গন্ধটা খুব সন্দেহজনক
সেবার আমার দিদিমা পড়লেন ভারী বিপদে!
দাদামশাই রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সে আজ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। আমার মা তখনও ছোট্ট ইজের-পরা খুকি। তখন এত সব শহর-নগর ছিল না, লোকজনও এত দেখা যেত না। চারধারে কিছু গাছগাছালি, জঙ্গল-টঙ্গল ছিল। সেইরকমই এক নির্জন জঙ্গুলে জায়গায় দাদামশাই বদলি হলেন। উত্তর বাংলায় দোমোহানীতে। মালগাড়ির গার্ড ছিলেন, তাই প্রায় সময়েই তাঁকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। কখনও এক নাগাড়ে তিন-চার কিংবা সাতদিন। তারপর ফিরে এসে হয়তো একদিন মাত্র বাসায় থাকতেন, ফের মালগাড়ি করে চলে যেতেন। আমার মায়েরা পাঁচ বোন আর চার ভাই। দিদিমা এই মোট ন’জন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসায় থাকতেন। ছেলেমেয়েরা সবাই তখন ছোট-ছোট, কাজেই দিদিমার ঝামেলার অন্ত নেই।
এমনিতে দোমোহানী জায়গাটা ভারী সুন্দর আর নির্জন স্থান। বেঁটে-বেঁটে লিচু গাছে ছাওয়া, পাথরকুচি ছড়ানো রাস্তা, সবুজ মাঠ, কিছু জঙ্গল ছিল। লোকজন বেশি নয়। এক ধারে রেলের সাহেবদের পাকা কোয়ার্টার, আর অন্যধারে রেলের বাবুদের জন্য আধপাকা কোয়ার্টার, একটা ইস্কুল ছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত। একটা রেলের ইনসটিটিউট ছিল, যেখানে প্রতি বছর দু-তিনবার কেদার রায় বা টিপু সুলতান নাটক হত। রেলের বাবুরা দল বেঁধে গ্রীষ্মকালে ফুটবল খেলতেন, শীতকালে ক্রিকেট। বড় সাহেবরা সে-খেলা দেখতে আসতেন। মাঝে-মাঝে সবাই দল বেঁধে তিস্তা নদীর ধারে বা জয়ন্তিয়া পাহাড়ে চড়ুইভাতিতেও যাওয়া হতো। ছোট আর নির্জন হলেও বেশ আমুদে জায়গা ছিল দোমোহানী।
দোমোহানীতে যাওয়ার পরই কিন্তু সেখানকার পুরোনো লোকজনেরা এসে প্রায়ই দাদামশাই আর দিদিমাকে একটা বিষয়ে খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে যেতেন। কেউ কিছু ভেঙে বলতেন না। যেমন স্টোরকিপার অক্ষয় সরকার দাদামশাইকে একদিন বললেন, ‘এ জায়গাটা কিন্তু তেমন ভালো নয় চাটুজ্যে। লোকজন সব বাজিয়ে নেবেন। হুটহাট যাকে-তাকে ঘরে-দোরে ঢুকতে দেবেন না।’ কিংবা আর একদিন পাশের বাড়ির পালিত-গিন্নি এসে দিদিমাকে হেসে-হেসে বলে গেলেন, ‘নতুন এসেছেন, বুঝবেন সব আস্তে-আস্তে। চোখ-কান-নাক সব খোলা রাখবেন কিন্তু। ছেলেপুলেদের সামলে রাখবেন। এখানে যারা সব আছে, তারা ভালো নয়।’
দিদিমা ভয় খেয়ে বললেন, ‘কাদের কথা বলছেন দিদি?’
পালিত-গিন্নি শুধু বললেন, ‘সে আছে, বুঝবেনখন’।
তারপর থেকে দিদিমা একটু ভয়ে-ভয়ে থাকতে লাগলেন।
একদিন হল কী, পুরোনো ঝি সুখিয়ার দেশ থেকে চিঠি এল যে, তার ভাসুরপোর খুব বেমার হয়েছে, তাই তাকে যেতে হবে। এক মাসের ছুটি নিয়ে সুখিয়া চলে গেল। দিদিমা নতুন ঝি খুঁজছেন, তা হঠাৎ করে পরদিন সকালেই একটা আধবয়সি বউ এসে বলল, ‘ঝি রাখবেন?’
দিদিমা দোনামনা করে তাকে রাখলেন। সে দিব্যি কাজকর্ম করে, খায়দায়, বাচ্চাদের গল্প বলে ভোলায়। দিন-দুই পর পালিত-গিন্নি একদিন সকালে এসে বললেন, ‘নতুন ঝি রাখলেন নাকি দিদি? কই দেখি তাকে।’
দিদিমা ডাকতে গিয়ে দেখেন, কলতলায় এঁটো বাসন ফেলে রেখে ঝি কোথায় হাওয়া হয়েছে। অনেক ডাকাডাকিতেও পাওয়া গেল না। পালিত-গিন্নি মিচকি হেসে হেসে বললেন, ‘ওদের ওরকমই ধারা। ঝি-টার নাম কী বলুন তো?
দিদিমা বললেন, ‘কমলা’!
পালিত-গিন্নি মাথা নেড়ে বললেন, ‘চিনি। হালদার-বাড়িতেও ওকে রেখেছিল।’
দিদিমা অতিষ্ঠ হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
পালিত-গিন্নি শুধু শ্বাস ফেলে বললেন, ‘সব কি খুলে বলা যায়? এখানে এই হচ্ছে ধারা। কোনটা মানুষ আর কোনটা মানুষ নয়, তা চেনা ভারি মুশকিল। এবার দেখেশুনে একটা মানুষ-ঝি রাখুন।’
এই বলে চলে গেলেন পালিত-গিন্নি, আর দিদিমা আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলেন।
কমলা অবশ্য একটু বাদেই ফিরে এল। দিদিমা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’
সে মাথা নিচু করে বলল, ‘মা, লোকজন এলে আমাকে সামনে ডাকলে না আমি বড় লজ্জা পাই।’
কমলা থেকে গেল। কিন্তু দিদিমার মনের খটকা-ভাবটা গেল না।
ওদিকে দাদামশাইয়েরও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। একদিন লাইনে গেছেন। নিশুতিরাতে মালগাড়ি যাচ্ছে ডুয়ার্সের গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। দাদামশাই ব্রেকভ্যানে বসে ঝিমোচ্ছেন। হঠাৎ গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। তা, মালগাড়ি যেখানে-সেখানে দাঁড়ায়। স্টেশনের পয়েন্টসম্যান আর অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টাররা অনেক সময় রাতবিরেতে ঘুমিয়ে পড়ে, সিগন্যাল দিতে ভুলে যায়। সে-আমলে এরকম হামেশা হত। সেইরকমই কিছু হয়েছে ভেবে দাদামশাই বাক্স থেকে পঞ্জিকা বের করে পড়তে লাগলেন, পঞ্জিকা পড়তে তিনি বড় ভালোবাসতেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। হঠাৎ দাদামশাই শুনতে পেলেন ব্রেকভ্যানের পিছনে লোহার সিঁড়ি বেয়ে কে যেন গাড়ির ছাদে উঠছে। দাদামশাই মুখ বার করে কাউকে দেখতে পেলেন না। ফের শুনলেন, একটু দূরে কে যেন ওয়াগনের পাল্লা খোলার চেষ্টা করছে। খুব চিন্তায় পড়লেন দাদামশাই। ডাকাতরা অনেক সময়ে সাঁট করে সিগন্যাল বিগড়ে দিয়ে গাড়ি থামায়, মালপত্র চুরি করে। তাই তিনি সরেজমিনে দেখার জন্য গাড়ি থেকে হাত-বাতিটা নিয়ে নেমে পড়লেন। লম্বা ট্রেন, তার একদম ডগায় ইঞ্জিন। হাঁটতে-হাঁটতে এসে দেখেন, লাল সিগন্যাল ইতিমধ্যে সবুজ হয়ে গেছে, কিন্তু ড্রাইভার আর ফায়ারম্যান কয়লার ঢিপির ওপর গামছা পেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওদের দোষ নেই, অনেকক্ষণ নাগাড়ে ডিউটি দিচ্ছে, একটু ফাঁক পেয়েছে কি ঘুমিয়ে পড়েছে। বহু ঠেলাঠেলি করে তাদের তুললেন দাদামশাই। তারপর ফের লম্বা গাড়ি পার হয়ে ব্রেকভ্যানের দিকে ফিরে আসতে লাগলেন। মাঝামাঝি এসেছেন, হঠাৎ শোনেন ইঞ্জিন হুইসল দিল, গাড়িও ক্যাঁচ-কোঁচ করে চলতে শুরু করল। তিনি তো অবাক। ব্রেকভ্যানে ফিরে গিয়ে তিনি সবুজ বাতি দেখালে তবে ট্রেন ছাড়ার কথা। তাই দাদামশাই হাঁ করে চেয়ে রইলেন। অবাক হয়ে দেখেন, ব্রেকভ্যান থেকে অবিকল গার্ডের পোশাক পরা একটা লোক হাত-বাতি তুলে সবুজ আলো দেখাচ্ছে ড্রাইভারকে। ব্রেকভ্যানটা যখন দাদামশাইকে পার হয়ে যাচ্ছে, তখন লোকটা তাঁর দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে গেল।
বহু কষ্টে দাদামশাই সেবার ফিরে এসেছিলেন।
সেবার ম্যাজিশিয়ান প্রফেসার ভট্টাচার্য চা-বাগানগুলোতে ঘুরে-ঘুরে ম্যাজিক দেখিয়ে দোমোহানীতে এসে পৌঁছলেন। তিনি এলে-বেলে খেলা দেখাতেন। দড়ি কাটার খেলা, তাসের খেলা, আগুন খাওয়ার খেলা। তা, দোমোহানীর মতো গঞ্জ জায়গায় সেই খেলা দেখতেই লোক ভেঙে পড়ল। ভট্টাচার্য স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম দৃশ্যে একটু বক্তৃতা করছিলেন, হাতে ম্যাজিকের ছোট্ট কালো লাঠি। বলছিলেন, ম্যাজিক মানেই হচ্ছে হাতের কৌশল, মন্ত্রতন্ত্র নয়, আপনারা যদি কৌশল ধরে ফেলেন, তাহলে দয়া করে চুপ করে থাকবেন। কেউ যেন স্টেজে টর্চের আলো ফেলবেন না…ইত্যাদি। এইসব বলছেন, ম্যাজিক তখনো শুরু হয়নি, হঠাৎ দেখা গেল, তাঁর হাতের লাঠিটা হঠাৎ হাত থেকে শূন্যে উঠে ডিগবাজি খেল, তারপর আবার আস্তে-আস্তে ফিরে গেল ম্যাজিশিয়ানের হাতে। প্রথমেই এই আশ্চর্য খেলা দেখে সবাই প্রচণ্ড হাততালি দিল। কিন্তু প্রফেসর ভট্টাচার্য খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এর পরের খেলা—ব্ল্যাকবোর্ডে দর্শকেরা চক দিয়ে যা খুশি লিখবেন, আর প্রফেসর ভট্টাচার্য চোখবাঁধা অবস্থায় তা বলে দেবেন। কিন্তু আশ্চর্য প্রফেসর ভট্টাচার্যের এই খেলাটা মোটেই সেরকম হল না। দর্শকরা কে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখবেন এ নিয়ে এ ওকে ঠেলছেন, প্রফেসর ভট্টাচার্য চোখের ওপর ময়দার লেচি আর কালো কাপড় বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাইকে বলছেন ‘চলে আসুন, সংকোচের কিছু নেই, আমি বাঘ-ভল্লুক নই…’ ইত্যাদি। সে সময় হঠাৎ দেখা গেল, টেবিলের ওপর রাখা চকের টুকরোটা নিজে থেকেই লাফিয়ে উঠল, শূন্যে ভেসে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর লিখতে লাগল, প্রফেসর ভট্টাচার্য ইজ দি বেস্ট ম্যাজিশিয়ান অফ দি ওয়ার্ল্ড। এই অসাধারণ খেলা দেখে দর্শকরা ফেটে পড়ল উল্লাসে, আর ভট্টাচার্য কাঁদো-কাঁদো হয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় বলতে লাগলেন, ‘কী হয়েছে! অ্যাঁ, কী হয়েছে!’ এবং তারপর তিনি আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। আগুন খাওয়ার খেলাতেও আশ্চর্য ঘটনা ঘটালেন তিনি। কথা ছিল, মশাল জ্বেলে সেই মশালটা মুখে পুরে আগুনটা খেয়ে ফেলবেন। তাই করলেন। কিন্তু তারপরই দেখা গেল ভট্টাচার্য হাঁ করতেই তার মুখ থেকে সাপের জিভের মতো আগুনের হলকা বেরিয়ে আসছে। পরে তাসের খেলা যখন দেখাচ্ছেন, তখনও দেখা গেল, কথা বলতে গেলেই আগুনের হলকা বেরোয়। দর্শকরা দাঁড়িয়ে উঠে সাধুবাদ দিতে লাগল। কিন্তু ভট্টাচার্য খুব কাঁদো-কাঁদো মুখে চার-পাঁচ-সাত গ্লাস জল খেতে লাগলেন স্টেজে দাঁড়িয়েই। তবু হাঁ করলেই আগুনের হলকা বেরোয়। তখনকার মফস্বল শহরের নিয়ম ছিল, বাইরে থেকে কেউ এরকম খেলা-টেলা দেখাতে এলে তাঁকে কিংবা তাঁর দলকে বিভিন্ন বাসায় সবাই আশ্রয় দিতেন। প্রফেসর ভট্টাচার্য আমাদের মামার বাড়িতে উঠেছিলেন। রাতে খেতে বসে দাদামশাই তাঁকে বললেন, ‘আপনার খেলা গণপতির চেয়েও ভালো। অতি আশ্চর্য খেলা।’
ভট্টাচার্য বললেন, ‘হ্যাঁ, অতি আশ্চর্য খেলা। আমি এরকম আর দেখিনি।’
দাদামশাই অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী! এ তো আপনিই দেখালেন!’
ভট্টাচার্য আমতা-আমতা করে বললেন, তা বটে ‘আমিই তো দেখালাম। আশ্চর্য।’
তাঁকে খুবই বিস্মিত মনে হচ্ছিল।
দাদামশাইয়ের বাবা সেবার বেড়াতে এলেন দোমোহানীতে। বাসায় পা দিয়েই বললেন, ‘তোদের ঘরদোরে একটা আঁশটে গন্ধ কেন রে?’
সবাই বললে, ‘আঁশটে গন্ধ! কই, আমরা তো পাচ্ছি না।’
দাদামশাইয়ের বাবা ধার্মিক মানুষ, খুব পন্ডিত লোক। মাথা নেড়ে বললেন, ‘আলবৎ আঁশটে গন্ধ। সে শুধু তোদের বাসাতেই নয়, স্টেশনে নেমেও গন্ধটা পেয়েছিলাম। পুরো এলাকাতেই যেন আঁশটে-আঁশটে গন্ধ একটা।
কমলা দাদামশাইয়ের বাবাকে দেখেই গা ঢাকা দিয়েছিল, অনেক ডাকাডাকিতেও সামনে এল না। দিদিমার তখন ভারি মুশকিল। একা হাতে সব সামলাতে হচ্ছে। দাদামশাইয়ের বাবা সব দেখেশুনে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘এসব ভালো কথা নয়, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।’
সেদিনই বিকেলে স্টেশন মাস্টার হরেন সমাদ্দারের মা এসে দিদিমাকে আড়ালে ডেকে বললেন, ‘কমলা আমাদের বাড়িতে গিয়ে বসে আছে। তা বলি বাছা, তোমার শ্বশুর ধার্মিক লোক, সে ভালো। কিন্তু উনি যদি জপতপ বেশি করেন, ঠাকুর দেবতার নাম ধরে ডাকাডাকি করেন, তাহলে কমলা এ বাড়িতে থাকে কী করে?’
দিদিমা অবাক হয়ে বললেন, ‘এ সব কী কথা বলছেন মাসিমা? আমার শ্বশুর জপতপ করলে কমলার অসুবিধে কী?’
সমাদ্দারের মা তখন দিদিমার থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ও হরি, তুমি বুঝি জানো না? তাই বলি বাছা, দোমোহানীর সবাই জানে যে, এ হচ্ছে ওই দলেরই রাজত্ব। ঘরে-ঘরে ওরাই সব ঝি-চাকর খাটছে। বাইরে থেকে চেহারা দেখে কিছু বুঝবে না, ওরা হচ্ছে সেই তারা।’
‘কারা?’ দিদিমা তবু অবাক।
‘বুঝবে বাপু, রোসো।’ বলে সমাদ্দারের মা চলে গেলেন।
তা কথাটা মিথ্যে নয়। দোমোহানীতে তখন ঝি-চাকর কিংবা কাজের লোকের বড় অভাব। ডুয়ার্সের ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, মশা আর বাঘের ভয়ে কোনও লোক সেখানে যেতে চায় না। যাদের না গিয়ে উপায় নেই, তারাই যায়। আর গিয়েই পালাই-পালাই করে। তবু ঠিক দেখা যেত, কারও বাসায় ঝি-চাকর বা কাজের লোকের অভাব হলেই ঠিক লোক জুটে যেত। স্টেশন মাস্টার সমাদ্দারের ঘরে একবার দাদামশাই বসে গল্প করছিলেন। সমাদ্দার একটা চিঠি লিখছিলেন, সেটা শেষ করেই ডাকলেন, ‘ওরে কে আছিস?’ বলামাত্র একটা ছোকরামতো লোক এসে হাজির। সমাদ্দার তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বললেন, ‘যা এটা ডাকে দিয়ে আয়।” দাদামশাই তখন জিগ্যেস করলেন, লোকটাকে নতুন রেখেছেন নাকি?” সমাদ্দার মাথা নেড়ে বললেন, ‘না-না ফাই-ফরমাশ খেটে দিয়ে যায় আর কী। খুব ভালো ওরা, ডাকলেই আসে। লোক-টোক নয়, ওরা ওরাই।’
তাই তো। মামাদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন ধর্মদাস নামে একজন বেঁটে আর ফর্সা ভদ্রলোক। তিনি থিয়েটারে মেয়ে সেজে এমন মিহি গলায় মেয়েলি পার্ট করতেন যে, বোঝাই যেত না তিনি মেয়ে না ছেলে। সেবার সিরাজদ্দৌলা নাটকে তিনি লুৎফা। গিরীশ ঘোষের নাটক। কিন্তু নাটকের দিনই তাঁর ম্যালেরিয়া চাগিয়ে উঠল। লেপচাপা হয়ে কোঁ-কোঁ করছেন। নাটক প্রায় শিকেয় ওঠে। কিন্তু ঠিক দেখা গেল, নাটকের সময়ে লুৎফার অভাব হয়নি। একেবারে ধর্মদাস মাস্টার মশাই-ই যেন গোঁফ কামিয়ে আগাগোড়া নিখুঁত অভিনয় করে গেলেন। কেউ কিছু টের পেল না। কিন্তু ভিতরকার কয়েকজন ঠিকই জানত যে, সেদিন ধর্মদাস মাস্টারমশাই মোটেই স্টেজে নামেননি। নাটকের শেষে দাদামশাই সমাদ্দার মশাইয়ের সঙ্গে ফিরে আসছিলেন, বললেন, দেখলেন, কেমন কার্যোদ্ধার হয়ে গেল। একটু খোনা সুরও কেউ টের পায়নি।’
দাদামশাই তখন চেপে ধরলেন সমাদ্দারকে, ‘মশাই রহস্যটা কী, একটু খুলে বলবেন?’
সমাদ্দার হেসে সাতখানা হয়ে বললেন, সবই তো বোঝেন মশাই। একটা নীতিকথা বলে রাখি, সদ্ভাব রাখলে সকলের কাছ থেকেই কাজ পাওয়া যায়। কথাটা খেয়াল রাখবেন।’
মামাদের মধ্যে যারা একটু বড়, তারা বাইরে খেলে বেড়াত। মা আর বড়মাসি তখন কিছু বড় হয়েছে। অন্য মামা-মাসিরা তখন নাবালক-নাবালিকা। মা-র বড় লুডো খেলার নেশা ছিল। তো, মা আর মাসি রোজ দুপুরে লুডো পেড়ে বসত, তারপর ডাক দিত, ‘আয় রে।’ অমনি টুক করে কোথা থেকে মায়ের বয়সিই দুটো মেয়ে হাসিমুখে লুডো খেলতে বসে যেত। মামাদের মধ্যে যারা বড় হয়েছে, সেই বড় আর মেজ-মামা যেত বল খেলতে। দুটো পাটিতে প্রায়ই ছেলে কম পড়ত। ছোট জায়গা তো, বেশি লোকজন ছিল না। কিন্তু কম পড়লেই মামারা ডাক দিত, ‘কে খেলবি, আয়।’ অমনি চার-পাঁচজন এসে হাজির হত, মামাদের বয়সিই ছেলে। খুব খেলা জমিয়ে দিত।
এই খেলা নিয়েই আর একটা কাণ্ড হল একবার। দোমোহানীর ফুটবল টিমের সঙ্গে এক চা-বাগানের টিমের ম্যাচ। চা-বাগান থেকে সাঁওতাল, আদিবাসী, দুর্দান্ত চেহারার খেলোয়াড় সব এসেছে। দোমোহানীর বাঙালি টিম জুত করতে পারছে না, হঠাৎ দোমোহানীর টিম খুব ভালো খেলা শুরু করল, দুটো গোল শোধ দিয়ে আরও একখানা দিয়েছে। এমন সময়ে চা-বাগান টিমের ক্যাপেটেন খেলা থামিয়ে রেফারিকে বলল, ‘ওরা বারোজন খেলছে’ রেফারি গুণে দেখলেন না, এগোরো জনই। ফের খেলা শুরু হতে, একটু পরে রেফারিই খেলা থামিয়ে দোমোহানীর ক্যাপ্টেনকে ডেকে বললেন, ‘তোমাদের টিমে চার-পাঁচজন একস্ট্রা লোক খেলছে।’
দুর্দান্ত সাহেব রেফারি, সবাই ভয় পায়। দোমোহানীর ক্যাপটেন বুক ফুলিয়ে বলল, ‘গুণে দেখুন।’ রেফারি গুনে দেখে আহাম্মক। এগারোজনই।
দোমোহানীর টিম আরও তিনটে গোল দিয়ে দিয়েছে। রোফারি আবার খেলা থামিয়ে ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে বললেন, ‘দেয়ার আর অ্যাট-লিস্ট টেন একস্ট্রা মেন ইন দিস টিম।’
দর্শকদেরও তাই মনে হয়েছে। গুণে দেখা যায় এগারোজন, কিন্তু খেলা শুরু হতেই যেন ঘাসের বুকে লুকিয়ে থাকা, কিংবা বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে থাকা সব খেলোয়াড় পিলপিল করে নেমে পড়ে মাঠের মধ্যে। রেফারি দোমোহানীর টিমকে লাইন আপ করিয়ে সকলের মুখ ভালো করে দেখে বললেন, ‘ শেষ তিনটে গোল যারা করেছে, তারা কই? তাদের তো দেখছি না। একটা কালো ঢ্যাঙা ছেলে, একটা বেঁটে আর ফর্সা, আর একটা ষাঁড়ের মতো, তারা কই?’
দোমোহানীর ক্যাপ্টেন মিনমিন করে সাফাই গাইল, তাতে রেফারি আরও রেগে টং। চা-বাগানের টিম-ও ভ্যাবাচ্যাকা থেয়ে হাফসে পড়েছে। কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।
খেলা অবশ্য বন্ধ হয়ে গেল। দাদামশাইয়ের বাবা লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে খেলার হালচাল দেখে বললেন, আবার সেই গন্ধ। এখানেও একটা রহস্য আছে, বুঝলে সমাদ্দার?’
স্টেশনমাস্টার সমাদ্দার পাশেই ছিলেন, বললেন, ‘ব্যটারা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।’
‘কে? কাদের কথা বলছ?’
সমাদ্দার এড়িয়ে গেলেন। দাদামশাইয়ের বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।’
দাদামশাইয়ের বাবা সবই লক্ষ করতেন, আর বলতেন, ‘এসব ভালো কথা নয়। গন্ধটা খুব সন্দেহজনক। ও বউমা, এসব কী দেখছি তোমাদের এখানে? হুট বলতেই সব মানুষজন এসে পড়ে কোত্থেকে, আবার হুশ করে মিলিয়ে যায়। কাল মাঝরাতে উঠে একটু তামাক খাওয়ার ইচ্ছে হল, উঠে বসে কেবলমাত্র আপনমনে বলেছি, একটু তামাক খাই। অমনি একটা কে যেন বলে উঠল, এই যে বাবুমশাই, তামাক সেজে দিচ্ছি। অবাক হয়ে দেখি সত্যিই একটা লোক কল্কে ধরিয়ে এনে হুঁকোয় বসিয়ে দিয়ে গেল। এরা সব কারা?’
দিদিমা আর কী উত্তর দেবেন? চুপ করে থাকেন। দাদামশাইও বেশি উচ্চবাচ্য করেন না। বোঝেন সবই। কিন্তু দাদামশাইয়ের বাবা কেবলই চারধারে বাতাস শুঁকে-শুঁকে বেড়ান আর বলেন, ‘এ ভালো কথা নয়, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।’
মা প্রায়ই তাঁর দাদুর সঙ্গে বেড়াতে যেতেন। রাস্তাঘাটে লোকজন কারুর সঙ্গে দেখা হলে তারা সব প্রণাম বা নমস্কার করে সম্মান দেখাত দাদামশাইয়ের বাবাকে; কুশল প্রশ্ন করত। কিন্তু দাদামশাইয়ের বাবা বলতেন, ‘রোসো বাপু, আগে তোমাকে ছুঁয়ে দেখি, গায়ের গন্ধ শুঁকি, তারপর কথাবার্তা।’ এই বলে তিনি যাদের সঙ্গে দেখা হতো, তাদের গা টিপে দেখতেন, শুঁকতেন, নিশ্চিন্ত হলে কথাবার্তা বলতেন। তা তাঁর দোষ দেওয়া যায় না। সেই সময়ে দোমোহানীতে রাস্তায় ঘাটে বা হাটেবাজারে যেসব মানুষ দেখা যেত, তাদের বারো আনাই নাকি সত্যিকারের মানুষ নয়। তা নিয়ে অবশ্য কেউ মাথা ঘামাত না। সকলেরই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল।
অভ্যাস জিনিসটাই ভারী অদ্ভুত! যেমন বড় মামার কথা বলি। দোমোহানীতে আসবার অনেক আগে থেকেই তাঁর ভারী ভয় ছিল। তাঁরও দোষ দেওয়া যায় না। ওই বয়সে ভূতের ভয় কারোই বা না থাকে। তাঁর কিছু বেশি ছিল। সন্ধের পর ঘরের বার হতে হলেই তাঁর সঙ্গে কাউকে যেতে হত। দোমোহানীতে আসবার অনেক পরেও সে অভ্যাস যায়নি। একদিন সন্ধেবেলা বসে ধর্মদাস মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ছেন একা, বাড়ির সবাই পাড়া-বেড়াতে গেছে। ঠিক সেই সময়ে তাঁর বাথরুমে যাওয়ার দরকার হল। মাস্টারমশাইকে তো আর বলতে পারেন না, ‘আপনি আমার সঙ্গে দাঁড়ান। তাই বাধ্য হয়ে ভিতর বাড়িতে এসে অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই শুনছিস?’
অমনি একটা সমবয়েসি ছেলে এসে দাঁড়াল, ‘কী বলছ?’
‘আমি একটু বাথরুমে যাব, আমার সঙ্গে একটু দাঁড়াবি চল তো!’
সেই শুনে ছেলেটা তো হেসে কুটিপাটি। বলল, ‘দাঁড়াব কেন, তোমার কীসের ভয়?’
বড়মামা ধমক দিলেন, ‘ফ্যাচ-ফ্যাচ করিস না। দাঁড়াতে বলছি, দাঁড়াবি।’
ছেলেটা অবশ্য দাঁড়াল। বড়মামা বাথরুমে কাজ সেরে এলে ছেলেটা বলল, ‘কিসের ভয় বললে না?’
বড়মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ভূতের।’
ছেলেটা হাসতে-হাসতে বাতাসে মিলিয়ে গেল। বড়মামা রেগে গিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘খুব ফাজিল হয়েছ তোমরা।’
তা এইরকম সব হতো দোমোহানীতে। কেউ গা করত না।
কেবল দাদামশাইয়ের বাবা বাতাস শুঁকতেন, লোকের গা শুঁকতেন। একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে তাঁর হাতে মাছের ছোট্ট খালুই, তাতে সিঙ্গি মাছ নিয়ে আসছিলেন। তো একটা মাছ মাঝপথে খালুই বেয়ে উঠে রাস্তায় পড়ে পালাচ্ছে। দাদামশাইয়ের বাবা সেই মাছ ধরতে হিমসিম খাচ্ছেন, ধরলেই কাঁটা দেয় যদি! এমন সময় একটা লোক খুব সহৃদয় ভাবে এসে মাছটাকে ধরে খালুতেই ভরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। দাদামশাইয়ের বাবা তাকে থামিয়ে গা শুঁকেই বললেন, ‘এ তো ভালো কথা নয়! গন্ধটা খুব সন্দেহজনক! তুমি কে হে! অ্যাঁ! কারা তোমরা?’
এই বলে দাদামশাইয়ের বাবা তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। লোকটা কিন্তু ঘাবড়াল না। একটু ঝুঁকে দাদামশাইয়ের বাবার গা শুঁকে সেও বলল, ‘এ তো ভালো নয়। গন্ধটা বেশ সন্দেহজনক! আপনি কে বলুন তো! অ্যাঁ, কে?’
এই বলে লোকটা হাসতে-হাসতে বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দাদামশাইয়ের বাবা আর গন্ধের কথা বলতেন না। একটু গম্ভীর থাকতেন ঠিকই, ভূতের অপমানটা তাঁর প্রেস্টিজে খুব লেগেছিল। একটা ভূত তাঁর গা শুঁকে ওই কথা বলে গেছে, ভাবা যায়!