গরিব খালাম্মা বিষয়ক একটি গল্প
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল জুলাই মাসের এক চমৎকার বিকেলে। সেটি আবার ছিল জুলাই মাসের প্রথম রোববার। দুটি অথবা তিনটি মেঘের সাদা ছোট টুকরো জমেছিল আকাশের গায়ে, ব্যতিক্রমী সতর্কতার সাথে বসানো যতি চিহ্নের মতো। বাধা না পেয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছিল পৃথিবীর গায়।
এক বান্ধবীর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আর ঘরে ফেরার পথে মেইজি মেমোরিয়াল পিকচার গ্যালারিতে থেমেছিলাম। জলাশয়ের কিনারে বসে আমরা অপর প্রান্তের সিংহের ল্যাজঅলা এক শৃঙ্গী অশ্বমূর্তি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। মৃদমন্দ বাতাসে তখন ওক গাছের পতা নড়ছিল আর জলাশয়ের জলে সৃষ্টি হচ্ছিল ছোট-ছোট ঢেউ। হালকা বাতাসের সাথে সময়ও বয়ে চলেছিল। তখন ঘাসের ওপরে রাখা বিশাল একটা পোর্টেবল রেডিও থেকে গান ভেসে এসেছিল। মনে হয়েছিল সুরটা আমার চেনা; কিন্তু নিশ্চিত হতে পারিনি।
এতকিছু থাকতে গরিব খালাম্মা সেই রোবারের বিকেলে কেন আমার হৃদয় দখল করেছিলেন জানি না। আশপাশে গরিব কোনো খালাম্মার অস্তিত্ব ছিল না; কোনো কিছুই তার অস্তিত্ব কল্পনায় প্রাণিত করেনি আমাকে। তারপরও গরিব খালাম্মা এসেছিলেন, আবার চলেও গিয়েছিলেন। এক সেকেন্ডের একশ ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য হলেও তিনি আমার ভেতরে ছিলেন। যাওয়ার সময় তিনি এক অদ্ভুত, মানবাকৃতির শূন্যতা রেখে গেছেন। যেন কেউ দ্রুত জানালার পাশ দিয়ে উধাও হয়ে গেল। জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরেছিলাম; কিন্তু কেউ ছিল না সেখানে।
গরিব একজন খালাম্মা?
আমার বান্ধবীকে বললাম কথাটাও “একজন গরিব খালাম্মাকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে আমাকে।”
“একজন গরিব খালাম্মা?” মনে হলো সে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়েছে।
“গরিব খালাম্মা কেন?”
কেন তা আমি নিজেও জানি না। খানিকটা সময়ের জন্য চুপ করে রইলাম। আমার ভেতরকার মানবাকৃতির শূন্যতার প্রান্তে আঙ্গুল বুলালাম।
“ওই ধরনের কোনো গল্প কেউ পড়তে চাইলে অবাকই হব আমি।” আমার বান্ধবী বলল।
“সত্যি কথা”, আমি বললাম, “ভাল পাঠ বলে যা তুমি ভাবছ তা না-ও হতে পারে।”
“তাহলে এসব লিখে আর কী লাভ?”
“শব্দ দিয়ে হয়ত ভালভাবে বোঝাতে পারছি না,” বললাম আমি, “কেন গরিব খালাম্মা নিয়ে গল্প লিখতে চাই তা ব্যাখ্যা করার জন্যই গল্পটা লিখতে হবে। কিন্তু গল্পটা একবার লেখা হয়ে গেলে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়বে না।”
কুঁচকে যাওয়া একটা সিগারেট পকেট থেকে বের করে অগ্নিসংযোগ করল সে। সব সময়ই সে এরকম কুঁচকে যাওয়া সিগারেট ধরায়। মাঝে মাঝে ওগুলো এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে যায় যে তাতে আগুনই ধরে না- এটাতে ধরল।
“তোমার আত্মীয়দের মধ্যে এ রকম কোনো গরিব খালাম্মা আছে নাকি?” আমার বন্ধবী শুধাল।
“একজনও নেই।” বললাম আমি।
“আমার কিন্তু এ রকম একজন খালাম্মা আছে। তার সঙ্গে বেশ কটা বছর থেকেছি আমি।”
তার চোখের দিকে তাকালাম। আগের মতোই শান্ত ওগুলো। “কিন্তু তাকে নিয়ে লিখতে চাইনে,” বলল সে, “এক লাইনও না …”
পোর্টেবল রেডিওতে অন্য গান বাজছে। আগেরটার মতোই; কিন্তু কার গলা চিনতে পারলাম না।
“তোমার কোনো গরিব খালাম্মা নেই, তারপরও তাকে নিয়ে লিখতে চাচ্ছ তুমি; অথচ আমার আসল গরিব খালাম্মা থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছে নেই আমার।”
আমি মাথা নাড়ি। বলি, “আমিওতো অবাক হচ্ছি সেই কথা ভেবে।” সে মাথাটা একটুখানি কাত করে, কিছুই বলে না।
সে তার পাতলা আঙ্গুলগুলো পানির ওপর ঘোরাতে থাকে। যেন আমার প্রশ্ন তার আঙ্গুলের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পানির ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীতে ডুবে গেছে ।
অবাক কাণ্ড, কেন? কেন? কেন?
“সত্যি কথাটা তবে বলি তোমাকে,” সে বলল, “আমার গরিব খালাম্মা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই তোমাকে। কিন্তু সঠিক ভাষা খুঁজে বের করা অসম্ভব আমার পক্ষে। একেবারেই পারব না তার কারণ সত্যিকার একজন গরিব খালাম্মাকে আমি চিনি।”
আমি আবার অশ্বমূর্তির দিকে তাকাই। স্কার্টের ওপর আঙ্গুল মোছে সে। বলে, “গরিব খালাম্মাকে নিয়ে লিখতে চাচ্ছ; কিন্তু ভাবছি এখন তা লেখার ক্ষমতা তোমার আছে কিনা। তোমার তো ধর আসল কোনো গরিব খালাম্মাই নেই।”
আমি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
“দুঃখিত,” বলে সে।
“না না, হয়ত তোমার কথাই ঠিক।”
এবং আসলেই তাই।
আহ্ যেন কোনো গানের লাইন।
আত্মীয়দের মধ্যেও যদি এ রকম একজন খালাম্মা থাকত। তখন আমাদের মধ্যে জিনিসটা কমন হতো। কিন্তু তোমাকে অন্তত কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন খালাম্মার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা থাকবে হবে। প্রতিটি বইয়ের শেলভে এমন একটা বই থাকে যা কেউ কখনো পড়েনি আর প্রতিটি ক্লোসেটেই এমন কোনো একটি শার্ট থাকে যা কেউ গায়ে দেয়নি কখনো, প্রতিটি বিয়ের অনুষ্ঠানেই একজন গরিব খালাম্মা হাজির থাকেন।
কেউ তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন অনুভব করে না। কেউ কথা বলে তার সাথে। তাকে কিছু বলতে অনুরোধ জানায় না। কোনো একটা টেবিলে তিনি বসে থাকেন, শূন্য একটা পানির বোতলের মতো। নিঃসঙ্গ তিনি, বিষণ্ণতার ভেতরে ডুবে থেকে ধীরে ধীরে সামান্য একটুখানি খাবার খান। যখন তার পাতে আইসক্রিম পরিবেশিত হয় তাতে কোনো চামচ থাকে না।
বিয়ের ছবিতে তিনিও থাকেন; কিন্তু তার ভাবমূর্তি সেখানে ডুবে যাওয়া লাশের মতো।
“ডার্লিং চশমা চোখে ওই বুড়িটা কে?” নতুন বউ শুধায় হয়তো।
“না না তেমন কেউ না, আমার এক গরিব খালাম্মা।”
কোনো নাম নেই তার। শুধু গরিব খালাম্মা।
সব নামই একদিন পৃথিবী থেকে মুছে যায়। নিমেষেই যাদের নাম মুছে যায় তাদের আসলে মৃত্যু ঘটে। পরিত্যক্ত পুরনো টেলিভিশন সেটের মতো। পর্দায় জ্বলজ্বল করতে থাকে বরফের কণা, তারপর হঠাৎ একদিন দপ করে নিভে যায়। আর মৃত্যুর আগেই যাদের নাম মুছে যায় সেই দলে থাকেন গরিব খালাম্মা। প্রায়ই আমার নিজের দশাও এই গরিব খালাম্মার মতো হয়। রেলস্টেশন কিংবা বিমানবন্দরের হৈচৈয়ের মধ্যে প্রায়ই আমি আমার গন্তব্য, নাম, ঠিকানা ভুলে যাই। তবে তা খুব অল্প সময়ের জন্য, পাঁচ থেকে দশ সেকেন্ডের বেশি না।
কখনো আবার এমনও ঘটে; বিশ্বাস করুন আপনার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়ত কেউ একজন বলে।
“না কিছু করার নেই ভাই। নাম ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।” তখন সে বলে, “কী আর বলব রে ভাই, পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
কিন্তু বিস্মৃত ওই নাম যায় কোথায়? নগরের গোলকধাঁধার ভেতর তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তারপরও কিছু কিছু নাম শেষতক আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়, আর হারানো নামের নগরে বসতি গড়ে তোলে, একটা গোষ্ঠী তৈরি করে। ছোট্ট একট নগর, ঢুকতেই বড় বড় করে লেখা চোখে পড়ে বিনা কাজে প্রবেশ নিষেধ। কাজ ছাড়া যারা ঢোকে, সামান্য সাজা তাদের কপালে লেখা থাকে।
সেই কারণে বোধকরি ছোট্ট একটা শাস্তি আমার জন্য প্রস্তুত ছিল। গরিব খালাম্মাকে আমার পিঠে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আগস্ট মাসের মাঝামাঝি আমি টের পেয়েছিলাম তিনি সেখানে আছেন। বিশেষ কোনো কিছু আমাকে তার উপস্থিতি জানান দেয়নি। একদিন হালকাভাবে টের পেয়েছিলাম তিনি আমার পিঠে আছেন। ওটা কোনো অস্বস্তিকর অনুভূতি ছিল না। তেমন একটা ভারীও ছিলেন না তিনি। আমার কাঁধে তার কোনো বদ নিশ্বাসও পড়েনি। একটা ছায়ার মতো আমার পিঠের সঙ্গে সেঁটে ছিলেন। তিনি যে সেখানে আছেন তা দেখতে পাওয়াও খুব সহজ ছিল না লোকের পক্ষে। তবে একথা ঠিক যে, প্রথম কয়েকটা দিন আমার অ্যাপার্টমেন্টের বিড়ালগুলো সন্দেহের চোখে তাকাত। কিন্তু যখন তারা দেখল তার কোনো দুরভিসন্ধি নেই তখন তারা স্বাভাবিক হয়ে এলো।
তবে আমার ক’জন বন্ধু খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। টেবিলে বসে তাদের সঙ্গে মদ পান করার সময় হঠাৎ তিনি আমার কাঁধের ওপর থেকে উঁকি মারেন।
এক বন্ধু তো বলেই ফেলে, “আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে একেবারে।”
“ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কারও ক্ষতি করার মধ্যে নেই।”
“জানি তো সে কথা। তবে জানতাম না, মন তার খুব খারাপ হয়ে আছে।”
“কাজেই ওদিকে তাকাবার চেষ্টাই কোর না।”
“না তা ঠিক বলেছ, তবে তোমার পিঠে এমন এক জিনিস এসে জুটল কোথা থেকে তা-ই ভাবছি।”
“এমন নয় যে কোথাও গিয়েছিলাম। শুধু চিন্তার মধ্যে এ রকম এসেছিল, এই শুধু, আর কিছু নয়।”
সে মাথা নাড়াল এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার ধারণা বিষয়টা বুঝতে পেরেছি আমি। এটা তোমার ব্যক্তিত্ব। সব সময় এর রকমই ছিলে তুমি।”
“উ হুঁ।“
পরবর্তী কয়েক ঘন্টা কোনো রকম উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা ছাড়াই সে বেশ কপেগ হুইস্কি গলাধঃকরণ করল।
“তার ভেতর মন খারাপ করা কী এমন ব্যাপার দেখলে,” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“জানি না সেটা। যেন মা নজর রাখছেন আমার ওপর।”
বেশ কিছু লোকের দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে আমার পিঠে লাগানো গরিব খালাম্মা এমন কোনো একক, সেঁটে রাখা অস্তিত্ব নন, মনে হয় তিনি তার আকৃতি পরিবর্তন করেন যে ব্যক্তি তাকে দেখে সেই অনুসারে…।
একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্টকে চিনতাম, তার গরিব খালাম্মা ছিল তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুড়ো শিক্ষিকা। সে আমাকে জানিয়েছিল, “ওটা ছিল ১৯৫০ সাল, কোরিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম বছর। দু’বছর পেয়েছিলাম তাকে। তাকে দেখে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যেত। তাকে ঠিক মিস করতাম না। তিনি যে বেঁচে আছেন তা-ই আসলে ভুলে গিয়েছিলাম।”
আমার মনে হতে লাগল, আমি একটা ডেন্টিস্ট চেয়ার, ঘৃণা না করলেও সবাই এড়িয়ে চলে যাকে। রাস্তায় কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে ছুতো ছানা করে পালায় আমার কাছ থেকে। একদিন তো একটা মেয়ে বলেই বসল, “তোমার আশপাশে থাকা খুব যন্ত্রণাকর হয়ে পড়েছে আজকাল। কেন জানি না তোমার পিঠে ছাতার স্ট্যান্ড বা ওই জাতীয় কিছু থাকলেও কিছু মনে করতাম না।”
ছাতার স্ট্যান্ড । ভাবুন একবার ব্যাপারখানা।
বন্ধুরা এড়িয়ে চললেও মিডিয়ার লোকেরা প্রায়ই হেঁকে ধরে আমাকে। প্রায় প্রতিদিনই রিপোর্টাররা আমার কাছে আসে। আমার আর গরিব খালাম্মার ছবি তোলে। তারা অভিযোগ করে খালাম্মার ছবি স্পষ্ট ওঠে না। তারা আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। আশা করে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলে তারা আমাকে গরিব খালাম্মা আবিষ্কারের জন্য তুঙ্গে তুলে ফেলবে; কিন্তু তা না-করে তারা ক্রমাগত হয়রান করে ফেলছে আমাকে।
এক ভোরে আমাকে একটা টিভি অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল ছ’টায় আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে গাড়িতে ওঠায় ও টিভি স্টেশনে নিয়ে যায়। তারা আমাকে অসম্ভব বাজে এক কাপ চা পান করতে দেয়। অবোধগম্য কিছু লোক আমার চারপাশ দিয়ে আনাগোনা করতে থাকে। তাদের কাজকর্মও আমার বোধের সীমায় ছিল না। ওখান থেকে সটকে পড়ার মতলব আঁটছিলাম। সেই সময় একটা লোক এসে জানায় এবার আপনার পালা। ক্যামেরা অন হলে দেখি অ্যাংকর এক বদমেজাজি উদ্ধত টাইপের লোক। কিছুই জানে না কেবল লোকেদের অহেতুক আক্রমণ করে। কিন্তু ক্যামেরার লাল আলো জ্বলতেই দেখতে পাই–
এক দ্রলোক ধীরে সুস্থে ঘোষণা দিচ্ছেন, “শুরু হচ্ছে আমাদের আজকের অনুষ্ঠান। এখনকার অতিথি জনাব… যিনি হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেন তিনি তার পিঠে গরিব খালাম্মাকে বয়ে চলেছেন। খুব বেশি লোকের কিন্তু এ ধরনের সমস্যা নেই; তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই কেমন করে ব্যাপারটার সূত্রপাত আর কী কী সমস্যা এ বাবদে তিনি মোকাবিলা করছেন। কী জনাব, গরিব খালাম্মাকে নিয়ে কোনো অসুবিধা হচ্ছে আপনার?”
“মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। তার ওজন খুব বেশি নয়, আর তাকে খাওয়াতে পরাতেও হয় না।”
“পিঠে ব্যথা ট্যাথা হচ্ছে না?”
“একেবারেই না।”
“কখন পেলেন তাকে আপনার পিঠে?”
আমি সেই বিকেলের ঘটনাটা খুলে বলার চেষ্টা করলাম; কিন্তু তিনি বুঝলেন বলে মনে হলো না।
তিনি গলা পরিষ্কার করে বললেন, “আপনারা যেখানে বসেছিলেন তার অদূরে পুকুরের মধ্যে তিনি ওঁত পেতে ছিলেন এবং এক সময় আপনার পিঠটা দখল করে ফেলেন, এই তো ব্যাপার?”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, “না ওরকম ছিল না ব্যাপারটা।”
কী করে বোঝাই ব্যাটাকে। তারা জোক কিংবা লোমহর্ষক কাহিনী শুনতে চাইছে।
“গরিব খালাম্মা ভুতটুত কিছু নন,” আমি বোঝানো চেষ্টা করে বলি, “তিনি কোথাও ওঁত পেতে ছিলেন না এবং তিনি কারও ওপর দখল নেননি। গরিব খালাম্মা একটি শব্দ মাত্র, শুধুমাত্র একটি শব্দ।”
কেউ কোনো কথা বলে না। আরও স্পষ্টতা প্রত্যাশা করে। “একটি শব্দ একটি বিদ্যুত্বহের মতো যা মনের সঙ্গে যুক্ত । আপনি যদি ক্রমাগত একই উদ্দীপক প্রেরণ করতে থাকেন তাহলে অবশ্যই কোনো ধরনের সাড়া, কিংবা ফল পাবেন। প্রতিটি একক সাড়াই হবে পৃথক। এবং আমার বেলায় সাড়াটির একটি স্বাধীন সত্ত্বা ছিল। আসলে আমার পিঠে লাগানো ছিল গরিব খালাম্মা শব্দটি। এ ছাড়া আর কিছুই নয়, এর কোনো অর্থ বা আকৃতি-ই আসলে ছিল না। যদি এর কোনো নাম দেয়া যায়, তাহলে বলতে হবে কাল্পনিক আকার বা ওই জাতীয় কিছু।”
অনুষ্ঠানের হোস্ট স্পষ্টতই বিভ্রান্ত। “আপনি বলতে চাইছেন এর কোনো অর্থ বা আকার নেই? কিন্তু আমরা তো স্পষ্টই দেখি… কিছু একটা… বাস্তব চিত্র আপনার পিঠের সঙ্গে সাঁটা। আর ওর একটা অর্থ তো অবশ্যই আমরা খুঁজে পাই।”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি, “অবশ্যই। বললাম তো কাল্পনিক কোনো নকশা বা চিহ্ন।”
“অতএব,” হোস্টের তরুণী সহকারী পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা নিয়ে বলল, “তাহলে তো আপনি ওটা কোনো ভাবে মুছে ফেলতে পারতেন।”
“না পারতাম না। কোনো কিছু বাস্তবে রূপ নিলে তা স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে থাকে। ঠিক স্মৃতির মতো। কোনো স্মৃতি ইচ্ছে করলেই ভুলে যাওয়া যায় । কিন্তু আপনি তা ভোলেন না। এটাও এই রকম…”
মনে হলো কথাটার প্রত্যয় জন্মালো না তার মধ্যে। “একটি শব্দকে কাল্পনিক চিহ্ন বা নকশায় পরিণত করার যে ব্যাপারটা আপনি বললেন, তা করা কী আমার পক্ষে সম্ভব?”
“কতটা কাজ করবে তা জানি না, তবে নীতিগতভাবে এটা করতে পারবেন। আপনি।” উত্তর দিলাম আমি।…
গোটা পৃথিবীই একটা প্রহসন। টেলিভিশন স্টুডিও থেকে শুরু করে জঙ্গলের একটা আশ্রম সর্বত্রই একই ব্যাপার। গরিব খালাম্মাকে পিঠে বয়ে নিয়ে ভাড়সুলভ এই পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে বড় ভাঁড়। মেয়েটি হয়ত ঠিকই বলেছিল ছাতার স্ট্যান্ড বয়ে বেড়ানোও ভাল ছিল। মাসে দু’বার হয়ত আমি তার রঙ বদলে খদ্দেরদের কাছে নিয়ে যেতে পারতাম।
“ঠিক আছে, তোমার ছাতার স্ট্যান্ড এ হপ্তায় গোলাপি!” কেউ বলতে পারে।
“নিশ্চয়ই,” হয়ত আমার জবাব, “পরের হপ্তায় বৃটেনের রেসিং গ্রিন।”
এমন হতে পারে সংসারে এ রকম মেয়েও আছে যারা গোলাপি রঙের ছাতার স্ট্যান্ড বইছে এমন কারও সাথে বিছানায় যেতে আগ্রহী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার পিঠে ছাতার স্ট্যান্ড না-থেকে ছিল গরিব খালাম্মা। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে আমার ও গরিব খালাম্মার ব্যাপারে লোকের আগ্রহ কমতে থাকে। পার্কে দেখা হওয়া সেই বান্ধবী ঠিকই বলেছিল গরিব খালাম্মার ব্যাপারে কারও আগ্রহ নেই।
“তোমাকে দেখলাম টিভিতে,” বান্ধবী বলল। আবার আমরা ওই জলাশয়টার ধারে বসেছিলাম। তিন মাস যাবৎ দেখা হয় না তার সাথে। এর মধ্যেই শরৎ আগত প্রায়। সময় ফুরিয়ে আসছে। আমাদের মধ্যে এতো দীর্ঘ অদর্শন আগে কখনো ঘটেনি।
“তোমাকে ক্লান্ত লাগছে খানিকটা।”
“হ্যাঁ।”
“তুমি নিজের ভেতরে ছিলে না।”
মাথা নাড়ি। সত্যিই আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না।
“শেষমেষ গরিব খালাম্মাকে খুঁজে পেয়েছিলে?”
“হ্যাঁ।”
বান্ধবী হাসল। হাঁটুর ওপরে রাখা একটা সার্ট নাড়াচাড়া করছিল সে। যেন একটা বিড়াল ওটা।
“এখন কি তাকে আরও ভালভাবে বুঝতে পার?”
“মনে হয় পারি একটু-একটু।”
“কিছু লিখতে সাহায্য করে তোমাকে?”
“নাঃ। লেখার প্রেরণা সেখানে ছিল না। হয়ত কখনোই লিখতে পারব না।”
একটুখানি সময়ের জন্য নীরব থাকে সে।
“আমার মাথায় বুদ্ধি এসেছে একটা, “ শেষে বলল সে, “আমাকে প্রশ্ন কর কয়েকটা। তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করব।”
“গরিব খালাম্মা বিশারদ হিসেবে!”
“আ হা,” হাসল সে, “এখনই গরিব খালাম্মা বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। এরপরে হয়ত আর পারবই না।”
কোথা থেকে শুরু করা উচিত জানি না।
বললাম, “কখনো কখনো ভাবি কী ধরনের মানুষ এই গরিব খালাম্মা । ওভাবেই কি তাদের জন্ম! নাকি তারা বিশেষ গরিব খালাম্মা অবস্থায় উপনীত হয়। কোনো ধরনের ছারপোকা আছে নাকি যেগুলো মানুষকে গরিব খালাম্মায় পরিণত করে?”
আমার বান্ধবী মাথা ঝাঁকায়, যেন বলতে চায় এগুলো খুব ভাল প্রশ্ন। সে বলল, “ওই একই জিনিস।”
“একই জিনিস?”
“তাই তো। দেখ, একজন গরিব খালাম্মার হয়ত ‘গরিব খালাম্মা বাল্যকাল’ ছিল। হয়ত ছিল না। তাতে কিছু যায় আসে না। লক্ষ লক্ষ ফলের জন্য চারপাশে লক্ষ লক্ষ যুক্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। এর কিছু বেঁচে থাকছে, কিছু মারা যাচ্ছে। যুক্তি আসাটা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু তুমি এ ধরনের কিছুর জন্য বসে নেই, তাই না?”
“মনে হয় না।”
“কিন্তু তিনি আছেন। এটাই আসল কথা। তোমার গরিব খালাম্মা আছেন। ওই সত্য স্বীকার করতে হবে তোমাকে, মেনে নিতে হবে। এই হচ্ছে গরিব খালাম্মা। তার অস্তিত্বই হচ্ছে তার যুক্তি। ঠিক আমাদের মতো। আমরা এখানে আছি, কোনো বিশেষ যুক্তি ও কারণ ছাড়াই।”
দীর্ঘক্ষণ আমরা কারও সাথে কোনো কথা না-বলে জলাশয়ের ধারে বসে থাকি। শরতের স্বচ্ছ রোদের আলো তার মুখে ছায়া ফেলে।
বান্ধবী বলল, “তোমার পিঠে আমি কী দেখি তা জিজ্ঞেস করবে না?”
“কী দেখ?”
“কিছুই না” সে বলল, “আমি শুধু তোমাকে দেখি।”
“ধন্যবাদ তোমাকে।”
সময়ই আসলে সবকিছু ওলোট পালট করে দেয়। কিন্তু যে-মারটা আমরা অধিকাংশ লোক খাই তা ভয়ঙ্কর রকমের নরম। আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই বুঝতে পারি মার খাচ্ছি আমরা। একজন গরিব খালাম্মার মধ্যে আমরা আসলে সময়ের জুলুমবাজিই প্রত্যক্ষ করি। এটা গরিব খালাম্মাকে কমলার মতো পিষে ফেলে আর তার সবটুকু রস শুষে নেয়। যে-বিষয়টা আমাকে গরিব খালাম্মার প্রতি আকৃষ্ট করেছে তা হচ্ছে তার পরিপূর্ণতা, তার পারফেকশন।
তিনি হিমবাহতে রাখা একটা লাশের মতো, যে হিমবাহের বরফগুলো ইস্পাতের মতো কঠিন। দশ হাজার বছর ধরে রোদের তাপ লাগলেই কেবল এমন হিমবাহ গলে পানিতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু কোনো গরিব খালাম্মাই দশ বছর জীবিত থাকেন না। কাজেই তিনি বাঁচেন তার নিখুঁত সত্ত্বার জোরে; তিনি মরেন তার নিখুঁত সত্তা নিয়ে; তিনি সমাহিত হন নিখুঁত সত্তা সমেত।
.
শরতের শেষ দিকে গরিব খালাম্মা আমার পিঠ ত্যাগ করেছিলেন। শীতের আগেই শেষ করতে হবে এমন কিছু কাজের কথা মনে পড়ায় শহরতলীর এক রেলস্টেশন থেকে গরিব খালাম্মাকে পিঠে নিয়ে ট্রেনে চেপেছিলাম। বিকেলের সব ট্রেনের মতো ওটিও ছিল ফাঁকা। ওই প্রথমবারের মতো আমি শহরের বাইরে গিয়েছিলাম, আর জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। বাতাস ছিল শীতল, দূরের পাহাড় অস্বাভাবিক রকমের সবুজ। রেল সড়কের পাশের গাছগুলোতে উজ্জ্বল লালরঙের জাম ধরেছে।
ওই সফর থেকে ফেরার সময় ট্রেনের ভেতর মধ্য তিরিশ বছরের এক মহিলাকে দেখলাম। তার সঙ্গে দুটি শিশু সন্তান। বড়জন একটি মেয়ে। তার পরনে নেভি-বু রঙের পোশাক, মাথায় লাল ফিতের ফেল্ট হ্যাট, কোনো কিন্ডারগার্টেনের ড্রেস হয়ত। সে মায়ের বাম পাশে বসেছিল। মায়ের ডান পাশে বসেছিল তার তিন বছরের ছেলে। মা ও বাচ্চা দুটোর ভেতর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তেমন কিছুই ছিল না। তাদের চেহারা সুরত ও পোশাক আশাক খুবই সাধারণ। মায়ের হাতে বড় একটা প্যাকেট। ক্লান্ত লাগছিল তাকে; যদিও অধিকাংশ মাকেই ক্লান্ত দেখায় সব সময়। ট্রেনে চড়বার সময় লক্ষ্যই করিনি তাকে।
একটু পরেই মেয়েটির কথাবার্তা আমার কানে আসতে লাগল। ধার দেয়া কণ্ঠস্বর। কথা বলার দ্রুততা থেকে বোঝা যায় কোনো কিছুর পক্ষে বলতে চাইছে। সে। তখন তার মাকে বলতে শুনলাম, “তোকে না বলেছি ট্রেনের ভেতর চুপ থাকবি।”
“কিন্তু মামনি দেখবে তো আমার হ্যাঁটের অবস্থা কী করেছে সে।”
“চুপ কর। আর একটা কথাও নয়।”
“আমার হ্যাটটা তো বরাবাদ করে দিচ্ছে ও।” প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল মেয়েটি।
“খেলুক না একটু, কী হয়েছে।” ওর মা বলল। মেয়েটি নীরবে কিছুক্ষণ তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল আর হঠাৎ ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় মারল। তারপর হ্যাটটা আঁকড়ে ধরে নিজের আসনে ফিরে এল। ভাইটি কাঁদতে শুরু করলে মা তার মেয়ের উরুতে চটাস করে চটকোনা মারল একটা।
“কিন্তু ও তো আমার হ্যাটটা…”
“কোনো কথা নয়, তুই কেউ নোস আমার। যা বেরিয়ে যা এখান থেকে।”
মেয়েটি তার আসন থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসল। মাথা নিচু করে রেখেছে এখন।
প্রায় সন্ধ্যা তখন। ট্রেনের ছাদ চুঁইয়ে বিষণ্ণ প্রজাপতির ডানা থেকে ঝরে পড়া গুঁড়োর মতো হলুদ আলোর আভা এসে পড়েছে। হাতে বই ছিল একটা। সেটি কোলের ওপর রেখে দীর্ঘক্ষণ হাতের পাতার ওপর তাকিয়ে রইলাম। শেষ করে নিজের হাত দেখেছিলাম? ধোঁয়াটে আলোয় ওগুলোকে ময়লা আর কঠিন লাগল; এত নোংরা যে আমার নিজের হাত বলেই মনে হলো না। হাত দেখার পর মনটা আমার দারুণ বিষণ্ণ হয়ে উঠল : এ ধরনের হাত নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। কাউকে রক্ষাও করতে পারে না। পাশে ক্রন্দনরত শিশুটির কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করতে চাইলাম। হ্যাটটি ছিনিয়ে এনে ভালই করেছে; কিন্তু মেয়েটিকে কিছু বলা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। এতে হয়ত তার ভয় আর বিষণ্ণতা বাড়ত আরও। আর হাত দুটো ছিল খুব নোংরা ।
এর মধ্যেই ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিলাম। ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছিল। শিগগিরই সোয়েটার পরার দিন শেষ হয়ে যাবে, মোটা, ভারী কোট নামাতে হবে তোরঙ থেকে। খানিকটা সময়ের জন্য কোট নিয়ে ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করলাম একটা নতুন কোট কিনব কিনা। পিঠ থেকে গরিব খালাম্মা উধাও হয়ে গেছেন তা টের পাওয়ার আগেই গেট পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।
ব্যাপারটা কখন ঘটেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ যেমন তিনি এসেছিলেন তেমনি হঠাৎ-ই চলে গেলেন। যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানেই গেলেন তিনি। আমি ফিরে এলাম আমার আগের অবস্থায়। নিজের মূল সত্তায়।
কিন্তু আমার আসল সত্তা কী ছিল? এ ব্যাপারে আমি মোেটও নিশ্চিত নই। অনুভব করা সম্ভব হলো না এটা অন্য কোনো আমি। অন্য একটি সত্তা আমার আসল সত্তার সঙ্গে যার ভাল রকমের মিল ছিল। এখন তা হলে কী করতে হবে আমাকে? চেতনা লুপ্ত হয়েছে আমার। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনে ডায়াল করলাম। নয় বার রিং হওয়ার পর আমার বান্ধবী ধরল।
“ঘুমুচ্ছিলাম হে।” একটা বড় হাই তুলে বলল সে।
“এই ভরা সন্ধ্যায়?”
“সারা রাত জাগতে হয়েছে একটা কাজে। ঘন্টা দুয়েক আগে শেষ হয়েছে।”
“দুঃখিত, তোমাকে জাগানোর ইচ্ছে ছিল না,” আমি বললাম, “শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে; কিন্তু একথা জানাবার জন্যই ফোন করলাম যে, তুমি এখনও জীবিত। সত্যি বলছি…”
টের পেলাম ফোনের অপর প্রান্তে হাসছে সে।
“ধন্যবাদ,” বলল সে, “ভেবো না এখনও বেঁচে আছি। বেঁচে থাকার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাজগুলো শেষ করছি। যে-কারণে এখন ভীষণ ক্লান্ত আমি। কী স্বস্তি মিলল এবার?”
“হ্যাঁ।”
কোনো গোপন বিষয় আমার সঙ্গে শেয়ার করছে এমন ভাব নিয়ে সে বলল, “জীবন বড় কঠিন হে!”
“জানি তো সে কথা,” বললাম আমি, আমার সঙ্গে ডিনার করতে হয় যে?”
টেলিফোনের অপর প্রান্তে তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমার কল্পনায় এল সে ঠোঁট কামড়াচ্ছে আর তার ছোট-ছোট আঙ্গুল দিয়ে ভ্র খুঁটছে।
প্রতিটি অক্ষরে গুরুত্ব দিয়ে সে বলল, “সে হবে ক্ষণ। এখন একটুখানি ঘুমুতে দাও। খানিকটা ঘুম হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। জেগেই ফোন করব তোমাকে, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে। শুভরাত্রি।”
“শুভরাত্রি।”
তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়ে সে বলল, “জরুরি কথা আছে নাকি আমার সঙ্গে?”
“নাহ্, এমন কোনো জরুরি ব্যাপার নয়, পরে বললেও চলবে।”
এ কথা ঠিক যে, বিস্তর সময় আমাদের ছিল। দশ হাজার, বিশ হাজার বছর। অপেক্ষা করতে পারব আমি।
শুভরাত্রি জানিয়ে লাইন কেটে দেয় আমার বান্ধবী। আর সেই সময় তীব্র ক্ষুধা অনুভব করলাম আমি। কিছু না খেলে পাগল হয়ে যাব। মুখে দেওয়ার মতো একটা কিছু হলেই চলবে। কেউ খেতে ডাকলে হামাগুড়ি দিয়ে হাজির হবো তার কাছে। তার আঙ্গুল চেটে সাফ-সুতরা করে দেব। হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তারপর দেব লম্বা একটা গভীর ঘুম।
ফোনের দিকে ঝুঁকলাম। মন শূন্য করে ফেলে চোখ বন্ধ করলাম। তখন পায়ের আওয়াজ কানে এল- হাজার হাজার পায়ের শব্দ। ঢেউয়ের মতো ওগুলো আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। চলতে লাগল পা গুলো, ক্রমাগত। গরিব খালাম্মা এখন কোথায়? অবাক হয়ে ভাবলাম। কোথায় চলে গেলেন তিনি? আর আমি-ই বা কোথায় ফিরে এলাম?
ঠিক এখন থেকে দশ হাজার বছর পরে যদি এমন এক সমাজ গঠিত হয় যেখানে শুধুমাত্র গরিব খালাম্মারা থাকবে, টাউন হল হবে গরিব খালাম্মাদের নিয়ে। সদস্যরা। নির্বাচিত হবেন গরিব খালাম্মাদের ভোটে। গরিব খালাম্মাদের জন্য গাড়ি থাকবে, গাড়ি চালাবেনও তারাই। উপন্যাস লিখবেন তারা। তারা কি আমার জন্য দ্বার উন্মোচন করবেন?
তারপরও বলতে হয়, এগুলোর কোনো কিছু দরকার হবে না তাদের। এর বদলে তারা হয়ত নিজেদের তৈরি ভিনিগারের বোতলে বাস করতে চাইবেন। আকাশ থেকে আপনি দেখতে পাবেন লাখ লাখ ভিনিগারের বোতলে পৃথিবী ছেয়ে গেছে। দৃশ্যটা এত চমৎকার হবে যে, আপনার শ্বাস বের করে আনবে।
হ্যাঁ, সে রকমই হবে। আর সেখানে যদি কবিতার কোনো স্থান থাকে তাহলে তা সানন্দে রচনা করব আমি : গরিব খালাম্মাদের জগতের প্রথম রাজকবি। আমি সবুজ বোতলের ওপর সূর্যের আভা আর আর ঘাসের বিশাল সমুদুরের প্রশংসা করে গান গাইব।
কিন্তু সে তো অনেকদিন পরের কথা অর্থাৎ কিনা ১২০০১ সালের ব্যাপার। অপেক্ষার জন্য দশ হাজার বছর একটা দীর্ঘ সময়। সে পর্যন্ত টিকে বৰ্তে থাকতে অনেক শীতকাল পাব আমি!