গরিবের ঘোড়া-রোগ
আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের গ্রামে এক জমিদার ছিলেন, তাঁর মা নাকি ভারী দয়ালু। কেউ তার ছেলেমেয়ের বিয়ে, বা মা-বাপের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে, বাড়ির দুটো কলা-মুলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে এলে, তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে কত আশীর্বাদ করতেন আর বলতেন, ‘আহা, বেঁচে থাক, সুখে থাক, আমার সতীশচন্দ্রের দোরে চিরকাল খেটেখুটে খেও!’ প্রজারা কৃতার্থ হয়ে বাড়ি যেত।
আরেক জমিদার ছিলেন, তিনি কারও বারণ না শুনে ছেলেকে স্কুলে ভরতি করে দিলেন। গাঁয়ের স্কুল নয়; সেখানে যত রাজ্যের চাষাভুষোর এবং তাঁর নিজের সেরেস্তার মুহুরি, দপ্তরির ছেলেরা পড়ত। তাদের সঙ্গে তো ছেলেকে বসতে দেওয়া যায় না।
তাই তাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন, মামার বাড়িতে থেকে, হিন্দু স্কুলে পড়ুক। তাঁর ছেলের প্রাণের বন্ধু মুহুরির ছেলে পাশের গাঁয়ের বড় স্কুলে ভরতি হল। মোসায়েবের মুখে সেকথা শুনে জমিদার রেগে গেলেন, ‘যত্ত সব বাড়াবাড়ি! কেন, গাঁয়ের পাঠশালাটা কীসে খারাপ হল? দেখিস্ তোরা, ওকে পাঠশালার গণ্ডি পার হতে হবে না!’
কয়েক বছর পরে জমিদারের ছেলেকে হিন্দু স্কুল থেকে ছাড়িয়ে, মামার বাড়ি থেকে সরিয়ে, কুষ্ঠিয়ার বোর্ডিং-এ রাখা হল। কলকাতার ছেলেরা নাকি ভারী খারাপ। মামাও আর ছেলেকে রাখতে চাইছেন না।
জমিদার বললেন, ‘স্রেফ হিংসে। আমার জগদীশ সর্দি-কাশিতে এমনি ভুগল যে মন দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষাটা দিতে পারল না। দিলে আটকে মাস্টারগুলো! এর ফলে মামার ছেলেও জগদীশের ক্লাসে উঠে এল। পাছে সে জগদীশের চেয়ে কম নম্বর পায়, তাই শালা বলে পাঠিয়েছেন— ও ছেলে রাখা আমার কম্ম নয়।’
মোসায়েব বললেন, এই তো ভাল, কত্তাবাবু। কাছে-পিঠে থাকবে, আনা-নেয়া করতে পারবেন!’
আরও দু’বছর বাদে বোর্ডিং ছেড়ে জগদীশ বাড়িতে এসে বসল। হেডমাস্টার নাকি ভারী খারাপ। ওর অসুবিধা বোঝে না।
মোসায়েব বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে, কত্তাবাবু, ওকে তো আর পরের দোরে চাকরি করে খেতে হবে না। এমন জমিদারি রয়েছে। একটা বাড়ির মাস্টার রেখে দিন, তাতেই হবে। আমার ভাইপোটা তো ম্যাট্রিক পাশ করে, সেই ইস্তক বসেই আছে।’
জমিদার বললেন, ‘বেশ। আচ্ছা ওই ব্যাটা মুহুরির ছেলেটার কী হল? তার সঙ্গে মিশে আমার ছেলেটা না আবার বয়ে যায়!’
মোসায়েব বললেন, ‘না, না, সে ভয় নেই। সে ব্যাটা এবার মধ্যশিক্ষায় পরীক্ষা দিয়েছে। চমৎকার নৌকো বায়।’
জমিদার বললেন, ‘হে হে তাই নাকি? পাস্ নিশ্চয় করতে পারবে না, তা না হয় মাঝিগিরি করে খাবে!’
মোসায়েব বললেন, ‘না কত্তামশাই, পাস্ করে সে জলপানি পেয়ে কুষ্ঠের ইস্কুলে ভরতি হয়েছে। ডেপুটি সায়েব ওর নৌকো বাওয়া দেখে খুশি হয়ে সোনার মেটেল দেছেন।’
জমিদার বললেন, ‘হুম!’
আরও কয়েক বছর গেল। ছেলেকে সামলাতে না পেরে, কড়া শ্বশুরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, জমিদার তাকে পাঠিয়ে দিলেন খিদিরপুরে, শ্বশুরের কুঠিবাড়িতে কাজ শিখতে।
সন্ধ্যাবেলা মোসায়েবকে বললেন, ‘এত দিনে সে হতভাগা নিশ্চয় জেলে গেছে? পিঁপড়ের পাখা উঠলে যা হয়।’
মোসায়েব বললেন, ‘আজ্ঞে না, কত্তাবাবু, সে ম্যাট্রিক পাস করে জলপানি পেয়ে, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছে।’
কত্তা একটু গরম হলেন, ‘তা পড়তে পারে। ছোটলোকের ছেলে স্রেফ কপালজোরে এতটা উঠেছে। বিএ পাস ওকে করতে হবে না দেখো।’
আরও চার বছর পরে, মোসায়েব একদিন নিজের থেকে বললেন, ‘ও কত্তামশাই, ওই যে অনুকূল মুহুরি, যার ছেলের বড্ড বাড় বেড়েছে বলে আপনি চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিলেন, তার সেই ছেলে বিএ পাস্ করে পাঁচশো টাকার পুরস্কার আর সোনার মেটেল পেয়েছে। এম্এ পড়ে আর মাসে মাসে বাপকে মাইনের ডবল টাকা পাঠায়।’
জমিদার কাষ্ঠ হাসলেন, ‘তা পেতে পারে। কিন্তু ছোটলোকের ছেলে তো, চাকরি-বাকরি পাবে না। এই আমি বলে দিলাম।’
আরও বছর দুই পরে মোসায়েব বললেন, ‘ও কত্তা, সেই ছোকরা সব-ডেপুটি হল!’
জমিদার বললেন, ‘হে হে ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের সব-ডেপুটি হয়ে কি আমাদের মাথা কিনে নেবে? ব্যাটা খোশামুদে কোথাকার!’
মোসায়েব বললেন, ‘তা নয়, কত্তা, সে যে ডেপুটি হয়ে, আমাদের কুষ্ঠেতেই আসছে!’
জমিদার আঁতকে উঠলেন, ‘অ্যাঁ বলো কী! ব্যাটার তো কম আস্পদ্দা নয়!’
তারপর কিছুক্ষণ থুম হয়ে বসে থেকে, শেষটা বললেন, ‘তা হলে ব্যাটা নিশ্চয় মরে যাবে!’