গণনার সাঁওতালি পদ্ধতি
যীশুখৃষ্টের আবির্ভাবের পর থেকে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরা খৃষ্টাব্দ গণনা শুরু করে এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের পয়গম্বর হজরত মহম্মদের মদিনা থেকে মক্কা যাত্রার অব্যবহিত পর থেকে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু তার বহুকাল পূর্ব থেকে বলতে গেলে প্রায় স্মরণাতীতকাল থেকে সাঁওতালদের মধ্যে দিন, মাস ইত্যাদি গণনার এই প্রথা প্রচলিত ছিল। তার কিছুটা এখনো অবশিষ্ট আছে বাকিটা অবলুপ্ত হয়েছে। এই অবলুপ্ত হবার কারণ সম্পর্কে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ব বিভাগের অধ্যাপক মার্টিন ওরান্সের মতে নিজেদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতিকে ত্যাগ করে হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়া। তাঁর মতে তাদের প্রতিবেশী হিন্দুদের কাছে খুব সম্ভব ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দের বিদ্রোহে পরাজিত হবার ফলে তারা হিন্দু সংস্কৃতিকে উন্নত মনে করে আপন করতে শুরু করে। ফলে, নিজেদের ঐতিহ্যমণ্ডিত উন্নত সংস্কৃতি অবলুপ্ত হতে থাকে। সামান্য যা কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে তাই এখানে উল্লেখ করব।
বছরে একবার পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় একথা আজ প্রমাণিত। সাঁওতালি ভাষায় বছরকে বলে সেরমা। যেমন মিৎসেরমা বার সেরমা ইত্যাদি অর্থাৎ একবছর, দুবছর ইত্যাদি। সাঁওতালি এই সেরমা শব্দের মধ্যেই যতসব বৈজ্ঞানিক রহস্য লুকিয়ে আছে। কারণ সেরমা বলতে যেমন বছরকে বোঝায় অপরদিকে আবার তেমনি সেরমা বলতে পৃথিবীকেও বোঝানো হয়। যেমন অৎ (মাটি), সেরমা (পৃথিবী)। সাঁওতালি ভাষায় সেরমা কে নিয়ে রচিত নিম্নে প্রদত্ত গানটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য :
বাহা সেরেঞ
হেঁসাঃকমা চটেরে
তুদেদয় রাগে কান,
বাড়েমা লাড়েরে
গুতরুমেদয় সাঁহেদ।।
দেশচ আচুরেন
তুদেয় রাগে কান,
দিশমচ বিহুরেন
গুতরুৎ দয় সাঁহেদ।।
বুড়ো অশ্বত্থের মগডালে
কাঠ ঠোকরা ডাকে।
সিংহ ডাকে থেকে থেকে
বট বৃক্ষের ফাঁকে।
আগমনীর আগমনে
পুরাতনের অবসানে
কাঠ ঠোকরায়, কাঠ ঠকরায়।
বছর এল ঘুরে ফিরে
সিংহ ডাকে তাই।।
(সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর মোট সময় লাগে ৩৬৫ দিন অর্থাৎ একবছর। এখানে বিশেষভাবে যেটা উল্লেখযোগ্য, সেটা হল আচুর, বিন্দুর (আচুরেন, বিহুরেন) এর অর্থ হচ্ছে ঘুরে ফিরে আসা। অনুরূপভাবে দেশ এবং দিশমও একটাই শব্দ।) পাখির কুজন আর সিংহের আর্তনাদে তারা বুঝত পুরাতনের অবসানে নতুনের আগমন। আলোচ্য গানে বছরের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার কথা)
(গানটি গুরু মাদরাজ মাণ্ডির কাছ থেকে সংগৃহিত)
বছরকে যেমন মাসে ভাগ করা হয়, অনুরূপভাবে সেরমাকেও চাঁদয় ভাগ বা বিভক্ত করা হয়ে থাকে। সাঁওতালিতে চাঁদ বা মাসের গণনা হয় চাঁদ (Chando) অনুসারে। এই কারণেই সাঁওতালি ভাষায় মাসকে চাঁদ বলা হয়। মাস এবং চাঁদ এক নয়। এক মাসে যে দুটো পক্ষ, শুক্ল এবং কৃষ্ণ পক্ষ চাঁদের হিসেবে যারা মাস গণনা করেন তাদের কাছে এটা যে অজানা নয়। তা আলাদা করে উল্লেখ করবার প্রয়োজন হয় না। এই পদ্ধতি যে কত নিঁখুত ছিল সেটা বোঝাবার জন্য আমি একটাই মাত্র উদাহরণ দেব। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে বৈশাখ পূর্ণিমায় প্রতি বছর শিকার উৎসব পালিত হয়। অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে সব আদিবাসী (সাঁওতালরা ছাড়াও এখানে অন্যসব আদিবাসীরা অংশগ্রহণ করে) ছড়িয়ে আছে তাদের অনেকেই ঐ নির্দিষ্ট দিনে সেখানে সমবেত হয় এবং শিকার (সেন্দরা) উৎসব সংঘটিত করে। আজকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, পাঁজি, পুঁথি ইত্যাদি হয়েছে তাই আজকে এই মুহুর্তে সেটা অনেক সহজ মনে হয়, কিন্তু শিকার উৎসব কি আজকের? বহুকাল পূর্বের। যখন আদিবাসীরা চাঁদ দেখেই দিন ঠিক করে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে শিকার উৎসব উদযাপন করে আসছে। তার অন্যথা হয়নি। অতএব এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল নিখুঁত।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় Tourist Spot হিসেবে ইতিমধ্যেই নাম কিনে নিয়েছে। পশ্চিমবাংলার সরকার পাহাড়ের উন্নয়নে বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়েছে সি, এ, ডি, সির (Comprehensive area development corporation) মাধ্যমে। এ ছাড়াও সরকার অযোধ্যা পাহাড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষের পরিকল্পনা নিয়েছে এবং জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে বলে জানি। সম্ভবত লুথেরান ওয়ার্ল্ড সার্ভিসই সর্বপ্রথম অযোধ্যা পাহাড়ে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম শুরু করে। শুনেছি, কিন্তু কতদূর সত্য জানি না, লুথেরান ওয়ার্ল্ড সার্ভিস অযোধ্যায় উন্নয়নমূলক কাজকর্ম শুরু করবার আগে পর্যন্ত সেখানকার লোকজন ভালো পোশাক পরা লোকজন দেখলেই দরজা বন্ধ করে জঙ্গলে গা ঢাকা দিত।
পাহাড়ের চুড়ায় ওঠবার দুটো রাস্তা আছে। একটা আড়শা থানার সিরকাবাইদ হয়ে এবং অপরটা ঘুরপথে বলরামপুর থেকে বাঘমুণ্ডি হয়ে অযোধ্যা পাহাড়। একসময় বাঘমুণ্ডি থেকে পাহাড়ের পথ বেয়ে চূড়ায় ওঠবার জন্য মিনিবাস চালাবার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী কালে কি কারণে সে চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়। কলকাতা থেকে অনেকেই অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে আসে। তারা পুরুলিয়া রেল স্টেশনে অবতরণ করে জীপ অথবা অন্য কিছু ভাড়া করে সিরকাবাইদ হয়ে সোজা পাহাড়ে উঠে যায়।
জনশ্রুতি যে, রাজা দশরথের জ্যৈষ্ঠপুত্র রাম যখন তাঁর ভাই লক্ষণ এবং সীতাকে নিয়ে পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে গিয়েছিলেন তখন পুরুলিয়ার এই অযোধ্যা পাহাড়েও কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। তার নিদর্শন হিসেবে এখনো কিছু কিছু দর্শনীয় অবশিষ্ট আছে। যেমন সীতার চুল। সীতা যখন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতেন তখন যে চুলগুলো মাথা থেকে খসে পড়ত সেগুলো তিনি আশপাশের গাছের ডালে গুঁজে দিয়েছিলেন। সেই চুল নাকি অযোধ্যায় এত বছর পরেও অবশিষ্ট আছে! আর আছে সিমেন্ট বাঁধানো বুজে যাওয়া একটা কুয়ো। সেই কুয়োয় নাকি শিকারে অংশগ্রহণকারী অনেকেই এক নিশ্বাসে মাটি তুলবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, অথচ তার গভীরতা এমন কিছু নয়। অযোধ্যায় গ্রাম আছে মানুষজনও আছে। তারা হেঁটে পাহাড় থেকে নীচে নেমে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে পাহাড়ে উঠে যায়। কিন্তু যেখানে কুয়ো আছে তার আশেপাশে কোন লোকালয় নেই। এই কারণেই কুয়োর রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। তবে চুল বলে যেটাকে মনে করা হয় স্টো চুলের মতই দেখতে সরু পাতলা একধরনের লতানো শেকড়। আশ্চর্যের মধ্যে আর আছে মজে যাওয়া একটা পাহাড়ী নদী যার জল শিকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এটা অনেকের কাছে আশ্চর্য মনে হলেও এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ শিকারে অংশগ্রহণ কারীরা জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নদীর বালি সরিয়ে জল বার করে উপরের নোংরা জল হাত দিয়ে তুলে ফেলে দেয় যার ফলেই নদীতে জলের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
বিবাহিত এবং অবিবাহিত সব পুরুষেরই শিকারে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। যারা বিবাহিত তারা শিকার যাত্রার পূর্বে তাদের পত্নীদের হাতের নোয়া খুলে নিয়ে যায়, শিকার শেষে যে বাড়িতে ফিরে আসবেই তার কোন গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা নাই। শিকারীরা পূর্ণিমার আগের দিন পাহাড়ের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়ে রাত্রিযাপন করে। সকাল হলেই শিকার শুরু করে। শিকারে সাধারণত তীর, ধনুক, বল্লম, তরোয়াল, বর্শা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। দড়ি দিয়ে তৈরি জালও শিকারে ব্যবহার করা হয়। শিকার শেষে সবাই সুতানটাডিতে এসে জড়ো হয়। এখানে গাছপালা থাকলেও জঙ্গল নাই। মাঠ। এখানে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয় এবং শিকারে বধ করা প্রাণীর মাংস কেটে অংশগ্রহণকারী সবার মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হয়, কারণ এটাই নিয়ম। ভাগের রকমফের আছে। তবে শিকারে সংগৃহীত প্রাণীর মাংস একলা কেউ খায় না। রান্নাবান্না করে খেতে খেতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। তখন আকাশে পুর্ণিমার চাঁদ ওঠে। চাঁদের আলোয় পৃথিবীর সব অন্ধকার দূর হয়ে আলোকিত হয়ে উঠে। শিকারে অংশগ্রহণকারীদের মনেও আনন্দের দোলা জাগায়। তাই খোলা আকাশের নীচে নাচগানের আসর বসে। তবে নাচগানে আদি রসাত্মক বিষয় সমুহকে পরিবেশন করা হয়। তার কারণ সম্বন্ধে অনেকেরই বক্তব্য হচ্ছে যে, তথাকথিত সভ্যদের মধ্যে যৌনশিক্ষার জন্য কামসূত্র, কোকশাস্ত্র ইত্যাদি বই আছে। কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে এই ব্যবস্থা নেই। তাই আদিবাসী যুবকদের যৌনশিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্যই এই ব্যবস্থা। অন্য আর এক দলের মতে এইসব অশ্লীল নাচগান হালের ব্যাপার। আদিতে নাকি এদের বালাই ছিল না। সব দিক খতিয়ে দেখে আমার যেটা মনে হয়েছে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ নারীবর্জিত পাঁচজন পুরুষমানুষ যেখানে সমবেত হয় সেখানে এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। শিকারের জন্য আলাদা গান আছে যেটা উপযুক্ত জাযগা ছাড়া অন্যত্র গাওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এসব নাচগানে একসময় রড়ে ক্ষেতুর খুব নাম ছিল। বর্তমানে অনেক দল গজিয়ে উঠেছে তবে রড়ে ক্ষেতুর সমকক্ষ এখনো পর্যন্ত কেউ হয়ে উঠতে পারেনি।
এ তো গেল শিকার উৎসবের একটা দিক এর অন্য আর একটা দিকও আছে। সেটা হচ্ছে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বিবাদ বিসম্বাদ নিষ্পত্তির জন্য তৈরি করা হয়েছে আদালত বা বিচারালয়। পাশাপাশি মাটির হাঁড়ি কলসি রাখলে যেমন ঠোকাঠুকি লাগতেই পারে তেমনি সমাজে, গ্রামে পাড়া প্রতিবেশী একসঙ্গে বাস করতে গেলে মানুষে মানুষে লড়াই ঝগড়া লাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বিবাদ বিসম্বাদ নিষ্পত্তির জন্য সাঁওতালদের প্রতি গ্রামেই আছেন মাঝি বা মোড়ল। বিবাদ দেখা দিলে তারা গ্রামের সবাইকে নিয়ে বিচারে বসেন এবং বিবাদের ফয়সালা করে থাকেন। কিন্তু কোনো বিবাদ যদি অমীমাংসিত থেকে যায় তখন ডাক দেওয়া হয় প্রতিবেশী পাঁচ দশটা গ্রামের মাঝিদের। তারাও যখন ব্যর্থ হয় তার নিষ্পত্তি হয় এই দিহরি বিচার সভায় অর্থাৎ শিকার উৎসবে যাকে উচ্চতর আদালত বলা যেতে পারে।
আগেকার দিনে রাজা মহারাজারা অবসর বিনোদনের জন্য দলবল নিয়ে শিকারে যেতেন। জনসাধারণের অংশগ্রহণ তাতে নিষিদ্ধ না হলেও তাদের দেখতে পাওয়া যেত না। কিন্তু সাঁওতালদের সমাজজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ এই শিকার উৎসব। এই উৎসব তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
এতক্ষণ ধরে যা বললাম আশা করছি যেটা বলতে চেয়েছি সেটা বোঝাতে পেরেছি অর্থাৎ তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে তারা দিন, তারিখ এবং মাসের কথা বলে দিতে পারতেন। মাসকে আবার দিনে ভাগ করা হয়েছে। সাঁওতালি ভাষায় তাকে বলা হয় মাহা। তবে আমার মনে হয় সাঁওতালদের মধ্যে বর্তমানে যে মাহা প্রচলিত আছে তা সাম্প্রতিক কালের, পূর্বে যা প্রচলিত ছিল অব্যবহারের ফলে তা অবলুপ্ত হয়েছে। কারণ এই মাহার কথা সাঁওতালদের সবাই জানে না। এটা মুষ্টিমেয় শিক্ষিত কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। ইদানীং লক্ষ করছি সাঁওতালদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অতি উৎসাহী বা কট্টরপন্থীদের মধ্যে সব কিছুকেই সাঁওতালি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যাতে আমার সায় নেই।
গণনার ক্ষেত্রেও সাঁওতালদের নিজস্ব পদ্ধতি আছে। যেমন মিটাং, বারয়া, পেয়া, পুনয়া, মড়ে তুরুই, এয়ায়, ইরাল, আরে, গেল (অর্থাৎ, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয় এবং দশ) ইত্যাদি। এইভাবে কুড়ি বা বিশ পর্যন্ত গণনার পদ্ধতি আছে। কুড়ি বা বিশটাই হচ্ছে সাঁওতালদের সর্বোচ্চ সংখ্যা। সাঁওতালরা কুড়ি বা বিশকে বলে ইসি বা মিইসি। এইভাবে মিৎ ইসি মিৎ, বারয়া, পেয়া বললে সাঁওতালরা সহজেই বুঝতে পারে যে, কি বলতে চাইছে বা কত বলতে চাইছে। এইভাবে চল্লিশের বদলে বার ইসি, ষাটের বদলে পে ইসি, আশির বদলে পুন ইসি এবং একশর বদলে মড়ে ইসি বললে সাঁওতালরা মোটেই বিভ্রান্ত হয় না। উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে আমি এখানে নমুনা হিসাবে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করব। ১৮৫৫-৫৬ খ্রীষ্টাব্দের সাঁওতালদের বিদ্রোহের ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখ দেখতে পাই। সাঁওতালরা যখন নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য মহাজনদের কাছে বিক্রি করতে নিয়ে যেত মহাজন তা মেপে নিতেন। কিন্তু যত দ্রব্যই নিয়ে যাক না কেন মহাজন কোন দিনই বিশ কথাটা বলতেন না। তখন সাঁওতালরা মহাজন বাবুকে অনুরোধ করত ‘বিশ বোল বাবু বিশ বোল।’ কিন্তু মহাজন বাবু বিশ আর কোনোদিনই বলতেন না। তবে এখানেও ছয়ের পর থেকে উনিশ পর্যন্ত গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা কতটা সাঁওতালদের নিজস্ব সেই নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে বাকিটা অবশ্যই সাঁওতালদের সম্পূর্ণ নিজস্ব এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। আধুনিককালে গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে সেটা সাম্প্রতিক কালের। কিন্তু সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত পদ্ধতি তখনকার পরিস্থিতির বিচারে অবশ্যই যুগান্তকারী বা বিপ্লবাত্মক।