গণ্ডির বাইরে
—অনিলা দাসী!
—উপস্থিত
—বনমালা রাহা
—উপস্থিত
—সর্বজয়া দাসী
—উপস্থিত
—পূর্ণিমা দাসী…
—লক্ষ্মী দাসী
রোলকল বন্ধ রেখে জিনা বলল, তোমরা বেশির ভাগই দেখছি দাসী লেখ! তোমাদের পদবি কি দাস?
নানা বয়সের মেয়েগুলি চোখ মটকে একে অন্যের দিকে চেয়ে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ল।
জিনা বিরক্ত হয়ে বলল, একটু সোজা হয়ে বসতে পার না? তোমাদের কি শিরদাঁড়া নেই? সব সময়েই হেলছ! না হেসে আমার কথার জবাব দাও।
প্রায় দু’মাস হয়ে গেছে। এতদিনে জিনার জড়তা খানিকটা কেটেছে। মুকুট চলে যাবার পর সে কয়েক দিন খালি ভেবেছে, ভেবেছে আর ভেবেছে। ভাবতে ভাবতে মনে হল সত্যি কী উদ্দেশ্যহীন জীবন তার! আহার-নিদ্রা-মৈথুন। দিনের পর দিন। দিনের পর দিন। স্বামীকে তার পেশাতে সাহায্য করার উপায়ও তার নেই। বাড়ির কাজকর্ম সে ইচ্ছে ক’রে করে বটে, কিন্তু সে না করলেও আটকাবে না। সামাজিক মেলামেশার সুযোগ কম। কেমন যেন শূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে সে ইদানীং। একটা বাচ্চাটাচ্চা হলে নিজেকে এরকম অপদার্থ লাগত না। হলেই হয়। অথচ কিছুতেই হচ্ছে না। এ নিয়ে হা-হুতাশ করতে তার ভাল লাগে না। আর মুকুট? দিনরাত্র ব্যস্ত, ব্যস্ত, ব্যস্ত। সবাই ব্যস্ত। নিখিল ব্যস্ত তার চাকরি নিয়ে, দাদা ব্যস্ত তাঁর তাস নিয়ে, দিদিভাই ব্যস্ত তার সংসার, মেয়েদের চৌকশ করে তোলা নিয়ে। শ্বশুরমশাই ব্যস্ত তাঁর চ্যারিটি-ক্লাস নিয়ে। একমাত্র পূর্ণ মাত্রায় অলস, কর্মহীন সে। জিনা। দাঁতে নখ কাটার বদভ্যাসটা তার এখনও যায়নি। ভাবতে ভাবতে ডান হাতের তিনখানা আঙুলের নখ চিবিয়ে সে শেষ করে দিল। তারপর ভেবে-চিন্তে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে গেল।
—বাবা?
ধড়মড় করে আরামচেয়ারে উঠে বসলেন কল্যাণবাবু।
—কিছু বলছ?
—হ্যাঁ বাবা, তার ওড়নাটা জিনা ডান হাতে সাত পাক জড়িয়েই ফেলল।
—আমার বন্ধু মুকুটকে দেখেছেন তো!
—হ্যাঁ—সেদিন তো আলাপ হল।
—ও বলছিল। মানে দুপুরে তো কোনও কাজ থাকে না, তা ছাড়া এনগেজ্ড্ থাকা ভাল।
জিনা এত কিন্তু কিন্তু? এটা নতুন ব্যাপার মনে হল কল্যাণবাবুর।
বললেন, হ্যাঁ বলো না।
—যদি অ্যাডাল্ট এডুকেশনের একটা ক্লাস করি। একটা থেকে চারটের মধ্যে। আপনি বেরোবার আগেই ফিরে আসব।
কল্যাণবাবু বিকেলে নিয়ম করে বেড়াতে বার হন।
—আমার ফিরে আসা না-আসার জন্যে তোমার ভাববার কোনও দরকার নেই। আমাকে একটা চাবি দিয়ে দিলেই তো হয়! কিন্তু তুমি যাবে কিনা…ছোট বউমা, আমি তো তোমার গার্জেন নই!
—কেন নয়!—জিনা অপ্রস্তুত মুখে বলল—ঠিক আছে কাজটা…কাজ করাটা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয় বাবা!
কল্যাণবাবু মনে মনে ভাবলেন এ মেয়ের এবার একটা বাচ্চা হওয়া খুব দরকার। এরা যে কী করছে! ডাক্তার-টাক্তার দেখাক! তিনি আরও ভাবলেন—জিনা করবে অ্যাডাল্ট এডুকেশন? সম্পন্ন বাড়ির আহ্লাদি মেয়ে, বড় চাকুরের বউ। এমনিতে খুবই কর্মদক্ষ, সুন্দর স্বভাব, হাসিখুশি, ভাল। বুদ্ধিমত্তাও খুব, কিন্তু একটু কি তরলমতি, হালকা সুখী সুখী নয়?
তিনি বললেন, তুমি তো জানো মা, আমি নিজেই অনেক দিন থেকে স্ট্রিট বয়েজদের একটা-দুটো ক্লাস নিই। এডুকেশন যাকেই দাও, যখনই দাও— আমার খারাপ মনে হবার কোনও কারণই নেই।
জিনা অমনি এগিয়ে গিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকল তাঁকে।
—তা হলে কাজটা আমি করছি বাবা, বলেই প্রায় ছুট।
—শোনো, শোনো, —কল্যাণবাবু ব্যস্ত হয়ে পিছু ডাকলেন— আমার মতের ওপর নির্ভর করে কিছু করো না। আবারও বলছি আমি তোমায় অনুমতি দেবার কেউ নই মা!
মাথাটা হেলাল জিনা। খুব বুঝেছে।
কিন্তু নিখিলের কাছে সে আদৌ সেভাবে অনুমতি নেয়নি। স্টেপকাটিনী বউকে নিয়ে নিখিল ইদানীং খুব মেতেছে। বুটিক থেকে দামি ডিজাইনার সালোয়ার-কামিজ কিনে দিল, দুদিন শহরের দুটো বিখ্যাত নাইট-ক্লাবে নিয়ে গেল। মাতিজ ছুটিয়ে দিঘা ঘুরিয়ে নিয়ে এল। তারই ফাঁকে জিনা বেমালুম বলে দিল— আমি একটা অ্যাডাল্ট এডুকেশন সেন্টারে যাচ্ছি, জান? —দারুণ লাগছে।
—তাই? ভাল লাগল?
—হ্যাঁ, আমি বলে দিলুম, সপ্তাহে তিনদিন পড়াব, দুপুরবেলায়। কেউ তোমরা বাড়ি থাক না। বসে বসে মোটা হই আর বোর্ড হই!
—অমনি তুমি ঠিক করে নিলে? আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না!
—আহা! তুমি কি আমার গার্জেন নাকি?
—ও, আমি তোমার গার্জেন নই? তো সেটি আজকাল কে হচ্ছেন?
—কে আবার? আমি একটা তিরিশ ছুঁই ছুঁই ইয়াং লেডি। একটা ক্লাস নেব, সমাজসেবা করব তার আবার অনুমতি! গার্জেন! জিজ্ঞেস! রাখো তো!
জিনার কূটনীতির কাছে নিখিলের এই প্রথম হার। হেরে যে গেল সেটা বেচারি বুঝতেই পারেনি। কী যেন একটা সামান্য মাসির বাড়ি, দিদির বাড়ি যাওয়া বিষয়ে তাকে জানাচ্ছে, এরকম একটা উড়িয়ে দেওয়া লঘু ভঙ্গি জিনার। নিখিল কিছু বলেনি।
জিনা প্রথম প্রথম যেত যেন সে-ই সমাজ পরিত্যক্তা, অপরাধিনী, চোখ তুলে চাইতে পারত না। যখন প্রথম সংকোচটা কাটল, তখন আবার শুরু হল দ্বিতীয় সংকোচ। তার মহার্ঘ শরীর, তার ত্বকের দামি জেল্লা, বসনভূষণের ঔজ্জ্বল্য, রুচি, তার নিজস্ব পরিমণ্ডলের সৌগন্ধ, সমস্ত কী মিলিয়ে সে যে ওই কালিপড়া বালিখসা ঘরে নানা বয়সের জীর্ণ মেয়েগুলির পাশে একটা ভীষণ বেমানান প্রশ্নচিহ্ন, এই বোধ কিছুতেই তাকে সহজ হতে দিচ্ছিল না। এখন কিছুটা হয়েছে। সে এদের মনে করে তার সাবালক বড় জোর বয়স্ক ছাত্রী। এর চেয়ে অন্যরকম কিছু না। সাধারণ স্কুলে যে ধরনের সভ্যতা, শৃঙ্খলা, মনোযোগ ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে দাবি করা হয় সেটাই সে এদের থেকে আশা করে। এদের আগের দিদিমণি এত কড়া ছিলেন না। একটু শিখলেই তিনি কৃতার্থ হয়ে যেতেন। শাবাশ দিতেন। যেন তারা ছেলেমানুষ। সেটাতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এ দিদিমণি সমানে সমানে মেশেন না তাদের সঙ্গে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। এতে প্রথম প্রথম একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্রমশ তারা বুঝতে শিখেছে এটা ঠিক ‘দেমাক’ নয়। দিদিমণি তো! দূরত্বটা দিদিমণিত্বের।
সবচেয়ে যেটা তাদের টানে সেটা হল দিদিমণির গল্প বলা। খুব ভাল ভাল গল্প বলেন। প্রথম দিন দুয়েক গল্প বললেন— একটা লোক চাকরি করতে গিয়ে এক নির্জন পাষাণপুরীতে আশ্রয় নেয়, সেখানে সে কীরকম সুন্দরী মেয়ের ভূত দেখে, বাদশা সুলতান, হাবশি খোজাদের ভূত দেখে, একজন আধপাগল লোক সকাল হলেই ‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’ বলতে বলতে ঘুরে বেড়ায়। প্রথম দিনেই এই গল্পটা বলে ছাত্রীদের মোহিত করে দেন দিদি। দ্বিতীয় দিন শোনালেন এক কিপটে বুড়ো কীভাবে ভুল করে তার নিজের নাতিকেই মাটির তলার ঘরে জ্যান্ত বন্দি করে যখ বানিয়ে দেয় সেই লোম-খাড়া-করা গল্প। মাঝে মাঝে আবার নতুন দিদিমণি তাদের টুকটাক মজাদার জিনিস খেতে দেন। এগুলো তাঁর নিজেরই হাতে করা কিনা সে নিয়ে জল্পনা চলছে। একজন জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ধমক খেয়েছিল। —সে খোঁজে তোমাদের দরকার কী? হাসি হাসি মুখখানি দিদিমণির। কিন্তু কড়া আছে।
—কী হল? জবাব দাও!
—একজন বলল, দাস নয়, আমরা দাসী-ই।
—দাসী বলে কোনও পদবি আমি কখনও শুনিনি, জিনা বলল। তখন আরেকজন বলল—আমাদের আবার পদুবী কী? বংশ নেই, ধারা নেই, বাপ নেই!
—মায়েরও তো কোনও না কোনও পদবি ছিল।
—মা-ও দাসী।
ক্লাসের শেষে, যখন সবাই চলে গেল, সবচেয়ে ভাল ছাত্রীটি যাকে সে ‘ক্ষীরের পুতুল’ পড়তে দিয়েছে, সে রয়ে গেল। এ প্রায় প্রতিদিনই রয়ে যায়। কিছু না-কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তার। যেমন, যকের গল্পটা সত্যি কিনা, তাদের গ্রামে এরকম দু-তিনটে যক ছিল, একজনের চেহারা সে ছোটবেলায় দেখেছে। এক্কেবারে সাধারণ মানুষের মতো, খালি হাঁ করলেই কুমির-দাঁত দেখা যায়, আর নখের ডগা ছুরির ফলার মতো। তার নিজের নখ ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। দিদিমণি এর কোনও প্রতিকার জানেন কিনা…ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ তার টাস্ক্ ছিল— ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর গল্পটা নিজের মতো করে লিখে আনা। জিনা ক্লাসরুমে বসেই লেখাটা দেখে দিল। অজস্র বানান ভুল সত্ত্বেও গল্পটা দাঁড় করিয়েছে।
জিনা বলল, ভাল হয়েছে বনমালা, বই দেখে দেখে বানানগুলো শুধরে এনো। তাদের এখানকার পদ্ধতিতে বানানটানান নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করাই থাকে। তা হলে নাকি এদের শেখার উৎসাহ চলে যাবে। কিন্তু সে দেখেছে, বানান বা বাক্য রচনারীতির ওপর জোর দিলে মনটা পড়ায় বসে ভাল। তা ছাড়া সবার ক্ষমতাও তো এক নয়। যারা পারবে বলে মনে হয়, তাদের এগিয়ে যেতে সে সবসময়ে উৎসাহ দেয়।
আজ বনমালা মুখ খুলল, দিদিমণি, আমাদের আসল পদবি থাকলেও কইতে নাই, মানা আছে।
—কে মানা করেছে।
—বাড়ি থেকেই।
—বাড়ি থেকে? মানে?
—মেসোর কাছ থেকে বিককিরি হয়ে তো আসি! এমনি ধরুন বাপের কাছ থেকে, সোয়ামির কাছ থেকে বিককিরি হয়েও তো মেয়েছেলে আসছে। তাদের বলে দেয়, তোর আর পদুবি রইল না, বলবি দাসী।
—তুমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছ, জানতে?
—মিথ্যে বলব না দিদি, জানতুম। তবে সে বিককিরির ঠিক মানেটা কী, তা কি আর বুঝেছি! মেসো-মাসির সাতটা ছেলেপুলে, আমি বাপ-মা মরে গিয়ে উঠলুম, আটটা হয়ে গেল। খেতে দিতে পারে না। দিন রাত খ্যাঁক খ্যাঁক আর খাটুনি। একদিন একটা লোক এল, এখন বুঝি আড়কাঠি। তার আমাকে পছন্দ হল, তখন আমার ন বছর বয়স। পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল মেসোকে। মেসো বলল— যা তুই বিককিরি হয়ে গেলি, খাটবিখুটবি, খেতে পাবি পেট ভরে। আমাদের ভুলে যা। এ পদুবি এ নাম নিবি না খবদ্দার। অতশত তো বুঝতুম না। গাঁয়ে নাম ছিল বনলতা, এখানে মাসি বলল বনমালা বেশি ভাল শোনাবে। তাই, তা-ই।
—তা তুমি যে রাহা বল?…জিনা মনে মনে বলল— ‘সেন’ হলেই তো ষোলোকলা পূর্ণ হত।
—ওই আড়কাঠিটা তো রাহা ছিল। ওর সঙ্গেই তো প্রথম ক মাস…বলতে বলতে দিদিমণির ছাইয়ের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে বনমালা থেমে গিয়ে মুখ নিচু করল।
—তারপরে? —জিনা জিজ্ঞেস করে। ন’ বছরের মেয়ে? ন বছর? এরা কারা? এই আড়কাঠি…এই মাসি…এদের খদ্দের…কারা?
—মুখ দিয়ে একদিন রাহা বেরিয়ে গেল দিদি। সেই থেকে রাহা হয়েই আছি। তা ওই পারুল? ওর সোয়ামি তো পুরুতঠাকুর! ভটচায্যি বামুন। ও-ও তো নিজেকে দাসী বলে। গাঁজা, আফিম, মদ কিছু বাকি ছিল না বরটার। মেরে ধামসে দিত একেবারে। তারপর নেশার জোগাড় করতে ঘরেতেই লোক জোটাতে শুরু করে। পারুল দেখলে এ তো মজা মন্দ নয়! তার গতর-বেচা টাকা দিয়ে নেশা করে লোকটা তাকেই উপুসি করে পেটাচ্ছে। ও পালিয়ে এল।
—আর?
—সর্বজয়াদিদি এখানকারই। তিন পুরুষে বেশ্যা। ওর দিদিমা ভাল নাচতে গাইতে পারত। সর্বজয়াদিদি গাইতে পারে সুন্দর। তা এখন তো খদ্দের গান শুনতে চায় না। ক্যাসেট রয়েছে কত। ওই যে দেখেন অনিলাদিদি। লোকের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করত। এক বাড়ির বাপ ছেলে দুজনেই ওকে নষ্ট করে…গতি না দেখে…
—চুপ করো বনমালা। ঘরে যাও।
জিনা হনহন করে বেরোতে গিয়ে চৌকাঠে ঠোক্কর খেল। আজ তার একটু দেরিই হয়ে গেছে। গলিটার যেন ঘুম ভাঙছে। সে তাড়াতাড়ি বড় রাস্তায় পড়ে একটা রিকশা নিল। বাড়িতে ঢুকেই সোজা বাথরুমে। সোম বুধ শুক্র তিনদিনই— এই তার রুটিন। প্রথম দু-চারদিন এমনই গা ঘিনঘিন করেছিল যে রাত্রে খেতে পারেনি। মুখে খালি জল কেটেছে। কী যে মাখে এরা? কী তেল? কী পাউডার? কী সেন্ট? উৎকট রকমের উগ্র একটা গন্ধ বেরোতে থাকে। অনেকবার মুখে এসেছে—প্লিজ তোমরা এই তেলটেলগুলো মেখে এসো না।
কিন্তু এ কথা কি বলা যায়? ওরা গন্ধ ভালবাসে। মাথায় সুবাসিত তেল ঢালবে, শাড়ির ভাঁজে সস্তার সেন্ট। মলিনা আবার কতক চাট্টি ধূপ এনে জ্বালিয়ে দিল একদিন। সেদিন জিনা আর থাকতে পারেনি, বলে ফেলেছিল— ধূপগুলো নিয়ে যাও প্লিজ, আমার মুখের মধ্যে ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে, দেখো!
—দিদিমণির রকম দ্যাকো…হেসে গড়ায় সব।
সরু গলির দু ধারে বড় বড় বাড়ি। এক একটা তো বহুতলও আছে। পুরনোই বেশি। দুপুরবেলা সব চুপচাপ, নিঝুম। একতলার ঘরগুলো অন্ধকার। ‘বান্ধব সমিতি’ লেখা সাইনবোর্ডটা হেলে পড়েছে। বাইরের ঘরটা ক্লিনিক। কড়া টিউবলাইটের তলায় নড়বড়ে টেবিলচেয়ার, গোটা তিনেক বেঞ্চি। একটা ওষুধের আলমারি। বহু ডাক্তার তাঁদের পাওয়া ওষুধের সাম্প্ল্ এখানে দান করেন। পার্টিশনের গায়ে বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। ওদিকে তার ক্লাস। ব্ল্যাকবোর্ড। মেঝেতে মাদুর পাতা, তার জন্য একটা নিচু চেয়ার আর টেবিল।
আগে যে পড়াত সেই সবিতা মাত্রই স্কুল ফাইন্যাল পাস। সে এখন কলেজে পড়তে গেছে।
—তুই অমন সিঁটিয়ে বসে আছিস কেন? এখানে তো কোনও নোংরা নেই! —মুকুট বলল ফিসফিস করে। সামনে বসা একটি মহিলা ঠিক শুনতে পেয়েছে। কালো লম্বা চেহারা। কপালটা ঢিবির মতো। মুখটা খুব চালাক-চতুর। বেশ স্মার্ট। বলেছিল—ইস্কুলঘরে আমরা লোক বসাই না গো দিদিমণি! ভয় পেয়োনি। জনা দুই খিলখিল করে হেসে উঠল। একজন ধমক দিল— কাকে কী বলতে হয় জান না সর্বজয়াদিদি! ছিঃ!
এই সর্বজয়াই তাকে সবচেয়ে বেশি র্যাগিং করে। মহিলা সহজাত বোধে তার কুঁকড়ে যাওয়া, ভেতরের ঘৃণা, অস্বাচ্ছন্দ্য বুঝতে পারে। একদিন ক্লাস-শেষে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুনতে পেল সর্বজয়া বলছে— ওরকম ঘরের বউ ঢের দেকা আচে, কে ঘরের মধ্যে কী করে, কী কোরে ভাতকাপড় জোটে সবাই জানে।
শুনে জিনার মধ্যে রাগ লকলকিয়ে উঠেছিল। সেই প্রথম। শুনতে পায়নি এমন ভাব করে সে চলে যেতে পারত। কিন্তু সে তা করেনি। দাঁড়িয়ে পড়ে ফিরে তাকিয়েছিল। বলেছিল—লেখাপড়া শিখতে ইচ্ছে হলে আসবে। এর মধ্যে কোনও জোরজুলুমের ব্যাপার নেই। আমাদের আর কী! শিখতে পারলে তোমাদেরই মঙ্গল! কিন্তু শিখতে যদি আস, ভদ্র বাধ্য ছাত্রীর মতো আসবে। ক্লাসে ডিসিপ্লিন মানতে হবে, টিচারকেও মানতে হবে।
পরের দিন আসতে ইচ্ছে করেনি। অনেক দিনই নিজের অনিচ্ছার সঙ্গে একটা লড়াই করেই তাকে আসতে হয়। মুকুট অনেক বড় মুখ করে কাজটা তাকে দিয়েছে তো! ভেবেছিল সর্বজয়া দাসীকে দেখবে না। কিন্তু না। ওই তো এক দিকে থানা গেড়ে বসে আছে। পরের কয়েক দিন সে সর্বজয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল। তারপর একদিন বলল— শুনেছি, অনেকে ভাল গান গাও, একটু গেয়ে শোনাও দেখি—
কয়েকজন সর্বজয়াকে ধরল, তখন সে-ও উৎসাহ দিল— গাও না, গাও।
অবশেষে সর্বজয়া তার জোরালো সুরেলা গলায় শ্যামাসংগীত ধরল—সকলই তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি…
গান শেষ হলে, জিনা বলল— বাঃ! ভাল গাও তো তুমি!
—দিদিমণি— এখন আপনি একটা গান, সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
জিনা বলল—আমি কিন্তু এত ভাল গাইতে পারি না। সে ভেবে-চিন্তে ধরল— যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।
কেন এই গান বাছল সে জানে না। গাইবার জন্য সে একেবারেই তৈরি ছিল না। ইদানীং খুব নিয়মিত সংগীতচর্চা হয়ে ওঠে না। ঝুম্পা-মাম্পি দুজনেরই লেখাপড়ার চাপ বেড়েছে। গানে আর নিয়ম করে বসতে পারে না। সে এক এক দিন আপন খেয়ালে সন্ধের মুখে গীতবিতান নিয়ে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাবার করে দেয় একটার পর একটা গানে, যতক্ষণ না নিখিল বাড়ি আসে। কিন্তু সেটা পুরোপুরিই তার মর্জির ওপর। গাইবার সময়ে অবশ্য দেখল এভাবে অনিয়মিত সেধেই হোক আর বাথরুম সং গেয়েই হোক, গলাটা ভালই আছে। গানটা খুব সচেতনভাবে বাছা নয়। কিন্তু এটুকু খেয়াল তার ছিল যে এখানে কোনও ভালবাসার গান সে গাইবে না। সে বড় ঠাট্টার ব্যাপার, অশ্লীল ব্যাপার হবে। দেশভক্তির গান? সে-ও হবে নিদারুণ ঠাট্টা। দেশ কোথায় এদের? আর ঠাকুরদেবতা? সর্বজয়া যেমন গাইল? কে জানে ভক্তিসংগীতও যেন কেমন অপ্রাসঙ্গিক এখানে। সাধারণ মানুষ তো ভক্তিসংগীত গেয়ে থাকে কোনও আশা-আকাঙক্ষার দিকে মুখ করে। সে টিচার হিসেবে অনুভব করে সেসব আশা-আকাঙক্ষার থেকে কত দূরে এসব জীবন। যে মিথ্যে শোনাতে চায়, শোনাক। তার উপলব্ধির বিরুদ্ধে সে যেতে পারবে না। মুকুটদের প্রতিষ্ঠান তার কাছ থেকে কী চায়, নির্দিষ্ট করে কিছু চায় কিনা, তার জানা নেই। কিন্তু তার ভেতরে একটা দেওয়ার অস্পষ্ট রূপরেখা গড়ে উঠছে। সে তার বোধের অনুগত হয়ে চলে। সে যখন সাজপোশাক করে, যেমন অবধারিতভাবে তার হাতে উঠে আসে হালকা রং, প্রসাধন করতে গিয়ে রং দিতে হাত ওঠে না, গান করবার সময়ে তেমনই গলায় উঠে এল এমন সুর এমন বাণী, যা এই অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটের একতলার এঁদো ঘরের উপর্যুপরি পুরুষসহশব্রক্লিষ্ট বিকৃত গর্তের জীবনের দিনগত বাস্তব থেকে দূরে। হয়তো ওদের ভাল লাগবে না। না সুর, না ভাষা। কিছু বুঝবে না। কিন্তু তার যদি এদের কিছু দেওয়ার থাকে তা হল এই যৌনতার বাইরের জগৎ, বাইরের ভাব।
—দিদিমণি আপনি কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন? —বনমালা জিজ্ঞেস করল।
—এ কথা বলছ কেন?
—ওই যে বিদায়বেলার গান করলেন? বনমালার চোখ কি একটু ছলছল করছে? অন্য মেয়েগুলিও তাকিয়ে আছে— চুপচাপ।
তবে? তবে কি এরা তাকে ভালবাসছে? বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করতে থাকে। সে বলল— না তো! যাবার কোনও ইচ্ছে তো এখনও পর্যন্ত নেই।
মুকুট প্রায়ই আসে। এখানে, বাড়িতে। আসলে এখানে জিনাকে লাগিয়ে ও বোধহয় একটা দায়ের মধ্যে পড়ে গেছে। জিনার কেমন লাগছে, জিনা কেমন আছে, এখনও অস্বস্তিতে আছে কিনা, এইগুলো হয়তো জানতে চায়।
একদিন বলল তোর মেয়েগুলোর প্রোগ্রেস খুব ভাল রে জিনা। কী করিস রে?
—কীরকম টিচার দেখতে হবে তো! জিনা হেসে বলল।
মুকুট বলল—সত্যি রে! খুব লো-কোয়ালিটি টিচার দিই আমরা। ওদেরই মধ্যে যে একটু লিখতে-পড়তে শিখেছে তাদেরই সাধারণত কাজটা দেওয়া হয়। আইডিয়াটা হল নিজেদের লোকের কাছে ওরা স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। করেও অবশ্য। তোকে এনেছিলাম জাস্ট একটা খেয়ালে। রেজাল্ট দেখে সবাই চমকে যাচ্ছে।
—কেন? কোনও পরীক্ষা তো…
—না রে সে সব না। ওরা প্রথমত পড়াশোনা করতে চায় না। বুঝতেই তো পারিস সমাজের কোন স্তর থেকে এসেছে বেশির ভাগ! তার ওপর সন্ধে থেকে সারা রাত ওই কাজ! মাথায় কিছু ঢোকে না। কনসেনট্রেশন বলে কোনও পদার্থ নেই। খালি প্রথম রিপু উসকে দিতে আর স্যাটিসফাই করতেই শেখে এরা। তোর মেয়েগুলোর চালচলন পালটে যাচ্ছে। বেশ কয়েকজন খবরের কাগজ পড়ছে শুনছি।
—হ্যাঁ, আমি পড়াই তো।
—হ্যাঁ রে ওরা নাকি গল্পগুচ্ছের গল্প বলতে পারে! নমিতাদিকে ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ শুনিয়েছে একটা মেয়ে আর একজন সেই জয়কালী নামে একজন শুচিবায়ুগ্রস্ত বিধবা নিজের রাধাকান্তর মন্দিরে একটা শুয়োরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন!
—হ্যাঁ। ‘অনধিকার প্রবেশ’ ওরা বলেছে? সত্যি?
জিনা গল্প বলে ঠিকই। বলে বলার আনন্দে। খানিকটা কৌতূহলেও। ওদের বুঝতে না দিয়ে সে লক্ষ করে গল্পগুলোর কী ফল হল, কীভাবে নিচ্ছে ওরা সেগুলো। বাইরের জীবনকে ওদের কাছে হাজির করার অন্য আর কী উপায়ই বা আছে? এদের মধ্যে বেশির ভাগই এই পল্লিরই মেয়ে। পুরুষানুক্রমে এই করছে। কোনও সমাজ, কোনও সভ্যতাকে কখনও ভেতরে ঢুকে দেখেনি। চৌকাঠ থেকে উঁকি মেরে কতটুকুই বা বোঝা যায়! এদের সমাজ নারীপ্রধান। মা, দিদিমা, মাসি…মাতৃকুলের দিকে একমুখী বিস্তার। শিক্ষা তো নেই-ই। সামাজিক বা পারিবারিক দৈনন্দিন কাজকর্মের বৈচিত্র্যও নেই, সাধারণ রুটিন নেই। সন্তান পালন যেটুকু আছে, এদের জীবনে তার ভূমিকা খুবই গৌণ। বেশির ভাগই সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। একটা জৈব মাতৃত্বের অনুভূতি ছাড়া কিছু নেই। সেটাও বেশিদিন থাকে না। ওরা জানে এই সন্তানদের কী ভবিষ্যৎ। বা, বলা ভাল, জানে এদের ভবিষ্যৎ ঠিক কী! লেখাপড়া শেখাবার তেমন কোনও গরজ নেই, সুযোগও নেই, বাইরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না। মেয়েরা বারো-তেরো বছর বয়স হলেই ব্যবসায় নেমে পড়বে। ছেলেগুলো দালালি করবে, মারামারি, চুরি, ছিনতাই, মস্তানি। শৈশব বলে কিছু নেই। পুরুষকে এরা মাত্র একটা ভূমিকাতেই চেনে। খদ্দের। পিতা, রক্ষক, পুত্র, পালক, ভাই, বন্ধু আর কোনও পরিচয়েই নয়। যেসব মেয়েরা বাইরে থেকে এসেছে, কেউ স্বামীর অত্যাচারে পালিয়ে এসেছে, কেউ ভালবাসার লোকের কাছে ঠকে এসেছে, কেউ বা পিতা বা পিতৃতূল্য কারও কাছ থেকে বিক্রি হয়ে এসেছে। এদের সবারই কাছে পুরুষ এক ভয়াবহ, বিপজ্জনক প্রবঞ্চক, চতুর ক্রেতা। কী করে এতকাল ধরে এতগুলো দেশে মানুষ মানুষকে এমন অমানুষিক গর্তের জীবনে বন্দি করে রাখতে পারল? এইরকম একটা পৈশাচিক বাস্তব তাদের ঘরের পাশেই জিয়োনো রয়েছে অথচ তাদের চেতনায় এদের জন্য কোনও মমতা, কোনও মুক্তির ভাবনা কোনওদিনও দেখা দেয়নি। পুরুষরা এদের ব্যবহার করে, সতর্ক চতুরতার সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা শ্রেণী তৈরি করে রেখে দেয়, আর মেয়েরা এদের ঘৃণা করে। যেমন সে করত। এদের কাজকর্ম, চালচলন, কথাবার্তা —এখনও করে।
একটা মজার খেলা আজকাল শুরু করেছে জিনা। তার ছাত্রীদের মোটামুটি অক্ষর পরিচয় তার আগের মেয়েটিই করিয়ে গিয়েছিল। এরা নাম সই করতে পারে। বাংলায়, ইংরেজিতে। কিন্তু পড়বার ধৈর্যটা অনেকেরই নেই। লেখবার তো নেই-ই। যাদের আছে তাদের সে পড়তে লিখতে দেয়। কিন্তু অন্যদের বেলায় এসব করে একেবারে পড়াশোনা বিমুখ করে দেবার ঝুঁকিটা সে নেয় না। অনেক সময়ে সে একটা গল্প অর্ধেকটা বলে থেমে যায়। গল্পটা কীভাবে শেষ হবে সেটা নিয়ে এবার ওরা ভাবুক, জল্পনাকল্পনা করুক। এটাই হল খেলা। এ খেলাটা ওদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। ‘দেনা পাওনা’র অর্ধেকটা শুনে ক্লাসসুদ্ধু মেয়ে রায় দিল, নিরুপমা শাশুড়ির অত্যাচারে মারা যাবে, তার বর আবার বিয়ে করবে। আশা বলে একটি মেয়ে বলল— এবার আরও বেশি টাকা চাইবে গো!
রবীন্দ্রনাথের কল্পনার সঙ্গে এদের কল্পনা কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাচ্ছে দেখে সে চমৎকৃত। ‘অতিথি’ শুনে জবা নামে একজন বলল— ‘ব্যাটাছেলে বলেই না বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্চ। মেয়েছেলে হলে মা মেরে ধামসে দিত, কাজ কর তবে খেতে পাবি। আর অমনি পালালে? দ্যাখ না দ্যাখ লাইনে ভর্তি হয়ে যেত।’ তারাশংকরের ‘কালাপাহাড়’ শুনে সবিতার মন্তব্য—‘নির্য্যস ফিরে আসবে মোষটা, আহা অবোলা জীব গো। মানুষের চেয়ে ওদের টান বেশি।’ ‘ডাইনি’ গল্পের সূক্ষ্মার্থ সবটাই মাঠে মারা গেল। প্রত্যেকেই ধরে নিল, মেয়েটি সত্যিই অশুভ শক্তির অধিকারিণী। বেচারি নিজেও জানে না সে ডাইনি-সমাজের অন্তর্গত, জন্ম থেকেই ডাকিনীবিদ্যা তার রপ্ত। কে কবে ডাইনি দেখেছে, ডাইনির কথা শুনেছে, প্রচণ্ড উত্তেজনাময় সেই আলোচনাতেই সেদিনের ক্লাস শেষ হল।
—কী ব্যাপার? তোর যে খুব পা হয়েছে! কোথায় কোথায় যাস দুপুরবেলায়?
মল্লিকার সঙ্গে প্রায় ঠোকাঠুকি হয়ে গেল বাড়ির দরজার কাছে। জিনা আসছিল আপন মনে। যেন একটা ভাবনার সুতো হাতে নিয়ে আনমনে কোনও গোলকধাঁধা পার হচ্ছে। এরকম সময়ে রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া পথ-চলতি মানুষ, ধারের আবর্জনা সবই অভ্যাসে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু চেনা মানুষকে চেনা যায় না। কেননা যে মনের দ্বারা চেনাচেনিগুলো হয় সেটা অন্যত্র ব্যস্ত থাকে। তাই জিনা ভীষণ চমকে গেল।
—আরে দিদিভাই! তুমি? কোথায় গিয়েছিলে?
—তোর পাশে পাশেই তো আসছিলুম। প্রথমে ছিলুম ও ফুটপাতে, তোকে ইশারা করলুম— ‘এই! এই যে শুনছেন!’ বলে ডাকলুম…
—‘এই যে শুনছেন!’ জিনার মুখ হাসিতে ভরে গেল।
—তা কী বলব! রাস্তার মাঝখানে তোর নাম ধরব? তুই শুনতে তো পেলিই না, রাস্তা ক্রস করে তখন থেকে তোর পেছন পেছন আসছি দেখতেও পাচ্ছিস না।
—আমার বুঝি পেছনে দুটো চোখ আছে? চলো—দরজার চাবি ঘোরাল জিনা— এ দিক দিয়ে ঢুকি।
আজও জিনার দেরি হয়ে গেছে। বাবা বেড়াতে বেরিয়ে গেছেন। সে বলল— দিদিভাই, প্লিজ বসো, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি। তারপর চা করব।
গা ধুয়ে বেরিয়ে সে দেখে মল্লিকার চা করা হয়ে গেছে। বলল—এত দেরি করলি? রাস্তায় কিছু মাড়িয়েছিসটিস নাকি?
জিনা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, —না, তেমন কিছু না। গরম হচ্ছিল।
চা খেতে খেতে মল্লিকা বলল, —‘বললি না তো কোথায় গিয়েছিলি? কোথায় যাস?
—তুমি দেখেছ? আমি রোজ যাই?
—রোজ কি না জানি না, প্রায়ই দেখি বেরিয়ে গেলি বা ফেরত এলি।
—বাবা কিছু বলেননি?
—বাবা? বাবা কেন বলবেন?
জিনা বলল—একটা কাজ করছি।
—কাজ? চাকরি?
—চাকরি ঠিক নয়। কাজ…কাজ দিদিভাই। বয়স্ক-শিক্ষা।
—পড়াচ্ছিস? সত্যি? কাদের?
—বয়স্ক মেয়েদের, ধরো সতেরো-আঠারো থেকে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ কী তারও বেশি বয়স!
—এ মুকুটের কাজ, না?
—ঠিক ধরেছ। সারাদিন কিচ্ছু করবার নেই। কোথাও যাবার নেই। কোনও মানুষের মুখ দেখি না। নবাববাহাদুরের অবরোধে একা একা। ভাল লাগে নাকি?
—এখন ভাল লাগছে?
—খুব। কারও জন্যে কিছু করছি, করতে পারছি। পরিবার-পরিজনের একেবারে বাইরে কারও জন্যে— এটা ভাবতে ভাল লাগে দিদিভাই। তারপরে আবার ইনসেনটিভ রয়েছে টাকাটা।
—এই যে বললি—চাকরি নয়!
—নয়ই তো। ওটা ধরো পথ-খরচা, বা বলো সম্মান-দক্ষিণা।
প্রথম প্রথম জিনা টাকাটা নিতে লজ্জা পেয়েছিল। এই রাস্তার চতুর্দিকের হতশ্রী দীনতা, উপরন্তু মেয়েগুলির জীবিকা! পেটের জন্য যাদের শরীর বেচতে হয়, সেই দুর্ভাগিনীদের পড়িয়ে সে টাকা কী করে নেয়? কিন্তু মুকুট বলেছিল— জিনা তোর পুরনো সমাজসেবার কনসেপ্টটা তুই ভুলে যা। আমরা যে সেটআপটা তৈরি করেছি সেখানে বাইরে থেকে অনেক টাকা গ্রান্ট আমরা পাচ্ছি। সব কর্মীর জন্যে দক্ষিণা ঠিক করা আছে। যে যা করবে দায়িত্ব নিয়ে করবে। তার সামর্থ্য, তার ইচ্ছা সবটারই মূল্য দেওয়া হচ্ছে। মনে করার কারণ নেই যে এটা ওদের স্রেফ ভিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
—কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম এঁরা কি কাজের জন্য টাকা নেন? এঁদের কি সেজন্য দায় কম থাকে?
—এঁরাও নেন। অনবরত নিচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে নিচ্ছেন না, কিন্তু এঁদের সঙঘ, মিশন অজস্র দান পায়। তাই দিয়ে যেমন সেবামূলক কাজ চলে তেমন সেবকদের ভরণপোষণ ইত্যাদি সমস্ত প্রয়োজনই মেটানো হয়। এঁরা যে স্কুল-হস্টেল ইত্যাদি চালান, সেখানে কি টাকা নেন না? আমরা কোনও সঙেঘ নেই। আমাদের পরিবার আছে, ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে, সেগুলো মিটবে কী করে? মেয়েরা তো টাকাটা দিচ্ছে না। আর যদি দিতও, তোর সেটা নেওয়া উচিত হত।
—কেন?
—কেন নয়? প্রথমত, ওদেরও তো মানসম্মান আছে! উপার্জন করছে, পয়সা খরচ করে কেনাকাটা করতে পারবে বলেই তো! আর দ্বিতীয়ত, ওরা যেভাবেই রোজগার করুক, তুই তো আর অসৎ কাজ করে টাকা নিচ্ছিস না!
এই যুক্তি জিনার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হয়, টাকাটা তাকে অতিরিক্ত দায়বোধ দিয়েছে। চ্যারিটি করছি, সুতরাং মনের ঔদার্যে যখন যতটুকু দিচ্ছি, খুব দিচ্ছি—এ মনোভাবটা তৈরি হতেই পারল না। সে চিন্তা করে কীভাবে এগোলে, অল্প সময়ে বেশি শেখাতে পারবে, কীসে ওদের ভাল লাগবে, কীভাবে ওদের জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বেশি আগ্রহী করে তোলা যায়। প্রত্যেকবার টাকাটা হাতে নেয়, আর ভেতর থেকে কী যেন তাকে কামড়ায়, আশা এখনও যুক্তাক্ষর কায়দা করতে পারল না। সর্বজয়া পারে কিন্তু পড়বে না। পুতুল উসখুস করে কিছুতেই মন বসে না তার, কী করে এগোবে? কীভাবে…
মল্লিকা বলল, তোর নবাববাহাদুরকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিস তো!
—জিজ্ঞেস করার কী আছে? তার টাইমের সঙ্গে তো আর ক্ল্যাশ করছে না!
—ক্ল্যাশ করুক আর না করুক…জিনা, অনুমতি নিসনি, না?
শাজাহানকে বলেছি।
—শাহাজানকে? মানে? ও, তা ঔরংজেব কবে শাজাহানের কথা মানল?
জবাবে জিনা বলল, —আমি তো আর দাসী-হাটে বিক্রি হয়ে আসিনি।
—বিপদে পড়বি জিনা।
—যেদিন পড়ব, সেদিন ভাবব। কুড়মুড় করে নিমকি চিবোতে চিবোতে বলল, জিনা।
—কোথায় তোদের সেন্টারটা?
—ওই তো ওই দিকে, সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু থেকে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট…
—ওরে বাবা। ও জায়গাটা একেবারে ভাল না জিনা।
—কেন গো?
—খারাপ পাড়া। তোর সঙ্গে কে থাকে? মুকুট?
—যদি কেউ না থাকে? শুধু আমি থাকি আর আমার ছাত্রীরা?
—তোর পক্ষেও নিরাপদ নয়, তোর ছাত্রীদের পক্ষেও নয়। ওরা কি আর জায়গা পেল না? যত উলটোপালটা লোক যায় ওখানে।
—সত্যি, কারা যায় ওসব জায়গায় বলো তো দিদিভাই!
—কী জানি বাবা, মেয়েরা যায় না, পুরুষরাই যায় এটুকুই জানি।
—কীরকম পুরুষ? ধরো তারা কি কারও বাবা? কাকা? জ্যাঠা? স্বামী? দাদা? ভাই?
—উঃ, তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না!
—আটকাবার কী আছে? যারা যায় তারা তো আর নিঃসম্পর্ক নয় রে বাবা। কারও না কারও ছেলে তো বটেই। বাবা-কাকা, ভাই-বেরাদর তো বটে!
—ইস, কী বিশ্রী! কখনও ভাবিনি এ নিয়ে।
—তা হলে এখন একটু ভাবো।
—কেন? হঠাৎ এখন আমার কী দায় পড়ল যে খারাপ মেয়েদের কথা ভাবতে বসব? তুই এমন এক একটা কথা বলিস!
—খারাপ মেয়েদের কথা ভাবতে বলিনি গো! খারাপ ছেলেদের কথা ভাবো। কারা সেই ধিনিকেষ্ট, যাদের মজার জন্যে পাড়া ভর্তি করে করে মেয়ে পুষে রাখতে হয়, যে মেয়েদের বাবা নেই, ভাই নেই, স্বামী নেই, ছেলে নেই, ছেলেবেলা নেই, বন্ধু নেই, দিন নেই, রাতও নেই রাতের মতো। পেটের দায়ে যারা যৌনাঙ্গ ভাড়া খাটায়!
মল্লিকা বলে উঠল, ছি! ছি! জিনু দু দিন বেরিয়েই তোর মুখের ভাষা কী হয়েছে রে? গঙ্গাজল দেব? মুখ ধুয়ে আসবি?
—ধুয়েছি তো! এসেই সাবান ঘষে ঘষে সর্বাঙ্গ ধুলাম দেখলে না? আমি যে ওদেরই পড়াতে যাই?
—কাদের? —স্তম্ভিত হয়ে মল্লিকা জিজ্ঞেস করল।
—‘খারাপ’ মেয়েদের দিদিভাই। ‘খারাপ’ ছেলেদের এখনও হাতের কাছে পাইনি। হাতে যদি একবার পাই…