গণতন্ত্রের সেপাই
বাসটা ছাড়ার পর ভালো করে লক্ষ করলাম লোকটাকে৷ ছ্যা, ছ্যা, কী চেহারা! শুঁটকো পানিফলের মতো মুখ, হনু দুটো ঠেলে উঠেছে, একেবারে চামড়াসার কঙ্কাল৷ হাইটই বা কী? এইটুকুনি, র্খবুরে, মেরেকেটে পাঁচ এক৷ ছাতিও আঠাশ হবে কিনা সন্দেহ৷ লিকলিক করছে হাত-পা, খাকি উর্দি লতপত করছে গায়ে, যেন জোববা আলখাল্লা চড়িয়েছে৷ হা কপাল, এই লোকটা পুলিশ? এ নাকি আমাদের বুথ পাহারা দেবে৷ বয়সেরও তো গাছপাথর নেই মনে হচ্ছে৷ মাথায় টুপি থাকার কল্যাণে চুল আছে কি নেই বোঝা দায়, তবে নিশ্চিন্তে আন্দাজ করা যায় ঢাকনা খুললে দু-একগাছি কাশফুল ছাড়া কিছু মিলবে না৷ এখনও কি এর রিটায়ার করার সময় হয়নি?
মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, দেখেছেন রমেশবাবু, কেমন একটা বুড়োহাবড়াকে আমাদের সঙ্গে যুতে দিয়েছে৷
রমেশ মান্না ভূমিরাজস্ব দপ্তরে আপার ডিভিশন ক্লার্ক৷ আপাতত আমার বুথের ফার্স্ট পোলিং অফিসার৷ মধ্যবয়সি, পাকাপোক্ত, গোছানো মানুষ৷ বাসে উঠেই ব্যালটবক্স দুটোকে পায়ের কাছে নিখুঁত সেট করে ফেলেছে৷ একটু আগেও টিফিনবাক্স খুলে ছানা খাচ্ছিল, এখন কোলে কিটসব্যাগ আঁকড়ে ঢুলছে মৃদু মৃদু৷
পটাং করে চোখ খুলল রমেশ, কিছু বললেন?
—ওই যে, ওই পুলিশটাকে দেখুন৷ ঘাটের মড়া৷ ওটাকে আমাদের সঙ্গে ট্যাগ করার কোনো মানে হয়?
—কী আর করা৷ রমেশ ছোট্ট হাই তুলল, যার ভাগে যা পড়েছে৷
—লোকটা এখনও চাকরি করছে কী করে? বয়স তো মিনিমাম সত্তর হবে৷
রমেশ মুচকি হাসল, আপনি যেন কদ্দিন চাকরিতে ঢুকেছেন?
—সিক্সথ মানথ রানিং৷ এই একত্রিশে মার্চ ছ-মাস পূর্ণ হবে৷
—অর্থাৎ সবে কলির ভোর৷ দিন যাক, সরকারি অফিসে অনেক রকম স্যাম্পল দেখতে পাবেন৷ রমেশ সামান্য গলা নামাল, এই যে আপনার থার্ড পোলিং, নিরাপদ বারুই… ওর বয়স আপনার কত মনে হয়?
—সাতান্না আটান্ন…
—নিরাপদর এখনও ন-বছর চাকরি আছে৷ কী বুঝলেন?
—বয়স ভাঁড়িয়েছে বলছেন?
—ভাঁড়ানো কী বলছেন? বলুন পুকুর চুরি৷ এদের বয়সের কোনো হিসেবই নেই৷ গরমেন্টের গ্রুপ ডি আর পুলিশের কনস্টেবল, এরা যে এক সময়ে কী সার্টিফিকেট দেখিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল…৷
—হুম৷ কিন্তু এই তালপাতার সেপাই আমাদের কী কম্মে লাগবে? ঝামেলা হলে ম্যানেজ করতে পারবে ও?
—তবু তো বন্দুকধারী৷ সঙ্গে একটা রাইফেল থাকা মানেই বলভরসা৷
হাহ, বন্দুক কাঁধে তোলার ক্ষমতা আছে লোকটার? ধরে রাখতে গিয়েই শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে৷ …ব্যাটাকে ফলস রাইফেল দেয়নি তো? পাববিলকে চমকানোর জন্য?
বাসের অনেকেই বোধ হয় আমার মতোই ভাবছে৷ আরও চার চারটে পোলিং পার্টি রয়েছে বাসে, তারাও রীতিমতো কৌতুকভরা চোখে দেখছে লোকটাকে৷ বাসের একেবারে পিছনের সিটে বসেছে পুলিশটা, দু-পাশে চার-পাঁচটা কচি কচি হোমগার্ড৷ সদ্য গোঁফগজানো ছেলেগুলো মহা ফক্কড়, রগড় শুরু করেছে লোকটাকে নিয়ে৷
—কী দাদু, দিদিমা প্রাণে ধরে ছাড়ল আপনাকে?
—ছোলা ছাতু সঙ্গে বেঁধে নিয়েছেন তো দাদু? কাল কিন্তু আপনাকে লড়তে হবে৷
—কিস্যু লড়তে হবে না৷ শুধু পালোয়ান দাদু একবার হাতের গুলিটা ফোলাবে, তাতেই সব…
ঠাট্টাবিদ্রূপ শুনেও লোকটা নির্বিকার৷ যেন কানে শুনতেই পাচ্ছে না৷ হঠাৎই পাশের হোমগার্ড ছেলেটা বন্দুকটা নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে খেলার ছলে৷ ঝটকা মেরে বন্দুক টেনে নিল লোকটা, খেপেও গেছে হঠাৎ৷ খোনা খোনা গলায় কী যেন বলল৷ শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে হোমগার্ড ছেলেগুলো৷ আমার বুথের সেকেন্ড পোলিং অফিসার তড়িৎ সাহা বসে আছে কনস্টেবলটার সামনে, সে-ও দেখি যোগ দিয়েছে মস্করায়৷ উত্তেজিত মুখে তেড়ে তেড়ে উঠছে তালপাতার সেপাই৷ দাঁত মুখ খিঁচোচ্ছে৷
লোকটার বিটকেল মুখভঙ্গি দেখে অজান্তে আমার মুখেও বুঝি হাসি ফুটে উঠেছিল৷ রমেশ পাশ থেকে বলল, এতক্ষণে মনে হয় টেনশান কাটছে?
ভেতরে একটা চোরা অস্বস্তি তো আছেই ক-দিন ধরে৷ জীবনে প্রথম ইলেকশান ডিউটি বলে কথা৷ লটবহর নিয়ে বাসে ওঠার পর থেকে অস্বচ্ছন্দ ভাব বেড়েছে বই কমেনি৷ হূৎপিণ্ডে একটা চোরা ধুকপুকুনি টের পাচ্ছি সর্বক্ষণ৷ তবে আমি একজন অফিসার র্যাঙ্কের লোক৷ হতে পারি চুনোপুঁটি, তাও তো অফিসার৷ একজন গ্রুপ সি স্টাফের সামনে আমার নার্ভাসনেসটা প্রকাশ হয়ে পড়লে চলবে কেন?
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, দুর দুর, টেনশান আবার কীসের? গভর্নমেন্টের কাজ, যাব, করব, চলে আসব…
—এই তো চাই৷ খামোকা ঘাবড়ানোর আছেটা কী! এ তো এখন প্রায় রুটিন জব, তাই না? বছর বছরই হচ্ছে৷ হয় স্টেট, নয় সেন্ট্রাল, নয় মিউনিসিপ্যালিটি, নয় পঞ্চায়েত… কিছু না-কিছু তো লেগেই আছে৷… জানেন, এই নিয়ে আমার ক-টা ইলেকশান হল?
—ক-টা?
—তেরোটা৷ তার মধ্যে তিনবার পঞ্চায়েত ডিউটি৷ এখন ভোট নেওয়াটা আমার কাছে জলভাত হয়ে গেছে৷
—সে আপনাকে দেখেই বোঝা যায়৷
—তা যায়৷ তবে কী জানেন বোসবাবু… প্রথমবার ভোট করার আগে আমিও খুব… ঘাবড়ে মাবড়ে পেচ্ছাপ পায়খানা বন্ধ হওয়ার জোগাড়৷ সেবার অবশ্য ডিউটিও পড়েছিল বেশ ডিসটার্বড এলাকায়৷ প্রপার হাওড়ায়৷ বেলিলিয়াস রোডে৷ আমার প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন এক অধ্যাপক৷ বয়স্ক মানুষ, তবে তাঁরও সেবার প্রথম ডিউটি৷ তিনিও বেজায় নার্ভাস, ঠকঠক করে কাঁপছেন৷ তাঁর কাঁপুনি দেখতে দেখতে আমার ভয় উবে গেল৷ সে তুলনায় আপনি তো যথেষ্ট স্টেডি আছেন৷
হাসি পেয়ে গেল৷ যাক, টেনশানটা তাহলে মোটামুটি লুকোতে পেরেছি৷ আলগাভাবে বললাম নাহ, একটু আনইজিনেস তো আছেই৷ একেবারে অজানা অচেনা জায়গায় যাওয়া… সেখানকার লোকজন কেমন হবে… আপনি কিছু খোঁজ নিয়েছেন মান্নাবাবু?
—কী ব্যাপারে?
—মানে, জায়গাটা কেমন?
—খোঁজ নেওয়ার কী আছে! আমাদের বাসের এই পাঁচটা টিমকে দেখলেই তো আঁচ করে নেওয়া যায়৷
—কী রকম?
—বাকি চারটে বুথের জন্য দুজন করে আর্মড পুলিশ, কিন্তু আমাদের জন্য সবে ধন নীলমণি ওই একটিই৷ তাও আবার ওরকম ঝিরকুটিয়া৷
—অর্থাৎ আমাদের সেন্টারটা মোটামুটি পিসফুল?
—ঠিক ধরেছেন৷ হয় খুব শান্তিপূর্ণ এলাকা, নয় পুরোপুরি এক পার্টির রাজত্ব৷ …তাও একটা কথা মনে রাখবেন, লোকাল লোকের সঙ্গে একদম নো মাখামাখি৷ পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে তো নয়ই৷ হাসিমুখে কথা বলতে পারেন, কিন্তু দূরত্ব রেখে৷ এক কাপ চা খাওয়াল, খেলেন৷ তার বেশি নয়৷
ট্রেনিং-এর প্রথম দিনটি থেকেই পাখিপড়ার মতো কথাগুলো শুনিয়ে আসছে রমেশ মান্না৷ হয়তো আমার শুভাকাঙ্খী হিসেবেই বলছে৷ কিংবা আমার বয়সটা কম দেখে নিজেকে একটু বেশি বেশি অভিভাবক ভাবছে৷ তা ভাবুক, কাল কাজটা ভালোয় ভালোয় তুলে দিলে বাঁচি৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অধিক বাগাড়ম্বর করা লোক প্রকৃত কাজের সময়ে শূন্যগর্ভ প্রতিপন্ন হয়৷
পকেট থেকে সিগারেট বার করতে গিয়েও রেখে দিলাম৷ বড্ড বেশি ধূমপান হয়ে গেছে আজ, জিভটা কষটে মেরে আছে৷ এখন একটু চা পেলে বেশ হত, কিন্তু বাস বোধ হয় কোথাও আর থামবে না৷
জানালার বাইরে চোখ ফেরালাম৷ দুপুরে চড়া তাপ আর নেই, বাইরে এখন এক মনোরম বিকেল৷ বম্বে রোড ধরে ছুটছে বাস, দু-ধারে ছোটো বড়ো মাঝারি কলকারখানা, ফাঁকে ফাঁকে সবুজ৷ গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ, হলদেটে সবুজ৷ সবুজ দুলিয়ে ফাল্গুনের হাওয়া ঝাপটা মারছে মুখেচোখে৷ ভালোই লাগছে৷ সকাল থেকে বড্ড ধকল গেছে আজ৷ চোখের পাতা জড়িয়েও আসছে একটু একটু৷ সেই কোন সাড়ে সাতটায় নাকতলা থেকে বেরোন, দশটার মধ্যে উলুবেড়িয়া হসপিটাল চত্বরে এসে রিপোর্ট করা, তারপর সমস্ত মালপত্র দেখে বুঝে নিয়ে তৈরি হওয়া…৷ নির্বাচনী বস্তায় কত রকম মাল যে থাকে৷ ছুঁচ, গুনছুঁচ, সুতো, ব্লেড, সুতালি দড়ি, নারকেল দড়ি, কালি, স্ট্যাম্পপ্যাড, রবারস্ট্যাম্প, হ্যারিকেন, তাড়া তাড়া কাগজ, কাপড়, পেরেক, গালা, ফর্ম, খাম, ভোটার লিস্ট, ব্যালট পেপারের প্যাকেট…৷ আটশো তেতাল্লিশজন ভোটারের জন্য সাড়ে আটশো ব্যালটপেপার দিয়েছে, প্রত্যেকটির নম্বর দেখে নিতে হল৷ অবশ্য রমেশ মান্না কাজে তখন সাহায্য করেছে খুব, অন্তত কী কী জিনিস মেলানোর দরকার নেই সেটা বাতলে দিয়েছে৷ তড়িৎ সাহা ছোকরাটি তো মহা ধড়িবাজ৷ শ্যামপুর ব্লক অফিসের রেকর্ড কিপার৷ চোখেমুখে কথা বলে৷ কিন্তু কাজের বেলায় ঢনঢন, ফুড়ুত ফুড়ুত উড়ে বেড়ায়৷ আর নিরাপদ তো আর এক চিজ৷ অতি নিরীহ, অতি সুবোধ, কিন্তু কোনো কথাই তার মগজে ঢোকে না৷ শুধু বিড়ি খায়, আর ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে৷ যে দুটো ব্যালটবাক্স তুলে আনল দুটোই ডিফেকটিভ৷ বদলে আনতে বলা হল, গিয়ে ভ্যাবাগঙ্গারামটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ কোন বাসটায় যাব সেটা খুঁজতে পর্যন্ত ঝাড়া এক ঘণ্টা লাগিয়ে দিল৷ এই টিম নিয়ে কাল যে আমার কী হাল হবে৷
ভাবতে ভাবতে চোখ চলে গেছে লোকটার দিকে৷ আশ্চর্য, বেমালুম ঘুমোচ্ছে৷ মাথা ঝুঁকে ঠেকে গেছে বুকের সঙ্গে, কানের পাশ দিয়ে খাড়া হয়ে আছে রাইফেলের নল, বিশ্রীভাবে লালা গড়াচ্ছে কষ বেয়ে! ছিঃ!
দুই
লোকটার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হল রাত্রিবেলায়৷
বুথে পৌঁছনোর পর থেকে সেভাবে ফুরসত পাইনি৷ একে তো পৌঁছেছি সন্ধের পর, তায় জায়গাটা একেবারে গাঁ গাঁ, বুথটাও বেজায় লঝঝরে এক প্রাইমারি স্কুলে, কোনোক্রমে চারদিকের দেওয়াল খাড়া আছে এই যা৷ মোটামুটি নিজেদের স্থাপন করতেই ঘন্টা দুয়েক লেগে গেল৷ কোথায় কালকে ব্যালটবক্স রাখার জায়গা করা হবে, রাত্রে আমরা গড়াব কোথায়, জিনিসগুলো এখন কীভাবে রাখলে ভালো হয়, তারপর জল বাথরুম পায়খানার বন্দোবস্ত, রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করা৷ এবং আলো৷ আলোর জোগাড় হল একটু বাঁকা পথে, সরাসরি ইলেকট্রিক লাইন থেকে হুক করে৷ গণতন্ত্রের সেবায় এসেছি আমরা, এইটুকুনি বেআইনি কাজ তো ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না৷ প্রতিটি বুথের জন্য একজন করে সাইকেল মেসেঞ্জার ঠিক করা আছে, বেকার যুবকটি দু-দিনের চাকরি পেয়ে বেজায় গদগদ, বাধ্য দাসের মতো হুকুম তামিল করে চলেছে৷ রমেশ মান্নার ফরমাশ মতো কোনো এক ডেকরেটারের দোকান থেকে স্ট্যান্ডফ্যানও জোগাড় করে আনল৷ বেঞ্চি সজিয়ে, ফ্যান চালিয়ে ঘুমনোর তোফা আয়োজন, আর কী চাই!
স্থানীয় মাতববররা এসে আগেই দেখা করে গেছে৷ পার্টির লোক, এমনি প্রভাবশালী লোক৷ প্রত্যেকেরই এক কথা, অনন্তখোলার মতো শান্তিপ্রিয় গ্রাম গোটা হাওড়া জেলায় আর দুটো নেই৷
শুনে খানিকটা ভরসা পাওয়া গেল৷ তবে রমেশ মান্না কানের কাছে পিনপিন করে চলেছে, পরের মুখে ঝাল খাবেন না বোসবাবু৷ ফলেন পরিচিয়তে৷ সেবার আমার ভাটোরায় ইলেকশান ডিউটি পড়েছিল, শুনেছিলাম দেউলগাছি মৌজার মতো শান্ত জায়গা নাকি ভূভারতে নেই, অথচ ভোটের দিন লঙ্কাকান্ড হয়ে গেল৷ কাল দিনের আলো ফুটতে দিন, যা বোঝার সরেজমিনে বুঝে নেব৷
তা রমেশ মান্না যতই কু গাক, মনে মনে একটু স্বস্তি নিয়েই কাজে বসলাম৷ তড়িৎ আর নিরাপদ দু-খানা টেবিলে চট ঘিরে ব্যালটপেপারে ছাপ মারার জায়গা গড়ে ফেলেছে৷ হ্যারিকেনের জন্য তেল এনে দিয়েছিল সাইকেল মেসেঞ্জার, চটঘেরা জায়গা দুটোতে কাল আলো দিতে হবে৷ বাড়িয়ে কমিয়ে দুটো হ্যারিকেনই পরীক্ষা করে নিল রমেশ৷ হোমগার্ড ছেলে দুটিও বসে নেই৷ অতিরিক্ত বেঞ্চি হাইবেঞ্চি বার করে দিয়েছে সামনের মাঠে, ঘর-টরগুলো সাফসুতরো করছে৷
হাজার গণ্ডা ফর্ম ভরতে হবে কাল৷ সইসাবুদগুলো সেরে রেখেছি, নৈশাহার এসে গেল৷ মেনু মন্দ নয়, ভাত ডাল ঝিরিঝিরি আলুভাজা, চিকেন৷ খেতে খেতে হালকাভাবে মার কথা মনে পড়ল৷ খুব কি দুশ্চিন্তা করছে আজ? নিশ্চয়ই টিভি খুলে বারবার খুঁজছে হাওড়ার কোথাও কোনো গণ্ডগোল হল কিনা৷ বলেছিল পারলে একবার রাতে ফোন করিস৷ এই অজ গাঁয়ে কোথায় ফোন খুঁজব?
স্কুলের সামনে ফালি মাঠ৷ একপাশে ছোট্ট পুকুর৷ খাওয়া সেরে পায়ে পায়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়েছি৷ হাওয়া বইছে মৃদুমন্দ৷ দখিনা বাতাস৷ হূদয় জুড়ানো৷ মনে মনে ভাবছি কাল কতক্ষণে দায় উদ্ধার করে বাড়ি পালাব৷
সিগারেট শেষ করে ফিরছি, ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেলাম৷ দাওয়ার কোণে কে ওভাবে কোলকুঁজো হয়ে বসে? বুড়ো পুলিশটা না? উর্দি টুপি ছেড়ে লুঙ্গি পড়ে নিয়েছে, খালি গা… একে এখন সুদূর কল্পনাতেও আরক্ষি ভাবা কঠিন৷
কী মনে হল পায়ে পায়ে কাছে গেলাম, কী করছেন এখানে বসে?
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল লোকটা, আজ্ঞে স্যার, একটু টান মতো উঠছিল৷ তাই হাওয়ায়…
—আপনার অ্যাজমা আছে নাকি?
—না মানে তেমন কিছু নয়… শুধু এই গরম শীতের মধ্যিখানে একটু…
—সর্বনাশ, কাল তাহলে আপনি ডিউটি করবেন কী করে?
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা টানটান৷ হাড়ের খাঁচা প্রকট হয়েছে আরও৷ তড়িঘড়ি বলে উঠল, না স্যার, ডিউটি আমি ঠিক ঠিক করে দেব৷ একটু ঘুমিয়ে নিলেই দেহ টাটকা হয়ে যাবে৷
—দেখবেন, ডোবাবেন না৷ সিগারেট ধরালাম আর একটা৷ আলগাভাবে জিজ্ঞেস করলাম, চাকরি আর কদ্দিন আছে আপনার?
—চাকরি তো নেই স্যার৷ আমি তো রিটায়ার হয়ে গেছি৷
—সে কী! আমি রীতিমতো চমকিত, তাহলে ডিউটিতে এলেন কী করে?
—ভোটের জন্য কল দিল স্যার৷ পুলিশ কম পড়েছিল…
—এরকম আবার হয় নাকি?
—হয় স্যার৷ আমি তো আগের ইলেকশানেও ডিউটি করেছি৷ তবে এমনি এমনি ডাকে না স্যার, নিজেকেও একটু তদ্বির করতে হয়৷
—স্ট্রেঞ্জ৷… কত দিন হল রিটায়ার করেছেন?
—আজ্ঞে সাড়ে পাঁচ বছর৷
অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী লোকটার বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি? উঃ এখানেও জল মেশানো আছে৷ সত্তরের কম হতেই পারে না৷
আমার ক্ষণিক নীরবতায় লোকটা যেন আশঙ্কিত হয়েছে সামান্য৷ গলা ঝেড়ে বলল, শরীরস্বাস্থ্য কিন্তু আমার এমনি ভালো আছে স্যার৷ হাঁপটাও আগে তেমন ছিল না, বার চারেক ম্যালেরিয়া হওয়ার পর দেহ একটু কাহিল হয়েছে, এই যা৷
—তা এই শরীরে তদ্বির করে ডিউটি নেওয়ার কী দরকার ছিল? পেনশন পাচ্ছেন তো, না কী?
—তা পাচ্ছি৷
—তাহলে? রিটায়ার করেছেন, কোথায় ঘরে শুয়ে বসে কাটাবেন, নাতিনাতনির সঙ্গে খেলবেন, ধর্মকর্ম করবেন তা না… বাই দি বাই, আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি এখনও৷
—আমার নাম স্যার শুকদেব৷ শুকদেব ব্রহ্মচারী৷
বেড়ে নাম তো৷ শুধু শুকদেব নয়, আবার ব্রহ্মচারীও৷
হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কোথায়?
—রসুলি৷ বাগনান থেকে চোদ্দো কিলোমিটার৷
—অ৷… তা ব্রহ্মচারী মশায়ের ছেলে-মেয়ে ক-টি?
—আজ্ঞে, সাত৷ ছয় মেয়ে, এক ছেলে৷
—বলেন কী, অ্যাঁ? আমি প্রায় আঁতকে উঠলাম৷ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকুরে হয়ে পৌনে দু-গণ্ডা বালবাচচা পয়দা করেছেন আপনাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত৷ কথাটা হাস্যকর শোনাবে বলে কোনোক্রমে সামলে নিয়ে বললাম, এতগুলো?
—মা ষষ্ঠীর কৃপা স্যার৷ তিনি শুধু পর পর মেয়েই দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ বংশরক্ষা হচ্ছিল না৷… শেষে, ছেলে দিলেন সেই আট নম্বরে গিয়ে৷ মাঝে একটি মেয়ে তো আঁতুড়েই…৷
ঘর থেকে বিজলিবাতির চিলতে আলো এসে পড়েছে শুকদেবের মুখে, সেই মুখ পলকের জন্য মলিন যেন আবার পলকেই উজ্জ্বল, ছেলের আমার খুব মাথা হয়েছে স্যার৷ অষ্টম গর্ভের সন্তান তো৷… প্রতিবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়! এ বছর তো নাইনে উঠেছে৷
আহা, শ্রীকৃষ্ণের গৌরবে গর্বিত পিতা বাসুদেব যেন! বললাম বাহ৷ তা মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন?
—বড়ো তিনটে ইস্কুল পাস করেছিল, বাকি তিনটেকে আর অদ্দূর টানতে পারলাম না৷
—কেন?
—মাথা ছিল না স্যার৷
সেই চিরন্তন বাহানা৷ গলা ভারী করে বললাম, মাথা ছিল না, নাকি পড়ালেন না?
—পড়িয়ে কী সুসারটা হবে স্যার? আয় তো আর হবে না, শুধুই ব্যয়৷ মেয়েদের বিয়ে দিতে দিতেই তো সর্বস্ব গেল৷ এখনও দু-দুটো বাকি রয়ে গেছে৷ কীভাবে যে কী হবে! রিটায়ার করে যে কটা টাকা পেলাম সেজো আর সানোকে পার করতেই… বড়ো চাপে আছি স্যার৷
বলে কী লোকটা? রিটায়ারমেন্টের টাকাটুকুই শুধু সম্বল ছিল? সারাজীবন পুলিশে চাকরি করেও ব্যাটা টু পাইস কামায়নি? ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির ছিল নাকি?
শুকদেব বুঝি মনের কথাটা ধরে ফেলেছে৷ কেশবিরল মস্তকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, মিথ্যে বলব না স্যার, চাকরিতে উপরি কিছু ছিল৷ তাতেই মেয়েগুলো তাও পার হয়েছে, একটুআধটু জমিও কিনতে পেরেছি৷ এই বিঘে দুয়েক মতো৷ কিন্তু কপালের লিখন কে খণ্ডাবে স্যার? গেলবারের আগেরবার বন্যা হল খুব… রূপনারাণে… পুরো জমি বালিতে ভরে গেল৷ পলি নয় স্যার, বালি৷ মোটা দানার বালি৷ কোত্থেকে এল কে জানে৷ কপিটা, মুলোটা, বেগুনটা হত, ধানও উঠত একবার… দু-সন কেনো চাষ নেই৷ পাঁচ পাঁচটা পেট পালতে গিয়ে এখন পাগল হওয়ার জোগাড়৷ চালটা এ বছর ছাইব ভেবেছিলাম, দেখি এই ডিউটির টাকায় কদ্দুর হয়!
বেচারা৷ যেন পুলিশ নয়, যেন সংসারের ভারে ন্যুজ এক গরিব বৃদ্ধ৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলছে৷
শুকদেব মৃদুস্বরে বলল, স্যার, একটি আর্জি রাখব?
—কী?
—না বলতে পারবেন না স্যার৷
—বলুন তো আগে৷ শুনি!
শুকদেব ইতিউতি চাইল৷ পোলিং পার্টির বাকি সবাই ঘরে এখন গজল্লা চালাচ্ছে জোর, এখান থেকেও গলা পাওয়া যাচ্ছে৷ বিশেষ করে ওই তড়িৎ সাহার৷ ওদের কানে আমাদের বাক্যালাপ যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু শুকদেবের গলা অস্বাভাবিক নেমে গেল, কাইন্ডলি… হ্যারিকেন দুটো আমায় দেবেন স্যার?
—কোন হ্যারিকেন?
—বুথের৷ শুকদেব হাত কচলাচ্ছে, আমার পরিবার স্যার পইপই করে হ্যারিকেন দু-খানা নিয়ে যেতে বলেছে৷
—কিন্তু ও তো ইলেকশানের মাল৷ ফেরত দিতে হবে৷
—ওরকম বললে আপনি বলে দেবেন ড্যামেজ৷ শুকদেবের মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল, ওরা স্যার খুশিই হবে৷ বছর বছর ইলেকশান, বছর বছর হ্যারিকেন কেনা… ওদেরই তো পোয়া বারো স্যার৷ দুটো পয়সা আসা-যাওয়া করে৷
হুম৷ এই ভোট মহাযজ্ঞে কতজনের যে কতভাবে বরাত খোলে৷ হয়তো লণ্ঠনের অর্ডার ধরেই কোনো সাপ্লায়ার লাল হয়ে গেল৷ তার থেকে গুঁড়োগাঁড়া কমিশান এলেও…
বাঁকা হেসে বললাম, আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে৷
—আপনি কিন্তু কথা দিলেন স্যার৷ শুকদেবের গলা আবার খাদে৷ প্রায় ফিস ফিস করে বলল, নিরাপদ বারুই হ্যারিকেন দুটো টার্গেট করেছে স্যার৷ ফার্স্ট পোলিংকে বলছিল, আমি স্বকর্ণে শুনেছি৷
—তো?
—আপনি আগে থেকে কাউকে কিছু বলবেন না স্যার৷ জানলে হয়তো চিমনি ভেঙে রেখে দেবে৷
—কেন, ভাঙবে কেন?
—নিজে পেল না তাই৷… গতবার প্রিসাইডিং অফিসার আমাকেই দিয়েছিলেন বলে থার্ড পোলিং কাচ ফাটিয়ে রেখেছিল৷
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ স্যার৷ শুকদেবের গলায় কাকুতি, আমার কথাটা ভুলবেন না স্যার৷ আমার পরিবার কিন্তু হ্যারিকেন দুটোর জন্য অপেক্ষা করে আছে৷
গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেললাম৷ ইলেকশানের দিন কত মানুষ যে কত কিছুর অপেক্ষায় থাকে!
তিন
অনন্তখোলা সত্যিই শান্তিপূর্ণ জায়গা৷ সকাল সাতটায় ভোট শুরু হয়েছিল, বারোটার মধ্যে প্রায় পাঁচশো ভোট পড়ে গেল৷ নারী পুরুষ আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে, তবে মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবে৷ বাইরে হোমগার্ড দুটোর প্রায় কিছুই করার নেই৷ তারা অলস মেজাজে লাঠি হাতে ঘুরছে মাঠটায়৷ শুকদেবও দিব্যি নিশ্চিন্ত, বন্দুকখানা দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে পায়চারি করছে৷
ঘরের ভেতরেও বেশ মাখো মাখো পরিবেশ৷ এখানে লোকসভার প্রার্থী আছে তিনজন৷ পার্টির পোলিং এজেন্টরা নিজেদের মধ্যে গল্পগাছা করছে৷ আমাদের বেশ কয়েকবার চাও খাওয়াল৷
পৌনে একটা নাগাদ বুথ প্রায় ফাঁকা৷ দু-পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর এক-আধজন ভোটার আসছে, ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছে৷ চাপ নেই দেখে রমেশ আর তড়িৎ খেতে চলে গেল, পাশেই একটা দোকানে৷ আমারও মানসিক জড়তা সম্পূর্ণ কেটে গেছে, নিজেই সামলাচ্ছি ওদের কাজ, ওরা ফিরলে আমিও টুক করে ভোজনটা সেরে আসব৷
ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটি চেঁচামেচির আওয়াজ৷ দ্যাখ না দ্যাখ জনা আট দশ লোক এক বছর কুড়ির ছেলেকে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে ঘরে নিয়ে এল৷
দলের একজন চড়া স্বরে বলল, এসব হচ্ছে কী, অ্যাঁ? ভোট নিতে এসেছেন, না ছেলেখেলা করছেন?
রমেশ মান্নার শিক্ষামতো গলা চড়িয়ে বললাম, কেন হয়েছেটা কী? আপনারাই বা বুথের ভেতরে ঢুকেছেন কোন রাইটে? উইদাউট মাই প্রায়র পারমিশান?
—অ্যাঁ, অ্যাঁহ, রাইট মারাচ্ছে! আর একজন চোখ লাল করে খেঁকিয়ে উঠল, এই যে ছেলেটা তিন তিনবার ভোট দিয়ে গেল, দেখতে পারেননি? চোখে ঠুলি পরেছিলেন?
ঝলকে দেখলাম ছেলেটাকে৷ সত্যি দিয়েছে নাকি? টের পাইনি তো? শ্যামলা রং, বেশ ভালোমানুষ ভালোমানুষ মুখ… দেখেছি কি একে আগে? উঁহু, মনে করতে পারছি না তো৷
গলার স্বর একইরকম উচচগ্রামে রেখে বললাম, ওভাবে চোখ পাকিয়ে কথা বলছেন কেন? আমি প্রত্যেককে চিনে রাখব কী করে?… আপনাদের পোলিং এজেন্ট তো বসে আছে, সে কিছু বলেনি কেন?
অমনি পড়াং করে লাফিয়ে উঠেছে এক পোলিং এজেন্ট৷ খানিক আগেও মুখে বেশ হাসি খেলছিল তার, হঠাৎই চোয়াল শক্ত৷ বেমালুম বলে দিল, আমি তো অনেকক্ষণ ধরেই অবজেকশান দিচ্ছি৷ আপনারা তো কেউ শুনছেনই না৷
কেমন যেন গুলিয়ে গেল সব৷ হতভম্ব মুখে বললাম, আপনি কখন বললেন? কখন প্রোটেস্ট করেছেন?
—করেছি তো৷
পাশের পোলিং এজেন্ট চুপচাপ নাটক দেখছিল এতক্ষণ৷ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এ স্যার পুরো জালি কেস৷ নিজেদের লোককে সাজিয়ে এনেছে৷ একটা ঝামেলা পাকানোর জন্যে৷
—শালা আমরা ঝামেলা পাকাচ্ছি? বলতে বলতে একজন আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে গেল ছেলেটার দিকে, বুকের পাটা থাকে তো বাইরে আয়, থেঁতো করে দিচ্ছি৷
সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন আমার মুখের সামনে আঙুল নেড়ে শাসাতে শুরু করেছে, এক্ষুনি একে অ্যারেস্ট করতে হবে৷ অ্যাট ওয়ান্স৷
আমার হাঁটুর জোর এবার কমে এসেছে৷ তবু বললাম, ও যে তিনবার ভোট দিয়ে গেছে তার প্রমাণ কী?
—আমরা বলছি সেটাই প্রমাণ৷ সাহস থাকে তো অস্বীকার করুক৷ বলতে বলতে ছেলেটার কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে এক ষণ্ডামার্কা, কী রে, বল বল… ক-বার ছাপ মেরে গেছিস বল৷
গতিক সুবিধের নয়৷ ছেলেটা বোবা হয়ে আছে৷ অ্যারেস্ট-ম্যারেস্ট কী করব? কীভাবে করব?
পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে গলা মোলায়েম করলাম, ছেড়ে দিন না ভাই৷ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, বাইরে গিয়ে মিটিয়ে নিন না৷
—অ৷ তার মানে আপনি কিছু করবেন না? তাহলে ভোট নেওয়ার প্রহসনটা করছেন কেন? নিতে হবে না আর ভোট, বন্ধ থাকুক৷
আর একদল উচৈচঃস্বরে নিনাদ করতে করতে আসছে বাইরে থেকে৷ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কয়েকজন, তীব্র স্বরে বচসা চলছে দু-পক্ষের৷ ভালো মতো ভিড় জমে গেছে একটা, দক্ষযজ্ঞ প্রায় বাধে বাধে৷
আমার একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা, দুই হোমগার্ড সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিরাপদ সিটে বসে কাঁপছে ঠক ঠক৷ শুকদেবকে দেখা যাচ্ছে না৷ ভয়ে সে কোথাও লুকিয়ে পড়ল নাকি?
তখনই তীক্ষ্ণ গলায় হুংকার শোনা গেল, খবরদার৷
উত্তেজিত জনগণ যেন থমকে গেছে সহসা৷
রাইফেলের ভারে কেতরে গেছে শুকদেব, কিন্তু টাট্টুঘোড়ার মতো পা ঠুকছে মাটিতে, হচ্ছেটা কী এখানে? ইলেকশানের কাজে বাধা দেওয়া? ভিড় পাতলা করুন, ভিড় পাতলা করুন৷
—অ্যাই, ফুঁকো সেপাইটার ডায়ালগ শোন৷
—কে? কে বলল কথাটা? ঝটাক ঘুরে দাঁড়িয়েছে শুকদেব, পুলিশের সঙ্গে রোয়াব? স্যার, আপনি একবার অর্ডার করুন তো…
কী আদেশ দেব জানি না, কিন্তু কিমাশ্চার্যম, লোকগুলো সত্যি সত্যি সরতে শুরু করেছে৷ রমেশ, তড়িৎও ছুটতে ছুটতে এসে পড়েছিল, রমেশ হাতমুখ নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে সকলকে৷ তড়িৎও৷ হোমগার্ড দুটো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল৷ লাঠি হাতে গলাখাঁকারি দিচ্ছে, আওয়াজও ছাড়ছে মাঝে মাঝে৷
শুকদেবের গর্জন থামে না৷ বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে গেল, হঠ হঠ হঠ সব৷ যা করতে হয় বুথের থেকে দু-শো গজ দূরে গিয়ে… যান যান৷
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভিড় সাফ৷ হট্টগোলের রেশ একটা কিছুক্ষণ রইল বটে, ক্রমশ সেটাও মিলিয়ে গেল৷ আবার ভোটার আসছে, ভোট চলছে৷ পোলিং এজেন্টদের মুখে আর হাসি নেই, যে যার কাজ করছে যন্ত্রের মতো, কাজ না থাকলে কাঠ কাঠ মুখে বসে আছে স্থির৷
শুকদেব দরজায় দাঁড়িয়ে৷ নড়ছে না৷ হাত খালি হতে রমেশ মান্না উঠে এল আমার সামনে৷ নীচু গলায় বলল, দেখলেন তো, খুচরো ঝামেলা একটা হয়েই গেল৷
খিদে তেষ্টা মরে গেছে আমার৷ ভেতরে এখন শুধু পালাই পালাই ভাব৷ বেজার মুখে বললাম, একে আপনি খুচরো বলছেন? কী অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠেছিল লোকগুলো৷
—আরে দুর দুর, তেমন জাত-বদমাইশ হলে আমরা কি ওদের তাড়াতে পারতাম?
—আমরা বলছেন কেন? বলুন শুকদেব৷ না বলে পারলাম না, আপনারা তো দিব্যি আমাকে একা ফেলে কেটে গিয়েছিলেন৷
রমেশ যেন সামান্য আহত হল৷ গোমড়া মুখে বলল, ওর তো কাজই ওই সব সিচুয়েশান ফেস করা৷
—তবু লোকটার সাহস আছে বলতে হবে৷ ওই বুড়ো মানুষ একা হটিয়ে তো দিল৷
—ও হটায়নি, ওর বন্দুক হটিয়েছে৷ পাবলিক ওই রাইফেলের নলটাই চেনে, কে পেছনে আছে দেখে না৷
—সে যাই বলুন গর্জে তো উঠেছে৷
—ও কি আর গর্জেছে, গর্জন করেছে ওর উর্দি৷ তড়িৎ পাশ থেকে ফোড়ন কাটল, খাকি উর্দির একটা আলাদা পাওয়ার আছে না?
—তার ওপর বুড়ো একদিনকা কোটাল বনেছে৷ রমেশ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, রাইফেল হাতে পেলে ওর জোশ তো এখন পাঁচগুন বাড়তে বাধ্য৷
কথা বাড়াতে আর ইচ্ছে হল না৷ মহিলা ভোটারও এসে গেছে দুজন, রমেশ তড়িৎ কাজে ব্যস্ত আবার, উঠে বাইরে এসে সিগারেট ধরালাম৷ শক্ত হাতে রাইফেল ধরে শুকদেব এখনও দরজায়৷ গুটগুটে পাঁজরাসর্বস্ব তালপাতার সেপাইটির মধ্যে সত্যিই যেন এক বলদৃপ্ত ভাব জেগে উঠেছে৷ শিরদাঁড়া এখন একেবারে সোজা টানটান৷ শুকদেব কি সত্যিই সাহসী? নাকি হারিয়ে যাওয়া ক্ষমতা ক্ষণিকের জন্য ফিরে পেলে মানুষ এভাবেই উদ্দীপিত হয়?
শুকদেবকে চিনতে পারছিলাম না৷ কালকের লোকটা আর আজকের লোকটা কি এক?
চার
অন্ধকার নেমে গেছে অনেকক্ষণ৷ ব্যালটবাক্স বাঁধাছাঁদা করে রেডি হয়ে গেছি, কিন্তু আমাদের বাসের এখনও দেখা নেই৷ বুথের বাইরে অপেক্ষা করছে একটা ছোট্ট জনতা, আমাদের রওনা না করিয়ে তারা নড়বেই না৷ আমরা ভোটবাবু বলে কথা৷
সারাদিন নিরাপদকে বিশেষ কথা বলতে দেখা যায়নি, এখন যেন সে ঈষৎ চঞ্চল৷ একবার হোমগার্ডদের সঙ্গে গিয়ে গুজগুজ করছে৷ একবার তড়িৎ সাহার সঙ্গে৷ বসে থাকতে থাকতে কোমর ধরে গেছে, ভাবছি আর একবার চায়ের অর্ডার দেব কিনা৷
গুটিগুটি পায়ে নিরাপদ এসে সামনে দাঁড়াল৷ অনেকটা ঝুঁকে, প্রায় আমার কানে কানে অভিযোগ পেশ করল, ওই শুকদেব কনস্টেবল কিন্তু খুব অন্যায্য কাজ করেছে স্যার৷
—কেন, কী করল? যেন কিছুই জানি না এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম৷
—কাল পাঁচ লিটার কেরোসিন কেনা হয়েছিল৷ দু-লিটারের মতো তেল বেঁচেছিল, ওই বুড়ো পুরোটা মেরে দিয়েছে৷ নিরাপদ গজগজ করে উঠল, তেলটুকু কি আমি পেতে পারতাম না স্যার?
ও, এই ব্যাপার৷ লণ্ঠন প্রাপ্তির আশায় আশায় তেলটাও গেঁড়িয়েছে৷ নাহ বুড়োকে যতই দেখছি, মোহিত হচ্ছি৷ ডেকে একটু দাবড়াব? তুৎ, এই মুহূর্তে সামান্য কেরোসিন তেল নিয়ে কুটকচালি ভাল্লাগছে না৷ তা ছাড়া বুড়ো আজ…
বিরক্ত মুখে বললাম, যাও তো৷… আমি মরছি নিজের জ্বালায়! বেশি রাত হয়ে গেলে উলুবেড়িয়া থেকে ট্রেন পাব কিনা ঠিক নেই…
রমেশ মান্না খানিক তফাতে৷ বেঞ্চিতে বসে ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন৷ উদবিগ্ন মুখে বলল, শেষরক্ষা বোধ হয় হল না বোসবাবু৷ নির্ঘাত অন্য কোনো বুথে ক্যাচাল হয়েছে৷
—বলছেন?
—নইলে বাস এত দেরি করে? চারটে পোলিং পার্টিই তো পাশাপাশি গ্রামের, এতক্ষণে সকলকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এসে যাওয়া উচিত ছিল৷ রমেশ আর একবার ঘড়ি দেখল, একটা কথা কিন্তু আমি আগে থাকতে বলে রাখছি বোসবাবু৷ কুলগাছিয়ার মোড়ে আমি নেমে যাব?
—আমার সঙ্গে উলুবেড়িয়া অবধি যাবেন না?
—কী হবে গিয়ে? উজান বেয়ে আবার এতটা পথ আসা…
—কিন্তু মালপত্র নিয়ে আমি একা…
—আপনি পারবেন স্যার৷ ইয়াং ম্যান, এত স্মার্ট লোক৷ রমেশ একগাল হাসল, কত বড়ো একটা ঝামেলা আপনি সামলে দিলেন…
শালা অয়েল করছে৷ কাল থেকে সারাক্ষণ বোসবাবু, বোসবাবু করে এখন শেষবেলায় স্যার! কাজে অনেক সাহায্য করেছে ঠিকই, তবে নিজের ধান্দাটি ঠিক বোঝে৷ রাতের খাওয়াটা কনটিজেন্সির টাকায় চালিয়ে দিল, চা খেয়েছে অন্তত পনেরোবার, একবারের জন্য উপুড়হস্ত করেনি৷ এখন আমায় ফেলে রেখে কাটবে, যেন গৃহসুখে কমতি না হয়৷
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, যা ভালো বোঝেন…৷
বলতে না বলতেই বাসের আবির্ভাব৷ গণ্ডগোল তেমন হয়নি কোনো বুথেই, শুধু এক জায়গায় সাড়ে এগারোশো ভোটার ছিল, ভিড় সামলাতে প্রিসাইডিং অফিসার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সামান্য, ঘাবড়ে-মাবড়ে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে বাথরুমে, তাই এই দেরি৷
ঝপাং ঝপাং বাক্স উঠে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে আমরাও৷ ব্যস, এবার প্রত্যাবর্তন৷ সমবেত কন্যাপক্ষকে টা-টা করে বরযাত্রীর বিদায়৷
বাসে কিচকিচ কলকল হচ্ছে খুব৷ এ পোলিং পার্টি, ও পোলিং পার্টিতে গল্প চলছে, সঙ্গে টুকরো-টাকরো চুটকি রসিকতা৷ রমেশ মান্নার মতো আরও কয়েকজন নেমে যাবে পথে, তারা গিয়ে কন্ডাকটরের সঙ্গে ভাব জমাল৷ শ্রান্তিতে ঢুলছে কেউ কেউ৷ কেউবা সেবন করছে দখিনা বাতাস৷
শুকদেব এবারও বাসের পিছনের সিটে৷ হোমগার্ড দুজন আছে শুকদেবের পাশে৷ তবে তারা এখন আর বুড়োকে নিয়ে ইয়ার্কি-ফাজলামি করছে না৷ কেরোসিন ঝাড়ুক আর যাই করুক, শুকদেবের দুপুরের মূর্তি বুঝি ওদের সমীহ আদায় করে নিয়েছে৷
সরু ভাঙাচোরা পিচরাস্তা৷ দু-ধারে বাঁশবন, আমজাম, কাঁঠালের জমাট অন্ধকার৷ পুকুর, ডোবা, ধানখেত৷ বাস চলছে ঢিকুর ঢিকুর৷ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে৷ আকাশে চাঁদ উঠেছে একটা৷ অর্ধবৃত্তাকার চাঁদ৷ চরাচরে মিহি জ্যোৎস্না৷
হাইওয়েতে পড়ার পর বাসের গতি মসৃণ হল৷ কোমল বাতাসে লেগে এসেছিল চোখের পাতা, তড়িতের ডাকে চটকা ভাঙল, উঠুন স্যার, এসে গেছি৷
চোখ রগড়ে সোজা হলাম৷ কবজি উল্টে দেখে নিলাম সময়৷ ন-টা৷ খুব রাত হয়নি তো!
নিরাপদ ব্যালটবাক্স তুলে নিয়েছে কাঁধে৷ বাকি মালপত্র সাপটে-সুপটে নিয়ে বললাম, চলো চলো৷
রমেশ মান্না তো মাঝপথেই ভাগলবা তড়িৎও কাউন্টারে পৌঁছে দিয়ে পলকে ভ্যানিশ৷ ছোট্ট লাইন, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হোমগার্ড দুটো ডিউটি কাগজে সই করিয়ে নিয়ে ধাঁ৷ পাশে শুধু লটবহরের জিম্মাদার হয়ে নিরাপদ৷ আর পিছনে পাহারাদার শুকদেব৷
মিনিট কয়েক যেতে না-যেতে নিরাপদও ঘাড় চুলকোচ্ছে, আমি কি এবার যেতে পারি স্যার?
—যাবে?… যাও৷
মুক্তি পেয়েও সঙ্গে সঙ্গে নড়ল না নিরাপদ৷ শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশে রাখা মালের বস্তাটার দিকে৷ কী যেন বলি বলি করেও বলল না৷ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চলে গেল, ধীর পায়ে৷ হ্যারিকেন দুটোর কথা বলতে চাইছিল কি?
দরকার নেই বাবা ঝুটঝামেলায়, সরকারি মাল সরকারকে জমা দেওয়াই ভালো৷ সেটাই উচিত কাজ৷
কাউন্টারে বুঝিয়ে দিচ্ছি কাগজপত্র, বস্তাটাও দিয়ে দিলাম৷ খুলে মেলাচ্ছে একজন৷ হঠাৎ বলে উঠল, আপনার হ্যারিকেনগুলো কোথায়?
আমি যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট৷ প্রাপ্তিযোগের ঠাণ্ডা লড়াই সামলাতে নিজের হাতে থলিতে ভরেছিলাম লণ্ঠন দুটো, গেল কোথায়?
ঝটিতি পিছনে তাকিয়েছি৷ এ নির্ঘাত শুকদেবের কাজ৷ ব্যাটা না বলে হাতিয়ে নিল?
শুকদেবের পায়ের কাছে শতরঞ্জিতে বাঁধা বেডিং, হাতে একটা ঝোলা৷ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মুখটা পুরো গোরুচোরের মতো হয়ে গেল৷ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ কাঠি কাঠি আঙুলগুলো বুকের কাছে জড়ো করল প্রার্থনার ভঙ্গিতে৷
মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার৷ দেব ধরিয়ে ব্যাটাকে?
কী জানি কেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কী যে সব রদ্দি মাল দেন! ভেঙে গেছে৷
কাউন্টারের লোকটা অস্ফুটে কী একটা বলল, আমল দিলাম না৷ বেরিয়ে আসছি৷ গেটের কাছে গিয়ে ঘুরে তাকালাম একবার৷ কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে আছে শুকদেব ব্রহ্মচারী৷
শীর্ণ হাত তুলে স্যালুট করল বন্দুকধারী৷
আমার গা শিরশির করে উঠল৷
এই আমাদের গণতন্ত্রের সেপাই৷ আমার ভারতবর্ষ৷