গণেশের বিবাহ
গণেশ কেমন যুদ্ধ করিয়াছিলেন তাহা বলিয়াছি, গণেশের বিবাহ কেমন করিয়া হইয়াছিল আজ তাহা বলিব।
যুদ্ধের পর হইতে শিব গণেশকে যারপরনাই স্নেহ করেন, আর পার্বতীর তো কথাই নাই। কার্তিক যেমন শিব আর পার্বতীর পুত্র, গণেশ তাঁহাদের তেমনি পুত্র হইলেন, আর তাহাদের নিকট তেমন স্নেহ পাইতে লাগিলেন।
কার্তিক আর গণেশ যখন বড় হইলেন, তখন একটা কথা লইয়া দুজনের মধ্যে বড়ই তর্ক উপস্থিত হইল;কার্তিক বলেন, “আমি আগে বিবাহ করিব,” গণেশ বলেন, “না আমি আগে বিবাহ করিব!”
তাঁহাদের এইরূপ তর্ক শুনিয়া শিব আর পার্বতী বড়ই ভাবনায় পড়লেন। দুই পুত্রকেই তাঁহারা সমান স্নেহ করেন; ইহাদের কাহাকে চটাইয়া কাহার বিবাহ আগে দেন? শেষে অনেক ভাবিয়া শিব স্থির করিলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আগে এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়া (অর্থাৎ তাহার চারিদিকে ঘুরিয়া) আসিতে পারিবে, তাহার বিবাহই আগে দিব।”
এ কথা শুনিয়া কার্তিক তখনই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতে বাহির হইলেন। গণেশের এই বড় ভুঁড়ি, তাহা লইয়া ছুটাছুটি করিবার সুবিধা নাই;তিনি ভাবিলেন, ‘তাইতো, এখন করি কি? ক্রোশখানেক যাইতে না যাইতেই আমার হাঁপ ধরে, পৃথিবীর চারিদিক আমি কি করিয়া ঘুরিব?’
যাহাই হউক, গণেশ বড়ই বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি মনে মনে এক চমৎকার যুক্তি স্থির করিয়া, স্নানের পর দুখানি আসন হাতে পিতামাতার নিকট আসিয়া বলিলেন, “বাবা! মা! এই দুইখানি আসনে আপনারা দুজনে বসুন, আমি আপনাদের পূজা করিব।”
এই কথায় শিব আর পাবর্তী সন্তুষ্ট হইয়া দুই আসনে দুইজন বসিলেন। গণেশও ভক্তির সহিত তাঁহাদের পূজা করিয়া, সাতবার তাঁহাদের চারিদিকে ঘুরিলেন। তারপরে জোড়হাতে তাহাদিগকে বলিলেন, “এখন তবে আমার বিবাহ দিন।”
শিব কহিলেন, “বাবা, আমি তো বলিয়াছি কার্তিকের আগে যদি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরিয়া আসিতে পার, তবে তোমার বিবাহই আগে হইবে।”
তাহাতে গণেশ বলিলেন, “সে কি বাবা, আমি যে সাতবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিলাম, তবে কেন এমন কথা বলিতেছেন?”
শিব কহিলেন, “তুমি কখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিলে?”
গণেশ বলিলেন, “এই যে আমি আপনাদের পূজা করিয়া সাতবার আপনাদিগকে প্রদক্ষিণ করিয়াছি। বেদে আর শাস্ত্রে আছে যে, পিতামাতাকে পূজা করিয়া প্রদক্ষিণ করিলে তাহাতে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ফল পাওয়া যায়, ইহাতে সংশয় নাই। বেদের কথা যদি সত্য হয়, তবে অবশ্যই আমার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা হইয়াছে। সুতরাং আমার শীঘ্র বিবাহ দিন, নচেৎ বেদের কথা মিথ্যা হইয়া যাইবে।”
এ কথায় শিব যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “তাইতো বাবা, তুমি তো ঠিক কথাই বলিয়াছ। বেদে আর শাস্ত্রে যাহা আছে তাহাই তুমি করিয়াছ, সুতরাং তোমার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা হইয়াছে বৈকি!”
তখনই গণেশের বিবাহের আয়োজন আরম্ভ হইল। দুটি কন্যাও পাওয়া গেল, রূপে গুণে কুলে শীলে সকলের চেয়ে ভালো, নাম সিদ্ধি আর বুদ্ধি। সুতরাং বিবাহ হইতে আর বিলম্ব হইল না।
এদিকে হইয়াছে কি, গণেশের বিবাহের কিছুদিন পরে কার্তিক প্রাণপণে পৃথিবীর চারিদিকে ছুটিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে কৈলাসে উপস্থিত হইয়াছেন, আর অমনি নারদ মুনি আসিয়া তাঁহাকে বলিয়াছেন, “দেখিলে ইহাদের কাজ? তোমাকে ফাঁকি দিয়া তোমার পিতামাতা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতে পাঠাইলেন আর সেই অবসরে গণেশের বিবাহ দিলেন। শাস্ত্রে বলে এমন মা-বাপের মুখ দেখিতে নাই, এখন তোমার যেমন ভালো মনে হয়, কর।”
এই বলিয়া যেই নারদ বিদায় হইলেন, অমনি কার্তিকও শিব আর পার্বতীকে প্রণাম করিয়া রাগের ভরে ক্রৌঞ্চ পর্বতে চলিয়া গেলেন।
শিব আর পার্বতী ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “কোথায় যাইতেছ বাছা? তোমার যে বিবাহ ঠিক করিয়াছি।”
কার্তিক কি তাহাতে থামেন? তিনি বলিলেন, “না, আমি এখানে আর থাকিব না;আপনারা আমাকে ফাঁকি দিয়াছেন।”
সুতরাং কার্তিকের আর বিবাহ হইল না;এইজন্যই তাঁহার আর এক নাম হইয়াছে ‘কুমার’।
ইহাতে শিব আর পার্বতীর মনে কিরূপ কষ্ট হইল, বুঝিতেই পার। তাহারা কার্তিককে ফিরাইতে না পারিয়া নিজেরাই সেই ক্রৌঞ্চ পর্বতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। কিন্তু কার্তিকের কিনা বড়ই রাগ হইয়াছিল, তাই তিনি তাঁহার পিতামাতাকে আসিতে দেখিয়া ক্রৌঞ্চ পর্বতে থাকিতে চাহিলেন না। দেবতারা অনেক বলিয়া কহিয়া সেখান হইতে বারো ক্রোশের মধ্যে থাকিতে তাঁহাকে রাজি না করাইলে না জানি তিনি কোথায় চলিয়া যাইতেন।