গণ্ডগোল

গণ্ডগোল 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

প্রাতঃকাল কিন্তু সূর্য্যদেব তখনও দুর্ভেদ্য কুজ্ঝটিকাজাল ভেদ করিতে সমর্থ হন নাই। ফাল্গুন মাস, শীতের প্রকোপ অনেকটা হ্রাস হইয়াছে। মৃদুমন্দ মলয়পবন প্রবাসীর দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় থাকিয়া থাকিয়া প্রবাহিত হইতেছে। বেল যুঁই মল্লিকাদি কুসুমসৌরভে চারিদিক আমোদিত হইতেছে। বসন্তাগমে বৃক্ষাদি নব পল্লবে আচ্ছাদিত হইয়া প্রকৃতির শোভা বর্দ্ধন করিতেছে। শিশিরবিন্দুচয় পত্র হইতে পত্রান্তরে পতিত হইয়া শ্রুতিমধুর অস্পষ্ট ধ্বনিতে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিতেছে। 

এ হেন সময়ে তিনজন সম্ভ্রান্ত মহিলা কাশিমগঞ্জের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভৈরবীর মন্দিরে উপনীত হইলেন। মন্দিরটি ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত — কাশিমগঞ্জের বিখ্যাত জমীদার শশাঙ্কশেখর সেই দেবী স্থাপনা করেন এবং তাঁহার পূজা ও অর্চ্চনার জন্য বার্ষিক দুই সহস্র মুদ্রা নির্দিষ্ট করিয়া দেন। 

মহিলাত্রয়ের মধ্যে একজন প্রৌঢ়া – বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখলেই বোধ হয় যৌবনে তিনি পরম সুন্দরী ছিলেন। তাঁহার নাম সুহাসিনী — গৌরীপুর গ্রামের প্রসিদ্ধ জমীদার সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী। দ্বিতীয়া বালিকা — বয়স বার বৎসরের অধিক নহে, দেখিতে অতি সুন্দরী, নাম চারুশীলা, সতীশচন্দ্রের একমাত্র সন্তান। অপরা যুবতী, বয়স প্রায় আঠার বৎসর। যৌবনের পূর্ণ জোয়ার তাহার দেহ-নদীর কূলে কূলে প্লাবিতা – নাম রাধারাণী, সুহাসিনীর দূর-সম্পর্কীয়া ভগিনী। 

প্রায় এক বৎসর অতীত হইল চারুশীলা সাংঘাতিক রোগে আক্রান্ত হয়। সতীশচন্দ্র জমীদার-অগাধ সম্পত্তির অধিকারী, একমাত্র কন্যার চিকিৎসার জন্য তিনি যথাসর্ব্বস্ব ব্যয় করিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না, কোন ঔষধেই তাহার উপকার হইল না, কিছুতেই কন্যার রোগ সারিল না। অবশেষে দেবী ভৈরবীর স্বপ্নাদ্য ঔষধ ধারণ করিয়া চারুশীলা রোগমুক্ত হইল। এই কারণে ষোড়শোপচারে দেবীর পূজা দিবার জন্য কন্যা ও ভগিনীকে সঙ্গে লইয়া জমীদার-পত্নী সুহাসিনী সেদিন অতি প্রত্যূষেই দেবীমন্দিরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। 

গৌরীপুর গ্রাম কাশিমগঞ্জ হইতে প্রায় তিন ক্রোশ দূর অবস্থিত। বেলা এক প্রহরের মধ্যেই দেবীর পূজা সমাপ্ত হয় শুনিয়া তাঁহারা পূর্ব্বদিনেই গৌরীপুর ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং কাশিমগঞ্জে এক পরিচিত লোকের বাড়ীতে রাত্রি যাপন করিয়া প্রত্যূষেই দেবীমন্দিরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। 

স্ত্রী কন্যাকে সঙ্গে লইয়া দেবীর মন্দিরে আসিতে সতীশচন্দ্রের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। নির্দ্দিষ্ট দিনে তাঁহার এমন কাজ পড়িল যে, তিনি কোন মতেই সেদিন বাটীর বহির হইতে পারিলেন না। অগত্যা দুইজন বলিষ্ঠ দ্বারবানের সঙ্গেই তাঁহাদিগকে পাঠাইতে বাধ্য হইলেন। 

পূজা সমাপ্ত হইলে জমীদার-পত্নী সকলকে লইয়া পূজারি ব্রাহ্মণের বাসাবাটীতে গমন করিলেন। ব্রাহ্মণ সেদিন যথেষ্ট লাভ করিয়াছিলেন! সুহাসিনী ও সঙ্গিনীগণের অভ্যর্থনার জন্য তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করিলেন। যাহাতে তাঁহাদের কোনরূপ কষ্ট না হয় তদ্বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ করিলেন। 

যে দুইজন দ্বারবান্ তাঁহাদের সঙ্গে আসিয়াছিল তাহারা রাজপুত ব্রাহ্মণ, অপর লোকের হস্তে আহার করে না বলিয়া সুহাসিনী তাহাদিগকে রন্ধন করিতে আদেশ করিলেন এবং তদুপযোগী সমস্ত দ্রব্যের আয়োজন করিয়া দিলেন। দ্বারবানদ্বয় হৃষ্টচিত্তে আপন আপন খাদ্য সামগ্রী পাক করিতে লাগিল। 

বেলা দ্বিপ্রহরের সময় সুহাসিনী, কন্যা ও ভগিনীর সহিত আহার করিলেন এবং গৃহে প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন কিন্তু দ্বারবান্দ্বয়ের পাক-শাক তখনও শেষ হয় নাই। বিলম্ব দেখিয়া রমণীত্রয় মাঠের শোভা সন্দর্শনার্থ ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলেন। 

পূজারি ব্রাহ্মণ তাঁহাদিগকে ভ্রমণার্থ বাহিরে যাইতে দেখিয়া অধিক দূরে যাইতে নিষেধ করিলেন এবং সত্বর প্রত্যাগমন করিতে অনুরোধ করিলেন। সুহাসিনীও ঈষৎ হাসিয়া তাঁহার কথায় সম্মত হইলেন এবং অতি অল্প কালের মধ্যেই নিকটস্থ এক বিস্তীর্ণ মাঠে প্রবেশ করিলেন। 

কিছুদূর গমন করিয়া তাঁহারা পথ ভুলিয়া গেলেন। যে পথ দিয়া তাঁহারা মাঠে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সে পথ তাঁহারা সকলেই বিস্মৃত হইলেন এবং যতই সেস্থান হইতে বাহির হইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন, ততই তাঁহাদের দিগভ্রম হইতে লাগিল। অবশেষে নিতান্ত অবসন্ন হইয়া এক প্রকাণ্ড বৃক্ষের তলে উপবেশন করিলেন। 

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সুহাসিনী অতি বিমর্য ভাবে বলিলেন “ব্রাহ্মণের উপদেশ যেমন অবহেলা করিয়াছিলাম, তেমনই তাহার উপযুক্ত ফল পাইয়াছি। বেলা প্রায় দুইটা বাজিতে চলিল, আমরা যে কতদূরে আসিয়া পড়িয়াছি তাহার জানিবার উপায় নাই। আমাদের দুজনের জন্য বিশেষ ভাবি না কিন্তু চারুশীলার কি হইবে? মা আমার শৈশবাবধি কষ্টের নামমাত্র জানে না, সে আজ কেমন করিয়া এই নির্জ্জন মাঠে রাত্রি যাপন করিবে? 

রাধারাণী এতক্ষণ কোন কথা কহেন নাই। কিন্তু সুহাসিনীর শেষ কথাগুলি শুনিয়া তিনি আর থাকিতে পারিলেন না। তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিলেন “কেন দিদি, এত ভাবিতেছ? সেই দরোয়ান দুইজনই ত নষ্টের মূল। এতক্ষণ নিশ্চয়ই তাহাদের আহার শেষ হইয়াছে, হয় ত এখনই আমাদের খোঁজ পড়িবে। যখন পূজারি ব্রাহ্মণ ঠাকুর আমাদের সহায়, তখন এত চিন্তা কেন? তিনি নিশ্চয়ই আমাদের অন্বেষণে লোকজন পাঠাইয়া দিবেন।” 

চারুশীলা মায়ের কথা শুনিয়া কাঁদ কাঁদ হইয়াছিল, মাসীমার কথায় তাঁহার সাহস হইল, মুখে হাসি ফুটিল। সে বলিল “সত্যই ত, আমাদের সঙ্গে যে দুইজন দরোয়ান আসিয়াছে তাহারা কি আমাদিগকে অন্বেষণ করিতে আসিবে না? তাহারা কি আমাদিগকে না লইয়া বাড়ীতে ফিরিতে পারিবে? 

কন্যা ও ভগিনীর কথায় সুহাসিনীরও সাহস হইল। তিনি বলিলেন “তবে আর এখানে বসিয়া থাকিলে কি হইবে–চল, আমরা আরও একটু অগ্রসর হই। দেখি, পথ বাহির করিতে পারি কি না।” 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

“সদার! একটা বড় কাৎলা দেখা দিয়াছে, কিন্তু 

“কিন্তু কি রে সদা! কথাটা ভেঙ্গেই বল্।” 

সদানন্দ ঈষৎ হাসিল। একবার চারিদিক ফিরিয়া দেখিল। পরে বলিল “কাৎলা বটে কিন্তু মেয়েমানুষ।” সদার অট্টহাস্য করিল। হাসিতে হাসিতে বলিল “অনেক দিন শিকার পাওয়া যায় নাই। রোজ রোজ খালি হাতে বাড়ী ফিরিলে তোদের সর্দ্দারনি আমায় দূর করে দেবে। মেয়েই হউক আর পুরুষই হউক, তুই খবর নিয়ে আয়, ভগবান যখন আজ শিকার পাঠিয়েছেন, তখন কিছুতেই ছাড়া হবে না। 

সদারের হুকুম পাইলেও সদানন্দ দাঁড়াইয়া রহিল। অবনত মস্তকে সে যেন কি ভাবিতে লাগিল, কিছুক্ষণ পরে উত্তর করিল “এতদিন তোমার চেলাগিরি করিতেছি, কই একটি দিনও ত এমন হুকুম দাও নাই সর্দ্দার! বরং আমরা ও কথা তুলিলে তুমি আমাদের উপর রাগ করিতে। আজ কেন তোমার এ ভাব?” 

সদানন্দের প্রশ্ন শুনিয়া এবং তাহার কার্য্যে অবহেলা দেখিয়া সর্দ্দার ভয়ানক রাগান্বিত হইল। তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ হইল; সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল, কিছুক্ষণ সে কোন কথা কহিল না। পরে বজ্রনির্ঘোষ স্বরে জিজ্ঞাসা করিল “সদা! আমার হুকুম তামিল করবি কি না?” 

বিনা মেঘে অশনিপাত হইলে পথিক যেমন মুগ্ধ হয়, সর্দ্দারের কথা শুনিয়া সদানন্দ ততোধিক স্তম্ভিত হইল। সে মুখে কোন কথা না বলিয়া সদারের সম্মুখ হইতে সরিয়া পড়িবার চেষ্টা করিল। সর্দ্দার তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া পুনরায় বলিল “যদি ভাল চাস্, যা বলেছি এখনই কর্।” 

সদানন্দ আর দ্বিরুক্তি করিতে সাহস করিল না। সে সর্দ্দারের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল, পরে সহসা তাহার পদতলে পতিত হইয়া দুই হস্তে পদধূলি গ্রহণ করতঃ আপনার মস্তকে প্রদান করিল। তাহার পর নিমেষ মধ্যে গাত্রোত্থান করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিল। এত শীঘ্র সে এই সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন করিল যে, সদারের আন্তরিক ইচ্ছা হইলেও সে তাহার কার্য্যে বাধা দিতে পারিল না। 

সদানন্দ প্রস্থান করিলে পর সর্দ্দার সম্মুখস্থ একটি প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষতলে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল। প্রায় অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যেই সদানন্দ ফিরিয়া আসিলে সর্দ্দার জিজ্ঞাসা করিল “খবর কি সদা?” 

যতক্ষণ তাহার সে কাৰ্য্যে মন ছিল না, ততক্ষণ সদানন্দ তাহা সম্পন্ন করিবার কোনপ্রকার উপায়েরই চেষ্টা করে নাই। কিন্তু এখন তাহার মতি ফিরিয়াছে; তাই সে হাসিতে হাসিতে উত্তর করিল “যা’ বলেছি ঠিক তাই। তিনজন স্ত্রীলোক, সঙ্গে পুরুষ নাই। ভাবভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বুঝা যায়, পথ ভুলেছে। এইদিকে আছিল, সহসা কি মনে করে ফিরে গেল। এখন বোধ হয় তারা এখান থেকে আধ ক্রোশ দূরে আছে। 

স। বেশ কথা—কিন্তু আসল কথা কি? কিছু আছে? 

সদা। আর কিছু না থাক্, গায়েব গহনায় হাজার কতক টাকা হ’তে পারে, মেয়েটা ত সোণায় মোড়া। সদার লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া হাসিয়া বলিল “বলিস্ কি? তবে আর দেরি কেন? শেষে কি আপশোষ করবো?” 

সদানন্দ বলিল, “আর একজন লোক চাই।” 

আশ্চর্যান্বিত হইয়া সর্দ্দার জিজ্ঞাসা করিল “সে কি! তিনটে মেয়েমানুষকে সাবাড় করতে আরও লোকের দরকার? বাধা দিয়া সদানন্দ বলিল “কাজটা রাতে নিঃশব্দে হাসিল হয়, তাই আমার চেষ্টা। একেবারে তিনজনে তিনজনকে আক্রমণ করলে কেউ আর চেঁচাতে পারবে না।”

সর্দ্দার কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিল। পরে বলিল “বেশ কথা—রত্নাকে ডেকে নিয়ে আয়। সেটা কাজের লোক—সহজে এ কাজটা হাসিল করতে পারবে।” 

সদানন্দ দ্বিরুক্তি না করিয়া চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ যুবকের সহিত ফিরিয়া আসিল। নবাগতকে দেখিয়া সদার অল্প কথায় সকল ব্যাপার বুঝাইয়া দিল। পরে তিনজনে পৃথক ভাবে তিন দিকে গমন করিয়া অতি দ্রুতবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল। 

কিছুক্ষণ এইরূপে গমন করিলে রমণী তাহাদের নয়ন গোচর হইল। সর্দ্দার তখন তাহার দুইজন শিষ্যকে সঙ্কেত করিয়া নিকটে ডাকিল এবং প্রত্যেককে এক একজন রমণীর ভার দিয়া স্বয়ং অবশিষ্ট স্ত্রীলোকের ভার গ্রহণ করিল। স্ব স্ব নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিলে পর সর্দ্দার রমণীগণকে আক্রমণ করিবার জন্য সঙ্কেত করিল। নিমেষ মধ্যে তিনজনে তিনজন রমণীকে আক্রমণ করিল। 

একে দুর্ব্বল রমণী অসহায়া, তাহার উপর সহসা আক্রান্ত হওয়ায় সকলেই হতচেতন হইয়া ভূমিতলে পতিত হইল। দস্যুগণ তাহাদিগের গাত্র হইতে অলঙ্কারগুলি খুলিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময়ে অদূরে অশ্বের পদশব্দ তাহাদের কর্ণ গোচর হইল। সর্দ্দার ও তাহার শিষ্যগণ সে শব্দে চমকিত হইল। যে কার্য্য করিতে উদ্যত হইয়াছিল তাহা করিতে আর সাহস হইল না। কিন্তু এত পরিশ্রমের ফল ত্যাগ করিয়া যাইতেও তাহাদের মন সরিল না। 

শব্দের গতি বুঝিয়া তাহারা দেখিল, একজন অশ্বারোহী অতি দ্রুতবেগে তাহাদেরই দিকে আগমন করিতেছে। সদার সদানন্দের দিকে চাহিয়া হাসিয়া উঠিল। শিষ্যদ্বয় সে হাসির মর্ম্ম বুঝিতে পারিল এবং তাহার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিল। 

নিমেষ মধ্যে অশ্বারোহী তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং দস্যুসর্দ্দার ও তাহার শিষ্যদ্বয় আক্রমণ করিবার পূৰ্ব্বেই ভূমিতলে লম্ফ প্রদান করিয়া সদারের ললাটে ভ্রুদ্বয়ের ঠিক মধ্যস্থলে সবলে এমন এক আঘাত করিলেন যে, সে তদ্দণ্ডে শব্দমাত্র না করিয়া হতচেতন হইয়া ভূমিতলে পড়িয়া গেল। 

সদারের এই অবস্থা দেখিয়া তাহার চেলা দুইজন কি করিবে স্থির করিতে না করিতে অশ্বারোহী সদানন্দের ললাটেও সেইরূপ আর একটি মুষ্ঠ্যাঘাত করিলেন; সেও অজ্ঞান হইয়া পড়িল। তৃতীয় দস্যু রত্না পলায়নের উদ্যোগ করিতেছিল অশ্বারোহী বুঝিতে পারিলেন এবং তাহাকেও তাহার সঙ্গীদ্বয়ের দশায় আনয়ন করিলেন। 

তিনজনকে হতচেতন দেখিয়া অশ্বারোহী সত্বর কিয়দংশ অশ্বরজ্জু কাটিয়া লইলেন এবং তদ্বারা তিনজনকে এমন দৃঢ়রূপে একটি গাছের সহিত বন্ধন করিলেন যে, তাহারা জ্ঞান লাভ করিয়া সবলে চেষ্টা করিলেও কোনক্রমেই পলায়ন করিতে পারিবে না। 

এইরূপে দস্যু তিনজনকে বন্ধন করিয়া তিনি রমণীত্রয়কে পরীক্ষা করিলেন এবং তাহাদের শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইলেন। অনেক কষ্টে বালিকার মোহ অপনীত হইল। কিন্তু সুহাসিনী বা তাঁহার ভগ্নী সাংঘাতিকরূপে আহত হওয়ায় সহজে জ্ঞান লাভ করিতে পারিলেন না। 

চারুশীলা জ্ঞান লাভ করিলে পর অশ্বারোহী একবার তাহার আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। যাহা দেখিলেন, তেমন রূপ তিনি আর কখনও নয়ন গোচর করেন নাই। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, সহসা তাঁহার মুখমণ্ডল পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। 

ইত্যবসরে সুহাসিনী চক্ষু উন্মীলন করিলেন। অশ্বারোহী তখনই আত্মসংবরণ করিয়া তাঁহার পার্শ্বে গমন করিলেন এবং বাহ্যিক পরীক্ষা দ্বারা স্পষ্টই জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার মৃত্যুকাল উপস্থিত। চারুশীলা এতক্ষণ কোন কথা কহে নাই, তাহার অবস্থা দেখিয়া অশ্বারোহী পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, সে অতি সামান্যমাত্র আঘাত পাইয়াছিল। সুহাসিনীকে সচেতন দেখিয়া বালিকা ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করিল এবং মায়ের নিকট গিয়া তাঁহাকে মুমূর্ষু বলিয়া বুঝিতে পারিল ও চীৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিল। 

অশ্বারোহী বিষম ফাঁপরে পড়িলেন। তিনজন আহতা রমণী তাঁহার সম্মুখে, তিনজন দুর্দান্ত দস্যু বদ্ধাবস্থায় এক বৃক্ষের তলে, এ সকল ত্যাগ করিয়া তিনি কেমন করিয়া নিকটস্থ থানায় সংবাদ দিবেন তাহা বুঝিতে পারিবেন না। কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। 

এমন সময়ে সুহাসিনী তাঁহার দিকে চাহিয়া অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন “চারু! আমার কন্যা কোথায়? হরি! হরি! কেন আমরা বেড়াইতে আসিয়াছিলাম?” 

চারুশীলা নিকটেই ছিল। সে মায়ের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল “এই যে আমি–মা! তুমি কি আমায় চিনিতে পারিতেছ না? আমি যে তোমারই নিকটে আছি মা! কেন মা তুমি এমন করিতেছ?” 

কন্যার কণ্ঠস্বর সুহাসিনীর কর্ণ গোচর হইল। তিনি চারুশীলাকে জীবিতা জানিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। কিন্তু বোধ হইল তিনি তাহার কোন কথাই বুঝিতে পারেন নাই। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন “রাধা গেল কোথায়? সে কেমন আছে?” 

রাধারাণীর মোহ তখনও অপনীত হয় নাই। চারুশীলাই মায়ের কথায় উত্তর দিল। বলিল “মাসীমার এখনও জ্ঞান হয় নাই। তিনি মড়ার মত পড়িয়া আছেন।” 

চারুশীলার শেষ কথাগুলি বোধ হয় সুহাসিনীর কর্ণ গোচর হইল না। তিনি পুনরায় হতচেতন হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁহার পুনরায় জ্ঞানসঞ্চার হইল। চক্ষু উন্মীলন করিয়া সম্মুখেই অশ্বারোহীকে দেখিতে পাইলেন এবং তখনই সঙ্কেত করিয়া তাঁহাকে নিকটে বসিতে বলিলেন। অশ্বারোহী সুহাসিনীর অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিলেন না, শশব্যস্তে তাঁহার সম্মুখে গিয়া বসিয়া পড়িলেন। 

সুহাসিনী একবার অশ্বারোহীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া অতি মৃদুস্বরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথায় বলিলেন “আপনি কে? চারুর কি হবে?” 

যেরূপ কষ্টের সহিত সুহাসিনী কথাগুলি উচ্চারণ করিলেন, তাহাতে অশ্বারোহী স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার মৃত্যুকাল উপস্থিত। তিনি ম্লান ভাবে উত্তর করিলেন “আপনার কোন চিন্তা নাই– আমাকে আপনার বলিয়াই বিবেচনা করিবেন। আমি একজন উকীল – বিশেষ কোন কাৰ্য্য বশতঃ অশ্বারোহণে এই মাঠ দিয়া যাইতেছিলাম। দূর হইতে তিনজন দস্যুকে আপনাদিগকে আক্রমণ করিতে দেখিয়া দ্রুতগতি এখানে আসিয়াছি। ঈশ্বরের কৃপায় দস্যু তিনজনকে গ্রেপ্তার করিতে সমর্থ হইয়াছি। দেখুন, তাহাদিগের হস্তপদ আবদ্ধ করিয়া বৃক্ষের তলে রাখিয়াছি। এখন তাহারাও অচেতন, সুতরাং পলায়নের কোন সম্ভাবনা নাই।” 

সুহাসিণী একবার নির্দ্দিষ্ট দিকে লক্ষ্য করিলেন। বোধ হয় দস্যুগণ তাঁহার দৃষ্টি গোচর হইল। তাঁহার মুখে অল্প হাসি দেখা দিল। কিন্তু সে কেবল ক্ষণেকের জন্য। পরে অতি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি উকীল বলিলেন?” অশ্বারোহী বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, আমার নাম কালীচরণ মুখোপাধ্যায়। যদি আপনারা আর কিছুক্ষণ এখানে এ অবস্থায় থাকেন, তাহা হইলে আমি সত্বর একজন ডাক্তার আনিতে পারি।” 

সুহাসিনী যেন কি চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন “না—ততক্ষণ বাঁচিব না। আর হয়ত দেখা হবে না।” অশ্বারোহী আন্তরিক দুঃখিত হইলেন। তিনি আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে আমি কি করিব বলিয়া দিন। যদি কোনরূপ সাহায্যের প্রয়োজন হয় বলুন, আমি এখনই প্রস্তুত আছি।” 

অশ্বারোহীর কথায় সুহাসিনীর মুখে হাসি আসিল। ক্ষণেকের তরে যেন তাঁহার যন্ত্রণার লাঘব হইল। তিনি যেন কিছু বল পাইলেন। স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, আমার একমাত্র কন্যার জন্য আমি বড়ই চিন্তিত হইয়াছি। মৃত্যুর পূর্ব্বে তাহার জন্য যদি কোনপ্রকার বন্দোবস্ত না করি, তাহা হইলে চারুশীলা কিছুই পাইবে না। তাই আমার আন্তরিক ইচ্ছা যে, তাহার নামে উইল করিয়া যাই। সৌভাগ্যক্রমে এ বিপদের সময় আপনি উপস্থিত আছেন। অল্প কথায় একখানি উইল করিয়া দিন, এই আমার একান্ত অনুরোধ।” 

অশ্বারোহী সম্মত হইলেন। সৌভাগ্যক্রমে নিকটেই সমস্ত সরঞ্জাম ছিল, পকেট হইতে কাগজ কলম বাহির করিয়া তিনি তখনই একখানি উইল লিখিয়া ফেলিলেন। 

উইল লেখা শেষ হইলে অশ্বারোহী সুহাসিনীকে উহার মর্ম্ম বুঝাইয়া দিলেন। মুমূর্ষু হইলেও তিনি তাহার অর্থ বুঝিতে পারিলেন। তাঁহার মুখে হাসি দেখা দিল। 

উকীলবাবু কলমটি সুহাসিনীকে স্পর্শ করাইয়া স্বয়ং তাঁহার নাম স্বাক্ষর করিলেন। পরে কাগজখানি চারুশীলার হস্তে প্রদান করিয়া যেমন সুহাসিনীর দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, দেখিলেন তাঁহার দৃষ্টি স্থির। তিনি বুঝিতে পারিলেন। তখনই তাঁহার দেহ হইতে প্রাণবায়ু বহির্গত হইল। চারুশীলা চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। 

রাধারাণী তখনও অজ্ঞানাবস্থায় ছিলেন। চারুশীলা তাঁহাকেও মৃতা বিবেচনা করিয়া অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িল। দস্যু তিনজন তখনও হতচেতন। সম্মুখে সুহাসিনীর মৃতদেহ। অশ্বারোহী বিশেষ চিন্তিত হইলেন। ভাবিলেন, তখনই নিকটস্থ থানায় সংবাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু কেমন করিয়াই বা চারুশীলাকে সে অবস্থায় রাখিয়া গমন করিবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। 

অনেক কষ্টে চারুশীলাকে শান্ত করিয়া অশ্বারোহী তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। 

অশ্রুপূর্ণ চক্ষে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া চারুশীলা অশ্বারোহীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল “গৌরীপুরের জমীদার সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আমার পিতা। আমরা এখানে ভৈরবীর পূজা দিতে আসিয়াছিলাম।” 

উকীলবাবু আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। ভাবিলেন, জমীদার-পত্নী লোকজন না লইয়া এত দূরে আসিলেন কেন? কিন্তু সে কথা চারুশীলাকে জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলেন না। 

তাঁহাকে নীরব ও চিন্তিত দেখিয়া চারুশীলা বোধ হয় তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিল। সে বলিল “আমাদের সঙ্গে যে লোক আসিয়াছিল, তাহাদের আহার হয় নাই বলিয়া আমরা তিনজনে মাঠে বেড়াইতে বেড়াইতে পথ ভুলিয়া যাই। চারিদিকে ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে এই দশা হয়।” 

অশ্বারোহী চমকিত হইয়া বলিলেন “কি সর্ব্বনাশ! মন্দির হইতে তোমরা যে প্রায় দেড় ক্রোশ পথ চলিয়া আসিয়াছ। এখান হইতে নিকটবর্ত্তী থানাও প্রায় এক ক্রোশ। সুতরাং মন্দিরে ফিরিয়া যাওয়া অপেক্ষা থানার দিকে যাওয়াই যুক্তিসিদ্ধ। কিন্তু একা তোমায় এতগুলি অচেতন ও মৃত লোকের মধ্যে রাখিয়া যাইতে সাহস হইতেছে না। কি জানি, ইতিমধ্যে যদি আবার কোন বিপদ ঘটে।” 

রাখিয়া যাইবার কথা শুনিয়া চারুশীলা শশব্যস্তে বলিয়া উঠিল “না – না – আমায় এখানে রাখিয়া যাইবেন না। আমি একা থাকিতে পারিব না।” 

যেরূপ নম্রতার সহিত চারুশীলা কথাগুলি বলিল, তাহাতে কালীচরণ বিচলিত হইলেন। তাঁহার হৃদয় দ্রবীভূত হইল। কিন্তু আসন্ন বিপদ হইতে উদ্ধারের কোন উপায় দেখতে পাইলেন না। থানায় সংবাদ দেওয়া বিশেষ প্রয়োজনীয় বটে, কিন্তু কেমন করিয়াই বা বালিকা চারুশীলাকে সেখানে রাখিয়া যান। তিনি বিষম ফাঁপরে পড়িলেন। কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। 

অবশেষে চারুশীলাকে সঙ্গে করিয়াই থানায় যাইতে মনস্থ করিলেন এবং তদনুসারে বলিলেন “যদি এখানে একান্ত না থাকিতে চাও, তাহা হইলে তোমায় আমার সহিত যাইতে হবে। আমার পার্শ্বে ঘোড়ার উপরে বসিতে হইবে– পারিবে ত?” 

চারুশীলা অতি বিনীত ও সলজ্জ ভাবে উত্তর করিল “আমি পূর্ব্বে অনেকবার ঘোড়ায় উঠিয়াছি— বিশেষ ভয় করে না। জমীদারের একমাত্র কন্যা, যাহা আবদার করিয়াছি তাহাতেই পিতামাতা সম্মত হইয়াছেন।” 

উকীলবাবু আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি প্রথমে চারুশীলাকে অশ্বে আরোহণ করাইয়া স্বয়ং তাহার পশ্চাতে উপবেশন করিলেন এবং এক হস্তে অশ্বরজ্জু অপর হস্তে বালিকাকে ধারণ করিয়া নিমেষ মধ্যে মাঠ পার হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ অতি দ্রুতবেগে গমন করিলে পর বালিকা হতচেতন হইয়া পড়িল। তিনি তাহার অচেতন দেহ বক্ষে দৃঢ় ধারণ করিয়া থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

উকীলবাবু চারুশীলাকে লইয়া প্রস্থান করিলে পর দস্যু তিনজনের মধ্যে একজনের জ্ঞান সঞ্চার হইল। সে চক্ষু উন্মীলন করিয়া একবার চারিদিক অবলোকন করিল। দেখিল, সম্মুখে দুইটি অচেতন দেহ, আর দেখিল তাহার ও তাহার বন্ধুদ্বয়ের হস্তপদাদি এরূপ দৃঢ় ভাবে সেই বৃক্ষের সহিত আবদ্ধ যে, সে অনেক চেষ্টা করিয়াও কোনক্রমে অব্যাহতি লাভ করিতে পারিল না। 

প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াও যখন সে আপনাকে মুক্ত করিতে পারিল না, তখন সে অপর দুই বন্ধুর মোহ অপনয়ন করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও কৃতকাৰ্য্য না হইয়া নিতান্ত হতাশ ভাবে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। সহসা তাহার মনে কি নূতন উপায় উদ্ভাবিত হইল। সে অতি উচ্চস্বরে তিনবার শিশ দিল। কিছুক্ষণ পরে অদূরে তাহার অনুরূপ আর তিনবার শিশ কর্ণ গোচর হইল এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গেই এক যুবতী হাঁপাইতে হাঁপাইতে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। 

দূর হইতে বৃক্ষতলে দস্যু তিনজনকে সেই প্রকার আবদ্ধ অবস্থায় দেখিতে পাইয়া রমণী কাপড়ের ভিতর হইতে একখানি ছোরা বাহির করিল। তাহার শাণিত চাকচিক্যময় ফলকে সূর্যরশ্মি প্রতিভাত হইতে লাগিল। রমণী সেই ছোরা তুলিয়াই বৃক্ষতলে উপস্থিত হইয়াছেন এবং কোন কথা না বলিয়া তখনই তাহাদের বন্ধন মোচন করিয়া দিল। 

ইত্যবসরে অপর দস্যুদ্বয়ও সংজ্ঞালাভ করিল। তখন তিনজনেই দণ্ডায়মান হইল। কিন্তু সকলের পলায়ন করিবার সামর্থ্য ছিল না। সর্দ্দার এরূপ আহত হইয়াছিল যে, তাহার নড়িবার ক্ষমতা ছিল না। রমণী যখন সর্দ্দারের অক্ষমতা বুঝিতে পারিল অথচ দেখিল যে, তাহার শিষ্য দুইজন তাহাকে লইয়া পলায়ন করিবার কোন চেষ্টা করিতেছে না, তখন সে অতি কর্কশ ভাবে বলিয়া উঠিল “ধিক্ তোদের জন্মে। সর্দ্দারের এরূপ অবস্থা দেখেও তোরা নিশ্চিন্ত আছিস্? ছিছি, যদি ভাল চাস, এখনই উহাকে দুইজনে কাঁধে ল’য়ে এখান হতে পলায়ন কর।” 

রমণীর কথা শেষ হইতে না হইতে সদানন্দ ও রত্না সর্দ্দারকে স্কন্ধে তুলিয়া লইল এবং নিমেষ মধ্যে দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল। রমণী সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। 

রমণীর বয়স প্রায় কুড়ি বৎসর। তাহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণা ও হৃষ্টপুষ্টা। অঙ্গসৌষ্ঠব অতি সুন্দর। মুখশ্রী নিতান্ত মন্দ নহে। কিছুক্ষণ ভাবিয়া সে স্থির করিল, অচেতন রমণীদ্বয়ের অলঙ্কার স্পর্শ না করাই ভাল। সে একবার অচেতন রমণীদ্বয়ের দিকে দৃষ্টি করিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিল। 

সদানন্দ ও তাহার সঙ্গী বিশেষ আহত হয় নাই, তাহারা অতি শীঘ্রই সর্দ্দারকে তাহার বাড়ীতে লইয়া গেল। সেখানে তাহারা তাহার আহত স্থানগুলির পরিচর্য্যা করিতেছে, এখন সময়ে সর্দ্দার অতি ক্ষীণ কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলিল “রাজু বড় সহজ মেয়ে নয়। সে যে খালি হাতে ফিরবে এমন ত বোধ হয় না।” 

বাধা দিয়া সদানন্দ বলিয়া উঠিল “নিশ্চয়ই না–সে নিশ্চয়ই খানকয়েক দামী গহনা যোগাড় ক’রে এনেছে। এখন শিকার আমাদের, কষ্ট আমাদের, আর লাভের বেলা রাজু! এ কথা বড় ভাল নয়।” 

রত্নাও এ কথায় সায় দিল। তখন সর্দ্দার বলিল, “এক কাজ করা যা’ক, ভায়াকে ডেকে এ বিষয়ে সন্ধান করতে বলে দেওয়া যা’ক্, রাজু যদি সত্য সত্যই কিছু যোগাড় করে থাকে, সকলেই অবশ্য তার অংশ পাবে।” 

সর্দ্দারের কথা শুনিয়া তাহারা উভয়েই সম্মত হইল। সদানন্দ সেইখানে বসিয়া সর্দ্দারের সেবা করিতে লাগিল। রত্‌না দ্রুতগতি তথা হইতে প্রস্থান করিল এবং অবিলম্বে আর একজন বলিষ্ঠ লোককে লইয়া পুনরায় সর্দ্দারের সম্মুখে উপস্থিত হইল। 

নবাগত ব্যক্তিকে দেখিয়া সর্দ্দার জিজ্ঞাসা করিল “দামু, এতক্ষণ কোথায় ছিলি ভাই! একটা বড় শিকার হাতে পড়ে পালিয়ে গেল, তুই কাছে থাকলে আজ অনেক টাকা লাভ হতো। 

মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে দামোদর ওরফে দামু উত্তর করিল “কোথাও যাই নাই–আজ সকাল থেকে রাজুকে দেখতে পাচ্ছি না। তাই তার সন্ধান করছিলাম।” 

সর্দ্দার চমকিত হইল। সে শশব্যস্তে বলিয়া উঠিল “সে কি! রাজু ছিল বলে আজ আমরা বেঁচে এসেছি। সে না থাকলে আমাদের যে কি দশা হতো বলা যায় না।” 

এই বলিয়া সদার অতি মৃদুস্বরে সকল কথা ব্যক্ত করিল। দামু শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল এবং রাজুর সাহসের বারংবার প্রশংসা করিতে লাগিল। 

রাজু ওরফে রাজবালা দামোদরের প্রণয়িণী। দামোদর তাঁহার ভরণ-পোষণের ব্যয় নির্ব্বাহ করে। সে প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় রাজবালার কুটীরে গমন করে এবং পরদিন অতি প্রত্যূষেই আপনার বাটীতে প্রত্যাগমন করে। রাজবালার উপর অনেকেরই লোভ ছিল, কিন্তু সর্দারের প্রতি-দামোদরের ভয়ে আর কেহ তাহাকে কোন কথা বলিতে সাহস করে না। 

কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর সর্দ্দার বলিয়া উঠিল “দামু! একটা কাজ তোকে এখনই করতে হবে।”

দা। কি কাজ দাদা? হুকুম কর—এখনই হাসিল করবো। 

স। একবার রাজুর কাছে বস। 

দামোদর মুচকি হাসিয়া বলিল “না দাদা, তামাসা নয়। তোমার হুকুম আমি কখনও অমান্য করি নাই।” দামোদরের কথা শুনিয়া সর্দ্দার হাসিয়া উঠিল। সে বলিল “না ভাই! আমি ত সে কথা বলি নাই। সত্য সত্যই তোকে এখনই একবার রাজুর বাড়ীতে যেতে হবে।” 

দামোদরও হাসিতে হাসিতে বলিল, “কবে না যাই দাদা! গিয়ে কি করবো?” 

স। রাজু নিশ্চয়ই সেই মাগীদের কাছ থেকে খানকতক গহনা এনেছে। সেই গহনাগুলি চাই। 

দা। সে যদি না দেয়? 

স। জোর ক’রে কেড়ে আবি। 

দা। সে কি দাদা – রাজুর উপর এত কড়া হুকুম দিলে চলবে কেন? 

স। গহনাগুলি সে এনেছে বটে কিন্তু আমরাই ত আগে সেই মাগীদের ঘাল করি। আর আমরাই শেষে ফাঁকিতে পড়বো! তুই কি বলিস্? 

দামোদর কিছুক্ষণ ভাবিয়া উত্তর করিল “না দাদা, সেটা ভাল হয় না। আমি এখনই রাজুর কাছে যাচ্ছি, যদি কিছু এনে থাকে, এখনই এখানে আনছি।” 

এই বলিয়া দামোদর তথা হইতে প্রস্থান করিল। সদানন্দ ও রত্না পুনরায় সর্দ্দারের সেবায় নিযুক্ত হইল। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

দামোদর যখন রাজুর কুটীরে উপস্থিত হইল, তখন বেলা চারিটা। আপন কুটীরে প্রত্যাগমন করিয়া রাজু তখন রন্ধনের উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময়ে দামোদর তাহার দৃষ্টি গোচর হইল। 

রাজবালা বাল্যবিধবা। বিবাহের তিন দিন পরে তাহার স্বামীর মৃত্যু হয়। শৈশবকালেই তাঁহার পিতামাতা কালগ্রাসে পতিত হয়। এক দূর-সম্পৰ্কীয় পিতৃস্বসাই তাহাকে মানুষ করিয়াছিল। কিন্তু রাজুর দুর্ভাগ্য বশতঃ সেও মারা পড়ে। রাজুর বয়স তখন এগার বৎসর মাত্র। এক প্রতিবেশী তাহাকে নিজ বাটীতে আনয়ন করে এবং কিছুদিনের মধ্যে তাহার বিবাহ দেয়। 

বিধবা হইবার চারি বৎসর পরে রাজু শ্বশুরবাড়ী হইতে পলায়ন করে। সেই সময় হইতেই সে দামোদরের সুনজরে পতিত হয়। সেইদিন হইতেই দামোদর তাহার ভরণ-পোষণ ভার গ্রহণ করে এবং তাহার বাসের জন্য নিজ ব্যয়ে একখানি ক্ষুদ্র কুটীর নির্ম্মাণ করিয়া দেয়। 

দামোদর প্রত্যহ সন্ধ্যার পূর্ব্বে সেই কুটীরে যাইত এবং প্রত্যূষেই তথা হইতে প্রস্থান করিত। সেদিন বেলা চারিটার সময় তাহাকে কুটীরে দেখিয়া রাজবালা হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “আজ অসময়ে যে দাসীকে মনে পড়েছে? কি ভাগ্যি!” 

দামোদর কোন উত্তর না করিয়া রাজবালার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার গম্ভীর মুখ দেখিয়া রাজবালার মুখের হাসি মুখেই মিলাইয়া গেল। তাহার প্রাণে কেমন একটা আতঙ্ক হইল। সে অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হয়েছে গা-বল না? মুখ ভার করলে কেন?” 

রাজবালাকে দামোদর আন্তরিক ভালবাসিত। যেরূপ মিনতি করিয়া সে পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি বলিয়াছিল, তাহাতে দামোদরের হৃদয় দ্রবীভূত হইল। সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল “আজ সকাল থেকে ছিলি কোথায়?” 

দামোদরকে হাসিতে দেখিয়া রাজবালার ভয় গেল, সেও হাসিতে হাসিতে বলিল “কেন, বাড়ীতেই ছিলুম।” দামোদর উপহাস বুঝিতে পারিল না। সে পুনরায় রাগান্বিত হইয়া বলিল “কখনও না, যদি তাই হয়, তবে তুই এখন রাঁধছিস কেন?” 

রাজবালা হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, “বিনির ছেলে হয়েছে- দেখতে গিয়েছিলুম। 

কিছুক্ষণ ভাবিয়া দামোদর জিজ্ঞাসা করিল, “বিনি কে? সদানন্দের স্ত্রীর নাম কি বিনি? তবে কি আমাদের সদার ছেলে হয়েছে?” 

রাজবালা হাসিয়া সম্মতিসূচক উত্তর দিল। তখন দামোদর বলিল “কই– সদা ত সে কথা কিছু বললে না? কথাটা চেপে গেল—না?”

রা। সে কথা আর বলতে! কিন্তু আমি না থাকলে ছেলের বাপকে যে চৌদ্দ বচ্ছর জেলে যেতে হতো। তোমার দাদাও যে তার মধ্যে ছিল। সেই বেশী চোট খেয়েছে। 

দামোদর কর্কশস্বরে বলিয়া উঠিল “ন্যাকা আর কি! দাদারা চলে আার পর তুই সেই মাগীদের কাছ থেকে যে গহনাগুলো এনেছিস্, সেইগুলো দে, এখন বুঝতে পেরেছিস্?” 

রা। আমি একখানিও গহনা আনি নাই। 

দামোদর অট্টহাস্য করিল। সে বলিল “ও সকল কথা এখন রেখে দে। দাদাকে চিনিস ত? তার হুকুমের জোর জানিস্ ত?” 

রাজবালা তখন অতি বিনীত ভাবে বলিল “তোমার দিব্যি করে বলছি, আমি তাদের গহনা ছুই নাই। আমি অমন কাঁচা কাজ করি না। সে সকল দামী জিনিষ বিক্রী করতে গেলেই ধরা পড়তে হবে। সেই ভয়ে আমি আনি নাই। তোমার বিশ্বাস না হয় আমার ঘর খুঁজে দেখ।” 

দামোদর রাজবালার এই কথা অবিশ্বাস করিতে পারিল না। সে অত্যন্ত বিরক্ত হইল, তখনই সেখান হইতে প্রস্থান করিল। 

দস্যু সর্দ্দার যখন এই সকল কথা শুনিতে পাইল, তখন সে দামোদরের উপর ভয়ানক রাগান্বিত হইল। দুই ভ্রাতার বিষম বচসা আরম্ভ হইল। কথায় কথায় বিবাদের সূত্রপাত হইল। অবশেষে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল, তখন উপস্থিত লোকেরা দুই ভ্রাতাকে দুই স্থানে পৃথক করিয়া বিবাদের নিষ্পত্তি করিয়া দিল। দামোদর সেইদিন হইতে ভাইয়ের অধীনতা ত্যাগ করিল এবং আপনার যথা সৰ্ব্বস্ব বুঝিয়া লইয়া পৃথকভাবে অবস্থান করিতে লাগিল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

কালীচরণ যখন চারুশীলাকে লইয়া অশ্বারোহণে কাশিমগঞ্জের থানায় উপস্থিত হইলেন, তখন চারুশীলা সম্পূর্ণ অচেতন। থানার লোকেরা তাহাকে মৃতা মনে করিয়াছিল, কিন্তু কালীচরণ তাহাদিগকে অল্প কথায় সমস্ত ব্যাপার বুঝাইয়া দিলেন। তখনই চারিজন চৌকিদার তাঁহার নিকট আসিয়া অশ্বপৃষ্ঠ হইতে চারুশীলার অচেতন দেহ নামাইয়া লইল। 

অপর একজনের হস্তে অশ্বরজ্জু প্রদান করিয়া কালীচরণ এক লম্ফে ভূমিতলে পতিত হইলেন এবং তখনই দারোগাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সকল কথা ব্যক্ত করিলেন। 

দারোগাবাবু তাঁহার নিকট হইতে সেই ভয়ানক সংবাদ পাইয়া স্তম্ভিত হইলেন। অপর কোন লোকের মুখে শুনিলে তিনি কোনক্রমেই বিশ্বাস করিতেন না; কিন্তু কালীচরণের পরিচয় পাইয়া বিশেষতঃ তাঁহাকে একজন উকীল জানিতে পারিয়া তাঁহার কথায় অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কয়জন দস্যুকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন?” 

কালীচরণ উত্তর করিলেন, “তিনজন।” 

দা। কোথায় তাহারা? 

কা। সেই মাঠেই একটি গাছের সহিত বাঁধিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। 

দা। আপনি একা তিনজন বলিষ্ঠ দস্যুকে কেমন করিয়া গ্রেপ্তার করিলেন? 

কালীচরণ আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। তিনি কর্কশস্বরে বলিলেন “সে সকল কথা পরে জানিতে পারিবেন। আপাততঃ একজন ডাক্তার লইয়া শীঘ্র আমার সঙ্গে চলুন। একজন ইতিপূর্ব্বেই মারা পড়িয়াছেন, অপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছেন।” 

দারোগাবাবু আর কোন প্রশ্ন করিতে সাহস করিলেন না। তিনি সত্বর একজন ডাক্তারকে লইয়া কালীচরণের সহিত যথাস্থানে গমন করিলেন। 

দস্যুগণকে যেরূপে সেই বৃক্ষের সহিত বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে কালীচরণের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, তখনও তাহারা সেই অবস্থায় পড়িয়া আছে। কিন্তু দূর হইতে যখন তিনি সেই বৃক্ষতলে দৃষ্টিপাত করিলেন, তখন তাঁহার অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল। তিনি দ্রুতপদে নির্দিষ্ট বৃক্ষতলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, কিন্তু দস্যুগণের কোন চিহ্নও দেখিতে পাইলেন না। যে রজ্জু দ্বারা দস্যুগণ আবদ্ধ ছিল, সেই রজ্জু খণ্ড খণ্ড হইয়া তথায় পতিত রহিয়াছে দেখিতে পাইলেন। 

দুইটি অচেতন রমণী দেহ যথাস্থানেই পতিত ছিল। দারোগাবাবু দস্যুগণকে না দেখিতে পাইলেও কালীচরণের কথায় অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। দস্যুগণ যে অপর কোন লোকের সাহায্যে বন্ধন মুক্ত হইয়া পলায়ন করিয়াছে, তাহা তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন। তিনি তখনই ডাক্তারবাবুকে অচেতন দেহ দুইটি বিশেষরূপে পরীক্ষা করিতে অনুরোধ করিলেন। ডাক্তারবাবু তদনুসারে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, একজন প্রায় দেড়ঘণ্টা পূর্ব্বেই মারা পড়িয়াছেন। অপরা তখনও জীবিতা বটে কিন্তু যদি এক ঘণ্টার ভিতর চৈতন্য না হয় তাহা হইলে তাহার জীবনও সঙ্কটাপন্ন। 

দারোগাবাবু তখন সত্বর দুইটি দেহ দুই স্থানে পাঠাইয়া দিয়া কালীচরণের সহিত পুনরায় থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। থানায় গিয়া দেখিলেন, চারুশীলার জ্ঞান হইয়াছে, সে বাড়ী ফিরিয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে কালীচরণবাবু তাহাদের বাড়ী চিনিতেন। তিনিই চারুশীলাকে লইয়া সন্ধ্যার পর গৌরীপুরের জমীদার সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। সতীশচন্দ্র এতক্ষণ স্ত্রী-কন্যার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিলেন, কন্যাকে একজন অপরিচিত যুবকের সহিত গৃহে ফিরিতে দেখিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন, এবং কালীচরণকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। কালীচরণ অল্প কথায় সমস্ত ব্যাপার প্রকাশ করিলেন। স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ ও শ্যালিকার সাংঘাতিক আহত হওয়ার কথা শুনিয়া সতীশচন্দ্র যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইলেন এবং কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিলেন। 

সতীশচন্দ্রকে সান্ত্বনা করিয়া কালীচরণ তথা হইতে বিদায় লইলেন। কিন্তু বিদায় লইবার পূর্ব্বে তিনি চারুশীলার মায়ের শেষ উইলখানি সতীশচন্দ্রের হস্তে প্রদান করিলেন। সতীশচন্দ্র উইল দেখিয়া এত সন্তুষ্ট হইলেন যে, সেইদিন হইতে তিনি কালীচরণকেই আপনার পারিবারিক উকীল বলিয়া স্থির করিলেন। 

পরদিন প্রাতঃকালে রাধারাণী হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া আসিলেন। সতীশচন্দ্র স্ত্রীর শোকে নিতান্ত কাতর হইয়াছিলেন, রাধারাণীকে দেখিয়া অনেকটা সুস্থ হইলেন। 

দস্যু তিনজনকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য সতীশচন্দ্র যথেষ্ট চেষ্টা করিলেন। তিন চারিজন ভাল ভাল গোয়েন্দা সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। দস্যুগণকে কেহই গ্রেপ্তার করিতে পারিল না। অবশেষে আরও কিছুদিন পুলিসের লোকে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবার পর সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া গেল। যে সকল দস্যু এই প্রকারে নারী হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছিল, তাহারা আর ধৃত হইল না। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পূর্ব্বোক্ত ঘটনার পর এক বৎসর অতীত হইয়াছে। এই এক বৎসরের মধ্যে সতীশচন্দ্রের পরিবারের মধ্যে নানা প্রকার পরিবর্তন ঘটিয়াছে। তাঁহার শ্যালিকা রাধারাণী এখন সে বাড়ীর গৃহিণী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। বাড়ীর কোন কার্য্যই রাধারাণীর পরামর্শ ব্যতীত সম্পন্ন হয় না। 

চারুশীলা এতকাল মায়ের আদরে ও পিতার যত্নে প্রতিপালিতা হইয়াছিল; কিন্তু এখন তাহাকেও রাধারাণীর অনুমতি লইয়া কার্য্য করিতে হয়। সতীশচন্দ্রের দুইটি ভ্রাতুষ্পুত্রও রাধারাণীর বিনা অনুমতিতে কোন কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ করিতে পারিতেন না। 

সতীশচন্দ্রের পুত্র ছিল না। তাঁহার একমাত্র কন্যা চারুশীলাই তাঁহার সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু জমীদারী তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি, চারুশীলা সে সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকারিণী হইতে পারে না। 

সতীশচন্দ্রের দুইজন ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। জ্যেষ্ঠের নাম গৌরীশঙ্কর, কনিষ্ঠের নাম হরশঙ্কর। সতীশচন্দ্র হরশঙ্করকেই অধিক ভালবাসিতেন। হরশঙ্করও তাঁহার অত্যন্ত বাধ্য ছিলেন, এই সকল কারণে তিনি হরশঙ্করকেই বিষয়ের অধিকাংশ প্রদান করিতে মনস্থ করিলেন। 

গৌরীশঙ্কর স্বয়ং এ সকল ব্যাপার জানিতেন এবং তজ্জন্য তাঁহার কনিষ্ঠের উপর কিছুমাত্র বিরক্ত হন নাই। উভয়ের মধ্যে তিনিই সচ্চরিত্র, উদার ও অমায়িক। তিনি সকলের সহিত হাসিয়া কথা কহেন। কাহারও সহিত তাঁহার বিবাদ নাই। কি বড় কি ছোট, কি ধনী কি নির্ধন, সকলেই তাঁহার প্রশংসা করে। এত গুণ সত্ত্বেও তিনি সতীশচন্দ্রের নিকট সুখ্যাতি লাভ করিতে পারেন নাই। 

সুহাসিনীর মৃত্যুর পর হইতে সতীশচন্দ্রও রাধারাণীর সম্পূর্ণ বশীভূত হইয়া পড়িলেন। সুহাসিনীর জীবদ্দশায় ইচ্ছা থাকিলেও সতীশচন্দ্র রাধারাণীর সহিত বাক্যালাপ করিতেন না। সুহাসিনী যে স্বামীকে কোনরূপ অবিশ্বাস করিতেন, তাহা নহে; কিন্তু তাঁহাকে এরূপে রক্ষা করিয়াছিলেন যে, সতীশচন্দ্র কোন দিন রাধারাণীর সহিত বাক্যালাপ করিতে সুবিধা পান নাই। 

সুহাসিনী সুন্দরী ছিলেন বটে, কিন্তু রাধারাণীর বয়স অল্প বলিয়া উভয়ের মধ্যে তাঁহাকে অধিক সুন্দরী বলিয়া বোধ হইত। এবং এই কারণেই সুহাসিনী রাধারাণীকে সর্ব্বদাই নজরে রাখিতেন। রাধারাণীর সহিত সুহাসিনীর বিশেষ সম্বন্ধ ছিল না। এমন কি, কিছুদিন পূর্ব্বে সুহাসিনী তাঁহাকে চিনিতেন না। একদিন সুহাসিনী প্রত্যূষে স্নান করিয়া নদী হইতে বাড়ীতে ফিরিতেছেন, এমন সময়ে রাধারাণীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। বাড়ীর একজন বৃদ্ধা দাসী সুহাসিনীর সঙ্গে গিয়াছিল। রাধারাণীকে দেখিয়া সেও দাঁড়াইয়া পড়িল। 

রাধারাণীকে দেখিতে অতি সুন্দরী—বিশেষতঃ যৌবনে তাহার সৌন্দর্য্য যেন শতগুণে বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল। সুন্দরী যুবতীকে পথে ঘুরিতে দেখিয়া এবং তাহার মুখে তাহার ভয়ানক দারিদ্র্যের কথা শুনিয়া সুহাসিনীর হৃদয় দ্রবীভূত হইল। তিনি রাধারাণীকে আপন ভগ্নী সম্বোধন করিলেন এবং তখনই নিজ বাড়ীতে লইয়া গিয়া তাহাকে প্ৰতিপালন করিতে মনস্থ করিলেন। যে দাসী সুহাসিনীর সহিত গিয়াছিল, সেই কেবল রাধারাণীর প্রকৃত পরিচয় জানিত। কিন্তু অদৃষ্টক্রমে সেও অল্প দিনের মধ্যেই মারা পড়িল। সুতরাং বাড়ীর আর কোন লোকই জানিত না যে, রাধারাণী সুহাসিনীর প্রকৃত ভগ্নী নহে। 

এইরূপে কিছুদিন অতীত হইল। কিন্তু যতই দিন কাটিতে লাগিল, রাধারাণীর ক্ষমতাও ততই বাড়িতে লাগিল। বাড়ীর সকলেই তাঁহার উপর বিরক্ত হইলেন, দাস-দাসীগণ আর তাঁহার দৌরাত্ম্য সহ্য করিতে পারিল না। একে একে দুই তিনজন দাসী সতীশচন্দ্রের বাড়ী হইতে দূরীভূত হইল। সতীশচন্দ্রও রাধারাণীর সম্পূর্ণ বশীভূত হইয়া পড়িলেন। 

এই সময়ে একদিন হরশঙ্কর আহারাদির পর সতীশচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন “জেঠা মহাশয়! আমার এক বন্ধু এ দেশে বেড়াইতে আসিয়াছেন। তাঁহার আন্তরিক ইচ্ছা, আমাদের এই বাড়ীতেই কিছুদিন বাস করেন। যদি আপনার অনুমতি পাই, তাহা হইলে তাঁহাকে এখানে আসিতে অনুরোধ করিতে পারি।” 

হরশঙ্কর যখন এই সকল কথা বলিতেছিলেন, তখন রাধারাণীও তথায় উপস্থিত ছিলেন। সতীশচন্দ্র কোন উত্তর করিবার পূর্ব্বেই তিনি উপযাচক হইয়া বলিলেন “বেশ ত! এ ত গৌরবের কথা! তোমার বন্ধু এ দেশে আসিয়া যদি অপর বাড়ীতে থাকেন, তাহা হইলে তোমারই লজ্জার কথা। তুমি এখনই তাঁহাকে এখানে আসিতে বল। আমাদের ঘরের অভাব নাই; একটি কেন, চারিজন বন্ধু আসিলেও সকলের স্থান দিতে পারি।” 

রাধারাণীর কথা শুনিয়া সতীশচন্দ্র আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। তিনি তাঁহার কথায় সায় দিয়া বলিলেন “এ কথা আর জিজ্ঞাসা করিবার অপেক্ষা করিতেছিলে কেন? তুমি ত অনায়াসেই তাঁহাকে এখানে আনিতে পারিতে। আমার অবর্তমানে এ সমস্ত বিষয়ই যখন তোমাদের, তখন আর আমি ও সকল বিষয়ে আপত্তি করিব কেন?” 

হরশঙ্কর কোন উত্তর করিলেন না। তিনি সেইদিনেই তাঁহার বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করিলেন। তাঁহার বন্ধুও এই সুযোগ অন্বেষণ করিতেছিলেন, হরশঙ্করের কথা শুনিয়া তিনিও সেই সতীশচন্দ্রের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

সতীশচন্দ্রের বাড়ীটি প্রকাণ্ড, দ্বিতল ও দ্বিমহল। বাড়ীর স্ত্রীলোকের মধ্যে রাধারাণী ও চারুশীলা, অন্দর মহল ছাড়িয়া, তাঁহারা বহির্বাটীতে আসিতে পারেন না। 

হরশঙ্করের বন্ধুটির নাম ভবানীপ্রসাদ রাত্রিকালেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বহির্ব্বাটীতেই তাহার একটি প্রকোষ্ঠ নিদ্দিষ্ট হইল। তিনি সেই রাত্রি হইতে উহা অধিকার করিলেন। রাধারাণী বা চারুশীলা সে রাত্রে তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না। 

ভবানীপ্রসাদ পরদিন অতি প্রত্যূষে গাত্রোত্থান করিলেন। প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া তিনি সেই অট্টালিকা সংলগ্ন উদ্যানে ভ্রমণ করিতে গমন করিলেন। কিছুক্ষণ চারিদিক ভ্রমণ করিবার পর তিনি সহসা সম্মুখে এক বিধবা যুবতীকে অদূরে পুষ্পচয়ন করিতে দেখিতে পাইলেন। 

দূর হইতে সেই রমণীকে দেখিয়া তিনি আর সেদিকে যাইতে সাহস করিলেন না। কিন্তু সেখান হইতে অন্যত্র যাইতেও তাঁহার মন সরিল না। তিনি একদৃষ্টে সেই রমণীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে সেই রমণীও সহসা তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। চারিচক্ষু সম্মিলিত হইল। রমণী ভবানীপ্রসাদকে দেখিয়া যেন স্তম্ভিতা হইলেন এবং কিছুক্ষণ তাহার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিলেন; কিন্তু সাহস করিয়া কোন কথা বলিতে পারিলেন না। অনেকক্ষণ পরে আত্মসংবরণ করিয়া তিনি ধীরে ধীরে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন 

ভবানীপ্রসাদ সহসা সেই স্থান হইতে ফিরিতে পারিলেন না। রমণীকে দেখিয়া অবধি তাঁহার মনে এক অভিনব ভাবের উদয় হইয়াছিল, অনেক অতীত কাহিনী তাঁহার মনে পড়িয়াছিল কিন্তু রমণীর বর্তমান অবস্থা দেখিয়া সে সকল কথা তাঁহার যেন স্বপ্নবৎ মনে হইতে লাগিল। 

আরও কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে সেই উদ্যানে গমন করিবার পর ভবানীপ্রসাদ আপন নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে আগমন করিলেন। দেখিলেন, হরশঙ্কর একাকী সেই গৃহে বসিয়া আছেন। 

বন্ধুকে দেখিয়া হরশঙ্কর হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত ভোরে কোথায় গিয়াছিলে ভাই!” 

ভবানীপ্রসাদও হাসিয়া উত্তর করিলেন আপনাদের উদ্যানটি অতি চমৎকার। এত ফুল কোন বাগানে দেখি নাই। শয্যা হইতে উঠিবামাত্র সদ্যঃপ্রস্ফুটিত পুষ্পগুলির সুগন্ধে আমার মনঃপ্রাণ এত পুলকিত হইয়াছিল যে, আমি আর সে ঘরে থাকিতে পারিলাম না, কিছুক্ষণ উদ্যানে ভ্রমণ করিতে গিয়াছিলাম। 

এইরূপ কথাবার্তার পর ভবানীপ্রসাদ কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনার জেঠা মহাশয় কি প্রত্যহ পূজা করিয়া থাকেন?” 

হরশঙ্কর উত্তর করিলেন “হাঁ-আমার জেঠা মহাশয় বড় ধাৰ্ম্মিক লোক। পূজাদি দ্বারা ঈশ্বরারাধনা করাই তাঁহার জীবনের প্রধান কার্য্য। তিনি প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে বেলা তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত পূজাদি লইয়াই থাকেন। কেন ভাই! তুমি সহসা এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন? 

ঈষৎ হাসিতে হাসিতে ভবানীপ্রসাদ বলিলেন “না—এমন কিছু নয়; একজন বিধবা পুষ্পচয়ন করিতেছিলেন আমাকে দেখিবামাত্র পলায়ন করিলেন।”

হরশঙ্কর হাসিয়া উঠিলেন। তিনি বলিলেন “তিনি আমার এক দূর সম্পর্কীয়া মাসীমা। জেঠাইমার এক প্রকার ভগ্নী। যতকাল জেঠাইমা জীবিত ছিলেন, ততকাল তিনিই স্বহস্তে ফুল তুলিতেন। তাঁহার মৃত্যুর পর দিনকয়েক চারুশীলা ওই কার্য্য করিয়াছিল, এখন দেখিতেছি মাসীমাই উহার ভার গ্রহণ করিয়াছেন। 

ভবানী। তিনি কি বিধবা? 

হর। হাঁ ভাই—অনেকদিন বিধবা হইয়াছেন। আমরা ত তাঁহাকে সধবা দেখি নাই। 

ভবানী। কতকাল তিনি এখানে বাস করিতেছেন? 

হর। অনেকদিন—যখন তিনি এখানে আইসেন, তখনও বিধবা ভবানী। উনি তোমার জেঠাইমার কিরূপ ভগ্নী? 

হর। ঠিক জানি না-শুনিয়াছি জ্ঞাতি ভগ্নী। 

ভবানী হরশঙ্করকে আর কোন প্রশ্ন করিলেন না। তাঁহার মনে এক ভয়ানক সন্দেহ হইল। তাঁহার অনেক পূর্ব্বকথা মনে পড়িল, তিনি সে সকল কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে সাহস করিলেন না। কিন্তু সেই রমণীকে পুনরায় দেখিবার জন্য বিশেষ প্রয়াসী হইলেন। 

পরদিন ভবানীপ্রসাদ অতি প্রত্যূষেই উদ্যানে গমন করিলেন। পূর্ব্বদিন যেখানে দাঁড়াইয়া তিনি রমণীকে দেখিতে পাইয়াছিলেন, সে দিনেও সেইখানে গিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার সন্দেহ আরও বর্দ্ধিত হইল, সেই রমণীর বিষয় যাহা মনে করিয়াছিলেন তাহাই সত্য বলিয়া মনে হইল। কিন্তু কেমন করিয়া তাহার প্রকৃত পরিচয় গ্রহণ করিবেন, তাহার কোন উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলেন না। অগত্যা সেদিন ক্ষুণ্ণ মনে আপনার প্রকোষ্ঠে ফিরিয়া আসিলেন। 

উপর্যুপরি তিন চারি দিন চেষ্টা করিয়াও যখন ভবানীপ্রসাদ সেই রমণীকে আর দেখিতে পাইলেন না, তখন তিনি অন্য উপায়ে অন্দরে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনঃস্থ করিলেন। সুযোগও সেইরূপ ঘটিল। চারুশীলার বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হইলে যেদিন তাহার পাকা দেখা হইল, সেইদিন জমীদার বাড়ীতে মহোৎসবের আয়োজন হইল। চারিদিক হইতে নিমন্ত্রিত লোক আসিয়া বাড়ী পূর্ণ করিল। 

সন্ধ্যার পর যখন আহারাদি শেষ করিয়া নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ স্ব স্ব স্থানে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন তখন ভবানীপ্রসাদ অন্দরের একটি নিভৃত স্থানে দাঁড়াইয়া রাধারাণীকে লক্ষ্য করিতেছিলেন। সেইদিন প্রাতঃকালে একবারমাত্র দেখিয়া তাঁহার যে সন্দেহ হইয়াছিল, এখন সেই সন্দেহ সত্যে পরিণত হইল। তিনি যে সকল কথা স্মরণ করিয়া স্তম্ভিত হইলেন এবং সময় বুঝিয়া একটি নিভৃত স্থানে গিয়া রাধারাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। 

রাধারাণীও প্রথম দর্শনেই তাঁহাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু সে কথা কাহাকেও প্রকাশ করেন নাই। এখন ভবানীপ্রসাদের সম্মুখীন হইয়া তিনি কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি এখানে কেন? হরশঙ্করের বন্ধু বলিয়া কি আপনি যখন ইচ্ছা অন্দরে আসিবেন?”

রাধারাণীর কর্কশস্বরে ভবানীপ্রসাদ কিছুমাত্র ভীত হইলেন না। তিনি বলিলেন “কি জন্য আসিয়াছি, তাহা কি তুমি বুঝিতে পার নাই? যদি না পারিয়া থাক, তাহা হইলে সেইদিন হইতে আর বাগানে ফুল তুলিতে যাও নাই কেন?” রাধারাণী আরও রাগিয়া গেলেন। তিনি আরও চীৎকার করিয়া বলিলেন “কে তুমি? আমি আর কখনও তোমায় দেখি নাই। কেন তুমি অন্দরে আসিয়া আমার বিরক্ত করিতেছ?” 

রাধারাণীর কথায় ভবানীপ্রসাদ ভীত হইলেন না। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন “সে কি প্রভা! এত শীঘ্রই কি আমায় ভুলিয়া গিয়াছ? এই ত সে দিনের কথা—একসঙ্গে হাত ধরাধরি করিয়া মাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে যেদিন দাঁড়াইয়াছিলাম, সেদিনের সকল কথাই কি ভুলিয়া গিয়াছ? তুমি মনে করিয়াছ চীৎকার করিয়া আমায় ভয় দেখাইবে। কিন্তু আমি ভয় পাইবার লোক নহি, এখনই সকল বিদ্যা প্রকাশ করিয়া দিব।” 

ভবানীপ্রসাদের কথা শুনিয়া রাধারাণী সহসা মলিন হইয়া গেল। তাঁহার মুখ দিয়া বাক্য নিঃসরণ হইল না, তিনি একবার চারিদিক লক্ষ্য করিলেন, ঘরের বাহির হইয়া একবার সকল দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, পরে সত্বর ভবানীপ্রসাদের নিকট আসিয়া যোড়হাত করিয়া অতি মৃদুস্বরেও বিনীত ভাবে বলিলেন “রক্ষা কর, দামোদর এযাত্রা রক্ষা কর। আমি শুনিয়াছিলাম তুমি জেলে মারা পড়িয়াছ। তাই ত আজ আমি এখানে। ভগবান জানেন আমি কতকাল তোমার আশায় ছিলাম। কিন্তু যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, যাইতে লাগিল, যখন আমার অর্থ কমিয়া গেল, যখন উদরান্নের জন্য আমায় লালায়িত হইতে হইল, তখন আমি জানিলাম তুমি মারা পড়িয়াছ। কি করি—শিকারের চেষ্টায় বাহির হইলাম। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর সৌভাগ্য বশতঃ এই স্থানে আসিয়া আশ্রয় পাইয়াছি। যদি আমায় একদিনের জন্যও ভালবাসিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি কখনও আমার অপকার করিতে পারিবে না।” 

সকল কথা শুনিয়া ভবানীপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করিলেন “এখানে আসিয়া অবধি কত টাকা সঞ্চয় করিয়াছ?” 

প্রভাবতী ওরফে রাধারাণী চমকিতা হইলেন। তিনি বলিলেন “বল কি? আশ্রয় পাইয়াছি এই যথেষ্ট। সতীশবাবুর স্ত্রী সুহাসিনী যে আমার কথায় ভুলিয়া আমাকে এ বাড়ীতে স্থান দিয়াছিলেন তাহাতেই আমি যথেষ্ট সন্তুষ্ট আছি, আমার আর অর্থের প্রয়োজন কি? যাহা ইচ্ছা আহার করিতেছি, যাহা ইচ্ছা পরিধান করিতেছি, ধৰ্ম্ম-কৰ্ম্ম পূজাদি যাহা ইচ্ছা করিতেছি, তাহাই করিতেছি যে কোন তীর্থে যাইবার বাসনা করিয়াছি সেইখানেই গমন করিয়াছি। আর আমার অর্থের আবশ্যক কি?” 

বাধা দিয়া ভবানীপ্রসাদ বলিয়া উঠিলেন “তোমার না থাকিলেও আমার আছে। শুনিলাম তুমিই এখন এ বাড়ীর গৃহিণী। কৰ্ত্তাকে তুমি সম্পূর্ণ বশীভূত করিয়াছ। যেরূপ শুনিতে পাওয়া যায় তাহাতে তোমার নামে শীঘ্রই একটা নূতন কলঙ্ক উঠিবে দেখিতেছি। যখন এতদূর হইয়াছে তখন কিছু কি আর তোমার হাতে নাই! আমার বিশেষ প্রয়োজন— কিছু চাই।” 

প্রভা। কি দিব—হাতে কিছুই নাই। 

ভবানী। ভাল, না থাকে- আদায় করিয়া দাও। যখন কর্তা তোমার হাতে, তখন টাকার অভাব কি? আমি এখন কিছুদিন এখান হইতে যাইতেছি না। যত শীঘ্র পার আমায় হাজার টাকা যোগাড় করিয়া দাও।” 

প্রভাবতী শিহরিয়া উঠিলেন। অতি বিস্মিতনেত্রে ভবানীপ্রসাদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন “কি সৰ্ব্বনাশ! ত টাকা আমি পাব কোথা? কেমন করিয়াই বা এখন আদায় করি?” 

সে সব কথা তুমি জান। আমি অত শত বুঝি না। তবে যদি দুই মাসের মধ্যে ওই টাকা না পাই, তাহা হইলে স্থির জানিও আমি তোমার প্রকৃত পরিচয় সকলের নিকট ব্যক্ত করিব।” 

এই বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই ভবানীপ্রসাদ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। রাধারাণী ওরফে প্রভাবতী কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল চিন্তা করিয়া পুনরায় গৃহকার্য্যে মনঃসংযোগ করিলেন। 

যেরূপ নিভৃতস্থানে দাঁড়াইয়া উভয়ে কথাবার্তা কহিতেছিলেন, তাহাতে তাঁহাদের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে সে সকল কথা বাড়ীর অপর কোন লোক শুনিতে পায় নাই। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। বাড়ীর অপরা দাসী মঙ্গলা কাৰ্য্যব্যপদেশে তথায় আসিয়া রাধারাণীর কথা শুনিতে পায়। বহুদিন হইতেই রাধারাণীর উপর তাহার সন্দেহ হইয়াছিল। এখন তাহাকে গোপনে অপর পুরুষের সহিত কথা কহিতে শুনিয়া তাহার কৌতূহল বৰ্দ্ধিত হইল। সে প্রচ্ছন্নভাবে তথায় দাঁড়াইয়া তাহাদের সকল কথাই শুনিতে পাইল। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

ভ্রাতার সহিত কলহ করিয়া দামোদর স্বতন্ত্র বাস করিতে মনঃস্থ করিল। পূর্ব্বে সে সায়াহ্নে রাজুর কুটীরে গমন করিত এবং প্রত্যূষেই তথা হইতে প্রস্থান করিত। কিন্তু এখন রাজুর কুটীরেই দিবারাত্রি বাস করিতে লাগিল। সেখানে আহারাদিরও বন্দোবস্ত করিল। 

বাল্যকাল হইতে দস্যুবৃত্তি করিয়াই সে জীবিকা নির্ব্বাহ করিত। জীবিকানির্বাহের আর কোন উপায় সে শিক্ষা করে নাই। ভাইয়ের সহিত পৃথক হওয়ায় সে বিষম বিপদে পড়িল। কেমন করিয়া সে অর্থ উপার্জ্জন করিবে, কেমন করিয়া নিজের ও রাজুর ভরণ-পোষণ নির্বাহ করিবে, তাহার কোন উপায় স্থির করিতে পারিল না। 

ভ্রাতৃদত্ত অর্থে কিছুদিন অতিবাহিত করিয়া সে ভাবিল দস্যুবৃত্তি করিয়াই অর্থ উপার্জ্জন করিবে। কিন্তু দস্যুবৃত্তি একাকী হয় না- তাহাতে স্বতন্ত্র দল বাঁধিতে হয়। রাজু তাহাতে সম্মতা হইল না। সে বলিল স্বতন্ত্র দল করিলে তাহার ভ্রাতার সহিত মনোমালিন্য উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইবে, তাই তাহার শত্রু হইয়া দাঁড়াইবে। দামু অগত্যা সে কল্পনা ত্যাগ করিল এবং নিজে অন্য উপায়ে অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টা করিতে লাগিল। 

অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া দামু অবশিষ্ট অর্থ সঙ্গে লইয়া রাজুর নিকট বিদায় লইল। যাইবার সময় রাজু অনেক কান্নাকাটি করিল। দামু মিষ্ট কথায় তাহাকে সান্ত্বনা করিয়া বলিল কিঞ্চিৎ অর্থ সঞ্চিত হইলেই সে পুনরায় তাহার নিকট প্রত্যাগমন করিবে। 

রাজুর কুটীর হইতে বহির্গত হইয়া দামু অবিলম্বে উচ্ছৃঙ্খল ধনবান যুবকগণের তোষামোদ করিয়া অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টা করিতে লাগিল। 

অল্পদিনের মধ্যেই সে অনেকের সহিত আলাপ করিল বটে, কিন্তু অর্থের অনাটন বশতঃ সকলেরই অপ্রিয় হইয়া উঠিল। অগত্যা কলিকাতা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইল। 

কিছুদিন পরে সে গৌরীপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সময়ে গৌরীপুরের জমীদার সতীশচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র হরশঙ্করের চরিত্র ক্রমেই দূষিত হইতেছিল। কিছুদিন গৌরীপুরে থাকিয়া দামু তাহা লক্ষ্য করিল এবং তাঁহার সহিত মিশিতে চেষ্টা করিল। 

সুযোগও সেইরূপ হইল। একদিন হরশঙ্কর অত্যধিক সুরাপান করিয়া টলিতে টলিতে কোন বারাঙ্গনা-গৃহে প্রবেশ করিতেছিলেন এমন সময়ে অপর এক যুবকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। কথায় কথায় উভয়ের মধ্যে কলহ উপস্থিত হইল। হরশঙ্করের মস্তিষ্ক স্থির ছিল না। তিনি ক্রোধান্বিত হইয়া সেই যুবককে আঘাত করিলেন। 

যুবক অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিল, সেও হরশঙ্করকে মারিবার জন্য প্রস্তুত হইল। দামু এতক্ষণ কোন কথা বলে নাই -নীরবে দাঁড়াইয়া তাহাদের কলহ শুনিতেছিল। যুবককে প্রহার করিতে উদ্যত দেখিয়া এবং হরশঙ্করের সহিত আলাপ করিবার ইচ্ছা হওয়ায় সে তখনই হরশঙ্করের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হইল। 

যুবক বলিষ্ঠ বটে, কিন্তু দামোদরকে হরশঙ্করের সহায় দেখিয়া সে রণে ভঙ্গ দিল। হরশঙ্কর অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। হরশঙ্কর দামোদরকে আলিঙ্গন করিলেন, তাহাকে বন্ধু বলিয়া সম্বোধন করিলেন এবং তাহাকে লইয়া সেই বারাঙ্গনালয়ে প্রবেশ করতঃ সমস্ত রাত্রি আমোদ-প্রমোদে অতিবাহিত করিলেন। 

সেইদিন হইতে দামোদর হরশঙ্করের বন্ধু হইল, পরস্পর পরস্পরের পরিচয় গ্রহণ করিল, দামোদর সুযোগ বুঝিয়া তাহার মনোভিলাষ ব্যক্ত করিল। সে বলিল কলিকাতায় তাহার বাড়ী, গৌরীপুরে বেড়াইতে আসিয়াছে। হরশঙ্কর আনন্দিত হইলেন। বন্ধুকে নিজের ঐশ্বর্য্য দেখাইতে অভিলাষী হইলেন এবং বন্ধুকে জমীদার বাটীতে স্থান দিতে বাসনা করিলেন। দামোদর তাহাই চাহিতেছিল। সে আপনাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচয় দিল এবং হরশঙ্করের বাসনা পূর্ণ করিতে অঙ্গীকার করিল। 

দামোদর লোক ভুলাইতে সিদ্ধহস্ত। একদিনেই সে হরশঙ্করকে বশীভূত করিয়া ফেলিল। বয়স অধিক না হইলেও সেই বয়সে সে অনেক কার্য্য করিয়াছে। ভ্রাতৃ আজ্ঞায় অত্যন্ত গর্হিত কার্য্যেও সে পশ্চাৎপদ হয় নাই। 

যৌবনের প্রথমে সে প্রভাবতী নাম্নী এক রূপবতী বিধবার প্রেমে উন্মত্ত হয়। তাহারই কৌশলে দামোদর অনেকবার জেল হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিয়াছে। দামোদর সেইজন্যই তাহাকে প্রাণের অধিক ভালবাসিত। রমণীও তাহাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসিত। একবার দস্যুতার জন্য দামোদরের ছয়মাস কারাদণ্ড হয়। দামোদর যখন কারাগারে ছিল সেই সময় প্রভা শুনিল দামোদরের মৃত্যু হইয়াছে। রমণী তাহার শোকে অনেক কাঁদিল। কিছুদিন অনেক কষ্টে তথায় অবস্থান করিল। অবশেষে নিজের গৃহত্যাগ করিয়া গৌরীপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

নবম পরিচ্ছেদ 

বহুদিন হইতেই চারুশীলার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইয়াছিল। জমীদারের একমাত্র কন্যা, অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী ও অনিন্দ্যসুন্দরী সুতরাং সুপাত্রের অভাব ছিল না। অনেকেই তাহাকে বিবাহ করিবার জন্য লালায়িত ছিল। কিন্তু সতীশচন্দ্র বিদ্বান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি-স্বয়ং কন্যার জন্য একটি সৎপাত্র মনোনীত করিয়া বাগ্দান করিয়াছিলেন। যদি সুহাসিনী জীবিতা থাকিতেন, তাহা হইলে পূর্ব্বেই চারুশীলার বিবাহকার্য সম্পাদিত হইত। 

স্ত্রীবিয়োগে সতীশচন্দ্র অত্যন্ত শোকাতুর হইয়াছিলেন। কিন্তু সময়ে লোকে পুত্রশোকও বিস্মৃত হয়—সতীশচন্দ্রও সময়ে স্ত্রীর শোক ভুলিলেন এবং মহা সমারোহে চারুশীলার পরিণয় কার্য্য সমাধা করিলেন। 

চারুশীলার বয়স হইয়াছিল; বিবাহের একমাস পরেই সে স্বামিগৃহে গমন করিল। রাধারাণীর একমাত্র কণ্টক দূর হইল। তাহার প্রতাপও উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। এতদিন চারুশীলার ভয়ে তিনি যে সকল কার্য্য করিতে পারিতেন না, তাহার অবর্তমানে তিনি যাহা মনে করিলেন তাহাই করিতে লাগিলেন। সতীশচন্দ্র তাঁহার সম্পূর্ণ বাধ্য তিনি রাধারাণীর কার্য্য দেখিয়াও দেখিতেন না। 

দুশ্চরিত্রা রমণীর অসাধ্য কিছুই নাই। সতীশচন্দ্র জমীদার–অতুল সম্পত্তির অধিকারী, রাধারাণী তাঁহাকে আয়ত্ত মধ্যে আনিলেও কেবল তাঁহাকে লইয়া তাহার মনোভিলাষ পূর্ণ হইত না। সতীশচন্দ্র সুপুরুষ ছিলেন বটে, কিন্তু যৌবনের সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন। রাধারাণী পূর্ণ-যুবতী, সতীশচন্দ্র তাঁহার সকল সাধ মিটাইতে পারিতেন না। তাই রাধারাণী অপর শিকারের সন্ধান করিতে লাগিলেন। গৌরীশঙ্কর যুবক ও অতি সুপুরুষ। তাঁহার রমণীমোহন রূপ দেখিয়া রাধারাণীর লোভ জন্মিল। তিনি তাঁহাকেও গ্রাস করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

গৌরীশঙ্কর সচ্চরিত্র –সরল ও উদার প্রকৃতির লোক, রাধারাণীর হাবভাব, অপাঙ্গদৃষ্টি ও তীব্র কটাক্ষ, এ সকল কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। রাধারাণী তাঁহাকে বশীভূত করিবার জন্য যত কিছু কৌশল করিলেন সমস্তই ব্যর্থ হইল। তিনি বিষম ফাঁপরে পড়িলেন। যৌবনের উদ্দাম কামনায় উৎপীড়িত হইয়া রাধারাণী ছটফট করিতে লাগিলেন। কেমন করিয়া আপনার মনোভিলাষ ব্যক্ত করিবেন, তাহার চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু সহজে কোন উপায় স্থির করিতে পারিলেন না। 

অবশেষে একদিন সায়ংকালে একটা সামান্য অছিলা করিয়া গৌরীশঙ্করকে কোন নিভৃত স্থানে লইয়া গেলেন এবং—প্রথমে দুই একটা সাংসারিক কথা জিজ্ঞাসা করিবার পর বলিলেন “গৌরীশঙ্কর- তোমার বয়স কত?” 

রাধারাণীর মুখে সহসা বয়সের কথা শুনিয়া গৌরীশঙ্কর স্তম্ভিত হইলেন। লোকপরম্পরায় যদিও তিনি রাধারাণীর গুণের কথা শুনিয়াছিলেন এবং অনেক বিষয় স্বচক্ষেও অবলোকন করিয়াছিলেন, তত্রাপি তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে রাধারাণী তাঁহারই সর্বনাশের চেষ্টা করিবেন। যে প্রকার হাবভাবের সহিত মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে রাধারাণী তাঁহার দিকে তীব্র কটাক্ষপাত করিয়া, ওই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহাতে গৌরীশঙ্কর তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন। কিন্তু সে দিকে ইচ্ছা না থাকায় তিনি যেন তাহা বুঝিয়াও বুঝিতে পারিলেন না। জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন গো—এতদিন পরে আজ তুমি আমার বয়সের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন?”

গৌরীশঙ্করের উত্তরে রাধারাণী সন্তুষ্টা হইলেন না। তিনি ভাবিয়াছিলেন গৌরীশঙ্কর উত্তরে নিশ্চয়ই কোনরূপ উপহাস করিবেন। কিন্তু তাহা হইল না দেখিয়া রাধারাণী হাসিতে হাসিতে বলিলেন “বিশেষ কোন কারণ নাই। তবে তোমার বিবাহের কথা হইতেছে সেইজন্যই ওই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি।” 

গৌরীশঙ্কর বিমর্ষ ভাবে বলিলেন “শৈশবেই আমি মাতাপিতৃহীন; জেঠা মহাশয় ও তুমিই আমার অভিবাক। তোমরা যাহা করিবে তাহাই হইবে কিন্তু আমার এখন বিবাহে ইচ্ছা নাই।” 

মুচকি হাসিয়া গৌরীশঙ্করের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া রাধারাণী বলিল “কেন গো? কাহাকেও বুঝি মনে মনে ভালবাসিয়াছ?” 

গৌরী। তাহা হইলে তোমরা কি এতদিন জানিতে পারিতে না? 

রাধা। তবে এত বৈরাগ্য কেন? বংশরক্ষার জন্য সকলেই বিবাহ করে। 

গৌরী। আমার সে ইচ্ছা নাই। 

রাধা। তাহা হইলে তোমার পিতার বংশলোপ হইবে। 

গৌরী। কেন—হরশঙ্কর বিবাহ করিলেই, পিতার বংশরক্ষা হইবে। 

রাধারাণী কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন। পরে লজ্জার মাথা খাইয়া সোহাগভরে, আধ আধ স্বরে বলিলেন “গৌরীশঙ্কর তোমার অভিপ্রায় মন্দ নয়। জানি না আমার মত তুমিও মজিয়াছ কি না। কিন্তু যেদিন আমি তোমায় দেখিয়াছি সেইদিনই প্রাণ ভরিয়া ভালবাসিয়াছি। তোমার জেঠা মহাশয় বৃদ্ধ হইয়াছেন। তিনি আর অধিক দিন বাঁচিবেন, এমন বোধ হয় না। তাঁহার মৃত্যুর পর হরশঙ্করই বিষয়ের অধিকাংশ লাভ করিবে। তুমি নামমাত্র পাইবে। তাহাতে তোমার যাবজ্জীবন সুখে থাকা দূরে থাক চিরকাল কষ্ট ভোগ করিতে হইবে। 

রাধারাণীর কথা শুনিয়া গৌরীশঙ্করের মনে ঘৃণার উদয় হইল। তিনি ভাবিলেন মা আর মাসীমা একই পদার্থ। তিনি একদিন তাঁহাকে পুত্রের মত দেখিতেন, পুত্র সম্বোধন করিতেন, আজ তিনি কোন্ সাহসে এ সকল কথা ব্যক্ত করিলেন। ছিঃ ছিঃ এ সংসারে কামিনী আর কাঞ্চন এই দুইটিই সকল অনিষ্টের মূল। 

এই প্রকার চিন্তা করিয়া গৌরীশঙ্কর বলিলেন “অদৃষ্টলিপি অখণ্ডনীয়। আমার অদৃষ্টে যাহা আছে শত চেষ্টাতেও তাহার বিপর্যয় করিতে পারিব না। আর সুখ-দুঃখ? ধনশালী হইলেই সুখী হওয়া যায় না; শাকান্নভোজী, পূর্ণকুটীরবাসী দরিদ্র ভিক্ষুকও অসীম সুখের অধিকারী হইতে পারে।” 

রাধারাণী অষ্টহাস্য করিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন “এ বয়সে তোমার মুখে ও সকল কথা শোভা পায় না। অশীতিবর্ষ বয়স্ক বৃদ্ধেরাই দৈবকে প্রধান বলিয়া স্বীকার করে। তোমার মত যুবকেরা দৈবকে পদতলে দলিত করিয়া পুরুষকারের আশ্রয় গ্রহণ করে।” 

গৌরীশঙ্কর রাধারাণীর কথা ভাল বুঝিতে পারিলেন না। তিনি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আমায় তবে কি করিতে বলেন? কি করিলে পুরুষকার লাভ করা যায়?” 

রাধারাণী মুচকি হাসিয়া গৌরীশঙ্করের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন “তুমি পুরুষ আমি রমণী। আমি তোমায় কি উপায় বলিব? তোমার ঘটে যে এ বুদ্ধিটুকুও নাই তাহা আমি জানিতাম না। এইজন্যই বুঝি পাঁচ জনে তোমার সুখ্যাতি করে।” 

গৌরীশঙ্কর লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। পরে অতি ধীরে ধীরে কহিলেন “কই আমি ত কোন উপায় দেখিতে পাইলাম না। যদি তোমার জানা থাকে বলিয়া দাও।” 

রাধা। বলিতে পারি—যদি সেই মত কাজ কর। 

গৌরী। না জানিলে কেমন করিয়া স্বীকার করিব। 

রাধারাণী আর একবার গৌরীশঙ্করের আপদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আমিই এখন এ বাড়ীর সর্ব্বময়ী কর্ত্রী ইহা স্বীকার কর কি?”

গৌরী। খুব স্বীকার করি। 

রাধা। আমার হাতেই জমীদারবাবুর যাবতীয় সম্পত্তি তাহাও জান বোধ হয়। 

গৌরী। জানি। 

রাধা। ইচ্ছা করিলে আমি তাহার অধিকাংশ আত্মসাৎ করিতে পারি? 

গৌরী। পার। 

রাধা। তবে আমার সাহায্য লও না কেন? 

গৌরীশঙ্কর তখনও রাধারাণীর মনের কথা বুঝিতে পারিলেন না। তিনি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “তুমি? কেমন করিয়া তুমি আমায় সাহায্য করিবে বুঝিতে পারিলাম না।” 

রাধারাণী বিরক্ত হইলেন। কি করিবেন স্থির করিতে পারিলেন না। অবশেষে লজ্জার মাথা খাইয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “আমি তোমায় অধিকাংশ সম্পত্তির মালিক করিতে পারি। আমি যদি জমীদারবাবুর সমুদায় নগদ সম্পত্তি লইয়া তোমার সহিত কোন দূরদেশে চলিয়া যাই তাহা হইলে ভবিষ্যতে সেই সমস্তই তোমার হইবে। কেমন সম্মত আছ? আমাকে লইয়া যাইতে সাহস হয়?” 

রাধারাণীর মনের কথা বুঝিতে পারিয়া গৌরীশঙ্করের মন ঘৃণা ও লজ্জায় পরিপূর্ণ হইল। রাধারণী যে তাঁহার সমক্ষে মুখ ফুটিয়া ওই সকল কথা বলিবেন তাহা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই। তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। রাধারাণী যে অতি ভয়ানক রমণী তাহা তিনি পূর্ব্বেই জানিতে পারিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি যে এতদূর করিতে সাহস করিবেন তাহা তাঁহার ধারণা ছিল না। 

কিয়ৎক্ষণ চিন্তার পর তিনি ব্রীড়াবনতমুখে বলিলেন “মাসীমা! আজ যাহা আমার সমক্ষে বলিলে, তাহা ভুলিয়া যাও। আমায় ক্ষমা কর। আমি তোমার সন্তান আমার উপর এ অত্যাচার কেন? আমি তোমার স্নেহের প্রার্থী – প্রণয়ের আকাঙ্ক্ষা করি না। আর ও কথা মনেও আনিও না।” 

এই বলিয়া আর উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই গৌরীশঙ্কর তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। রাধারাণী ব্যর্থ প্রণয়ের বিষময় ফল ভোগ করিয়া নীরবে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন। 

ঠিক সেই সময় সতীশচন্দ্র তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন রাধারাণী রোদন করিতেছেন, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। গৃহে প্রবেশ করিবার সময় গৌরীশঙ্করকে দ্রুতবেগে প্রস্থান করিতে দেখিয়াছিলেন। গৃহ মধ্যে আসিয়া রাধারাণীকে রোদন করিতে দেখিলেন। ব্যাপার কি বুঝিতে না পারিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন এবং সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “কি হইয়াছে রাধা? এখানে বসিয়া রোদন করিতেছ কেন?” 

রাধারাণী কোন উত্তর করিলেন না। প্রিয়তমের সোহাগ পাইয়া তিনি আরও রোদন করিতে লাগিলেন। সতীশচন্দ্ৰ একবার চারিদিক লক্ষ্য করিয়া তখনই তাঁহার পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিজ বস্ত্রাঞ্চলে তাঁহার অশ্রুজল মার্জ্জনা করিয়া পুনরায় তাঁহার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে রাধারাণী শান্ত হইলেন। তিনি অতি ধীরে ধীরে উত্তর করিলেন “আমার আর এ বাড়ীতে বাস করা হইল না দেখিতেছি।” 

বাধা দিয়া সতীশচন্দ্ৰ জিজ্ঞাসা করিলেন সে কি? কি হইয়াছে? অমন কথা মুখে আনিতেছ কেন? 

রাধা। যে সে লোক যে আমায় উপহাস করিবে, যাহা তাহাদের মুখে আসিবে তাহাই বলিবে, ইহা আমি গৃহস্থের বধূ ও গৃহস্থের কন্যা হইয়া সহ্য করিতে পারিব না। 

সতীশচন্দ্র রাগান্বিত হইলেন। তিনি সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন “কি হইয়াছে বল আমি এখনই তাহার উপায় করিতেছি।” 

সুযোগ পাইয়া রাধারাণী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে বলিলেন “গৌরীশঙ্কর আজ আমায় এই নিৰ্জ্জন গৃহে একা পাইয়া যৎপরোনাস্তি অপমানিতা করিয়াছে। তিনি তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র, ভবিষ্যতে এই জমীদারীর মালিক কিন্তু তাহার জন্য আমি তাঁহার অপমান সহ্য করিব কেন? আর আমি এখানে থাকিব না।” 

সতীশচন্দ্র কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন “কাল যদি গৌরীকে এ বাটীতে আর দেখিতে পাও, তাহা হইলে তোমার যাহা ইচ্ছা করিও। আমিও এইমাত্র তাহাকে এই গৃহ হইতে দৌড়িয়া পলায়ন করিতে দেখিয়াছি। কিন্তু তখন তাহার কারণ জানিতে পারি নাই। এখন সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাকে আমি বেশ জানি। সে এ বাড়িতে থাকিবার উপযুক্ত পাত্র নহে।” 

রাধারাণীর মনোভিলাষ পূর্ণ হইল। তাহার মুখে হাসি দেখা দিল। সতীশচন্দ্র সে বিদ্যুৎ হাসি দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন এবং কিছুক্ষণ পরে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। 

দশম পরিচ্ছেদ 

সেইদিন রাত্রে আহারাদি সমাপন করিয়া সতীশচন্দ্র গৌরীশঙ্করকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তিনি ইহার পূর্ব্বেই বুঝিয়া ছিলেন যে রাধারাণীকে প্রত্যাখ্যান করিবার জন্য তাঁহাকে যথেষ্ট কষ্ট পাইতে হইবে। এখন সতীশচন্দ্র তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছেন শুনিয়া তিনি চিন্তিত হইলেন এবং বিলম্ব না করিয়া ম্লান বদনে তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। 

রাধারাণীর কথা শুনিয়া সতীশচন্দ্র ভয়ানক রাগান্বিত হইয়াছিলেন। তাঁহাকে সম্মুখে দেখিয়া তিনি অতি কর্কশভাবে বলিলেন “গৌরী! এ বাড়ী কাহার?” 

গৌরীশঙ্কর এ পর্যন্ত কখনও তাঁহার জেঠামহাশয়ের কথায় উত্তর করেন নাই। তিনি তিরস্কার বা কটুকাটব্য বলিলেও কথা কহিতেন না—নীরবে সমস্তই সহ্য করিতেন। কিন্তু সেদিন আর তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না এত অবিচার এত পক্ষপাতিত্ব তাঁহার প্রাণে লাগিল। তিনি অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “আজ্ঞে-সমস্তই আপনার।” 

সতীশচন্দ্র তখন আরও রাগান্বিত হইলেন। তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন “যদি তাহাই বুঝিয়া থাক তবে এ বাড়ীতে তোমার ইচ্ছামত কার্য্য করিতেছ কেন?” 

গৌরী। কি কাজ করিতেছি? আপনার অনুমতি ব্যতীত আমি কোন কাজই করি না। 

সতী। এ বাড়ীতে আমার এক আত্মীয় আছেন। তিনি না থাকিলে, তাঁহার সাহায্য না পাইলে স্ত্রী বিয়োগের পর আমি কোন ক্রমেই সংসার চালাইতে পারিতাম না। আমি সেইজন্য তাঁহার সম্মান রক্ষা করিয়া থাকি। আমার এখন ইচ্ছা নয় যে এ বাড়ীর কোন লোক তাঁহাকে অপমানিতা করে। শুনিলাম আজ নাকি তুমি তাঁহাকে অনেক কুকথা বলিয়াছ? 

আশ্চর্যান্বিত হইয়া গৌরীশঙ্কর বলিয়া উঠিলেন “আমি–কুকথা বলিয়াছি আমি? আপনি শুনিয়াছেন?” সতী। আমি স্বয়ং তোমায় বলিতে শুনি নাই কিন্তু যখন তুমি রাধারাণীকে অপমান করিয়া পলায়ন করিতেছিলে ঠিক সেই সময়ে আমি তথায় উপস্থিত হই। তাহার পর গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখি রাধারাণী রোদন করিতেছন। আমি তাঁহার ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম, প্রথমে তিনি তোমার নাম করিতে ইচ্ছা করেন নাই। অবশেষে আমার নিৰ্ব্বন্ধাতিশয় দেখিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে সকল কথা বলিলেন এখনও কি তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করিতে চাও? 

গৌরী। আজ্ঞে না—আপনার কথায় আমার অবিশ্বাস নাই। 

সতী। তবে কেন এমন কাজ করিলে? 

গৌরীশঙ্কর কোন উত্তর করিলেন না। তিনি নির্নিমেষ নয়নে সতীশচন্দ্রের পায়ের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সতীশচন্দ্র তখন ক্রোধে অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়া ছিলেন। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছিল। তিনি বলিলেন এ বাড়ীতে তোমার আর স্থান হইবে না। কাল প্রত্যূষে যেন আর আমায় তোমার মুখ দেখিতে না হয়।” 

এই বলিয়া সতীশচন্দ্ৰ তখনই তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। গৌরীশঙ্কর কিছুক্ষণ তথায় নীরবে রোদন করিয়া ধীরে ধীরে সে ঘর হইতে বাহির হইলেন এবং কাহাকেও কোন কথা না বলিয়া সেই রাত্রেই গৌরীপুর ত্যাগ করিলেন। পরদিন প্রত্যূষেই সতীশচন্দ্র গৌরীশঙ্করকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ভৃত্য বাড়ীর চারিদিকে অন্বেষণ করিল কিন্তু কোথাও তাঁহার দেখা পাইল না। সে তখন জমীদারবাবুকে প্রকৃত ব্যাপার জ্ঞাপন করিল। সতীশচন্দ্র ক্রোধের বশবর্তী হইয়া গৌরীশঙ্করকে বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিয়া বিশেষ দুঃখিত হইলেন এবং গোপনে তাঁহার অনুসন্ধানের জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইয়া দিলেন। 

চারুশীলা, হরশঙ্কর ও তাঁহার বন্ধু ভবানীপ্রসাদ যথা সময়ে এই সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। গৌরীশঙ্কর নিজগুণে সকলেরই প্রিয় ছিলেন, তাঁহার অদর্শনে সকলেই ব্যথিত ও বিষণ্ণ হইলেন। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

এক মাস অতীত হইয়া গেল, কিন্তু গৌরীশঙ্করের কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। সতীশচন্দ্র ক্রমেই চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। তিনি ভাবিলেন হয় ত গৌরীশঙ্কর আত্মঘাতী হইয়াছেন। নানা চিন্তায় তাঁহার শরীর ও মন দিন দিন অবসন্ন হইয়া পড়িতে লাগিল। 

রাধারাণী কৌশলে নিজ দোষ গৌরীশঙ্করের উপর চাপাইয়া নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু যখনই তাঁহার গৌরীশঙ্করকে মনে পড়িত, যখনই তাঁহার অমায়িক ভাব ও হাসি হাসি মুখখানি তাঁহার মানস পটে উদিত হইত তখনই তিনি আন্তরিক দুঃখিতা হইতেন, তাঁহার আর কোন কার্য্য ভাল লাগিত না। 

সতীশচন্দ্র রাধারাণীর এইরূপ পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিলেন। তিনি অনুমান করিলেন গৌরীশঙ্কর একা দোষী নহে——নিশ্চয়ই রাধারাণীরও দোষ আছে। এইরূপ নানা প্রকার চিন্তায় সতীশচন্দ্র অস্থির হইয়া পড়িলেন এবং গৌরীশঙ্করের অন্বেষণের জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

আন্তরিক চেষ্টায় সুফল ফলিল— গৌরীশঙ্কর যখন শুনিলেন যে তাঁহার জেঠামহাশয় তাঁহার জন্য আন্তরিক দুঃখিত হইয়াছেন এবং তাঁহার অনুসন্ধানের জন্য চারিদিকে লোক প্রেরণ করিয়াছেন, তখন তিনিও আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলেন না, সতীশচন্দ্রকে পত্র লিখিলেন। 

পত্র পাঠ করিয়া সতীশচন্দ্র আনন্দিত এবং গৌরীশঙ্করকে পুনরায় বাড়ীতে ফিরিতে অনুরোধ করিলেন। গৌরীশঙ্কর সম্মত হইলেন কিন্তু বিশেষ কাৰ্য্য থাকায় তখনই প্রত্যাগমন করিতে পারিলেন না। সতীশচন্দ্রকে পত্রদ্বারা জানাইলেন দুইদিন পরে তাঁহার চরণ দর্শন করিবেন। 

হরশঙ্কর চিরকালই আমোদ-আহ্লাদ লইয়া ব্যস্ত। সমস্ত দিন তিনি বন্ধুর সহিত পরামর্শ করেন আর সন্ধ্যার পর আহারাদি করিয়া দুই বন্ধুতে বাহির হন। কোন দিন বাড়ীতে ফিরেন, কোনদিন বা ফিরিতে পারেন না। সতীশচন্দ্র এ সকল কথা জানিতেন না। তিনি হরশঙ্করকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন তাঁহার দোষ তিনি দেখিতে পাইতেন না। রাধারাণী দুই একদিন এ কথা সতীশচন্দ্রের কানে তুলিয়াছিলেন, কিন্তু এবার তিনি তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিয়া সহসা কোন কার্য্য করেন নাই। তিনি রাধারাণীকে মিষ্ট কথায় সন্তুষ্ট করিলেন। 

ভবানীপ্রসাদের সহিত রাধারাণীর মধ্যে মধ্যে সাক্ষাৎ হইত। চারিচক্ষু মিলন হইলে ভবানীপ্রসাদ ইঙ্গিত করিয়া সেই হাজার টাকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন, কিন্তু বিশেষ সন্তোষজনক উত্তর পাইতেন না। 

রাধারাণী কিন্তু নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সুযোগ পাইলেই তিনি সতীশচন্দ্রের নিকট হইতে আদায়ের চেষ্টা করিতেন এবং মধ্যে মধ্যে সফলও হইতেন। কিন্তু হাজার টাকা সহজ কথা নয়, এত টাকা সংগ্রহ করাও তাঁহার পক্ষে কষ্টকর। তথাপি কোন উপায়ে ওই টাকাগুলি যোগাড় করিবেন তাহাই প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। 

হরশঙ্কর দিন দিন অতি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। যতদিন গৌরীশঙ্কর নিকটে ছিলেন, ততদিন তিনি বিশেষ কোন উৎপাত করিতে পারেন নাই। সতীশচন্দ্রকে তিনি যত ভয় না করেন গৌরীশঙ্করকে তদপেক্ষা অনেক অধিক ভয় করিতেন। যে কয়দিন গৌরীশঙ্কর গৌরীপুরে ছিলেন না, সেই কয়দিনের মধ্যেই হরশঙ্কর অনেক টাকার হ্যাণ্ডনোট কাটলেন। দেনার দায়ে তাঁহার মুখ দেখান ভার হইল। 

ভবানীপ্রসাদ যখন দেখিলেন যে হরশঙ্করের যথেষ্ট দেনা হইয়াছে, অর্থের অভাবে আর পূর্ব্বের মত আমোদ-আহ্লাদ হইতেছে না, তখন তিনি নিজের পথ দেখিত লাগিলেন কিন্তু রাধারাণী তখনও হাজার টাকা সংগ্রহ করিতে পারে নাই বলিয়া তিনি আরও দিন কয়েক সেখানে থাকিতে বাধ্য হইলেন। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

একদিন প্রাতঃকালে ভবানীপ্রসাদ উদ্যান ভ্রমণ করিতেছেন, এমন সময়ে জমীদার বাড়ীর এক দাসী আসিয়া তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিল। তিনি শশব্যস্ত হইয়া পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলেন এবং পাঠ করিয়া স্তম্ভিত হইলেন। প্রথমে ভাবিলেন পত্রখানি জাল; কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তাঁহার সে ধারণা দূর হইল। তিনি পত্রের কথা মত কার্য্য করিতে মনস্থ করিলেন। 

উদ্যান ভ্রমণ শেষ করিয়া যখন ভবানীপ্রসাদ আপন প্রকোষ্ঠে গমন করিলেন, তখন বেলা প্রায় আটটা, তিনি গৃহ মধ্যে একখানি কৌচের উপর উপবেশন করিলেন এবং গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। কিছুক্ষণ পরে পত্রখানি আবার বাহির করিলেন এবং অনুচ্চস্বরে পুনরায় পাঠ করিলেন। 

“দামোদর। 

যদি আমার উপর কিছু মাত্র ভালবাসা থাকে, যদি আমাকে দেখিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে আজ রাত্রি নয়টার সময় ভৈরবনদের জমীদার ঘাটে বড় বটবৃক্ষের তলে আসিও। অনেক কথা আছে। 

তোমারই—রাজু” 

পত্র পাঠ করিয়া ভবানীপ্রসাদ ওরফে দামোদর কি ভাবিয়া হাসিয়া উঠিলেন। পরে আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন যদি প্রভাকে পাই তাহা হইলে রাজুকে কোন প্রয়োজন নাই। প্রভার সহিত অপর কোন রমণীরই তুলনা হয় না। কিন্তু একবার যাহাকে আদর করিয়াছি তাহাকে নিতান্ত অবজ্ঞা করাও ভাল দেখায় না। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি রাত্রি নয়টার সময় নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া পত্র লেখিকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলেন। 

যে দাসী পত্রখানি তাঁহার হস্তে দিয়াছিল সে বড় চতুরা। পত্রখানি প্রদান করিয়া সে অন্তরালে লুকাইয়া রহিল ও যখন ভবানীপ্রসাদ অনুচ্চস্বরে আপনা আপনি ওই কথা বলিতেছিলেন, তখন সে গোপনে দাঁড়াইয়া তাঁহার সকল কথা শুনিতে পাইয়াছিল। তাহার কেমন সন্দেহ হইল। পূৰ্ব্ব হইতেই সে ভবানীপ্রসাদের উপর বিরক্ত হইয়াছিল এখন তাঁহার মুখে সেই সকল কথা শুনিয়া সে ভবানীপ্রসাদের কার্য্য লক্ষ্য করিতে লাগিল। 

সন্ধ্যার পর আহারাদি সমাপন করিয়া ভবানীপ্রসাদ যখন নির্দিষ্ট গৃহে গমন করিলেন, তখন সেই দাসীও গোপনে তাঁহার গৃহের নিকট লুকাইয়া রহিল এবং ভবানীপ্রসাদ যখন সকলের অগোচরে জমীদার বাটী হইতে বহির্গত হইলেন, দাসীও তাঁহার অনুসরণ করিল। 

কিছুদূর গমন করিয়া ভবানীপ্রসাদ নদীতীরে আগমন করিলেন এবং জমীদার ঘাটের নিকট যে বটবৃক্ষ ছিল তাহার তলে উপস্থিত হইলেন। দাসীও দূরে থাকিয়া তাঁহার অনুসরণ করিল এবং নিকটস্থ অপর একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়াইয়া রহিল। 

কিছুক্ষণ পরেই দাসী একজন স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইল। সে আশ্চৰ্য্যান্বিতা হইয়া ব্যগ্র ভাবে তাহাদের কথোপকথন শুনিতে লাগিল। 

ভবানীপ্রসাদ বটবৃক্ষতলে উপস্থিত হইবামাত্র সেই পত্র লেখিকা রাজবালা ব্যস্ত সমস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “কেও দামু!” 

অতি কর্কশস্বরে ভবানীপ্রসাদ উত্তর করিলেন, না – আমার নাম এখন ভবানী। তুমি এখানে কি জন্য? এখনও কি আমার আশা ত্যাগ করিতে পার নাই?” 

অতি বিনীত ভাবে রাজবালা উত্তর করিল “এ জন্মে তোমার আশা ছাড়িতে পারিব না। কিন্তু এই তোমার ভালবাসা? এতকাল আশা দিয়া শেষে কি এইরূপেই আমাকে হতাশ করিতে চাও? নানা—দামু তুমি আমায় নিশ্চয়ই উপহাস করিতেছ। আমি যে তোমার জন্য সাতসমুদ্র তেরনদী পার হইয়া, কত লোকের নিকট অপমানিতা হইয়া কত লোকের তিরস্কার খাইয়া এতদূরে আসিলাম, তাহার কি এই প্রতিফল? না দামু—আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। জান কি তুমি, আমি কত কষ্টে তোমার সন্ধান পাইয়াছি?” 

ভবা। সে কথা জানিয়া আমার ফল কি? কেন তুমি এত কষ্ট করিয়াছ? 

রাজ। তোমায় পাইব বলিয়া। যখন সোহাগ ভরে আমায় আদর করিয়া বলিয়াছিলে এ জন্মে আমার পরিত্যাগ করিবে না তখন কি এ সকল কথা ভাব নাই? জানিতে না কি রমণীর প্রতিহিংসা কি ভয়ানক। জান না কি আমি এখনও তোমার সর্ব্বনাশ করিতে পারি? 

ভবানীপ্রসাদ কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিলেন না। পরে অতি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন “এখন আর তুমি আমার কি অপকার করিবে?” 

রাজ। কি করিব? যদি একবার এখানকার থানায় লোকে জানিতে পারে যে তুমি জেল হইতে পলয়ান করিয়াছ, তাহা হইলে কি হইবে ভাবিয়া দেখিয়াছ কি? 

ভবা। তাহাতে তোমার লাভ? আর তুমিও সাধু নহ, তুমিও একজন জেলের আসামী। 

রাজ। আমি জেল হইতে পলায়ন করি নাই। তোমাকে উদ্ধার করিবার জন্য সাহায্য করিয়াছি মাত্র। যদি তাহাতেই আমার শাস্তি পাইতে হয়, তাহা হইলে তোমার কি হইবে ভাব দেখি। 

ভবানীপ্রসাদ আর সহ্য করিতে পারিলেন না। তিনি গোপনে একখানি তীক্ষ্ণধার ছোরা বাহির করিয়া সহসা রাজবালাকে আক্রমণ করিলেন এবং একটি আঘাতে তাহাকে নদী গর্ভে নিক্ষেপ করিয়া দ্রুতপদে বিক্ষেপে জমীদার বাড়ীর দিকে পলায়ন করিলেন। 

দাসী যখন দেখিল ভবানীপ্রসাদ দৌড়িয়া পলায়ন করিতেছেন তখন সেও দ্রুতগতি তাঁহার পশ্চাদনুসরণ করিল এবং ভবানীপ্রসাদকে জমীদার বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দেখিয়া পুনরায় নদীতীরে গমন করিয়া নিমেষ মধ্যে রাজবালাকে উত্তোলন করিল। দেখিল রমণী মূৰ্চ্ছিতা। 

দাসী ভাবিয়া ছিল ভবানীপ্রসাদের ছোরার আঘাতে রমণী মারা পড়িয়াছে। কিন্তু যখন দেখিল সে সামান্য আঘাত পাইয়াছে তখন সে সত্বর তাহাকে ক্রোড়ে তুলিয়া নিকটস্থ একটি পরিচিত বৃদ্ধার কুটীরে লইয়া গেল। 

দাসী যখন বৃদ্ধার কুটীরে উপস্থিত হইল, তখন রাত্রি প্রায় এগারোটা বাজিয়াছে। বৃদ্ধা নিদ্রা যাইতেছিল দাসী অনেক কষ্টে তাহার নিদ্রাভঙ্গ করিয়া অল্প কথায় সমস্ত ব্যাপার ব্যক্ত করিল এবং রাজবালাকে তাহার নিকট রাখিয়া পুনরায় আপনার মনিব বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিল। 

বাড়ীতে আসিয়া দাসী প্রথমে ভবানীপ্রসাদের ঘর লক্ষ্য করিল। দেখিল তাহা ভিতর হইতে আবদ্ধ। সে তখন নিশ্চিন্ত হইল। ভাবিল যখন তিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন, তখন আর তাঁহার পলায়নের ইচ্ছা নাই। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ 

ভবানীপ্রসাদ জমীদার বাড়ীর ফটক পার হইয়া যখন উদ্যানে উপস্থিত হইলেন তখন সহসা তাঁহার পদস্খলন হইল। একে তিনি দিক-বিদিক জ্ঞান শূন্য হইয়াই পলায়ন করিতেছিলেন, তাহার উপর তাঁহার মনেরও কিছুমাত্র স্থিরতা ছিল না। পদস্খলন হওয়ায় তিনি পড়িয়া গেলেন কিন্তু তখনই আবার গাত্রোত্থান করিয়া কোন দিক লক্ষ্য না করিয়া একেবারে আপনার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন এবং ভিতর হইতে গৃহদ্বার আবদ্ধ করিয়া দিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে ভবানীপ্রসাদ যেন কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। এতক্ষণ বাড়ীতে জনমানবের সাড়া-শব্দ ছিল না, এতক্ষণ তিনি ভাবিয়াছিলেন তাঁহার সে রাত্রির কার্য্য আর কেহ জানিতে পারে নাই, তাই তিনি এতক্ষণ একপ্রকার নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু সহসা অপরের পদশব্দ শুনিয়া তাঁহার প্রাণে আতঙ্ক হইল। তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, কোন উপায়ে পলায়ন করিবেন তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। 

সহসা কে যেন বলিয়া উঠিল “খুন-খুন”। ভবানীপ্রসাদ স্তম্ভিত হইলেন। ভাবিলেন নিশ্চয়ই কোন লোক তাঁহার কার্য্য দেখিয়া তাঁহার অনুসরণ করিয়াছে। এই চিন্তা করিয়া তিনি শয্যা হইতে দুইখানি চাদর তুলিয়া লইলেন। পরে চাদর দুইখানি একত্রে গাঁইটি দিয়া তাহার এক প্রান্ত একটি জানালায় বন্ধন করিলেন, তাহার পরে জানালার একটি গরাদ ভাঙ্গিয়া সেই চাদরের সাহায্যে নিম্নে অবতরণ করিলেন এবং একবার চারিদিকে লক্ষ্য করিয়া প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া ষ্টেসনের দিকে গমন করিলেন। 

যে দাসী তাঁহার সমস্ত কার্য্য লক্ষ করিয়া ছিল সে নিশ্চিত্ত হইলেও কোন কারণবশতঃ ঠিক সেই সময়ে নিম্নে গিয়াছিল। সহসা তাহার দৃষ্টি ভবানীপ্রসাদের গৃহের জানালার দিকে পতিত হইল। সে দেখিল তিনি চাদরের সাহায্যে নিম্নে অবতরণ করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িতেছেন, দাসীও নিশ্চিন্ত রহিল না। সেও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িতে লাগিল। 

জমীদার বাড়ী হইতে ভবানীপ্রসাদ পলায়ন করিবার পর সেখানে মহাহুলস্থুল ব্যাপার ঘটিল। “খুন—খুন” এই শব্দ চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। বাড়ীর দাস-দাসী সকলেই বাহির হইল, রাধারাণী সেই চীৎকার ধ্বনি শুনিয়া শশব্যস্তে আপনার শয়নকক্ষ হইতে বাহির হইলেন এবং চারিদিক অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। 

ঠিক সেই সময়ে গ্রামের চৌকীদার সেই স্থান দিয়া যাইতেছিল। সে জমীদার বাড়ীতে “খুন খুন” শব্দ শুনিয়া তখনই তথায় প্রবেশ করিল এবং বাড়ীর লোকজনের সহিত সকল স্থান অন্বেষণ করিতে লাগিল। 

ইত্যবসরে রাধারাণী চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। চারুশীলা শ্বশুরবাড়ী গিয়াছিল, হরশঙ্কর সেদিন বেলা চারিটার সময় কোথায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলেন। গৌরীশঙ্কর সেই অবধি জমীদার বাড়ীতে ফিরিয়া আইসেন নাই। সেই রাত্রেই তাঁহার ফিরিবার কথা ছিল। 

রাধারাণীর চীৎকার শব্দ শুনিয়া চৌকীদার তখনই তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিল। যাহা শুনিল তাহাতে তাহারও প্রাণে ভয়ের সঞ্চার হইল। শুনিল সতীশচন্দ্রকে কে খুন করিয়া গিয়াছে। 

এই সংবাদ পাইয়া চৌকীদার বাড়ীর দুইজন চাকরের সহিত জমীদারবাবুর গৃহে গমন করিল। দেখিল গৌরীশঙ্কর দক্ষিণ হস্তে একখানি রক্তাক্ত ছোরা লইয়া ঘর হইতে বাহির হইতেছেন। চৌকীদার একবার সতীশচন্দ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই বুঝিতে পারিল তাঁহার দেহ হইতে প্ৰাণবায়ু নিৰ্গত হইয়া গিয়াছে। সে তখন কোন কথা না বলিয়া সেই ছোরা সমেত গৌরীশঙ্করকে গ্রেপ্তার করিল এবং তখনই একখানি গাড়ি করিয়া বন্দীকে থানায় লইয়া গেল। 

এদিকে ভবানীপ্রসাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দাসীকে ছুটিতে দেখিয়া একজন চৌকীদার উভয়কেই গ্রেপ্তার করিল। দাসী তখন তাহাকে প্রকৃত কথা জ্ঞাপন করিল। ভবানীপ্রসাদ দ্বিরুক্তি করিলেন না। চৌকীদার যতই প্রশ্ন করিতে লাগিল তিনি কোন কথারই জবাব দিলেন না। দাসীর কথা সত্য বিবেচনা করিলেও চৌকীদার উভয়কেই বন্দী করিয়া থানায় লইয়া গেল। 

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ 

পরদিন প্রভাতে জমীদার বাড়ীতে মহাহুলস্থুল পড়িয়া গেল। থানার লোকে বাড়ী পূর্ণ করিল। দারোগাবাবু স্বয়ং আসিয়া সতীশচন্দ্রের মৃতদেহ পরীক্ষা করিলেন, বাড়ীর ডাক্তারবাবু দেহ পরীক্ষা করিয়া স্পষ্টই বলিলেন “সহসা পশ্চাৎ দিক হইতে আহত হইয়া জমীদারবাবু কোনপ্রকার শব্দ না করিয়াই মারা পড়িয়াছেন। গৌরীশঙ্করের হস্তে যে ছোরা খানি পাওয়া গিয়াছিল সম্ভবতঃ সেই ছোরার আঘাতেই সতীশচন্দ্রের প্রাণ বিয়োগ হইয়াছে।” 

লাস চালান দিয়া দারোগাবাবু গৌরীশঙ্করের সহিত দেখা করিলেন। কিন্তু তাহার পূর্ব্বে তিনি বাড়ীর দাস-দাসীগণকে জিজ্ঞাসা করিয়া অনেক সংবাদ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। দারোগাবাবু গৌরীশঙ্করকে জিজ্ঞাসা করিলেন “গৌরীবাবু আপনার এবুদ্ধি কেন হইল? জমীদারবাবু আপনাকে এত ভাল বাসিতেন আপনিও তাঁহাকে যথেষ্ট ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন কিন্তু সহসা আপনার এ বুদ্ধি ঘটিল কেন?” 

বিরক্ত হইয়া গৌরীশঙ্কর উত্তর করিলেন “কি বুদ্ধি? আমি কি করিয়াছি?” 

দারোগাবাবু স্তম্ভিত হইলেন। তিনি বলিলেন “জমীদারবাবুকে খুন করিয়াছেন।” 

অতি দৃঢ়স্বরে গৌরীশঙ্কর উত্তর করিলেন “কখনও না। আমি জেঠামহাশয়কে খুন করি নাই। আপনারা মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমায় বন্দী করিয়াছেন।” 

দারোগাবাবু মনে মনে হাসিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনারই হাতে রক্তাক্ত ছোরা ছিল।” 

গৌরী। আজ্ঞে হাঁ, ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র আমি সেই রক্তমাখা ছোরাখানি দেখিতে পাই এবং তুলিয়া লই।

দারো। সেখানি কাহার ছোরা? 

গৌরী। আমার—ইহাতে আমারই নাম লেখা আছে। কিন্তু সকলেই ব্যবহার করিত। 

দারো। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় আপনি আপনার জেঠামহাশয়ের ঘরে যাইলেন কেন? 

গৌরী। বোধ হয় শুনিয়া থাকিবেন কোন গূঢ় কারণ বশতঃ জেঠামহাশয়ের সহিত আমার বিবাদ হয়। তিনি আমাকে বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দেন। কিন্তু পরে যখন আমাকে নির্দোষ বলিয়া বুঝিতে পারেন তখন আবার আমায় ডাকিয়া পাঠান। আমি পশ্চিমে ছিলাম; মনের ঘৃণায় আত্মঘাতী হইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম, কৃতকাৰ্য্য হই নাই। জেঠামহাশয় যখন ফিরিবার জন্য পত্র লিখিলেন তখন আমি সমস্ত ভুলিয়া গেলাম। তাঁহার করুণ পূর্ণ পত্রখানি পাঠ করিয়া আমার গৃহে ফিরিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু তখন ফিরিতে পারিলাম না। একটা বিশেষ কাৰ্য্য থাকায় বিলম্ব হইল। আমি জেঠামহাশয়কে এই মৰ্ম্মে পত্র লিখিলাম–আজ আমার আসিবার কথা ছিল। ইচ্ছা ছিল বেলা চারিটার মধ্যেই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইব, কিন্তু পরে নানা বিঘ্ন উপস্থিত হওয়ায় রাত্রি দশটার পর গৌরীপুরে উপস্থিত হই। তাহার পর যখন বাড়ীতে আসিলাম তখন অনেক রাত্রি। মনে করিয়া ছিলাম জেঠামহাশয় নিদ্রত হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহার গৃহের সম্মুখে আসিয়া দেখিলাম তাঁহার গৃহের ভিতর আলোক জ্বলিতেছে। আমি জানি আলোক নিৰ্ব্বাপিত না হইলে তিনি নিদ্রা যাইতে পারেন না, আলোক দেখিয়া আমার সন্দেহ হইল। ভাবিলাম হয় ত তিনি এখনও জাগিয়া আছেন। হয় ত আমারই জন্য কত কি চিন্তা করিতেছেন। এই সন্দেহ করিয়া আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম দরজা খুলিয়া গেল। আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। যাহা দেখিলাম তাহাতে আমার হৃদয়ের রক্ত শুকাইয়া গেল। দেখিলাম জেঠামহাশয় বিছানার উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া রহিয়াছেন। তাঁহার পৃষ্ঠে এক ভয়ানক ছোরার আঘাত। সেই ক্ষতস্থান হইতে রক্তের স্রোত বহিতেছে বিছানা রক্তাক্ত হইয়া গিয়াছে। ঘরের মেজের উপর দিয়া রক্তের নদী প্রবাহিত হইতেছে এবং সেই স্থানে ছোরাখানি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। ছোরাখানি তুলিয়া লইয়া আমি একবার জেঠামহাশয়ের নিকট যাইলাম কিন্তু তাঁহার মুখের দিকে চাহিতে পারিলাম না। সেখান হইতে ফিরিয়া যেমন ঘর হইতে বাহির হই অমনই চৌকীদার আমাকে ধরিয়া ফেলিল। আমি ঈশ্বরের শপথ করিয়া বলিতেছি ইহাই সত্য—আমি জেঠামহাশয়কে হত্যা করি নাই। 

গৌরীশঙ্কর এত বিনীত ভাবে অথচ দৃঢ়তার সহিত এই সকল কথা বলিলেন যে দারোগাবাবু তাঁহার কথায় অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। যদিও বাহ্যিক অবস্থা দেখিলে তাঁহাকেই দোষী বলিয়া সন্দেহ হয় তত্রাপি তিনি এস্থলে গৌরীশঙ্করের কথাই বিশ্বাস করিলেন। 

দারোগাবাবু বিষম ফাঁপরে পড়িলেন। গৌরীশঙ্কর যে অন্যায় রূপে আবদ্ধ হইয়াছেন তাহা বুঝিতে পারিলেন; কিন্তু যতক্ষণ না প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিতে পারিবেন ততক্ষণ তাঁহাকে কারাগার হইতে মুক্তি প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন না মনে করিয়া তিনি প্রাণপণে প্রকৃত দোষীর সন্ধান লইতে যত্নবান হইলেন। চৌকীদার যে ভ্রমে পতিত হইয়া গৌরীশঙ্করকে গ্রেপ্তার করিয়াছে তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন। 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ 

গৌরীশঙ্করকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিবার পর দারোগাবাবু দেখিলেন হরশঙ্কর ফিরিয়া আসিয়াছেন। দারোগাবাবুকে দেখিয়া তিনি তাঁহার নিকটে আসিলেন এবং জেঠামশায় ও জ্যেষ্ঠভ্রাতার শোকে কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহার দুঃখ দেখিয়া দারোগাবাবুর কঠিন হৃদয়ও দ্রবীভূত হইল। তাঁহার চক্ষে জল আসিল। তিনি মিষ্ট কথায় তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। 

হরশঙ্কর কিছু শান্ত হইলে দারোগাবাবু জিজাসা করিলেন “আপনাদের বাড়ীর দাস-দাসীদিগকে কিরূপ বিবেচনা করেন? তাহাদের দ্বারা এ কার্য্য হইতে পারে কি না?” 

হরশঙ্কর মিথ্যা বলিতে পারিলেন না। তিনি অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “এ বাড়ীর ভৃত্যগণ সকলেই জেঠামহাশয়কে ভক্তি শ্রদ্ধা করিত। তাহারা কখনও তাঁহার উপর বিরক্ত হয় নাই। তিনি ও তাহাদিগের উপর কখনও কোনপ্রকার অন্যায় ব্যবহার করেন নাই।” 

দারো। কোন লোকের উপর আপনার সন্দেহ হয় না? 

হর। আজ্ঞে না। 

দারো। জমীদারবাবু যেদিন খুন হন সে রাত্রে এ বাড়ীতে কতগুলি লোক ছিল? হর। পুরুষের মধ্যে আমার এক বন্ধু ভবানীপ্রসাদ আর বাড়ীর চারিজন ভৃত্য। 

দারো। আপনার বন্ধু কোথায় গেলেন? তাঁহাকে ত আজ প্রাতঃকালে দেখি নাই। 

হরশঙ্কর চিন্তিত হইলেন। তিনি বলিলেন “এতক্ষণ এই সকল গোলযোগে আমারও সে কথা স্মরণ হয় নাই। আমিও আসিয়া অবধি তাঁহাকে দেখি নাই।” 

হরশঙ্করের কথা শুনিয়া দারোগাবাবু স্তম্ভিত হইলেন এবং তখনই তাঁহাকে অন্বেষণ করিবার জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইলেন। স্বয়ং হরশঙ্করকে লইয়া তাঁহার গৃহের দিকে অগ্রসর হইলেন। 

পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে ভবানীপ্রসাদের গৃহদ্বার ভিতর হইতে আবদ্ধ ছিল। দারোগাবাবু দ্বার সম্মুখে আসিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন এবং তখনই হরশঙ্করের অনুমতি লইয়া দ্বার ভগ্ন করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহারা যাহা দেখিতে পাইলেন পাঠক মহাশয় পূর্ব্বেই তাহা অবগত আছেন। 

ভবানীপ্রসাদের প্রকোষ্ঠ পরীক্ষা করিয়া দারোগাবাবু স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন যে তিনিই জমীদারবাবুকে হত্যা করিয়া জানালা দিয়া দুইখানি চাদরের সাহায্যে পলায়ন করিয়াছেন। এই নূতন সূত্র পাইয়া দারোগাবাবু আন্তরিক সন্তুষ্ট হইলেন। ভাবিলেন ভবানীপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করিতে পারিলেই তাঁহার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইবে। 

এই স্থির করিয়া দারোগাবাবু তখনই জমীদার বাড়ী হইতে বাহির হইলেন এবং হরশঙ্করের নিকট বিদায় লইয়া পুনরায় থানায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। 

থানায় আসিয়া দারোগাবাবু শুনিলেন ভবানীপ্রসাদ ও জমীদার বাড়ীর একজন দাসী ধরা পড়িয়াছে। তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং তখনই ভবানীপ্রসাদের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। 

ভবানীপ্রসাদের বিমর্ষ মুখ ও ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস দেখিয়া দারোগাবাবু তাঁহাকে দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিলেন। তিনি জিজাসা করিলেন “কি অপরাধে আপনি এই হত্যা করিলেন? এ হত্যাকাণ্ডে আপনার স্বার্থ কি? নরহত্যা করিয়া কি লাভ করিলেন? কেনই বা আপনি এ কার্য্যে হাত দিলেন?” 

ভবানীপ্রসাদ অতি বিনীত ভাবে বলিলেন “ সে সকল কথা আর আপনার শুনিয়া কাজ নাই। আমি হত্যা করিয়াছি-আমায় শাস্তি দিন।” 

দারোগাবাবু তখনই বন্দীর কথাগুলি লিখিয়া লইলেন এবং জমীদার বাড়ীর দাসীর সহিত দেখা করিলেন ও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার নাম কি বাছা? কতদিন তুমি জমীদার বাড়ীতে চাকরী করিতেছ? 

দাসী সসম্ভ্রমে বলিল “আমার নাম মঙ্গলা প্রায় আট বৎসর আমি সেখানে চাকরী করিতেছি।”

দারো। তুমি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় কিছু জান, কেনই বা তুমি ভবানীপ্রসাদের সহিত গ্রেপ্তার হইয়াছ?”

মঙ্গলা। আমি সেই হতভাগা ভবানীবাবুকে স্বচক্ষে খুন করিতে দেখিয়াছি। যখন সে জানালা দিয়া চাদর ধরিয়া ঘর হইতে পলায়ন করিতেছিল আমি দেখিতে পাইয়া তাহার পিছু লই এবং তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য দৌড়িতে থাকি। আমি অনেকক্ষণ চীৎকার করি কিন্তু কোন লোক আমার সাহায্য করে না। অবশেষে একজন চৌকীদার আমাদের দুইজনকেই চোর মনে করিয়া ধরিয়া ফেলে। তাহার পর আমার কথা শুনিয়া এখানে লইয়া আসে, কেন যে এখনও আমাকে ছাড়িয়া দেয় নাই বলিতে পারি না। আপনি দয়া করিয়া আমায় মুক্তি দিন। 

দারোগাবাবু তাহাকে আশ্বাস দিয়া পুনরায় ভবানীপ্রসাদের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন ও জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি হরশঙ্করের বন্ধু হইয়া এ কাজ কেমন করিয়া করিলেন?” 

ভবানীপ্রসাদ এই প্রশ্নের মর্ম্ম বুঝিতে পারিলেন না। তিনি নিস্তব্ধে দাঁড়াইয়া রহিলেন দেখিয়া দারোগাবাবু পুনরায় বলিলেন “যে বন্ধু আপনাকে এতকাল নিজগৃহে রাখিয়া ভরণ-পোষণ করিলেন আপনি তাঁহারই জেঠামহাশয়কে স্বচ্ছন্দে হত্যা করিলেন, লোকে উপকারী বন্ধুর কি এই রূপেই প্রত্যুপকার করে?” 

দারোগাবাবুর শেষ কথা শুনিয়া ভবানীপ্রসাদ চমকিত হইলেন। তিনি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে কি সতীশচন্দ্রও সেই রাত্রে খুন হইয়াছেন?” 

দারোগাবাবুও তাঁহার কথায় স্তম্ভিত হইলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে আপনি এতক্ষণ কাহার কথা বলিতেছিলেন? আপনি তবে কাহাকে খুন করিয়া পালাইতেছিলেন?” 

ভবানীপ্রসাদ তখন ধীরে ধীরে রাজবালার সেই পত্রের কথা হইতে আরম্ভ করিয়া রাত্রে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যে যে কথা বলিয়াছিলেন ও যাহা যাহা করিয়াছিলেন তাহা আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন। সেই কথায় দারোগাবাবুর চক্ষু ফুটিল। তাঁহার ধারণা মিথ্যা বলিয়া স্ত্রি করিলেন। 

কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “রমণী সত্যই কি মারা পড়িয়াছে?” 

ভবা। আমার ছোরার আঘাতে সে নদীতে পড়িয়া গিয়াছিল। কোনরূপ শব্দও করে নাই আমি তাহাতেই বুঝিয়াছি রাজবালা মারা পড়িয়াছে। 

দারো। যে দাসী আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিতেছিল সেও কি এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছে? 

ভবা। আজ্ঞে না—সে বেচারা সম্পূর্ণ নির্দোষ সে বোধ হয় আমাকে খুন করিতে দেখিয়াছিল। তাই আমাকে ধরিবার জন্য তাড়া করিয়াছিল। 

দারোগাবাবু তখন পুনরায় দাসীর নিকট গমন করিবেন এবং সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। মঙ্গলা প্রথম হইতে শেষ পর্য্যন্ত সকল কথাই ব্যক্ত করিল। পরে বলিল “আমার বোধ হয় সেই রমণী জীবিতা আছে, আমি গত রাত্রে যখন তাহাকে নদী হইতে উদ্ধার করিয়া নিকটস্থ একখানি কুটীরে লইয়া যাই তখন সে অজ্ঞান ছিল বটে কিন্তু তাহার অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিয়াছিলাম যে আঘাত অতি সামান্য, দুই-এক বিন্দু রক্ত তাহার পৃষ্ঠে দেখিয়াছিলাম। 

মঙ্গলার কথায় দারোগাবাবু সন্তুষ্ট হইলেন। ভবানীপ্রসাদ যে সতীশচন্দ্রকে হত্যা করেন নাই তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন। এদিকে গৌরীশঙ্করের কথাতেও তিনি অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি বিষম ফাঁপরে পড়িলেন। দুইজনকে সন্দেহ করিয়া ধৃত করা হইলেও তাহাদের মধ্যে প্রকৃত দোষীকে দেখিতে পাইলেন না, তিনি ভাবিয়াছিলেন ভবানীপ্রসাদ নিশ্চয়ই হত্যাকারী। তাঁহার অনুমান সত্য বটে কিন্তু তিনি সতীশচন্দ্রের হত্যাকারী নহেন। 

উভয় বন্দীকে নিরপরাধী জানিয়াও দারোগাবাবু কাহাকেও মুক্তি প্রদান করিতে পারিলেন না। তিনি কেবল মঙ্গলাকে ছাড়িয়া দিলেন। সে যখন শুনিতে পাইল তাহার মনিবকে কে হত্যা করিয়াছে এবং গৌরীশঙ্করকে সন্দেহ করিয়া বন্দী করা হইয়াছে, তখন সে কাঁদিয়া অস্থির হইল। তাহার প্রধান দুঃখ গৌরীশঙ্করের জন্য। সে জানিত যখন জমীদারবাবু মারা পড়িয়াছেন তখন তাঁহার জন্য শোক করিলে কোন ফল হইবে না। তিনি আর ফিরিয়া আসিবেন না। নিরপরাধী গৌরীশঙ্কর ধৃত হইয়া কারাগারে নীত হইয়াছেন শুনিয়া সে বড়ই অস্থির হইল এবং তাঁহার মুক্তির জন্য দারোগাবাবুকে বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিল। মঙ্গলার কথা শুনিয়া এবং গৌরীশঙ্করের জন্য তাহাকে কাঁদিতে দেখিয়া দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “তুমি গৌরীশঙ্করকে নির্দোষ বলিতেছ কেন? তিনি যখন জমীদারবাবুরে ঘর হইতে রক্তমাখা ছোরা লইয়া বাহির হইতেছিলেন তখন তিনি যে তাঁহার জেঠামহাশয়কে খুন করেন নাই কেমন করিয়া বলিব। বিশেষতঃ তাঁহার সহিত জমীদারবাবুর সম্প্রতি বিবাদ হইয়াছিল এবং জমীদারবাবুও তাঁহাকে বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিয়াছিলেন।” 

মঙ্গলা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। পরে বলিল “সে অনেক কথা। গৌরীবাবু অতি সজ্জন, তাঁহার বিরুদ্ধে কোন লোক একটি কথাও বলিতে পারে না। কিন্তু আমাদের বাড়ীতে এক রাক্ষসী আসিয়া বাস করিতেছে। আমরা ভাবিয়াছিলাম বুঝি সত্য সত্যই সে গিন্নিমার ভগিনী এবং সেই ভাবিয়াই তাহাকে এতকাল সম্মান করিতাম। কিন্তু এখন সকল কথা জানিতে পারিয়াছি। সে সামান্যা রমণী নহে জেলের একজন পলাতক আসামী।” 

দারোগাবাবু মঙ্গলার কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। তিনি শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সে রমণী এখন কোথায়? সে কি এখনও জমীদার বাড়ীতে আছে? যদি তাহাই হয় তাহা হইলে আমরা যে এতক্ষণ মিথ্যা কাৰ্য্যে ঘুরিতেছিলাম তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।” 

দাসী উত্তর করিল “আজ্ঞে হাঁ, আছে বৈ কি। কিন্তু তাহাই বা কেমন করিয়া বলি? কাল রাত্রি দ্বিপ্রহরের পূর্ব্বেই আমি সেখান হইতে বাহির হইয়াছিলাম। আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই ইহারই মধ্যে বাবু আমাদের খুন হইবেন! হয়ত সে মাগী এতক্ষণ কোথায় সরিয়া পড়িয়াছে।” 

দাসীর কথায় দারোগাবাবু বলিলেন “তবে তোমারই সহিত জমীদার বাড়ীতে যাই চল।” 

এই বলিয়া তিনি সত্বর থানা হইতে বাহির হইলেন, এবং সত্ত্বর জমীদার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন বেলা প্রায় তিনটা। মঙ্গলা একেবারে উপরে গিয়া রাধারাণীর খোঁজ লইল। দেখিল তাহার অনুমান মিথ্যা, সে তখনও সেখানে রহিয়াছে এবং জমীদারবাবুর জন্য ভয়ানক ক্রন্দন করিতেছে। 

এই সংবাদ লইয়া দাসী তখনই দারোগাবাবুর নিকট গমন করিল এবং তাঁহাকে সকল কথা নিবেদন করিল। দারোগাবাবু তাঁহাকে দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিলেন এবং তাঁহাকে ডাকিয়া আনিতে মঙ্গলাকে আদেশ করিলেন। 

কিছুক্ষণ পরে বস্ত্রে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া এক অবগুণ্ঠন দিয়া রাধারাণী দারোগাবাবুর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি এ বাড়ীতে কতদিন বাস করিতেছেন?” 

অতি বিনীত ও সলজ্জ ভাবে রাধারাণী উত্তর করিল “আজ্ঞে প্রায় আট বৎসর।” 

দারো। আপনার সহিত জমীদারবাবুর সম্বন্ধ কি? 

রাধা। তিনি আমার ভগ্নিপতি। 

দারো। কিরূপ ভগ্নিপতি?—জমীদারবাবুর স্ত্রী কি আপনার সহোদরা? 

রাধা। না–জ্ঞাতি ভগিনী। 

দারো। আপনার বাড়ী কোথায়? 

রাধারাণী সহসা কোন উত্তর করিতে পারিল না। কিছুক্ষণ পরে বলিল “আমার শ্বশুরবাড়ী কলিকাতায়, কিন্তু তাঁহাদের কেহই নাই, বংশ লোপ হইয়াছে।” 

দারো। আপনার কাহারও উপর সন্দেহ হয়? 

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া রাধারাণী উত্তর করিল “আমার সন্দেহ সেই ভবানীবাবুর উপরে, তিনি যদি কর্তাকে খুন না করিবেন, তাহা হইলে তিনি জানালা দিয়া পলায়ন করিলেন কেন?” 

দারোগাবাবু কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিলেন না। পরে কি চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “ভবানীপ্রসাদের সহিত আপনার কত দিনের আলাপ?” 

দারোগাবাবুর শেষ কথা শুনিয়া রাধারাণী স্তম্ভিতা হইলেন, তিনি সহসা কোন উত্তর করিতে পারিলেন না দেখিয়া দারোগাবাবু পুনরায় বলিলেন “ভবানীপ্রসাদ ধরা পড়িয়াছে। আপনার সহিত তাহার বহুদিনের আলাপ ছিল, সে যে জেলের পলাতক আসামী, সেই সমস্ত কথাই সে ব্যক্ত করিয়াছে, আপনি কি সে সকল কথা অস্বীকার করিতে চান?” ভবানী ধরা পড়িয়াছে শুনিয়া রাধারাণী কোন উত্তর করিলেন না। তখন দারোগাবাবু অতি কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “তবে আপনিই জমীদারবাবুকে খুন করিয়াছেন?” 

রাধারাণী একেবারে দমিয়া গেলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া অতি বিনীত ভাবে বলিয়া উঠিলেন “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষী। সন্দেহ করিয়া আমায় শাস্তি দিতে চান স্বচ্ছন্দে দিন, কিন্তু আমি নিদোষী।” 

যেমন করিয়া রাধারাণী এই কথাগুলি বলিলেন দারোগাবাবু তাহাতে কোনরূপে অবিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তিনি ভাবিলেন যেরূপ শোনা যাইতেছে তাহাতে জমীদারবাবু জীবিত থাকিলেই রাধারাণীর লাভ। তাঁহাকে হত্যা করিলে রাধারাণীর কোন স্বার্থ সিদ্ধ হইবে না, বরং জমীদার বাড়ী হইতে একেবারে দূরীভূত হইবার সম্ভাবনা। 

এই মনে করিয়া দারোগাবাবু জমীদার বাড়ীর একটি নিভৃত স্থানে বসিয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। 

ষোড়শ পরিচ্ছেদ 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর তিনি ভাবিলেন জমীদারবাবুর শত্রু অতি বিরল; নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং বাহিরের কোন লোক যে তাঁহাকে খুন করিবার জন্য জমীদার বাড়ীতে প্রবেশ করিবে তাহা অসম্ভব। নিশ্চয়ই বাড়ীর কোন লোকেই তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে। 

বাড়ীতে যে কয়েকজন পুরুষ ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে গৌরীশঙ্কর ও ভবানীপ্রসাদ যে এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন না তাহা দারোগাবাবু স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়া ছিলেন। হরশঙ্কর জমীদারবাবুর প্রিয় পাত্র তিনি অধিকাংশ বিষয়ের উত্তরাধিকারী সুতরাং তিনি যে এ কার্য্য করিবেন তাহাও দারোগাবাবুর বিশ্বাস হইল না। কিন্তু তিনি শুনিয়াছিলেন হরশঙ্কর অত্যন্ত অমিতব্যয়ী। এই বয়সেই তিনি সকল প্রকার নেশা করিতে শিখিয়াছেন এবং ভয়ানক বেশ্যাসক্ত হইয়াছেন, তাঁহারই অর্থের অভাব কিন্তু তিনি সেদিন বাটীতে ছিলেন না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে অন্য গ্রামে গিয়াছিলেন। এইরূপ চিন্তা করিয়া তিনি পুনরায় মঙ্গলাকে ডাকিলেন। সে নিকটে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলেন “হরশঙ্করবাবু সেদিন কোথায় গিয়াছিলেন?” 

মঙ্গলা কি ভাবিয়া বলিল “চারুশীলার শ্বশুরবাড়ী।” 

দারো। চারুশীলা কে? 

মঙ্গ। জমীদারবাবুর কন্যা। 

দারো। তাহার শ্বশুরবাড়ী কোথায়? 

মঙ্গ। শান্তিপুর গ্রামে। 

দারো। সে ত নিকটেই—চারু এখন কোথায়? সে কি এ সংবাদ পাইয়াছে? 

মঙ্গ। নিশ্চয়ই মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া সে কালই এখানে আসিয়াছে। 

দারো। তাহার মুখে শুনিয়াছ কি, হরশঙ্করবাবু সেখানে গিয়াছিলেন কি না? 

মঙ্গলা। আজ্ঞে না এত গোলযোগে সে কথা মনে ছিল না। আমি এখনই যাইতেছি। 

এই বলিয়া মঙ্গলা যাইবার উদ্যোগ করিতেছে এমন সময় দারোগাবাবু বলিলেন “একবার হরশঙ্করবাবুকে আমার নিকট পাঠাইয়া দাও।” 

মঙ্গলা চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই হরশঙ্কর তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হরশঙ্করকে দেখিয়া দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কাল কোথায় গিয়াছিলেন?” 

হরশঙ্কর কি চিন্তা করিলেন। পরে উত্তর করিলেন “আমার ভগ্নীর শ্বশুরবাড়ী। 

তাঁহার কথা শেষ হইতে না হইতে মঙ্গলা ফিরিয়া আসিল। সে বলিল “না ছোটবাবু আপনি ত সেখানে যান নাই। আমি এইমাত্র দিদিমণির মুখে শুনিয়া আসিলাম।” 

তখন দারোগাবাবু অতি গম্ভীর ভাবে বলিলেন “হরশঙ্করবাবু আপনিই জমীদারবাবুকে খুন করিয়াছেন। যদি স্বীকার করেন ভালই নতুবা আপনার অদৃষ্টে অনেক দুঃখ আছে। আপনি সম্প্রতি যেরূপ অমিতব্যয়ী হইয়াছেন তাহাতে আপনার যথেষ্ট দেনা হইয়াছে। আমি শুনিয়াছি আপনার পাওনাদারেরা সকলেই নালিশ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে। আপনি আর কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া শেষে আপনার জেঠামহাশয়কেই হত্যা করিয়াছেন। তাঁহার মৃত্যুতে আপনিই অধিকাংশ বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবেন আশা করিয়া এই ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। আপনার জ্যেষ্ঠ সম্পূর্ণ নিদোষ কিন্তু অদৃষ্ট চক্রে তাঁহাকেই সাধারণ চক্ষে দোষী হইতে হইয়াছে। 

দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া হরশঙ্কর কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি সকল কথাই স্বীকার করিলেন। বলিলেন “আপনার অনুমান সত্য। আমিই সন্ধ্যার পর গোপনে তাঁহার শয়ন প্রকোষ্ঠের এক নিভৃতস্থানে লুকাইয়া ছিলাম। পরে সুযোগ বুঝিয়া যখন দেখিলাম তিনি গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইলেন তখন ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বাহির হইলাম। বাগানের দিকে চাহিয়া দেখি কে যেন দৌড়িয়া বাড়ীর ভিতর আসিতেছেন। দৌড়িবার সময় সহসা পড়িয়া গেলেন আমি আবার লুক্কায়িত হইলাম, তাহার পর তাঁহার উঠিয়া যাইবার সময় যখন দেখিলাম তিনি আমারই বন্ধু ভবানীপ্রসাদ তখন আর কোন কথা না বলিয়া যেস্থানে তিনি পড়িয়া গিয়াছিলেন তথায় গমন করিলাম। দেখিলাম একখানি ছোরা পড়িয়া রহিয়াছে। ছোরাখানি তুলিয়া লইলাম এবং পুনরায় গৃহ মধ্যে আসিয়া অগ্রে আলোক জ্বালিলাম। তখন জেঠামহাশয় গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত ছিলেন। আমার বিশেষ সুবিধা হইল। তাহার পর—আর কি বলিব যাহার অন্নে এতকাল প্রতিপালিত হইয়াছে, যিনি আমাকে পুত্রের অধিক ভাল বাসিতেন তাঁহারই পৃষ্ঠে সেই ছোরাখানি আমূল বিদ্ধ করিয়া তখনই তুলিয়া লইলাম এবং ছোরাটি গৃহ মধ্যে নিক্ষেপ করতঃ পুনরায় বাড়ী হইতে পলায়ন করিলাম।” 

দারোগাবাবু তাঁহার সকল কথা লিখিয়া তাঁহাকে বন্দী করিলেন এবং তখনই থানায় লইয়া গেলেন। গৌরীশঙ্কর মুক্তি লাভ করিলেন। ভবানীপ্রসাদও সে যাত্রা অব্যাহতি লাভ করিল। দারোগাবাবু মঙ্গলার সহিত নদীতীরে সেই বৃদ্ধার কুটীরে গিয়া দেখিলেন রাজবালা সম্পূর্ণ সুস্থা হইয়াছে। 

ভবানীপ্রসাদ এই মকদ্দমায় মুক্তি লাভ করিয়া রাজবালার সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা করিল এবং তাহাকে জীবিতা দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইল। 

ভবানী প্রসাদ ও রাধারাণী ওরফে প্রভাবতী পূর্ব্ব অপরাধে গ্রেপ্তার হইল। উভয়েই পূর্ব্ব অপরাধে কারারুদ্ধ হইল। হরশঙ্কর বিচারালয়ে গিয়াও সকল কথা স্বীকার করিলেন। বিচারে তাঁহার ফাঁসী সাব্যস্ত হইল, গৌরীশঙ্করই জমীদারের সমস্ত বিষয়ের অধিকারী হইলেন। তিনি মহাসমারোহে সতীশচন্দ্রের শেষ কার্য্য সকল সমাপন করিয়া সেই জমীদারীর ভার গ্রহণ করিলেন। অতি অল্প দিবসের মধ্যেই তাঁহার সুনাম চারিদিকে রাষ্ট্র হইল। 

সমাপ্ত 

[ ভাদ্র, ১৩১৮ (?) ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *