গন্ধর্বলোক
ঈশানীর চিঠি ঈশান কোণের মেঘের মতোই আমার ছুটির দফারফা করে ছাড়ল। নামডাক ।এমনিতে হয়নি। বোম্বাইয়ের রূপোলি পর্দার তারকা-রানি আমি। কাজেই আবেগ বস্তুটার মাত্রা আমার মধ্যে একটু বেশিই। স্নায়ুর ওপরেই আমাকে বাঁচতে হয়। জানি, সব চিত্রতারকাদের মতোই চল্লিশ ছুঁয়ে আমাকেও গ্যাসট্রিক আলসারে ভুগতে হবে–স্নায়ুর ওপর অত্যাধিক চাপ দেওয়ার শাস্তি পেতে হবে। শিলাদকুমারও এই নিয়ে ঠাট্টা করে আমাকে।
বছরে পাঁচ-ছটা বড় বড় ছবিতে আমাকে নায়িকা হতেই হয়। দ্বিতীয় ছবির শুটিং শেষ হবার পর শিলাদকুমার ফিরল কাম্বোডিয়া থেকে। দুজনেই বেশ কাহিল। কেননা, সাতমাস একটানা কাম্বোডিয়ার ছবির কাজ করেছে শিলাদ। তাই প্রস্তাব করেছিল, আর একবার হানিমুনে বেরোনো যাক।
শিলাদের কথা শুনে হাসি পেয়েছিল বইকি। আর একবার হানিমুন, কথাটার কোনও মানে নেই আমার কাছে। কোনও হানিমুনই হয়নি আমাদের। বিয়ে হলে তো হবে। বিয়ে করার সময় পেলাম কখন? ফিল্মদুনিয়ার গন্ধর্বলোকে বিয়ে করার সময় কটা ভাগ্যবানের হয়?
সে যাই হোক, মধুচন্দ্রিমা যাপনের প্রস্তাব লুফে নিয়েছিলাম।
বাইরে বেরোনো নিরাপদ নয়। ভক্তদের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। তাই যেমন-তেমন ঘরে শুয়ে রইলাম। বাইরে বাজতে লাগল টেলিফোন। নীচে খটাখট শব্দে ব্যস্ত রইল অফিস টাইপরাইটার। ফ্যান-ক্লাব কর্মীরা ফুরসত পেল না চিঠির বস্তা থেকে মুখ তোলবার। ডিটেকটিভরাও রোজকারমতে টহল দিয়ে ফিরতে লাগল বাড়ি আর বাগানের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চিতে।
আমি আর শিলাদ এয়ারকন্ডিশনড ঘরে শুয়ে বিভোর হয়ে রইলাম পরস্পরকে নিয়ে। এক-এক রাতে এক-এক ফুলশয্যার রোমান্সে মশগুল হয়ে রইলাম দুজনে দুজনকে নিয়ে। ব্রেকফাস্ট আসত সূর্য যখন মধ্যগগনে। আমি ক্রিম খেতে ভালোবাসি বলে শিলাদকুমার কত ঠাট্টাই না করত। বলত, দুদিনেই অ্যায়সা মোটা হবে যে ছবির কাজ আর জুটবে না। আমি শুনতাম না। ক্রিম আমার ভীষণ ভালো লাগে। এতদিনেও যখন মুটিয়ে যাইনি–তখন আর যাবোও না।
সেদিনও ব্রেকফাস্ট এলে ক্রিম খাচ্ছি। খেতে খেতে আমার চিঠির তাড়া থেকে একটা খাম বেছে নিলাম। খুলতেই দেখলাম ঈশানীর চিঠি।
শ্রীযুক্তা মদালসা দেবী
মান্যবরেষু,
আমি আর পারছি না। আপনার হয়ে জাল অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। রেহাই পাবার জন্য চুল হেঁটে ফেলাম। তবুও মুক্তি নেই। আপনার ভক্তের দল এখনও রাস্তায় দেখলেই আমার পেছনে ছোটে। মনে করে আমিই মদালসা। বলে, কেন চুল ছাঁটলাম। অমন লম্বা চুল হেঁটে কেন ববছাঁট করলাম। মদালসা দেবী, আমি সত্যিই আর পারছি না। সারাটা জীবন নকল মদালসা দেবী হয়ে কাটাবার বিড়ম্বনা আর সইতে পারছি না।
বিনীতা
ঈশানী দত্ত
চিঠি পড়েই মাথা গরম হয়ে গেল। চিঠির বক্তব্যর জন্য নয়। এ চিঠি আমার কাছে এল কী করে? সেক্রেটারিদের পইপই করে বলে দিয়েছি, ভক্তবিটেলদের কোনওরকম স্তুতিপত্র যেন আমার সামনে না পৌঁছোয়। ফ্যান-ক্লাব খুলেছি কি এমনি-এমনি? খোশামুদে চিঠি প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। ভাবতেও অবাক লাগে, এসব চিঠির জবাবও দিতাম। কিন্তু হাউইয়ের মতো খ্যাতির আকাশে উঠে পড়ার পর স্তুতিপত্র দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়।
একেই বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা। খ্যাতি যখন থাকে না, তখন খ্যাতির পেছনে দৌড়াই। খ্যাতি যখন আসে, তখন খ্যাতিকে এড়িয়ে চলি। শিলাদকুমার অবশ্য এর ব্যতিক্রম। গোড়া থেকেই এ কারো ধার ধারেনি। গন্ধর্বলোকে হিরো রূপেই ওর প্রবেশ; প্রস্থানও ঘটবে হিরোর মতো।
তাই সেক্রেটারিদের ওপর ঢালাও হুকুম আছে, সব চিঠিই খুলে দেখবে। ব্যক্তিগত চিঠি আসবে, আমার সামনে-বাদবাকি সব যাবে ফ্যান-ক্লাবে। বাঁধা ছকের টাইপকরা চিঠিতে জবাব যাবে। এমনকী আমার সইকরা যে ফটোগ্রাফ পাঠানো হবে, তার সইটিও নিজে করব না–ওরাই আমার হয়ে করে দেবে।
মোট কথা, কোনও ধরনের ফ্যান-লেটার যেন আমার ত্রিসীমায় আসে। এই হল আমার অর্ডার। তা সত্ত্বেও ঈশানীর চিঠি আমার কাছে পৌঁছোয় কী করে?
বিরক্তি নিশ্চয় কণ্ঠেও প্রকাশ পেয়েছিল। কেননা, কাগজ পড়তে পড়তে মুখ তুলল শিলাদ–হল কী?
ফ্যান লেটার। হাজারবার বলেছি এসব চিঠি যেন আমার কাছে না পৌঁছোয়।
বলে, চিঠিটা ছুঁড়ে দিলাম ওর বিছানায়। এক হাতে তুলে নিল শিলাদ। ভারী সুন্দর হাতটা সিল্কের চাদরের পটভূমিকায় নতুন করে দেখলাম। হাত দেখে মানুষের চরিত্র ধরা যায়। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। তা না হলে যার চেহারা অমন অসুরের মতো, তার মন অমন মিষ্টি, অমন নরম, অমন শিল্পীসুলভ হবে কেন? ওর হাতে সে চিহ্ন আছে।
চিঠিটা পড়ল শিলাদ। পড়ে হেসে ফেলল–ঈশানী দত্ত! বেশ নাম। চিঠিটাও। ভক্তের চিঠি তো এরকম হয় না। ইন্টারেস্টিং! বলে, অপাঙ্গে তাকাল। চিঠিটার মধ্যে রহস্য আছে।
রহস্য! রহস্য আবার কি? এ চিঠি এখানে পৌঁছোল কী করে, এ ছাড়া আর কোনও রহস্য তো দেখছি না।
হাতের লেখাটা যে তোমার হাতের লেখার মতো। রহস্য সেইটাই।
কথাটা সত্যি। ঈশানী দত্তর হাতের লেখা অবিকল আমার হাতের লেখার মতোই।
সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই মতলবটা মাথায় এল আমার। খাট থেকে নামতে নামতে বললাম–চললাম।
কোথায়?
ঈশানীকে দেখতে।
কিন্তু এ যে হানিমুনের সময়! এই দ্যাখো কাগজেও তাই লিখেছে। এখন কি বাইরে বেরোয়?
নকল মদালসারও তো হানিমুনের ইচ্ছা যায়। বলে মুচকি হাসলাম আমি। বিধাতারও তখন হেসেছিলেন–অলক্ষ্যে।
বেশ তো, খাবার নেমতন্ন করো, বর্তে যাবে, শিলাদ বলেছিল।
উঁহু। থার্ডক্লাস যে-কোনও একটা হোটেলে শুধু দুজনে দেখা করব, কথা বলব। এই হল আমার আজকের অ্যাডভেঞ্চার।
সেই ব্যবস্থাই হল। প্যারাডাইজ হোটেল। বিকেল চারটে। ঘর বুক করার পর ঈশানী দত্তর প্যারেলের ঠিকানায় খবর পাঠালাম–আমি আসছি।
.
স্নান সেরে নখরঞ্জন করে চুল আঁচড়ে যখন আমার হেয়ার-ড্রেসারের চেম্বার থেকে বেরোলাম, তখন আমাকে নায়িকা-শ্রেষ্ঠা মদালসা বলে চেনা মুশকিল। প্রসাধন এবং কেশবিন্যাস আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই।
প্যারাডাইজ হোটেলের সিঁড়ির ধাপে পা দিয়ে হঠাৎ মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। নকল মদালসাকে দেখে লাভ কী? খামোকা এনার্জি নষ্ট..ধাপ থেকে পা নামিয়ে ফিরতে যাচ্ছি, মনে পড়ল শিলাদকুমারের মুখ…ঠাট্টা…টিটকিরি…ভক্তের ভয়ে পলায়ন? নাঃ, ফেরা হল না। সোজা গেলাম অফিসরুমে। নাকের ডগায় চশমা এঁটে বুড়ো ম্যানেজার এমন ভাবে তাকাল আমার পানে যেন আমি মেয়েটা তেমন সুবিধের নয়। দুই চোখে বেশ সন্দেহ…বারান্দা দিয়ে এগোতে এগোতে বিড়বিড় করে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদানও করা হল। এ হোটেল নামী হোটেল, কুঅভিসন্ধি নিয়ে এখানে কেউ আসে না। হোটেলের দুর্নাম মালিক একদম সইতে পারে না। বলতে-বলতে বুক করা কামরার সামনে পৌঁছোলাম। দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলে ঢুকলাম। প্রায়ান্ধকার। একটা টেবিল। দূরপ্রান্তে গোটাতিনেক চেয়ার। কে যেন সেখানে বসে রয়েছে।
পেছন ফিরে দেখলাম বুড়ো নেই। বললাম–অন্ধকারে কি মুখ দেখা যায়? বলেই খট করে সুইচ টিপলাম। আলোয় ভরে উঠল ছোট্ট ঘরটা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নকল মদালসার দিকে। চেয়ারে বসা মেয়েটি যেন আর একটা আমি।
তফাত শুধু পোশাক। আমি যা পরেছি, তা দামি না হলেও পরিচ্ছন্ন। কিন্তু নকল আমি যা পরেছে, তা রীতিমতো নোংরা। যেমন ব্লাউজের ছিরি, তেমনি শাড়ির অবস্থা। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুল। তা সত্ত্বেও আমার সঙ্গে তার মুখের আদলের হেরফের ঘটেনি। থুতনি সুডৌল। টানা টানা
চোখ। কামনার দুটি ডিপো। আমার ভক্তরা যে যে দেহশ্রীর জন্য আমাকে নিয়ে পাগল, সবই দেখলাম রয়েছে নকল আমির মধ্যে।
ঈশানী নির্ভয়ে তাকিয়েছিল। নিঃশঙ্ক চোখ। বলল–বসুন। কণ্ঠস্বর আমার মতোই। ঈষৎ ঘষা, ঈষৎ ধরা, ঈষৎ তীক্ষ্ণ। শুনেছি, পুরুষের রক্তস্রোত নাকি উদ্দাম হয় আমার এই কণ্ঠস্বরে। নকল আমি বহু চেষ্টায় এ স্বরও নকল করেছে।
আমি অভিনেত্রী। বিস্ময় চোখমুখ থেকে সরিয়ে রাখলাম। ঈশানী কিন্তু দেখলাম, মোটেই ঘাবড়ায়নি। মদালসার সামনে এসে বহু বাঘা রিপোর্টারও কেঁপে ওঠে। কিন্তু ঈশানী দত্ত বিন্দুমাত্র নার্ভাস হয়নি।
নৈঃশব্দ্য আমি ভাঙলাম। গৌরচন্দ্রিকার ধার দিয়েও গেলাম না। বললাম।–কি মনে করে?
কিছুই মনে করে নয়। বলল ঈশানী আমারই গলায়। আগে বসুন। অতদূরে নয়–আমার পাশে। ঈশানী যেন হুকুম করছে। যেহেতু তাকে আর আমাকে দেখতে যমজ বোনের মতো, অতএব আমার ওপর তার যেন একটা অধিকার জন্মে গিয়েছে। কত লম্বা আপনি?
প্রশ্নটা আকস্মিক। সুরটাও যেন কেমন-কেমন। কিন্তু গায়ে মাখলাম না। বললাম–সাড়ে পাঁচ।
আমারও তাই। ম্যাগাজিনেও তাই দেখেছিলাম। বাজিয়ে নিলাম।
কেন? বাজিয়ে নেবার দরকার কি? কিছু একটা বলা দরকার, তাই বললাম।
কোলের ওপর রাখা কালো হ্যান্ডব্যাগটা খুলল ঈশানী। একটা কালো রঙের সাইলেন্সার ফিট করা রিভলভার বার করে বলল–একটু পরেই আপনাকে খুন করব, তাই জেনে নিলাম। মরবার আগে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
নিস্তব্ধ ঘরে ঈশানীর কথা ফুরোলো। আবেগ নেই, উত্তাপ নেই, ঘৃণা নেই, দ্বেষ নেই। শুধু একটা ঘোষণা–আমাকে মরতে হবে। শুটিংয়ের সময়ে এরকম সংলাপ শুনলে মনে হত নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঈশানীর কণ্ঠে নাটক নেই।
বিক্ষিপ্ত মনটাকে জড়ো করবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। শুধু মনে হল, অফিস ঘরের বুড়ো ম্যানেজার একটু আগেই হোটেলের সুনাম নিয়ে লম্বা-চওড়া বচন ঝেড়েছে; মনে পড়ল রাস্তার মোড়ে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার, এয়ারকন্ডিশনড ঘরে আমার প্রতীক্ষায় বসে আছে শিলাদকুমার। ইচ্ছে হল খামচে নিই রিভলভারটা। ফিল্ম হলে তাই করতাম। কিন্তু এটা বাস্তব। সব শেষ হতে চলেছে।
ধরা গলায় বললাম–কী করেছি আমি? কেন খুন করবে?
জবাব দিল না ঈশানী। রিভলভারটা দোলাতে দোলাতে শুধু চেয়ে রইল।
রাগ হয়ে গেল–ফঁদটা ভালোই।
ফাঁদ আপনার। আপনিই আমাকে ডেকেছেন।
কথাটা সত্যি। অ্যাডভেঞ্চারের লোভে নিজের ফঁদ নিজেই পেতেছি। চোখ ফেটে জল এল। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। শুধু বললাম ছেলেমানুষের মতো–কিন্তু কী অপরাধ করেছি আমি?
এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল ঈশানী। বল্লমের মতোই জবাবটা ছুঁড়ে দিল আমাকে লক্ষ্য করে–অপরাধ! শেষ নেই অপরাধের। প্রথম অপরাধ, হুবহু আমার চেহারা নিয়ে কেন এসেছিলেন পৃথিবীতে? দ্বিতীয় অপরাধ, এসেই ছিলেন যদি ফিল্মস্টার হতে গেলেন কেন? কেন আমার জীবন বিষিয়ে তুলেছেন? নিশ্চিন্ত মনে আমি কোথাও বেরোতে পারি না। বেরোলেই মদালসা মনে করে আমায় তাড়া করে, ছিঁড়ে খায়। কেন? কী অপরাধে? বছরের পর বছর কেন এই নির্যাতন? আপনার হয়ে মিথ্যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যায়, জানোয়ার লোকগুলোর জ্বালায় অলিগলি দিয়ে মুখ ঢেকে পালিয়ে বেড়াই। কেন? কী অপরাধে? আজ সুযোগ এসেছে শোধ তুলবার, এই অত্যাচার বন্ধ করবার। শুধু তাই নয়, এবার আমার পালা। বহু বছর মদালসার ছায়া হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি, এবার হবো আসল মদালসা। হাঃ হাঃ, হাঃ।
পাগল? না। স্থির সংকল্পে বজ্রকঠিন মুখ। দীর্ঘ ক্লেশের শেষ হতে চলেছে। তাই আনন্দ জ্বলজ্বলে আনন। দুই চোখে কেবল ঘৃণা, অপরিসীম ঘৃণা।
ফিসফিস করে শুধু বললাম–আসল মদালসা হবে? আমাকে মেরে? পারবে না।
পারব না? কেন?
দেখতে আমার মতো হলেও সত্যি সত্যিই তো তুমি নও। আমার চালচলনই আলাদা। সে জিনিস রপ্ত করা মুখের কথা নয়। যেমন ধরো, এ হোটেল থেকে কতদুরে ঠিক কোনখানে গাড়ি পার্ক করেছি, তা তোমার জানা নেই।
বারান্দা থেকে তাও দেখেছি। মোড়ের কাছে বাস-স্টপেজের সামনেই গাড়ি পার্ক করেছেন।
ড্রাইভারের নাম? কী বলে ডাকবে?
কমলবাহাদুর। ডাকব শুধু কমল বলে।
যাবে কোথায়? কমলবাহাদুরকে বলবে কী?
ব্লু-টেম্পল, অবিকল আমার গলায় বলল ঈশানী।
কমল ধরে ফেলবে। এখান থেকে বেরিয়েই যে গাড়ি বাড়ি ফিরছি না, কমল তা জানে। আজ বিকেলে অনেক প্রোগ্রাম নিয়ে তবে রাস্তায় বেরিয়েছি।
বলব, কমল, আর পারি না। প্রোগ্রাম বাতিল। চলো ব্লু-টেম্পল। ছুটির সময়ে যতটা পারি জিরিয়ে নিই।
শুনতে-শুনতে বেশ বুঝলাম কমলবাহাদুরের ক্ষমতা নেই একথা শোনার পর নকল মনিবানিকে চেনে। গলার খোঁচগুলো পর্যন্ত নকল করেছে ঈশানী। বলবার কায়দায় কোনও ফারাক নেই। শুধু পোশাক পাল্টে নিলেই হল। আমার পোশাক ও পরবে–নিজের পোশক আমাকে পরাবে। কমলবাহাদুর কেন, স্বয়ং শিলাদকুমারও চিনতে পারে কিনা সন্দেহ।
উপায় নেই। কোনও উপায় নেই। আমার জীবনে গোপনতা নেই। আমি যে গন্ধর্বলোকের অপ্সরী। আমার চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, কথাবার্তা, হাবভাব–সবকিছুই পাবলিক প্রপার্টি। ভক্ত জনগণ মুখস্থ করে রেখেছে আমার অষ্টপ্রহরের পাঁচালী। ঈশানী আমাকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ পড়েছে, আমার অভিনয় করা ফিল্ম দেখেছে, আমার সঙ্গে ফিল্ম সমালোচকের সাক্ষাৎকার মুখস্থ করেছে; ফলে আমার সব কিছুই তার নখদর্পণে। যে-কোনও মুহূর্তে আমার জায়গায় সে দাঁড়ানোর সব পর্বই তার কণ্ঠস্থ। কী ভয়ানক!
অভিশপ্ত গন্ধর্বলোকের পরী আমি। এই তো আমার জীবন। আমার কথা বলার রেকর্ডে আমার ভক্তবৃন্দ বারংবার শুনেছে। ঈশানীও শুনেছে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে নয়–আমার সর্বনাশ কামনায়। রেকর্ডের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে রপ্ত করেছে মদালসার সেই বিখ্যাত কথা বলার ভঙ্গি।
ঠান্ডা গলায় বললাম–বিয়ে করেছ নিশ্চয়। স্বামী তো তোমায় ছাড়বে না।
স্বামী আমায় নেয় না।
আশ্চর্য মিল! আমার স্বামীও আমাকে নেয়নি।
ছেলেপুলে?
অবাক চাহনি মেলে তাকায় ঈশানী–সে কী! ভুলে গেলেন? আমাদের তো ছেলেপুলে নেই?
চমকে উঠেছিলাম কথা বলার ধরনে। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাদের বলতে ঈশানী আর স্বামীর কথা বলা হচ্ছে। পরক্ষণেই বুঝলাম, তা নয় ঈশানী আর আমি আমাদের বলতে এই দুজনে। বছরের পর বছর এইভাবেই ভেবে এসেছে ঈশানী। মজ্জায় তার এই চিন্তাই পাকা আসন পেতে বসেছে। মদালসা মানেই ঈশানী–ঈশানী মানেই মদালসা। লোকে তার পিছু নিয়েছে মদালসা ভেবে-চিন্তাটা আরও কায়েমী হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে মদালসার অভিনয় করতে করতে ঈশানী নিজেও কখন মদালসা হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তো আমি সন্তানহীনা। এখন প্রয়োজন কেবল পট পরিবর্তনের। আসল মদালসা নিহত হবে নকল মদালসার বেশে। আর, নকল মদালসা গিয়ে বসবে আসল মদালসার সিংহাসনে।
সফল হবে এক উন্মাদ ছন্নছাড়ার অপ্রকৃতিস্থ স্বপ্ন। তিল তিল করে খ্যাতির যে সৌধ আমি গড়ে তুলেছি, বহু বছরের সাধনায় যে বৈভব, যশ, প্রতিপত্তি অর্জন করেছি, কালো রিভলভারের একটিমাত্র গুলিতে তা চলে যাবে নোংরা পোশাকের ওই মেয়েমানুষটার দখলে। আর, খ্যাতিহীন হোটেলের প্রায়ন্ধকার ঘরে যথাসময় আবিষ্কৃত হবে নামগোত্রহীন একটি লাশ!
ঈশানী চেয়েছিল আমার পানে। চোখ তুলতেই বলল–একটা কথা জানার ছিল। শিলাদকুমার লোকটা কীরকম?
কনকনে বরফ-খণ্ডের মতো কথাটা কানের পর্দায় গিয়ে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার স্রোত বইল অন্যদিকে। জানি শিলাদ কি বলবে। আমাকে নিকেশ করে ঈশানী আমার বেশে ব্লু-টেম্পলে ফিরলেই শিলাদ শুধোবে–কিগো পরী, ঈশানীকে দেখলে?
ঈশানী নতুন ঢং শুরু করবে। বলবে, চুলটা হঠাৎ ছাঁটতে হল। শুনে শিলাদ সাদাসাদা ঝকঝকে দাঁত বার করে অট্টহাসি হাসবে। কাছে টেনে নেবে ঈশানীকে।
লুঠ হয়ে যাবে শিলাদকুমার! আমার জীবনের সবচাইতে দামি, সবচাইতে আদরের, সবচাইতে গোপনীয় মণিকোঠায় ধুলো পায়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করবে শয়তানী ঈশানী। হীরে জহরতকেও ছড়িয়ে রাখি, কিন্তু সন্তর্পণে সরিয়ে রাখি যে মানুষটিকে–সেই শিলাদকুমারকে কেড়ে নিয়ে যাবে ঈশানী–কিন্তু কেউ কোনওদিন জানতেও পারবে না! শিলাদের নিঃশ্বাসে উত্তপ্ত হবে ঈশানী, শিলাদের আদরে বিহ্বল হবে শয়তানি!
ভাবতে ভাবতেই লক্ষ লক্ষ অগ্নিশিখা যেন উদ্দাম নৃত্যে আগুন ধরিয়ে দিল শিরায় শিরায়, মগজের প্রতি স্নায়ুকোষে। যা হবার নয়, তাই হতে চলেছে–অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে। সেই মুহূর্তে দুর্বিসহ এই সম্ভাবনা নিঃশেষে মুছে নিয়ে গেল আমার সমস্ত ভয়, আতঙ্ক, আশঙ্কা। ইচ্ছে হল…প্রচণ্ড ইচ্ছে হল চুলোয় যাক রিভলভারের তপ্ত বুলেট…ইচ্ছে হল লাফিয়ে গিয়ে ঝাঁপিড়ে পড়ি কুচক্রী ঈশানীর ওপর…আঁচড়ে কামড়ে চড়িয়ে পিটিয়ে কেড়ে নিই নিকষ হাতিয়ার…খামচে খুবলে ছিঁড়ে মেরে বিচুর্ণ করি ওর আকাশ-কুসুম আশার…কিন্তু না.মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে..শয়তানী বুদ্ধি দিয়েই কজায় আনতে হবে।
অকস্মাৎ পরিকল্পনাটার আবির্ভাব ঘটেছিল মগজে। মস্তিষ্কের সেই মুহূর্তের উর্বরতায় পরে বিস্মিত হয়েছিলাম। মিথ্যে…একটা ডাহা মিথ্যেকে বলতে হবে সত্যির মতো করে…পারব না? নিশ্চয় পারব..আমি যে অভিনেত্রী…মিথ্যের বেসাতিতে বড় কারবারী!
ঈশানী, আবেগের পুঞ্জ মেঘ গলার মধ্যে সঞ্চয় করে বললাম–ঈশানী, শিলাদকুমারের সব কথাই তোমাকে বলতে পারি। যা জানি–সব। তারপর তুমি আমাকে খুনও করতে পারো। কিন্তু আমার ভাগ্যে যা লেখা, তা রোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। ঈশানী, তোমারও নেই।
বলে থামলাম। সেকেন্ড কয়েক শব্দহীন সাসপেন্স সৃষ্টি করলাম। তারপর একই সুরে কথার খেই টেনে বললাম–ঈশানী, আমার পরিণতি রোধ করবার ক্ষমতা তোমারও নেই। নিয়তির লিখন, ঈশানী, নিয়তির লিখন। একথা কেউ জানে না, কাউকে বলিনি। কাগজে কোথাও বেরোয়নি। জানো আমার শেষ কোথায়? কী অবস্থায়?
উৎকণ্ঠা। নৈঃশব্দ্য। ঈশানীর নির্নিমেষ চাহনি।
আর মাত্র ছমাস। ছমাস পরেই আমাকে যেতে হবে অ্যাসাইলামে..রাঁচির পাগলাগারদে… দুরারোগ্য ব্যাধিতে দিনে দিনে পাকিয়ে যাচ্ছি আমি…এত খাই কিন্তু গায়ে মাংস লাগে না (ব্রেকফাস্টে ক্রিম খাওয়া নিয়ে শিলাদকুমারের রঙ্গ পরিহাস আমার মিথ্যেকে অনেকটা সত্যির বনেদ জোগাল)… আর মাত্র ছমাস, ছমাস বাইরে থাকার অনুমতি দিয়েছে ডাক্তার…এই ছমাস শেষ বিশ্রাম নিচ্ছি। ব্লু-টেম্পলে..কাগজে কে না সে খবর পড়েছে…কিন্তু এ বিশ্রাম যে শেষ বিশ্রাম তা কেউ জানে না…জানে না শিলাদকুমার আমাকে শেষ সঙ্গসুখ দিচ্ছে বহু অর্থের বিনিময়ে…
এইখান থেকেই আমার অভিনয় প্রাণবন্ত হল। শিলাদকুমার যে দেহ মনে একটা অসুর ছাড়া কিছু নয়–এ সত্য বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম। শিলাদকুমার যে বহু অভিনেত্রীর শয্যায় অংশ নিয়েছে, এ ঈর্ষা আমার অন্তর সেই মুহূর্তে বিষিয়ে তুলল। শিলাদকুমারের সাত মাস কাম্বোডিয়া প্রবাস যে অনেক গোপন রঙ্গের মুখরোচক ইতিহাস, এ কল্পনা চোখের জল আরও বৃদ্ধি করল। ফলে, অশ্রু যেন বন্যার মতো উপচে পড়ল দু-গাল বেয়ে। রমণীমোহন শিলাদকুমার তুমি আমার যৌবন-সুধার শেষ বিন্দুটিও লুঠে নিতে এসেছ…তারপর যাবে নতুন ফুলে, নতুন মধুর লোভে। এ ফুল যাবে ঝরে…ছমাস পরে রাঁচির পাগলাগারদে শুরু হবে অনিশ্চিত জীবন। ডাক্তাররা? চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু শেষ ঘনিয়ে এসেছে…কেউ জানে না…জানি শুধু আমি আর শিলাদকুমার…
শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার আমার ভাগ্যে একাধিকবার জুটেছে। কিন্তু সেদিনের অভিনয় বুঝি সব রেকর্ডকেও ম্লান করে দিয়েছিল। তিল তিল করে আমার দীপ নিভে যাওয়ার কাহিনির শেষে আমি অঝোর ধারে কাঁদতে লাগলাম।
ঘর নিস্তব্দ। আমার উচ্ছ্বাস এবার নীরব অশ্রুধারায় পর্যবসিত। দুহাতে মুখ ঢেকে বেশ কিছুক্ষণ ডুকরে কাঁদলাম। মনের চোখ দিয়ে দেখলাম, কালো রিভলভারের মিশমিশে নলটা আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে তাগ করেছে…অন্তিম নির্ঘোষের প্রত্যাশায় কাঠ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
কিন্তু কোনও শব্দ নেই। নিস্তব্ধ ঘরে কেবল আমার ফোঁপানি যেন শ্মশানপুরীর হাহাকার সৃষ্টি করে চলেছে। দু-হাত নামিয়ে মাথা তুললাম। অবাক হয়ে গেলাম ঈশানীকে দেখে।
ঈশানী কাঁদছে। চেয়ারের পেছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে কাঁদছে। রিভলভারের নলচে নির্মমভাবে চেপে ধরেছে চিবুকের নীচে।
আপনিও…আপনিও… ফুঁপিয়ে উঠল ও।
ঈশানী! আমার আর্ত চিৎকারে আমি নিজেই চমকে উঠেছিলাম। ঈশানী! না..না…! বলতে-বলতে ছিটকে গিয়েছিলাম চেয়ার ছেড়ে। এক, ঝটকায় ওর শিথিল মুঠি থেকে কেড়ে নিয়েছিলাম রিভলভার। ঈশানী হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আমার ওপর। দু-হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না!
সেকেন্ডকয়েক গেল ওকে সামলাতে। অবশ্য রিভলভার হাতছাড়া করলাম না। সিধে হয়ে বসল ঈশানী। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে যা বলল, তা সত্যিই মর্মন্তুদ।
দৈব সহায় না হলে এরকম কাকতালীয় বড় একটা ঘটে না। কী করে যে এ কাণ্ড, ঘটল, তা এখনও ভাবলে আমার অবাক লাগে। আমার অজান্তেই ওর এমন একটা টন্টনে জায়গা ছুঁয়ে ফেলেছিলাম যে নিমেষে ভেঙে পড়েছিল ঈশানী। হয়তো ঈশানীর করাল ব্যক্তিত্বের প্রভাব সাময়িকভাবেও আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। অলৌকিক ঘটনাও ঘটে। নইলে ওর মনের গোপন ক্ষতে এভাবে আমার হাত গিয়ে পড়বে কেন?
অদ্ভুত কাকতালীয়। ঈশানী নিজেই এই একই ব্যাধিতে ভুগছে। যেদিন ও আমাকে চিঠি লিখে, তার আগের দিন ডাক্তার ওকে যে প্রেসক্রিপশন লিখেছে, তারও অর্থ ছমাস পরে পাগলাগারদে গিয়ে মগজ পরীক্ষা করা। এই ছমাস খোলা বাতাসে ঘুরেও যদি ঈশানীর দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম না ঘটে, তাহলে পথ ওই একটাই!
ঈশানী তাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বছরের পর বছর নকল মদালসা থেকে একলাফে আসল মদালসা হবার প্ল্যানটা তখনি মগজে এসেছিল। এছাড়া বাঁচবার আর পথ নেই। প্রেসক্রিপশনের লিখনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর জন্যেই ও আমাকে মেরে আমার জীবনে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! আমিও সেই ব্যাধিতে আক্রান্ত? আমারও সেই শোচনীয় পরিণতি?
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে উঠেছিল ঈশানীর। আমি আমার রুমাল দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিলাম। ও উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল–জানি না আর দেখা হবে কিনা। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। অভাবের যন্ত্রণা আর সইতে পারছিলাম না। কিন্তু নিয়তির চাইতে বড় আর কিছু নেই।
সেই মুহূর্তে আমার মনটা কীরকম হয়ে গেল। যে মেয়েমানুষটা কিছুক্ষণ আগেই কসাইয়ের মতো আমার হৃদ্যন্ত্র স্তব্ধ করার পণ করেছিল, সহসা তার অসহায় চাহনি নিঃসীম অনুকম্পায় ভরিয়ে তুলল আমার অন্তর। আমি আর একটি কথাও বললাম না। হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফাউন্টেন পেন আর চেকবই বার করে দশ হাজার টাকার একটা বেয়ারার চেক লিখে দিলাম ঈশানীকে।
ও চেক নিয়ে আমার আগেই বিদায় নিল। সজল চোখে শেষবার আমার পানে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। নোংরা শাড়ি ব্লাউজের আড়ালে ছমাসের পরমায়ু নিয়ে প্রেতচ্ছায়ার মতো অদৃশ্য হল নকল মদালসা–আমার তারকা জীবনের দুষ্টগ্রহ!
.
শিলাদকুমার সব শুনে অট্টহাসিতে ঘর কাঁপয়ে তুলল।
–এরকম সুপারফাইন ব্ল্যাকমেলিং এর আগে কখনো ঘটেছে বলে শুনিনি। ওগো কন্যে, তোমার কপাল ভালো, ঈশানী এখনো ফিল্মে নামেনি। নামলে কী কাণ্ড ঘটত বলো তো? তুমি আর এ তুমি হতে না।
কথাটা একদম উড়িয়ে দিতে পারি না। কেননা ঈশানীর রিভলভারটা ব্লু-টেম্পলে এনেছিলাম। খুলেওছিলাম। কার্তুজের খুপরিতে একটা কার্তুজও পাইনি।
* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত।