষ এল অবশেষে। লোকের আলাপ-আলোচনা আর তার মেলে-ধরা কাপড়ের শূন্যতা বৃদ্ধকে সে-খবর পৌঁছে দিল যথা সময়ে।

–কুড়ি টাকা মণ দরেও যদি কেউ আমাকে চাল দেয় তো আমি এক্ষুণি নগদ কিনতে রাজি আছি পাঁচ মণ—বুঝলে হে–

উত্তরে আর একটি লোক কি বলে তা শোনা যায় না, কারণ তারা এগিয়ে যায় অনেক দূর…

–আরে ভাবতিছ কী ভজহরি, এবার আর বৌ-বেটা নিয়ে বাঁচতি অবে না—

–তা যা বলিছ নীলমণি…

বৃদ্ধ উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু আর কিছু শোনা যায় না। শুধু একটা প্রশ্ন তার মন জুড়ে ছটফট করতে থাকে-কেন, কেন? বৃদ্ধের ইচ্ছা করে একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে-কেন চালের মণ তিরিশ টাকা, কেন যাবে না বাঁচা-কিন্তু তার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? কে এই অন্ধ বৃদ্ধকে বোঝাবে পৃথিবীর জটিল পরিস্থিতি? শুধু বৃদ্ধের মনকে ঘিরে নেমে আসে আশংকার কালে ছায়া। আর দুর্দিনের দুর্বোধ্যতায় সে উন্মাদ হয়ে ওঠে দিনের পর দিন। অজন্ম নয়- প্লাবন নয়।–তবু দুর্দিন, তবু দুৰ্ভিক্ষ? শিশুর মতো সে অবুঝ হয়ে ওঠে; জানতে চায় না-কেন দুর্দিন, কেন দুৰ্ভিক্ষ—শুধু সে চায় ক্ষুধার আহাৰ্য। কিন্তু দিনের শেষে যখন কাপড় হাতড়ে সে শুকনো গাছের পাতা ছাড়া আর কিছুই পায় না, তখন সারাদিনের নিস্তব্ধতা ভেঙে তার আহত অবরুদ্ধ মন বিপুল বিক্ষোভে চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু কণ্ঠস্বরে সে-শক্তি কোথায়? খানিক পরে সেই নরম হাতে তার অবসন্ন শিথিল হাত নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তুলে দেয়। আর ক্রমশ অন্ধকার তাদের গ্রাস করে।

একদিন বৃদ্ধের কানে এল; ফেণীতে যে আবার বোমা পড়ছে, ত্ৰিলোচন–

উত্তরে আর একটি লোকের গলা শোনা যায়; বল কী হে, ভাবনার কথা–

দ্বিতীয় ব্যক্তির দুশ্চিন্তা দেখা দিলেও অন্ধ বৃদ্ধের মনে কোনো চাঞ্চল্য দেখা দিল না। তার কারণ সে নিৰ্ভীক নয়, সে অজ্ঞ। কিন্তু সে যখন শুনল :

–ঘনশ্যামের বৌ চাল কিনতে গিয়ে চাল না পেয়ে জলে ড়ুবে মরেছে, সে-খবর শুনেছি শচীকান্ত?

তখন শচীকান্তের চেয়ে বিস্মিত হল সে। শূন্য কাপড় হাতড়ে হাতড়ে দুর্দিনকে মর্মে মৰ্মে অনুভব করে বৃদ্ধ, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে অনেক বেশী ক্লান্ত করে তোলে; প্ৰতিদিন।

 

তারপর একদিন দেখা গেল বৃদ্ধ তার নীরবতা ভঙ্গ করে ক্ষীণকাতর স্বরে চিৎকার করে ভিক্ষা চাইছে আর সেই চিৎকার আসছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে; সেই চিৎকারে বিরক্ত হয়ে কেউ কিছু দিল, আর কেউ বলে গেল :

–নিজেরাই খেতে পাই না, ভিক্ষে দেব কী করে?

একজন বলল : আমরা পয়সা দিয়ে চাল পাই না, আর তুমি বিনি পয়সায় চাল চাইছ? বেশ জোচ্চুরি ব্যবসা জুড়েছ, বাবা।

আবার কেউ বলে গেল : চাইছ। একটা পয়সা, কিন্তু মনে মনে জানো এক পয়সা মিলবে না, কাজেই ডবল পয়সা দেবে, বেশ চালাক যা হোক।

এইসব কথা শুনতে শুনতে সেদিন কিছু পয়সা পাওয়া গেল এবং অনেকদিন পর এই রোজগার তার মনে ভরসা আর আনন্দ এনে দিল। কিন্তু অনেক রাত পৰ্যন্ত প্ৰতীক্ষার পরও সেইদিন আর সেই কোমল হাত তার হাতে ধরা দিল না। দুর্ভাবনায় আর উৎকণ্ঠায় বহু সময় কাটার পর অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে চমকে উঠে সে হাতড়াতে লাগল, আর খুঁজতে লাগল একটা কোমল নির্ভরযোগ্য হাত। আস্তে আস্তে একটা আতঙ্ক দেখা দিলঅপরিসীম বেদনা ছড়িয়ে পড়ল তার মনের ফসলকাটা মাঠে। বহুদিন পরে দেখা দিল তার অন্ধতাজনিত অক্ষমতার জন্যে অনুশোচনা। রোরুদ্যমান মনে কেবল একটা প্রশ্ন থেকে থেকে জ্বলে উঠতে লাগল : পাঁচ বছর আগে যে এইখানে এনে বসিয়েছে পাঁচ বছর পরে এমন কী কারণ ঘটেছে যার জন্যে সে এখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে না?–তার অনেক প্রশ্নের মতোই এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। শুধু থেকে থেকে ক্ষুধার। যন্ত্রণা তাকে অস্থির করে তোলে।

তারপর আরো দুদিন কেটে গেল। চিৎকার করে ভিক্ষা চাইবার ক্ষমতা আর নেই, তাই সেই পয়সাগুলো আঁকরে ধ’রে সে ধুকতে থাকল। আর দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোটা ফোটা জল। দু-হাতে পেট চেপে ধ’রে তার সেই গোঙানী, কারো কানে পৌছুলো না। কারণ কারুর কাছেই এ দৃশ্য নতুন নয়। আর ভিখারীকে করুণা করাও তাদের কাছে অসম্ভব। যেহেতু দুৰ্ভিক্ষ কত গভীর, আর কত ব্যাপক!

বিকেলের দিকে যখন সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল অবসন্ন হয়ে, তখন একটা মিলিত আওয়াজ তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল; ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হল। তার অতি কাছে হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল। : অন্ন চাই-বস্ত্ৰ চাই…। হাজার হাজার মিলিত পদধ্বনি আর উন্মত্ত আওয়াজ তার অবসন্ন প্ৰাণে রোমাঞ্চ আনলঅদ্ভুত উন্মাদনায় সে কেঁপে উঠল থর্‌থর্‌ করে। লোকের কথাবার্তায় বুঝল : তারা চলেছে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চাল আনতে। অন্ধ বিস্মিত হ’ল—তারই প্ৰাণের কথা হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে–তারই নিঃশব্দ চিৎকার এদের চিৎকারে মূর্ত হচ্ছে! তা হলে এত লোক, প্ৰত্যেকেই তার মতো ক্ষুধার্ত, উপবাসখিন্ন? একটা অজ্ঞাত আবেগ তার সারাদেহে বিদ্যুতের মতো চলাফেরা করতে লাগল, সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। এত লোক, প্ৰত্যেকের ক্ষুধার যন্ত্রণা সে প্ৰাণ দিয়ে অনুভব করতে লাগল, তাই অবশেষে সে বিপুল উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে পারল না, কেবল একবার মাত্র তাদের সঙ্গে “অন্ন-চাই” বলেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

 

সেই রাত্রে একটা নরম হাত বৃদ্ধের শীতল হাতকে চেপে ধরল; আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে সে তার কেঁচড়ে ভরা চাল দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

[‘দুর্বোধ’ গল্পটি ২৮শে মে ১৯৪৩-এর অরণি পত্রিকায় চিত্র-গল্প হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *