গণ্ডারের দুধ
টু প্লাস টু ফোরই হবে, থ্রি কিংবা ফাইভ হবে না—এই ইংরেজি প্রবচনটা শিবরাম চক্রবর্তী একবার একটু ঘুলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন, দুয়ে দুয়ে সব সময়ে চার হবে তা নয় অনেক সময় দুয়ে দুয়ে দুধও হয়।
শিবরাম চক্রবর্তীর এই দুধ দোয়ানোর কথা মনে পড়ল সাম্প্রতিক একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে। সংবাদটি গণ্ডারের দুধ দোয়ানো সংক্রান্ত। সংবাদটি অনেকেই হয়তো দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে হাতির দুধের গল্পটা বলে নিই।
গল্পটি অবশ্য আমার পক্ষে খুব সম্মানজনক নয়। না, এমন আশঙ্কা করবেন না কেউ যে আমার মেদবহুল সুস্বাস্থ্য দেখে কেউ আমাকে হাতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সে রকম কেউ করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কিন্তু তা করেনি, অন্তত আমার জ্ঞাতসারে নয়।
আমারই অস্ত্রে আমাকে ঘায়েল করেছিল একটি প্রগলভা বালিকা। কয়েকমাস আগে গিয়েছিলাম বাঁকুড়ায়। সেই সময়ে জঙ্গলের হাতি এসে জনপদে হুলস্থূল বাঁধিয়ে দিয়েছে। ঘরদোর ভেঙে ফেলছে হাতির পাল। ধানখেত চষে ফেলছে। মানুষজন আহত হচ্ছে, নিহতও হচ্ছে। প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় হস্তিযূথের ছবি বেরচ্ছে। এদিকে শহরে গুজব রটেছে যে হাতির পাল এদিকেই আসছে। চারদিকে সাজসাজ রব উঠে গিয়েছে। বাজারে, রাস্তায়, অফিসে-আদালতে সর্বত্র হাতির কথা।
বাঁকুড়া শহরে আমি পুরনো বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। বন্ধুদের আবার জমিজমা আছে জঙ্গলের দিকে গ্রামে। ফলত বন্ধুদের বাড়িতে হাতির গল্প, লোমহর্ষক সেসব কাহিনী—আরও বেশি বেশি হচ্ছে।
এই রকম এক আলোচনার সময়ে হঠাৎ বন্ধুর ভাইঝি, সুরম্যা, বছর বারো বয়েস হবে, ক্লাস এইটে পড়ে, হঠাৎ বলে বসল, ‘হাতির দুধ খুব স্বাস্থ্যকর।’
এ রকম কথা আগে আর শুনিনি, তাই বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে না গিয়ে প্রশ্ন করলাম ‘কে বলেছে?’
সুরম্যা ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘কে আবার বলবে? প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কী প্রত্যক্ষ প্রমাণ?’
সুরম্যা বলল, ‘হাতির দুধ খেয়ে একটা বাচ্চার তিন মাসে কুড়ি কেজি ওজন বেড়েছে।’
সুরম্যার কথা শুনে তার জ্যাঠা মানে আমার বন্ধু মিটমিট করে হাসছিলেন। আমি সুরম্যাকে বললাম, ‘কত বড় বাচ্চা?’
সুরম্যা জানাল, ‘এক বছরের বাচ্চা।’
আমি বললাম, ‘অসম্ভব। এক বছরের বাচ্চার ওজনই দশ কেজি হবে না। তার ওজন বাড়বে কুড়ি কেজি?’
সুরমা বলল, ‘ও তুমি বুঝি মানুষের বাচ্চার কথা ভেবেছ। মানুষের নয় হাতির বাচ্চা, একটা হাতির বাচ্চার মায়ের দুধ খেয়ে তিনমাসে কুড়ি কেজি ওজন বেড়ে গেছে।’
এবার গণ্ডারের দুধ দোয়ার প্রসঙ্গে আসি। সম্প্রতি, এই গরমের দিনেও অসময়ে গুয়াহাটি শহরের চিড়িয়াখানায় খুব ভিড় হচ্ছে। সবাই যে জীবজন্তু দেখছে তা কিন্তু নয়, সবাই যাচ্ছে গণ্ডারের দুধ দোয়ানো দেখতে।
শনিরাম বোড়ো চিড়িয়াখানার জনৈক কর্মচারী। সে গোরুর মতো করে গণ্ডারের দুধ দোয়ায়।
শনিরামের আসল কাজ ছিল গণ্ডারের খাঁচা পরিষ্কার করার এবং গণ্ডারের খাবার দেওয়া। এ কাজ করতে প্রথম সে খুব ভয় পেত। কিন্তু তাকে তার শ্বশুরমশায় বলেছিলেন যে কোনও হিংস জীবজন্তুকে আদরযত্নে-ভালবাসায় বশ মানানো যায়।
কিন্তু গণ্ডার অত্যন্ত খামখেয়ালি প্রাণী। প্রায় বিনা প্ররোচনাতেই সে অনেক সময় মানুষকে বা অন্য পশুকে আক্রমণ করে। তবুও সাহসে ভর করে শনিরাম ধীরে ধীরে খাঁচায় গণ্ডারের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপিত করে এবং গণ্ডারের বাচ্চা আলাদা খাঁচায় রেখে গণ্ডারের দুধ দোয়া আরম্ভ করে।
আশ্চর্যের বিষয় এই দুধ দোয়ানোয় মা গণ্ডার শনিরামকে মোটেই বাধা দেয়নি। এ ঘটনা শুরু হয়েছিল বছর পনেরো আগে। তারপর শনিরাম বছরের পর বছর দুগ্ধবতী গণ্ডার জননীদের দোহন করে যাচ্ছে।
এবং এ কাজে এখন সে একা নয়। তার একটি দোসর জুটছে। তার নাম উমেশ রাজবংশী।
উমেশ রাজবংশীও গুয়াহাটি চিড়িয়াখানার কর্মচারী। সে শনিরামের কাছ থেকে গণ্ডারের দুধ দোয়া ভাল ভাবেই শিখে নিয়েছে। এ ব্যাপারে তারও কোনও ভয়ডর নেই।
ফলে চিড়িয়াখানায় একসঙ্গে দুটি দুগ্ধবতী গণ্ডার হলে, পাশাপাশি খাঁচায়, শনিরাম আর উমেশ বালতি নিয়ে গণ্ডারের দুধ দোয়ায়। এই দৃশ্য দেখতে চিড়িয়াখানায় ভিড় উপচিয়ে ওঠে।
কিন্তু জানা যাচ্ছে না, এই গণ্ডারের ওই দুধ দিয়ে কী হয়। শনিরাম বা উমেশ কি খায়। নাকি অন্য মানুষেরা কিনে খায়। অবশ্য জল মিশিয়ে গোরুর দুধের সঙ্গে ভেজালও দেওয়া হতে পারে।
আমি ভাবছি, বাঁকুড়ার সুরম্যার গল্পের মতো গণ্ডারের দুধ নিয়মিত খেয়ে কোনও মানুষের ওজন তিনমাসে কুড়ি কেজি বেড়ে যাবে না তো?