গণেশ

গণেশ

কতদিন হল নিরুদ্দেশ?

গত হাটবার থে।

মানে কত দিন?

ধরুন চাইর দিন।

বয়স?

বন্যার সালে জন্ম।

গোঁপ উঠেছে?

এই এট্টু রেখা মতন।

আচ্ছা। চোদ্দ। ঝগড়া-ঝামেলা কিছু হয়েছিল?

না আজ্ঞা।

টাকাপয়সা চুরিটুরি…

কীই-বা আছে আমার যে নেবে?

আইডেনটিফিকেশন মার্ক আছে কিছু?

সিটা কী স্যার?

এই ধরো কোনও আঁচিল, জডুল কাটা দাগটাগ…

পাশ থেকে কনস্টেবলটি বলল, চিন্ন, চিন্ন, ঝা দেকি তোমার ছেলেরে চিনা যাবে।

বিজয় হাজরা তক্ষুনি বলল, আছে স্যার, আছে। ছ্যামড়ার বাঁ কানটা বড়, এই অ্যাতো পর্যন্ত, কুলোর মতন পেরায়।

নতুন আসা মেজবাবু অবাক হয়। বলে কুলোর মতো? অসুখ-বিসুখ নাকি?

কনস্টেবলটি মানেওলা হাসি মেরে বলল, আছে স্যার, এ অঞ্চলে ব্যাপার আছে। পরে জানবেন।

নতুন আসা মেজবাবু লিখলেন: ভেরি লার্জ লেফট ইয়ার।

থানায় ডায়েরি করিয়ে বিজয় হাজরা ফিরছিল। তখনই দেখল পিচরাস্তার বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিল্টার ফুঁকছে গোপীবল্লভ। চুলে টেরি, গায়ে টেরিকটন, বগলে চামড়ার ব্যাগ, আর হাতে জামাকাপড়ের পুঁটুলি। গোপীবল্লভকে আগে নাম ধরেই ডাকত বিজয় হাজরা। বয়সে ছোট। ধোপাদের ঘরের ছেলে। টেন-ক্লাস অব্দি পড়েছিল। এখন এই ড্রেসমারা অবস্থায় কী ডাকবে ভাবছিল, তার আগেই গোপীবল্লভই ডাকল, ও বিজয়…। ডাকের মধ্যেও বেশ মশলা এসেছে। বিজয় হাজরা কাছে গেল। গোপীবল্লভ বলল, কী হল, তোমার ভায়রাভাইয়ের কেসটা কী করলে? বিজয় বলল, ওসব কেস-কথা পরে। আমার ধনঞ্জয়ডারে কী করলা তুমি, কানটা ইয়া বড় হয়ি গেল, ইস্কুলের ছেলেপিলে আর পাড়ার চেটো-চ্যাংড়ারা সব ওর লম্বা কানটা ধরি টানাটানি এমন অস্থির করি তুলিল যে ছ্যামড়া খ্যাপাপনা হয়ি নিঘঘিননেতি ঘর ছাড়ি পালাল। এখন যে কতি গেচে সে…। গোপীবল্লভ আঙুলের সিগারেটসমেত হাতের পাঞ্জাটা ভোটের হাতচিহ্নের মতো বিজয় হাজরার মুখের সামনে ধরল। মানে থামো। বিজয় থামলে গোপীবল্লভ বলল, বুঝলে বিজয়, ঝারা খ্যাপাচ্ছে, ওইসব চ্যাংড়াচোটাগুলুন, ওদের মধ্যি দেকো, অনেকিরি কান বড় হবে, নাক বড় হবে, হাত বড় হবে, কিছু ব্যস্ত হবার নেই, কাজ এগুচ্ছে।

বিজয় হাজরা বলে, সি কতা নয়। বলতিচি, তুমি ত পাঁচ জায়গায় ঘাই মারো, আমার ধনার সন্ধানটা কোরো। টিভিতে ওরে দ্যাকানো যায় না?

সে দ্যাখাবে কী করি? ওর কি ছবি আচে?

হ্যা, আচে বৈকী। মেলার সময় তোলা হয়েছিল, পিছনে তাজমহলের সিন…

সে তো পুরনো। কান বড় হবার পর ছবি আছে?

তা অবিশ্যি নেই।

তবে?

তাইলে ধনারে খুঁজি পাবার কী উপায়?

সে আমি দেকচিখনে। তোমার কিছু চিন্তা করার নেই। চিন্তা করবে চিন্তামণি। তোমার ভায়রার কাছে যাবার ছেল, একটা কেস আছে বলছিলে না?

সিটা মোর দ্বারা হবেনি। আমি নে যাবনি। মাথা নাড়তে থাকে বিজয়।

ঠিক আছে। আমি একাই যাব। এড্রেসটা, মানে ঠিকানাটা ত বলবে।

ওই ত, আনন্দপুর গেরাম।

ভায়রার নাম?

মহাদেব হাজরা।

বাস এসে গেল। সিগারেটের হলুদ ফিল্টার রাস্তার ধারের সাদা ধুতরোফুলের দিকে ছুড়ে দিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরল গোপীবল্লভ।

একটু টাউনে যাব। জামাকাপড়গুনু এট্টু লন্ড্রিতি দিতে হবে।

ধোপাদের ছেলে গোপী এখন জামাকাপড় কাচাতে ধোপাবাড়ি চলল।

দিন কতক পরে গোপীবল্লভ হাজির হল মহাদেব হাজরার ঘরে। গোপীবল্লভের পরনে ফাইন ধুতি। কোঁচাটা ফুল বানিয়ে পকেটে রাখা। ঠোঁট লাল। বগলে চামড়ার ব্যাগ। বলল, বিজয় হাজরা পাঠায়ি দেছে।

কী বিত্তান্ত?

কথা আছে। দরকারি কথাবার্তা আছে কিছু।

মহাদেব হাজরা খেজুরপাতার চাটাই পেতে দিল। গোপীবল্লভ চাটাইয়ে ফুঁ দিয়ে বসল। সটাস করে ব্যাগের চেন খুলল। কিছু কাগজপত্তর বার করল।

মহাদেব হাজরা বুঝে নিল কোনও দুনম্বরি ব্যাংক পার্টি। এখন নানা রকমের ব্যাংক গজিয়েছে। মা লক্ষ্মী সঞ্চয়, ম্যাডোনা সেভিং এরকম সব। টাকা খিঁচে হাওয়া হয়। মহাদেব তাড়াতাড়ি বলে, টাকাপয়সা মোটে নেই, ওসব দিতি পারবনি।

গোপীপল্লভ বলে, টাকাপয়সা তোমায় দিতি হবে না, বরং উলটি তুমিই পাবা। ম্যালা টাকা। আগে ব্যাপারটা মন দে শোনো।

একটা ফিল্টার সিগারেট ধরায় গোপীবল্লভ, আর-একটা মহাদেবের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কমলা রঙের ফিল্টারটা মহাদেবের দিকে চেয়ে আছে। নেব না নেব না করেও মহাদেব ওটা নেয়। গোপীবল্লভ সিগারেটের সামনে গ্যাসলাইটার খিচ করে। লাইটার ফণা তুলে দেয়।

শোনো বলি। আমি একটা কোম্পানির কাছ থেকি আসছি। কামিং ফ্রম ভেরি গুড কোম্পানি। ইন্টারন্যাশনাল লেবেলিং কোম্পানি। ইন্টারন্যাশনাল জুড়ে কাজ কারবার। এই কোম্পানি মানুষের সেবার জন্যি কাজ করতিছে। নানারকমের রিসার্চ চালাচ্ছে। বুঝলে? মহাদেব মাথা নাড়িয়ে হ-হ করে। কিন্তু বুঝতে পারে না, এতবড় কোম্পানির মহাদেবের কাছে কী দরকার। সিগারেট টানতে ভুলে যায় মহাদেব।

গোপীবল্লভ বলে, আমি হলুম গে সেই কোম্পানির লোক। ক্যানভাসার। এজেন্ট। বোঝলা না?

মহাদেব এবার অন্যরকমের মাথা নাড়ায়। মানে বোঝেনি।

গোপীবল্লভ বলে, তোমার একটা ছেলে আছে না! একটু কেমন খ্যাপা মতো।

মহাদেব বলে, খ্যাপা নয়, একটু বোকা মতন। আসলে খুব সরল পোকিতির।।

কোম্পানিরে ছেলেটা দ্যাও। ছ’ মাস বাদ ফিরত পাবা। সঙ্গে ট্যাকা। কাগজপত্র খোলে গোপীবল্লভ।

আমি যে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারতিছি না।

সব জলের মতো বুঝোয়ি দিচ্চি, শোনো। আমাদের কোম্পানির কিছু গেঁড়াগেঁড়ি দরকার। ছেলেপিলে। খাবে ভাল, থাকবে ভাল। এবার টার্ম কন্ডিশনগুলি শুনি নাও। আমাদের কোম্পানিই হল যে সাইন্টিফিক কোম্পানি। রিসার্চ চলতিছে, বোঝলা না। যে ছেলেদের ওখানে নেয়া হবে, তার গার্জিয়ান ভরতি করি দিলেই প্রথমে নগদ পাঁচশো টাকা পাবে। ফাইব হানড্রেড। এবার ওই ছেলেদের অঙ্গে ইনজিকশন ফোঁড়া হবে। রিসার্চের ইনজিকশন। এক একটা ছেলের একেক অঙ্গে। কার কোন অঙ্গে ইনজিকশন ফোঁড়া হবে তা কোম্পানির সাইনটিস্টরা ঠিক করবেন। ইনজিকশন ফুঁড়লি কারওর কারওর অঙ্গ বড়পানা হয়ি যাতি পারে, বোঝলা না, যদি বড়পানা হয়ি যায়, তবে ছ’ মাস পরে ছেলেসমেত পাবা পাঁচ হাজার। যদি কিছুনা হয়, দু’মাস পর্যন্ত ওরা দেখবে কাজ হচ্ছে কি না। যদি কাজ না হয়, দু’মাস পরে ছেলে ফিরত সঙ্গে এক হাজার টাকা।

মহাদেব বলে, ডেলি ডেলি ইনজিকশন ফুঁড়বে? ব্যথা লাগবেনি? গোপীবল্লভ সিগারেটে টুসকি মেরে ছাই ঝেড়ে বলে স্পেশাল ইনজিকশন যে। পিমড়ের কামড়ের চেয়িও কম ব্যথা। তোমার ভায়রার গাঁয়ের অনেক ছেলেপিলে আমাদের এই ইস্কিমে গিয়ে আবার ফিরে আসিচে। ওদের জিজ্ঞাসা করলি ডিটেল জানতি পারবা। সব্বাই গায়ের ওজন বাড়ায়ে ফিরি আসিচে। ওদের কাছে ইনকোয়ারি করি দেখবে ডানলোপিলো, মানে দুধির ফেনার মতো নরোম বিছানায় শুয়িচে, ভাল ভাল খায়িচে…

মহাদেব বলল, ওই যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কথা বললে, অঙ্গ বড় হলি তো খুঁতো হয়ি যাবানে, তার কী হবে?

তার আর হবেটা কী? তুমি তো আর মেয়েসন্তান পাঠাচ্ছ না যে একটা আঙুল ছোটবড় হয়ি গেলে খুঁতো হয়ি যাবানে, বে দিতি পারবা না। পাঠাচ্ছ তো ছেলি। সোনার আংটি আবার বাঁকা হয় নাকি। তা তোমার ভায়রার ছেলেরও ত কানটা বড় হয়ি গেছে। তয়? কী হল? বরং হিল্লে হয়ি গেল এই বেকারির যুগে।

কী হিল্লে হল?

অ! শোননি বুঝি! তোমার ভায়রার ত আমার কাছে কেঁদি-পেদি একসা। বলে ছেলে হারায়ি গেছে। আমি বললাম, অত নার্ভাস হবার নাই, আমি দেখছি। ক’দিন আগে স্বরূপনগরে এয়িচিল সার্কাস, ঝা ভেবিচি, ওখেনে জোকারের কাজে ওরে নিয়ে নেছে। তা বোঝে। এই মাত্র চোদ্দ বছর বয়সি চাকরি জুটোয়ে নিল। কানটা বড় হল বলেই না পেল। তা এখানে বলে রাখি। কোনও গ্রান্টি নেই। সবারই যে এমনধারা অঙ্গ বেড়ে যাবে তার কোনও গ্রান্টি দিচ্ছে না কোম্পানি। আসলে ইটাই হল কোম্পানির রিসার্চ। একটা ইনজিকশন দিলে কারওর কারওর অঙ্গ বড় হয়ে যাচ্ছে আবার ওই একই ইনজিকশনে কারুর কিছুই হচ্ছে না। কেন এমনধারা হয় এই হল রিসার্চ। ওসব বড় বড় ব্যাপার। বোঝবা না। এই যেমন ধরো চিংড়ি খেয়ে কারওর গায়ে চাকা চাকা ওঠে, কারুর-বা কিছুই হচ্ছে না। তা তোমার ছেলিটারে দ্যাও।

মহাদেব মাথা চুলকোয়। কিছু বলে না। একবার বলল, ধরো যদি এদিক-সিদিক কিছু হয়ি যায়?

ইদিক-সিদিক মানে?

এই ভালমন্দ কিছু?

ও, সে কথাটা বলা হয়নি। কোম্পানি সব ব্যবস্থা রেখিচে। কিচ্ছু ত্রুটি করেনি। যদি রিসার্চ চলাকালীন একস্‌পার করে, মানে মরিটরি যায়, তবে লগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেচ্চে কোম্পানি। বাড়ি ফিরি আসার পর ওরকম কিছু হলি অবশ্য কোম্পানি দায়ী হচ্ছে না। যদি…

থাক। থাক। ওকথা বলতি হবে না আর।।

তবে কী করবা?

ভেবে দেখি। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করি।

পরামর্শ তুমি কী করবে? সে আমি কয়ে দিচ্ছি। ডাকো তোমার পরিবার।

সে তো এখন ঘরে নাই। মুড়ি ভাজতি গেছে।

আচ্ছা। তবে ছেলিডারে নে এসো, একটু দেকি।

সে বোধহয় ঘুমুচ্ছে। ও একটু ঘুময় বেশি।

বয়স কত হবানে একচুয়াল?

ধরো দশ চলচে।

নাম কী রেখিচো?

রেখিচিলাম ত গণেশ। কিন্তু ছেলেটা এট্টু বোকাসোকা ত, কথা পষ্ট বলে না, মুখ দে লাল গড়ায়, ওরে সবায় ডাকতি লাগল ক্যাবলা। এখন বলতি গেলে ওটাই নাম।

মিলিয়ি-দুলুয়ি নাম রাখিছিলে ত বেশ, মহাদেবের পুত্র গণেশ। তবু বুধবার আসি? মঙ্গলে ঊষা বুধে পা যেথা ইচ্ছা সেথা যা।

না গো, আর ক’দিন যাক। পরের মাসে এসো।

মহাদেবের ভায়রাভাই বিজয় হাজরার ঘর এমন কিছু বেশি দুর না। আট-দশ কিলোমিটার হবে। কিন্তু কথায় বলে রাজায় রাজায় দেখা হয়, ভায়রা ভায়রা দেখা হয় না। বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই ওদের। বিজয়ের ছেলে ধনঞ্জয়ের কান বড় হবার কথা শুনেছে কিন্তু একবারও চোখের দেখা দেখতে যায়নি। এবার গেল। পরামর্শ আছে। বউকে নিল না। মহাদেব তো মাগের ভেড়ো নয়, যে সব বউয়ের কথামতো চলবে।

মহাদেবকে দেখে বিজয় হাজরারা বেজায় খুশি। স্বামীস্তিরিতে যত্নআত্তি করল। মহাদেবকে মানি অর্ডারের কাগজ দেখাল। ধনঞ্জয় ডায়মন্ডহারবার থেকে পাঠিয়েছে পঞ্চাশ টাকা। তারপর খবর কাগজের ছবি দেখাল। খামে করে পাঠিয়েছে ছেলে। ছেলের ছবি উঠেছে। মহাদেব পড়তে পারল ‘ডায়মন্ডহারবার টাইমস’। ধনঞ্জয়ের মস্ত কানের উপর বসে আছে একটা টিয়া পাখি। কানের মধ্যে অনেক রিং সার সার আটকানো। একটা রিঙের সঙ্গে দড়ি বাঁধা, একটা বাঁদর দড়ি টানছে। মানে দোল খাওয়াচ্ছে। ধনঞ্জয় হাসছে। তলায় লেখা জুপিটার সার্কাসের একটি দৃশ্য।

ভালই ত আছে ধনঞ্জয়।

মহাদেব বলল, ধনার সঙ্গে ত দেখা হল না। অন্য দু-একটা ছেলেপিলে দেখাতি পারো, যারা ওই ইস্কিমে গেছে। একটু তত্ত্বতালাশ নিতাম।

বিজয় তখন মহাদেবকে নিয়ে চলল কাছেই একটা ঘরে। ঘরে নতুন টিন চকচকাচ্ছে। বিজয় বলল, যদু ঘরামির ছেলের আঙুলের টাকায় নতুন টিন। মেয়ের বিয়েও দেছে। বিয়েতে সাইকেল টেপরেকট দেছে। যদু ঘরামির গাজনের সন্নেসীর মতো খাংরাখাংরা চুল, মুখে দুশ্চিন্তা লেপে থুয়েছে।

যদু বলল, ভালই হল তুমি এয়িচ। তোমার কাছেই যাব মন করছিলাম। আমার ছেলেডারেও সার্কেসে ঢুইকে দাও। যদুর ছেলে এল। বছর বারোর হবে। ডান হাতের আঙুলগুলো হাতখানেক লম্বা হয়ে পায়ের গোড়ালির কাছটা পর্যন্ত নেমেছে। একবার পিঠ চুলকোল ছেলেটা। আঙুলগুলো ঢ্যামনা সাপের বাচ্চার মতো কিলবিল করে উঠল।

যদু বলল, ছেলেডারে নিয়ি বড় ঝামেলায় পড়িচি। পুলিশ খুব টর্চার মার করিল। মুখটা এখনও কেমন ফুলি রয়েছে।

টর্চার মারিল ক্যানো? কী দোষ?

আর বলো ক্যানো। গোপীর কোম্পানি ঝ্যাকন ছেলে ফিরত করিল তখন ত আঙুলগুলো সব বড় বড়। যুধিষ্ঠির তখন পিছু লাগল।

যুধিষ্ঠির কেডা?

যুধিষ্ঠিরির নাম শোননি? যুধো। চোরটা। ও বলিল, তোরে আমার বড় দরকার। তোর আঙুলগুলো এমন কায়দায় হয়িচে যে কোনও যন্তরের সাধ্য নেই এর ধারে যায়। যুধো ওরে ট্রেনিং দেল। ঘরের জানালার ভিতর দি হাত ঢুকোয়ে আঙুলের কায়দায় জিনিসপত্তোর গ্যাঁড়াতি শিখাল। এর মধ্যে কবে তালবন্দির এক মুরুব্বি মাস্টারের বউয়ের গলার হার আঙুলির কায়দায় চুরি করতি যেয়ে বিপত্তি ঘটাল। মাস্টার সেদিন বাড়ি ছিল নি। পার্টি মিটিং করতি যেয়িছিল বারাসত। মাস্টারের বউ গলায় সুড়সুড়ি পেয়ি সজাগ হল, আর দেখল মুখির উপর হাত আর লম্বা লম্বা আঙুল কিলবিল করতিছে। সে ভাবল ভূত। তারপর অজ্ঞান। মাস্টার পরদিন পুলিশি খবর করল। পুলিশ ত মোর বাপধনটারে ধরি নিয়ি প্যাঁদাল। ছেলে সব স্বীকার যেছে। যুধোরে কিছু করলনি। সে দিব্বি ঘুরি বেড়াচ্ছে। এখন পুলিশ বলতেছে যদ্দিন আঙুল এরম কেঁচোর পানা লম্বা থাকবে, মাসে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে থানায় ট্যাক্সো দিতি হবে। আমিও যেছিলাম থানায়। বললাম, এত টাকা কোত্থে পাব। মেজোবাবু বললে, ক্যানো, এতগুলো টাকা পেলে যে, কোম্পানি দেল। বললাম, সে টাকায় মেয়ে বে দেছি। বড়বাবু বললে, তাহলি আঙুল কাটি ফ্যালো। তারপর খোজ করি এজেন্ট গোপীবল্লভরে ধল্লাম। সে বলে, কাটতি হয় হাসপাতালে কাটাও গে যাও। কোম্পানি বড় করি দিতি পারে। ছোট করার কুনো কনডিশন নাই।

যদু ঘরামি এবার বিজয় হাজরার কাছে প্রায় হাতজোড় করে। বলে, তোমার ছেলেডারে বলিকয়ি আমার ছেলেডারেও সার্কেসে ঢুইকে দ্যাও। ছেলেডার হিল্লে হয়ি যাক।

বিজয় বলল, ছেলের ত ঠিকানা জানতি পারিনি। আসবে নিশ্চয়। আমি বলবানে।

আর একটা বাড়িতে মহাদেবকে নিয়ে গেল বিজয়। মহাদেবকে বলল, এ বাড়ির ছেলেটার খারাপ জায়গায় ইনজিকশন দেছে। বিজয় ডাকতেই ছেলেটা এল। বিচ্ছিরি ব্যাপার। ওটা ল্যাজের মতো লাগছে। মহাদেব তো অচেনা লোক, দেখেই ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল। বিজয় বলল, থাক। লজ্জা পাচ্ছে। এরকম আরও দু-একটা ইস্কিমের ছেলেকে নিজের চোখে ইনিসপেকশন করে ঘরে ফিরল ওরা।

বিজয়কে জিজ্ঞাসা করে মহাদেব—তুমি ভাই কী পরামর্শ দাও। ইস্কিমে পাঠাব? বিজয় বলল, আমি ভাই কী বলব। নিজির পাঁঠা….

মহাদেব সিদ্ধান্ত নিল যা টাকা পাওয়া যাবে তার তুলনায় ফ্যাচাং এমন কিছু না। আঙুল লম্বা হয়ে গেলে চোখে চোখে রাখলেই হবে যাতে যুধিষ্ঠিরদের পাল্লায় না পড়ে। আর তা ছাড়া তার ছেলে হল হাবাগোবা। যুধিষ্ঠিররা নেবেও না। আর অন্য কোনও অঙ্গ বড় হয়ে গেলে সার্কাসে না হোক মেলায় দেখিয়ে দু’পয়সা পাওয়া যাবে। সিঁদুর-টিদুর পরানো ছ-ঠ্যাংওলা গোরু দেখেছে মেলায়। পঞ্চাশ পয়সা টিকিট কেটে দেখছে সব। গোপীবল্লভকে শুধু বলবে খারাপ জায়গাটায় যেন ইনজিকশন না দেয়, এটুকু যেন দেখে। মহাদেব আরও সিদ্ধান্ত নিল যে বউকে কিছুই বলবে না। বললে, বউ কিছুতেই ছেলেকে ছাড়বে না। হাবাগোবা যাই হোক না কেন, বহু আদরের ধন এই ক্যাবলা। ক্যাবলা হবার পর আর ছেলেপুলে হয়নি। হাসপাতালেও দেখিয়েছিল। বলে দিয়েছে নাড়িতে জট লেগে রয়েছে। অপারেশন কেস। ম্যালা টাকার ধাক্কা। এই স্কিমে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে অপারেশন করিয়ে নাড়ির জট ছাড়িয়ে নেবে। গোপীবল্লভ নিতে এলে বউকে বলবে কলকাতার বড় হাসপাতালে চিকিচ্ছের জন্য যাচ্ছে। ছ’ মাস পর ভাল হয়ে ফিরে আসবে। আর গোপীবল্লভকে অনেক করে বুঝিয়ে বলবে—দেখো, খারাপ জায়গাটায় যেন ইনজিকশনটা…

সকাল থেকে মেঘ। বাতাস থম মেরে আছে। গাছের পাতা নড়ে না। বিবিধ ভারতী বাজে। মহাদেব ওর ছেলেকে আদর করছে সকাল থেকে। ওর মুখের লালা মহাদেবের সারা গায়ে লেপটেছে। বিবিধ ভারতী বাজে। ক্যাবলা হাতের আঙুলগুলোয় আঁকড়ে ধরে আছে ট্রানজিস্টার। কদিন আগে কিনে এনেছে মহাদেব। ছেলে চলে যাবে। ক’দিন বাজাক। বড় শখ ছিল ছেলের।

মহাদেব ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, কী রে, ওখানে গিয়ে ভাল থাকবি ত বাবা?

ঠাকব।

আমাদের জন্য খুব ভাববি?

ভাবব।

ইনজেকশন দিলে ব্যথা লাগলে কাঁদিস না।

কাদব না।

আমাদের জন্য কাঁদবি না ত!

কাদব না।

চোখের জল ফেলবি?

ফেলব।

আসলে হাবাগোবা ছেলেটি ঠিক মতো বুঝতেই পারছে না কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কী জন্য যাচ্ছে।

মহাদেবের বউ মুড়ির মোয়া বাঁধছে। গুড় মাখানো মুড়িতে নুন মাখানো জল পড়ছে। কাল থেকেই কাঁদছে ও। বিবিধ ভারতী বাজছে।

বাইরে ঘুঘু ডাকে। এমন ঘুঘু কি রোজই ডাকে? বাতাস থম। একটা পাতা খসে গেল। ডমডম ডিগাডিগা। মায়া মমতা কষ্ট লেগে লেগে মুড়ির মোয়াগুলো গোলাকার হয়ে ওঠে ক্রমশ। একটা নিয়ে ক্যাবলার হাতে দেয়। বলে, হাসপাতালে খিদে পেলেই চেয়ি-চিন্তি খাস বাপ আমার। ক্যাবলা বলে, না—চাইব না।

আসলে ঘরে বড্ড খাইখাই করে বলে বকুনি খায় ও। ও পেট ভরলেও ঠিক বোঝে না। বমি করে ফেলে। তখন মারও খায়। ‘আর চেয়ে চেয়ে খাবি’ বললেই বলে আর চাইব না।

ক্যাবলার মা ক্যাবলার সারা গায়ে হাত বুলতে থাকে। বলে, কিছু দুঃখু করিসনি বাপ আমার। ভাল হয়ি ফিরবি। ইস্কুলি ভরতি হবি। হাতের আঙুলগুলোর মধ্যে এমনি ধারা আরও অনেক কথা থাকে যা ক্যাবলার সারা শরীরে মিশে যায়।

ভগবান, আজ যেন গোপীবল্লভ না আসে।

গোপীবল্লভ আসে। বলে বস রেডি ত? মহাদেব ‘রোসো, আর দশ মিনিট’ শব্দ ক’টা উচ্চারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। ছেলেকে নতুন জামাপ্যান্ট পরানো হয়েছে। পলিথিনের ঠোঙায় নারকোল নাড়ু, মুড়ির মোয়া।

গোপীবল্লভ বলে, এসব কিছু দরকার নেই। কোম্পানি বাইরের ফুড অ্যালাউ করবে না। ওরাই যথেষ্ট ফুড দিয়ি থাকে। গণেশের মা বলে, তবু থাক। ভালবাসে।

ক্যাবলার সঙ্গে ক্যাবলার মাকে নিচ্ছে না মহাদেব। মহাদেব যাচ্ছে। ক্যাবলা ট্রানজিস্টারটা ছাড়ছে না। শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে। ক্যাবলার মা ক্যাবলার কড়ে আঙুল কামড়ে দেয়। মাথার আঘ্রাণ নেয়। আর একবার সর্বশরীর দিয়ে জড়িয়ে ধরে। রেডিয়োতে আই অ্যাম এ কমপ্ল্যান বয় বাজে।

কলকাতা শহরে একটা বিরাট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গোপীবল্লভ বলল, দ্যাখ, এই বাড়ি। ঘাড় উঁচু করে মহাদেব দেখল বাড়ি কী ভাবে আকাশ ছুঁয়েছে। গোপীবল্লভ বলল, এই বিল্ডিংটার চোদ্দ আর পনেরো তলায় হল আমাদের কোম্পানি। কী যে কাণ্ডকারখানা চলতেছে কোনও ধারণা করতি পারবা না। কত রিসার্চ, এক্সপিরিমেন্ট। এমন যে নিমফল-বীজ, তার পোঙায় ইনজিকশন মারি দেচ্ছে, সেই বীজ পুঁতলি যে নিমগাছ হবে তার পাতার হবে মিষ্টি সোয়াদ। এইসব চলতিছে। ছাইনস্‌ যে কোথায় গিয়ে ঠেকিছে তোমরা বোঝবা না। ওরা লিফট-এর ভিতর ঢুকল, দরজা বন্ধ হল নিজে নিজে। এই প্রথম ভয় পেল ক্যাবলা। কেঁদে উঠল। চোদ্দোতলায় একটা ফুল নকশাকাটা দরজা ঠেললেই ঠান্ডা। টেবিলের ওপাশে সুন্দরী মেয়েছেলে। মেয়েছেলের সামনে চেয়ার। গোপীবল্লভ বলল, তোমরা এখানে বোসো। নরমের ভিতরে ডুবে যায় মহাদেব। মহাদেবের কোলে গণেশ। অন্য একজন ছোটচুল সুন্দরী আসে। সামনে মেলে ধরে রঙিন কাগজ। সই করবেন, না টিপ?’ কাঁপা কাঁপা সই করে মহাদেব হাজরা। আর একবার চুমো খায় ওর ক্যাবলা গণেশকে। ওর লালা লাগে মুখে। মেয়েটি মহাদেবের হাতে পাঁচটি একশো টাকার নোট দিয়ে মুচকি হাসে। তারপর মহাদেবের কোল থেকে ছেলেটিকে নিয়ে যায়। অন্য একটা ফুল নকশাকাটা দরজা ঢেকে দেয় ওদের। গোপীবল্লভ মহাদেবের কানে কানে বলে, মন খারাপ কোরো না। তোমার কোনও লস নেই, উলটি লাভ। কীই-বা করতে তোমার হাবাগোবা ছেলেডারে নিয়ি? যা হোক ওই পাঁশশো থেকে আমারে গোটা পঞ্চাশ দ্যাও।

মহাদেব বাড়ি ফেরে। হাতের কবজিতে ধর্মতলা থেকে কেনা সত্তর টাকার ইলেকট্রনিক্স ঘড়ি।

এরপর আকাশে আরও ইনসাট উঠে যায়। ক্রয়োজেনিক রকেট ইঞ্জিনের নো হাউ জেনে যায় ভারতবর্ষ, কর্ডলেস টেলিফোনের উৎপাদন বাড়ে। ছয় ডিজিটের টেলিফোন নম্বর সাত ডিজিটের হয়। অনেক স্ত্রী ভ্রূন নষ্ট হয়, ধ্বংস হয়, গৃহবধূ পোড়ে, ক্যাবলা ফিরে আসে।

ওর নাকটা লম্বা হয়ে নাভির কাছটাতে এসে পড়েছে। একটু একটু নাড়াতেও পারে। শুঁড়ের মতোই লাগে। ওর কান দুটোও বড় বড় করে দেয়া হয়েছে। ওর শরীর নাকি দারুণ সেনসেটিভ। নাকের উপর কয়েকটা ইনজেকশন দেয়ার পরই নাকটা তাড়াতাড়ি বাড়তে শুরু করেছিল। এটা একটা রেয়ার কেস। নাককে নাকি সহজে বাড়ানো যায় না। এর আগে আফ্রিকায় মাত্র একটি কেস সম্ভব হয়েছে। নাকের পর কানেও ইনজেকশন অ্যাপ্লাই করা হয়। এজন্য কিছু বেশি টাকা পার্টিকে দিয়েছে কোম্পানি। ক্যাবলার থেকে অনেকবার রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করেছে কোম্পানি। কী আছে ওই রক্তে। কেন এত তাড়াতাড়ি সাড়া দিচ্ছে। ওই পরীক্ষার ফল পার্টি জানে না। ক্যাবলার মাথার ভিতর থেকে নিউরোন সেল নিয়ে পরীক্ষা করেছে কোম্পানি। ওই পরীক্ষার ফল পার্টি জানে না। ওকে নানা রকমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। কী ইনজেকশন, কী হরমোন কিংবা স্টেরয়েড বা অন্য কিছু পার্টি জানে না। শুধু পার্টির স্কিম ম্যাচুয়োর করে। পার্টি প্রজেক্ট থেকে ফিরে আসে লম্বা নাক আর দুটো বড় বড় কান নিয়ে।

গোপীবল্লভ বলে, গণেশ নামটা এত দিনে সার্থক হল। একেবারে রিয়েল গণেশ করে দিয়েছে কোম্পানি। গণেশের বাপ মহাদেব। মায়ের নামটা দুর্গা করি দিলিই একেবারে ষোলোকলা পূর্ণ হয়ি যায়। তোমাদের কাঁঠালগাছে সাইনবোর্ড মারি দেবা—কৈলাশ।

ছোটবেলার মহাদেবের বাবা মহাদেবকে সং সাজাত। মাথায় ঝুঁটি বেঁধে, ঝুঁটিতে পালক গুঁজে, মুখে নীল রং করে হাতে বাঁশি লাগিয়ে কেষ্ট ঠাকুর কিংবা গায়ে ছাই মাখিয়ে মাথায় জটা বেঁধে মহাদেব। মহাদেব হলে চোখ বড় বড় করতে হত আর কেষ্ট হলে চোখ ঢুলুঢুলু করতে হত। লোকের দুয়ারে গেলে পয়সা মিলত, চাল-ডাল সিধে মিলত। এখন মহাদেব ভাবে এই সত্যিকারের গণেশকে যদি সাইকেল রিকশার সিটে বসিয়ে হাটে নেয়া যায়, কেমন হয়।

গণেশের পেটটাও আগের চেয়ে একটু বড় হয়েছে। মহাদেব ভাবে কোম্পানিতে ভাল খাওয়া-দাওয়া পেয়ে এমনটা হয়েছে। গাঁয়ের লোকজন দেখতে আসে। বলে, এক্কেবারে জ্যান্ত গণেশ গো। একদিন সন্ধ্যাবেলা মহাদেব দ্যাখে মাদুরের উপর কিছু খুচরো পয়সা ছিটিয়ে আছে। গুনে দেখে টাকা খানিক হবে।

পাশের গাঁ থেকে জীবনের মা, ভামিনীবুড়ি লাঠি ঠকঠক করতে করতে আসে। এসে বিহ্বল তাকিয়ে থাকে। বলে, সত্যিকারের ভগমান দেখনুগো। আঁচলের গিঁট খুলে একটা আধুলি বের করে গণেশের পায়ের কাছে রাখে।

গণেশ বলে, জিলিপি খাব।

বুড়ি বলে, হ্যা-হ্যা, লিচ্চয়। লিচ্চয় আমি জিলিপি ভোগ দেব। বুড়ি লাঠি ঠকঠক করতে করতে বেরিয়ে যায়। গোটা চারেক জিলিপি নিয়ে আবার আসে। গণেশের পায়ের সামনে রাখে। নীল মাছি উড়ে আসে। গণেশের নাকের তলায় দুটি শাশ্বত ফুটো। ফুটোসমেত নাকের ডগাটা জিলিপির উপর নাড়ায়। শ্বাস ছাড়ে। মাছি উড়ে যায়। এবার শ্বাস নেয়, গন্ধ শোঁকে। গণেশ হাসে। একঘর লোক দেখে।

বুড়ি বলে, কিরপা করো বাবা গণেশ। আর পারতেছি না। জীবনের বউটা খাতি দেয় না। বড় জ্বালাতন করে। কেবল গাল মন্দ করে। উদ্ধার করো।

গণেশ মাথা নাড়ে আর জিলিপি খায়।

পরদিন ভোরবেলা কলমি শাক তুলতে গিয়েছিল জীবনের বউ। সাপে কাটল ওকে। তাই শুনেই ভামিনীবুড়ি মাথা চাপড়াতে লাগল। মনে মনে বলতে লাগল, হায়রে হায়। বাবা গণেশ তুমি এমন জাগ্রত বুঝতি পারিনি গো। আমি ভোলা বুড়ি, আমার কথাই শুনলে। জীবনের এখন কী হবে।

গাঁয়ের লোক জীবনের বউকে ভ্যান গাড়িতে শুইয়ে হাসপাতালের দিকে যায়। ভামিনীবুড়ি মাথা কুটে বলে, একবারটি মহাদেব হাজরার ঘরে নে চল ওরে, দোহাই বাপাদের।

আশেপাশে ওঝাবদ্যি নেই। যে ওঝাটি ছিল মরে গেছে। তার ছেলে বিডিও অফিসের পিওন। সে কিছু কিছু বশীকরণ ইত্যাদি তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্ম করে অবশ্য। কিন্তু তাকে তেমন বিশ্বাস নেই। হাসপাতালের দিকেই চলল ওরা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আট কিলোমিটার। অনেকটা সময় লাগবে। বুড়ির কথায় কেউ কান দেয় না। বুড়ি সাইকেলভ্যানের সামনে শুয়ে পড়ে। বলে, আমার মাথা খা। বউডারে বাঁচাতে চাস ত গণেশের কাছে নে চল।

মহাদেবদের পাড়া হাসপাতালের পথেই পড়ে। জীবনের বউ ভ্যানে শুয়ে আছে। জ্ঞান আছে। ভ্যানের কোণে ভামিনীবুড়ি বাবা গণেশ বাবা গণেশ করতে থাকে। মহাদেবের উঠনে ভ্যান থামে।

ভামিনীবুড়ি ভ্যান থেকে নেমে বলে, বাবা গণেশ, একবারটি দেখা দাও। আগের দিন ঝা কয়েচি অলায্য কয়েচি। মাথার ঠিক ছিল না বাবা। এখন তোমার ঠেয়ে এনিচি। ওরে কিরপা কর।

গণেশ তখন হাগতে গিয়েছিল। এত লোক দেখে পাণ্ডবজবা গাছটার তলে দাঁড়িয়ে পড়ে। গণেশের মা তাড়াতাড়ি জলের কাজ করিয়ে দিয়ে প্যান্ট পরিয়ে দেয়। গণেশের কপালে গেরিমাটির তিলক। শুঁড়ে একটা লাল ফিতে জড়ানো। গণেশের মা তাড়াতাড়ি পাণ্ডবজবা গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে লাল ফিতের মধ্যে গুঁজে দেয়। গণেশ আসছে হেলতে দুলতে। শুঁড়টা একবার নাড়াল। একটু ওঠাল। ও বোধহয় ভামিনীবুড়িকে চিনতে পেরেছে। জিলিপি ভোগ দেয়া বুড়ি। বুড়ি গণেশের সামনে শুয়ে পড়ে ভুঁয়ে। বলে, বউডারে বাঁচয়ি দ্যাও বাবা, বরং আমারে পার করো।

গণেশ এদিক চায়, ওদিক চায়। কারুর হাতে কোনও শালপাতার ঠোঙা নেই। গণেশ ঘরের দিকে মুখ ফেরায়। বুড়ি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। গণেশ কী ভেবে বুড়ির দিকে চায়। বুড়ি বলে, কিরপা হবে তো বাবা!

গণেশ বলে, কিপা হবে।

বুড়ি বলে, একবারে বউডারে স্পর্শকরি দ্যাও ঠাকুর। গণেশ আস্তে আস্তে বউটার গলায় হাত দেয়। লকেটের ঝুটো পাথরের লাল চিকচিক দেখে। কে একজন ভ্যানরিকশার ঘন্টি বাজিয়ে দেয় টিরিং।

ভ্যানরিকশাটা পিচরাস্তায় পড়ল। মাইল দুয়েক পরেই কৈবর্তহাট। ওখানে মাইক। আলুর চপ ভাজার গন্ধ। জীবনের বউ উঠে বসে। বলে, চা খাব।

চা খেয়ে অবশ্য হাসপাতালে যায়। ডাক্তার বলে, সাপে বিষ ছিল না তেমন, তবু যাহোক ইনজেকশন দেয়।

জীবন আর জীবনের বউ মুরগি নিয়ে আসে মহাদেব হাজরার বাড়ি। বলে, গণেশকে পুজো দেবে। এরপর লোকজন আসতে থাকে। পরীক্ষায় পাস, আই আর ডি পি বা জওহর রোজগার যোজনার কাজ, বন্ধ্যানারীর সন্তান লাভ, শূল বেদনার উপশম, স্বামীর সংসারে সুমতি, এইসব কামনাবাসনা বয়ে নিয়ে লোকজন আসে। প্রতিদিন সন্ধেবেলা পাড়ার ছাগলে এসে অনেক ফুল খায়, শালপাতা খায়।

ইতিমধ্যে একদিন নতুন পাম্পশু জুতোয় মচমচ শব্দ করতে করতে গোপীবল্লভ এল। বলল, কোম্পানির আফটার সেল সার্ভিস বলে একটা ব্যাপার আছে। দেকতি এলাম। শুনলাম তোমাদের দিন ফিরি গেছে।

মহাদেব হাত কচলায়।

গোপীবল্লভ গণেশের কাছ গিয়ে বলে, কী গণেশ, কেমন আছ?

গণেশ চোখ পিটপিট করে।

বলো, কেমন আছ, ভাল না?

গণেশ মাথা নাড়ে। বলে, না।

কেন? ভাল নেই কেন?

আমাল অচুক।।

কে বলল, অসুখ? তোমার সুখ। তুমি এখন জ্যান্ত গণেশ। ভগবান। শোনো বলি। কেউ যদি তোমার কাছে আসে, তুমি ডান হাতখানা সামনে ধরবা। আঙুলগুলি এই এমনি করি জোড়া রাখবা। যেন ভোটের হাত চিন্ন। এটা বরাভয় মুদ্রা। কী মহাদেব, এসব শিখোয়ি দেবা ত। আর শোনো গণেশ। এই বরাভয় মুদ্রা পাইকিরি সবারে দেখাবা না। যারে মনে হবে তারে দেখাবা। নইলে ওজন থাকবে না।

মহাদেবের বউ চা করে আনে। চায়ের সঙ্গে নোনতা বিস্কুট, চানাচুর।

মহাদেবের বউ ঘোমটার ভিতর থেকে বলে—আমার ক্যাবলার মধ্যি সত্যিসত্যিই গণেশের অংশ আছে। নইলে ঠিক ঠিক গণেশ পানা হতিছে কেন? পেটটা বড় হতিছে। ঝা বলতেছে তাই হচ্চে। রোগব্যাধি ভাল হচ্ছে। লোকের মনস্কামনা পূরণ হতিছে। আমাদেরও ঘরদুয়োর হল। ওর মধ্যে যদি গণেশ নাই থাকবে, মনস্কামনা পুরে কেন? গোপীবল্লভ হাসে। বলে, গণেশের মধ্যে গণেশ যদি আসি গেছে মনে করো, ভাল কথা। ও, ভাল কথা, শোনলাম অনেকে নাকি মুরগি নে আসে? গণেশের পূজায় মুরগি পেসাদ কোথাও শুনিচ? এসব ছোটলোকদের প্র্যাকটিস। শুধু ফল-ফলাদি। নিরামিষ। বোঝলা না?

মহাদেব মাথা নাড়ে।

গোপীবল্লভ বলে, আমারেও একটু স্মরণে রেখো। আমার জন্যিই ত এইসব। আমিই ত গণেশ বানালাম। একেবারে বঞ্চিত কোরো না। বোঝলা না? আমিও গণেশের কৃপাপ্রার্থী একজনা।

জোরে জোরে হাসে গোপীবল্লভ।

মহাদেব বলে, হাসির কথা নয় বল্লভ। এই ধরো না কেন আমার নাম মহাদেব। ছেলের নাম রাখিলাম গণেশ। এরপর যে ও সত্যি সত্যি গণেশ হয়ে গেল, এখানে ভগবানের কোনও ইচ্ছা ছিল কি না কে বলতি পারে?

বল্লভ বলে, ভগবান নয়, সবই কোম্পানির ইচ্ছা।

পঞ্চায়েতের ভোট এসে গেল। পাশের ব্লকের এক প্রার্থী এসে পুজো দিয়ে গেল। জিতল সে। গণেশের ঘরে ভিড় বাড়ল।।

এখন আর রোজ রোজ গণেশের দেখা পাওয়া যায় না। সপ্তাহে দু’বার। সোম আর বুধ। এখন মোকদ্দমায় জয়লাভ বা ব্যাংক লোন প্রাপ্তির জন্যও লোকে আসছে। মোপেড মোটরসাইকেলে চড়া লোক আসছে, পকেটে ক্যালকুলেটার নিয়ে লোক আসছে, হাতের কবজিতে ইলেকট্রনিক ঘড়িসমেত হাতজোড় করছে।

গণেশ এখন দর্শন দেবার সময় হাফপ্যান্ট পরে না। সিল্কের রঙিন ধুতি পরানো হয় ওকে। অর্ডার দিয়ে বানানো কাঠের সিংহাসনে সে বসে। বেশ মানায় ওকে। পেটটা আরও বড় হয়েছে ওর। মহাদেব একটা টেপ রেকর্ড কিনেছে। পঙ্কজ উধাস, অনুপ জালোটার ভজন, সঙ্গে কুমার শানু-মহম্মদ আজিজ।

মহাদেবের বউ আগে অন্যের বাড়ি ধান সেদ্ধ করতে গিয়ে বা মুড়ি ভাজতে গিয়ে দাওয়ায় বসা গিন্নিদের গপ্পোসপ্পো উঠোনে বসে শুনত। এখন মহাদেব-গিন্নি মুড়ি ভাজতে বা ধান সেদ্ধ করতে যায় না। তত্ত্বতালাশ নিতে যায়। ও এখন বসতে পিঁড়ি পায়।

কার স্বামী কী খেতে ভালবাসে, ডালের বড়া না হলে কার স্বামী খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়, এসব শোনে। কার স্বামীর রোজই চাই, নইলে ঘুম হয় না, শোনে। কার ননদের শহরে বিয়ে হয়েছে, খাট-আলমারি-ফিরিজ দেয়া হয়েছে, কার বোনের বিয়েতে সমস্ত ইস্টিলের বাসন, প্রেসার কুকার, মশলাবাটার মেশিন, কার ভাসুর-ঝির বিয়েতে টিভি-সোফা-টেলিফোন…

অ্যাই, এটা ভাই মিছ? টেলিফোন কেনা যায় না।

কে বলল যায় না। আমি নিজে দেখলাম। মাইরি বলছি।

আবার মিছ? আমার দেওরের বারাসাতে কাপড়ের দোকান, সে কিনা পাচ্ছে না টেলিফোন। কাঁড়ি পয়সা তার। টাকা দিয়ে কেনা যেত যদি, কবে কিনত।

গণেশের মা এসব শোনে। ওরও কথা বলতে ইচ্ছা করে। গণেশের স্কিমের টাকায় ঘরে টিন হয়েছে, বাকি টাকা ব্যাংকে। গণেশের দক্ষিণার টাকায় টেপ রেকট, গদিখাট, আলমারি, ঘর পাকা, লাল সিমিন্ট। ওর যদি মেয়ে হত, ও তবে দিতে পারত, বলতে পারত ওরকম আঠেরো ভরি সোনা, খাট-আলমারি-ফোঁস কুকার…। কিন্তু নাড়ির জট খোলাবার জন্য হাসপাতালে যাবার সময় হয় না ওর। ও হাসপাতালে ভরতি হয়ে গেলে ভক্ত সামাল দেবে কে?

বারাসাত থেকে লাল শালুতে লিখিয়ে আনা হয়েছে ওঁ গণেশায় নমঃ। প্রতি সোম আর বুধবারটা মহাদেব বড় ব্যস্ত। ক্যালেন্ডারের এক-দুই-তিন-চার কেটে কেটে পিছনে পিসবোর্ডের টুকরোয় আঠা দিয়ে সেঁটে কুপন করেছে। আগে এলে আগে নম্বর পাবে। কোনও নির্দিষ্ট দক্ষিণা রাখেনি মহাদেব। যে খুশি হয়ে যা দেয়। সবাই জানে এটা ইনজেকশন মারা শুঁড়। তবু আসে৷ এমনকী গাঁয়ের অন্য যাদের কান বড় ঠোঁট বড় হাত বড়, তারাও আসে। মহাদেবরা ভাবে সত্যিই ওর মধ্যে গণেশের অংশ আছে। মহাদেব ফিল্টার সিগারেট খায়। আজকাল মাটি কোপালে গা ব্যথা করে। সারিডন-টারিডন খেলে ব্যথা কমে।

একদিন রাতে গণেশ বলে, আজ কী বার!

কেন বাবা, রবিবার।

কাল ছোমবার?

হ্যাঁ বাবা।

গণেশ কাঁদতে থাকে।ওর চোখের জল শুঁড় বেয়ে পড়ে। বলে, কালকে আমি গণেছ হবনি।

কেন বাবা?

না। গণেছ না। আমি ক্যাবলা হব আবার।

তা কি আর হয়? ওকে বলে-কয়ে, শেষটায় জোর করে সিংহাসনে বসানো হয়। ও বেশি কথাবার্তা বলে না। কাউকে বরাভয় মুদ্রা দেখায় না। জিলিপি, সন্দেশ কিছুই খায় না।

বুধবারও তাই করল।

ও আগে ওর শরীরে যা কুলত সেইমতো পাড়ার ছেলেপিলেদের সঙ্গে একটু-আধটু খেলত-টেলত। ও গণেশ হবার পর তা বন্ধ। ভগবান কখনও মানুষের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলতে পারে না। গণেশ আজকাল নতুন বসানো জানালার দরজা ফাঁক করে বাইরের মাঠ দেখে। ছেলেদের দৌড়ঝাঁপ দেখে। নতুন বসানো লোহা শিকের শীতলতা লাগে ওর মুখে, কানে, শুঁড়ে।

নাপিতকে দিয়ে ওর বিশাল কানের লতিতে ফুটো করিয়ে ওখানে পরানো হয়েছিল দুল। তখন গণেশ কেঁদেছে। ওর কানে সাদা পাথর চকচকায়। ওর শুঁড়ে উল্কি করানো হয়েছিল। উল্কির সুচ ফুটেছিল, গণেশ কেঁদেছে। আর এখন ওর সামনে কমলালেবু আপেল সন্দেশ। আর জানালার শিকের বাইরে মাঠের সবুজে বাচ্চারা খেলছে। গণেশ কাঁদে।

বিজয় হাজরা আসে। সঙ্গে ধনঞ্জয়। ওর বড় কানটা ছেঁড়া ফাটা। বর্ষার দরুন সার্কাস বন্ধ। ধনঞ্জয় আর গণেশ মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কোনও কথা বলে না।

পরের বুধবার গণেশকে জোর করেই বসানো হল লাল ভেলভেট মোড়া ডানলোপিলোর কুশ বসানো সিংহাসনে। বাবা, বোস বাবা। ঝা চাইবি দেবানে।

মুখে শ্বেতি-দাগ ষোলো বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছে ওর মা। হাত জোড় করে বলছে, আমার মেয়ের সাদা দাগ ভাল করে দাও বাবা গণেশ।

গণেশ চিৎকার করে বলে, আলও দাগ হয়ি যাক।

একজন সম্রান্ত চাষি, হাতে ঘড়ি, গায়ে টেরিকট, খবর কাগজের ব্যাংকের বিজ্ঞাপনে আমরা সর্বদা চাষিভাইদেব সেবায় আছি লেখার সঙ্গে ট্রাক্টরের পাশে যে চাষির মুখ থাকে, সেরকম একজন চাষিবাবু এসে বলে, বাবা গণেশ, গত বছর পাঁচ বিঘের আলু ধসা রোগে…

গণেশ ঘাড় কাত করে বলে, আমি গণেছ না, ক্যাবলা।

মহাদেব বলল, এঁদের সব নানারকমের লীলাখেলা। গণেশ তখন টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে টগরফুলের মালা। জরির ফিতে। সিংহাসন থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়। শুঁড় বেয়ে মুখের লালা নেমে আসে গোলাপি রেশমে।

আরও সোমবার আসে, বুধবার আসে। সিংহাসনের দারু-কারুকাজে ছোট মাকড়শা নিজস্ব কারুকাজ শুরু করে। মেঘের ফাঁক দিয়ে নেমে আসা রোদ্দুর কারুকাজ করে গাছের পাতায়, জলের ঢেউয়ে; গণেশ দেয়ালের চুনবালিতে নখচিহ্ন এঁকে এঁকে কী যে… বলতে চায়…।

গণেশের শুঁড়ের ডগাটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। ও ব্যথার কথা জানায়। কাঁদে।

মহাদেব বলে, কিছু কি কামড়েছিল? ভোমরা-টোমরা, ডাঁস-ডোমা। গণেশ মাথা নাড়ে। মহাদেব বলে, নিগ্‌ঘাত কিছু কামড়েছিল। ভাল হয়ি যাবি। গণেশের মা সরষের তেল বুলিয়ে দেয়। বলে তাড়াতাড়ি ভাল হ বাবা। কিন্তু গণেশ ভাল হয় না। একদিন ধুম জ্বরে বলে, আমার ছুড় কেটি দ্যাও বাবা। আমি আবার আমি হব। খেলব, মাঠে যাব।

গণেশের শুঁড়ের ফোলা জায়গাটা অনেকটা বেড়ে গেছে। একটা মাংসপিণ্ড জেগে উঠেছে। গণেশ রোগা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছু খেতে চাইছে না। পেটটা ফুলে উঠছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের কপাল কুঁচকে ওঠে। বলে, কলকাতা নিয়ে যান। ভাল ঠেকছে না।

গণেশের মা ভাবে তবে কি গণেশের মধ্যে সত্যিই গণেশ নেই। গণেশ কেন ওর নিজের রোগ ভাল করতে পারছে না? গণেশের মা একটা মাটির গণেশ কিনে নিয়ে আসে। জ্যান্ত গণেশের সামনে মাটির গণেশকে বসিয়ে দিয়ে বলে, পাত্থনা কর বাবা, ভাল হয়ি যাবি। গণেশ মাটির মূর্তি ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে। মাটির গণেশের শুঁড় ভেঙে গেলে মাংসের গণেশ সেই মুখ দেখে। স্মিত হাসে।

একদিন গণেশের শুঁড়ের জেগে ওঠা মাংসপিণ্ড থেকে রক্ত ঝরে। পুঁজ রক্ত ঝরে। কোথা থেকে এসে যায় নীল মাছি। মহাদেব ডাক্তার ডাকে। ডাক্তার বলে, শুড়টা কেটে ফেলতে হবে। গণেশ যেন খুশি হয়। বলে, তা হলি আমি আবার আমি হয়ি যাব।

মহাদেব গোপীবল্লভের কাছে যায়। বলে, কোম্পানিতে বলে শুঁড়টা কাটিয়ে দিতে। গোপীবল্লভ বলে, কন্ট্রাক্টে নেই। কোম্পানি ছোট করে না। শুধু বড় করে দেয়।

তারপর গণেশ মরে যায়। গণেশের নাকের ডগার গলিত মাংসপিণ্ডের মধ্যে দুটি গর্তের হু-হু শূন্যতার দিকে কান বড় হাত বড়রা তাকিয়ে থাকে। একটি বালকের লম্বা লম্বা আঙুলগুলো কিছু একটা ধরবে বলে কিলবিল করতে করতে ক্রমশ স্থির হয়ে যায়। চলে আসে নীল মাছি।

কোথা থেকে খবর পেয়ে চলে আসে ফটোগ্রাফারের দল, বাণিজ্যিক টিভির। তোয়ালেতে ঘাম মুছে বলে, দেরি হয়ে গেল। তিন পায়ের উপর দাঁড়ায় ভিডিও ক্যামেরা—জাপান নির্মিত। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, জুম-টেলি ইত্যাদি সহযোগে রঙিন ছবি রকমারি ইনসাট যোগে চলে যাবে মানচিত্রের লাল-নীল-সবুজ-হলুদ নানা দেশে। শ্মশান-বন্ধুরা মরা গণেশের, গণশার, ক্যাবলার মৃতদেহ ছেড়ে ঘিরে ধরে দেখছে ক্যামেরা যন্ত্র। দেখছে, যন্ত্রের মানুষ।

এ সময়ে কীভাবে ছুটে এল ধনঞ্জয়। ধনা। ওর বড় কানটার এখানে ওখানে অনেক গর্ত। এখানে ওখানে অনেক ছেঁড়া ফাটা। সে গণেশের মৃতদেহটার উপর উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে।

ছবি উঠছে এখন। ছবি উঠছে।

শারদ প্রতিক্ষণ, ১৯৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *