গয়ানাথের হাতি

গয়ানাথের হাতি

একটা হাতি কেনার ভারি শখ ছিল গয়ানাথের। শখ সেই ছেলেবেলা থেকেই। গাঁয়ের মগনলালের হাতি ছিল। হাতিতে চেপে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। হাতির ঠমক চমকই আলাদা রকমের। ঘোড়া বা গাধাতেও চাপা যায় বটে, তবে তাতে তেমন সুখ হয় না। কেউ তাকিয়েও দেখে না তেমন। কিন্তু হাতি বেরোলে লোকে ভারি সম্মান করে পথ ছেড়ে দেয়।

তা গয়ানাথ হাতি কিনবে কী, তার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। চাষবাস করে যা মেহনতটা হয় তার দশ ভাগের এক ভাগও ফসল হয়ে ঘরে ওঠে না। ধারকর্জ শোধ করতে করতেই মাঠের ফসল যখন ঘরে পৌঁছোয় তখন তার বারো আনাই খসে গেছে। তবে তা নিয়ে গয়ানাথের দুঃখও নেই, দুশ্চিন্তাও নেই। গরিবের ঘরে জন্মেছে, গরিবের মতোই বেঁচেই আছে, গরিবের মতোই জীবনটা যাবে। তারা গরিবেরই বংশ। তা বলে হাতির শখ তার যায়নি।

তার যে একটা হাতির শখ আছে সেটা অনেকেই জানে। ধনেশ বৈরাগী একদিন বলল, তা হাতি পুষলে খাওয়াবি কী বাপ? তোর নিজেরই পেট চলে না, আর হাতির পেট দেখেছিস তো, আস্ত একখানা ছোটোখাটো বাড়ি ঢুকে যায়।

গয়ানাথ বলে, তা আর জানি না। হাতির অ আ ক খ সব জানি। খোরাকির চিন্তা পরে, আগে হাতিটা তো হোক।

জপেশ্বর সাধুখাঁ হাটবারে গোরু বেচতে গোহাটায় গিয়েছিল। গয়াকে দেখে বলল, দূর বোকা, হাতি কেনা বেজায় লোকসান। আমার গোরুটা বরং কিনে রাখ, দোবেলা সাত সের দুধ দেবে। হাতির দুধ তো আর মানুষে খেতে পারে না, দোয়ানোও কঠিন কাজ।

গয়ানাথ হেসে বলল, দুধেল হাতি না হলেও চলবে গো জপেশ্বরদাদা।

তবে সবচেয়ে অন্যরকম কথা কয় গয়ানাথের বউ জবা। সে বড়ো ধার্মিক মহিলা। পুজো—আচ্চচা, ব্রত—পার্বণ, উপবাস—কাপাস তার লেগেই আছে। সে বলে, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি বাপু, হাতি নিয়ে আমার কাজ নেই। কবে হাতির পায়ের তলায় কার প্রাণ যায় ঠিক কী। হাতির চিন্তা ছেড়ে একটু ভগবানকে ডাকো তো। পরকালের কাজ হোক।

গয়ানাথ অবাক হয়ে বলে, ভগবানকে আবার ডাকাডাকির কী আছে। তাঁর সঙ্গে তো আমার নিত্যি দেখা হয়।

জবা ভয় খেয়ে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে, ওগো, ভগবানকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলতে নেই। তাতে পাপ হবে যে!

কিন্তু গয়ানাথের মুশকিল হল, কিছুদিন যাবৎ দুপুরবেলায় বাস্তবিকই বটগাছের তলায় ভগবান এসে থানা গেড়ে বসেন। বুড়োসুড়ো মানুষ। একটা চটের থলিতে করে হুঁকো, তামাক, টিকে নিয়ে আসেন। গাছতলায় একখানা আসন পেতে বসে গুুড়ুক গুুড়ুক তামাক খায়। মাঠে চাষের কাজ করতে করতে আড়ে আড়ে দেখে গয়ানাথ।

একদিন গিয়ে পেন্নাম করে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কে আজ্ঞে, কোথা থেকে আগমন হলেন?

বুড়োমানুষটা ভারি খুশিয়ান হাসি হেসে বলে, আমি হলুম গে ভগবান, বুঝলি! হ্যাতান্যাতা লোক নই, স্বয়ং ভগবান!

বাপ রে! ডবল পেন্নাম হই কর্তা, আপনিই তাহলে তিনি?

তাহলে আর বলছি কী? তা কিছু জাদুটাদু দেখতে চাস নাকি?

জিব কেটে গয়ানাথ বলে, আরে না। আপনার মুখের কথাতেই আমার পেত্যয় হয়েছে।

তা তুই কত বড়ো হাতি চাস বল তো!

গয়ানাথের মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে বলল, আজ্ঞে হাতিই যদি হয় তাহলে তো বড়ো হওয়াই ভালো, কি বলেন কর্তা?

তা বটে। হাতি ছোটোখাটো হলে আর সুখ কী? হাতি বলে টের পেতে হবে তো!

যে আজ্ঞে। তবে কিনা হাতির বড়ো দাম শুনেছি।

আচ্ছা, তুই মন দিয়ে চাষবাস কর তো। হাতির সময় হোক তখন ঠিক হাতি এসে হাজির হবে।

তা ভগবান প্রায়ই এসে গাছতলায় বসে থাকেন। তার মেহনত দেখেন। তার সুখ—দুঃখের কথাও শোনেন। আর গয়ানাথ মাঝে মাঝে ভগবানের তামাক সেজে দেয়, পা টিপে দেয়, বাতাসও করে।

বউ কথাটা বিশ্বাস করল না দেখে গয়ানাথ মাথা চুলকে বলল, তাই তো! ভগবানকে পেতে হলে অনেক পুণ্যিটুন্যি করতে হয় শুনেছি, তপস্যাও লাগে, কিন্তু আমার তো কিছুই নেই। তাহলে বোধহয় দিনের বেলাতেই আমি জাগাস্বপ্ন দেখি। ভগবান কী আর তুচ্ছ মানুষের কাছে ধরা দেন।

তা সেদিনই ভগবান বললেন, হ্যাঁ রে, তোর আমাকে এত সন্দেহ কেন? জাদুটাদু যদি দেখতে চাস সে অন্য কথা।

আজ্ঞে না কর্তা, বউ বলছিল কিনা, তাই একটু ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম।

বুড়োমানুষ তামাক খেয়ে ভারি আয়েস করে গাছে ঠেস দিয়ে বসে ট্যাঁক থেকে একটা চোপসানো ন্যাতানো বেলুন বের করে বললেন, আজ তোর জন্য একটা হাতি নিয়ে এসেছি।

হাতি! কই হাতি?

এই যে দেখছিস না।

কর্তা, ও তো একটা বেলুন মনে হচ্ছে।

ওরকম মনে হয়, যা দেখছিস সবই তো আদতে বেলুন। এই যে ফুটো দেখছিস এটাতে কষে ফুঁ দে তো বাবা।

তা গয়ানাথ ফুঁ দিল। আর তাজ্জব কাণ্ড। যত ফুঁ দেয় ততই বেলুনটা ফুলে একটা হাতির আকার নিতে থাকে।

ভগবান বলেন, যত বড়ো হাতি চাস তত ফুঁ দিয়ে যা।

বেলুনটা যখন ফুলে বেশ একটা পেল্লায় হাতির সাইজ হল তখন একটা সুতো দিয়ে ফুটোটা বেঁধে দিয়ে বললেন, এই নে তোর হাতি।

হাতিটা দিব্যি দাঁড়িয়ে শুঁড় দোলাতে লাগল, দু—একবার হাতির ডাকও ছাড়ল।

গয়ানাথ তাজ্জব হয়ে বলে, বেলুন থেকে যে হাতি হয় তা আমার জানা ছিল না কর্তা! কিন্তু এই হাতিকে খাওয়াতেও তো হবে!

ভগবান বলেন, তারও ভাবনা নেই। খাওয়ার আগে খানিকটা হাওয়া ছেড়ে দিবি, দেখবি যখন একটা কুকুরছানার মতো ছোটো হয়ে গেছে তখন হাওয়া বন্ধ করে তোর পাতের একমুঠো ভাত দিস, তাতেই দেখবি হেউ—ঢেউ হয়ে যাবে। আর হাতি রাখার জন্য হাতিশালেরও দরকার নেই। বালিশের পাশে ঘুম পাড়িয়ে রাখবি। আর বড়ো হাতিতে তোর বউ ভয় পেলে ছোটো করে নিবি। তখন হাতি তোর ছেলেপুলের সঙ্গে দিব্যি খেলা করতে পারবেখন।

মহা খুশি হয়ে সেদিন বিশাল হাতিতে চেপে বাড়ি ফিরল গয়ানাথ, সারা গাঁ ঝেঁটিয়ে হাতি দেখতে এল। গয়ানাথের বউয়ের গালে হাত। আর তার ছেলেপুলেদের সে কী আনন্দ!

গাঁয়ের মোড়ল—মাতব্বররা তুমুল মিটিং—এ বসে গেল, গয়ানাথের মতো এমন হাড়হাভাতে মানুষ হাতি কিনে ফেলল, এ তো সাংঘাতিক কথা! জিজ্ঞেস করলে সে হাতজোড় করে কেবল বলে, ভগবান দিয়েছেন, নইলে আমার সাধ্যি কী যে হাতি কিনব! কিন্তু মোড়লরা ভগবানের ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাস করল না। বলল, এর মধ্যে একটা প্যাঁচ আছে। গয়ানাথ নিশ্চয়ই গুপ্তধন পেয়েছে।

কয়েকদিনের মধ্যে গাঁয়ে জানাজানি হয়ে গেল যে, গয়ানাথের হাতির সংখ্যা মোটেই একটা নয়। একপাল এবং নানা সাইজের হাতি। সকালে গয়ানাথ তার বিশাল হাতিতে চেপে মাঠে চাষ করতে যায়। দুপুরে তাকে ভাত পৌঁছে দিতে তার বউ যখন যায় তখন যায় একটা ছোটোখাটো হাতিতে চেপে। আবার বিকেলে গয়ানাথের ছেলেপুলেরা যে হাতিটার সঙ্গে খেলা করে সেটা একটা গোরুর সাইজের। আর গাঁয়ের বিখ্যাত চোর নটবর দাস স্বচক্ষে দেখেছে, গয়ানাথের একটা কুকুরছানার মতো ছোটো হাতিও নাকি আছে। আর সেটা গয়ানাথের শিয়রের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমোয়।

মোড়ল—মাতব্বররা তাকে ডেকে বলল, দেখ, গুপ্তধন যদি পেয়েই থাকিস তাহলে তাতে আমাদেরও একটা পাওনা হয়। ভালো চাস তো আধাআধি বখরা করে নে। নইলে ভালো হবে না। যার এবেলা ভাত জুটলে ওবেলা জোটে না তার চার—পাঁচটা হাতি হয় কী করে? গয়ানাথ ফের হাত জোড় করে বলে, সবই ভগবানের ইচ্ছে।

তার বউ জবা একদিন বলল, ওগো, ভগবানের সঙ্গে যখন তোমার এতই ভাব তখন আর একটু চেয়েই দ্যাখো না! আমাদের তো এত অভাব। শুধু হাতি হলেই তো হবে না।

তা কী চাইব?

এই একখানা সাতমহলা বাড়ি, সাত ঘড়া মোহর, সাত কলসি হিরে—মুক্তো।

তা সে আর বেশি কথা কী? বলবখন।

সেদিন ভগবান গাছতলায় বসেছেন। গয়ানাথ তাঁকে পাখার হাওয়া করতে করতে বলল, আজ্ঞে বাবা, একটা কথা ছিল।

ভগবান হুঁকোয় টান দেওয়া থামিয়ে বললেন, সাতমহলা বাড়ি, সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি হিরে—মুক্তো তো! তাতে হবে তো তোর? আরও কিছু লাগবে না?

মাথা চুলকে গয়ানাথ বলে, বউ তো আর কিছু বলেনি।

ভগবান মিটিমিটি হেসে বলেন, সাতমহলার জায়গায় চৌদ্দ মহলা বাড়ি হলে তো আরও ভালো, চৌদ্দর জায়গায় চৌষট্টি মহল হলে আরও আনন্দ— কী বলিস? আর সাত ঘড়াই বা কেন, ভগবান তো তোকে সাত হাজার ঘড়া মোহর দিতে পারে, আর হিরে—মুক্তোও সেই পরিমাণ।

গয়ানাথ শুকনো মুখে বলে, আমি গরিব মানুষ, অত কী সামলাতে পারব?

আহা, সামলানোর জন্য মাইনে দিয়ে লোক রাখবি। তখন কী আর তুই আজকের গয়ানাথ থাকবি? কেষ্ট বিষ্টু হয়ে উঠবি যে, সমাজ তোকে দু—বেলা সেলাম ঠুকবে। ভালো হবে না?

গয়ানাথ খুব চিন্তিত মুখে বলে, শুনে ভালো লাগছে না বাবা।

তাহলে ভালো করে ভেবে দ্যাখ গিয়ে। বউয়ের সঙ্গেও পরামর্শ করিস। যা চাস তাই পাবি। তবে—

তবে কী বাবা?

এই গাছতলায় রোজ দুপুরে যে এসে বসতুম সেটা আর হবে না। তোকে দিয়ে থুয়ে, একটা হিল্লে করে দিয়ে আমাকে এবার পাততাড়ি গুটোতে হবে।

শুনে গয়ানাথের বুকটা কেমন করে উঠল। বলল, বাবা, তুমি না এলে যে চারদিক বড়ো ফাঁকা হয়ে যাবে।

দুর বোকা! আমি না এলেই কী! তোর কত লোকলশকর হবে, কত নামডাক হবে। কত খাতির হবে তোর!

রাত্রিবেলা বউয়ের কাছে সবটাই খুলে বলল গয়ানাথ। জবা বলল, আহা, ভগবানবাবা এসে গাছতলায় না—ই বা বসলেন। আমি তাঁর জন্য সোনার সিংহাসন বানিয়ে দেব। রোজ পোলাও পায়েস ভোগ দেব, ঠাকুরের সোনার গড়গড়া হবে, তুমি বরং ওটাই চেয়ে নাও। আর রোদে জলে ভগবানের গাছতলায় বসে কষ্ট করার দরকারই বা কী!

কথাটা কানে যেন ভালো শোনাল না গয়ানাথের। তার বেশি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। ভালো—মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও কম। সে শুধু বোঝে, বুড়োমানুষটা এসে ওই যে গাছতলায় বসে থাকেন ওতেই তার বুক ভরে যায়।

পরদিন হাতির হাওয়া খুলে দিয়ে বেলুনটাকে ট্যাঁকে গুঁজে মাঠে গেল গয়ানাথ। তারপর দুপুরে ভগবান এসে গাছতলায় বসতেই তাড়াতাড়ি গিয়ে তামাক সেজে হাতে হুঁকোটা ধরিয়ে দিয়ে একটা প্রণাম করে উঠল। ট্যাঁক থেকে ন্যাতানো বেলুনটা বের করে বলল, এই নাও বাবা, তোমার জিনিস, আমার হাতির শখ মিটে গেছে।

বলিস কী?

আজ্ঞে, দুনিয়ার সব জিনিসই যে ফোলানো জিনিস, ফোঁপড়া, তা আমি টের পেয়েছি।

তা কী ঠিক করলি?

ওসব মোহর টোহরে আমার দরকার নেই। আধপেটা খেয়ে থাকব, তবু রোজ তোমাকে গাছতলায় এসে বসে থাকতে হবে।

ভালো করে ভেবে দ্যাখ।

ভাবতে আমার বয়েই গেছে। অত বুদ্ধিও নেই। আমার ভাবনা তুমিই ভাবো।

ভগবান গুড়ুক গুড়ুক তামাক খেতে খেতে খুব হাসলেন। যেন কথাটা শুনে ভারি আহ্লাদ হয়েছে তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *