গল্পগুচ্ছ ও কল্যাণবাবু
শেষ সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট থেকে জিনাকে বেরোতে দেখলেন কল্যাণবাবু। দেখলেন বাস থেকে। তিনি শ্যামবাজারের মোড় অবধি গিয়ে বাস বদল করবেন। জিনা একটা উজ্জ্বল সাদা রংয়ের পোশাক পরে ছিল। চুলগুলো খোলা। কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। তিনি প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি। তাঁর বুড়ো চোখে এখন অল্পবয়স্ক মেয়েমাত্রই ভাল লাগে। একটি মেয়ে, যেন জীবন-যৌবন, প্রাণের যত আনন্দ সব কিছুর মূর্তি ধরে এসে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছে—এরকমটাই তিনি দেখলেন। উচ্ছল নয়— ধীর, চঞ্চল নয়— গভীর। যে জিনাকে তিনি বাড়িতে দেখেন সে তো এমনটা নয়। সে ছটফটে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে, প্রাণচঞ্চল, বকবক করছে তো করছেই। আসলে, কল্যাণবাবু প্রকৃত জিনাকে দেখেন না। যে ছোট বউমাটিকে তাঁরা সবাই খুব পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলেন, এবং যে সমস্ত সাংসারিক ওঠা-পড়া মন-কষাকষির মধ্যেও আশ্চর্যভাবে নিজের হালকা হাসি দিয়ে বাড়িটাকে তার বাতাবরণকে লঘু, সুগন্ধ রেখেছিল, সেই জিনাকেই তিনি দেখেন। জিনা যে একটু একটু করে বড় হয়ে গেছে, বদলে গেছে সূক্ষ্মভাবে তা তিনি খেয়াল করেননি। কে-ই বা করে। কাছের মানুষকে কেউই চিনতে পারে না। এখন দূর থেকে অন্য মেয়ে অন্য মানুষ হিসেবে যখন দেখলেন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। জিনা, না? তারপরে তিনি আর একটা সন্দেহজনক দৃশ্য দেখলেন। জিনার পেছনে পেছনে, সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে দুটো লোক। ঠিক গুন্ডা-মস্তান টাইপের না হলেও, তাদের ধরনধারণ ভাল লাগল না তাঁর। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তারা জিনাকে অনুসরণ করছে। জিনা সেটা জানে কি না তিনি বুঝতে পারলেন না। তারপরেই জিনা একটা রিকশায় উঠে পড়ল। এবং রিকশা বেশ জোরে জোরেই ছুটে চলল দক্ষিণমুখে। জিনা বাড়ি ফিরছে। লোকদুটি একটা হার্ডওয়্যারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল, কথা বলতে লাগল। এর পরেই সিগন্যাল পেয়ে কল্যাণবাবুর বাস ছেড়ে দিল।
পাইকপাড়ায় বন্ধুর বাড়িতে আজ বেশিক্ষণ বসতে পারলেন না কল্যাণবাবু। গল্পগাছাও তেমন জমল না। অজিত যে এত বুড়ো হয়ে গেছে, ব্লাডপ্রেশার, ব্লাডসুগার আর ইউরিক অ্যাসিড ছাড়া তার আলোচনার আর কোনও বিষয় নেই তা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। অজিতের গিন্নি তো অজিতেরও এককাঠি বাড়া। তার আবার আছে উপরন্তু বউমার নিন্দে। ছেলে তাঁর যথারীতি সোনার চাঁদ, বউয়ের পরামর্শেই সে কানাডায় থেকে গেল। তখন কল্যাণবাবু তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানেন সোনার চাঁদ ছেলেরও নিজস্ব মাটির পা বেরোয়, তার প্রতিমাতেও প্রচুর খড় থেকে থাকে, কাজেই এইসব একপেশে কথাতে তাঁর আজকাল একটু বিরক্তিই লাগে। বিশেষত এইজন্য আরও লাগে, যে তিনিও তো জিনাকে গোড়াতে দোষ দিয়েছিলেন, মনে মনে। নিখিল যে খুব বাপের সুপুত্র নয়, কাঠগোঁয়ার একটা, এটা পুরোপুরি জেনেও তো তিনি জিনাকেই দোষারোপ করেছিলেন। পরে নিজের ভুল যে বুঝতে পেরেছেন তাই-ই শুধু নয়, এ-ও দেখেছেন যে এক হাতে তালি বাজে। এত সব অভিজ্ঞতার পর আর পক্ষপাতের কথা শুনতে তাঁর ভাল লাগে না। তিনি উঠে পড়লেন।
তখন সাড়ে সাতটা। চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলেই শুনতে পেলেন জিনা গান করছে।
আমার বেদনা আমি নিয়ে এসেছি,
মূল্য নাহি চাই যে ভালবেসেছি
কৃপাকণা দিয়ে আঁখিকোণে ফিরে দেখো না।
ডেকো না।
ঝুম্পা-মাম্পির গলাও এবার শুনতে পেলেন কল্যাণবাবু।
দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে
আজ অবহেলা ছলনা দিয়ে ঢেকো না
ডেকো না।
বারে বারে ঘুরে ঘুরে গাইছে। অর্থাৎ সংগীতশিক্ষার আসর বসেছে ওদের। তিনি নীচের ঘর দিয়ে সিঁড়িতে পৌঁছোলেন, সিঁড়িগুলো উঠলেন, দালান দিয়ে নিজের ঘরে গেলেন, মাঝের দরজাটা খোলা রয়েছে, ওপারেও আলো জ্বলছে। ঘরের মধ্যে হালকা আলো জ্বলছে—ধূপের গন্ধ। তিনি ছিলেন না। কিন্তু ঘরটা তাঁকে অভ্যর্থনা করবার জন্য আলো জ্বালিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে প্রস্তুত ছিল। তিনি হাতমুখ ধুয়ে এলেন, জামাকাপড় বদলালেন, আলো জ্বালালেন না, আরামচেয়ারে কাত হয়ে চোখ বুজিয়ে গান শুনতে লাগলেন। অনেকদিন পর খুব বেশি করে স্ত্রীর কথা মনে পড়তে লাগল। একটা মেয়ের বড় শখ ছিল আরতির। হয়নি। ছেলেদের দস্যিপনায় অস্থির হয়ে যেত। আজ থাকলে চার-চারটি বিভিন্ন বয়সের মেয়ের উপস্থিতি দেখতে পেত। এ তো শুধু দেখারই জিনিস নয়। শোনার জিনিস, অনুভব করবার জিনিস। তাঁর ভাগ্য, তিনি দেখতে শুনতে পেলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের অভিমানের সুর যেন তাঁকে লক্ষ্য করেও ঢেউয়ে ঢেউয়ে এগিয়ে আসছে। এরকম তাঁর মনে হল। তারপরে তাঁর মনে হল নাতনিদুটিকে কি তিনি যথেষ্ট মনোযোগ দেন? মল্লিকাকে? জিনাকে? বিমানকে? নিখিলকে? বিমানের সঙ্গে যাও-বা রাত্রে খাবার টেবিলে কথাবার্তা হয়, নিখিলের সঙ্গে সেসব বন্ধ। যবে থেকে সে অশান্তি করতে শুরু করেছে, তার ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়েছে, তখন থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এটা কি ঠিক? ওদের জন্যে তাঁর মনখারাপ করে কি? খুব কম। তিনি যেন নিজের জীবনে ছেলেদের প্রয়োজন ছাড়িয়ে উঠেছেন। এ বাড়িতে তাঁরা থাকেন তিনজন আধা-পরিচিত মানুষের মতো। বিমান-নিখিলের থেকে মল্লিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক বেশি। আর তাঁর প্রতি টান? ছেলেদের কি তাঁর প্রতি কোনও টান আর অবশিষ্ট আছে? বড়র যদি-বা কিছু থেকে থাকে, ছোট? বউমারা তাদের কর্তব্য অবশ্যই করে, ষোলোআনার জায়গায় আঠারোআনা। কিন্তু সত্যি সত্যি ভালবাসে কি? মেয়ে হলে যেভাবে বাসত! ক্রমশ ক্রমশ রবিঠাকুরের গানের অভিমান তাঁর নিজের হয়ে যেতে থাকল। তাঁর বয়সের হয়ে যেতে থাকল। পৃথিবীর যত যুবক-যুবতী, তাদের প্রতিই যেন তাঁর অভিমান, সমস্ত বুড়োমানুষের হয়ে। বয়স্করা তো অল্পবয়সিদের কৃপারই পাত্র। তাদের সমস্ত যত্ন-আদর সবটাই ছলনা। সত্যি তো একজন বৃদ্ধ হল বাতিল মানুষ, তার যা দেবার সব দেওয়া হয়ে গেছে। আর নতুন কিছু তার ভাণ্ডারে নেই। বাকি জীবনটা যাকে বলে আনপ্রোডাক্টিভ। আধুনিক পৃথিবী তো অনুৎপাদক মানুষকে মূল্য দেয় না। কর্ম ছাড়া আধুনিক সভ্যতার তালিকায় আর কিছু নেই! ভালবাসা একটা বাজে সেন্টিমেন্ট। সম্পর্কের টান পায়ের বেড়ি, হাতের শেকল। এগিয়ে চলতে হলে ওসব ভেঙে ফেলাই ভাল।
তিনি গান শুনতে শুনতে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ একখণ্ড নিয়ে বসলেন। অবসর নেওয়ার পর থেকে কল্যাণবাবুর বইপড়া অনেক বেড়ে গেছে। এক ধরনের বই তিনি পড়েন না। পপুলার সায়েন্স, সহজ দর্শন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস…নানা রকমের বইয়ে আগ্রহ তাঁর। আজকে গল্পগুচ্ছর একটা বিশেষ গল্প পড়ছিলেন। ‘বিচারক’। গল্পটা পড়তে পড়তে তাঁর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। এই গল্পটা ‘মোস্ট আনরাবীন্দ্রিক’। এইভাবেই তিনি ভাবলেন। পতিতাদের কথা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আর রবীন্দ্রনাথ কতটুকু জানবেন? জানতেন না। সেইসব লোক যারা একটি স্বাভাবিক মেয়েকে ‘পতিতা’য় পরিণত করে কিন্তু নিজেরা বেশ উঁচুতেই ‘অপতিত’ অবস্থান করে তাদেরও তিনি স্বরূপে জানতেন কিনা সন্দেহ। তবু, তাঁর স্বভাবজ পবিত্রতাবোধ, মানুষের প্রতি তাঁর অচল বিশ্বাস, তাঁর আভিজাত্য। সমস্ত সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ এরকম একটা গল্প লিখলেন কেন? গল্পটা তিনি যদ্দূর বোঝেন—ভাল হয়নি। বড্ড সাজানো যেন। যে বিনোদ ক্ষীরোদাকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল, তাকেই জজ হয়ে বিগতযৌবনা ক্ষীরিকে ফাঁসির হুকুম দেওয়ার জন্য আনতে হল এবং তাকেই হঠাৎ ক্ষীরির অনুতাপ হয়েছে কিনা দেখতে জেলখানার ভেতরে গিয়ে ক্ষীরির আংটিতে নিজের প্রতিকৃতি দেখাতে হল! সন্দেহ নেই একবার প্রলোভনে বাইরের পৃথিবীতে পা দিলে অবলা বালিকাদের ক্ষীরির গতিই হয়, এতেও সন্দেহ নেই প্রলোভনকারীর অনায়াসেই ভবিষ্যতে জজ-ব্যারিস্টার হয়ে সমাজের মুকুটমণি হয়ে ওঠাও কেউ আটকাতে পারে না। অবিচারের ধাঁচটা এরকমই, সেটাকেই রবিঠাকুর বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু কেন? রবিঠাকুরের মেজাজের সঙ্গে যেন গল্পটার বিষয়বস্তু খাপ খাচ্ছে না।
কল্যাণবাবুর মনে এ প্রশ্ন জাগছিল, কেননা এই বয়সে, পুরো একটা জীবন কাটাবার পর তিনি কোনও বই-ই আর শুধু সময় কাটাবার জন্যে পড়েন না। সময় কাটাবার হলে তো তিনি তাঁর বড় ছেলের মতো ব্রিজের আড্ডাতেও যেতে পারতেন। তিনিও খুব ভাল ব্রিজ খেলতে পারেন। আর তাসে যেমন সময় কাটে অন্য কিছুতেই তেমন কাটে না। আসলে তাঁর মনে হয় সারাজীবন তিনি কিছু শেখেননি, কিছু বোঝেননি, কিছু অনুভব করেননি, অথচ জীবনটা কী ভীষণ জটিল, পৃথিবীটাও কঠিনে কোমলে কী অদ্ভুত একটা জায়গা। জানা হল না, অথচ মৃত্যু থাবা গেড়ে অদূরে বসে আছে। মৃত্যু মানে শেষ। একটা অধ্যায়েরও শেষ হতে পারে, একেবারে শেষও হতে পারে। কিন্তু যাই হোক, তিনি ঠকে গেলেন। একেবারে শেষ যদি হয়, তো আর পাঁচজনে যা শেখে, যা জানে, যা গড়ে তিনি তার কিছুটা করলেন না, একেবারে নিরর্থক একটা অস্তিত্ব তাঁর। আর যদি একটা অধ্যায় হয় তা হলে এ অধ্যায় থেকে কিছু সংগ্রহ না করেই তিনি পরবর্তী অধ্যায়ের পাতা উলটোচ্ছেন। কল্যাণবাবু তাই এখন পড়েন প্রচণ্ড আগ্রহে, দাগ দিয়ে দিয়ে, এক কথা বার বার, এক বই বার বার। কোনও বিষয়ে আগ্রহ বেড়ে গেলে বইয়ের শেষে উল্লেখপঞ্জী দেখেন। আরও পড়েন।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, মৃদু ডাকে চোখ মেললেন।
—বাবা, ও বাবা, খাবেন না?
দিনেরবেলায় কল্যাণবাবু জিনার সঙ্গে খান। রবিবার বা ছুটির দিনে নিখিল থাকলে নয় অবশ্য। একেবারে না খেলে জিনার ভীষণ অভিমান হয়। আর সত্যিই তো, সে তো কোনও অপরাধ করেনি। শুধু শুধু তার মনে কষ্ট দেবেন কেন? কিন্তু রাত্তিরবেলায় তাঁর খাওয়া বড় বউমার রান্নাঘরে। চারজনে একসঙ্গে বসেন। মোটামুটি সব এগিয়ে দিয়ে মল্লিকাও বসে পড়ে। নাতনিদের গল্পস্বল্প, খুনসুটি, বিমানের স্বল্পবাক মন্তব্য, হাসি, মল্লিকার গল্পগাছা—সব মিলিয়ে রাতের আসরটা বেশ জমজমাট হয়।
আজ দেখলেন মল্লিকা তাঁর খাবার নিয়ে এসেছে। ছোট একটা টেবিলে রেখে টেবিলটা এগিয়ে আনছে। তাঁর শরীর-টরির খারাপ হলে অবশ্য এরকম ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু আজ শুধু শুধু…। তিনি বললেন, কেন বউমা? তোমরা কি ভাবলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি বলে আমার শরীর খারাপ? কিচ্ছু হয়নি। এদের গান শুনতে শুনতে পড়তে পড়তে ঘুম এসে গিয়েছিল।
মল্লিকা বলল, কটা বেজেছে দেখেছেন?—সে আলোটা জ্বেলে দিল। সাড়ে দশটা।
—ওরে বাবা! ডেকে দিলে না কেন?
—ঝুম্পাকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম। বলল—অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। ভাবলাম হয়তো কোনও কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। একটু ঘুমিয়ে নিন। ওদের সব খাইয়ে দিয়েছি বাবা।
—তার মানে তোমার হয়নি।
—এই আপনার হয়ে গেলেই…
—না, তোমারটাও নিয়ে এসো। একসঙ্গে খাই। কিংবা চলো টেবিলে যাই। আবার দুজনে নীচে নামলেন। খেতে খেতে মল্লিকা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল— একটা কথা বলব ভাবছিলুম বাবা।
—বলো—মনে মনে একটু শঙ্কিত বোধ করলেন তিনি। দুই পুত্রকে আলাদা করে দেওয়ার পরেও অশান্তি যায়নি। অশান্তির উৎস অবশ্য একটাই। ইদানীং জিনা খুব বুঝে চলে বলেই হয়তো অশান্তি খুব একটা টের পান না। অন্তত অশান্তিটা তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছোয় না। এক ছেলে তাস পিটে, আর এক ছেলে টাকা পিটে রাত করে বাড়ি ফেরে। দুই বউমা-ই একা। দুজনেই নিজের নিজের মতো ভাল। তবে ছোটর সন্তানহীন জীবনে প্রকৃত শূন্যতাই থাকার কথা। এ তিনি বোঝেন। কিন্তু তাঁর তো কিছু করার নেই। যা তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে, আগ বাড়িয়ে সেই সমস্যায় নাক গলিয়ে তিনি করবেনটা কী? এখন ঘটা করে বড় বউমা কী বলতে চায়? নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু। ঠিক ভয় না পেলেও, তিনি সতর্ক এবং অনিচ্ছুক। ঝুম্পা যদি নিজে কোনও ছেলেকে পছন্দ করে থাকে? সেই কথা? সেই বিষয়েও তাঁর কোনও বক্তব্য নেই। বিমান-মল্লিকা তাদের মেয়ে সম্পর্কে যা ঠিক করবে তাই হবে। নাতনির ওপর জুলুম হলে তিনি হয়তো হস্তক্ষেপ করবেন। নইলে নয়।
—বাবা, কথা দিন কাউকে কিছু বলবেন না। যার সম্পর্কে বলছি তাকেও না।
—সর্বনাশ! এত শর্ত কেন? কী হয়েছে বউমা!
—জিনা বোধহয় আপনাকে বলেছিল ও একটা বয়স্ক-শিক্ষার ক্লাস নিতে যায়!
—হ্যাঁ, সে তো অনেকদিন হল! বছরখানেক কি তারও বেশি হয়ে গেল।
—হ্যাঁ, কিন্তু এই বয়স্করা কারা বলেছে কি?
—না তো! কারা!
—মানে ওই, ওই দিকে সোনাগাছির মেয়েরা…অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে মল্লিকা মুখ নিচু করে।
—সোনাগা…বলতে বলতে প্রচণ্ড বিস্ময়ে কল্যাণবাবু হাতের গ্রাস নামিয়ে রাখলেন। তাঁর হাতটা একটু একটু কাঁপছে। একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটায় কাঁপছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ! রবিঠাকুর! উত্তর দিয়ে গেলেন। তাঁর সারাজীবনে কল্যাণবাবু কখনও এমন আবেগমথিত হননি। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। অবাক হচ্ছিলেন। কেন? ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘অতিথি’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’র রবিবাবু কেন ‘বিচারক’ গল্পটা লিখতে গেলেন? উত্তরটা এইমাত্র রবিঠাকুর দিয়ে গেলেন। তিনি ওটা লিখেছিলেন এক অনস্বীকার্য দায়বোধ থেকে। তিনি লেখক, যে-মুহূর্তে গল্প-উপন্যাসের জন্য কলম ধরলেন অমনই মনুষ্যসমাজ যা গল্প-উপন্যাসের প্রধান বিষয় তা দশভুজ মূর্তিতে উঠে এল তাঁর সামনে। দশভুজ, শতকোণী, সহস্ৰক্ষতচিহ্নিত মানুষের সমাজ। যখন তিনি সার্চলাইটের মতো তাঁর দৃষ্টি ঘোরাচ্ছিলেন এই অন্ধকার কোণে আলো পড়ল। শিউরে উঠে তিনি ভাবলেন এ নিয়ে লেখেননি তো! ভাবেননি তো! ভাবলেন, যতটা ভাবলেন লিখে উঠতে পারলেন না। রোমান্সের হাত ছিল, করুণার হাত ছিল, কিন্তু ঘৃণার হাত ছিল না তাঁর। তাই ক্ষীরির হাতে ফাঁসির সময়েও প্রেমের আংটি নিয়ে আকুলতার কথা তিনি লিখতে পারেন। আজকের লেখকদের হাতে পড়লে ওই আংটিটাকেই ক্ষীরি আগে ফাঁসি দিত। কিন্তু সত্যিই দিত কি? তিনি জানেন না পতিতাদের মধ্যে ঘৃণাও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে কি না।
শ্বশুরের রকম দেখে মল্লিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। কী দুর্বুদ্ধি যে তার হয়েছিল!
কল্যাণবাবু বললেন, একটা এন.জি.ও-র স্কিমে কাজ করছে না জিনা!
—হ্যাঁ, ওর ওই বন্ধু মুকুট…আপনি একটু ডেকে যদি বলে দেন, কাজটা ভাল নয়…তা হলেই…
—কেন বউমা? এর মধ্যে তুমি খারাপ কী দেখলে? আশ্চর্য হয়ে বললেন কল্যাণবাবু, এডুকেশনের কাজ, সে তুমি যাদের জন্যই কর, সব সময়ে ভাল, এটা জানবে মা। এত বড় দেশ! এত সমস্যা! একা সরকারের সাধ্য কী সব দিকে খুঁটিয়ে নজর দেয়! আমাদের সাধারণ নাগরিকদের, যাদের হাতে সময় আছে, অসুবিধে নেই, তারা যদি একটুও পারে, সে তো মস্ত আশার কথা। আমরা সকলেই যদি ভাবি— আমার ছেলেমেয়ে করবে না, ওরা করুক, ওদের ছেলেমেয়ে করুক, তা হলে আর কী করে কাজ হবে?
মল্লিকা দ্বিগুণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। কেনই বা বাবার প্রথমে অমন বাকরোধ হয়ে গেল? তারপর কেনই বা এত উদারতা দেখাচ্ছেন? মানুষটি রহস্যময়। এতদিনেও তাঁকে সে বুঝতে পারল না।— কিন্তু বাবা, জিনার ফিরতে প্রায়ই আজকাল সন্ধে হয়ে যাচ্ছে। ও নিজেই বলছিল ওই সময়ে আজেবাজে লোক ঘোরাফেরা করে। যদি কোনওদিন বিপদে পড়ে?
কল্যাণবাবুর দপ করে মনে পড়ে গেল—দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের মোড়ে জিনা দাঁড়িয়ে আছে মাধুর্য ও গরিমা বিস্তার করে, পেছনে দুটো সন্দেহজনক লোক। তিনি সামান্য একটু ভেবে নিয়ে খুব সহজভাবে বললেন, পাঁচটা নাগাদ তো? আমি ওকে আনতে গেলে হবে?
অতঃপর কল্যাণবাবু আসেন, যান। জিনার ছাত্রীরা বলে ওঠে—‘ও দিদিমণি, ওই আপনার চলনদার এসে গেছেন।’ জিনা কবজি উলটে দেখে তাই তো কাঁটা অনেকক্ষণ চারটে ছাড়িয়ে গেছে। দু-চারজন মেয়ে ক্রমে সাহস করে কাছে এসে বলে, মেশোমশাই পেন্নাম হই।
—আহা হা কর কী! কর কী! রোজ রোজ আবার পেন্নাম কী? কল্যাণবাবুর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, তাঁর প্রৌঢ় মুখের সঙ্গে মানানসই ধবধবে সাদা চুল, মুখের শান্ত, ধীরভাব এগুলো মেয়েদের আশ্বস্ত করেছে। কাছে টেনেছে।
দুজনে ধীর কদমে বেরিয়ে আসেন। জিনা আর রিকশা করে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে। কল্যাণবাবু জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে জিনা পড়ায়, কী কী শেখায়। সে যে যোগাসন, আর গানও শেখাচ্ছে, সিলেবাসের বাইরে হলেও, শুনে সমর্থনের মাথা নাড়েন তিনি। ‘গল্পগুচ্ছ’ আর ‘গীতবিতান’ অবলম্বন করে জিনা এগিয়েছে শুনে হতবাক হয়ে ছোট বউমার দিকে চান তিনি। বলেন, ঠিক বুঝেছ, এই মানুষটি একসঙ্গে এমন কাছে আবার এমন দূরে! জিনা মানে জিজ্ঞাসা করে এ কথার। তখন তিনি ব্যাখ্যা করেন কাছের রবীন্দ্রনাথকে ধরে কীভাবে দূরে সুদূরে নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার পাথেয় তিনি নিজে পান। চেনা মানুষ, চেনা ঘটনা অথচ কোথাও এক জায়গায় তারা অচেনা হয়ে যান, আমাদের দৈনন্দিনতার জড়ানো পাঁক থেকে উঠে আসবার জন্যে ডাক দেন। এই ডাক আছে ঘটনাক্রমে চরিত্রগুলোকে উপস্থাপিত করবার ধরনে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে আছে ভাষায়। বাড়ি ফিরে দুজনে ঝুঁকে পড়েন ‘গল্পগুচ্ছ’র ওপর। ‘গীতবিতান’ নিয়ে বসেন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’ কিংবা ‘বজ্ৰানলে আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে’—এইসব অতি পরিচিত পঙ্ক্তির জীবনে কতরকম প্রয়োগ হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা চলে। ক্রমশ এই আসরে মল্লিকাও যোগ দেয়। এবং অনতিবিলম্বে জিনার পাশে আর একটা ঘর জোগাড় করে আর একদল মেয়ের ক্লাস নিতে আরম্ভ করেন কল্যাণবাবু। এরা বাচ্চা মেয়ে, বালিকা, কয়েকটি ছেলেও আছে। গণিকাদের সন্তান। কয়েকটি মেয়ের তো ব্যবসায় নামবার বয়স হয়ে এসেছে। মুকুটের মতে—এদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই মায়েরা চাইছে না এরা ব্যবসায়ে নামুক। কিন্তু অন্য দিক থেকে চাপ আছে। খুব বেশিরকম। এবং সেই চাপ দেনেওয়ালারা চাইছে না কল্যাণবাবু বা আর কেউ এদের নিয়ে ক্লাস করুন।
জিনা বলল, কেন রে?
—ওদের ধারণা এইসব ক্লাস করলে মেয়েগুলোকে ব্যবসায় নামানো শক্ত হবে। মা আর মেয়ে দুজনে মিলে বেঁকে দাঁড়ালে ওদের মুশকিল।
কিন্তু তোদের সংস্থা যে এখানে কাজ করছে, এই এত মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে, তাতে তো ওদের আপত্তি হচ্ছে না?
—হচ্ছে না, কেননা মেয়েগুলোতো ব্যবসা ছাড়ছে না। ছাড়লেই ওদের কাট-মানিতে টান পড়বে, তখনই ওদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়বে।
—কিন্তু তোদেরও তো শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য এদের জন্যে অন্য ব্যবস্থা করা…
মুকুট একটু ইতস্তত করে বলল, জিনা তুই বোধহয় একটু ভুল বুঝেছিস রে। এখনও এইরকম টার্গেট আমাদের নেই।
—তা হলে?
—আমরা চেষ্টা করছি ওদের বেসিক এডুকেশন দিতে। স্বাস্থ্য-সচেতনতা জাগাতে। কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক করে দিয়েছি, কতকগুলো ট্রেনিং সেন্টারও খুলেছি। যারা এইগুলো অবলম্বন করে স্বেচ্ছায়, নিজেদের কৃতিত্বে বাইরে চলে আসতে পারে আসবে। তবে দুঃখের বিষয়, বয়স্ক বা যাদের এখানে রুজি নেই তারা ছাড়া বড় একটা আসছে না কেউ এখনও পর্যন্ত। এতজনের কর্মসংস্থান করি, সে সাধ্য আমাদের কই? তাই ওসব বলি না।
জিনার হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় মুকুটের অস্বস্তি হল। সে বলল, দারিদ্র আর জনসংখ্যা এই দুটো ফ্যাক্টর সমস্ত উন্নয়নের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় রে জিনা! তুই আগে জীবন রক্ষা করতে পারবি, তবে তো গুণমানের প্রশ্ন উঠবে? এত জীবন, এত! এত! একেবারে দুঃস্থ। পোকামাকড়ের মতো জন্মে যাচ্ছে। এরা তো তবু নিজেদেরটা যেমন করে হোক জুটিয়ে নিচ্ছে। আরও কত মানুষ আছে কোনওক্রমে আস্তাকুঁড় ঘেঁটে জীবনধারণ করছে। কতজন আছে— কৃষক ছিল, জমি গেছে, কারখানার শ্রমিক ছিল, কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেখছিস তো কাজ জানা লোকগুলো না খেতে পেয়ে কীভাবে আত্মহত্যা করছে।
উত্তরে জিনা বলল, তা হলে…তা হলে মুকুট এডস্ তো বেশ ভাল জিনিস ছিল রে! জনসংখ্যা কমাবার নিশ্চিত উপায়। হোক না। হয়ে যাক না! বাধা দিচ্ছিস কেন?
—বলছিস কী? পুরো সভ্যতা, পুরো মানবসমাজই যে শেষ হয়ে যাবে রে?—মুকুট অবাক।
—সভ্যতা কাদের নিয়ে বল—জিনা বলল। সমাজটাই বা কাদের জন্যে? সবাইকে নিয়েই তো সভ্যতা! না কী? জীবনের গুণমান উন্নত করার নামই তো সভ্যতা। তা বেশির ভাগ মানুষই যদি এইভাবে বাঁচে, তা হলে মুষ্টিমেয়র সুখ আর নিরাপত্তার জন্যে প্রাণপণ এইসব চেষ্টায় তো ঠিক সভ্যতার বাঁচার প্রশ্ন থাকে না আর! সম্প্রদায়ের বাঁচা হয়ে যায়—সেটা সভ্যতা না অসভ্যতা! বেশ এসেছিল এডস্টা সময় বুঝে। কী সুন্দর ফাঁকা হয়ে যেত রাস্তাঘাট। বেড়ে উঠত বনজঙ্গল, বহুতল উঠত না, গ্রাউন্ড ওয়াটার শূন্য হয়ে আসত না। ইতিহাসে লেখা থাকত— কী করে মৃত্যু হল এই সভ্যতার। বইপত্তরের তো আর এডস্ হয় না! তারপর যে কটি লোক বেঁচে থাকত আবার নতুন করে শুরু করত! তাদের গাইড করার জন্যে বইপত্তরগুলো রয়ে যেত।
মুকুট আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল জিনার তীব্র মুখভঙ্গির দিকে। সুদ্ধু সময় কাটছে না বলে যে সুখী সম্পন্ন গৃহবধূ মেয়েটিকে সে সামান্য একটা আংশিক সময়ের প্রোগ্রামে ঢুকিয়েছিল, সে যে এমন সব প্রশ্ন তুলতে পারে তা তার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয় শত হোক এ তো সেই জিনাই যে ক্লাস-মনিট্রেস ছিল। আন্তরিকভাবে যে ক্লাসে শৃঙ্খলা ও সুবিচার রাখার চেষ্টা করত। সেই জিনা যে একটি মুখচোরা নতুন মেয়েকে ক্লাসসুদ্ধু মেয়ের ও টিচারদেরও মানসিক অত্যাচার থেকে বাঁচিয়ে ছিল। পরে, নিজেদের পরিবারের দাবি ওর ওপর ক্রমাগত বেড়ে গেছে। পরিবারের সংস্কার পরিবেশ ওকে একটা ঘরোয়া, নিষ্ক্রিয় জীবন বেছে নিতে বাধ্য করেছে। তবু এ তো সেই জিনাই। একেবারে সেই যাকে সে ছোটবেলায় কিশোর বয়সে চিনেছিল!