গরমের পাখা মাঘ মাসে
কয়েক বছর আগে, পূর্ব শহরতলির এই নতুন পাড়ায় আসার কয়েকদিনের মধ্যেই অনুভব করি যে, এই এলাকায় প্রয়োজন এবং মানুষজনের তুলনায় ফেরিওয়ালার সংখ্যা অনেক পরিমাণে বেশি।
সেই কলিকাতা-কমলালয়, মহাস্থবির জাতক কিংবা রাধাপ্রসাদ গুপ্তের স্মৃতিবিহুল রচনায় যতরকম ফেরিওলার ডাকের কথা পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল, এতকাল পরে এখানে এসে সব শুনতে পাচ্ছি।
তা নিশ্চয় নয়, হারিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালার ডাকগুলো তালিকা করে পেশ করতে গেলে সে এক নতুন মহাভারত হয়ে যাবে। এই সামান্য রচনার পরিসীমায় কুলোবে না।
এ-পাড়ায় এসে সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত হয়েছিলাম যে ফেরিওলাকে দেখে, তাঁকে ঠিক ফেরিওলা বলা উচিত হবে না।
আলোচ্য ফেরিওলা হলেন একজন তুলোর ধুনকর। তিনি তাঁর বেহালার মতো গুণ টানা তুলো ধুনবার যন্ত্রটি কাঁধে করে বাজাতে বাজাতে গলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ান, সঙ্গে একটা ছোট ছেলে থাকে সে তারস্বরে চেঁচায়, “লেপ বানাই, লেপ বানাই।”
এ-বাড়িতে এসেছিলাম শ্রাবণের শেষে, ভাদ্র মাসের মুখোমুখি। নতুন বাড়ি, চুন-সিমেন্টের উত্তাপ, পাদপহীন খোলামেলা জায়গার অসহিষ্ণু আর্দ্রতা, সেই সঙ্গে তাল পাকা গরম।
সেই অসহ্য গরমের ভরদুপুর বেলা ধুনকরের টঙ্কার এবং ‘লেপ বানাই’ চিৎকার শুনে খুবই বিচলিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এখন আবার লেপ বানাবে কে?
এরই কয়েক মাস পরে এক জবর ঠান্ডা মাঘ মাসের সন্ধ্যায় হঠাৎ শুনতে পেলাম বন্ধ জানলার ওপারে রাস্তা দিয়ে কে যেন হেঁটে যাচ্ছে, “শীতল পাটি, তালপাতার পাখা।”
জানলার খড়খড়ি উঁচু করে দেখলাম। কৌতূহল হল, এই জবুথবু শীতের রাতে কে বিক্রি করতে এসেছে গরমের আরাম হাতপাখা আর শীতলপাটি।
ফেরিওয়ালাকে দেখে মনের মধ্যে কেমন একটা সন্দেহ দেখা দিল, কী রকম যেন একটা খটকা।
খটকাটা দূর হতে ছ’ মাস লাগল।
ছ’ মাস পরে আবার গ্রীষ্ম। লোডশেডিংয়ের দুরন্ত দুপুর। ভিজে গামছা দিয়ে হাত-মুখ-শরীর মুছতে মুছতে ভাবছি, একটা হাতপাখা, একটা শীতলপাটি থাকলে কিছুটা আরাম হত।
এমন সময় গত গ্রীষ্মের সেই ফেরিওলার ডাক “লেপ বানাই, লেপ বানাই।” সেই সঙ্গে ধুন যন্ত্রের ছড়িতে তীব্র টঙ্কার।
বাইরে গরমের হলকা সত্ত্বেও দরজা খুলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ধুনুরি সামনে আসতে তাকে বললাম, “এই গরমে কে লেপ বানাবে? এই যে এত রোদে ঘুরছ ঘামতে ঘামতে, কেউ তোমার কাছে লেপ বানাতে দিয়েছে?”
ধুনুরি বলল, “হ্যাঁ, দিয়েছে, এই কালই আপনাদের ব্লকের ৭৯৪ নম্বর বাড়ির বুড়োবাবু একটা ডবল লেপ বানালেন।”
বুড়ো বাবার এমন মতিভ্রম কেন, শীতগ্রীষ্ম বোধ কী করে নষ্ট হয়ে গেল, তা নিয়ে কিছুক্ষণ মাথা ঘামালাম, ধুনুরি নিজের মতো চলে গেল।
ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, হঠাৎ ছ’মাস পরে এক ঘন ঠান্ডার সন্ধ্যায় আবার ফেরিওলার ডাক, “তালপাখা, শীতলপাটি। তালপাখা, শীতলপাটি।”
বাইরে উত্তরের হাওয়া। তবু রাস্তায় বেরলাম। এবার চিনতে পারলাম, এ সেই ধুনুরি, এরা দু’জনে একই ব্যক্তি। এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, “এই মাঘ মাসের রাতে হাতপাখা, শীতলপাটি কেউ কিনল?”
ফেরিওলা বলল, “কেন কিনবে না। ৭৯৪ নম্বর বাড়ির বুড়ো বাবুই তো একডজন হাতপাখা আজই কিনলেন।”
এলাকায় প্রায় দু’বছর বসবাস করছি, ৭৯৪ নম্বরের বুড়োবাবুর সঙ্গে সামান্য পরিচয় হয়েছে। তাঁকে তো খামখেয়ালি বা পাগল বলে মনে হয় না। পরদিন সকালে তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমার প্রশ্ন শুনে হেসে বললেন, “হিসেবটা একমাত্র বুঝুন।”
এসব হিসেব জীবনে আমি কখনও বুঝতে পারিনি। বলা বাহুল্য, এবারেও পারলাম না। হিসেবটা এ রকম—মাঘ মাসে তালপাতার পাখা গরমের দিনের তুলনায় অর্ধেক দামে পাওয়া যায়, তেমনি শীতের দিনে যেখানে একটা লেপ বানাতে আড়াইশো টাকা লাগে, গরমে লাগে দেড়শো।