গল্পের গোরু
একবার এক নদীতে আগুন লেগেছিল। খুব আগুন। আগুন লেগে নদী দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। নদীর তীরে ছিল অনেক বড় বড় গাছ। আগুনের তীব্র আঁচ সইতে না পেরে অবশেষে সেই নদীর মাছগুলো প্রাণ বাঁচাতে গাছে উঠে পড়ে।
গুলিখোরদের আড্ডায় সেদিন সন্ধ্যায়ও জোর গল্প-গুজব চলছিল। বলা বাহুল্য, গল্পের চেয়ে গুজবই বেশি। সেখানেই এক নম্বর গুলিখোর এই গল্পটা বলেছিল।
কিন্তু অন্য যে কোনও আড্ডার মতোই গুলিখোরদের আড্ডাতেও এত সহজে গল্প বলে কেউ পার পায় না। তুমুল প্রতিবাদ উঠল অন্যান্য গুলিখোরদের, তারা বলল, ‘এ হতেই পারে না।’ গুলিখর এর প্রতিবাদে যে কথাটা বলেছিল সেটা সবাই মেনে নিল।
দু’নম্বর গুলিখোরের অবশ্য সেদিন নেশা বেশি হয়েছিল। সে প্রায় গুম হয়েই বসেছিল, সে বিশেষ কিছুই বলেনি। দীর্ঘ একটা হাই তুলে দীর্ঘতর একটা তুড়ি মেরে সে সামান্য একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘মাছ কি গোরু যে গাছে উঠবে?’
এসব অনেকদিন আগেকার কথা। সেই থেকে এবং তারও বহু আগে থেকে গল্পের গোরুরা গাছে উঠছে। অবশ্য তারও আগে নদীতে আগুন লাগছে।।
রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য, বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর আর ঠাকুমার ঝুলির ভিতর দিয়ে সে গোরু প্রবেশ করেছে ত্রৈলোক্যনাথের কঙ্কাবতীর গল্পে, পরশুরামের বিরিঞ্চবাবায়। আদি ও অকৃত্রিম শিবরাম চক্রবর্তী গল্পের গোরুকে বরাবরই গাছে উঠিয়েছেন এবং নামিয়েছেন।
গল্পের গোরুর কাহিনীটা প্রথম গোপাল ভাঁড়ের বইতেই দেখেছিলাম, তারপর এর নানারকম পাঠান্তর দেখেছি।
গোপাল ভাঁড়ের সহজলভ্য বইগুলোতে এখনও এ জাতীয় গল্পের ছড়াছড়ি। দুয়েকটি রীতিমতো ক্লাসিক।
তার মধ্যে অন্তত একটি গল্প আপাতত স্মরণ করা যাক। গোপাল ভাঁড়ের বাজার-চালু বইগুলি, যেগুলো কালীঘাট মন্দিরের চাতালে বা রেলগাড়ির কামরায় সদাসর্বদাই পাওয়া যায়, তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই এই গল্প রয়েছে।
নদীয়াধিপতি রাজাধিরাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে গোপাল ভাঁড় ছাড়াও আরও একাধিক উলটোপালটা কথার লোক ছিলেন। তার মধ্যে একজন ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তিনি রাজদরবারে বসে যা-নয় তাই বাজে কথা বলে যেতেন। রাজার আত্মীয় বলে কেউই কোনও প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না, এমনকী গোপাল ভাঁড়ও পর্যন্ত নয়।
কিন্তু একদিন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেললেন ভদ্রলোক। তিনি সেদিন গোপাল ভাঁড়কে বললেন, ‘জানো গোপাল, আমার মামার বাড়িতে একখানা পেল্লায় লোহার কড়াই ছিল। সে বলতে গেলে একটা পুকুরের মতো, পুকুর নয় প্রায় দিঘিরই মতো। রান্নাঘরে সে কড়াই রাখা যেত না, আমার মামারা সেটাকে নদীর ধারে বালির চরে রেখে দিত। বর্ষাকালে সে কড়াইতে এত বষ্টির জল জমত যে লোকেরা নদীতে আর স্নান করতে যেত না, সেই কড়াইতেই তারা স্নান করত, সাঁতার কাটত।’
গোপাল ভাঁড় সেদিন আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারলেন না।
তিনি বললেন, ‘এবার আমার মামার বাড়ির গল্পটা বলি।’ প্রতিপক্ষের দিকে কঠোর নেত্রপাত করে গোপাল ভাঁড় শুরু করলেন, ‘ আমার বড়মামা মাছ ধরতে খুব ভালবাসতেন। তিনি ছিপে যেমন মাছ ধরতেন, তেমনি লোকজন জোগাড় করে জাল দিয়েও মাছ ধরতেন। একবার তার জালে একটা মহারুই ধরা পড়ল, সে মাছটার ওজন একশো মণ, লম্বায় তিরিশ হাত পাশে দশ হাত। তিনি সেই রুইমাছ টুকরো করে কেটে, ভেজে সব আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে ছিলেন। আমাদের বাড়িতেও এসেছিল এক মণ মাছ। কী অপূর্ব স্বাদ ছিল সেই মাছে, আহা, এখনও জিবে লেগে আছে।’
পরপর এমন দুটো গাঁজাখুরি গল্প শুনে রাজসভার অন্য পারিষদেরা স্তম্ভিত কিন্তু রাজার আত্মীয় যিনি তাঁর মামার বাড়ির কড়াইয়ের কথা বলেছিলেন, তিনি তীব্র আপত্তি তুললেন।
তার আপত্তি দুই দফা :—
(এক) কোনও মাছ অত বড় হতে পারে না।
(দুই) অত বড় মাছ ভাজা হল কী করে। একশো মণ মাছ ভাজতে কত বড় কড়াই লাগে তা কি গোপাল জানে?
প্রথম আপত্তির কোনও জবাব দিলেন না গোপাল কিন্তু দ্বিতীয় আপত্তির মুখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, বললেন, ‘অবশ্যই জানি। শুধু আমি নই আমার মামারাও জানত। সেইজন্যেই আমার বড়মামা সেবার আপনার মামার বাড়ি থেকে সেই কড়াইখানা নিয়ে এসেছিল এবং সেই কড়াইতেই মাছটা ভাজা হয়েছিল।’
তারপর একটু থেমে গোপাল বললেন, আপনার মামার বাড়িতে সেবার আমার বড় মামা আড়াই মণ মাছ পাঠিয়েছিলেন। আপনিও দশ-বিশ টুকরো খেয়েছিলেন। আপনার নিশ্চয় মনে আছে কী অপূর্ব স্বাদ ছিল সেই মাছের।’
এরই পাশাপাশি একটি বিলিতি গল্প আছে। সেটাকে জাতীয়করণ করে সুন্দরবনে নিয়ে আসছি।
পঞ্চাশ বছর আগের গল্প এটা। তখনও কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবে নেটিভদের প্রবেশাধিকার ছিল না। শ্বেতাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গিনী ছাড়া ক্লাবের ত্রিসীমানায় যেসব ভারতীয়কে দেখতে পাওয়া যায় তারা সবাই হয় ভৃত্য, না হয় রাঁধুনি, বড়জোর বেয়ারা।
সে যা হোক এই ক্লাবের লনে একদিন রাতে জোর আড্ডা চলছে, এমন সময় স্থায়ী সদস্য টমসাহেব হাঁফাতে হাঁফাতে সেখানে এসে ঢুকলেন। তিনি যা বললেন সেটা অকল্পনীয়। প্রথমে ভাল করে কিছু বলতে পারছিলেন না, শুধু বলছিলেন ‘গুড গড! কলকাতায় কী সাংঘাতিক কথা, কলকাতায় বাঘ।’
সবাই বলল, ‘এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? কলকাতায় বাঘ তো আছেই। চিড়িয়াখানায় অন্তত সাতটা বাঘ আছে। তা ছাড়া মার্বেল প্যালেসে মল্লিকদের বাড়িতে এবং আরও অনেক জায়গায়ই নাকি পোষা বাঘ আছে।’
টমসাহেব বললেন, “আরে না না পোষা বা বন্দি বাঘ নয়। একেবারে তরতাজা, টগবগে, জংলি রয়াল বেঙ্গল।’
টমসাহেব বললেন, ‘ফোর্টের সামনের মাঠে আজ সন্ধ্যাবেলা একলা বসে বিয়ার খাচ্ছিলাম। ঘণ্টাখানেক আগের কথা। হঠাৎ ঘাড়ের ওপর গরম নিশ্বাস পড়ায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মস্ত হাঁড়ির মতো মাথা, বিশাল এক কেঁদো ডোরাকাটা বাঘ। ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে পুরো বিয়ারের বোতলটা সেই বাঘটার মাথায় ঢেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।’
টমসাহেবের এ রকম বাজে গল্প বানিয়ে বলার বাতিক আছে। আড্ডার কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করল না। কিন্তু সেই টেবিলেই তখন ছিলেন জনসাহেব, টমসাহেবের চিরশত্রু।
টমসাহেবের গল্প শেষ হওয়ার পরে কিঞ্চিৎ শোরগোল উঠল, প্রায় সবাই বলতে লাগল বাজে, গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু জনসাহেব আজ সম্পূর্ণ বিপরীত রাস্তা ধরলেন, তিনি বললেন, ‘অন্যান্য দিন টম হয়তো গালগল্প বানিয়ে বলে, তবে আজ যা বলেছে সম্পূর্ণ সত্যি। আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি টম এ গল্পটা বানিয়ে বলেনি।’
সবাই অবাক, সমস্বরে জিজ্ঞাসা উঠল, ‘মানে?’
জনসাহেব বললেন, ‘আধ ঘণ্টা আগে ফোর্টের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। স্ট্যান্ডের কাছে এসে দেখি, ওই টম যেমন বলল বিশাল কেঁদো এক রয়াল বেঙ্গল বাঘ হেলতে-দুলতে আসছে। বাঘটা কাছে আসতে সেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। দেখি যে মাথার লোমগুলো কেমন ভেজা ভেজা, হাতটাও কেমন চটচট করছে। শুঁকে দেখি বিয়ারের গন্ধ। এখন টমের কথা শুনে বুঝলাম রহস্যটা কী?’
টমসাহেব আর জনসাহেবের গল্প পড়ে যাদের বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে তাদের জন্যে আরও একটা গল্প আছে।
এই পরের গল্পের চরিত্রদ্বয়ের নামও টমসাহেব এবং জনসাহেব। তবে এ গল্পে তাঁরা দু’জনেই পাগল।
টমসাহেব আর জনসাহেব, যুগ্ম উন্মাদ। দু’জনে একই পাগলাগারদের আবাসিক। দু’জনে একযোগে বুদ্ধি করে একদিন সকালবেলায় প্রহরীর চোখে ফাঁকি দিয়ে উন্মাদ আশ্রমের দেওয়াল টপকিয়ে পালিয়েছেন।
দেওয়ালের ওপাশেই একটা খাল। বর্ষাকাল, খালে গভীর জল। তবে আশার কথা এই যে খালপার ধরে কিছুদূর এগোলেই একটা বাঁশের সাঁকো আছে।
টমসাহেব এবং জনসাহেব সেই সাঁকোর দিকে দ্রুত ছুটতে লাগলেন। ইতিমধ্যে উন্মাদ আশ্রমের রক্ষীরা টের পেয়েছে যে দু’জন পাগল পালিয়েছে। তারা দেওয়ালের ওপাশ দিয়ে ছুটে এসে দেখল কিছুদূর টমসাহেব আর জনসাহেব বাঁশের সাঁকোর দিকে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছেন।
তাই দেখে আশ্রমের রক্ষীরাও তাদের পেছনে দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে টমসাহেব এবং জনসাহেব সেই বাঁশের সাঁকোর ওপরে উঠে পড়েছেন।
বাঁশের সাঁকোটি পুরনো, নড়বড়ে এবং ভাঙা। খুব সাবধানে একজন যেতে পারে। কিন্তু কথাই তো আছে যে ‘পাগলারে পাগলা সাঁকো নাড়াস না।’ এ ক্ষেত্রে পাগল একজন নয়, দু’জন। আর দুজনেই দ্রুতবেগে বাঁশের সাঁকোর ওপরে ছুটে যাচ্ছেন। ফলে যা হবার তাই হল, টমসাহেব এবং জনসাহেব উভয়েই নড়বড়ে সাঁকো ভেঙে খালের সুগভীর জলের মধ্যে পড়ে গেলেন।
রক্ষীরা তখন বাঁশের সাঁকোর কাছে খাল ধারে এসে গেছে। তারা দুই পলাতক রোগীর এই পরিণতি দেখে ‘হায় হায়’ করে উঠল। নিমজ্জিত ব্যক্তিদের জল থেকে উদ্ধার করার মতো সাঁতারে পটু তারা কেউই নয়। তা ছাড়া মধ্যবর্ষার খালের জল শুধু গভীরই নয়, খরস্রোতাও বটে।
তবে সুখের কথা এই যে রক্ষীরা দেখতে পেল টমসাহেব বেশ ভাল সাঁতার জানেন, তিনি তরতর করে সাঁতরিয়ে পারে এসে রক্ষীদের পাশে উঠলেন। ইচ্ছে করলে তিনি ওপাড়ে উঠে পালিয়ে যেতে পারতেন, সাঁকোও ভেঙে গেছে, রক্ষীদের পক্ষে আর তাকে অনুসরণ করা সম্ভব হত না।
কিন্তু টমসাহেব পালানোর চেষ্টা না করে রক্ষীদের কাছেই ফিরে এলেন এবং শুধু তাই নয়, যখন দেখলেন জনসাহেব জল থেকে উঠে আসতে পারেননি মধ্যখালে হাবুডুবু খাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে আবার জলে ঝাপিয়ে পড়লেন এবং জীবন বিপন্ন করে জনসাহেবকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে আনলেন।
রক্ষীরা নিশ্চিন্ত মনে টমসাহেব আর জনসাহেবকে নিয়ে হাসপাতালে ফিরে এল। হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব যখন টমসাহেবের অতুল কীর্তির কথা শুনলেন তিনি ধরে নিলেন টমসাহেব তা হলে মোটামুটি সুস্থই হয়ে গেছেন।
অনেক কিছু বিবেচনা করে সুপারিনটেন্ডেন্ট সাহেব ভাবলেন আজ বিকেলেই টমসাহেবকে একটা বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে ছেড়ে দেব, উনি তো ভালই হয়ে গেছেন। তিনি আরও ঠিক করলেন সেই সভায় জনসাহেবকেও বলা হবে যে তাঁকে শিগগিরই ছেড়ে দেওয়া হবে।
সেদিন বিকেলে যথারীতি সংবর্ধনা ও বিদায় সভার আয়োজন করা হল। হাসপাতালের ডাক্তার, রক্ষী, কর্মী এবং রোগীরা সবাই উপস্থিত, টমসাহেব গলায় মালা পরে মঞ্চে বসে আছেন। কিন্তু আশেপাশে কোথাও জনসাহেবকে দেখা যাচ্ছে না।
কর্তৃপক্ষের একজন ব্যাপারটা খেয়াল করলেন, আজকের সংবর্ধনার নায়ক টমসাহেব বটে কিন্তু এ ব্যাপারে জনসাহেবের ভূমিকাও কম নয়। তাঁকে ছাড়াও অনুষ্ঠান হয় কী করে? তখন খোঁজ পড়ল জনসাহেবের।
তাই দেখে টমসাহেব বললেন, ‘কী হল, আপনারা জনসাহেবকে খুঁজছেন? আমি তো তাঁকে তিনতলার চিলেকোঠার ছাদে রোদ্দুরে শুকোতে দিয়েছি।’
এই বলে টমসাহেব সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের তিনতলার ছাদে উঠলেন।
সেখানে দেখা গেল চিলেকোঠার সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে জনসাহেবকে ঝোলানো হয়েছে, তবে দড়ির গিঁটটা তেমন শক্ত নয়। জনসাহেবকে তাড়াতাড়ি দড়ি খুলে নামিয়ে দেখা গেল এখনও ধড়ে কিঞ্চিৎ প্রাণ আছে। তবে দড়ির টানে থুতনিটা ছড়ে গেছে।
জলের ছিটে দিয়ে, অনেক সেবাযত্ন করে কিছুক্ষণের মধ্যে জনসাহেবের সংজ্ঞা ফিরে এল। তখন জনসাহেব কোনওরকমে চিঁ চিঁ করে জানালেন, ‘আমি তো জলে ডুবে একদম চুপসে গিয়েছিলাম। ছাদের এদিকটায় পশ্চিমের রোদটা আসে, তাই টম আমাকে এখানে রোদে শুকনোর জন্যে টাঙিয়ে দিয়েছিল।’
জীবন্ত মানুষকে গলায় দড়ি দিয়ে রোদে শুকোতে দেওয়া, কিংবা কইমাছ এবং গোরুর গাছে ওঠা, দিঘির মতো বড় কড়াই বা বন্য বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া এই জাতীয় আজগুবি গল্পগুলোকে ইংরেজিতে বলে টল টেল মানে লম্বা কথিকা। সাদা বাংলায় গাঁজাখুরি গল্প বললেও এই গল্পগুলোর জন্যে একটি চমৎকার শব্দ আছে বাংলা ভাষায় সে শব্দটি হল আষাঢ়ে গল্প।
‘আষাঢ়ে গল্প’ শব্দটির বুৎপত্তি সম্পর্কে অভিধানে বিশেষ কিছু খুঁজে পাইনি।
চলন্তিকায় রাজশেখর বসু আষাঢ়ে গল্পের মানে দিয়েছেন অদ্ভুত, অসম্ভব ঘটনা সংবলিত গল্প। তার মানে শুধু গল্পটা অদ্ভুত হলে হবে না, গল্পটাকে অদ্ভুত ঘটনা সংবলিত হতে হবে।
সংসদ বাংলা অভিধান অবশ্য অনেক স্পষ্ট। সেখানে বলছে আষাঢ়ে মানে অদ্ভুত, মিথ্যা, অলীক। সংস্কৃত আষাঢ় শব্দের সঙ্গে বাংলা ইয়া প্রত্যয় যোগে আষাঢ়িয়া, এবং তারপরে আষাঢ়িয়া থেকে আষাঢ়ে।
অভিধানেই যখন হাত দিলাম একটু সুবল চন্দ্র মিত্রকেও ছুঁয়ে রাখি। বাংলা ভাষার অভিধানে সুবল মিত্র বলছেন আষাঢ়ে গল্পের মানে হল অদ্ভুত গল্প, কাল্পনিক কাহিনী, অবিশ্বাস্য কাহিনী।
গল্পের আগে আষাঢ়ে বিশেষণটি কেন তা কিন্তু জানা যাচ্ছে না। তবে আমরা অনুমান করতে পারি।
আষাঢ় মাস। সারাদিন রাত প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। ঘর থেকে বাইরে বেরনোর উপায় নেই। অন্ধকার সন্ধ্যাবেলা, স্তিমিত কেরোসিন লণ্ঠন বা রেড়ির তেলের বাতিকে ঘিরে কয়েকজন কর্মহীন অলস লোক বসে আছে। তাদেরই ভিতরে কেউ কল্পনার অশ্বের লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। সেই অশ্বখুরের তাড়নায় আষাঢ়ে গল্পের গোরু উঠছে গাছে। বাঘের মাথায় বিয়ার ঢালছে মানুষ।
আর শুধু গল্পের গোরু কেন পদ্যের গোরুও গাছে ওঠে। সুকুমার রায়, এডোয়ার্ড লিয়ার কিংবা লুইস ক্যারল অবশ্যই শিরোধার্য কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও গল্পের গোরুকে গাছে তোলার বদলে পদ্যের রাজাকে দাঁড়ে তুলিয়েছিলেন।
স্মরণ করা যাতে পারে সোনার তরী’র ‘হিং টিং ছট’ কবিতা,…’
শিয়রে বসিয়া যেন তিনটি বাঁদরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে—
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড়,
চোখ মুখে লাগে তার নখের আঁচড়।
সহসা মিলালো তারা এলো এক বেদে
‘পাখি উড়ে গেছে’ বলে মরে কেঁদে কেঁদে।
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে।
নিচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি।’
পুনশ্চ : গল্পের গোরু নামক আষাঢ়ে নিবন্ধটি রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে শেষ করা সমীচীন হবে না। সুতরাং আর একটি তরল কাহিনী যোগ করছি। অতি সংক্ষিপ্ত সেই কাহিনী এবং প্রকৃতই সেটা একটা আষাঢ়ে গল্প।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টিময় এক আষাঢ়ে সন্ধ্যা। ঘরের মধ্যে বসে লোকেরা বিশ্রম্ভালাপ করছে। এক সময় মনে হল এতক্ষণে বুঝি বৃষ্টি থামল কিন্তু সবাই দ্রব্যগুণে ঝিম মেরে বসে আছে। অবশেষে একজন বলল, ‘কেউ একজন বাইরে গিয়ে দেখে এসো তো বৃষ্টি ধরল কিনা?’
সেই কেউ একজন বলল, ‘বাইরে যেতে হবে কেন? গোয়ালঘরে গোরুটা রয়েছে সেটাকে আয়-আয় করে ডাকলেই এখানে চলে আসবে।’
সবাই বলল, ‘তাতে কী হবে’?
উত্তর পাওয়া গেল, ‘গোরুটা এখানে এলে তার পিঠে হাত বুলিয়ে যদি দেখা যায় ভেজা তা হলে বৃষ্টি এখনো হচ্ছে, আর যদি দেখি শুকনো তা হলে বৃষ্টি থেমে গেছে।