গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে – ৫

ওর পাগলামির লম্বা কৈফিয়ত 

মিনু বেশ ভয় পেয়ে গেছে। ওর চোখে মুখে বেশ উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি জানি, ও ভাবছে আমার মাথা খারাপ হয়েছে। এখনই ও বাড়ি যেতে চাইবে। তার আগেই আপনাদের আমার কথাটা জানিয়ে দিতে চাই। আপনারা, যারা আমাদের দু’জনকে এই ব্রিজের উপর উঠে আসতে দেখেছেন এবং এতক্ষণ ধরে আমাদের হাবভাব বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করছেন, সেই তাদের কাছেই আমার প্রশ্ন, আপনারা নিশ্চয়ই মিনুর মত, মানে আমার বউ-এর মত আমাকে পাগল ভাবছেন না। ভাববার কোনও কারণ নেই। আমি সত্যিই স্বাভাবিক। আপনাদের মতই সাধারণ। অনেক দূর থেকে, উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণে বউভাতের নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলাম। এটা নিশ্চয়ই পাগলামি নয়। এসেছিলাম বউকে সঙ্গে নিয়ে। বউকে একটু সঙ্গ দেবার ইচ্ছে জেগেছিল। এটা কি পাগলামি? এ বাড়িতে আসার ইচ্ছে ওর ছিল না। কাউকে চেনে না তো। তাই আসতে ও চায়নি। আমি একরকম জোর করেই ওকে নিয়ে এসেছি। মিনুর অসুখ আমি বুঝতে পারি। সংসারের সমস্ত ঝক্কি সে সামলায়। আর আজকাল কলকাতা শহরে যেখানে দ্রব্যমূল্য সতত অস্থির সেখানে একমাত্র অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর সকলের পক্ষেই সংসারের লগি ঠেলা রীতিমত স্নায়ুবিধ্বংসী ব্যাপার। মিনু যেহেতু একেবারেই সাধারণ মেয়ে কাজেই তার পক্ষে এই ব্যাপারটা ভারতের বৃহত্তর পটভূমিকার প্রেক্ষিতে বিচার করে দেখা সম্ভব নয়। তার কাছে এটা আশা করা অন্যায়। আমি আশা করিও না। তাকে সংসার চালাতে হয়। এবং সে সংসার চালায় বলে সকলেই তার কাছে অযৌক্তিক দাবির ফর্দ তুলে ধরে, এমন কি, আমিও কবুল করছি, আমিও। স্বভাবতই সে কাউকে খুশি করতে পারে না। এবং সে সঙ্গতভাবেই ভেবে দ্যাখে, তার কোনও দোষ নেই। সত্যিই নেই। আমার কাছ থেকে সে যেরকম টাকা পাবে, সে তো সেইভাবেই চালাবে। অতএব দোষ যদি কাউকে দিতে হয় তবে আমাকেই দিতে হয়। এবং আমাদের সংসারে এক মিনু ছাড়া আমাকে কেউ দোষ দেয় না। সবাই মিনুকে দোষে। 

এবার অনুগ্রহ করে আমার দিকটা দেখুন। আমি বেতন যেরকম পাব, সেইমতো টাকাই তো সংসারে দেব। তাতে যদি আমার সংসারের অভাব না মেটে তো আমার আর কী করার থাকতে পারে। কথাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। এইরকম যুক্তি-শৃঙ্খল ধরে আমরা যদি ক্রমশ এগোই তবে দেখবেন, আমরা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটের সামগ্রিক এক মসীময় চিত্র এঁকে ফেলতে পারব। এবং এই জটিল গোলকধাঁধা আমাদের উত্তরোত্তর হতাশ করে তুলতে সহায়ক হবে। এবং এই বিরাট কৃষ্ণবর্ণ এক হতাশার আকাশতলে দাঁড়িয়ে আমাদের কারওই আর বাঁচার ইচ্ছা থাকবে না। কিন্তু তথাপি আমরা বেঁচে থাকছি। এবং আছি সংসার নামক এক অতি বাস্তব আধারের মধ্যে, যার আপাত অস্তিত্ব যন্ত্রণাদায়ক। আচ্ছা, এবার বলুন, কেউ যদি এই সংসারে থেকে বলে, আমি ভালবাসব, সেটা কি পাগলামি? 

এটা যদি পাগলামি হয়, তবে যথার্থই আমি পাগল। কারণ সর্বদাই আমি আমার বউকে, বউ-এর শরীর আর মন আর সত্তাকে, কীভাবে ভালবাসব তার ফাঁক খুঁজছি। আমি মিনুকে আগলে রাখতে চাই, কারণ আমার সংসারের দাবিদাররা ওকে ঠিকমত বুঝতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেই বা কাকে বুঝতে পারে। সবাই তো আমরা আন্দাজেই চলি। 

যাই হোক, আমি ব্যতিক্রম কিছু ঘটাতে চাই না। বউকে সঙ্গে নিয়ে অফিসের সহকর্মীর বউভাতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে আসা যে ব্যতিক্রম, আশা করি সে কথা আপনারা কেউ বলবেন না। সত্যি বলতে কি, যজ্ঞেশ্বরের বউভাতে আমার না এলেও চলত। আমি আর সে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি, একই কো-অপারেটিভ সোসাইটির সদস্য, আর যেহেতু সে আমাদের অফিসের ইউনিয়নের অবিসংবাদী নেতা, তার অফিসের কাজ প্রায়ই জমে থাকে এবং শচীর নির্দেশে প্রায় তার বকেয়া কাজ আমাকেই করে দিতে হয়, যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রাথমিক ভিত্তি হল এই। এর বেশি নয়, কমও নয়। তবে কিছুকাল হল যজ্ঞেশ্বর আমার সঙ্গে দু-একটা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলতে শুরু করেছে। ফলে কিছুটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি। সেই সূত্রেই আমরা পরস্পর তুমি-তুমি করতে শুরু করেছি। ব্যস এই 

তবে এর জন্য তার বউভাতে আসতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আমার ছিল না। আমার পজিশনটা যে এত বিস্তারিতভাবে বোঝাতে হল তা এই কারণে যে, আমি সত্যিই মিনুকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছি, ওর সঙ্গে একটু একা থাকব বলে, একথাটা না-হলে বোঝাতে পারতাম না। এবার দেখুন, আমরা যে এই ব্রিজে এতক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি, এটা আপনাদের কাছে আর অস্বাভাবিক ঠেকবে না। 

এসেছিলাম কীভাবে তাও আপনাদের বলি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ভিড়ের বাসে ঝুলতে ঝুলতে ন’ নম্বর বাস টারমিনাসে গিয়েছিলাম। দোতলায় একেবারে সামনের সিটে বসব বলে। মাত্র একটাই বাস দাঁড়িয়ে ছিল। চটপট তার উপরে উঠেই আমাদের মনোমত জায়গা পেয়ে গেলাম। কলকাতায় এ একটা বলার মত . ঘটনা। যেন রূপকথা। কেননা, ও বাসটা ছাড়ল না। একটু পরে যে বাসটা বোঝাই হয়ে এল, কোথা থেকে জানিনে, শুনলাম সেইটেই ছাড়বে। সে-বাসে মনোমত সিট ছিল না। তাতে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, ততক্ষণে আমার সংকল্প স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আজ শুধু আমি আর মিনু। কোনও ঘটনাকেই আজ আমাদের দু’জনের মধ্যে আড়াল রচনা করতে দেব না। 

তাই অপেক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে নীচে নেমে গিয়ে স্টেট বাসের পোশাক পরা যাকে পেলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, এই বাসটা কখন ছাড়বে? তিনি বললেন, ওদিকে জিজ্ঞেস করুন। ওদিকের জন আবার আরেকদিকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আবার আরেকজনের কাছে। কলকাতা শহরে আপনারা আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, স্টেট বাস কর্মীদের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। তাই আমি অসহিষ্ণু হলাম না। কেননা আজ আমি সংকল্পে স্থির। আজ আমি আর মিনু। ব্যস। 

আরও একটা বাস এল। মিনু তখনও আমার মতলব বোঝেনি। সে তখন ও জানে, নেমন্তন্নে যাওয়াটাই আমাদের এই যাত্রার লক্ষ্য। তাই সে বাস ছাড়ার সময়টায় উসখুস করে উঠছিল। 

আমি মিনুকে তার পাশে বসে শুধু অনুভব দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম, ব্যস্ত হয়ো না মিনু। আমরা অন্য বাসে যাব না। আমাদের বাস এইটেই। এ যদি আমাদের কোথাও পৌঁছে দিতে চায়, যাব। না চায়, এইখানে বসে থাকব, দু’জনে। যতক্ষণ ভাল লাগবে, ততক্ষণ। তারপর না হয় নেমে যাব। এসো আজ আমরা এই বাসটায় বসে বসে ভাল লাগার চাষ শুরু করি। মিনু হয়ত বুঝতে চেষ্টা করছিল, হয়ত বুঝত, যদি না উপহার দেবার জন্য কেনা শাড়িটা ওর কোলের উপর পড়ে থেকে বিরক্ত করত। তবু সে কিছু বলেনি। শুধু দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকার জাদুটা, হয়ত তাকে খানিকটা আচ্ছন্ন করে থাকবে। আমি ওকে বলতে চাইলাম, ব্যস্ত হয়ো না মিনু। সব বাসই ঠিকানায় পৌঁছায়, কেউ আগে, কেউ পরে। এসো, আমরা তার উপর নির্ভর করি। তবে হয়ত আমরা সুখ পেতে পারি। 

আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, অতীতে আবেগের মাথায় আমি মিনুকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, একা ওকে নিয়ে কোথায় যাব, যাব কোনও ভাল জায়গায়, নির্জনে, স্বল্পখ্যাত বা অখ্যাত সমুদ্রতীরে, অথবা শৈলশহরে বা কোনও গভীর অরণ্যবর্তী এক ডাকবাংলোয়। শুধু পরখ করতে, মানুষ থেকে দূরে, সংসার থেকে দূরে, শুধু দু’জনে থাকলে কেমন লাগে। 

সত্যি বলতে কি, আসলে আমি চেয়েছিলাম আমার অলিখিত কোনও উপন্যাসের জন্য মনোরম একটি অধ্যায় রচনা করতে। ওঃ, আপনাদের বলা হয়নি যে, আমি একজন পার্ট-টাইম লেখক। 

এবার বুঝেছেন তো, আমার স্ত্রীকে নিয়ে অনিচ্ছুক এক বাসের দোতলায় সামনের সিটে নিশ্চিন্ত মনে সওয়ার হয়ে থাকার মধ্যে কেন কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। 

আমি যে মিনুকে প্রতিশ্রুত কোনও নন্দনকাননে নিয়ে যেতে পারিনি, তার কারণ আমার তরফের কোনও অনিচ্ছা নয়, সোজাসুজি আর্থিক অক্ষমতা। আমি যে যজ্ঞেশ্বরের রাজনীতি অপছন্দ করা সত্ত্বেও তার দিকে ঝুঁকেছিলাম, তার কারণ এই যে, আমার কর্মজীবনে সে-ই একমাত্র লোক যে কিনা যখন-তখন আমার চোখে একটা অতিরিক্ত প্রাপ্তিযোগের ছবি এঁকে দিতে পারত। যে ছবিটা কখনও হত বর্ধিত মাগগি ভাতার, কখনও বা আটমাসের বোনাসের। বা এই জাতীয় অন্য কোনও কিছুর। এসব কথা যে মুহূর্ত থেকে শুনতাম সেই মুহূর্ত থেকেই শুধু আমার আর মিনুর নির্জন বাসের সম্ভাবনাটা যেন স্বচ্ছ এবং নিকটবর্তী হয়ে আসত। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর যেমন শেষ পর্যন্ত থোক থোক টাকা পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিটা রাখতে পারত না, আমিও তেমনি মিনুকে নিয়ে ক’দিনের জন্য কোথাও চলে যাবার প্রতিশ্রুতিটা রাখতে পারতাম না। 

আরেকটা উপায় অবশ্য ছিল। আমার মাকে বা বোনেদের কিছুদিনের জন্য মেজদা কি বড়দি, কি অন্য সব বিবাহিত বোনেদের বাড়িতে যদি পাঠিয়ে দেওয়া যেত, তা হলেও ক’দিন এই বাড়িতেই শুধু আমি আর মিনু শুধু দু’জন দু’জনের সঙ্গ লাভ করতে পারতাম। কিন্তু যদিও অন্যেরা মায়ের ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করত এবং মিনুর হাতে মায়ের যত্ন তেমন হচ্ছে না, এ বিষয়ে প্রায় সবাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এসে পৌঁচেছিল, তবু মাকে কয়েক দিনের জন্যও কেউ অধিকতর শান্তির নীড়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাত না। মাও কোথাও যেতে চাইত না। যদিও মেজো বউদি বা অন্যান্যদের সম্পর্কে মা অনেক সময় স্নেহবাচক নানাবিধ উক্তি করত কিন্তু তাদের কারও কাছে গিয়ে থাকবার কথা উঠলেই মায়ের উৎসাহ নিবে যেত। 

কাজেই বুঝতে পারছেন, আমি আর মিনু ক’টা দিন একা থাকব, এই ন্যূনতম অভিলাষটাও কেন চরিতার্থ হয়নি। ব্যাপারটা পীড়াদায়ক এবং অসুখের উৎস। অথচ সাধারণ সাদামাটা ঘটনা। শত শত পরিবারে এই ধরনের বা অনুরূপ অচরিতার্থ অভিলাষজনিত পীড়ায় শত শত নর এবং নারী ভুগছেন বলেই আমার ধারণা। এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, কারও কোনও বিশেষ দোষ না থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র বাইরের ঘটনার অনিবার্য চাপে ক্রমশ পীড়াদায়ক এবং তিক্ত হয়ে উঠছে। এসব ঘটনা এত সাধারণ এবং এত সাদামাটা বলেই সম্ভবত আমরা এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিই। এবং এসব ঘটনার মোড় ফেরাবার জন্য আদৌ কোনও চেষ্টা করিনে। এইটেই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

কিন্তু আমি নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাসী নই। আমি ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। উদ্যোগে বিশ্বাসী। ঈশ্বরের দান হিসাবে ভালবাসা পেলাম না তো কী হল? আসুন না, আমরা ভালবাসার চাষ শুরু করি। হিমঘরে যারা একবার ছত্রাক উৎপন্ন করতে শিখে গেছে তারা কি ঈশ্বরের পরোয়া করছে? 

এই মন নিয়ে আমি ন’ নম্বর বাস টারমিনাসে পৌঁচেছিলাম মিনুকে নিয়ে। এই মন নিয়েই আমরা বাসটার দোতলায় একেবারে সামনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম দু’জনে। মিনুকে ধৈর্য ধরতে মিনতি করছিলাম। ওকে বলেছিলাম, বাসের উপর নির্ভর করো, আমাদের ও পৌঁছে দেবেই। এবং সত্যিই প্রায় অলৌকিক ঘটনা, আমাদের প্রার্থনা পূরণ করতে হঠাৎ বাসটা প্রাণবস্তু হয়ে উঠল। আমরা উপরে বসেই টের পেলাম, ও বার দুয়েক যেন কাশল, তারপর থরথর করে উঠল ওর প্রাণের স্পন্দন। এবং কী আশ্চর্য, মাইল মাইল পথ গিলে গিলে ও আমাদের পৌঁছে দিল যোধপুর পার্কের স্টপে। 

মিনু এতক্ষণ ধরে আমার পাশে ছিল। আমার কাছে। এত কাছে তাকে অনেকদিন পাইনি। পথে নামতে আমি মিনুকে বলতে চাইলাম, দেখলে মিনু, নির্ভর করলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। অতএব এসো, আমি তোমার উপর নির্ভর করি, তুমি আমার উপর নির্ভর করো, দেখবে তোমার বা আমার কোনও অসুখই থাকবে না। নির্ভরতাই ভালবাসার সোপান। 

কী বলেন আপনারা, এটা পাগলের প্রলাম? অথচ দেখুন, এই সাদা কথাটা কেউ বুঝছে না। নিজেদের মুছে ফেলে দিয়ে কেউ নির্ভর করছে দলের ছেলেদের উপর, কেউ পুলিশের উপর, কেউ বা হুইসকিকে মনে করেছ তার নিজের থেকেও আপন। কী নিদারুণ হাস্যকর ব্যাপার! 

ও গোরিলার মত দু’হাতে গড়িয়াহাট ব্রিজের রেলিং-এ ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর হা হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, বাস্টারডস্। সব শালা মুখোশ। 

.

মিনুর সাময়িক চঞ্চলতা 

তোমার কি শরীরটা খারাপ লাগছে? মিনু তখন সেই গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল। তোমার কি শরীরটা খারাপ লাগছে? চোখে মুখে জল দেবে? জল খাবে একটু? একটু বসবে? রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াবে? চলো না-হয় বাড়ি যাই। বুঝলে? 

মিনু আবার ভয় পাচ্ছে। এতক্ষণ বেশ শান্ত এবং সমাহিত ছিল সে। এবং এখন, এই মুহূর্তে বিচলিত বোধ করছে। এর পর ক্রমশ উদ্বেগে আক্রাস্ত হয়ে উঠবে মিনু। তার পক্ষে ক্রমাগত উদ্বেগ, ডাক্তাররা বলেছেন, হানিকর। তার শরীরে এবং মনে যে-সব যন্ত্রণাদায়ক বেদনাদি রয়েছে, উদ্বেগ বৃদ্ধি ঘটছে বলেই সেগুলির বৃদ্ধি ঘটছে—ছ’বছর ধরে নানারকম চিকিৎসা করে মিনুকে একটুও উপশম দিতে না পেরে বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অবশেষে উপরোক্ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। বুঝলেন, ‘ব্যাপারটা সাইকোসোমাটিক।’ মিনু অনেকদিন ধরে, যখন যন্ত্রণায় সে অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়ত, ওকে বলে আসছিল মাতনগাছির পীরের কাছে তাকে নিয়ে যেতে। ও আজও নিয়ে যায়নি। উভয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটার এও একটা কারণ। 

এই ধরনের অস্বস্তিকর দৃশ্যে বারকতক উভয়কে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে। যথা : স্থান—শয়নকক্ষ, বিছানা। কাল—মধ্য রাত্রি। মিনু যন্ত্রণায় এপাশ ওপাশ করছে। তার স্বামী একখানি ইংরেজি পুস্তকে প্রাণপণে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে। মলাটে কামোদ্রেককারী এক রমণীর রমণীয় ছবি। এবং ললাটে যে ইংরেজি শব্দটি লেখা, তার অর্থ উপপত্নী। 

মিনু (গলায় ঝাঁজ) : আলোটা নিবোবে না কী? 

ইংরেজি পুস্তক : 

Unlike almost any other prostitutes I have known, Edith possessed the frankness to confide her thoughts and feelings in me without reservations. 

মিনু : যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি। সেই কখন থেকে দু-চোখ বুজতে চেষ্টা করছি— ইংরেজি পুস্তক : 

‘After all, why shouldn’t I have my fun?” She often grinned at me. “Do you begrudge me my amusement?” 

মিনু (অত্যন্ত তিক্তস্বরে) : যেন কাকে বলছি! তোমরা কি মানুষ? 

“NO, I’m thinking of the evil consequences it may have for your physical and mental health.” 

মিনু : ছি ছি ছি। বাড়িতে কুকুর-বেড়াল পুষলেও লোকে তার যত্ন নেয়। আর তোমরা কী! একটা মানুষ পাশে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তার মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। আর তোমার হুঁশই জাগছে না। জানোয়ার! 

(মিনু ডুকরে কেঁদে উঠল। ) 

মিনুর স্বামী (সংবিৎ পেয়ে এবং অপ্রস্তুত হয়ে) : ‘অ্যাঁ, একী! মিনু কাদছ কেন? কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার? 

(মিনু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ) 

মিনু : বাবা বাবা! উস্ উস্। তোমার মনে আঘাত দিয়ে বিয়ে করেছিলাম। উস্ উস্। তার ফল আজ পাচ্ছি। উস্ উউ-উস্‌। 

মিনুর স্বামী (বেশ ঘাবড়ে গিয়ে) : মিনু, এই মিনু, কী হল তোমার! বলো বলো, প্লিজ! 

(মিনু উঁ উঁ উঁ, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ) 

মিনুর স্বামী (নিরুপায়ভাবে মিনুর প্রতি) : কোনও কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার ডাকব? (মিনু কাঁদছে। ) 

মিনুর স্বামী (নিরুপায়ভাবে দর্শকদের প্রতি) : কিছু একটা বলুন আপনারা। কী করব আমি? ডাক্তার ডেকে আনব একটা? একটা চুমু খাব ওকে? 

মিনু কাঁদছিল। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : মিনু, মিনু, প্লিজ! 

মিনুর স্বামী (নিজেকে) : পাষণ্ড, নরাধম, ক্ষমার অযোগ্য তুই! এমন সাধ্বী স্ত্রী তোর, এত পতিব্রতা, এবং সে যন্ত্রণায় কাতর। আর ধিক তোকে, তুই কিনা তাকে উপেক্ষা করে তারই পাশে শুয়ে ‘উপপত্নী’ নিয়ে মজে আছিস। ছিঃ। 

মিনুর স্বামী (বিব্রত, বিপন্ন হয়ে দর্শককে) : দেখুন, ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে আমাকে বলতে সুযোগ দিন। আজকাল কলকাতার এই নিদারুণ অনিশ্চিতির মধ্যে আমার ভয়টা কিছু বেড়ে গিয়েছে এবং ক্রমশ আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন ভীত ত্রস্ত একটি হরিণ শাবক এবং আমার স্ত্রীর সহনশীল শরীরটা নিরাপদ আশ্রয়। কোনওক্রমে যদি স্ত্রীর শরীরে একবার আশ্রয় গ্রহণ করতে সমর্থ হই, তবে আমি, একমাত্র তখনই আমি নিরাপদ। কোনও নৃশংস ব্যাধই আর আমাকে অতর্কিতে হত্যা করতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি, স্ত্রীর শরীরে যতই আমি মিশে যেতে থাকি, ততই আমি, একমাত্র তখনই আমি সেই অভয় আহ্বানটা জল স্থল অন্তরীক্ষ থেকে শুনতে পাই, ‘ন হন্তব্য, ন হন্তব্য –হত্যা কোরো না, হত্যা কোরো না। 

মিনু (তিক্তস্বরে) : জানোয়ার! জানোয়ার!

মিনুর স্বামী (নিজেকে) : নরাধম : পাষণ্ড!

মিনু : স্বার্থপর! নীচ! 

মিনুর স্বামী (দর্শককে) : কিন্তু হায়, আজ আর আমার অভয়ারণ্যে আশ্রয় নেবার উপায় নেই। আমার সাধ্বী স্ত্রী আজ যন্ত্রণায় কাতর। তার শরীর আজ ব্যবহারের অনুপযুক্ত বিধায় একখানি ইংরেজি পুস্তকে কিঞ্চিৎ মনোনিবেশ করেছিলাম। আমি স্বীকার করছি, বইটি যৌন উত্তেজনা উদ্রেককারী। আমি স্বীকার করছি, আমার কিঞ্চিৎ চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেছিল। আমি স্বীকার করছি আমি–আচ্ছা আমার এই কাজ কি আমার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ? 

মিনু (তার স্বর্গত পিতাকে) : তোমার মনে কষ্ট দিয়েছিলাম বাবা! তাই ভুগছি। মিনুর স্বামী (মিনুকে : মনে মনে) : ব্যথাতুরা কপোতী আমার! 

মিনু (স্বামীকে) : বাপ-মায়ের মনে আঘাত দিয়ে বিয়ে করে যে পাপ করেছি- 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : মিনু প্লিজ, এটা আমার প্রতি নিদারুণ অবিচার- 

মিনু : এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত সারা জীবন দিয়ে করে যেতে হবে। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে : হঠাৎ রেগে) : আবার পুরনো রেকর্ডটা চাপালে। কতদিন বলেছি মিনু, এ তোমার মিথ্যে ধারণা। তোমার বাবা পরে আমাদের আশীর্বাদ করেছিলেন। 

মিনু (চেঁচিয়ে) : মিথ্যে কথা। 

মিনুর স্বামী : মিথ্যে নয় মিনু, সত্যি, আমি তো তোমাকে তোমার বাবার লেখা চিঠি দেখিয়েছি। বলো, সে চিঠিটা জাল? 

মিনু (খানিকটা নরম হয়ে 🙂 আমি কি সে কথা বলেছি! 

মিনুর স্বামী (এবার বেশ গরম হয়ে) : তা হলে কি বলবে তিনি মিথ্যে কথা লিখেছেন? 

মিনু (আরও খানিকটা নরম হয়ে) : আমার বাবা তোমাদের মত মিথ্যে কথা বলতেন না। তুমি বারে বারে আমার বাবার চিঠিটা তুলে খোঁটা দাও কেন, বলো তো। 

মিনুর স্বামী (নরম হয়ে) : আমি তোমাকে খোঁটা দিইনে মিনু। তোমাকে একটা কথাই বোঝাতে চাই, আমরা ভালবেসে বিয়ে করে কোনও পাপ করিনি। না মিনু, আমার কাছে আর সরে এসো না, আমি তোমার উপযুক্ত নই। কাল থেকে আলাদা ঘরে শোব। 

মিনুর স্বামী (দর্শকদের) : আমি জানি স্বামী হিসাবে আমি অতিশয় গৃধু। আমার স্ত্রী যে অসুস্থ, হাতে পিঠে ঘাড়ে ছুঁচ ফোটার মত নিরন্তর তীব্র যন্ত্রণায় তিনি কাতর, আমার চেয়ে একথা আর ভাল কে জানে? এও জানি, এতৎসত্ত্বেও আপনারা যখন জানবেন, আমার এখন, এই মুহূর্তে, কী করতে ইচ্ছে করছে, তখন আপনারাও আমাকে পাষণ্ড বলে ধিক্কার দিয়ে উঠবেন। হৃদয়, উদ্বেল হোয়ো না। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : না মিনু, না, প্লিজ, তুমি আর আমার গায়ে গা ঠেকিয়ো না। সরে যাও। ওকী, অত কাছে তোমার মুখ এনো না। আমার গায়ে হাত রেখো না। না না। আমি তোমার অধম স্বামী। 

মিনুর স্বামী (দর্শকদের প্রতি) : ভদ্রমহোদয় এবং মহিলাবৃন্দ! আমি স্ত্রীর প্রশ্রয় পেয়ে এখন রিরংসা রিপুর দ্বারা সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত এবং আত্মরক্ষায় অসমর্থ। এমতাবস্থায় একটি দুর্বল নর এবং অবলা নারীকে রক্ষা করার কোনও উপায় যদি আপনাদের জানা থাকে, সত্বর বলুন! 

মিনু (সরে এসে : গদ্‌গদ স্বরে) : রাগ তো আমারই করার কথা। মুখ ফিরিয়ে তো আমারই শোয়ার কথা। এ যে দেখি উল্টো চাপ। আঃ, ফেরো না, লক্ষ্মী সোনা! 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনারত) : হে দেব, গন্ধর্ব, হে অন্তরিক্ষবাসী পিতামহ-মাতামহগণ, তোমরা সকলে সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী ব্লাউজের একটা বোতাম খুলল)। 

মিনু (সরে এসে আধো-আধো সুরে) : ও কী, আঃ, অসভ্যতা করছ কেন? 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনা) : ভূচর খেচর জলচর চরাচরব্যাপী জীব সকল, তোমরা সবাই সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী আরেকটা বোতাম খুলল। ) 

মিনু (আরও ঘনিষ্ঠ আধো-আধো স্বরে) : না! খালি এইসব সময়ে অঢেল আদর। অন্য সময়ে আর চোখ তুলে দেখারও ইচ্ছে হয় না। 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনা) : চেতন ও অচেতন, বিরাট ও অণুপ্রমাণ, দৃশ্য ও অদৃশ্য, বস্তু ও অবস্তু, হে যাবতীয় অস্তিত্ব সকল, তোমরা সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী একটি হুক ধরে টানাটানি করতে লাগল। ) 

মিনু (গদ্‌গদভাবে) : আঃ ছিঁড়ে যাবে, ছাড়ো। 

(মিনু অনায়াসে হুক খুলে দিল। ) 

মিনু (আবেগে অস্থির) : আমাকে একটু দ্যাখো, আমাকে একটু দেখো, আমাকে একটু আগলে রেখো। আমি যে শেষ হয়ে গেলাম। আমি যে শুকিয়ে উঠলাম। 

মিনুর স্বামী (সমবেদনায় গলা ধরে এল) : আমি তোমাকে দেখি মিনু। 

মিনু (অভিমান উথলে উঠল) : ছাই দ্যাখো। এই যে যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি, একবারো জিজ্ঞেস করো? 

মিনুর স্বামী : কেন মিনু, আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। 

মিনু (অভিমান আরও উথলে উঠল) : তোমার ডাক্তার ছাই করছে। এত করে …বলছি মাতনগাছির পিরের কাছে একবার নিয়ে চলো। 

মিনুর স্বামী (হঠাৎ দর্শককে) : নাউ দিস ইজ টু মাচ। বিষয়টা আমার পক্ষ থেকে একটু পরিষ্কার করে রাখা দরকার। মাতনগাছির পির। মিনু আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছে। যেখানে ডাক্তারের চিকিৎসায় ওর কোনও উপশম হচ্ছে না, সেখানে মাতনগাছির পির ওকে কী করে ভাল করতে পারে? আমি তো বুঝিনে। বিজ্ঞান যেখানে ব্যর্থ, দৈবও সেখানে নিষ্ফল। আমার বরাবরকার সিদ্ধান্ত তাই। সেই কারণেই পির-ফিরের কাছে মিনুকে কখনও নিয়ে যাইনি। অনেক বুঝিয়েছি। বলেছি, চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ হয়ত এই যন্ত্রণার কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ বের করতে পারেনি, কিন্তু পৃথিবীর দিকে দিকে মানুষের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা অবিশ্রান্ত চলছে। ওষুধ একদিন বের হবে। আমি তাই মিনুকে মাতনগাছির পিরের কাছে নিয়ে যাইনি, সেই অনাবিষ্কৃত ওষুধের জন্য পকেটে টাকা রেডি করে বসে আছি। আমার ইচ্ছা মিনু বিজ্ঞানের সেবায় নিজেকে নিবেদন করুক। 

মিনু (গলায় ঝাঁজ ফুটিয়ে) : আমার বেলায় তোমার সময় হয় না। বন্ধুর বউকে নিয়ে সিনেমা যাবার সময় তো ঢের থাকে। 

(মিনুর স্বামী আরেকটা বোতাম খুলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল। ) 

মিনুর স্বামী (বিপন্ন হয়ে) : সময়ের অভাব নয় মিনু, তুমি বোঝো না কেন যে, আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনে। আমি তো বলেছি, পিরের জলপড়া বুজরুকি। 

মিনু : কিন্তু সেদিন ডাক্তারবাবু কী বললেন? 

মিনুর স্বামী : মিনু শোনো, একটু ধৈর্য ধরো। আমি জানি তো কষ্টের সীমা নেই। তুমি – 

মিনু : ডাক্তারবাবু কী বললেন সেদিন? বললেন না একবার গিয়ে দেখতে পারেন? বিশ্বাস থাকলে অনেক সময় ফল পাওয়া যায়। বলেননি? 

মিনুর স্বামী (দর্শককে) : মিনুর কোনও দোষ নেই। সেই রাসকেলটা বলেছিল বটে। সিগারেটে টান দিয়ে গোল গোল ধোঁয়া ছেড়ে কেমন অম্লান বদনে বলে গেল, উনি যখন এত ইনসিস্ট করছেন, একবার নিয়ে যান না। হয়তো জলপড়া খেলে সেরে যেতেও পারে। আফটার অল, ব্যাপারটা যখন সাইকো সোমাটিক। আমাদের মেডিকেল সায়েন্সটাই বা কী? এক কানা আরেক কানাকে পথ দেখাচ্ছে। ছ’মাস ধরে আমাকে ক্রমাগত দোহন করার পর, আজ তার এই উক্তি! 

মিনু : ডাক্তারবাবু কী বললেন, বলো? 

মিনুর স্বামী (বিরক্ত হয়ে) : ও শালা হাতুড়ে, কিচ্ছু জানে না। 

মিনু (হিসটিরিয়া রোগীর মত চেঁচিয়ে উঠল) : ওই ডাক্তারের ভিজিট কত জানো? চৌষট্টি টাকা। বিলেত ফেরত। উনি কিছু জানেন না, আর তুমি আপিসের কেরানি, যত জানো তুমি! 

মিনুর স্বামী (হতাশভাবে দর্শককে) : মিনু এক ঝটকায় সে রাতের মত সরে গেল। আমি জানি সে আর ফিরবে না! আমি বিজ্ঞানের বেদীমূলে নিবেদিত। হায়! আজ বিজ্ঞানের সঙ্গেই শোব। 

আজ, এখন, এই ব্রিজের উপরে, এই সঞ্জীবনী হাওয়ায়, আবার মিনু ওর খুব কাছে। আজ মিনু খুব বিচলিত। আজ মিনু যে শাড়িটা পরে এসেছে, সেটাতে ওকে ভাল মানায়। 

ও হাসতে হাসতে বলল, তুমি কী ভয় পেয়েছ মিনু! সত্যিই হাসিটা আমার বড় জোরেই হয়ে গিয়েছে। আসলে কী জানো, ছকু বকশির মুখটা মনে পড়ে গেল। 

মিনু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই বলো। সত্যিই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। 

ও বলল, আরে দূর, এই কলকাতা শহরে ভয় পেলেই ভয়, না হলে কোনো ভয় নেই। আজ তা বুঝে গেলাম। এই দ্যাখো না, এই ছকু বকশি, যজ্ঞেশ্বরের দাদা, যে-সব মন্ত্রীরা এসেছিলেন, পুলিশের জাঁদরেলরা, ওঁদের থেকে যে ভয় পাবার কিছু নেই, আজ এত কাছে বসে নেমন্তন্ন খেলাম বলেই বুঝতে পারলাম। এঁরা যে সাধারণ স্তরের মানুষের মতই হাসেন, কাশেন, ফেলে ছড়িয়ে খান, এটা দেখে বুঝতে পারলাম, আমরা যারা প্রতিদিন সংবাদপত্র মারফত এঁদের বাণী পাই, মাইকের মারফত এঁদের বিরাট আহ্বান শুনি এবং তারপর ধারণা করে নিই এঁদের আকার কত বিরাট! কত কম জানি, কত বোকা। নিজের বোকামির কথা মনে পড়ল, তাই হো হো করে হেসে উঠলাম। 

.

যজ্ঞেশ্বরের প্রাইভেট সমস্যা 

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাচের মধ্যবর্তী সময়টায় যখন মিনু মেয়েদের ভিতরে গিয়ে বসেছিল এবং কেয়াও আসেনি, ও একা বসে বসে যখন অভ্যাগতদের যাওয়া-আসা হাসা কথা বলার ভঙ্গিসকল খুটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল, এবং শচীর ভাবভঙ্গিতে বেশ মজা পাচ্ছিল, ইদানীং শচী ওর সঙ্গে কথা বলে না, অফিসে দেখা হলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় অথচ বিব্রত বোধ করে, আজও এখনও পর্যন্ত শচী ওর চোখে চোখ ফেলেনি, যদিচ কেয়া দেখা হওয়ামাত্র তার পাশে দাঁড়িয়েই ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে।

.

সেই রাতে কী ঘটে 

প্রথম তরুণটি এগিয়ে আসতেই মিনু ওকে প্রায় আড়াল করে দাঁড়াল। ও মিনুকে প্রায় টেনেই একপাশে সরিয়ে দিল। 

ছেলেটি এবার ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। ওর শরীরে একটা শীতল বিদ্যুতের শিহরন খেলে গেল। 

ছেলেটি বলল, দাদা, দেশলাই আছে? 

দেশলাই চাইছে কেন? এমন কথা তো ছিল না। প্রথমেই তো মাথায় ডাণ্ডার চোট পড়বে। তাই না মিনু? দেশলাই চাইছে কেন? তবে কি এটা কোনও সংকেত? পূর্ববঙ্গে নৌকোর গায়ে নৌকো ভিড়িয়ে ডাকাতরা যেমন বলত, আগুন আছে গো। 

ছেলেটি আবার বলল, ও দাদা, শুনছেন, দেশলাই আছে? 

ও বলল, আছে। 

ছেলেটি বলল, দেবেন? 

এমনও হতে পারে, ছেলেটি সত্যিই দেশলাই চাইছে। যজ্ঞেশ্বর বলেছিল, কী জানো, আজকাল এমন হয়েছে, রাস্তায় চারটে ছায়া একত্র হয়েছে দেখলেই নারভাস হয়ে পড়ি। যজ্ঞেশ্বর, যার নিজের হাতেই পার্টির ছেলে অসংখ্য, সে-ই একদিন এই কথা বলেছে। হুঃ! 

ও দেশলাই বের করে ছেলেটার হাতে দিল। 

ছেলেটা একটা সিগারেট ধরাল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, এই, আছে মাইরি। আয়। 

মিনুর শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়েছে। 

হঠাৎ একটা ন’নম্বর বাস এসে গেল। 

ও বলল, মিনু, বাস। এই রোকে। রোকে। 

মিনু গলা চিরে চেঁচিয়ে উঠল, রোকে। 

বাস থামল না। 

ছেলেটি ওদের বলল, বাস তো এই ব্রিজের উপর থামে না দাদা। 

আরেকটি ছেলে এগিয়ে এল। বলল, দেশলাই যখন আছে, তখন সিগারেটও কি আর দু-একটা নেই? 

আরেকটি ছেলে এগিয়ে এল। 

মিনু চেঁচিয়ে উঠল, এই এই ট্যাক্সি। ট্যা-ক্-সি 

ও চেঁচাল, ট্যা-ক্‌-সি। ট্যা-ক্‌-সি। 

ট্যাক্সি ভোঁ করে বেরিয়ে গেল। 

ছেলেটি বলল, কী বে, বলিনি?

একটি ছেলে বলল, দেবেন দাদা একটা?

ও বলল, নিন না। খান। 

ও সিগারেট বের করে দিল। 

ছেলেটা বলল, কোথায় যাবেন দাদা? 

আরেকটা ছেলে সিগারেট ধরাল। বলল, কী বে, চলবে না কি?

ও বলল, চিড়িয়ার মোড়। 

আরেকটা ছেলে এগিয়ে এল। বলল, কী সিগারেট বে? 

আরেকজন বলল, চিড়িয়ার মোড়? 

আরেকজন বলল, চারমিনার? ধুস্। 

আরেকজন বলল, চিড়িয়ার মোড় যাবেন? এত রাতে কী ব্যাপারে? আরেকজন বলল, তা হলে খাসনি। 

ও বলল, ব্যাপার কিছু নয়, আমরা ওখানে থাকি। 

আরেকজন বলল, খাব না বলিছি! দাদাকে দূর থেকে বেশ শাঁসালো মনে হচ্ছিল। ভাবলাম, ভাল কিছু জুটবে। 

আরেকজন বলল, চিড়িয়ামোড়ে থাকেন? তা এখানে কী করছেন? 

মিনু বলল, নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলাম। 

আরেকজন বলল, যত্তো শালা লবাবি। জানিস, চারমিনার আজকাল বড় লোকেরাই খায়। 

আরেকজন বলল, আরে ওর কথা ছোড়ো। শুধু ডিংবাজি। 

আরেকজন বলল, নেমন্তন্ন খেতে এসেছেন! সেই চিড়িয়ামোড় থেকে এখানে! আরেকজন বলল, শখ আছে মাইরি! 

আরেকজন বলল, পাগলা আছে। 

আরেকজন বলল, সাহস আছে, বল। 

আরেকজন বলল, ছাড় মাইরি, দাদার চারমিনারই একটা ছাড়। 

মিনু বলল, ওগো, ওই যে ট্যাক্সি। ট্যা-ক্‌-সি। 

ট্যাক্‌সি একটুও দাঁড়াল না। 

আরেকজন বলল, এইখানে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি ট্যাক্সি করলে কেউ দাঁড়াবে?

আরেকজন বলল, এই ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কী করছিলেন দু’জনে? 

ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, কী করছিলাম এতক্ষণ? 

আরেকজন বলল, হাঁ হাঁ, দেখছিলাম এতক্ষণ। একবার রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ছিলেন। একবার দিদিকে ধরে টানাটানি করছিলেন। 

ও দারুণ বিস্ময়ে বলে উঠল, আমরা! 

আরেকজন বলল, ট্যাকসি, ট্যাকসি। আরে এখানে দাঁড়িয়ে চিল্লাচিল্লি করলে কোনও শালা ড্রাইভার ডাক শুনবে না গাড়ি থামাবে? 

আরেকজন মিনুর স্বর নকল করে চেঁচাল, ট্যা-ক্‌-সি! 

আরেকজন বলল, এই শালা চোপ। হারামিপনা করবি তো এক থাপ্পড়ে নকশা বদলে দেব। 

আরেকজন বলল, আপনি একবার রেলিং-এ ঝুঁক মারছেন, দিদি একবার রেলিং-এ গিয়ে ঝুঁক মারছেন। আমরা দেখলাম। কী মতলব আপনাদের, অ্যাঁ? 

ও বলল, আমরা! না না, আমরা তো অন্যায় কাজ কিছু করিনি। 

আরেকজন বলল, আরে এ শালা কলকাতা শহর। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাসি ট্যাক্সি করলে শালা ট্যাক্সি কথা শুনবে? ট্যাক্সি কি কারও বাপের চাকর? ট্যাক্সি চড়বে তো ট্যাক্সির স্ট্যান্ডে চলো। 

আরেকজন বলল, আরে আমরা তখন থেকে দেখছি, আপনি একবার রেলিং-এ ঝুঁক মারছেন, দিদি একবার রেলিং-এ ঝুঁক মারছেন, সুইসাইড করবেন নাকি? 

আরেকজন বলল, শালা, নকশাবাজি খুব করছ। ট্যাক্সি চড়বে তো স্ট্যান্ডে চলো। যেন দু’বেলা ট্যাক্সি চড়ছে! যা না স্ট্যান্ডে। শ্যামবাজার যেতে চাইবি তো শালা বলবে, ওদিকে যাব না, টালিগঞ্জে যাব, টালিগঞ্জে যেতে চাইবি তো বলবে, ওদিকে যাব না, খিদিরপুর যাব। খিদিরপুর যেতে চাইবি তো বলবে, ওদিকে যাব না, বেলেঘাটা যাব। বেলেঘাটা যেতে চাইবি তো বলবে, শ্যামবাজার যাব 

ও বলল, সুইসাইড করব! কেন? হাঃ হাঃ। না না, ওসব কিছু নয়। মিনু শুনছ, এরা বলছে, আমরা নাকি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম। হাঃ হাঃ! 

আরেকজন বলল, আরে ট্যাকসিওয়ালার হারামিপনা সিধে করার রাস্তা আমার জানা আছে। দেখবি, ধরব ট্যাকসি? 

মিনু বলল, আমরা একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। 

আরেকজন বলল, শোন রে, দিদি বলছে—একটু হাওয়া খাচ্ছিলাম। আহ্ হা। ওরা সকলে হা হা করে হেসে উঠল। 

মিনু বলল, হ্যাঁ, আমরা হাওয়া খাচ্ছিলাম। নেমন্তন্ন খেয়ে বাসে উঠতে পারিনি, এধার ওধার দৌড়ে ট্যাক্সি ধরতে পারিনি। আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা ওধারে যাব বলে একটু একটু করে ব্রিজের উপর উঠি। এখানে একটু দাঁড়াই। ঠাণ্ডা বাতাসে আমাদের শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। তা এতে হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা করে এত হাসবার কী আছে? 

ও ভয় পেয়ে গেল। মিনু রেগে গিয়েছে। মিনু এবার সব গোলমাল করে ফেলবে। ও ডাকল, মিনু! চুপ করো। 

মিনু বলল, কেন চুপ করব, আমরা কারও খাই না পরি! তুমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? ভাল করে দ্যাখো, আমার বিলু বেঁচে থাকলে আজ এদের মতই বড় হত। দ্যাখো দ্যাখো, ওদের প্রত্যেকের মুখে আমার বিলুর মুখ বসানো। আমি এদের কেন পরোয়া করব। আমাদের বিলু যদি বেঁচে থাকত, এদের সঙ্গে মেতে এরকম অসভ্যতা করত, আমরা চুপ করে থাকতাম? থাকতে পারতাম? 

ও যা ভেবেছিল তাই। মিনু পার্ট একদম গুলিয়ে ফেলেছে। আমাদের এখানে চড়া গলায় কথা বলার কথা নয় মিনু। আমাদের আত্মসমর্পণ করার কথা। দ্যাখো তো, কী করে বসলে! এখন কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, কে জানে? ও হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, হা ঈশ্বর! 

মিনু ওদের দিকে চেয়ে শান্তভাবে বলল, এতক্ষণ তো জেরা করে করে আমাদের কথা জেনে নিলে, কিন্তু তোমরা এখানে কী করছ, শুনি? 

একজন থতমত খেয়ে বলল, আমরা? 

মিনু বলল, হ্যাঁ তোমরা, এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ? 

আরেকজন বলল, আমরাও হাওয়া খাচ্ছি। 

আরেকজন বলল, আমরাও বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলাম। 

আরেকজন বলল, আমাদের এক বন্ধুর দিদির বিয়ে। খাটাখাটনি করলুম তো। 

আরেকজন বলল, ওই যে, আলো জ্বলছে, ওই বাড়িটা। 

আরেকজন বলল, বন্ধু বললে, একটু দাঁড়া, একটা জিনিস দেব। 

একটি ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এল। ওরা হই হই করে তার দিকে ছুটে গেল। 

ছেলেটি হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ওরা দু’জনে শুনল, ওঃ বাবা মাইরি, যা কঞ্জুস না, কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছে, শালা খুঁজেই পেলুম না। ভাগ্যিস দু’ প্যাকেট সন্ধেবেলায় সরিয়ে রেখেছিলুম। এই নে। 

ওরা আবার হই হই করে উঠল। প্যাকেট খুলে সকলেই এক একটা সিগারেট মুখে দিল। জ্বলন্ত দেশলাই-এর কাঠি সকলের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। তারপর হই হ‍ই করে চলে যেতে যেতে ওরা এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল। ওরা একটা ট্যাকসিকে গোল করে ঘিরে ধরেছে। চেঁচাচ্ছে। দমাদম তার গা পিটছে। 

হঠাৎ একজন ছুটতে ছুটতে ওদের কাছে এল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, আসুন দিদি, আসুন, এক শালাকে, মানে একটা ট্যাকসি ধরেছি। 

মিনু ওর মুখের দিকে চাইল। ও-ও মিনুর মুখের দিকে। 

তারপর মিনু ওকে বলল, তুমি আবার হড়বড় করে ছুটে যেয়ো না। অসুস্থ মানুষ। পড়ে-টড়ে যাবে। 

.

উপসংহার 

আমি মিনুর এই ধরনের গোঁয়ার্তুমি আদৌ সমর্থন করতে পারিনে। ছেলেগুলো খুনে নয়, যদিও আমরা তা প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি, তাই দৈবাৎ বেঁচে গিয়েছি। একেবারে নিছক দৈব। এরা খুনে নয়, কিন্তু যদি হত! মিনুর মুশকিল কি, ওকে কিছু বোঝানো শক্ত। লজিক ওর মাথায় একদম ঢোকে না। মিনুর ধারণা, এখনও ধারণা, কে খুনে আর কে খুনে নয়, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। যতো সব বাজে কথা! মেয়েদের পক্ষেই একথা বলা সম্ভব। কিংবা ওটা অন্য যুগের কথা। আজকের কলকাতায় এগারো বছরের ছেলে অম্লান বদনে ছুরি চালায়, চোখের পাতা একবারও কাঁপে না, পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরী ফাঁদ পেতে শিকার ধরে, শ্রেণীশত্রুর গলার নলি দু’ফাঁক করে দেবার জন্য সোৎসাহে ছুরি এগিয়ে দেয়। এখানে চেহারা দেখে কে খুনে নয় তা বোঝা যাবে, এতই সোজা! আমি মশাই, যুক্তিশাস্ত্র অনুসরণ করে চলি। তাই আজকের কলকাতায় আমার কাছে সবাই খুনে। হয় সে নিজেই খুন করছে আর না-হয় কোনও না কোনও ভাবে খুনেদের মদত দিচ্ছে। 

এই কারণে আমি সবাইকে সন্দেহ করি, সবাইকে। এমন কি নিজেকেও। এবং সর্বদাই সতর্ক থাকি। কেননা, একথা তো সবাই জানে, মিরাল দু’বার ঘটে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *