গন্ধকাঁথা
সেজদা বমি করছে। বমির শব্দ পাচ্ছি। চোখের সামনে রোববারের কাগজের ডিটেকটিভ গল্প খোলা, টিভিও খোলা, সুমিতাও এখন অনেকটাই খোলা, দরজা খোলা নয়, বন্ধ। সুমিতা দেশলাই কাঠি দিয়ে আটকে থাকা রোববারের মাংস বার করছে দাঁত থেকে। মেয়েরা এসব করলে খুব বাজে লাগে। মেয়েদের কান খোঁচানো, নাক খোঁটা, এসব বিচ্ছিরি। আজ সকালে সুমিতা দাঁতব্রাশের ফ্লোরাইড যুক্ত ফেনা নিয়ে বলেছিল, টেঁটুল আর ঢনে পাটা এনো… অসহ্য লেগেছিল। তাকাইনি।
বমির শব্দ শুনলাম। সেজদার! আমার পুচকু বাচ্চাটা হাত পা ছুড়ছে মিকি মাউসের ছবিওলা তোয়ালের উপরে। একটু আগে ঘুম থেকে উঠল। রোববারের রবিবাসরীয়র ডিটেকটিভ বন্ধ করে বাচ্চাটার হাত-পা ছোড়া দেখতে থাকি। বাচ্চাটা হিসি করল মনে হয়। পা-দুটো উঁচু করে দেখলাম, হ্যাঁ, করেছে। তোয়ালে পালটে দিতে হবে। বেশ লাগে কিন্তু। পা-টা একটু উঁচু করে ভেজা তোয়ালেটা টেনে নিলাম, ঘরের কোনায় রেখে দিলাম। ওখানে আরও ভেজা কাঁথা-তোয়ালে আছে, আর ওখানে জমে আছে একটা গন্ধ। দেখি, ওখানে একটা প্রজাপতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও কেন ঘুরঘুর করছে ওখানে? প্রজাপতিদের শৈশবে কাঁথা জড়ানো পেচ্ছাপ থাকে না। শিশুটা হাত-পা ছুড়ছে। কেন আনন্দ, কী আনন্দ ওর এখন? একটা কাঁথা খুঁজতে থাকলাম, শুকনো। পরবর্তী হিসির জন্য। অনেক নরম নরম তোয়ালে রয়েছে। কাঁথা নেই। সুমিতার কয়েকটা কাঁথা সেলাই করে দিয়েছিলেন মরে যাবার আগে। বাচ্চাটা হবার দিন—পনেরো আগে সুমিতার মা মারা যান। ক্যানসার। গোটা পাঁচেক কাঁথা দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনটে আছে, দুটো মিসিং। হারিয়ে গেছে হাওয়ায়।
সুমিতার বক্তব্য হাওয়াতে হারাতেই পারে না, ইমপসিব্ল। বাইরে মেলেইনি ও। ও দুপুরবেলা কাঁথাগুলো ঘোয় তারপর মেলে দেয়। ও নাকি ধুতে নেবার সময়েই পায়নি কাঁথা দুটো। অথচ সেদিন সকালেও নাকি ছিল। আমি শিয়োর, এটা সুমিতারই ক্যালাসনেস। নিশ্চই বারান্দায় মেলে দিয়েছিল, ক্লিপ আঁটেনি। নইলে পেচ্ছাপ মাখা ওই সব কাঁথা কে চুরি করতে আসবে? কাজের বউটা? ও তো চারটে বাচ্চার পর লাইগেশন করিয়েছে—তাও দু’বছর হয়ে গেল। সুমিতার কাছেই পাওয়া এই খবর। কাঁথা হারানোতে, কিন্তু সুমিতা দুঃখ পেয়ে ছিল খুব। পাবেই তো। ছোট্ট সুমিতার যখন বছর তিনেক বয়স, তখন নাকি ও ওর মায়ের পরনের হাতিছাপ শাড়ি দেখে বায়না করেছিল—ওই শাড়িটা ও পরবে। ওর মা ওর গায়ে পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন শাড়িটা। সুমিতা সারাদিন পরে ছিল, কিছুতেই খুলতে দেবে না। রাত্রে ঘুমোলে ওর মা সরিয়ে দিয়েছিল ওই শাড়ি। মাঝরাত্তিরে নাকি সুমিতা আমার হাতি কোথায় গেল বলে কেঁদে উঠেছিল। আর সেদিনই নাকি ওর মা ভেবে রেখেছিলেন— ওই শাড়ি দিয়ে সুমিতার সন্তানের জন্য কাঁথা বানিয়ে দেবেন?
সেজদা বমি করছে।
কাল কি মাল-ফাল বেশি গিলেছে? আর পারা যায় না লোকটাকে নিয়ে। একটা নুইসেন্স। কাল রাত দেড়টার পরে শ্যামাসংগীত শুনেছিলাম। শোবার আগে একটা শ্যামাসংগীতের অভ্যাস সেজদার। সাধারণত নিজেই গায়, যেদিন বেশি গেলা হয়ে যায়, পান্নালালে কিশোরকুমার জড়িয়েও হচ্ছে না, সেদিন টেপটা অন করে শুড়ে পড়ে। টেপ-এ ভরাই থাকে, ক্যাসেট শেষ হলে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। কাল রাত্রে স্বখাত সলিলে ডুবে মরি দিয়ে শুরু হয়েছিল। ভল্যুমটা একটু বেশিই। মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ কোরো না’র সময় আমি সেজদার ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে আসি।
আমার জানালার ওপাশেই সেজদার ঘরের জানালা। মাঝে একটা চার ফুটের বারান্দা। আমার ঘরে অক্রুর দত্ত লেন থেকে হাওয়া মাঝে মাঝে আসে, আমার ঘরের মধ্যেই একটু ঘুর ঘুর করে মন খারাপ করে অক্রুর দত্ত লেনেই ফিরে চলে যায় ফের। যদি আমার জানালাটা আর সেজদার জানালাটা একই সঙ্গে খোলা থাকে, তবে অক্রুর দত্তর হাওয়া সেজদার ঘর হয়ে বাঁকা রায় স্ট্রিটে ছুটে যেতে পারে। আগে যেত, এখন হয় না।
সেজদা বমি করছে।
বারান্দার দিকের জানালাটা খুললাম। একটা মাকড়সার জাল ছিঁড়ে গেল। বারান্দার ওপাশকে ওপাড় মনে হল। মেজদার জানালা বন্ধ। জানালার সবুজ কাঠে ভূতের ছবি। এইসব ভূতের ছবি-টবি আঁকিয়েছিল সেজদাই। সিঁড়ির দেয়ালে, বারান্দায়, বোধহয় সেজদার ঘরের দেয়ালেও। আমাদের বাসন মাজার ঝি-টা একটা বছর পাঁচেকের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসে। সেজদা একদিন ওই ছেলেটার হাতে একটা খড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলে, অ্যাই ব্যাটা, আঁক, সারা বাড়িতে ছবি আঁক, যা মন চায় আঁক, জিলিপি দোব, গজা দোব, সারাটা বাড়ি যা মন চায় এঁকে কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং এঁকে ভরিয়ে দে। ছেলেটা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। সেজদা তখন বলেছিল, না আঁকলে প্যাঁদাব। ছেলেটা বারান্দার দেয়ালে এঁকেছিল দুটো গোল গোল। ওগুলো নাকি রসগোল্লা। দেয়ালে আঁকাবাঁকা দাগ। সেজদার বন্ধ জানালায় ভূত, নাকি সেজদাকেই এঁকে ছিল। কে জানে? মেজদা ক্যাডবেরি দিয়েছিল। ছেলেটার পছন্দ হয়নি বলেছিল, জিলিপি কই, জিলিপি?
এই যে দেয়ালগুলো নোংরা করাল সেজদা। কিছু বললাম না। বললেই ঝগড়া শুরু হয়ে যেত। বড় মুখ খিস্তি করে সেজদা। এটা সেজদার একটা টেকনিক। এই ভয়েই কিছু বলি না। খিস্তির প্রাবল্য বেড়েছে ইদানীং, বিশেষত আমার বিয়ের পর থেকে।—তা আমি কী করব? দাদা-দিদিরা মিলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিল। আমি তো বললুম কত করে যে সেজদার বিয়েটা হয়নি, আমারটা থাক এখন। আসলে সেজদাটা হচ্ছে বাউণ্ডুলে টাইপের। কোনও কিছুই ঠিক করে করল না। আমার বাবা সব ভাইদেরই কারবার করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু আমাকেই করতে হয়নি। অঙ্কে এইট্টির কমে কখনও পেতাম না। আমি বলেছিলাম কারবার করব না, চাকরি করব। পরীক্ষা দিয়ে এক চান্সে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছি। বাবার ছিল চিরুনির কারবার। বড়দা-মেজদা ওটাই দেখে। সেজদাকে প্রেস করে দিয়েছিলেন। বাবা, সেজদা চালাতে পারেনি। মেশিনপত্র বেচে দিয়ে চানাচুরের কারবার। অফুরন্ত চাট, গাদা গাদা চানাচুর আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেগুলার মাল খাওয়া। চানাচুরের কারবারটাও ভোগে। এখন কী করে-টরে জানি না কিন্তু বাড়িতে ও থাকে না। একটা বাজে কথা মনে এল। কথায় বলে কুকুরের কাজও নেই, আবার অবসরও নেই। দাদারও সেই রকম। ক’দিন আগে আমার জামাইবাবুর হার্ট সার্জারি হল, এক মাস পড়ে ছিল নার্সিংহোম-এ, একদিনও সময় হল না গিয়ে একটু দেখে আসবার। আমার তিন দিদি। সেজদার পরই দিদিরা, দিদিদের পর আমি৷ সেজদা আমার চেয়ে বারো-চোদ্দ বছরের বড়। আমার যখন বিয়ে ঠিক হল সেজদা আমায় বলল, দেবু, ওভারটেক করলি কিন্তু। আমি কিন্তু বড়দাকে বলেছিলাম, সেজদার জন্য আগে কিছু করো। বড়দা বলেছিল, ও তো একটা উড়নচণ্ডী। তা ছাড়া ওর বিয়ের বয়স কি আর আছে? কে জানে দাদারা এরকম ভাবল কেন? আমার বিয়ের সময় আমি বত্রিশ ছিলাম, সেজদা ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ। এমন কী বেশি।
আমার বিয়ের পরই সেজদা কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠল। বাড়িতে মেয়েমানুষ নিয়ে আসতে লাগল। সেজদার ঘরে পর্দা ঝুলল। বাথরুমের বেসিনে পানসুপুরি-জর্দার কুঁচি মাখা গয়ের। ম্যা- গো…। ওরা সব ফ্ল্যাশটাও ঠিক মতো টানে না। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার। বাড়িতে বউ-এর কাছে মুখ দেখাতে পারি না। বউ বলল, কিছু একটা করো। কী করব আমি?
বাবাই ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। একতলায় বড়দা, দোতলায় মেজদা, তিনতলায় সেজদা আর আমি। আমরা দু’ভাই তখন ব্যাচেলার ছিলাম।। বাথরুম কমন।
দাদাদের বললাম। দাদারা বলল, একটা ফ্ল্যাট দেখে নে। এটা কোনও কাজের কথা হল!
একদিন সকালে সেজদা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সিঁড়ির সামনেটায় বাজারের থলি হাতে বলছে— হ্যাঁগো, শুনছ, কী আনব বলো। গলদা আনব? চারশো টাকা কিলোর? বাইরে উকি মেরে দেখি পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যবয়সিনী, গালের ভিতরে পান, বাইরে মেচেতা, বলছে যা মন চায় এনো।
রান্নাঘরটা আমিই ব্যবহার করি। সেজদা হোটেলেই খায়। বারান্দায় একটা স্টোভ ও রেখেছে। মাঝে মাঝে ব্যবহার করে। দেখি ওই স্টোভের পাশে আলু কোটা। সেজদা বাজার থেকে এল। বলল—চম্পা, আমি পচা মাছ এনেছি, ইচ্ছে করেই। তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করো। প্লিজ, বউয়েরা যেমন ঝগড়া করে। মেয়েটা হি হি করে হাসছে। সেজদা ওকে জড়িয়ে ধরে বলছে— একটু মুখ করো চম্পা, একটু মুখ করো, আমি একটু সুখ করি।
দাদাদের সব বললাম। জানালাম এবার সুমিতাকে বাপের বাড়ি রেখে আসতে বাধ্য হব, সেটা ফ্যামিলির প্রেস্টিজের পক্ষে ভাল হবে না।
দাদারা একদিন সেজদার সঙ্গে বসল। আমিও ছিলাম। বড়দা বললেন, দ্যাখ সেজো, তুই আমাদের ফ্যামিলির প্রেস্টিজ ডুম করে দিচ্ছিস। বাইরের প্রস্ ঘরে ঢোকাচ্ছিস। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। এসব বন্ধ কর।
সেজদা বলল, দ্যাখো বড়দা, তুমি পঁয়ত্রিশ বছর আগে বিয়ে করেছ। জীবনে মিনিমাম তিন হাজার বার করেছ। মেজদা, জানি তোমার ডায়বিটিস, তাও দু’হাজার বার করোনি কি? আর এই যে ছোট, সব সময়ই তো দরজা বন্ধ। আমি শালা জীবনে কিছুই পেলাম না, আর তোমরা আমায় এখন গীতা শোনাচ্ছ? যা করেছি বেশ করেছি।
এরপর থেকেই সেজদার সঙ্গে কারুর কথাবার্তা নেই। তবে সেজদাও আর নতুন করে প্রস্ আনেনি বাড়িতে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই রাত্রে ফেরে না। আগেও ফিরত না।
সেজদার বমির শব্দ আবার।
সুমিতা আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি বললাম, দেখে আসি। সেজদার ঘরে ঢুকলাম কতদিন পর। টেবিলের ওপরে একটা লাল জবা শুকিয়ে এলিয়ে আছে। একটা সাদা কাগজ, পেনটা খোলা। শ্রীচরনেষু মা, ইতিপূর্বে তোমাকে… এটুকুই লেখা। মা? বারো বছর আগে স্বর্গে গেছেন। মায়ের একটা ছবি বিরাট বড় করে বাঁধিয়ে ছিল সেজদা। দেওয়ালে তাকালাম। ছবিটা রয়েছে। একটা প্ল্যাস্টিকের ফুলমালা। ছবিটার পায়ের কাছে সেজদার নিজের একটা ছবি সাঁটানো। ঘরের দেয়ালে ভূতের ছবি। তা ছাড়া কাঠকয়লায় লেখা, কুমু, তোমায় ভুলছি না ভুলব না। কুমু মানে কি সেজদার সেই বন্ধু কুমুদ দত্ত? নাকি ওই সব কুমুদিনী-টুমুদিনী। এই ধরনের লেখা তো শ্মশানে থাকে। সেজদার কাছে যাওয়াই মুশকিল। মেঝেতে বমি, চাদর-বালিশেও। আমি ওর কপালে হাত রাখি, অনেক দিন পর। চাপ দি৷ সেজদা চোখ খুলেই বন্ধ করে নেয়। খুব উইক হয়ে গেছে বমি-টমি করে। আমি ডাক্তার ডাকি।
ডাক্তার এসে জিজ্ঞাসা করল, ড্রিংক করেছিলেন? উত্তর নেই। তিন বার জিজ্ঞাসার পর সেজদার গলায় যে আওয়াজ বেরুল, তাতে আমি বুঝতে পারলাম সেজদা বলছে, ইয়েস। ভীষণ জড়ানো গলা। তার মানে এখনও নেশা রয়েছে, এত বমির পরও? আমি রেগে জিজ্ঞাসা করি ক’পেগ, অ্যাঁ? সেজদা ডান হাতটা একটু উঁচু করে পাঁচটা আঙুল দেখাল, এরপর বাঁ হাতটাও উঁচু করতে চেষ্টা করল, ওঠাতে পারল না। তখন ডান হাতটাই উঁচু করে পাঁচটা আঙুল দেখাল আবার। ডাক্তারবাবু বলল, বাঁ হাতটা নাড়ান তো দেখি, সেজদা পারল না। ডাক্তারবাবু কপাল কুঁচকোলেন। ছোট হাতুড়ি দিয়ে ঠোকাঠুকি করলেন হাতে পায়ে। তারপর বললেন, বোধ হয় সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যান।
বড়দা-মেজদাকে ডাকি। অ্যাম্বুলেন্স ডাকি। অ্যাম্বুলেন্স এল। সেজদাকে ডাকি। সেজদার সাড়া নেই। সেজদাকে ঠেলা মারি। সাড়া নেই। কানের সামনে মুখ নিয়ে বলি— সেজদা, আরও দু’পেগ খাবি? সাড়া নেই। তক্ষুনি মনে মনে দেয়ালে লিখে ফেলি সেজদা তোমায় ভুলব না। দেখি সেজদা নিশ্বাস নিচ্ছে। আমরা তিন ভাই ধরাধরি করে সেজদাকে স্ট্রেচারে তুলি। সেজদাকে স্ট্রেচারে তুলতে গিয়ে ওর বালিশ আর চাদর সরে যায়, বালিশের তলদেশ থেকে ফণা তোলে সেই হারিয়ে যাওয়া কাঁথাগুলি, আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে যায়। সেই হাতি ছাপ কাঁথা। আমি বমি মাখা চাদর টেনে দিয়ে কাঁথাগুলিকে আড়ালে রাখি। সেজদা, তুই এই কাঁথাগুলি কেন চুরি করলি রে? কী লাভ তোর? সুমিতার মনে কষ্ট দিতে চেয়েছিলি?
অ্যাম্বুলেন্স-এ আমরা তিন ভাই। বড়দা একবার মেজদাকে জিজ্ঞাসা করল— সেজোর অ্যাকাউন্টটা কার সঙ্গে জয়েন্ট রে? মেজদা ঠোঁট উলটোল। আমি সেজদার দিকে চেয়ে থাকি। হা করা মুখ। একটা সামনের দাঁত পড়ে গেছে। কবে, কবে রে? সেজদা সামনের দাঁত দিয়ে দারুণ আখের চোকলা ছাড়াত। সেজদার চোখটা আধখোলা। আমি সেজদার চোখের দিকে চেয়ে হাসি মুখ করি। সেজদার চোখ নড়ে না, মুখ করে না। মুখ দিয়ে জোরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে দুই ঠোঁট জোড়া লালার সুতোটা ছিড়ে গেল। হাতটা ধরি। তোর হাত ধরে শিমুলতলার টিলা-জঙ্গলে ঘুরতাম। আংটিটা কোথায় গেল?
মা মারা যাবার পর মায়ের গয়নাগুলো ভাগাভাগি হয়েছিল আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে। ছ’টা কৌটোর মধ্যে গয়নাগুলো ভাগ করে রেখে লটারি হয়েছিল। সেজদার ভাগ্যে মুক্তার আংটি আর হিরের নাকছাবি উঠেছিল। অনেকটা সোনার মধ্যে বেশ বড়সড় মুক্তো, একটু নীলচে আভা। সেজদা ও-আংটিটা সবসময় পরে থাকত। আমি একবার বলেছিলাম রাত বিরেতে বাড়ি ফিরিস, আংটিটা না পরাই ভাল। সেজদা বলেছিল, তোকে জ্ঞান দিতে হবে না। সেজদার কি জ্ঞান আছে? বুকের কাছ কান নিয়ে সেজদার বুকের ধুকপুকি শোনার ইচ্ছে হল৷ সেজদার বুকে হাত রাখি। ধুকপুকি পাই। আমার আর সেজদার রক্ত একই গ্রুপের। বি-মাইনাস। আমার স্কুটার অ্যাক্সিডেন্টের সময় সেজদা রক্ত দিয়েছিল। সেজদাকে একবার বলেছিলাম—তোর রক্তের মধ্যে লাম্পট্য রয়েছে। সেজদা বলেছিল, আমার রক্ত তোর বডিতেও আছে, মনে রাখিস। আমিই দিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম আনফর্চুনেট টু রিসিভ ব্লাড ফ্রম ইউ। তা ছাড়া তোর সেই রক্ত আর নেই। জেনে রাখ, হিমোগ্লোবিন একশো কুড়ি দিনে ভেঙে যায়।
সেজদা বলেছিল, কৃতজ্ঞতাটাও কি একশো কুড়ি দিনে ভেঙে যায় দেবু?
সেজদার হাত ধরি। হাতের কবজি। পাল্স পাচ্ছি না। আমি তোকে বড্ড অপছন্দ করি রে সেজদা, তবু চোখ জলে ভরে আসে কেন? হাসপাতাল কতদূর। কতদূর আর?
দুই
সেজদা বাড়ি ফিরছে। ওর বাঁ অঙ্গ পড়ে যাবে ভাবা হয়েছিল তা হয়নি। বাঁ হাতের মুঠোয় কিছু ধরতে না পারলেও একটু-আধটু নাড়াতে পারে। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছিলেন ফিজিওথেরাপি করালে অনেকটা ঠিক হয়ে যাবে। এখনও ফিজিওথেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। যা কিছু আমাকেই তো করতে হবে।
সেজদা এখন গান গাইছে, মা আমার ঘুরাবি কত চোখ বাঁধা বলদের মতো। কিছুটা জড়ানো গলা, তবে মাল খেয়ে গলা জড়ানোর সঙ্গে এই অস্পষ্টতার কতটা তফাত। আজকাল কথা বলার সময় মুখ দিয়ে লালা গড়ায় সেজদার। হাসপাতাল থেকে ফিরে সেজদাকে যখন বিছানায় শোয়ালাম ফের, সেজদা আমার পিঠে হাত দিয়ে মুখের লালা সমেত বলল—ভাল ছেলের বাপ, ভাল থাক। তোর ছেলে যেন মেত্তুনজয় হয়। বোধহয় মৃত্যুঞ্জয় বলতে চেয়েছিল সেজদা। মৃত্যুঞ্জয়ী কোন মহাপুরুষ? নাকি অক্রুর দত্ত লেনের মৃত্যুঞ্জয় সাধুখাঁ? সরষের তেলের কারবার। সকালে কাককে কচুরি খাওয়ায়। ওর জ্যাঠামশাইয়ের নামে দাতব্য হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারখানা। বাইরের ঘরে জ্যাঠামশাইয়ের পাথরের মূর্তি। সেজদাও যে আমার ছেলের জ্যাঠামশাই…।
হাসপাতালে ভরতি হবার তিন দিন পর জ্ঞান এসেছিল সেজদার। তারপরেও দিন তিন-চার লোক চিনতে পারত না। যেদিন চিনতে পারল আমায়, জড়ানো গলায় বলেছিল, একটু কুমুকে খবর দে।
কে কুমু?
কুমকুম।
সে কোথায় থাকে?
অবিনাশ কবিরাজ লেন৷
তখনও স্যালাইন চলছে।
তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল সেজদা। এর মধ্যে কম করে দশবার বলেছে, কুমুকে নিয়ে আয় একবারটি। ঠিকানাও দিয়েছিল। অসম্ভব। কী করে যাব ওখানে। শেষকালে সেজদা হাসপাতালের হাউসস্টাফকে নাকি একদিন বলেছিল সোনাগাছির দিকে যাতায়াত আছে ভাই? যদি যাও আমার একটা উপকার করবে? হাউসস্টাফটি আমাকে নালিশ করেছিল। সেজদার এই হাল দেখে শুধু ফ্যামিলি প্রেস্টিজ বাঁচাবার জন্য ওই কুমকুমকে খবর দেয়া করালাম। নিজে যাইনি। আমার এক বন্ধু আছে, অভয়, খুব ডেসপারেট। বিয়ের পর কনডোম কিনতে লজ্জা করত, ওকে নিয়ে কেনাতাম। ওকেই বললাম। ও বলল, নো প্রবলেম। একদিন হাসপাতালে এল ওই কুমু। কুমু কোথায়? এ তো চম্পা। সেজদা তো চম্পা বলেই ডাকত শুনেছি। সেই প্রায় বুড়ি, গালে মেচেতা। তবে চম্পা বুঝি আদরের ডাক?
সেজদার কপালে হাত বুলোল ওই কুমু কিংবা চম্পা। সেজদা বলল, এবার আমি সেরে যাব।
সেজদা গান গাইছে। বাড়িতে আজ ওই কুমু। সঙ্গে বোধ হয় কুমুর মেয়ে, বছর পঁচিশ বয়স হবে, আর বছরখানেকের একটি বাচ্চা। সকাল থেকেই নরক। খিস্তি, জোরে টেপ চালানো, স্টোভে রান্না সাঁতলানোর রসুন পিয়াজের গন্ধ…
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর একটা আয়া মতন রাখা হয়েছে। সেজদার রান্নাটাও করে দেয়। সুমিতা বাপের বাড়ি। বাচ্চাটার জন্যেই। বাচ্চাটাকে আদর করতে চাইত সেজদা, সুমিতা অ্যালাও করত না। ছেলেটাকে যখন তেল মাখিয়ে বারান্দার রোদুরে রাখত, সেজদা নাকি জুলজুল করে দেখত—সুমিতা বলেছে। হাসপাতালেও সেজদা বলত, পুচকুটাকে একবারটি একটু কোলে করে নিয়ে আয়। একটু দেখব।
বউকে এসব বলিনি। বউকে ওই কাঁথার কথাও বলিনি। ওই হাতিছাপ কাঁথা। ওই কাঁথা নিয়ে কোনও কথা সেজদাকেও বলিনি, আর একটু সুস্থ হোক, চার্জ করব। কাঁথা ক’টা ফিরিয়েও আনিনি আমি। সেজদার বিছানায় থাকা কাঁথাগুলি সুমিতা কিছুতেই ইউজ করত না।
সেজদা গান গাইছে। এখন শ্যামাসংগীত নয়। জিন্দেগী এক সফর হ্যায় সুহানা… সেজদার সঙ্গে গাইছে ওই বুড়িকুমু, ওর মেয়েটাও। আজ আয়াটা নেই, বোধ হয় ছুটি দিয়ে দিয়েছে। ওরা সব বারান্দায়। সেজদাও। সেজদা একটু-আধটু হাঁটতে পারে এখন। ফিজিওথেরাপি করালে আর একটু ভাল পারত নিশ্চই, করানো হয়নি। বাঁ হাতটা এখনও ভাল ভাবে নাড়াতে পারে না। একটা ফিজিওথেরাপিস্ট খোঁজ করতে হবে। গানটা কিন্তু ভালই গাইছে মেয়েটা। একটু উঁকি মারি। মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়। ওর নাকে ওটা কী? নাকছাবিটা কীসের? হিরের না? আমার মায়েরটা। না? বারান্দায় যাই। মেয়েটা গাইছে, আলোর কণা ঠিকরে পড়ছে মেয়েটার নাক থেকে। মায়েরটাই তো। সেজদা বুঝি মায়ের ওই গয়নাটা ওকে দিয়ে দিয়েছে। ছিঃ। আমি সেজদার দিকে কটমট করে তাকাই। সেজদা চোখ বুজে থাকে। ডান হাত দিয়ে ওর ডান হাঁটুতে তাল দিচ্ছে— হাসতে হাসতে জাঁহাসে গুজর। দুনিয়াকে তু পরোয়া না কর… সেজদা বলল, চুমকি মা, তুমি এবার একা একটা গান গাও। ওই মেয়েছেলেটার নাম বুঝি চুমকি? চুলে রিবন, কোলে বাচ্চা। ওই চুমকি বলল, ন- না—না, যেমন হচ্চে তেমন এক সঙ্গেই হোক। সেজদা বলল, আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল গা, গা নারে মেয়ে। চুমকি শুরু করল, বোল রাধা বোল…
ধুর থাকব না বাড়িতে। আজ দরজা এঁটেছিলাম, আর থাকা যাবে না, বড়দা-মেজদাদের তো এসব পোয়াতে হচ্ছে না, আমাকে দিয়েছে বাঁশ। সেরিব্রাল স্ট্রোকেও… ছিঃ বলতে নেই। নীচের তলায় বড়দার কাছে যাই। বলি, মায়ের স্মৃতিমাখা ওই হিরের নাকছাবিটার কথা। বড়দা মেজদাকেও ডাকল। আলোচনা হল। মেজবউদি তো বলেই ফেলল— অত যত্ন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রতিফল পাচ্ছ তো…। আমি বললাম, এই দুঃখেই ফিজিওথেরাপি করাচ্ছি না বউদি…। বড়বউদি বলল, দরকার নেই, একে তো নাচনি, তার উপরে ঢাকের বাড়ি আর নাইবা পড়ল। গুড় খেয়ে তোমার সেজদা পাটালি হাগে। আমরা মিটিং করে ঠিক করলাম, শত হোক, ভাই। ফেলে তো দিতে পারব না, সবাই মিলে টাকা দিয়ে, ছাতে একটা ঘর করে দিয়ে ওকে ওখানে চালান করে দেব। তিন তলাটায় আমিই পুরোটা থাকব। আমরা ভায়েরা পালা করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত পাঠিয়ে দেব। বাঁ অঙ্গ যেমন পড়ে গেছে, তেমনি থাক, পুরো ঠিকঠাক হয়ে গেলে আবার পেয়ে বসবে। মানে, গুড় খেয়ে পাটালি হাগবে। আর বাইরের মেয়েছেলে একদম ঢুকতে দেওয়া হবে না। মেজোবউদি বলল, নাকছাবিটা আমার কাছেই বেচতে পারত, ঘরের জিনিস ঘরেই থাকত। আমার নাকে ওটা দারুণ মানায়। একদিন পরেছিলাম, মা বেঁচে থাকতে। বড়বউদি বলল, যা না, ওই মাগীটার কাছ থেকে কিনে নে না। মেজবউদি বলল, পোবিত্তি হয় না।
বড়দার ঘরে খাওয়া দাওয়া করে বেলা তিনটে নাগাদ উপরে উঠেছি, একটু শোব। দেখি ক্যাওস্। সেজদার ঘরের জানালার সামনে চ্যাঁচ্যামিচি। ওই চম্পাবুড়ি, আর ওর মেয়ে, যার নাকে আমার মায়ের নাকছাবি, দু’জনেই চ্যাঁচ্যাচ্ছে, দরজা খোলো, খোলো বলছি, হারামির পো, বলছি খোলো… আর সব খিস্তি। আমায় দেখে ওই চুমকি বলল, দ্যাখো দ্যাখো, তোমার দাদা আমার ছেলেটাকে নিয়ে কী করচে। আমি জানালা দিয়ে দেখি সেজদা একটা গ্লিসারিন সাপোজিটার বাচ্চাটার পায়ুদেশে ঢোকাচ্ছে। প্যারালিসিস হয়ে যাওয়া বাঁ হাত দিয়ে গ্লিসারিন স্টিকটা বাচ্চাটার পিছনে ঢোকাবার চেষ্টা করছে। পারছে না, পিছলে যাচ্ছে। দরজার ছিটকিনি বন্ধ। দেয়ালে ভূতের ছবি। আমি চেঁচিয়ে বলি—এসব কী পাগলামি হচ্ছে সেজদা, দরজা খোল। সেজদা শুধু আমার দিকে একটু নির্বিকার তাকাল। কিছু বলল না। গ্লিসারিন স্টিকটা ঢোকাবার চেষ্টা করতেই থাকল। শেষ পর্যন্ত গ্লিসারিন স্টিকটা চালান করে দিল ভিতরে। তারপর বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল—আমার বুকে হেগে দে সোনামণি। আমার গায়ে হেগে দে।
আমি ওই মেয়েছেলেগুলোকে বললাম, ব্যাপারটা কী? চুমকি বলল, বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। খাটে শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় বসে পান সিগারেট খাচ্ছিলুম, হঠাৎ বাতাবিবাবু ঘরে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিল। তারপর দেখুন এইসব করছে!
মেজদার নাম বাতাবিবাবু? কত কী জানি না। কিন্তু গ্লিসারিন স্টিক ঢোকাচ্ছে কেন? গ্লিসারিন স্টিক সেজদার লাগে। ওর কনস্টিপেশন আছে।
বাচ্চাটা চ্যাঁচ্যাচ্ছে। মেয়েছেলে দুটোও। আমি বলি, ভাল হচ্ছে না সেজদা, দরজা খুলে দে। সেজদা পাত্তাই দিচ্ছে না। লালাময় মুখে বলছে, গোপাল আমার, কলজে আমার, ফুসফুস আমার, অক্সিজেন আমার, হেগে দে সোনা, আমার সারা গায়ে হেগে দে।
বাচ্চাটা সশব্দে পায়খানা করে সেজদার বুকে। সেজদার মুখে ফোটে পদ্মফুল।
সেজদা বাচ্চাটাকে বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে হলদে রং-এর অর্ধতরল ওই পদার্থের দিকে কেমন আনন্দে তাকাল। তারপর বালিশের তলা থেকে বার করে নিল হাতিছাপ কাঁথা। সেই কাঁথা। যে কাঁথায় প্রয়াগ স্নান করা সন্ন্যাসীর মতো গা মুছল সেজদা। ছিটকিনি খুলল ডান হাতে, বাঁ হাতটা অসহায় ঝুলছে।
ওরা চলে গেল। বিকেল নেমেছে। ইলেকট্রোপ্লেটিং কারখানার অ্যাসিডের গন্ধ মেখে দখিনা বাতাস অক্রুর দত্ত লেন-এ ঢুকে পড়েছে। আইসক্রিমওলা বেরিয়ে পড়েছে। সেজদা গান গাইছে।
সেজদা গান গাইছে বাথরুমে। মনরে কৃষি কাজ জানো না। বাথরুমে জলের শব্দ। দরজা খোলা। সেজদা মলমাখা হাতিছাপ কাঁথা জলকাচা করছে। ধরছে দু’হাতে। বাঁ হাতেও। আশ্চর্য, থুপথুপ। থুপথুপ। জলের শব্দ। থুথুপ। জলের ছিটে। থুপথুপ। হাতিছাপ। থুপথুপ। কাঁথার থেকে বেরিয়ে আসছে গান। সেজদা গান গাইছে।
শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৯৯৮