গন্ডারের খড়্গ – অমলেন্দ্রনাথ ঘটক
রাজা সুমিত্রের জলসাঘরে আজ যেন নতুন সূর্যোদয় হয়েছে। শুঙ্গ রাজাদের এখন বাড়-বাড়ন্ত। রাজা পুষ্যমিত্রের সাম্রাজ্যকে অনেক বিস্তৃত করেছেন তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র। অগ্নিমিত্রের পুত্র সুমিত্র সেই সাম্রাজ্যকে একটা বিশাল রূপ দিয়েছেন।
রাজা অগ্নিমিত্রের পুরুষবিদ্বেষ সর্বজন-বিদিত। গুপ্তঘাতকের ভয়েই হোক বা স্বেচ্ছায়ই হোক—তিনি নারী-সাজে সজ্জিত থাকতেন। রাজ-অন্তঃপুরের সর্বত্র রমণীদের দাপট ছিল অব্যাহত।
ছেলেবেলা থেকে সুমিত্র দেখছেন রাজপুরী জুড়ে চলেছে ব্যভিচার আর উচ্ছৃঙ্খলতার বেসাতি। রমণী এখানে পণ্যদ্রব্যের সামগ্রী। রাজা সুমিত্রের রানির অভাব নেই। বিদর্ভ, বিদিশা, কাশী, কোশল, কাঞ্চী—সর্বত্রই একটা করে বিবাহ করেছেন রাজা। তবু তাঁর নারীদেহের ক্ষুধা মেটেনি, ভোগ-বিলাসের শেষ হয়নি। নাচ-গান রাজার খুব প্রিয়। জলসাঘরে নিত্য নতুন নর্তকী না এলে রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে যান।
এদিকে রাজ্যের আশে-পাশে শত্রু আস্তানা পেতে বসে আছে। এরই মধ্যে যবনেরা দু-একবার মাথা তোলবার চেষ্টা করেছে। বৌদ্ধরা যবনদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
রাজ্যে যেটুকু শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় আছে তা মন্ত্রী বাসুদেবের জন্য। তিনি রাজা সুমিত্রকে সবসময় আড়াল করে রাখেন। পাটলিপুত্রের প্রান্তে গঙ্গানদীর ধার ঘেঁষে একদল যবন ছাউনি ফেলেছে। তারা নাকি ব্যবসা করতে চায়। অনেক বিচার করে মন্ত্রী বাসুদেব তাদের সম্মতি দিয়েছেন।
রাজা সুমিত্রের ভোগ-বিলাস মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন-নতুন নর্তকী ধরে আনবার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে রাজার চর সর্বদাই ব্যস্ত। কৌশাম্বীর প্রখ্যাত নর্তকী মালবিকা রাজার মনোরঞ্জন করে প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে গেছে। কাঞ্চীর নর্তকী প্রলভা তো একমাস রাজপুরীতে থেকে গেল। মন্ত্রী বাসুদেব অনেক চেষ্টা করেও রাজাকে এ-পথ থেকে সরিয়ে আনতে পারেননি। রাজা আজকাল রানি-মহলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন।
রাজা দিনের এবং রাতের বেশিরভাগ সময় জলসাঘরেই থাকেন। সুরাপান করে বিভোর হয়ে থাকেন। অনুচর মুলাদেব রাজাকে সবসময় পাহারা দেয়।
মুলাদেবের জীবনের একটা ইতিহাস আছে। রাজা সুমিত্র একবার মৃগয়া করতে গিয়ে এই শবর ছেলেটিকে দেখতে পান। ছেলেটিকে রাজার ভালো লাগে। তিনি ছেলেটিকে রাজপুরীতে নিয়ে এসে মানুষ করেন। সাপ ধরাই এদের পৈতৃক ব্যবসা। মুলাদেব ছেলেবেলায় নানারকম সাপ ধরে এনে রাজাকে সাপের খেলা দেখিয়ে চমক সৃষ্টি করত।
বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুলাদেব রাজার দক্ষিণ হস্ত হয়ে পড়ে। রাজার হুকুম সে-ই সকলকে জানিয়ে দেয়। সব বিভাগেই তার প্রচণ্ড আধিপত্য। অস্ত্র নির্মাণের কাজে তার জুড়ি নেই। বিভিন্ন সময়ে সে নানারকম অস্ত্র বানিয়ে রাজাকে উপহার দেয়। রাজা তারিফ করেন।
নগরের একপ্রান্তে রাজা মুলাদেবকে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে মুলাদেবের বাবা-মা-ভাইরা থাকে। মুলাদেব মাঝে-মাঝে বাড়ি যায়। বেশিরভাগ সময় রাজপুরীতে থাকে। যুবরাজ বজ্রমিত্র মুলাদেবকে সহ্য করতে পারে না, কিন্তু কিছু বলতেও পারে না।
ইদানীং রাজার নজর পড়েছে নর্তকী নয়নার দিকে। নয়না মগধেরই মেয়ে। কৈশোরে বাবার সঙ্গে বিদিশায় চলে যায়। সেখানে রাজনর্তকী সুধন্যার কাছে নাচ-গান শেখে। ক্রমে নয়নার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাবার সঙ্গে আবার মগধেই ফিরে এসেছে।
রাজার কানে নয়নার কথা উঠেছে। রাজার দূত গিয়ে নয়নাকে এত্তেলা দিয়েছে। নয়না এসে রাজার সঙ্গে দেখা করে গেছে। দুজনের মধ্যে নিভৃতে কথাও হয়েছে।
নয়নার উদ্ভিন্ন যৌবন, উপচে পড়া রূপের জৌলুস, আয়ত চোখ রাজার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। রাজার পাশে যখন নয়না এসে বসল, তখন যেন ঘরটা আলোয় ভরে গেল। রাজা নয়নার চিবুক ধরে মুখটা তুলে দেখলেন। সত্যি! নয়না সুন্দরী!
অনেক স্বপ্ন দেখছেন রাজা নয়নাকে নিয়ে। নর্তকী নয়নাকে বরাবরের জন্য জলসাঘরে রেখে দেওয়া গেলে তবে সকল সমস্যারই সমাধান হয়। রাজবধূ না করলেও রক্ষিতা হিসেবে রাখতে দোষ কী! রমণীর যৌবন আর ক’দিনের। বেচাল করলে রাজপুরী-ছাড়া করতেই বা কতক্ষণ!
এরই মাঝে রাজার মনে ভালোবাসার ছোঁয়া লেগেছে। রাজা মনে-মনে হেসেছেন—এ কী বিভ্রম! রাজাদের আবার প্রেম-ভালোবাসা বলে কিছু থাকে নাকি! রাত ফুরোলেই তো নেশা কেটে যায়! তখন চাই নতুন নারীদেহ। নতুন যৌবন।
মুলাদেবের ওপর ভার পড়েছে জলসাঘর সাজাবার। রাজপুরী থেকে কিছুটা দূরে দ্বিতল জলসাঘর। পিছনে সরোবর। চারদিকে রকমারি ফুলের বাগিচা।
দ্বিতলের মেঝেতে জাজিম পাতা। একপাশে রাজার উপবেশনের জন্য স্বর্ণময় আসন। দু-পাশে মখমলের তাকিয়া।
মেঝের ঠিক ওপরে একটা স্তিমিত ঝাড়লন্ঠন। ঝোলানো ঝাড়লন্ঠন একটা দড়ি দিয়ে ছাদের কড়ির সঙ্গে বাঁধা। ঝাড়লন্ঠনের দড়ি দূরে বাঁধা থাকবে। নৃত্যের তালে তা ওঠানামা করাবে মুলাদেব।
মুলাদেবের পরিকল্পনা রাজা সানন্দে অনুমোদন করলেন।
সন্ধে হতে-না-হতেই রাজা আজ জলসাঘরে এসেছেন এবং আসন গ্রহণ করেছেন। মুলাদেব কোষবদ্ধ তরবারি আসনের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। সুরাপান একাকী হয় না, তাই কয়েকজন মোসাহেব রাজার পদতলে বসে নানারকম মনোরঞ্জক কথা বলছে। মাঝে-মাঝে বিদূষক হাসির চমক সৃষ্টি করছে।
আকণ্ঠ সুরাপানে রাজা বেহুঁশ। এমনসময় নর্তকী নয়না প্রবেশ করল। তার বক্ষে শুধুমাত্র কাঁচুলি, কোমরে স্বল্প বেশ। চোখে আকর্ণ সুরমা টানা। পায়ে ঘুঙুর। নয়নার দেহে, মুখে যেন কামনার বহ্নি। তরঙ্গের মতো দুলছে তার দেহ। নৃত্যের তালে-তালে সৃষ্টি হচ্ছে নব মূর্ছনা। যন্ত্রী যেন তাল রাখতে পারছে না নর্তকীর সঙ্গে। রাজা সুমিত্র বিভোর হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে নয়না বারকয়েক বাহুবেষ্টন করে গেছে।
মুলাদেব তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বিশ্বস্তভাবে। নৃত্যের ছন্দে-ছন্দে সে ঝাড়লণ্ঠন ওঠানামা করাচ্ছে।
হঠাৎ একটা তোপধ্বনির আওয়াজ হল।
মুহূর্তে ঝাড়লন্ঠন সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। চারদিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল।
তবে কি যবনেরা রাজপুরী আক্রমণ করেছে! চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার ঘনিয়ে এল। রাজা সুমিত্র শশব্যস্ত হয়ে তরবারি কোষমুক্ত করতে গেলেন। সেই অন্ধকারের মধ্যে তীব্র আর্তনাদ করে রাজা সুমিত্র আসন থেকে নীচে পড়ে গেলেন।
মুলাদেব ছুটে এল। বাতি আনা হল। রাজা যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন। ডানহাত কাঁপছে।
রাজার দক্ষিণ হস্তে সর্প দংশন করেছে। সকলে প্রাণভয়ে নীচে নেমে গেল। শুধু মুলাদেব রাজার পাশে বসে তাঁর সেবা করতে লাগল।
খবরটা দাবানলের মতো রাজপ্রাসাদে ছড়িয়ে পড়ল। মন্ত্রী বাসুদেব এবং যুবরাজ বজ্রমিত্র ছুটে এলেন। রানিরাও খবর পেয়ে জলসাঘরে জমায়েত হলেন। রাজা সুমিত্রের দেহ ক্রমশ নিথর হয়ে পড়ল। ওঝা ডাকতে লোক ছুটল।
যুবরাজ বজ্রমিত্র চারপাশটা ভালো করে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে মন্ত্রী বাসুদেবকে বলল, দেখুন পিতৃব্য! তরবারির বাঁটটা রয়েছে, ফলাটা নেই!
যুবরাজ বজ্রমিত্র তরবারির কোষটা ভালো করে পরীক্ষা করল। দেখল, কোষের মধ্যে দু-তিনটে ছিদ্র রয়েছে।
ইতিমধ্যে ওঝা এবং রাজবৈদ্য এসে উপস্থিত হল।
ওঝা নানারকমভাবে রাজা সুমিত্রের দক্ষিণ হস্তের ক্ষতস্থান পরীক্ষা করল এবং বলল, বিষধর কালসর্পের দংশনে রাজার মৃত্যু হয়েছে। দংশন করেই সর্প প্রস্থান করেছে। এই ঘরে সর্প নেই। রাজাকে বাঁচানো আমার পক্ষে অসাধ্য।
রাজবৈদ্য নানারকম পরীক্ষা করে একই অভিমত ব্যক্ত করল।
সকলে ধীরে-ধীরে প্রস্থান করল। রাজার মৃতদেহ প্রহরীবেষ্টিত হয়ে জলসাঘরে শায়িত রইল।
চারিদিকে শোকের ছায়া নেমে এল। রাজপুরী থেকে ক্রন্দনের রোল শোনা যেতে লাগল।
পরদিন প্রভাতে সকলে রাজদরবারে সমবেত হল।
মন্ত্রী বাসুদেব অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে বললেন, রাজপদ কখনও শূন্য থাকে না। সুতরাং যুবরাজ বজ্রমিত্রকে শুঙ্গ বংশের রাজা করা হোক।
যুবরাজ বজ্রমিত্র বলল, পিতৃব্য, আগে আমার পিতার মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা হোক, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হোক—তবেই আমি সিংহাসনে আরোহণ করব।
মন্ত্রী বাসুদেব বললেন, বেশ, তাই হোক। গতকাল সন্ধ্যায় তোপধ্বনির যে-শব্দ হয়েছে তা আমাদের কামান থেকেই হয়েছে। কিন্তু তার আদেশ কে দিল?
মুলাদেব বলল, আমিই দিয়েছি, মন্ত্রীমহাশয়। কয়েকদিন ধরে কামানটি পরিমার্জনা করেছিলাম। রাজা সুমিত্র গতকাল আমাকে আদেশ করেছিলেন সন্ধ্যার সময় কামানটি পরীক্ষা করে দেখতে। তাই যন্ত্রশালার লোকদের অনুরোধ করেছিলাম তোপধ্বনি করতে।
উপস্থিত সকলেই মত প্রকাশ করল, রাজহত্যার পিছনে যবনদের চক্রান্ত রয়েছে। রাজপথে মাঝে-মাঝে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদেরও দেখা গেছে। শুধু বজ্রমিত্র মাথা নিচু করে সব শুনতে লাগল।
একজন বলল, রাজ-অস্ত্রশালায় যবনদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কারণ, রাজার পাশে যে-তরবারিটি পাওয়া গেছে তা যবনদের তরবারির ন্যায় খর্বাকৃতি।
মন্ত্রী বাসুদেব বললেন, এটি রাজার প্রিয় অস্ত্রের অন্যতম। রাজা এই খর্বাকৃতি তরবারিটি বহুদিন ধরে ব্যবহার করছেন।
—কিন্তু দ্বিতলে সাপ উঠল কী করে—সেটাই বড় রহস্য।—গম্ভীরভাবে বজ্রমিত্র বলল।
—কালসাপের অগম্য স্থান নেই।—একজন মন্তব্য করল।
—কিন্তু বেছে-বেছে রাজাকেই দংশন করল—এটাই আশ্চর্য! তাও আবার দক্ষিণ হস্তে! পায়ে কামড়ালেও একটা কথা ছিল।
—জাজিমের ভেতরেও থাকতে পারে। কেউ হয়তো লক্ষ করেনি।
নানারকম মন্তব্য শোনা গেল। কিন্তু আসল রহস্যের সন্ধান কেউ দিতে পারল না।
এইভাবে ক’দিন নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কেটে গেল। সকলেই বিমর্ষভাবে কাজকর্ম করে যেতে লাগল।
একদিন সন্ধ্যারাত্রে বজ্রমিত্র সবার অলক্ষে নয়নার বাড়ির কাছে গেল! শহরের শেষ প্রান্তে নয়নার বাড়ি। চারদিকে ঝোপঝাড়। জঙ্গলে ভরতি।
বজ্রমিত্র পা টিপে-টিপে নয়নার জানলার কাছে গেল। মৃৎপ্রদীপের স্তিমিতালোকে বজ্রমিত্র ঘরের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। ভেতরে একটা পালঙ্কের ওপর আধ-শোয়া অবস্থায় মুলাদেব, আর তারই পায়ের কাছে বসে নয়না কাঁদছে।
মুলাদেব : আর কেঁদে লাভ কী! রাজা তো আর বেঁচে উঠবে না।
নয়না : তুমি আমাকে নিষ্কৃতি দাও—আমি বিদিশায় ফিরে যাব।
মুলাদেব : তা কী করে হয়! তুমি একদিন এ-রাজ্যের পাটরানি হবে। রাজাকে যখন সরিয়েছি তখন রাজকুমারকে সরাতে কতক্ষণ?
—হত্যার মধ্যে দিয়ে আমি সুখ চাই না।
—আমি চাই। জানো তো নয়নে, এ-রাজ্যের প্রতীক গন্ডার। গন্ডারের জেদ আর একগুঁয়েমি আমি এদের কাছ থেকেই আয়ত্ত করেছি।
—যে-রাজা তোমাকে এত ভালোবাসতেন, তোমাকে সাধারণ অবস্থা থেকে এত বড় করলেন, তাঁকে সরাতে তোমার পাপবোধ হল না, দ্বিধা হল না!
—রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। তা ছাড়া রাজার ব্যভিচার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল—সুরাপানও মাত্রাতিরিক্ত করছিলেন।
—কিন্তু আমি তাঁকে সুপথে আনতে পারতাম, তিনি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন।
মুলাদেব অট্টহাস্য করে উঠল, বলল, রাজাদের ভালোবাসা! আমি অনেক তরুণীকে দেখেছি, সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়ে রাজদ্বারে বসে কাঁদছে। হায়রে হতভাগিনী!
—কিন্তু তুমি একদিন ধরা পড়বেই। তরবারির ফলা একদিন বের হবেই।
—অত কাঁচা কাজ আমি করি না, নয়না। তরবারির ফলা সকলের লক্ষ্যেই রয়েছে, অথচ অলক্ষ্যে। ইচ্ছে করলেই দেখা যায়।
মুলাদেব হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল, নয়নাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি অধীর হয়ো না, নয়নে। এসব একদিন স্তিমিত হয়ে পড়বে—তখন তোমাকে আমি তুলে নিয়ে যাব আমার ঘরে।
বজ্রমিত্র স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। সমস্ত ব্যাপারটা তার মনে এক অশান্ত ঝড় তুলল। কোনওরকমে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেল।
পরদিন বজ্রমিত্র তোরণদ্বারের পাশ দিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়াল। এ কী! তোরণদ্বারের নীচের ঘরটি খোলা! এই ঘরটি দিয়েই দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হয়। নীচে সবসময় প্রহরী থাকে। বজ্রমিত্র প্রহরীকে জিগ্যেস করল, এ-ঘর কে খুলেছে?
প্রহরী বলল, আজ্ঞে, মুলাদেব। কদিন আগে কিছু যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে সে ওপরে উঠেছিল। কোথায় নাকি মেরামতি করতে হবে। তারপর অনুমতির অভাবে ঘর বন্ধ করা হয়নি।
—সময়টা কখন?—বজ্রমিত্র জিগ্যেস করল।
—সন্ধ্যার কিছু পরে।—প্রহরী উত্তর দিল।
বজ্রমিত্র দ্রুতপদে তোরণশীর্ষে উঠে গেল। তোরণশীর্ষে যে-গন্ডারের প্রতিমূর্তি রয়েছে, তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই চক্ষু স্থির হয়ে গেল। কষ্টিপাথরের গন্ডারের শিংটি শ্বেতপাথরের। সেই শিং অপসৃত হয়ে প্রোথিত হয়েছে রাজা সুমিত্রের তরবারির ফলা।
ক’দিন নিঃশব্দে কেটে গেল। কেউ কিছুই বুঝতে পারল না। তবে বজ্রমিত্রকে বেজায় ব্যস্ত বলে মনে হল।
সেদিন সকালে রাজদরবারের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। রাজপুরীর সকল মানুষই এসেছে। এসেছে মুলাদেব, তার ভাই শুকদেব আর নর্তকী নয়না।
মন্ত্রী বাসুদেব একপাশে বসে আছেন।
বজ্রমিত্র আসন ছেড়ে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করল, আজ আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব রাজা সুমিত্রের হত্যার বিবরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরব। আপনারাই দোষী ব্যক্তির শাস্তি নির্ধারণ করবেন।
আপনারা অবগত আছেন, রাজা সুমিত্র কিছুদিন পূর্বে জলসাঘরে সর্পদংশনে মারা যান। প্রথমে একে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কতকগুলি কারণ এবং ঘটনায় আমার স্থির বিশ্বাস হল—এ-মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
প্রথমে, দ্বিতলে সাপ উঠল কী করে? এই প্রশ্নই আমাকে ভাবিয়ে তুলল। তারপর অকস্মাৎ তোপধ্বনি, ঝাড়লন্ঠনের পতন, ছিদ্রযুক্ত কোষ এবং ফলাবিহীন তরবারির বাঁট—আমাকে নিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিল যে, রাজাকে হত্যা করা হয়েছে।
কিন্তু হত্যাকারী কে? তার উদ্দেশ্যই বা কী? নানা চিন্তা আমার মাথায় এল। তখন এক-একটি চরিত্র বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। একটি লোকই আমার সামনে এল—সে মুলাদেব। মুলাদেব রাজার বিশ্বস্ত অনুচর। সে রাজার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। রাজার সব ক’টি বিভাগে তার অবাধ গতি। রাজার অনেক গোপন খবর সে জানে। সে বিভিন্ন সময়ে রাজাকে বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ করে দিয়েছে, রাজাও তারিফ করেছেন।
জলসাঘরে যে-তরবারিটি রাজার সঙ্গে ছিল তা যবনদের তরবারির অনুরূপ বেঁটেখাটো এবং বাঁকানো—যাতে সহজে সন্দেহ আসে কোনও যবন এ-হত্যার পেছনে আছে।
রাজার মৃত্যুর দিন সে তরবারি থেকে ফলাটা খুলে ফেলে, কোষে ছিদ্র করে এবং ভাই শুকদেবকে দিয়ে একটা বিষধর সাপ কোষে ঢুকিয়ে রেখে ফলাবিহীন বাঁট দিয়ে শক্ত করে আটকে রাখে। বন্দোবস্ত এমন নিখুঁত যে, রাজা তরবারির বাঁট ধরে টানলেই তা খুলে যাবে এবং সাপ তাঁকে ছোবল মারবে। এ-কাজে মুলাদেবকে সাহায্য করেছে তার ভাই শুকদেব, কারণ শুকদেব এখনও সাপ ধরার ব্যবসা করে।
কিন্তু এর জন্য চাই পরিবেশ।
পরিবেশ রচনায় মুলাদেব অত্যন্ত কুশলতার পরিচয় দিয়েছে। নিজেই ঝাড়লন্ঠনের ওঠা-নামার দায়িত্ব নিয়েছে। সে জানে, ঝাড়লন্ঠন ফেলে দিলেই সমস্ত জলসাঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।
অস্ত্রশালার লোকদের সাহায্যে সে অকারণে সেদিন তোপধ্বনির ব্যবস্থা করে। আমি অনুসন্ধান করে জেনেছি যবন এবং বৌদ্ধদের ছাউনিতে কোনও কামান ছিল না। আমাদেরই একটা কামানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।
মুলাদেব ধূর্ত। তরবারির ফলাটা সে ফেলে না দিয়ে তোরণশীর্ষে পাথরের গন্ডারের শৃঙ্গে স্থাপন করেছিল।
রাজা যখন সুরাপানে বেহুঁশ, তখনই সে তোপধ্বনির আওয়াজ শোনামাত্র ঝাড়লন্ঠনের দড়ি ছেড়ে দেয়। রাজা সন্ত্রস্ত হয়ে তরবারি বের করবার জন্যে বাঁটে হাত দিতেই তা খুলে যায় এবং কোষের মধ্যেকার সাপ রাজাকে দংশন করে। কোষের মধ্যে কয়েকটি ছিদ্র দেখে মনে হয় মুলাদেব সাপের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা রেখেছিল।
কিন্তু মুলাদেবের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য একটাই। নয়নাকে লাভ করা। বিদিশা থেকে ফিরে আসবার পর নয়নাকে দেখে সে মুগ্ধ হয় এবং নয়নাকে নানা প্রলোভনে বশীভূত করতে চায়। মুলাদেবের বাড়ির অনতিদূরে নয়নার বাড়ি। সে প্রতি সন্ধ্যায় একবার করে নয়নার বাড়ি যেত।
নয়না রাজার নজর কাড়লে মুলাদেবের ভয় হল—নয়না বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল। তা ছাড়া, রাজ-ঐশ্বর্যের প্রলোভন হয়তো নয়না ছাড়তে পারবে না। আমি এরই মধ্যে নয়নার বাড়ির পেছনদিক দিয়ে গিয়ে সমস্ত বাক্যালাপ শুনে আসি।
ক্ষমতা মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। মুলাদেবকে তাই করেছিল। সে শুঙ্গ বংশের পতন ঘটিয়ে শবর বংশের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। যে-রাজা তাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এনে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছিলেন—ক্ষমতার লোভে তাঁকেই হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি। রাজার মৃত্যুর পর তার কপট কান্না দেখে সকলেরই মনে হয়েছিল—তারই বুঝি পিতৃবিয়োগ হয়েছে। অথচ রাজাকে সেদিন অতিরিক্ত সুরাপান করিয়ে বেহুঁশ করার পরিকল্পনা তারই। এখন আপনারাই বলুন—এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হত্যা—এর কী শাস্তি হতে পারে?
—প্রাণদণ্ড! মৃত্যু! হত্যার বদলে হত্যা!
মন্ত্রী বাসুদেব উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, মুলাদেব সারাজীবন কারারুদ্ধ থাকবে। প্রাণদণ্ড দিলে সে অনুশোচনার সময় পাবে না।
মন্ত্রী বাসুদেবের প্রস্তাব জনতা অনুমোদন করল।
শুঙ্গরাজের কারারক্ষী মুলাদেবের দিকে অগ্রসর হল।
মাসিক রহস্য পত্রিকা
পুজো সংখ্যা, ১৯৮৫