গরল

গরল

সাত সকালেই পাড়ার নীরবতা ভঙ্গ করে তীক্ষ্ণসুরে বাঁশিটা বেজে ওঠে ‘ফুরু রুরু ফুর রুরু’। বেশ কয়েকবারই বাজে বাঁশিটা, যেন মাঠের দুদিকে এগারোজন করে প্লেয়ার ধড়াচূড়া পরে তৈরি হয়ে আছে। মাঝমাঠে বলটা রাখা। এইবার খেলা শুরু হবে। প্রথম প্রথম এমনি ভাবটাই এই বিজয়রত্ন বাইলেনের মানুষদের মনে হতো, অনেকে বের হয়েও আসতো কী ঘটবে এরপর সেটা দেখার জন্য, কিন্তু ক্রমশ মানুষ ধাতস্থ হয়ে গেছে।

ওই বাঁশি বাজার পরই শোনা যায় ঘড় ঘড়াং একটা ধাতব কর্কশ শব্দ। রাস্তা দিয়ে ভাঙাচোরা নববড়ে একটা ছোট হাতগাড়ি টেনে আনছে যদু। যদু পাশোয়ান এই অঞ্চলের জঞ্জাল সাফাই-এর কাজ করে।

ইদানীং আর বাড়ির জঞ্জাল নিয়ে গিয়ে বাইরে ভাঙা ডাস্টবিনে ফেলতে হয় না। তখন ময়লা সেখানেই পড়ে বৃষ্টিতে পচতো, কুকুরে রাস্তাময় ছিটোতো সব ময়লা, এখন তাই কর্পোরেশন থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে বাড়ির সামনে হাতগাড়ি নিয়ে যাবে সাফাইকর্মীরা। গৃহস্থ তাদের বাড়ির সব আবর্জনা, নোংরা ওই গাড়িতে তুলে দিয়ে তাদের ঘর মালিন্যমুক্ত করে রাখবে।

তাই যদু পাশোয়ান আসে রোজ সকালে। ঘরে ঘরে গিয়ে ওই পাড়ার সব সংসারের ময়লা সাফ করে নিয়ে যায়।

নবীনবাবু এ-পাড়ার পুরোনো বাসিন্দা। ওর পিতৃপুরুষের স্বর্ণশিল্পের ব্যবসা ছিল। তখন দমদম বাজারে একটা এঁদো ঘরে সামান্য পুঁজি নিয়ে সোনা রূপার গহনা গড়তো। অবশ্য তখন এই এলাকায় এত ঘর বাড়িও ছিল না। কিছু পুরানো বসতি ছিল, আর ছিল কলকাতার রইস আদমিদের বাগানবাড়ি। শনিবার, রবিবার জমজমাট মহফিল বসতো বাগানবাড়িতে। জুড়িগাড়ি আসতো, সারেঙ্গির সুর উঠতো, বাঈজির ঠুংরির কলিও শোনা যেতো।

বাবুরাই পেয়ারের বাঈজির জন্য গহনাপত্র গড়াতো, আর কিছু গহনা তৈরি করাতো সাধারণ গৃহস্থ তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের সময়। ওই সব করে কোনমতে টুকটাক করে নবীনের বাবা নরহরি দাস সংসার চালাতো। আর এই অঞ্চলে ছিল তার বাড়ি। একটা ডোবা এদিকে, দু’চারটে আপনা আপনি গজিয়ে ওঠা আম, গাব-এর গাছ আর কিছু বাঁশবন। তারই একদিকে একটা ইঁটের দেওয়াল টিনের চাল দেওয়া সাবেকি ধরনের বাড়ি।

সেই অঞ্চলকে এখন নবীনের বাবা নরহরিও যদি স্বর্গলোক থেকে কোন দিন যদি আসে আর চিনতেই পারবেনা। আর দমদমের দোকানটাকে খুঁজেই পাবে না ভিড় আর আলোর ঝকমকানিতে। সেখানে নবীন এখন চারতলা বিল্ডিং করে নিজে একতলা জুড়ে বিশাল শোরুম বানিয়েছে। আর বাকিটা কোন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে মাসিক বিশাল অঙ্কের টাকা আমদানি করছে।

আর নিজের বাড়ির ওই অঞ্চলেও এখন প্রাচীরঘেরা বিশাল বাড়ি আর একদিকে সুরক্ষিত সোনার গহনার কারখানা গড়েছে। মজবুত গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ওদিকে লাখ লাখ টাকার সোনার রকমারি গহনা গড়াচ্ছে। বড়বাজারে পাঠায় সেসব গহনা। দেশ-বিদেশের বাজারেও রপ্তানি করে।

নবীন দাস এখন এই এলাকার নামী লোক। অবশ্য এই এলাকার চেহারাই বদলে গেছে এখন। সেই বনজঙ্গলের কিছুমাত্র নেই। সাবেক আমলের দু’চারটে গাছ টিকে আছে অতীতের সাথি হয়ে, বাকি সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে সেখানে উঠেছে বড় বড় বাড়ি আর রাস্তা। এসেছে নতুন মানুষ।

ওদিকে সতুমাস্টারের জীর্ণ বাড়িটা এখনও কোনমতে টিকে আছে। সতুমাস্টার ছিলেন এখানের স্কুলের শিক্ষক। তখনকার দিনে স্বদেশী আন্দোলন করে দীর্ঘদিন কারাবাসও করেছিলেন। নিজের হাতে চরকা কাটতেন, আর স্কুলের পরও ছাত্রদের পড়াতেন বিনা পয়সায়। সামান্য মাইনে পেতেন স্কুলে, তার থেকেও গরিব ছাত্রদের বইও কিনে দিতেন। পরীক্ষার ফি দিতে পারছে না শশধর, মেধাবী ছাত্র। সতুবাবুই নিজে তার হয়ে বন্ধুবান্ধবদের কাছে ভিক্ষে করে তার ফি জমা দেন।

শশধর অবশ্য বৃত্তি পেল, সেদিন সতুবাবুর কী আনন্দ। শশধরকে তিনিই কলেজে ভর্তি করান।

সেই শশধর এখন ইঞ্জিনিয়ার। সরকারি চাকরি করে আর বাড়িতেই এখন আর্কিটেক্ট, প্ল্যান-মেকার, বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজও দেখেন অন্য পার্টিদের। কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটির কর্তাদের কর্মীদের কী যাদুবলে বশ করে এখন প্রমোটারদের প্ল্যান স্যাংশন করিয়ে দেন। সেইখানে আইন-কানুনগুলোর কোন বাধাই থাকে না। শশধর এখন বিজয়রত্ন সেনের মুখেই বিশাল বাড়ি করেছে। গ্যারেজে দুখানা গাড়ি, ওদিকে নবীন দাসের বিশাল এলাকা, ওদিকে ধোপার মাঠের বড় পুকুর আর মাঠ-এর চিহ্ন নেই।

এই পুকুর ছিল আয়তনে বেশ বড়, টলটলে জল থাকতো সব সময়। এলাকার মানুষজন স্নান করতো, ধোবারাও এদিকে কাপড় কাচতো। মাঠটায় খেলাধুলা করতো এদিকের ছেলে-মেয়েরা, সন্ধ্যার পর ওখানে গিয়ে বসতো বহু মানুষ, মুক্ত বাতাস পেতো। ক্রমবর্ধমান শহরতলির ওইটুকুই ছিল ফুসফুস। ওই জমির মালিক ছিল মধ্য কলকাতার কোন জমিদার পরিবার। এখন বহু শরিকান সম্পত্তি, অনেকেই বিদেশে, অনেকে মারা গেছেন। তাই ওই মাঠ পুকুর এখন জনগণই ব্যবহার করে।

নবীন দাস এর মধ্যে শশধরবাবুকে বেশ পটিয়ে ফেলেছে। অবশ্য পাড়ার বেশ কিছু লোকই নবীন দাসকে সমীহ করে। কারণ তার টাকা অনেক, বিরাট ব্যবসা, আরও টাকা চাই তার।

ওই এলাকায় নবীন দাসের সোনার কারখানায় বৈকালের দিকে সোনা গলানো হয়, নাইট্রিক অ্যাসিড অন্য অনেক কিছু বিষাক্ত ধোঁয়াও ওঠে। শীতের দিনে ঘন কুয়াশার চাপে ওই বিষাক্ত ধোঁয়া নীচেই থাকে। সারা এলাকার মানুষের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বাচ্চা কান্নাকাটি করে, বেদম কাশে। মানুষজন এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে ক্ষণিকের জন্য উদ্ধার পাবার আশাতেই ওই মাঠে এসে বসে।

পাড়ার দু’চারজন লোক ক্রমশ আপত্তি তোলে। কিন্তু ওদের মুখের উপর কারো কিছু বলার সাধ্য নেই। নবীনবাবুর দুই ছেলে এখন লায়েক হয়েছে। বড় ছেলে সুনীল বাবার ব্যবসাপত্র দেখে, একটা মারুতি হাঁকিয়ে বড়বাজারে অন্যত্র যায়। সঙ্গে থাকে লাখলাখ টাকার সোনা, তাই পাড়ার ন্যাপলা বুলা দুই মস্তান তার সঙ্গে থাকে। শোনা যায় রাত দুপুরেও ওরা গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করে, কি আনা নেওয়া করে কে জানে। তবে ওদের সঙ্গে দামী বিদেশী চেম্বার থাকে তা সকলেই জানে।

আর ছোট ভাই অনিল এখন দোকান ছাড়াও প্রমোটারি ব্যবসাতেও নেমেছে। কলকাতায় আর ঠাঁই নেই। পুরানো বাড়িও মেরামত করার সামর্থ্য নেই। তাই শহরের ওই সব বাড়ি চড়াদামে অবাঙালিদের বিক্রি করে শহরতলির দিকে ছোট ছোট ফ্ল্যাট কিনে চলে আসছে। আর এখানের পুরোনা বাসিন্দারাও আগেকার জায়গা বাড়ি প্রমোটারের হাতে তুলে দিয়ে দু-একটা ফ্ল্যাটও পাচ্ছে সঙ্গে নগদ টাকাও।

তাই ফ্ল্যাটের চাহিদাও আকাশছোঁয়া। সুনীল এখন একটা জিপ হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এর মধ্যেই পাড়ার গুপী-নোটনের দল মস্তানি ছেড়ে সুনীলের সঙ্গে ঘোরে। কেউ ইঁট-বালি-সিমেন্ট সাপ্লাই করে, কেউ পাড়ার উঠতি মস্তানদের চমকে জায়গার দখল নিয়ে সেখানে বাড়ি ফাঁদে।

সুনীল সেই মস্তানদের পোষে। এহেন শক্তিধর নবীন দাসকে ওই বিষাক্ত ধোঁয়ার জন্য বলার কেউ নেই। তবু প্রতিবাদ গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে।

সতুবাবুও দেখেছেন ব্যাপারটা। তারও অসহ্য ঠেকে। পাড়ার লোকদের সঙ্গে করে তিনিই গেছেন সেদিন নবীনের বাড়িতে।

নবীনের বাড়িতে ইঞ্জিনিয়ার শশধরও আসে। সুনীলের হাতে এখন বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট বাড়ির কাজ হয়েছে। শশধরবাবুর দৌলতে সুনীল মিউনিসিপ্যালিটির লোকদের বশ করে ফ্ল্যাটের পাঁচশো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাট এরিয়াকে ছশোতে পরিণত করে দু’হাতে পয়সা লুটছে।

এবার তারা নজর দিয়েছে ওই পুকুর আর মাঠটার দিকে। সুনীল জানে গোলমাল কিছু হবে, তবে সামলে দিতে পারলে ভালোই আমদানি হবে। শশধরবাবুকে সে জায়গাটার নকশা দেখাচ্ছে। ওখানে একটা বড়সড় হাউসিং কমপ্লেক্স মার্কেট … কোটি টাকার ব্যাপার।

হঠাৎ সতুবাবুকে পাড়ার নারাণবাবু, রতন ঘোষদের নিয়ে ঢুকতে দেখে একটু বিরক্তই হয় ওরা। নবীন-শশধর সতুবাবুর ছাত্র। সুনীল যখন স্কুলে ঢোকে সতুবাবু তখন রিটায়ার করেছে। শশধর বলে, স্যার আপনি? এখানে।

সতুবাবু এই পরিবেশে যেন বেমানান। ময়লা ধুতি, রংচটা একটা গেরুয়া পাঞ্জাবি, পায়ে সস্তা টায়ার-কাটা চটি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। সামান্য স্কুলমাস্টার, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিলেন এক সর্বত্যাগী সৈনিক। স্বাধীনতার পর তাদের ভাগ্যে এর বেশি কিছু জোটা যে অসম্ভব তা সতুবাবুও জানেন। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই করতে এসেছিলেন তিনি, স্বাধীনতার সুফল পাবার জন্য নয়। তার জন্য রয়েছে ওই নবীন-শশধরবাবুদের দল। সুনীলদের মতো করিতকর্মা জাতির ভবিষ্যৎরা, সতুবাবু তো ঝরাপাতার দলে।

সতুবাবু বলেন—নবীন, শশধর কেমন আছো? নবীন বলে চলছে, মাস্টারমশাই। ব্যবসাপত্রের অবস্থা তেমন ভালো নয়। যা বাজার পড়েছে স্বর্ণশিল্প তো উঠে যাবারই দাখিল।

সতুবাবু বলেন—সেকি? তাহলে রোজ বৈকালে একেবারে চিমনির মত এত অ্যাসিডের ধোঁয়া বের হচ্ছে কেন? পাড়ার লোক তো অস্থির হয়ে উঠেছে বায়ুদূষণে। একটা ব্যবস্থা করো।

নবীন গুম হয়ে যায়। এবার বুঝছে পাড়ার ওই নারাণবাবু, রতনবাবুরাই সতুবাবুকে তাতিয়েছে। আর নেতা সেজে চলে এসেছে ওই বুড়ো ভাম। এখন কেউ ওকে মানে না, নতুন নেতারা সবাই নবীনবাবুর পোষ্য। তাদের জন্য, তাদের দলের জন্য নবীন মোটা টাকা মাসোহারা দেয়। তারাই এলাকার মানুষের প্রতিভূ, তারা কিছু বলে না, এসেছে ওই বাতিল বুড়ো লোকটা তাকে এ নিয়ে কথা শোনাতে।

সুনীলও বসেছিল। সে বলে,

—ধোঁয়া তো ওদিকে যায় না, তবে কেন এসব বলছেন?

সতুবাবু দেখেছে সুনীলকে। ওদের দেখে সতুবাবু নানা জায়গায়। দলবেঁধে পার্কস্ট্রীটের বারেও যায়। এপাড়া কেন স্টেশনেও দেখেছে মেয়েদের গাড়িতে তুলে নিয়ে ওইসব বারে যেতে। পাড়ার লোকদের ও ধমকায় অকারণে। রাস্তা জুড়ে তাদের ইঁট পাথর ফেলে রাখে, বলারও উপায় নেই।

সুনীলের কথায় কান না দিয়ে সতুবাবু নবীনকে বলে,

—ওদের অসুবিধা হচ্ছে, তাই বলে গেলাম তোমাকে। এটার একটা ব্যবস্থা করো।

কথাগুলো বলে চলে যান সতুবাবু। তিনিও বেশ বুঝেছেন এরা এ নিয়ে কিছু করবে না। তবু প্রতিবাদ জানানো দরকার বলেই কথাটা জানিয়ে গেলেন।

চলে যেতেই নবীন বলে—বুড়ো ভাম-এর তড়পানি দেখলে শশধর? আমাকে শাসিয়ে গেল?

সুনীল বলে—এর ব্যবস্থা করছি। ওই পুকুর, জমিটাই এবার কেড়ে নেব। আর কারখানার কাজ যেমন চলছে চলবে।

সেদিন বৈকালে আরও বেশি করেই সোনা গলানো শুরু হলো।

অবশ্য অনিলকে সোনা গলাতেই হতো। নবীনও বলেছিল।

—ওসব মাল গালিয়ে গহনা করে সরিয়ে ফ্যাল। পাড়ার লোক পিছনে লেগেছে মনে হচ্ছে।

নবীন জানে ওসবের সে পরোয়া করে না। ইদানীং রাতারাতি বাইরে থেকে ভালো পরিমাণ সোনার বিস্কুট আসছে, এছাড়াও নবীনের কাছে দু চারটে গ্যাং-এর চুরি ডাকাতি করা অনেক সোনার জিনিসও আসে। অনেক লাভ থাকে এসবে। কিন্তু বিপদও আছে। অবশ্য এসবের জন্য থানাপুলিশ মায় রেলপুলিশকেও প্রণামী দিতে হয়, তবু তাদের চাকরি বাঁচাবার জন্য মাঝে মাঝে কিছু মাল ধরিয়েও দিতে হয়। যদি তেমনি কোনো ব্যাপার ঘটে, তাই মাল ওরা গালিয়ে ফেলে, তাতে ধরা ছোঁওয়ার ভয় থাকে না। তাই সেদিন প্রচুর ধোঁয়াই বের হয়। শীতের সন্ধ্যায় সারা পাড়ার মানুষ কাশতে থাকে।

সতুবাবুও কাশছেন। চোখে জল নামে। সব মানুষ কাচ্চাবাচ্চা মেয়েদের নিয়ে ঘর ছেড়ে ওই মাঠে এসে আশ্রয় নেয়।

নরেনবাবু কাশতে কাশতে বলে সতুবাবুকে,

—ওদের শয়তানি দেখেছেন মাস্টারমশায়? বলতে গেলাম তাই বেশি করে এসব শুরু করেছে। ভাগ্যিস এই মাঠটা ছিল, নাহলে কোথায় যেতাম কে জানে? পাড়া ছেড়ে না যেতে হয়?

রতনবাবু বলে—ওদেরই সুবিধা হয়, জলের দরে বাড়ি কিনবে ওর ছেলে সুনীল আর ফ্ল্যাট বানাবে। আমাদের তোলার জন্যই এইসব শুরু করেছে।

সতুবাবু আজ বৃদ্ধ। তাঁর সময়ের দু-চার জন প্রথম দিকে মন্ত্রী হয়েছিল, তখন রাইটার্সেও গেছেন, পাড়ার রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থাও করেছেন তাদের বলে। এখন তাদের আর কেউ নেই।

এসেছে নতুন নেতার দল। এদের চেনেন না সতুবাবুর মতো সেদিনের সর্বত্যাগী কর্মীরা।

তারাই এখন নেতা হয়ে কয়েক বছরের মধ্যে হাল ফিরিয়ে নিয়েছে।

এরা সতুবাবুদের চেনে। ওদের থেকে সতুবাবুও দূরে থাকেন। এই মাঠটা তবু তাদের ভরসা।

পদ্মার তীরে ভাঙন হয় প্রায়ই, সেটার প্রস্তুতি টের পাওয়া যায় না। মাটির অতলে জলস্রোত নীচেকার সব মাটি ধুয়ে নিয়ে যায়, তারপর হঠাৎ একদিন উপরের ঘর, বাড়ি জমি বাগান সব তলিয়ে যায় অতলে জেগে ওঠে জলস্রোত।

তেমনি গোপনে সুনীল, নবীনরা যে এর প্রস্তুতি নিয়েছিল তা জানেনা এরা। কিন্তু এরা থেমে থাকে না। এদের মদত দিয়েছে শশধরবাবুও।

হ্যাঁ নবীনের সংসারে অভাবের ছায়ামাত্র নেই। কিন্তু যা আছে সেটা নবীনকে কুরে কুরে খায় এত প্রাচুর্যের মধ্যেও। সেখানেও যেন পদ্মার সর্বনাশা ভাঙনের অদৃশ্য খেলাই শুরু হয়েছে।

নবীনের মেয়ে সীমার বিয়ে-থা দিয়ে পার করতে চেয়েছিল নবীন ছেলেবেলাতেই। তখন ওর ব্যবসা সবে জমছে, অনিলও তার ওই রাতের কারবার শুরু করেছে। সুনীল কলেজে পড়ছে। অবশ্য পড়ার জন্য কলেজে সে যায় না। তখন থেকেই সুনীল জীবনকে ভোগ করতে শিখেছে। বাবার দুনম্বরি পয়সার অভাব নেই। দাদার ওই রাতের কারবারে দেখছে কিভাবে মাল আমদানী হচ্ছে। সে ওদের ম্যানেজ করে টাকা বেশ পায় আর বন্ধুও দু চারটে জুটেছে। তাদের সঙ্গে নানা বার রেস্তোরাঁয় যায়।

একটা গাড়িও পেয়েছে দাদার কাছ থেকে। পয়সার প্রচার না হলে পয়সার মূল্য কি? নবীন এটা চায়নি, সে চুপচাপ থাকতে চায়, কিন্তু সুনীল সেটা চায় না। সে মদ্যপানও করে, অন্য দোষও জুটেছে।

কিন্তু ওই ব্যবসার কথাটা ভোলেনি, ফলে ওইসব করেই সে প্রমোটারি ব্যবসা জমিয়ে ফেলেছে। আর তার বোন সীমাকে সে-ই কলেজে ভর্তি করায়। সীমাও এ বাড়ির সাবেকি ধারার জীবনের কাঠিন্য থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন এক আনন্দের ঘোরলাগা জীবনেই হারিয়ে যেতে চায়।

তার টাকাও আছে, রূপেরও খামতি নাই। তাই স্তাবকদের দলও জুটে যায়। দিলীপ আগরওয়ালও বড়লোকের ছেলে, ওদের বিরাট লোহার কারবার। সুনীলও ক্রমশ পরিচিত হয় ওর সঙ্গে। সুনীল তখন থেকেই দিলীপের টাকা নিয়েই তার প্রমোটারি ব্যবসা শুরু করে আর সীমাকে অনেক কাছে পায় দিলীপ।

কলেজের ছাত্রীদের ট্যুরে যাচ্ছি বলে সীমাও দিলীপের সঙ্গে কখনও দার্জিলিং কখনও সিমলা বেড়াতে যায়।

নবীনের সংসারেও এ নিয়ে অশান্তির সূত্রপাত হয়। নবীনের স্ত্রী দেখেছে ওদের অতীতের অভাবের দিনগুলোকে। সাধারণ ঘরের মেয়ে সে। তখন অভাব থাকলেও ঘরে একটা লক্ষ্মীশ্রী ছিল। কিন্তু এখন?

নবীনের স্ত্রী দেখেছে তার বড় বৌমাকে। অনিলের বিয়ে দিয়েছিল তখন নবীন দুপয়সা করেছে। তাই বড়লোকের ঘর থেকেই এনেছিল বড়বৌ মালতীকে। অনিলও খুশি।

এতদিন তাদের কোনো কৌলিন্যই ছিল না। লোকে বলতো নরু স্বর্ণকারের নাতি। ক্রমশ অতীতের সেই নাকতোলা মানুষগুলোও চলে গেল, ক্রমশঃ শহরতলির রূপ বদলালো। বিরাট বিরাট ফ্ল্যাট বাড়ি গড়ে উঠলো, এলো নতুন মানুষ।

তারা দেখেছে নবীনের ঝকঝকে দোকান, বিশাল বাড়ি, তখন সে হয়ে উঠেছে নবীনবাবু। গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করে, বিরাট ব্যবসা। অনিলও শ্বশুরবাড়ির পরিচয় দেয় বেশ বড় মুখ করেই।

মালতী লেখাপড়া শিখেছে , বড়লোকের মেয়ে। তার জীবনে এর আগেই পুরুষ এসেছে। বিকাশ এখনও তাকে ভোলেনি। বিকাশ এখন পুলিশের বড় অফিসার। অনিলও চেনে বিকাশবাবুকে। এবাড়িতেও আসে বিকাশ, অনিলের বন্ধু হিসাবে।

ওবাড়ির তিনতলার ঘরে রাতে তাদের পান-ভোজনের আসর বসে। মালতীও থাকে। অনিল জানে তার মালপত্র আসে বর্ডার পার হয়ে, সোনার বিস্কুট। ওই কারবারে পুলিশকে হাতে রাখতেই হবে, তাই সে গভীর রাতে বিকাশকে মালতীর জিম্মায় রেখে বের হয় সেই সব মালপত্র আনার তদ্বির তদারক করতে। বিকাশ ও মালতী এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। ওদের অভিসার চলে নির্বিঘ্নেই, আর অনিল টাকা রোজগার করে।

ব্যাপারটা চোখে পড়ে নবীনের স্ত্রী কাত্যায়নীর। শিউরে ওঠে সে। তারই বাড়ির মধ্যে ঘরের বৌ-এর এই ব্যাপারটাকে সে মেনে নিতে পারে না। তার বিবেকে বাধে, সংস্কারে বাধে। তাই সে জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করে।

এসব কি কাণ্ড চলছে বাড়িতে? ছিঃ ছিঃ লক্ষ্মীছাড়া কাণ্ড!

নবীন জানে ব্যাপারটা, কিন্তু অনিলের ওই প্রচুর আমদানিকে সেও স্বাগত জানায়। সে যা করেছে তা ওই চোর-ডাকাতদের আনা গহনা থেকে, অবশ্য তাদের নবীন সন্ধান দিয়েছে সেইসব মক্কেলদের, তাদের গহনার পরিমাণও জানিয়েছে, আর তার দলবল ওই ন্যাপা শিবারা সে সব মাল এনে দিয়েছে নবীনদের হাতে, তারাও বখরা পেয়েছে।

কিন্তু অনিল এর মধ্যে ওই বৌকে দিয়ে বিকাশবাবুর মারফৎ লাইন করে মা-লক্ষ্মীকে এনে ঘরে বেঁধেছে। আর সুনীলও এখন নামকরা বিল্ডার। ঝাঁ চকচকে অফিস-গাড়ি-টাকা সব করেছে, আরও করছে, তবে এর জন্য নবীনের পয়সা সে নেয়নি, সীমাকে টোপ দেখিয়ে ওই দিলীপের টাকাতেই এসব করছে। তাই গিন্নীর কথায় নবীন বলে,

—চুপ করো, কী বলছ আজেবাজে কথা?

কাত্যায়নীও চটে ওঠে—আজে বাজে কথা? ঘরের মধ্যে কী কেলেঙ্কারি চলছে দেখো না? ঘরের বৌ এই করছে আর তোমার মেয়ে উড়ছে কোন লোহার কারবারির সঙ্গে। লোক গায়ে থুতু দেবে এবার।

অনিল, সুনীলও মায়ের কথাগুলো শুনেছে।

তারা এই কাজগুলোকে কোনদিনই অন্যায় বলে ভাবেনি, তাই মায়ের এই কথার প্রতিবাদে তারাও গর্জে ওঠে।

—কি যা তা বলছ মা? লোকের কথায় কান দেবার দরকার আমাদের নেই। গাড়িতে ঘুরি আমরা, ইতরজনের কথায় কিছু আসে যায় না। চুপ করো তুমি।

সুনীলও গর্জে ওঠে—ওসব কথা একদম বলবে না। বললে মা বলে রেয়াৎ করবো না।

কাত্যায়নী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। মনে হয় এ যেন একটা পাপপুরীই, এর কোণে কোণে লোভ লালসা আর পাপেরই জঞ্জাল স্তূপীকৃত হয়ে আছে। এ নিয়ে তার কোন কথা বলার অধিকারও নাই। এদের টাকার লোভ সব মূল্যবোধ শুচিতাকেও বিকৃত করে দিয়েছে। সবকিছুই দেখতে হবে তাকে নীরব দর্শকের মতই। না হলে তাকেও উচিত শাস্তি দিতে পারে তা-ও ঘোষণা করেছে তার সুপুত্ররা।

কাত্যায়নীর সংসারের অতলে একটা গভীর আবর্তের সৃষ্টি হয়। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবার বাইরের সমাজেও। হঠাৎ সেদিন পাড়ার লোকজন ঘরের বৌ বাচ্চারা দেখে যে ওই মাঠে কারা মাপজোপ করছে, আর বেশ কয়েকটা লরী-বোঝাই মাটি-আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে ওই পুকুরটায়। লোকজনও রয়েছে। ক্রমশ কৌতূহলী জনতার ভিড় বাড়তে থাকে।

পাড়ার লোকজন এসে জোটে। সুনীল, নবীনবাবুও হাজির রয়েছে। ওদিকে হাজির হয়েছে পুলিশ অফিসারের ইউনিফর্ম পরে বিকাশ সাহেব, সঙ্গে একটা বাস-বোঝাই পুলিশ। তারাও নেমে বন্দুক হাতে চারিদিকে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বাধা এলেই তারাও অ্যাকশন নেবে।

চোখের সামনে এলাকার মানুষের ওই এক ফালি সবুজ স্নিগ্ধতাকে এরা নিঃশেষ করে দিতে চায়, ওদের ফুসফুসকে অকেজো করে তিলে তিলে ওদের শেষ করতে চায়।

মানুষগুলো এতদিন নবীনবাবুর গ্যাস চেম্বার থেকে ওখানে এসে বাঁচার চেষ্টা করেছে। আজ নবীনবাবু ওদের বাঁচার সেই আশ্রয়টুকুই কেড়ে নিতে চায়।

এর মধ্যে পাড়ার লোকজন নরেনবাবু, রতনবাবু অন্যদেরও খবর দেয়। বেশ কিছু তরুণ এই মাঠে খেলা করতো, তারাও এসে হাজির হয়। গুঞ্জন ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষায়। সতুবাবুও এসে পড়েছেন, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, পরনে ময়লা ফতুয়া, পায়ে টায়ারের চপ্পল, হাতে লাঠি।

—একি করছ তোমরা? এই নবীন, শশধর!

তিনি এগিয়ে আসেন, প্রথম প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে।

—এ তোমাদের অন্যায়, এ সব শরিকান সম্পত্তি। সব সরকারি ভেস্টেড ল্যাণ্ড-এর দখল তোমরা নিতে পারো না।

শশধর তখন নক্সা পড়চা মিলিয়ে জায়গা মাপ করাচ্ছে। এক প্লটে প্রায় ষোল বিঘে জায়গা। সুনীল দারুণ একটা সুযোগ দিয়েছে। কোটি টাকার ব্যাপার। শশধর আজ নিজের সেই অতীতের দিনগুলোকেও ভুলে গেছে। স্যার তাকে খাইয়েছে, বই কিনে দিয়েছে, পরীক্ষার ফিস দিয়েছে ভিক্ষা করে, তার পিছনে জীবনের অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু শশধর আজ সে সব কথা ভুলে গেছে।

সুনীল, নবীনের সামনে আজ বিরাট একটা টাকার পাহাড়ের স্বপ্ন। এত বড় কাজ! নবীনই বলে,

—এসব জায়গা আমরা কিনেছি মাস্টারমশাই, এখানে বাধা দিতে আসবেন না। দলিলপত্র হয়ে গেছে।

নরেনবাবুরা এগিয়ে আসে। বলে,—এসব মিথ্যা দলিল আমরা মানি না। শরিকানদের পাত্তাই নেই। সুনীলের চেলারাও এবার তৈরি।

সারা পাড়ার লোকজন এসে জুটেছে। ওই নবীনবাবুর বাড়ির ছাদ থেকে মাঠটা স্পষ্ট দেখা যায়। কাত্যায়নী এখানে বৌ হয়ে এসেও দেখেছে চারিদিকে শ্যাম সজীবতা, পাখির ডাক, শান্ত একটি পল্লীকে। তখন সকলে সকলকে চিনতো, ক’ঘরই বা মানুষ। কাত্যায়নীও মাথায় কাপড় দিয়ে যাতায়াত করতো। সে-ও ওই পুকুরে স্নান করেছে, এখানের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দুদণ্ড বিশ্রাম নিয়েছে। আজ তার স্বামী, ছেলেরা নিজেদের সংসারে লোভের আগুন জ্বেলে সব শুচিতাকে পুড়িয়েছে, সব শান্তিকে বিঘ্নিত করে এবার সারা এলাকার মানুষের এতটুকু শান্তির আশ্রয়কেও তছনছ করে দিতে চায়।

ওদিকে জনতাও গর্জে ওঠে—এ জমি পুকুরের দখল নিতে দেব না।

—না। তরুণদল গর্জে ওঠে।

তারপর শুরু হয় গোলমাল। ছেলের দল গিয়ে ওই পুকুর বোঝাই করতে আসা লরীগুলোকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোঁড়ে। কেউ মাপামাপির চেন, থিওডোলাইট স্ট্যাণ্ড সমেত ছিটকে ফেলে। তারপরই শুরু হয় নবীন শশধরের খেলা। বিকাশ সাহেবের পুলিশও অনিল-সুনীলের ইঙ্গিতে ওই জনতার উপর লাফিয়ে পড়ে নির্দয়ভাবে লাঠি চালাতে থাকে। কলরব আর্তনাদ ওঠে। সারা এলাকার মানুষ তখন ছুটে পালাচ্ছে।

নবীন গর্জন করে—মেরে পাট করে দে! জমির দখল দেবেনা? এ জমি আমার।

কয়েক মিনিট ধরে ওই যুদ্ধ চলে, তারপর যুদ্ধক্ষেত্র ফাঁকা। এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়ে আছে দু-চারজন, কারও মাথা ফেটেছে, কার হাত ভেঙেছে, ওদিকে ছিটকে পড়ে আছে সতুমাস্টারের দেহটা, চোখের চশমাটা ভেঙে গেছে, মাথায় লাঠির আঘাতে সামনেটা ফেটে গেছে।

শশধর বলে, বুড়ো যে খতম হয়ে গেছে হে নবীন!

নবীনও দেখছে। বিকাশ সাহেব এগিয়ে আসে, বেটন দিয়ে সতুমাস্টারের দেহটা খুঁচিয়ে বলে,

—তাই তে দেখছি, ডেড ইন অ্যাকশন। ওহে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে দাও, যেখানে হোক নিয়ে যাক।

সতুমাস্টার আজ নেই। সংসারে তার আপনজনও কেউ ছিল না। সকলকে নিয়ে এক স্বাধীন সুখী ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিল সে। আজ তারই ছাত্ররা উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা দিয়েছে।

সারা এলাকায় কদিন অশান্তির ঝড় ওঠে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই ঝড় থামে, মানুষ ভুলে যায় সতুমাস্টারকে। দেখে তাঁর সেই মাঠপুকুরে এখন পাইলিং হচ্ছে। সুনীল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি পুরোদমে কাজ করছে বিশাল হাউসিং স্কিমের। অনেক নতুন মানুষ ঘর বাঁধবে সেখানে।

বিজয়রত্ন লেনের জীবন চলছে নিজের ছন্দে। রোজ সকালে যদুর বাঁশি বাজে, ময়লা গাড়িতে নবীন শশধর সকলের বাড়ির জঞ্জাল ময়লা তুলে নিয়ে যায়।

কাত্যায়নী তারপর নীরব হয়ে গেছে। সীমা কোন নার্সিং হোম থেকে অবৈধ মাতৃত্বের দায় মুক্ত হয়ে এসেছে। কাত্যায়নী নীরব। যদুর ময়লা গাড়ি দেখে মনে হয় ওই বাঁশি বাজিয়ে ও ঘরের ময়লা সাফ করে। মনের ময়লা, সংসারের অতল অন্তরে জমে থাকা ময়লা পচা পাঁকগুলো কি কোনদিনই সাফ করার বাঁশি বাজিয়ে আসবেনা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *