গদ্যের কথা
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল। এটা কী? কবিতা। আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে। এটা কী? কবিতা। রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার ওপরে বসলো রাজা। এটা কী? কবিতা। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? এটা কী? কবিতা। ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনি বহিয়া যায়। এটা কী? কবিতা। আপণা মাংসে হরিণা বৈরী। এটা কী? কবিতা। কবিতায় ভ’রে আছে বাঙলা ভাষা। ছন্দে মিলে সাজানো শব্দগুচ্ছ : কবিতা বা পদ্য।
আমরা কেউ কবিতায় কথা বলি না। কথা বলার সময় ছন্দে মিলে সাজিয়ে দিই না ভাষা। রান্নাঘরে বেড়ালের লড়াই দেখে কেউ বলবে না : ‘আম্মা আবার রান্না ঘরে বেড়াল ঢুকে লড়াই করে।’ ‘গরু’ সম্পর্কে রচনা লিখতে দিলে কেউ লিখবে না : ‘আমরা সকলেই ভালো ক’রে জানি। গরু আর ষাঁড় সব চতুষ্পদ প্রাণী। রাখালের আগে আগে ধীরেধীরে যায়। মাঠে গিয়ে খুশি হয়ে কতো ঘাস খায়।’ এমন আজ আর কেউ লিখবে না। কিন্তু লিখতো তিনশো কি চারশো কি পাঁচশো বছর আগে। কেননা তখন গদ্যে কিছু লেখার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। প্রায় সব কিছু লেখা হতো কবিতায় বা পদ্যে, ছন্দে-মিলে সাজিয়ে।
বাঙলা ভাষার আদি ও মধ্যযুগ ভ’রে ছিলো কবিতা। পদ্য। বাঙলা ভাষায় লেখা ওই সময়ের যা কিছু পাওয়া গেছে, তার শতকরা নিরানব্বই ভাগেরও বেশি হচ্ছে পদ্য। তার মানে কি আগের মানুষ কথাও বলতো কবিতায়? পদ্যে? প্রতিটি বাঙালিই ছিলো তখন কবি? মাঠের রাখাল কবি, নদীর জেলে কবি? ঘরের বউ কবি? বাজারের মুদি কবি? নিশ্চয়ই এমন ছিলো না। তারা সকলেই কবি ছিলো না, তবে কেউ কেউ ছিলেন কবি। মানুষ তখন কথা বলতো গদ্যেই—সহজ সরল সাধারণ ভাব বিনিময় করতো না-সাজানো না-গোছানো শব্দে। কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টির উৎসাহ জাগলেই তাদের মনে দোলা দিতো ছন্দ, গুণগুণিয়ে উঠতো মিল। ওই পদ্যের একটা বড়ো অংশই অবশ্য গদ্যের মতো। কিছু অংশ তো গদ্যের চেয়েও গদ্য। গদ্য দরকার পড়ে প্রতিদিনের জীবন নির্বাহের জন্যে; বক্তব্য আর চিন্তা প্রকাশের জন্যে। আমাদের আদি ও মধ্যযুগের পূর্বপুরুষেরা প্রতিদিনের জীবন যাপন করতেন আটপৌরে গদ্যেই। কিন্তু তার কোনো উদাহরণ কালিতে কাগজে বাঁধা পড়ে নি। মুখ থেকে বেরিয়ে মুখর গদ্যভাষা মিশে গেছে অনন্তে। বক্তব্য আর চিন্তা প্রকাশের কোনো প্রয়োজন ছিলো না তাদের? যেমন প্রয়োজন এখন আমাদের? ছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু তা আজকের বাঙালির প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। আর ওই প্ৰয়োজন মিটে যেতো গদ্যেরই যমজ বোন পয়ার ছন্দে।
এখন তো লিখিত বাঙলা ভাষার পঁচানব্বই ভাগই গদ্য। সহজ সরল, দুরূহ জটিল, শুদ্ধ অশুদ্ধ, সুন্দর অসুন্দর নানারকম গদ্যে পূর্ণ লিখিত মুদ্রিত বাঙলা ভাষা। গদ্যই বাঙলা ভাষা, এমনও মনে হয় অনেকের। বাঙলা ভাষার যখন জন্ম হচ্ছিলো, তখন কেউ গদ্য লেখে নি। মধ্যযুগের শুরুতেও যে গদ্য লেখা হয়েছিলো, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ষোলো শতকেই লিপিবদ্ধ হয় বাঙলা গদ্য। তবে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার কোনো ধারাবাহিক বিকাশ ঘটেনি। এ-সময়ে পাওয়া যায় নড়োবড়ো, বিকল, অদ্ভুত গদ্য। তখনকার বাঙলা গদ্য ও পদ্যের অবস্থা দেখে প্রশ্ন জাগে—যা হাঁটতেই শিখলো না তা এমন নাচ শিখলো কেমন ক’রে? পদ্য তখন নেচে চলেছে, গদ্য চলছে খুঁড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে। ১৫৫৫ থেকে ১৭৪৩ পর্যন্ত সময়টা বাঙলা গদ্যের খুঁড়িয়ে চলার কাল। এ-সময়ে অনেক দলিলদস্তাবেজ, চিঠিপত্র লেখা হয়েছে গদ্যে; আর বৈষ্ণব সাধকদের কিছু কিছু গ্রন্থের কোনো কোনো অংশ লেখা হয়েছে গদ্যে। খুবই গরিব এ-গদ্য। তবে তা বাঙালি গদ্য। কেননা এগুলো লিখেছিলেন মোটামুটিভাবে বাঙালিরাই। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে বিদেশিদের কলমে রচিত হয় বাঙলা গদ্য। এতোদিন যা দেশীয় রীতিতে খোঁড়াচ্ছিলো, ১৭৪৩-এ তাতে লাগে বিদেশি- পর্তুগিজ-খোঁড়ানোর ঢঙ। কিন্তু তখন বাঙলা গদ্য স্থির ক’রে ফেলেছে যে তাকে শক্তি আয় করতে হবে, সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। যেতে হবে অনেক দূ র। দাঁড়াতে হবে দুপায়ে। পা ফেলতে হবে স্থিরভাবে। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বেশ স্থির হয়ে ওঠে গদ্য। তারপর দ্রুত আধশতকেই বাঙলা গদ্য এতো শক্তি আর পেশি অর্জন করে যে নাচ বন্ধ হয় বাঙলা ভার। দিকে দিকে ছন্দের নর্তকীরা নূপুর খুলে ফেলে। নৃত্যের কাল শেষ হয়েছে; শুরু হয়েছে পদযাত্রার কাল।
আসামের তেজপুর থেকে প্রকাশিত “আসামবন্তি” পত্রিকায় ১৯০১ অব্দের জুন মাসের ২৭ তারিখে বাঙলা ভাষায় লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। চিঠিটি, ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে, লিখেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ, অহোমরাজ স্বর্গনারায়ণের কাছে। এ-চিঠিতেই খচিত হয়ে আছে বাঙলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো গদ্যের রূপ। এর ভাষা আর ভাব দুই-ই বেশ সহজ সরল। পরে যে-ভাষাকে সাধুভাষা বলা হয় চিঠিটিতে তারই সূচনা ধরা পড়ে। চিঠিটির কিছু অংশ এমন :
লেখনং কার্যঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরি বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়ত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত রহে। তোমার আমার কর্তব্যে সে বর্দ্ধিতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগতে আছি তোমারো এ গোট কৰ্ত্তব্য উচিত হয় না কর তাক আপনে জান। অধিক কি লেখিম।
রাজার কাছে রাজার লেখা রাজকীয় চিঠি এটি। সম্বোধনে একটি ‘আপনি’ এখানে প্রত্যাশা করি; কিন্তু এতে পাওয়া যায় ‘তোমার’। তাই বোঝা যায় ষোলোশতকে রাজাদের কাছেও অপরিচিত ছিলো ‘আপনি’। যে- সব চিঠিপত্র পাওয়া গেছে তাতে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে সম্বোধন। আজকাল আমরা যেখানে ‘প্রিয়’, ‘জনাব’, ও প্রচণ্ড কাউকে সম্বোধন করতে গেলে বড়জোর ‘মাননীয়’ বা ‘মহামান্য’ লিখি সেখানে ওইসব পুরোনো চিঠিতে পাওয়া যায় লোমহর্ষক সব সম্বোধন। যাদের সম্বোধন করা হয়েছে ওইসব পত্রে, তারা কেউ ‘প্রচণ্ড প্রতাপ’, কেউ ‘প্ৰবল প্রতাপ’, কেউ ‘মহোগ্র প্রতাপ’, আবার কেউ ‘গঙ্গাজল নিরমল পবিত্র কলেবর’। ১৭৮৮ অব্দে লেখা এক আবেদনপত্রের রোমহর্ষক ও নিরর্থক সম্বোধন এমন :
স্বস্তি প্রাতরূদীয়মানাকমণ্ডল নিজভুজবল প্রতাপতাপিত সক্ৰসমূহ পূজিতাখীল রাজ্যেশ্বর মহামহিম শ্রীযুত মশীরাখাষ হুজুর সুলতানল গোলেস্তান ও বুনিয়ান জব্ধয়েণ আজীমঃশান শেফাহসালার আফোআজ বাদসাহি ও কম্পেনী কেশওরে হিন্দোস্থান গবনর জনরেল চারলষ লাট করণওালশ বাহাদোর বিশম শমরাট বৈরীকুল করিকুম্ব বিদারণ কেশরীবর মহোগ্র প্রতাপেষু।
কী করা যাবে। প্রচণ্ড প্রতাপেরা সিংহাসন আর সম্বোধন খুব ভালোবাসে। ভাষার তাতে প্রাণ থাক না থাক কিছু যায় আসে না। সতেরো-আঠারো শতকের যে-সব চিঠিপত্র দলিল পাওয়া গেছে, তাতে আরবিফারসি শব্দের বাদশাহি চোখে পড়ে। এখন অনেকেই ওই বাঙলা ভাষার অর্থ বুঝে উঠতে পারবে না। একটি দলিলের অংশ :
ইহার মৌধ্যে পরগনা পরগনাতে দেওড়া ও মুরুত তোড়িবার আহাদে হুজুর থাকিয়া পরোয়ানা লইয়া আর আর পরগনাতে দেওড়া ও মুরুত তোড়িতে লাগীল। এ বার্তা মুনিয়া ঠাকুর রামজীবন মৌলিকের বাড়িতে বাহির বাড়িতে আসিয়া রহিলা রাম সম্মা ও ভগীরথ সম্মা ওগয়রহ ঠাকুরের সেবা ও চৌকী পহরা রাত্রিদিন আছিল তাহার পর ২৭ মহররম মাহে ২৮ জৈষ্ট ঠাকুর দেখিবার…….
বেশ রুগ্ন বাঙলা। তবে দলিল, আবেদন, বিজ্ঞপ্তির বাঙলা এখনো বেশ রুগ্ন।
সতেরোশতক থেকে বৈষ্ণব সাধকেরা কখনো গদ্যে কখনো পদ্যে- গদ্যে এক ধরনের শাস্ত্রীয় রচনা লেখা শুরু করেন। রচনাগুলোর নাম ‘কড়চা’। ধারাবাহিক গদ্যের স্রোত নেই এগুলোতে। মনে হয় এইমাত্র ভাষা অর্জন করেছে এমন কোনো শিশু প্রশ্ন করছে, আর উত্তর পাচ্ছে তারই মতো আরেকজনের থেকে। একটি কড়চার অংশবিশেষ এমন :
তুমি কি। আমি জীব। তুমি কোন জীব। আমি তটস্থ জীব। থাকেন কোথা। ভাণ্ডে। ভাণ্ড কীরূপ হইল। তত্ত্ব বস্তু হইতে। তত্ত্ব বস্তু কি? পঞ্চ আত্মা। একাদশেন্দ্র। ছয় রিপু ইচ্ছা এই সকল এক যোগে ভাণ্ড হৈল।
বৈষ্ণবদের যে-সব শাস্ত্রীয় রচনা পাওয়া গেছে সতেরো-আঠারো শতকের তাতে যে-গদ্য পাই, আর তাতে প্রকাশ করা হয়েছে যে-ভাব, তা খুবই তুচ্ছ। মনে হয় বাঙালি তখনো বলার মতো বক্তব্যই খুঁজে পায় নি I তাই ভাষা পাবে কোথা থেকে? জটিল কাহিনী বলার বেদনা তখনো জাগে নি তার মনে, বিশ্বজ্ঞানের কোনো এলাকাই ব্যাখ্যার বিষয় হয়ে ওঠে নি. তার। তাই স্রোতের মতো তার বুক থেকে উৎসারিত হয় নি গদ্যভাষা। তবে আঠারোশতকে রচিত দু-একটি রচনা পাওয়া গেছে যাতে খুঁড়িয়ে-জিরিয়ে- থেমে চলা গদ্য এগিয়েছে স্বাভাবিকভাবে। যেমন পাওয়া যায় আঠারোশতকের ‘মহারাজ বিক্রমাদীত্যচরিত্র’ নামের কাহিনীটিতে :
মোং ভোজপুর শ্রীযুত ভোজরাজা তাহার কন্যা নাম শ্রীমতি মৌনাবতি সোড়ষ বরিস্যা বড় সুন্দরি মুখ চন্দ্রতুল্য কেষ মেঘের রঙ্গ চক্ষু আর্কন পর্যন্ত যুঙ্গ্য ভ্রূর ধনুকের নেয়ায় ওষ্ঠ রক্তিমে বর্ণ হস্ত পদ্মের মৃণাল স্তন দাড়িম্ব ফল রুপলাবন্য বিদ্যুৎছটা তাহার তুলনা আর নাঞী এমন ষুন্দরি সে কন্যার বিভাহ হয় নাঞী কন্যা পন করিয়াছে রাত্রের মধ্যে জে কথা কহাইতে পারিবেক তাহাকে আমি বিভা করিব।
আজকের ব্যাকরণ অনুসারে এটিতে ভুলের মেলা ব’সে গেছে। কিন্তু বোঝা যায় কথক বলার মতো একটি গল্প পেয়ে গেছেন, আর তিনি তা চমৎকারভাবেই বলবেন। কন্যাটিকে বড়োই দেখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে হয় তাকে রাত পোহানোর আগেই কথা কহাই!
আসে অবিস্মরণীয় অব্দ ১৭৪৩। এ-বছরই প্রথম, সুদূর লিসবন শহরে, বাঙলা ভাষা মুদ্রাযন্ত্রস্থ হয়। মুদ্রিত হয় বাঙলা ভাষা। তবে বাঙলা বর্ণমালায় নয়, রোমান বর্ণমালায়। মুদ্রিত হয় তিনটি বই। একটির নাম ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক-সংবাদ। অন্য দুটির নাম কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ ও ভোকাবুলিরও এম ইদিওমা বেনগল-া, ই পোরতুগিজ। প্রথমটির লেখক বাঙালি। কিন্তু তিনি খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ ক’রে হয়ে গিয়েছিলেন খ্রিস্টান। তখন নাম হয়েছিলো তাঁর দোম আন্তোনিয়ো। অন্য দুটির প্রণেতা-সংকলকের নাম মনোএল দা আসসুম্পসাঁউ। প্রথম বই দুটিতে পাওয়া যায় বাঙলা গদ্যের নমুনা। তৃতীয়টি একটি শব্দকোষ ও ব্যাকরণপুস্তক। দোম আন্তোনিয়ো বাঙালি ছিলেন। খ্রিস্টান হয়ে তিনি যখন জেসাসের ধর্মের উৎকর্ষ প্রমাণে উদ্যোগী হলেন, তখন তাঁর বাঙলা ভাষার ওপর নিশ্চয়ই প্রভাব ছড়িয়েছিলো লাতিন বাক্যের গঠন। খ্রিস্টধর্মের মূল কথা আয়ত্ত করার জন্যে কিছুটা লাতিন তিনি নিশ্চয়ই আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর বইটি লিখেছিলেন সতেরোশতকের শেষ দিকে। সাধু গদ্যের অনেক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছিল তাঁর রচনায়। তাঁর রচিত কথোপকথন এমন :
ব্রাহ্মণ।—তুমি কারে ভজো।
রোমা।—পরমেশরেরে পুর্ণো ব্রমেরে।
ব্রাহ্মণ।—তবে তোমোরা বরো উতম ভজোনা ভজো, আমোরা তাহারে ভজি।
রোমা।—যদি তোমোরা সেই পূর্ণ ব্রমেরে ভজো তবে কেন এত কুরিত (কুরীত) কুধরাণ নানা অধর্ম্মো ভজানো দেখি।
রোমান অক্ষরে লেখা বাঙলা ভাষাকে বাঙলা বর্ণমালায় ঢাললে কিছুটা হারিয়ে যায়ই। অনেক শব্দের উচ্চারণ রোমান অক্ষরে হয়তো প্রকাশ করতে পারেন নি আন্তোনিয়ো; আবার তাঁর রোমান বর্ণে খচিত বাঙলাকে বাঙলা বর্ণমালায় প্রকাশ করতে গিয়ে কিছুটা হয়তো পিছলে গেছেন আধুনিক গবেষকরা। দোম আন্তোনিয়ো রামায়ণকাহিনী বলেছেন এমন গদ্যে :
রামের এক স্ত্রী তাহার নাম সীতা, আর দুই পুত্রো লব আর কুশ তাহান ভাই লকোণ, রাজা অযোধ্যা বাপের সত্যো পালিতে বোনবাসী হইয়াছিলেন, তাহাতে তাহান স্ত্রীরে রাবোণে ধরিয়া লিয়াছিলেন, তাহার নাম সীতা, সেই স্ত্রীরে লঙ্কাত থাক্যা আনিতে বিস্তর যুর্দো করিলেন, বালিরে মারি তাহার স্ত্রী তারা সুসীরেরে দিলেন, সে বালির ভাই, তাহারে রাজ খণ্ডো দিলেন; বিস্তর রাখ্যেস বধ করিলেন; কুর্মোকর্ণো বধিলেন, ইন্দ্রোজিৎ বধিলেন, প্ৰছাতে রাবোণ বধিয়া সীতারে আনিলেন।
এ-ভাষা দেখে মনে হয় গল্প বলতে গেলে গদ্য বেশ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু চিন্তা প্রকাশ করতে গেলেই বিপদ বাঁধে। হোঁচট খেতে থাকে ভাষী ও বাঙলা ভাষা।
১৭৪৩-এ বাঙলা গদ্য চ’লে যায় ইউরোপিদের হাতে : ধর্মযাজক তাকে দীক্ষা দেন, ব্যাকরণপ্রণেতা অভিধানসংকলক তাকে শাসন করেন, আইনপ্রণেতা তাকে বিধিসম্মত করতে চান। বাঙলা ভাষার মানরূপ তখনো স্থির হয় নি, তাই বিদেশিদের পক্ষে বাঙলা আয়ত্ত ও প্রয়োগ করা খুব সহজ ব্যাপার ছিলো না। তাঁদের শিখতে হয়েছে আঞ্চলিক বাঙলা ভাষা, লিখতে হয়েছে গ্রন্থের বাঙলা ভাষা। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা তাঁদের প্রকাশ করতে হয়েছে বক্তব্য। বাঙলা ভাষা প্রথম বক্তব্য প্রকাশ করতে শেখে ইউরোপিদের হাতে। বিদেশিদের বাঙলা গদ্যেই প্রথম প্রকাশ পায় বক্তব্য। তাঁদের গদ্যে ভুল আছে নানা রকম, আছে বিদেশি ঢঙের হোঁচট খাওয়ার ঘটনা, রয়েছে শব্দের অপপ্রয়োগ; তবে তাঁরাই সূচনা করেন ধারাবাহিক গদ্যের ধারা। তাঁদের বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে ধর্ম, ভাষাতত্ত্ব, আইন, এবং আরো অনেক কিছু।
বাঙলা ভাষায় প্রথম বিদেশি গদ্যলেখক পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ। তাঁর বইয়ের নাম “কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ”। আসসুম্পসাঁউও কাহিনী বলার সময় বেশ স্বাভাবিক; কিন্তু যেই কথা বলতে শুরু করেছেন বা রচনা করেছেন প্রার্থনাসঙ্গীত, অমনি তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে বিদেশির বাঙলা। তাঁর কাহিনীর গদ্য এমন :
হিস্পানিয়া দেশে মাদ্রিদ শুহরে দুই গলিম পুরুষ আছিল: বিস্তর দিন তাহারা একজনে আর জনেরে তালাশ করিয়াছিল দাদ তুলিবার কারণ। কষ্টের দিন ছয় ঘড়ি দুই পহর বাদে তাহারা জনে জনেরে লাগাল পাইল, লাগাল পাইয়া দুইজনে ও তরোয়াল খসিয়া মারামারি করিল। যে জনে বেশ তেজবন্ত সে আরো এক চোট দিল, সে মাটিতে পড়িল, পরাজয় হইল।
বোধ হয় আসসুম্পসাঁউর এ-বাঙলার ওপর প্রভাব ফেলেছে তাঁর মাতৃভাষা পর্তুগিজ। ঢাকার আঞ্চলিক বাঙলা এখানে আছে প্রকাশ্যে, গোপনে হয়তো আছে পর্তুগিজ বাক্যের গঠন।
পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল দা আসসুম্পসাঁউ যখন বাঙলা গদ্য লেখেন ও প্রকাশ করেন দোম আন্তোনিয়োর লেখা বই, তখন তিনি জানতেন না যে আন্তোনিয়ো ছাড়া কোনো বাঙালি তাঁরও আগে লিখেছিলেন বাঙলা গদ্য।
আসসুম্পসাঁউর সাড়ে তিন দশক পর যখন ইংরেজরা বাঙলা ভাষায় উৎসাহী হন, উদ্যোগী হন বাঙলা ভাষা শিখতে ও শেখাতে, এবং রচনা করেন বাঙলা গদ্য, তখন তাঁরা জানতেন না যে তাঁদের আগে আদৌ কেউ লিখেছিলেন বাঙলা গদ্য। তাঁদের সামনে ছিলো একটি সত্য; – বাঙলা সাহিত্য গদ্যহীন। এটা সত্য ছিলো তাঁদের জন্যে, কেননা বাঙলা গদ্য রচনার সময় কোনো নমুনাই উপস্থিত ছিলো না তাঁদের সামনে। তাই তাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো শুরু ও শূন্যতা থেকে। কিন্তু তাঁরা অল্প সময়ের মধ্যে বাঙলা ভাষাকে ভ’রে দেন বিভিন্ন রকম গদ্যে, এবং সৃষ্টি করেন বাঙলা গদ্যের অবিরাম ধারা। তাঁদের নিজেদের লেখা হয়তো অসাধারণ ছিলো না, ছিলো তাতে বহু ভুলভ্রান্তি। তাঁদের লেখা বহু বাক্য হাস্যকর। কিন্তু বাঙলা গদ্যের অবিরাম ধারা সৃষ্টিতে ইংরেজের দানকে অস্বীকার করা যায় না। এক সময় বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকেরা বাঙলা গদ্য সৃষ্টির প্রায় সমস্ত কৃতিত্ব দিতেন তাঁদের। এখন চলছে তাঁদের কৃতিত্ব অস্বীকারের সময়। বাঙালি সম্ভবত কখনো সত্যের মুখোমুখি হবে না।
আঠারোশতকে ইংরেজরা ব্যাকরণ-অভিধান প্রণয়ন করেছেন, ও বাঙলা গদ্যে অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন আইন। ওই বাঙলায় অনূদিত আইনগুলোতেই প্রথম বাঙলা ভাষায় প্রকাশ পায় জটিল বক্তব্য, ও রচিত হয় মিশ্রজটিল বাক্য। এ-গ্রন্থগুলোর গদ্যের সাথে পুরোনো বাঙলা গদ্যের দুস্তর পার্থক্য। মনে হয় এই প্রথম পরিবেশিত হলো বাঙলা গদ্যে উল্লেখযোগ্য চিন্তা-বক্তব্য। এ-গ্রন্থগুলোতেই বপন করা হয় আধুনিক বাঙলা গদ্যের বীজ। আইনের বাঙলা অনুবাদগ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে জোনাথন ডানকানের দেওয়ানি আইনসংক্রান্ত ইম্পেকোডের বাঙলা অনুবাদ (১৭৮৫), বেনজামিন অ্যাডমনস্টোনের ফৌজদারি আইনসংক্রান্ত গ্রন্থ (১৭৯৩), ও হেনরি পিটস ফরস্টারের কর্নওয়ালিশ কোড (১৭৯৩)। ডানকানের গদ্য এমন :
সদর দেওয়ানি আদালতে যদি কোন সাক্ষী আজ্ঞা মতো সাক্ষাৎ না আইসে অথবা সাক্ষাৎ আসিয়া সুকৃতি না করে কিম্বা সাক্ষি পত্র লিখিয়া তাহাতে স্বাক্ষর করিতে না চাহে কিম্বা আপন অভিপ্রায় মতে অথবা কিছু গ্রহণ করিয়া মিথ্যা সাক্ষি দেয় কিম্বা কচহরির মধ্যে আদালতের অসম্মান করে তবে তাহার সমুচিত জন্যে পূর্ব্বে মপস্বল আদালতের ব্যবস্থাপক সাহেবের দিগের যে মত অধিকার লেখা গিয়াছে সদর দেওয়ানি আদালত হইতে ও সেই মত সমুচিত হবেক–
এখনকার মানদণ্ডে কিছুকিছু ত্রুটি থাকলেও এ-গদ্যকে চমৎকার না ব’লে উপায় নেই। আজকের বহু বাঙালির পক্ষেও ওপরের পংক্তিগুচ্ছ রচনা করা কঠিন।
খুব ভালো হয়েছিলো যে ইংরেজ ধর্ম নিয়ে বাঙলা গদ্যচর্চায় নামে নি। কিন্তু অল্প পরেই মহাসমোরোহে ধর্ম এসে উপস্থিত হয়। বাইবেলের বিভিন্ন অনুবাদের মুদ্রণে মুখর হয়ে ওঠে মুদ্রাযন্ত্র। বাইবেলে বাইবেলে হিব্রু লাতিনের অনুকরণে রচিত হয় একরকম অদ্ভুত স্বাদযুক্ত বাইবেলি বাঙলা গদ্য, যার কিছু অংশ হাস্যকর, কিছু অংশ অভাবিত, আর কিছু অংশ মহান। বাঙলা বাক্যের পদক্রম নানাভাবে এলোমেলো হয়ে যায় বাইবেলের মূল ভাব আর বাক্যের গঠন শুদ্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টায়। ধর্মগ্রন্থ সব সময়ই বাঙলায় অনূদিত হয়েছে বেশ বিশ্রী ভাষায়—সম্ভবত অনুবাদকেরা ঈশ্বরের ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেছেন বারবার আর পীড়ন নির্যাতন চালিয়েছেন নিরীহ বাঙলা ভাষার ওপর। এমন একটি অনুবাদ হচ্ছে মঙ্গল সমাচার মতীয়ের রচিত (১৮০০)। এটির অনুবাদক টমাস ও রামরাম বসু; সংশোধক উইলিয়াম কেরি। এতেই সূচিত হয় বাইবেলি বাঙলা গদ্য :
সে দিনে য়েশু ঘর হইতে যাইয়া বসিলেন সমুদ্রের তিরে। এবং হেন বড় মানব্য একত্তর হইল তাহার স্থানে তাহাতে জাহাজে যাইয়া বসিলেন ও সকল মানব্য তটের উপরে ডাণ্ডাইল। এবং তিনি হিত উপদেশ কহিলেন অনেক বিষয় তাহারদিগের বলিয়া দেখ এক বীজ বুনক বীজ বুনিতে গিয়াছে। বুনিতে ২ কিছু পড়িল পন্থের পার্শ্বে ও পক্ষেরা আসিয়া তাহ গ্রাস করিল।
এতে বিলেতি বাঙলা গদ্যের কিছু লক্ষণ সহজেই চোখে পড়ে।
কেউকেউ বাঙলা না শিখেই অন্যদের বাঙলা শেখাতে চেয়ে পরিণত হয়েছেন উপহাস্যকর উদাহরণে। জন মিলার সিক্ষ্যাগুরু প্রকাশ করেছিলেন ১৭৯৭ অব্দে, যখন তিনি নিজেই ঠিক মতো আয়ত্ত ক’রে উঠতে পারেন নি বাঙলা ভাষা। ‘সিখাইতে তোমারদিগেরকে ইঙ্গরাজি কথা সহজে আর অনাআসে’, বা ‘অয়েব আমি বিবেচনা করিয়া এ তরজমা করিয়াছি চলতি কথার দ্বারায়’ ধরনের বিলেতি বাঙলা লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন মিলার।
তবে তাঁদের সবার বাঙলা গদ্য এমন নয়। অবশ্য বিলেতি বৈশিষ্ট্য তাঁরা বাঙলায় খচিত করেছেন নানাভাবে। ‘আমরাও দেখিলাম না তাহারে’ বা ‘বির্ধকালে পুণ্যে পুর্ণিৎ মরিয়া চলিয়া গেল স্বর্গে’, বা ‘আত্মা স্বর্গে গেল উড়িয়া’, বা ‘সে এক পুত্র জর্মাইল’ ধরনের বিদেশি বাঙলা জ্বলজ্বল ক’রে ওঠে মাঝেমাঝেই।
১৮০১ সালে শুরু হয় আধুনিক বাঙালির বাঙলা গদ্যের ধারা। এ-বছর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে বেরোয় বেরোয় রামরাম বসুর “রাজা প্রতাপাদিত্যচরিত্র”। দেড় দশক ধ’রে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাঙালি পণ্ডিতেরা সংস্কৃত থেকে আঞ্চলিক শব্দে অবিরাম যাতায়াত ক’রে নানাভাবে বাড়িয়ে দেন বাঙলা গদ্যের শক্তি। রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ পণ্ডিতের পরে আসেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামমোহন রায়ের মতো তার্কিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ। বিকশিত হ’তে থাকে বাঙলা গদ্য; স্থির হ’তে থাকে তার সর্ববঙ্গীয় রূপ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনায় বাঙলা গদ্য লাভ করে সুস্থিতি। তারপর বিভিন্নভাবে বিকশিত হয় বাঙলা গদ্য, সরল জটিল বিজ্ঞানমনস্ক কাব্যিক ও আরো বিভিন্ন রূপের গদ্যে ভ’রে ওঠে বাঙলা ভাষা। উনিশশতকের মাঝামাঝিই স্থির হয়ে যায় বাঙলা ভাষার একটি রূপ, যাকে বলা হয় সাধুভাষা।