গল্পের খোঁজে
গল্পের খোঁজে লেখকদের নানা জায়গায় যেতে হয়। নানা দেশে, নানা পরিবেশে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দিনলিপিতে লিখছেন—সব কোয়েন্ট ধরনের লোকের সঙ্গে মিশতে হবে। ‘মম’ এসেছিলেন ভারতবর্ষে, গ্রাহাম গ্রিন গেলেন আফ্রিকায়। জ্যাক লন্ডন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেন চরিত্রের সন্ধানে, গল্পের সন্ধানে। কমপিউটারকে যেমন আগে-ভাগেই নানা তথ্য দিয়ে তার যান্ত্রিক মস্তিষ্কটিকে তৈরি করে দিতে হয়, তা না হলে কোনও সমস্যাই তার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হয় না, কোনও প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর আসে না, লেখাকেও তেমনি সর্বসময়ে আইডিয়া দিয়ে, প্ট দিয়ে, মুড দিয়ে, নিজেকেই নিজে ভরপুর করে রাখতে হয়। কখনও বেদনা দিয়ে চাবকাতে হয়, কখনও সুখ-সুখ ভাবের ময়ূর-পেখম মনের আকাশে মেলে দিতে হয়। কখনও রাগ, কখনও বিষাদ, কখনও হর্ষ, কখনও উল্লাস, নানাভাবে নানা মানসিক অবস্থায় নিজেকে রেখে নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি মেজাজের আবরণ তৈরি করে, বিভিন্ন পরিস্থিতি, পরিবেশের মধ্যে থেকে, জন্ম দেওয়া। চরিত্রের জন্ম, ঘটনার জন্ম, বিশ্বাস, অবিশ্বাসের জন্ম। দিনের জন্ম, রাতের জন্ম। প্রথম একাত্মতা, পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে অনুভূতি আর কল্পনা দিয়ে বাস্তবের আদলেই নিটোল একটি জগৎ তৈরি করা। ত্রুশবিদ্ধ যিশুর কথা ভেবে এক ভক্তের হাতের আর পায়ের তালু থেকে রক্তক্ষরণ হত। যবন হরিদাসকে চাবুক মারা হল, দাগ ফুটে উঠল শ্রীচৈতন্যের শরীরে। দুটো হৃদয় না থাকলে সৃষ্টি হয় না।
তাহলে গল্পের খোঁজে অন্য কোথাও যাওয়ার আগে নিজের কাছেই সরে আসা ভালো। যার হাত ধরে পথে বেরিয়েছি, আসরে নেমেছি, যাকে সামলাতে, সুখে রাখতে, মেজাজে রাখতে এত কসরত, যার আবদার সামলাতে নাজেহাল, সেই আমিটাকেই যদি ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লক্ষ করা যায়, সেই আমিই তো কয়েকশো চরিত্রের কাহিনির জন্ম দিতে পারে। আমিটাকে বিকিয়ে দেওয়ার জন্যেই তো পৃথিবীতে আসা।
”আমির বাহার” বহুরূপে সম্মুখে আমার—আমি। ভীতু আমি, সাহসী আমি, ভোগী আমি, ত্যাগী আমি, প্রেমিক আমি, বিরহী আমি, ঋষি আমি, উদার আমি, শয়তান আমি, প্রকাশিত আমি, অপ্রকাশিত আমি। আমির কেয়ারি করা বাগান।
”চাপের আমি, আমির চাপ” আমার বা আমাদের আসল আমি বা ভার্জিন আমিটা কেমন ছিল বলা মুশকিল। শৈশব আমিটা যখন সবে কুঁড়ি খুলে ফুল হতে চলেছে তখনই আমির বাগানের বড় বড় মালিদের নানারকম ছাঁটকাট শুরু হয়ে গেল। চেয়ারে বসানো হল, সামনে আয়না। পিতার হাতে কাঁচি, মাতার মুখে হাসি, অভিভাবকদের নানা উপদেশ। ”আমি ছাঁটাই সেলুন।” ওই যে কানের পাশ দিয়ে অবাধ্যতা খোঁচা মেরেছে—একটু ছেঁটে দাও। ঘাড়ের কাছে বড্ড বেশি স্বাধীন ইচ্ছে লটপট করছে, দাও একটু চেঁছে। পুডিং তৈরির টিনের খোপে ‘আমি’টাকে গুলে ঢেলে দাও, তারপর আমাদের ইচ্ছের উনানের তাপে জমিয়ে, ‘আমাদের’ ভালোবাসার ফ্লেভার দিয়ে বাজারে ছেড়ে দাও। শ্রীমান অমুকচন্দ্র তমুক।
সেই চাপের আমি ছাঁটের আমি, চারদিকে আমির চাপ, আমির ছাঁট তৈরির চেষ্টা করে চলেছে। তোমার ‘তুমি’র ওপর, আমার আমি’টা চেপে বসে থাকবে। কারণ আমার ‘আমি’টার ওপর অন্যের ‘আমি’টা জড়িয়ে আছে।
”ফুল পয়েন্ট, তিন পয়েন্ট” আমি চাই, পাখা ঘুরবে তিন পয়েন্টে। ফুল পয়েন্টে সাঁই সাঁই পাখা ঘুরলে আমি বিরক্ত হই। দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের ঠ্যাং ছোঁড়ার শব্দ হয়, খবরের কাগজ পড়তে পারা যায় না। বইয়ের পাতা উড়তে থাকে। সবকিছু চেপে রাখতে না পারলে সারাঘরে উড়তে থাকে। আমি চাই তিন, তুমি চাও ফুল স্পিড। ঘরের মালিক আমি, আমার পয়সার পাখা। বিল দেব আমি। আমি বলছি তিন, তিনেই থাকবে।
”ফুল পয়েন্ট ভার্সাস তিন পয়েন্ট” ফুল পয়েন্টে যিনি পাখা চালাতে চান, তাঁকে কিছু অধিকার দিয়েই জীবনে প্রবেশ পথ করে দেওয়া হয়েছে। সেই ‘তুমি’ আর এই ‘আমি’ দুটোরই স্বতন্ত্র ওজন আছে। দুটোকে দু’পাল্লায় রাখলে কাঁটা যদি সমান থেকে যায়, তাহলে একটা রফা হবে—বেশ, তোমার কথাও থাক, আমার কথাও থাক, চারে চলুক। আমি যদি ভারী হই তাহলে রাখো, তোমার ফুল। তিন, তিনেই চলবে। ‘তুমি’ যদি ভারী হও তাহলে রাখো তোমার তিন, ফুল স্পিড লাগাও।
একটা সময় ছিল যখন সব সংসারেই কর্তা ‘আমি’র বেশ ওজন ছিল। নাদুস-নুদুস, নেয়াপাতি ভুঁড়ি। হয় ন্যাজঝোলা গোঁফ, না হয় কার্নিস খোলা গোঁফ, অথবা হিটলারি বাটার ফ্লাই। ভেতরে একটা গমগমে ‘আমি’। বাড়ির ঝি বাইরে বর্ণনা দিচ্ছে—কর্তা এই এতখানি শরীর নিয়ে লাল একটা লুঙ্গি পরে লাল মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসেছে। টকটক করছে চওড়া পিঠ। ব্রহ্মদত্যির মতো সাদা চওড়া পৈতে। মুক্তোর মতো ঘাম ফুটে উঠেছে। ঝকঝকে থালার পাশে গোল করে সাজানো বাটি। আমের আঁটিটা মুখে ধরেছে যেন সুন্দরবনের রয়েল বাঘ প্রসন্ন মুদীর ঘাড় কামড়ে ধরেছে। পাশে বসে গিন্নী ঝালর লাগানো হাতপাখায় হাওয়া করছে। বয়েস হয়েছে তো, সাদা ধবধবে শাড়ি, চওড়া ভেলভেট পাড়। এই এতবড় আঁচলা। থেবড়ে বসেছে, পেছনটা যেন চৌধুরীবাবুদের বাড়ির থাম। সাদা গোল হাতে মিছরিকাটা চুড়ি। পাখা নড়ছে, চুড়ি বাজছে টিনটিন। ঘুম এসে যায়। ল্যাংড়ার আঁটি চুষতে চুষতে কর্তা গিন্নীর দিকে যখন তাকাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে, এই বড় একটা কদম ফুল। যেন রাধিকার দিকে চেয়ে আছে। গোঁফে আমের রস। দুটো নীল মাছি ঠোঁটের কাছে ভ্যান ভ্যান করছে। লোমওলা সাদা কাবলে বেড়ালটা সামনে থেবড়ে বসে মিটিমিটি চাইছে। মাঝেমাঝে জড়ানো গলায় মিউ মিউ করছে। একবার করে উঠতে চাইছে, গিন্নী বাঁ হাত দিয়ে মাথায় চাপড় মেরে বলছেন—খুঁশি খুঁশি। খাওয়া শেষ করে ঢেঁকুর তুললে—মনে হল গোয়ালে মুংলীটা ডেকে উঠল—হম্বা। কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লেন—মোক্ষদা হাতে জল দিয়ে যা। শব্দ শুনে ঘুলঘুলি থেকে দুটো পায়রা ঝটপট করে বেরিয়ে আকাশে তিন চক্কর পাক খেয়ে এল। হাত মুছে বললেন—কই গো পান দাও। মনে হল বারোয়ারি তলায় ঢাকে কাঠি পড়ল।
তিরিক্ষি মেজাজের খিটখিটে কর্তার খোলেও ঝনঝনে একটা ‘আমি’ থাকতে পারে। ডিসপেপসিয়ায় তোবড়া গাল গর্তে বসা হলদেটে চোখ। নাকের তলায় খ্যাংরা গোঁফ। মাথার ব্রহ্মতালুটা কামিয়ে ডিম ছেড়ে দিলে পোচ তৈরি হয়ে যাবে। রাতে ঘুমোতে পারে না। জানলার ধারে টুলে বসে ঘন ঘন নস্যি নেয় যতক্ষণ না রাত ভোর হচ্ছে। মাঝেমাঝে গলা খাঁকারি দিয়ে সন্ধান নেয় ‘আমি’টা খোলের মধ্যে ঠিকঠাক আছে কিনা। এরা সব শুকনো আমি। খায় কম। জীবনে ভোগের চেয়ে দুর্ভোগ বেশি। চরিত্র, আদর্শ, ঈশ্বর, প্রেততত্ব এইসব নিয়ে মাথা ঘামায়। ইচ্ছে করে সিনেমায় যেতে চায় না। বউ জোর করে বগলদাবা করে ধরে নিয়ে যায়। বিয়ে বাড়িতে লোক-লৌকিকতা করতে যাওয়ার নাম শুনলেই এইসব ‘আমি’দের মুখ ভার হয়, মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। ইয়া খোঁপা করা, সিল্কের শাড়ি পরা। ক্ষয়াক্ষয়া চেহারার বউকে দাবড়ে ওঠে—মনে রেখো যাচ্ছ বিয়েবাড়িতে কোনও খারাপ পাড়ায় নয়। বুঝেছ। খোঁপার ভেতর থেকে গোলাপটা খুলে ফেলে দাও। ভালো করে মুখটা ধুয়ে এসো, খড়ি ফুটে আছে। ছাই পাঁশ না মেখে একটু সরষের তেল মেখে এসো। ভদ্রবাড়ির বউদের মতো দেখাক। পরেছ তো মেয়ের ব্লাউজ, পিঠ বেরিয়ে আছে। নিজের জামা নেই?
‘আমি’র আক্রমণে ‘তুমি’ ফুঁসে উঠল। দুহাত দিয়ে খোঁপার ধামাটা ঘাড়ের ওপর থেকে ঠেলে মাথার দিকে তুলতে তুলতে তুমি বলে উঠল—ওই যে জায়গার নাম করলে, সেই জায়গায় যাও বুঝি, তা না হলে জানলে কি করে, খোঁপা কেমন, মুখের পাউডার কীরকম। নিজের বউয়ের দিকে তো জীবনে তাকালে না, বাইরের মেয়েছেলে সামলাতেই মর্কট মেরে গেলে। মেয়েরা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার আগে এই ভাবেই খোঁপা করে। মুখটা তেলতেলে করে বলেই একটু পাউডার ঘষা। গরমে ঘাম শুকিয়ে একটু খড়িখড়ি দেখাবেই। আর, বড় ব্লাউজ ম্যানুফ্যাকচার হয় না আজকাল। কোথায় পাব তোমার পিসিমার আমলের ঘটিহাতা জামা।
‘আমি’ চিৎকার করে উঠল—ওপাড়ায় যেতে হয় না আমাকে। বাড়িরটাই ওপাড়ার ওপর যায়। যেমন চাল, তেমনি চলন, তেমনি কথার ছিরি। দুটো জিনিস পাশাপাশি চলছে—সুরুচি, কুরুচি। নিলে নিলে, কুরুচটাই নিলে। আর হবে না, ছেলেবেলার বদশিক্ষা। ভদ্দরলোকের বউয়ের মতো সাজতে পারো যাব, না পারো এই বসল ‘আমি’।
যেতে হবে না, এই রইল তোমার জিনিস। ‘তুমি’ ছুড়ে দিল শাড়ির প্যাকেট। ছিঁড়ে চিতপটাং হয়ে মেঝেতে পড়ল ছাপা শাড়ি।
এই তো চেয়েছিল ‘আমি’। নাক কেটে যাত্রাভঙ্গ। ‘আমি’র ভালো লাগছে না, ‘তুমি’র লাগছে। ‘আমি’ চাইছে ‘তুমি’র আত্মসমর্পণ, ‘তুমি’ চাইছে ‘আমি’র। যে ‘আমি’ ঝুঁকতে জানে, মানাতে জানে, যে ‘তুমি’ মানতে পারে, ছাড়তে পারে, ‘আমি’ আর ‘তুমি’ সেখানে একরকমের গল্প। তা না হলেই সংঘাত।
নানারকম সবজি দিয়ে এক এক স্বাদের তরকারি। বিশ্বকটাহে উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ, তৃতীয় পুরুষ টগবগ করে ফুটছে। ‘স্মোক নুইসেনস অফিসার’ খুব বড় বাড়ির ছাদ থেকে চোখে দূরবীণ লাগিয়ে চিমনি দিয়ে ওঠা ধোঁয়ার রং দেখে বলতে পারেন, কীসের ধোঁয়া, কতটা ক্ষতিকারক ধোঁয়া, কিংবা স্বাভাবিক ধোঁয়া। অনেক জ্যোতিষী আছেন, মানুষের চেহারা দেখে বুঝতে পারেন—শনির জাতক, শুক্রের জাতক, বুধের জাতক। সিংহের কি বৃষের কি মেষের চরিত্র। বাসের মাঝখানে বেশ দাঁাড়িয়েছিলেন সুখে স্বাচ্ছেন্দ্যে। হঠাৎ ভূত দেখার মতো সরতে সরতে ঘাড়ে এসে পড়লেন। ব্যাপারটা কী! ওই যে দেখছেন না, গোঁফওলা, শনি প্রবল, পাশে দাঁড়ালেই ঝগড়া করবে, তাই হুড়ম করে আপনার ঘাড়ে চাপলুম। আমি কে। বুধের মানুষ—ছেলে ছেলে, খোকা খোকা ভাব আজীবন বুড়ো খোকা, বোকা বোকা আপনি কে—আমি! চিনতে পারলেন না-রাহু। মুণ্ডু আছে ধর নেই। মুখ দিয়ে গলে গলা দিয়ে বেরিয়ে যাবেন।
গল্পের খোঁজে, চরিত্রের খোঁজে, চরিত্রের ভেতরে ঢুকতে হলে কি যে হতে হবে —ঈশ্বর কিংবা জ্যোতিষী, কিংবা তান্ত্রিক স্পাই অথবা সখা। মেয়েদের মতো দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়াতে হবে, শুনি ওরা ভেতরে কি বলাবলি করছে। বদমাইশ হোটেলওলাদের মতো পার্টিশানে ফুটো করে অন্যের ঘর গেরস্থালির দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কি করতে হবে লেখকই জানেন। স্রষ্টা ‘আমি’ অজস্র ‘সে’, ‘তুমি’, ‘তোমরা’ ‘তাহারা’র স্রোতে ভেসে চলেছে। সংঘাত, মিলন, আনন্দ, বেদনা, কিছু দেখা, কিছু অদেখা, সব মিলিয়েই, ‘তোমাকে’ উপহার—আমাদের জীবন।