‘পদ্য জিনিসটা সমুদ্রের মতো-তার যা বৈচিত্র্য তা প্রধানত তরঙ্গের-কিন্তু গদ্যটা স্থলদৃশ্য, তাতে নানা মেজাজের রূপ আনা যায়-অরণ্য পাহাড় মরুভূমি সমতল অসমতল প্রান্তর কান্তার ইত্যাদি ইত্যাদি। জানা আছে, পৃথিবীর জলময় রূপ আদিম যুগের, স্থলের আবির্ভাব হাল আমলের। সাহিত্যে পদ্যটাও প্রাচীন, গদ্য ক্রমে ক্রমে জেগে উঠছে-তাকে ব্যবহার করা অধিকার করা সহজ নয়, সে তার আপন বেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না-নিজের শক্তি প্রয়োগ করে তার উপর দিয়ে চলতে হয়-ক্ষমতা অনুসারে সেই চলার বৈচিত্র্য কত তার ঠিক নেই, ধীরে চলা, লাফিয়ে চলা, নেচে চলা, মার্চ করে চলা; তারপর না-চলারও কত আকার, কত রকমের শোয়া বসা দাঁড়ানো। বস্তুত গদ্যরচনায় আত্মশক্তির সুতরাং আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র খুবই প্রশস্ত। হয়তো ভাবীকালে সংগীতটাও বন্ধনহীন গদ্যের গূঢ়তর বন্ধনকে আশ্রয় করবে। কখনো কখনো গদ্যরচনায় সুরসংযোগ করবার ইচ্ছে হয়। লিপিকা কি গানে গাওয়া যায় না ভাবছো। মনে রাখা দরকার ভাষা এখন সাবালক হয়েছে, ছন্দের কোলে চড়ে বেড়াতে তার লজ্জা হবার কথা। ছন্দ বলতে বোঝাবে বাঁধা ছন্দ।’
[পথে ও পথের প্রান্তেঃ ৩৮ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
শুরুতেই স্বীকার করা ভালো, গদ্য-সম্পর্কিত এই রবীন্দ্রকথনটি আমার গোচরে ছিল বলেই, প্রস্তাবিত রচনা-প্রতিযোগিতায় আমি অংশ নিতে রাজি হয়েছি। পুরোটা না হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমি অনেকটাই একমত। আজকাল রবীন্দ্রনাথের কবিতার চেয়ে তাঁর রচিত গদ্যই আমি বেশি আগ্রহসহকারে পাঠ করি। আমি নিজে আজকাল কবিতার চেয়ে গদ্যরচনায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছি, তা বেশি আনন্দ পাচ্ছি, বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি বা পাঠক আমার গদ্যকে পছন্দ করছেন বলে নয়, রবীন্দ্রনাথের আত্মজৈবনিক গদ্য ও প্রবন্ধসাহিত্যবাচ্য রচনাসমূহ জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করার পাশাপাশি আমার রসতৃষ্ণাকেও প্রবলভাবে নিবৃত্ত করে বলে।
‘জলময় আদিম পৃথিবীর মতো সাহিত্যে পদ্যটাও প্রাচীন-’ রবীন্দ্রনাথের এই ধারণার বিপরীতে আমাদের সামনে এক হাজার বছর পূর্বে রচিত জাপানি গদ্যের যে নিদর্শনটি রয়েছে, তার নাম দি টেইল অব গেঞ্জি। এবং ওই বিশাল গদ্যগ্রন্থের রচয়িত্রী হচ্ছেন জনৈকা মহিলা। রচয়িত্রীর নামটা ভুলে গেছি। এর ব্যাখ্যা কী তবে? মানুষ কি পদ্যের ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছিল? এখনো বলে? না। আমার ধারণা, গদ্যটাই আগের। মানুষের বুকের ভাষা পদ্য হলেও তার মুখের ভাষা গদ্যই ছিল, আছে এবং থাকবে।
অলঙ্ঘনীয় ভেবে রবীন্দ্রনাথের পর্বতপ্রতিম কাব্যসমগ্রর সামনে আমি এখনো থমকে দাঁড়াই-এ রকম বললে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। তাঁর কাব্যের মুগ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সংগ্রামে আমার কিছুটা সাফল্য যে ফলেছে, তা কোনো কাব্যবেত্তার স্বীকৃতিলব্ধ তথ্য নয়, আমার নিজেরই বিনীত প্রত্যয়মাত্র। আশা করি, রবীন্দ্রভক্তরা আমার অপরাধ নেবেন না। আমার রবীন্দ্রভক্তির নিদর্শন তো আমার কাব্যসমগ্রর বহু পাতায়, বহুভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। এখন আমার ভক্তি চাইছে প্রীতির প্রসাদ।
কিন্তু তাঁর গদ্যের গহিন অরণ্যে আমি আজও নিজেকে ‘পথহারা এক পথিক’ হিসেবেই বিবেচনা করি। পথহারা নাবিকের কাছে সমুদ্রতীরের বাতিঘর যেমন, আমার কাছে তেমনি তিনি, রবীন্দ্রনাথ, তাঁর রসঋদ্ধ গদ্যভাণ্ডার নিয়ে।
সম্প্রতি আমার একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘আপনার গদ্যও তো চমৎকার পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কখনো কি গদ্য লিখতে গিয়ে কবিতার চেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন?’
তার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছি-হ্যাঁ, আমার আত্মকথা ১৯৭১ প্রকাশের তিন মাসের মধ্যেই ফুরিয়ে গেছে। প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার ৩০০ টাকা দামের বই এটি। আশ্চর্য বটে, বইয়ের এই চড়া মূল্য বই বিক্রির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার কোনো কবিতার বই কখনোই এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়নি। সুতরাং আমার গদ্যের ব্যাপারে ‘পাঠকপ্রিয়তা’র অভিযোগটি এখন উঠতেই পারে। পত্রিকাগুলোও লক্ষ করছি, আজকাল আমার কাছে কবিতার চেয়ে আমার গদ্যরচনাই বেশি করে চাইছে। এটা সুলক্ষণ কি না, এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু এটা একটা নতুন লক্ষণ যে তা অস্বীকার করবার জো নেই। এর জন্য কাব্যকার আমি ও গদ্যকার আমির মধ্যে আমি কোনো বিরোধ দেখি না।
অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান।
কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি,
গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।
তবে, গদ্যরচনার জন্য আমি কৃতজ্ঞ যে যন্ত্রটির কাছে, সে হচ্ছে কম্পিউটার। বহু বছর ধরে আমি এই চমৎকার লিখনযন্ত্রটির ওপর নির্ভরশীল। কাগজের ওপর বলপেন বা ঝরনাকলম দিয়ে অক্ষরের পর অক্ষর বসিয়ে, বাক্যের পর বাক্য সাজানোর কথা আমি ভাবতে পারি না। যান্ত্রিক কারণে আমার কম্পিউটার বিকল হয়ে গেলে আমার লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। যে বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করে আমার গদ্যরচনার পথ সহজ করে দিয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। অন্যথায় আমি গদ্যের মরুপথে পা বাড়াতাম বলে মনে হয় না। শুধু পদ্য নিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আমাকে অনেক আর্থিক কষ্ট ভোগ করতে হতো। আমার গদ্যসাধনা আমাকে অনিবার্য অর্থকষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
এখন পুস্তকবাজারে আমার তিন খণ্ড কাব্যসমগ্রর পাশাপাশি তিন খণ্ড গদ্যসমগ্রও রয়েছে। খণ্ডবিচারে সমসংখ্যক হলেও পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে আমার রচিত গদ্যের পরিমাণ কবিতার চেয়ে ঢের বেশি। ঈশ্বর আমাকে আরও অধিক, আরও উত্তম গদ্যরচনার তওফিক দান করুন, এই প্রার্থনা।
নির্মলেন্দু গুণ
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮