ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

গল্পের চেয়েও ভয়ংকর

গল্পের চেয়েও ভয়ংকর (ছোট গল্প)

ঘুম ভেঙে গেল..

ঘুম ভেঙে যাওয়া কিছু আশ্চর্য নয়।

সেই বীভৎস চিৎকার কানে গেলে জ্যান্ত মানুষ তো দূরের কথা, বোধ হয় কবরের মড়াও বাপ রে বলে কবরের মধ্যে ধড়মড়িয়ে উঠে বসত…

ঘুমের ঘোর তখনও চোখ থেকে কাটে নি, আমার স্তম্ভিত দৃষ্টির সম্মুখে ফুটে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য!

ভালো করে চোখ মুছে চাইলুম– না, দুঃস্বপ্ন নয়, নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি চতুষ্পদ জীব- তাদের রোমশ দেহের সাদা সাদা চামড়ার উপর নাচছে অগ্নিকুণ্ডর রক্তিম আলোকধারা, জ্বলন্ত কয়লার মতো চোখে চোখে জ্বলছে ক্ষুধিত হিংসার নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি!

কাফাতো হাতের বর্শা বাগিয়ে ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল, ঠান্ডা গলায় বললে, মি. ম্যাক, বাঁচার আশা রেখো না, সাদা শয়তানের দল যাকে ঘিরে ধরে তার নিস্তার নেই। তবে মরার আগে মেরে মরব।

পাশের রাইফেলটা তুলে ধরে সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে দিলুম। সঙ্গেসঙ্গে একটা জানোয়ার অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছে এসে চিৎকার করে উঠল অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় ঝকঝক করে উঠল তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি।

অগ্নিকুণ্ডের কাছে ও দুরে যে চতুষ্পদ জীবগুলি এতক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

কাফাতো বললে, মি. ম্যাক, প্রস্তুত হও এবার ওরা আক্রমণ করবে।

রাইফেলের ট্রিগারে আঙুলে রেখে চার পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম। সামনে অগ্নিকুণ্ড, তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিমান যমদূতের দল, আগুনের এধারে আমি আর কাফাতো, পিছন থেকে আমাদের বাঁদিক ও ডানদিক দিয়ে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর।

শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল।

আমার কাছে রাইফেলের কার্তুজ খুব বেশি নেই, ভরসা খালি আগুন। কিন্তু আগুনের তেজ কমে এসেছে; জ্বালানি কাঠ, বসার টুল, এমনকি তাঁবুটাকেও আমরা জ্বালিয়ে দিয়েছি আর এমন কিছু নেই যা দিয়ে আগুনটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবার?

কাফাতোর দিকে তাকিয়ে দেখলুম তার কালো পাথরের মতো মুখ সম্পূর্ণ নির্বিকার, শুধু শরীরের মাংসপেশীগুলি যেন এক ভয়ংকর প্রতীক্ষায় ফুলে ফুলে উঠছে…

সামনের জানোয়ারটা আরও কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে আগুন ডিঙিয়ে একেবারে আমাদের সামনে এসে পড়ল। তার সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম তাকে অনুসরণ করে আরও দুটো জানোয়ার আগুনের বেড়ার উপর দিয়ে শূন্যে লাফ মারল।

আমার হাতের রাইফেল সশব্দে অগ্নি-উদ্গার করলে, সামনের জন্তুটার মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল।

কাফাতো হাতের বর্শা চার্লিয়ে আর-একটা জন্তুকেও মাটিতে পেড়ে ফেলল; কিন্তু তিন নম্বর শয়তানটা তার দেহের উপর এসে পড়ল এবং বিকট হাঁ করে শত্রুর গলায় কামড় বসাবার উপক্রম করলে। ভীষণ আতঙ্কে আমার হাতের আঙুল অবশ হয়ে এল। গুলি চালাবার উপায় নেই, কাফাতোর গায়ে গুলি লাগতে পারে।

আড়ষ্ট দেহে চোখের সামনে এক বিয়োগান্ত নাটকের রক্তাক্ত দৃশ্যের অপেক্ষা করতে লাগলুম।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি নিজের দেহের রক্তমাংস দিয়ে কোনো উপবাসী শ্বাপদের উপবাস ভঙ্গ করাতে কাফাতো রাজি হল না- চটপট মাথা সরিয়ে সে গলটা বাঁচিয়ে নিল, কিন্তু তীক্ষ্ণধার দাঁতগুলি তার বাঁদিকের কাঁধের উপর এঁকে দিল এক গভীর ক্ষতচিহ্ন।

কাফাতোর হাতের বর্শায় আবার বিদ্যুৎ খেলে গেল তীব্র আর্তনাদ করে জন্তুটার রক্তাক্ত দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ল– সব শেষ!

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যাক বাঁচা গেল।

কাফাতোর মুখে শুকনো হাসি খেলে গেল, মি. ম্যাক বাঁচবার আশা রেখো না- ওরা আবার আক্রমণ করবে।

সত্যিই তাই।

পর পর তিনটি সঙ্গীর মৃত্যু দেখে জন্তুগুলো একটু সরে গিয়েছিল কিন্তু একটু পরেই কয়েকটা জানোয়ার আবার আগুনের বেড়া ডিঙিয়ে আক্রমণ করল।

আবার গর্জে উঠল আমার হাতের রাইফেল, রক্তে লাল হয়ে গেল কাফালোর হাতের বর্শা আমাদের সামনে আর অগ্নিকুণ্ডর ওপাশে পড়ে রইল কতকগুলি শ্বেতকায় প্রাণহীন পশুদেহ।

কিন্তু শয়তানের দল পালিয়ে গেল না। কিছুক্ষণ পর পর তারা আক্রমণ করে, মাটিতে পড়ে থাকে কয়েকটা হতাহত জানোয়ার, ওরা পিছিয়ে আবার আক্রমণ করে…।

হঠাৎ সভয়ে দেখলুম রাইফেলের বুলেট ফুরিয়ে গেছে।

অকেজো জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কোমরের রিভলভারটা টেনে নিলুম মাত্র ছয়টি বুলেট তাতে ভরা আছে, সঙ্গে আর কার্তুজ নেই!

কাফাতোর নীরস কণ্ঠ শুনতে পেলুম, মি. ম্যাক, ওরা আবার আসছে..।

আহোয়ার সাদা কুকুর সম্পর্কে কোনো কথা আগে শুনিনি। পরে যখন জানতে পারলুম তখন মনে মনে ঠিক করে ফেললুম কয়েকটা সাদা কুকুরের চামড়া জোগাড় করতেই হবে।

আমি জাত শিকারি, শিকার আমার শুধু নেশা নয়- পেশাও বটে। যেসব জানোয়ার সচরাচর দেখা যায় না তেমন বহু জন্তু আমি শিকার করেছি এবং পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুঘরগুলি আমার কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সেই সব বিরল পশুচর্ম সংগ্রহ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আমার হাতে নিহত সাদা কুকুরগুলি এখন ম্যানিলা, পাপিতি এবং হনলুলুর বিখ্যাত জাদুঘরের শোভাবর্ধন করছে।

তাদের সাদা চামড়ার শোভায় মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা প্রায়ই চেঁচিয়ে ওঠে, বাঃ! বাঃ! কী সুন্দর! কী চমৎকার!

চমৎকারই বটে! এই চমৎকার চামড়া জোগাড় করতে গিয়ে আমার গায়ের চামড়াই শরীর-ছাড়া হওয়ার উপক্রম করেছিল। সেই কথাই বলছি…

আহোয়া উপত্যকায় যাওয়ার আগে অবশ্য এই সাদা কুকুরদের সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছুই জানা ছিলনা। পরে জানতে পারলুম হাঙ্গারির কোভাজ জাতের কুকুর থেকেই এদের উৎপত্তি।

এই জাতীয় কুকুরগুলি অত্যন্ত হিংস্র এবং শক্তিশালী হয় এবং এদের দেহের আয়তনও নেকড়ের চাইতে একটুও ছোটো নয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হিভাওয়া দ্বীপে কোনো এক হতভাগা ইউরোপীয় নাবিক কয়েক জোড়া কোভাজ কুকুর আমদানি করে। হাঙ্গারির কোভাজ বছরের পর বছর এই দ্বীপে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।

কিন্তু দ্বীপের মাঝখানে মানুষের হাতের তৈরি খাবার কোথা থেকে জুটবে? অতএব ক্ষুধার্ত কুকুরদের চোখ পড়ল পাহাড়ি ছাগল, বুনো মোষ ও গোরুর দিকে হিভাওয়া দ্বীপের উপর শুরু হল এক বিভীষিকার রাজত্ব।

এইভাবে সভ্য জগতের বাইরে হিভাওয়া দ্বীপের ওহিও উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করল একদল হিংস্র রক্তলোলুপ শ্বাপদ বিপুল বপু কোভাজ বিপুলতর হয়ে উঠল বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে, ধূসর রঙের ছোঁয়া লাগল তার দুধসাদা চামড়ায়, স্বভাবে তারা হয়ে উঠল আরও হিংস্র, আরও ভয়ংকর।

ইউরোপীয় নাবিকদের সঙ্গে আরও দুটি জানোয়ার এই দ্বীপে পদার্পণ করেছিল–ইঁদুর এবং বিড়াল। সাদা মানুষগুলি এখন আর নেই বটে কিন্তু কুকুর বিড়াল আর ইঁদুর- এরা সবাই আছে।

কুকুরগুলি এখন বিরাটকায় নেকড়ে বাঘের আকার ধারণ করেছে, ইঁদুরগুলি প্রায় ভোঁদড়ের মতো এবং বিড়ালগুলি আমাদের পোষা বিড়ালের চাইতে অনেক বড়ো হয়ে বন্য মার্জারে পরিণত হয়েছে।

ওহিও উপত্যকার বনবিড়াল এখন বুনো ইঁদুর শিকার করে, কুকুরগুলি ইঁদুর বা বিড়াল কাউকেই রেহাই দেয় না।

আর ইঁদুরগুলি কী খায়?

ইঁদুররা সর্বভুক– ফলমূল, পাখি, গিরগিটি, রুণ কুকুর বা বিড়াল তো বটেই, এমনকি সুযোগ পেলে জাতভাই-এর রক্তমাংসে উদরপূরণ করতেও তারা আপত্তি করে না।

যে ইউরোপীয় ভবঘুরের দল এখানে প্রথম এসেছিল তাদের কী হল?

ক্ষুধার জ্বালায় সুসভ্য নরখাদকে পরিণত হল- এখনও এখানকার দেশীয় অধিবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু লোক রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়, অনেক খোঁজাখুজি করেও তাদের পাত্তা মেলে না। এখানকার দেশি মানুষদের চেহারা ও আচার ব্যবহারে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না। মিশনারিদের কল্যাণে তারা সভ্যজগতের নিয়মকানুন কিছুটা শিখেছে বটে কিন্তু মন থেকে মেনে নেয়নি।

কাফাতো ঠিক এদের মতো নয়। তার বাপ ছিল মালয়ের অধিবাসী– সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার পেশা। ভবঘুরে নাবিকের রক্ত শরীরে থাকলেও কাফাতো তার দেশ ছেড়ে এদিক ওদিক যেতে চাইত না, বরং বর্শা আর ছুরি হাতে শিকার করতেই সে বেশি ভালোবাসত।

শিকারের হাত তার চমৎকার। কাফাতোর বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হয়েছিল কিন্তু তার বেতের মতো পাকানো ছোটো শরীরটা বয়সের ভারে একটুও কাবু হয়নি। রক্তারক্তি আর হানাহানিতে তার বড়ো আনন্দ; তাকে ঠিক শিকারি না বলে খুনে বললেই সঠিক আখ্যা দেওয়া হয়।

হিভাওয়া দ্বীপে যেদিন এসে নামলাম সেদিনই কাফাতোর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। আমার উদ্দেশ্য জানতে পেরে সে বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে হেসে ফেলল, তুমি বুঝি কুকুরের মাংস খুব পছন্দ করো?

মাংস নয়, শুধু চামড়ার জন্য মানুষ এমন বিপদের ঝুঁকি নিতে পারে এ কথা কাফাতোর কাছে অবিশ্বাস্য। তবু যখন অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে পারলাম যে কুকুরের মাংস খাওয়ার লোভ আমার নেই তখন সে গম্ভীরভাবে বললে, ঠিক আছে, চামড়া তোমার মাংস আমার তবে সাদা কুকুরের মাংসের রোস্ট যদি খাও তাহলে জীবনে ভুলতে পারবে না…।

শিকারের অনুমতি নিতে আমায় অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়েছিল। হিভাওয়া দ্বীপটা ফরাসিরা শাসন করে, আর ফরাসিদের মতো সন্দেহপ্রবণ জাত দুনিয়ায় নেই। অনেক হাঙ্গামা-জুত করার পরে কর্তৃপক্ষ আমাকে দয়া করে দু-সপ্তাহ সময় দিলেন তার মধ্যে আমার কাজ শেষ করে বিদায় নিতে হবে।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এক অজানা দ্বীপের অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব কিনা এই কথা ভেবে দস্তুরমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলুম, এমন সময় হঠাৎ কাফাতোর সঙ্গে আলাপ হওয়ায় স্বস্তি বোধ করলুম।

পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কাফাতো খুব উদার। কুকুরের মাংসের মতো লোভনীয় খাদ্যে আমি কোনো ভাগ বসাব না এতেই সে খুশি চামড়ার মতো অখাদ্য জিনিস নিয়ে তার কী লাভ?

চামড়া তোমার– মাংস আমার, এই তার শর্ত।

শর্তটা আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগল।

.

সন্ধ্যার ধূসর যবনিকাকে লুপ্ত করে নেমে এল রাত্রির অন্ধকার। ক্যাম্পের সামনে আগুন জ্বালিয়ে আমি চোখ বুজে শুয়ে পড়লুম। ঠিক হল প্রথম রাত আমি নিদ্রাসুখ উপভোগ করব আর কাফাতো পাহারা দেবে, বাকি রাতটা কাফাতোকে ঘুমোবার সুযোগ দিয়ে আমি জেগে থাকব।

ক্লান্ত শরীরে ভরপেট খাওয়ার পরে চোখ বুজতেই ঘুম এসে গেল।

একটা বীভৎস চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা আগেই বলেছি।

হ্যাঁ, ওরা আসছে আসবেই। এখনই তীক্ষ্ণ দাঁতের আঘাতে টুকরো হয়ে যাবে আমাদের শরীর দুটো। নিশ্চিত মৃত্যু করাল ফঁদ মেলে ছুটে আসছে, ঘিরে ধরছে আমাদের এই ভয়ংকর মরণ-ফঁদ থেকে আমাদের নিস্তার নেই…

কিন্তু আমি এখনও আশা ছাড়িনি।

একটা উপায় আছে শেষ উপায়।

হাতের রিভলভার উঁচিয়ে ধরে উপরি উপরি ছয়বার গুলি ছুড়লাম- চার-চারটে কুকুর মাটির উপর লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।

বাকি জন্তুগুলো আবার দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়ল।

ফাঁকা রিভলভারটা ফেলে দিয়ে কেরোসিনের বোতল আর টিনটা তুলে নিলুম, চিৎকার করে বললাম, কাফাতো, খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে যাও- আমি পিছনে আসছি।

শুনেছিলাম এই কুকুরগুলির দৃষ্টিশক্তি অতিশয় দুর্বল, এরা নির্ভর করে ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তির উপর। জ্বলন্ত আগুনের প্রখর আভা এবং রাইফেল ও রিভলভারের অগ্নিবৃষ্টি এদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কাজেই অন্ধকারের আড়াল দিয়ে আমরা যে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করেছি এটা তারা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু তাদের চোখকে ফাঁকি দিলেও কানকে ফাঁকি দিতে পারলুম না।

খানিক পরেই পাহাড়ের গায়ে আমাদের জুতোর অস্পষ্ট আওয়াজ তাদের কানে এল, পরক্ষণেই হিংস্র গর্জন করে ছুটে এল শ্বেত বিভীষিকার দল পাহাড়ের নীচে

এমন লোভনীয় শিকার হাতছাড়া করতে তারা রাজি নয়!

আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলুম। কুকুরগুলি যখন পাহাড়ের নীচে, আমি আর কাফাতো তখন অন্তত পঞ্চাশ ফিট উপরে উঠে গেছি।

উঁচু-নীচু পাথরের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথ উঠে গেছে উপর দিকে পাহাড়ে উঠতে হলে ওই একটি রাস্তা ছাড়া অন্য পথ নেই। শয়তানের দল সেই পথ বেয়ে তিরবেগে উঠে আসতে লাগল। নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করে কয়েকটা কুকুর ছিটকে পড়ল নীচে।

আমি কাফাতোকে ইঙ্গিত করলুম। সে সামনের কুকুরটাকে বর্শা দিয়ে চেপে ধরল পাহাড়ের গায়ে। কুকুরটার রোমশ দেহের উপর এক বোতল কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আমি একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ফেলে দিলুম। বিকট চিৎকার করে জন্তুটা পাহাড়ের উপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে গিয়ে পড়ল।

এইভাবে পর পর ছয়টা কুকুর উঠে এল আমাদের সামনে এবং তারা প্রত্যেকেই অগ্নিদেবের জ্বলন্ত আশীর্বাদ শরীরে বহন করে গড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের নীচে।

অবশিষ্ট কেরোসিন পাহাড়ের সরু পথের উপর ঢেলে একটি জ্বলন্ত দেশলাই-এর কাঠি ফেলে দিলুম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই তরল অগ্নিস্রোতের উপর দিয়ে উঠে আসার ক্ষমতা কোনো প্রাণীর নেই।

আমরা একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে নীচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলুম।

পাহাড়ের আগুন তখন নিভে এসেছে, কিন্তু দুরে অনেক নীচে কতকগুলি আগুনের গোলা ছুটছে, লাফাচ্ছে, গড়াচ্ছে। যে কুকুরগুলির শরীরে আগুন লেগেছে তারা অসহ্য যন্ত্রণায় দাপাদাপি করছে।

ধীরে ধীরে আগুন নিভে গেল, বাতাসে ভেসে এল দগ্ধ বোম ও মাংসের কটু গন্ধ!

অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা গেল কয়েকটা সাদা সাদা ভুতুড়ে ছায়া মৃত কুকুরগুলির দেহ নিয়ে টানাটানি করছে ওহিওর সাদা শয়তান জাতভাই-এর মাংস খেতেও আপত্তি করে না।

.

রাত্রি প্রভাত হল।

পাহাড়ের উপর থেকে এতক্ষণ নামতে সাহস হয়নি। দিনের আলোয় যখন ভালো করে দেখলুম আশেপাশে একটিও জ্যান্ত কুকুর নেই তখন সাবধানে নীচে নেমে এলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হয়েছে এই বুঝি শয়তানের দল তাড়া করে আসে। কিন্তু ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। দিনের আলোয় কুকুরগুলি বিশ্রাম নিতে গেছে, এক রাতের অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাতে তাদেরও বেশ খানিকটা সময় যাবে।

নীচে নেমে দেখলুম এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে অনেকগুলি কুকুরের মৃতদেহ। কতকগুলি কুকুরের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে বুঝলাম তাদের দেহের মাংসে তাদের স্বজাতিরাই উদর পূরণ করেছে। আবার কতকগুলির শরীর আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

তবে কয়েকটা চামড়া একেবারেই অটুট পেয়ে গেলুম। শুধু বুলেট এবং বর্শার ক্ষতচিহ্ন ছাড়া ওই চামড়াগুলিতে আর কোনো দাগ পড়েনি।

আমি আর কাফাতো কয়েকটা চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলুম। আমার সমস্ত শরীর তখন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে কিন্তু কাফাতোর বেতের মতো পাকানো দেহে অবসাদের কোনো চিহ্ন নেই- একদল লোক নিয়ে সে হই হই করে চলল সেই পাহাড়ের নীচে যেখানে পড়ে আছে কুকুরগুলির মৃতদেহ।

কুকুরের মাংসে সেদিন রাতে এক চমৎকার ভোজ হল ঝলসানো মাংস আমিও একটু চেখে দেখলুম। বললে বিশ্বাস করবে না, কুকুরের মাংসের রোস্ট ঠিক কুকুরের মাংসের মতোই, একটুও অন্যরকম নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *