গভীর রাত্রে ব্রহ্মপুত্রে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

গভীর রাত্রে ব্রহ্মপুত্রে – দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

বছরকয়েক আগে অসমে গোঁসাইগাঁও-এর ওদিকে একটা ইশকুলে মাস্টারি নিয়ে গিয়েছিলাম। ধুবড়ির কাছে ফকিরাগ্রামে আমার বড়োজ্যাঠার বাড়ি। তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজটায় টিঁকতে পারলাম না। বছর না পুরতেই পালিয়ে এসেছি। তা, এই আক্রাগন্ডার বাজারে অমন ভালো একটা চাকরিতে একটা গোটা বছরও টিঁকতে পারলাম না কেন সেই গল্পই বলতে বসেছি।

বাড়ি ছেড়ে ওই দূরের মুল্লুকে আমি সাধ করে যাইনি অবশ্য। এমনিতে আমি দমদমের ছেলে। কলকাতাতেই ঘোরাফেরা। জন্মে ইস্তক রানাঘাট পেরোইনি। পেরোবার ইচ্ছেও যে বিশেষ ছিল তা নয়। কিন্তু হলে কী হয়, পেটের দায় বড়ো দায়। গ্র্যাজুয়েশন করবার পর প্রায় বছর পাঁচেক হন্যে হয়ে খুঁজেও যখন এদিকে চাকরিবাকরি জোটবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না, তখন একদিন অসম থেকে বড়োজ্যাঠা আমাদের দমদমের বাড়িতে এলেন। কী কাজে যেন কলকাতায় এসেছিলেন, তাই বাবার সঙ্গে একবার দেখা করে যাওয়া।

এ কথা সেকথায় আমার কথা উঠতে জেঠা হেসে বললেন, ‘ঘরকুনো হয়ে থাকলে কি আর কাজকর্ম জোটে? বারাকপুর থেকে টালিগঞ্জের বাইরে কখনও কোনও কাজের খোঁজ করেছিস?’

মাথা নেড়ে বললাম, ‘না মানে বাংলাটা ছাড়া হিন্দি বা ইংরিজি বিশেষ জানি না তো!’

‘হুম। অসমে যাবি? আমাদের ওদিককার ভাষাটা অনেকটা বাংলারই মতো। হিন্দি বা ইংরিজি ততটা না জানলেও চলে যাবে। তোর তো অঙ্ক সাবজেক্ট ছিল, না?’

‘হ্যাঁ। অঙ্ক, ভুগোল আর ইকনমিক্স। অঙ্কে অনার্স নিয়েছিলাম। থাকেনি।’

‘আরে দুত্তোর অনার্স। ও নিয়ে ভাবিস না। তিরিশ বছর ধরে বরদলুই কলেজে পড়াচ্ছি ও মুল্লুকে! চেনাপরিচিতি যা আছে তাতে আমার ভাইপো শুনলে অনেক ইশকুলেই লুফে নেবে তোকে ওখানে। এখন যাবি কিনা সেটা ঠিক কর।’

মাথা নেড়ে বললাম, ‘যাবো।’

এর ঠিক একমাসের মাথায় জ্যাঠার কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। গোঁসাইগাঁওয়ের কুমার নিশানাথ মেমোরিয়াল স্কুলে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন। অঙ্কের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচারের চাকরিটা আমার একরকম হয়েই গিয়েছে ওখানে। নামমাত্র ইন্টারভ্যু শুধু হবে একটা। চিঠিতেই কীভাবে যেতে হবে সেসব লেখা ছিল। অতএব একটা শুভ দিন দেখে দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা হয়ে পড়লাম।

হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে নিউ কোচবিহার, সেখান থেকে বাসে ধুবড়ি, তারপর লঞ্চে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ফুলবাড়ি হয়ে বাসে চেপে গোঁসাইগাঁও যেতে হয়। রেল আর বাস কোম্পানির দয়ায় পাক্কা দু-দিন দু-রাতের ধাক্কা।

বাড়ি ছেড়ে সেই প্রথম প্রবাসে যাওয়া। মনে মনে একটু দুশ্চিন্তা হয়েছিল বইকি, তবে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেখি জায়গাটা মন্দ নয়। ইশকুলের সেক্রেটারি বিজয় হাজরিকার বয়স বেশি নয়। জমিদার বংশের ছেলে। ওঁর ঠাকুরদার নামে ইশকুল। নিজে আবার জ্যাঠার ছাত্র ছিলেন এককালে। কাগজপত্রও কিছু দেখতে চাইলেন না আমার। বলেন, ‘স্যার আপনার নাম রেকমেণ্ড করেছেন ওই আপনার যথেষ্ট কোয়ালিফিকেশন।’

অতএব চাকরিটা হয়ে গেল। দিনকয়েকের মধ্যেই বেশ গুছিয়ে বসলাম গোঁসাইগাঁওতে। পাহাড়ি দেশ। স্বাস্থ্যকর জলহাওয়া। খাবার-দাবারে ভেজাল নেই। পুজোর পর পর গিয়েছিলাম, তা পরের বসন্তকালের মধ্যেই দেখি শরীরের হাড়গোড় আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। দিব্যি নেয়াপাতি ভুঁড়িও একখানা উঁকি মারছে জামার ওপর দিয়ে।

আমাদের এই কলকাতা শহরের মতো হাজারগন্ডা ঝামেলাও ছিল না কিছু সেখানে। খাই দাই, ইশকুলে যাই, ঘড়ি ধরে ক্লাশে পড়াই। সপ্তাহে বড়োজোর গোটা কুড়ি ক্লাস নেওয়া আর বছরে দু-বার পরীক্ষার খাতা দেখা ছাড়া কাজকর্মও বিশেষ নেই। মাইনে অবশ্য বেশি ছিল না। তবে সকাল-বিকেল দু-ব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে উপরি জুটত খানিকটা। তার ওপর, গোঁসাইগাঁও-এর লোকজনের মাস্টারভক্তি মন্দ নয়। মাইনের ওপরেও কলাটা মুলোটা, কখনো একভাঁড় ঘি কিংবা এক হাঁড়ি গুড়, পুকুরের মাছ, এসব তো লেগেই থাকত। চাল, ডাল ছাড়া আর কিছুই প্রায় কিনে খেতে হত না।

দুশমন বলে এক ছোকরা কাজের লোক রেখেছিলাম। ঘরে বাইরে সংসারের সব কাজকর্ম সে-ই সামলাত। কেবল তার রান্নার হাত মোটেই সুবিধের ছিল না বলে হাত পুড়িয়ে রান্নাটা করতে হত রোজ। তবে সেদুঃখুটা বেশি জানান দিত না, কারণ ছুটিছাটায় ফাঁক পেলেই দু একদিনের জন্য ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ফকিরাগ্রামে গিয়ে জেঠিমার হাতের রান্না খেয়ে আসতাম। মাঝে মাঝে জেঠিমার ছেলে ধনপতি ওরফে আমার ধনদা এসে থেকে যেত দু-একদিন। রান্নায় তারও হাত বেজায় ভালো।

সেটা ছিল শ্রাবণ মাসের শেষাশেষি একটা শনিবার। সকাল থেকেই মেঘ করে আছে। আকাশটা যেন জলে টসটস করছে একেবারে, খোঁচা দিলেই জল ঝরবে ঝরঝরিয়ে। টিফিনের আগের পিরিওডে এইট বি সেকশনে বীজগণিতের ক্লাস নিচ্ছিলাম। সেদিনকার মতো সেটাই শেষ ক্লাস। ছেলেদের গোটাকয়েক ফ্যাক্টরাইজেশনের অঙ্ক কষতে দিয়ে জানালার কাছে চেয়ারটা টেনে চুপচাপ বসে ছিলাম। চোখ রয়েছে অফিস ঘরের বাইরে টাঙান বড়ো ঘড়িটার দিকে। মনটা ভারি উড়ু উড়ু করছিল। আর আধঘণ্টা বড়োজোর। তারপরেই বাড়ি। দিনতিনেক আগে ফকিরাগ্রাম থেকে ধনদা এসেছে। তিনদিন ধরে তাই নিজে হাতে রান্নার ছুটি করে মনের সুখে ভালোমন্দ খাওয়া চলেছে আমার। সেদিনও সকালে মেঘ দেখে ভুনি খিচুড়ি বসাবার তোড়জোর করছে দেখে এসেছি।

আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল না অবশ্য। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখি দুশমন দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে। জানালার নীচে এসে দাঁড়িয়ে দুহাতে শিক ধরে মাথাটা উঁচিয়ে বলে, ‘মাস্টারদাদা, বাড়ি আহ। ধনকত্তায় মাতিছে।’

আমি তখন অসমীয়া মোটামুটি বুঝতে পারি। একটু অবাকই হচ্ছিলাম দুশমনের কথা শুনে। ধনদা ‘মাতিছে’ মানে ডেকে পাঠিয়েছে! জানে তো আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এমনিতেই বাড়ি ফিরব। তাহলে এত তাড়া কীসের? বললাম, ‘গিয়ে বল গে, ক্লাসটা শেষ করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যাচ্ছি।’

‘নহয়। তুমি এতিয়ে আহ। নহলে ধনকত্তা চকু রঙ্গা করি বহি আছে। মোক মাতি ক’লে, তোর মাস্টারদাদাক খবর দিয়া।’

বুঝলাম, কিছু একটা ঘটেছে। ধনদার মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষও যখন চোখ লাল করে বসে খবর দিয়ে ডাক পাঠিয়েছে, তখন ব্যাপারটা গুরুতর কিছু হবে। অতএব আর কথা না বাড়িয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাড়িমুখো চললাম।

আমার বাড়িটা ইশকুল থেকে মাইলটাক দূরে একটা ছোটো টিলামতো জায়গায়। উঠতে বেশ খাটুনি। হাঁফাতে হাঁফাতে তার মাথায় চেপে বাড়ি পৌঁছে দেখি, ধনদা তার ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে। অবাক হয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার? তাড়া দিয়ে ডেকে পাঠালে, তারপর এইভাবে চললে কোথায়? এ সপ্তাহটা তো থাকবে বলেছিলে—’

আমার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ধনদা হড়বড় করে বলল, ‘ও বিনু, বাড়ি থেকে তার এসেছে। মা-র শরীরটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়েছে। ডাক্তার সন্দেহ করছেন সেরিব্রাল। অবস্থা ভালো নয়। ফুলবাড়ি থেকে ব্রহ্মপুত্র পেরোবার লাস্ট লঞ্চটা ক-টায় বল তো?’

বললাম, ‘রাত আটটায়। তবে সেনিয়ে ভেবো না। একটার বাসটা পেয়ে গেলে বিকেল পাঁচটার আগেই ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ধুবড়ি পৌঁছে যাব। সেখান থেকে মোটামুটি রাত আটটার মধ্যে ফকিরাগ্রাম।’

‘ঠিক আছে। তুই তাহলে তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নে বিনু—’

খাওয়াদাওয়া তখন আমার মাথায় উঠেছে। ধনদার মা, মানে বড়ো জেঠিমাকে গত কয়েকমাসে আমারও ভীষণ ভালো লেগে গেছে। আমাকে স্নেহও করেন খুব। মিনিট দশেকের মধ্যে ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ঘরের চাবি দুশমনের হাতে দিয়ে রওনা হয়ে গেলাম দুজনে মিলে। ততক্ষণে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নেমে গেছে।

দেরিতে ছেড়ে, রাস্তায় দুবার ব্রেকডাউন সামলে, দুপুর একটার বাস ফুলবাড়ি এসে পৌঁছল যখন ততক্ষণে ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজছে। বাসের প্যাসেঞ্জার সবাই ফুলবাড়িরই মানুষ। আমরা দুজন ছাড়া, ব্রহ্মপুত্র পার হবার লোক সেখানে আর কেউ নেই।

গাড়ি থেকে নামতেই নদী থেকে উঠে আসা জোলো হাওয়ার ঝাপটা লাগল এসে আমাদের শরীরে। বাসস্ট্যাণ্ডের টাইমবাবুর গুমটির একখানা টিমটিমে লমফের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই গোটা চত্বরটায়। নদী থেকে বেশি দূরেও নয় জায়গাটা। তার ছুটন্ত জলের গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছিল সেখান থেকে।

আটটার লঞ্চের সময় তখনো পেরিয়ে যায়নি। অতএব কপাল ঠুকে ঘাটের দিকে রওনা দিলাম দু-জনে মিলে। কিন্তু, ওই যে একটা কথা আছে না, বিপদ কখনো একা আসে না! কথাটা যে কতদূর সত্যি তার একটা অকাট্য প্রমাণ পেলাম লঞ্চঘাটে পৌঁছে। জেটি হা হা করছে ফাঁকা। জেটির পাশেই টিকেটবাবু তাঁর এক ঘরের গুমটিতে বসে ভাত রান্না করছিলেন। জিজ্ঞাসা করতে বললেন, নদীতে জল বাড়ায় দিন দুয়েক হল লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ আছে। জল না কমা অবধি বন্ধই থাকবে।

লঞ্চওয়ালাদের অবশ্য দোষ নেই। বর্ষার জল পেয়ে তখন এক নদী যেন ফুলে উঠে দশ নদী হয়েছে। অন্ধকারে আবছা আবছা টের পাওয়া যাচ্ছিল, লম্বা জেটিটার প্রায় সবটা ডুবিয়ে দিয়ে জল উঠে এসেছে উঁচু পাড়ের একেবারে কাছাকাছি। ফুলে ওঠা নদীর অন্ধকার বুকের ভেতর থেকে গুমগুম ডাক উঠছিল। মাঝেমাঝেই কাছে দূরে পাড় ভেঙে পড়বার ঝপঝপ শব্দ। অন্ধকারে খোলা আকাশের নীচে বসে সেইসব আওয়াজ যে না শুনেছে তাকে বোঝানো মুশকিল তা ঠিক কী রকম!

খানিক ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার পর বললাম, ‘চলো ধনদা, রাতটা তবে এখানেই—’

ধনদা নদীর দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘তোর ইচ্ছে হয় ফিরে যা বিনু, কিন্তু আমি যেভাবে পারি—’, বলতে বলতে সামনে পড়ে থাকা একখানা গাছের গুঁড়ির ওপর গিয়ে বসে পড়ল সে। ধনদা যা একগুঁয়ে লোক! বুঝলাম, এই গোঁ সহজে ভাঙবার নয়। কী আর করা। একা তো আর ফেলে রেখে আসা যায় না! যা মাথাগরম মানুষ। কখন কী করে বসে! কাজেই খানিক দোনোমনা করে আমিও গুটি গুটি তার পাশে গিয়ে বসলাম।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছিল। কোথা দিয়ে যে প্রায় দুটো ঘণ্টা কেটে গেছে ততক্ষণে, টেরও পাইনি। টিকেটবাবুও কখন যেন তাঁর গুমটির আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। আকাশ, নদী, পেছনে ফেলে আসা ছোট্ট গঞ্জ শহরটা, সবকিছু যেন আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকারের আস্তর পড়ে মুছে গিয়েছে চোখের সামনে থেকে। আর সেই অন্ধকারের বুক থেকে কেবল উঠে আসছিল ক্রুদ্ধ নদীর রক্ত জমানো হুঙ্কার।

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা হবে। হঠাৎ ধনদা দেখি কান খাড়া করে কী যেন একটা শুনল। তারপর অন্ধকার নদীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘পার করবাইননি কর্তা? তিনগুণা ভাড়া দিবাম।’ বুঝলাম বিপদে পড়ে অসমীয়া ভুলে নিজের মাতৃভাষা ময়মনসিংহি বুলি বেরিয়েছে এইবারে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নদীর বুক থেকে, ছুটে যাওয়া স্রোতের শব্দকে ডিঙিয়ে, সেই একই বুলিতে অন্য একটা গলার শব্দ ভেসে এল, ‘মোয়াজজেম, ভিড়াও, ভিড়াও, ওইপারে যাওনের লাইগ্যা পিসিঞ্জর আছে।’ তাই শুনে চোখ টানটান করে নদীর দিকে অনেক খুঁজেও আমি অবশ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। বলিহারি চোখ বটে ধনদার!

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটা ছোটো নৌকো এসে পায়ের নীচে পাড়ের গায়ে ভিড়ল। তারপর ছপাত করে সাপের মতো একখানা দড়ি ওপরদিকে ছিটকে এল তার মধ্যে থেকে। নীচে থেকে কমবয়েসি একটা গলা ভেসে এল, ‘কাঁটাডারে মাটিত গাঁইথ্যা রশি ধইরা লাইম্যা আসেন। ডর নাই।’

তার নির্দেশমতো দড়ির মাথায় আটকানো কাঁটাটা মাটিতে গেঁথে দিয়ে তাই ধরে পিছল খাড়াই ঢাল বেয়ে কোনোমতে নেমে এলাম টলমলে নৌকোটার ওপর। দুটো শক্ত হাত আমায় জাপটে ধরে নিল সঙ্গে সঙ্গে। কী ভীষণ ঠাণ্ডা সেহাতদুটো। একটু পরে ধনদাও সেই একই কায়দায় নেমে এসে দড়িটাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে আনতে আনতেই নৌকো ছেড়ে দিল।

নৌকায় দু-জন দাঁড়ি মাঝি। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষটি হালে বসে। কমবয়েসিটি দাঁড় বাইছে। খানিক আগের কথাবার্তাতেই মালুম পেয়েছি তারা ময়মনসিংহের লোক। এ জেলার মাঝিমাল্লারা যেমন শক্তি ধরে গায়ে তেমনই তাদের বুকের পাটা। আর, তেমন বুকের পাটা না হলে কারুর সাহস হবে এমন গাং-এ এমন রাতে দাঁড় ফেলবার?

জ্যাঠার বাড়ি যেতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র এর আগেও বেশ কয়েকবার পেরিয়েছি আমি। এইখান দিয়েই। কিন্তু সেতো দিনের বেলা, মোটরলঞ্চে চেপে নদী পেরনো। তাতে জল থাকে সাত হাত নীচে। ডগডগে দিনের আলোয় কলের নৌকোর ডেকে দাঁড়িয়ে পায়ের নীচে ব্রহ্মপুত্র দেখা আর এমন অন্ধকার রাতে খ্যাপা ব্রহ্মপুত্রের বুকে একটা ছোট্ট নৌকোয় দুলতে দুলতে এক হাত নীচে তার পাগলা স্রোতের গর্জন শোনায় তফাত আছে।

রওনা দেবার ঘণ্টাখানেক বাদে বৃষ্টিটা একেবারে থেমে গেল। ওপর আকাশে হাওয়া চলছিল। তার ঠেলায় এদিক-ওদিক ছিটকে যাচ্ছিল জমাটবঁাধা মেঘ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসা আবছা চাঁদের আলোয় যতদূর চোখ চলে শুধু জল আর জল, খল খল করে ছুটছে। ভয়ে ভয়ে উত্তর-দক্ষিণ দু-দিকেই তাকিয়ে দেখে নিলাম একবার—পাড়ের কোনো চিহ্ন নেই কোনোদিকে।

বেশ কিছুক্ষণ কারও মুখেই কোনো কথা ছিল না। শুধু হালের মটমট আর দাঁড়ের ছপছপ শব্দ উঠছে। তীব্র স্রোতের টানে মোচার খোলার মতো ভেসে যেতে চাওয়া নৌকোটাকে বাগ মানিয়ে রাখতে আপ্রাণ কসরত করে চলেছে দাঁড়ি আর মাঝির দু-জোড়া হাত। তাদের কালো শরীরে পাকিয়ে উঠছিল দড়ির মতো পেশিগুলো। দাঁড় আর হালের জোরে পাগলা স্রোতকে বাগ মানিয়ে কোনাকুনি উলটো পাড়ের দিকে ভেসে চলছিল আমাদের নৌকো।

হঠাৎ আমার পেছন থেকে হালে বসা মাঝি গম্ভীর গলায় বলে উঠল, ‘মড়া দেখিস মোয়াজজেম।’

উলটোদিকে বসা কমবয়েসি দাঁড়িটি অনেকক্ষণ থেকেই নদীর জলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বসে ছিল। সেদিক থেকে মাথা না সরিয়েই বলল, ‘খেয়াল রাখতাসি আব্বা। ভাইবনেন না—’

ফিসফিস করে ধনদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মড়া আবার কোত্থেকে পেল?’

ধনদা মাথা নেড়ে বলল, ‘কে জানে। বর্ষার সময় নদী দিয়ে অনেক সময় বন্যায় ডোবা মানুষের মড়া ভেসে আসে তো! তার কথাই বলছে বোধ হয়।’

গা-টা শিরশির করে উঠল শুনে। নিজেকে ওইরকমভাবে কল্পনা করছিলাম—চারপাশে ছুটন্ত জল—তার মধ্যে একটা শরীর—দিন রাত ভেসে চলে—মাছে চোখ ঠুকরে খেয়ে নিয়েছে—পচা শরীরে বাসা বেঁধেছে জলজ কীট—

মনে একটা অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়ি আর মাঝির দিকে একবার চেয়ে দেখলাম আমি। আধো অন্ধকারে জলের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে বসে আছে তারা। হাতগুলো কেবল যান্ত্রিকভাবে নিজেদের কাজ করে চলেছে। বেশ অনেকটা দূরে তখন উলটোদিকের ধুবড়ি শহরের আলোর হালকা আভাস দেখা দিয়েছে। আমাদের নৌকো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল সেইদিকে।

খানিক বাদে, একেবারে হঠাৎ করেই মোয়াজজেম নামের সেই ছেলেটি চিৎকার করে উঠল, ‘পাইছি বাপজানরে, ওই যে আপনের মড়া যায় গো—ওই যে—বাম দিকে—ধরেন ধরেন—’

মুহূর্তের মধ্যে হালের এক মোচড়ে নৌকো ফের মুখ ঘোরাল উলটোমুখে। ঝপ ঝপ করে দাঁড় ফেলে ফের তিরবেগে এগিয়ে গেল মাঝনদীর দিকে। একটা অজানা ভয়ে বুকটা কেন যেন শিরশির করে উঠল আমার। কাঁপা কাঁপা গলায় মাঝির দিকে চেয়ে বললাম, আ-আমাদের পাড় করে দেন গো আগে—বাড়িতে অসুখ—অবস্থা ভালো নয়—’

কোনো উত্তর এল না দাঁড়ি বা মাঝি কারও কাছ থেকে। শুধু শক্তিশালী হাতে দাঁড়ের ঝাপটায় নৌকো যেন প্রায় উড়ে চলল গভীর থেকে গভীরতর জলের দিকে, আর তারপর, একেবারে হঠাৎ করেই হালের মুঠ ছেড়ে দিয়ে, দুহাত মাথার ওপরে তুলে, নৌকার মাঝবরাবর এগিয়ে গেল মাঝি। হালের শাসন থেকে ছাড়া পেতেই মাতালের মতো টলে উঠে ঘুরপাক খেতে শুরু করল ছোট্ট নৌকোটা। আর, তারপর দু-পায়ের ধাক্কায় তাকে আরও টালমাটাল করে দিয়ে মাঝি ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ছুটন্ত জলে। হাতের দাঁড়দুটো জল থেকে তুলে নিয়ে মোয়াজজেম দেখি অবিচলিত মুখে তাকিয়ে রয়েছে অন্ধকার নদীর দিকে।

কয়েকটা মাত্র মুহূর্ত, অথচ মনে হচ্ছিল যেন কতযুগ পার হয়ে গেল সেইভাবে বসে থেকে। হঠাৎ জলের ভেতর থেকে একটা চাপা আওয়াজ ভেসে এল, ‘দড়ি লামা মোয়াজজেম! এইবারে পাইছি—’

মোয়াজজেম নামের ছেলেটা নৌকোর পাটাতন থেকে সেই হুক লাগানো দড়িটার একপ্রান্ত গলুইয়ের সঙ্গে পাক দিয়ে আটকে ফেলে অন্য প্রান্তটা ছুঁড়ে দিল জলের দিকে। সড়সড় করে খানিকদূর এগিয়ে গিয়েই টানটান হয়ে গেল দড়িটা, আর তারপর জল থেকে দুহাত বাড়িয়ে নৌকোর কানা চেপে ধরে তাতে ভর দিয়ে ওপরে উঠে এল মাঝি। আবছা আলোয় দেখলাম, দড়ির অন্য মাথার হুকে আটকানো একটা মানুষের আধগলা শরীর ভেসে চলেছে নৌকোর পাশাপাশি। ভয়ে ভয়ে দুপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কোনোদিকেই পাড়ের চিহ্ন নেই কোনো। নিয়ন্ত্রণহীন নৌকো ফের একেবারে মাঝনদীতে ফিরে এসেছে।

লোকদুটো মানুষ না পিশাচ! মাঝনদীতে ভেসে যাওয়া মরা নিয়ে করবেই বা কী? একেবারে নীরব ওই দুটি রহস্যময় মানুষকে এসব প্রশ্ন করবার সাহসটুকুও তখন আমরা খুইয়া বসেছি। এমন কি ধনদার মতো ডাকাবুকো মানুষও দেখি একেবারে নীরব হয়ে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রয়েছে পাটাতনের ওপর।

ঠিক তক্ষুণি মেঘ কেটে গিয়ে চতুর্দশীয় চাঁদটা বের হয়ে এল আকাশে। নির্জন নদীর আদিগন্ত জল ঝলমল করে উঠল বৃষ্টিধোয়া চাঁদের মায়াবী আলোয়। আর, সেই আলোয় তাকিয়ে দেখলাম, হালে বসে আছে যে মাঝি, আমাদের পাশে পাশে জলে ভেসে চলেছে তারই গলিত মৃতদেহ। কপালের ওপরে আড়াআড়ি একটা রক্তমাখা ফাটল দগ দগ করছে দুটো প্রাণলেশহীন মুখেই।

অতিরিক্ত ভয় পেলে কোনো কোনো মানুষ একেবারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ধনদাও দেখলাম সেই দলের লোক। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে সেএগিয়ে গেল মাঝির দিকে। মুখে গালাগালের খই ফুটছে যেন। তারপর তার একেবারে মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘কেডা তুই? বেঙ্গাপাড়ার ধনপতি দত্ত যমেরেও ডরায় না, আর তুই ত কুন ছাড়—’

মানুষটা একচুলও নড়ল না নিজের জায়গা থেকে। শুধু তার একটা হাত উঠে এসে চেপে ধরল ধনদার মুখটা। অতবড়ো মানুষটা কেমন অসহায়ের মতো ছটফট করছিল তার মুঠোর মধ্যে। খানিকক্ষণ সেইভাবে তাকে ধরে রেখে তারপর হাতটা সরিয়ে নিতে ধনদা ধপ করে এলিয়ে পড়ল আমার পায়ের কাছে। তাড়াতাড়ি তার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখি, বেঁচে আছে। নি:শ্বাস চলছে। কিন্তু জ্ঞান নেই। পাড়ের দিকে নৌকোর মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লান্ত, বিষণ্ণ গলায় মাঝি তখন বলছিল, ‘ভাড়া লাগবো না বাবু। কেবল আমার দেহডার একটা গতি কইরা দিয়েন, ওই আমার পাড়ানির কড়ি—’

তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারাতে হারাতে শুধু কানে এসেছিল মোয়াজজেমের অস্ফুট কান্নার আওয়াজ—‘আব্বাজান, আমারে কবে পাব—’

পরদিন সকালে আমাদের দুজনের অজ্ঞান শরীর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ফকিরাগ্রাম লঞ্চঘাটের মাইলটাক উত্তরে। নৌকোটার কোনো চিহ্ন ছিল না কোথাও। পরে লোকের মুখে জেনেছিলাম আমাদের সঙ্গেই আরও একটা মৃতদেহও ভেসে এসেছিল নাকি নদীর পাড়ে। মার্ডার কেস। কপালে তলোয়ারের কোপ ছিল। পুলিশ তার পোস্টমর্টেম করে নিয়মমাফিক শেষকৃত্য করেছে।

সেরেসুরে উঠে ফকিরাগ্রাম থেকেই গাড়ি ধরে সোজা কলকাতা। ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে গোঁসাইগাঁও যাওয়া দূরস্থান, আর কোনোদিন ব্রহ্মপুত্রের ধারেকাছেও যাবার নাম করছি না আমি।

শুধু, আজ এতদিন পরেও মাঝে মাঝে মোয়াজজেম নামে সেই ছেলেটার হাহাকার ভরা গলা ফিরে আসে স্মৃতিতে। অকালে প্রাণ হারানো এক কিশোর। আজও হয়তো সেতার দেহটাকে খুঁজে চলেছে এক অন্ধকার মহানদ-এর বুকে। কিংবা হয়তো—কে জানে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *