গণমৃত্যু উদ্যাপনের দুর্লভ সুযোগ
অনেক চেষ্টা করেও যারা ভবযন্ত্রণা লাঘব করতে পারছিলেন না, পশ্চিমবঙ্গের ইনডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন তাঁদের সামনে আগামী ১৫ মারচ সেই সুযোগ এনে দিয়েছেন। এজন্য মুমূর্ষু রোগীরা আই-এম-এর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবেন।
আই-এম-এর ঘনিষ্ঠ মহল আশা রাখেন, পশ্চিমবঙ্গের মুমূর্ষু রোগীগণকে ঐদিন বিনা চিকিৎসায়ে মরবার যে সুবর্ণ সুযোগ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন দিচ্ছেন রোগীগণ তা হেলায় হারাবেন না এবং তাঁরা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে অর্থাৎ দলে দলে মরে আন্দোলনরত ডাক্তারবাবুদের হাত শক্ত করে প্রগতিশীল মনোভাবের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাবেন।
পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিবাদী ডাক্তার-প্রেমিক সমিতির জনৈক মুখপাত্র জানান, আগামী ১৫ মার্চ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন চব্বিশ ঘণ্টার জন্য রাজ্যব্যাপী যে চিকিৎসা ধর্মঘট ডেকেছেন, সমাজ সচেতন এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রোগীমাত্রই যে তার সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন এবং গণমৃত্যু উদ্যাপনের মাধ্যমে ইহসংসার ছেড়ে ভবপারে যাত্রা করবেন, সে বিষয়ে আমাদের অণুমাত্রও সন্দেহ নেই। তবু আমরা আমাদের সংস্থার পক্ষ থেকে চিকিৎসা ধর্মঘটের প্রাক্কালে সেইসব টেটিয়া রোগীদের শেষবারের মত সাবধান করে দিতে চাই যে, তাঁরা যদি এতদ্সত্ত্বেও বিদেশী চরেদের (অর্থাৎ আমাদের বা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন দেশের) চক্রান্তে পা দিয়ে গণমৃত্যু উদ্যাপনে যোগ না দেন তবে সেইসব রোগীদিগকে সঙ্গত কারণেই প্রতিক্রিয়াশীল, ডাক্তার বাবুদের মহান আন্দোলনের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন, এমন কি সি আই-এর চর বলেও চিহ্নিত করতে বাধ্য হব।
‘একদিনের চিকিৎসা ধর্মঘটে কত রোগী মরতে পারে বলে আপনাদের ধারণা?’
‘ক্রিটিক্যাল পেসেন্ট্রা সবাই গণমৃত্যু উদ্যাপনে অংশ নিতে চান না, এমন হতভাগা রোগী কেউ আছেন নাকি? থাকলে তাঁদের সংখ্যা কত?’
এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিবাদী ডাক্তারপ্রেমিক সমিতির মুখপাত্র বললেন, ‘আই-এম-এর কৃপায়, এই প্রথম আমরা গণমৃত্যু উদ্যাপনের সুযোগ পেলাম। আই-এম-এ এমন সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন যে, কোনও দিকে আর ফাঁক নেই। যেমন ধরুন, আপনি হারট পেসেন্ট। হঠাৎ আপনার স্ট্রোক হল। অন্য সময় হলে আপনি হয় হাসপাতালের দ্বারস্থ হতেন, যদি ট্যাকে কড়ির জোর থাকে তাহলে নারসিং হোমে যেতেন, হয়তো বাড়িতে ডাক্তার ডাকবেন, কিংবা মেয়াদী রোগী হলে বাড়ির লোকেরাই দৌড়ে দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনে এনে আপনাকে খাইয়ে দিলেন। একটা না একটা ঝামেলা পোয়াতে হতই। হত না?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, তাতো হতোই। একটা লোককে বাঁচিয়ে রাখার হ্যাপা কি কম?
পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল ডাক্তারপ্রেমিক সমিতির মুখপাত্র বললেন, ‘দেয়ার ইউ আর। আই-এম-এ এবং সরকারি ডাক্তার বাবুরা এক অলিখিত শান্তি মৈত্রী এবং সহযোগিতার চুক্তিপাশে আবদ্ধ হয়ে এবার এমন জনহিতকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছেন যাতে পাবলিককে আর এই ধরনের কোনও ঝামেলা পোয়াতেই হবে না। যেমন ধরুন আই-এম-এ জানিয়েছেন যে, ওইদিন সরকারি বেসরকারি কোনও চিকিৎসক কাজ করবেন না। হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ই এস আই ডাক্তার, নানা, ডিসপেনসারি, ওষুধের দোকান কিছু খোলা থাকবে না। অর্থাৎ গণমৃত্যু উদ্যাপনের ঢালাও এক ব্যবস্থা আই-এম-এর উদ্যোগে করে রাখা হয়েছে। এখন আমরা চাই যে রোগীরা, বিশেষ করে মরণাপন্ন রোগীরা নিশ্চিন্ত মনে গণমৃত্যু উদ্যাপনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। ডাক্তার এবং রোগীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্মরণে রেখে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সমাজ সচেতন রোগীরা এই ন্যূনতম সহযোগিতাটুকু পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশনের সঙ্গে করবেন, এই আশা নিশ্চয়ই এই রাজ্যের সংগ্রামী রোগীদের উপর রাখা যায়, কি বলেন?’
অবশ্যই। মরে ডাক্তারবাবুদের উপকার করার ঐতিহ্য অন্তত এই রাজ্যের রোগীরা বিসর্জন দেবে না, একথা আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি। পশ্চিমবঙ্গের রোগীদের আর যে দোষই থাক, তাঁরা কখনো মরতে পিছপা নয়।’
‘আই-এম-এর ঘনিষ্ঠ মহলেরও দেখলাম রোগীদের শুভবুদ্ধির প্রতি পূর্ণ আস্থা আছে।’ ওই মুখপাত্র একটু থেমে বললেন, ‘আই-এম-এ মহল আমাদের কি বলেছেন জানেন? বলেছেন, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে, গীতায় না কোথায় যেন শ্রীভগবান স্বয়ং এরকম একটা কথা বলেছেন। রোগীরা এমনিতে তো আমাদের হাতেই মরে। মরার ব্যাপারে রোগীদের সহযোগিতা আমরা বরাবরই পেয়ে থাকি। ঐদিন না হয় আমাদের নোবল কজটা সমর্থনের জন্য রোগীরা পাইকারিভাবে মরার সুযোগ গ্রহণ করবে। তাদের ফি-এর টাকাটাও বাঁচবে আবার ইতিহাসে নামও থাকবে।’
‘ইতিহাসের কথা কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারছিনে। ব্যাপারটা কি বলুন তো?’
‘আই-এম-এর সুযোগ্য এবং বৈপ্লবিক নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তারবাবুগণ এত বড় একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন’, পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিবাদী ডাক্তারপ্রেমিক সমিতির মুখপাত্র প্রায় ধমকেই উঠলেন, ‘আর আপনার সেটা চোখেই পড়ছে না। আপনি কি মশাই চোখের মাথা খেয়েছেন। পৃথিবীতে আর কোন্ মেডিকেল এসোসিয়েশন নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য এমন আটঘাট বেঁধে এমন এক মহান গণমৃত্যু উদযাপনের আয়োজন করতে পেরেছেন তা দেখাতে পারেন? এমন সর্বাত্মক চিকিৎসা ধর্মঘটের কথা আর কখনও শুনেছেন? ইতিহাসে এই প্রথম। ১৫ মার্চ বিশ্বের চিকিৎসা-ব্যবসায়ের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অক্ষয় তিথি। ঐদিন যে শিশু ছাদ থেকে পড়ে মর-মর হবে, যে যুবক দুর্ঘটনায় পড়বে, যে মেয়ে বা মা অসাবধানে আগুনে ঝলসাবে, বাড়ির যে উপায়ী লোকটি হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হবে, উঃ, তাঁরা কি ভাগ্যবান। তাঁদের কথা ভাবতেও ঈর্ষা হচ্ছে মশাই। এই রাজ্যের মেডিকেল জারনালে তাঁদের ফটো ছাপা হবে। ফটোর নিচে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে— বিশ্বের প্রথম গণমৃত্যু উদ্যাপনের বীরসকল, যাঁহারা ডাক্তারবাবুদের দাবির নিকট সরকারকে নতিস্বীকার করাইবার জন্য চিকিৎসা ধর্মঘটে আত্মাহুতি দিয়াছেন। ভাবুন তো কী থ্রিল। উঃ।’
‘আচ্ছা অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজন মেটাবার জন্য কয়েক জায়গায় ইমারজেন্সি স্কোয়াড রাখা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই স্কোয়াড কী করবে?
আই-এম-এর ঘনিষ্ঠ মহল জানালেন, ‘কেন ওরা ডেথ সারটিফিকেট লিখবে আর শ্মশানযাত্রীদের শ্মশানের পথ বাতলে দেবে। ডাক্তাররা যে সামাজিক কর্তব্য ভুলে যাননি এই জরুরি কাজগুলোই তার খাসা প্রমাণ, নয় কি?’
১৩ মার্চ ১৯৭৪