গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে – ৪

মেঘের ভেলায় ও আর মিনু 

ও মিনুর হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিল। আকাশে ততক্ষণে ভারী মেঘটা অনেক দূর ভেসে গেছে। এখন তাকে অনুসরণ করছে হালকা-হালকা ফিকে-ফিকে রকমারি সব মেঘ। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে ভ্রম হয় ওরাই বুঝি ভেসে চলেছে মেঘের ভেলায়। ও মিনুর করতল দুটো অনুভব করছিল। কেমন কাটা, ফাটা, খসখসে। কেয়ার করতল নবনীত মসৃণ। যজ্ঞেশ্বর আজ রাতে তার বউ-এর কোমল করতলের সুখপ্রদ স্পর্শ পাবে। এবং সে কোমলতা কেয়ার মতই কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না। 

ও আবেগভরে বলে উঠল, মিনু, তোমাকে আমি আর বাসন মাজা, কাপড় কাচা, এসব কাজ করতে দেব না। 

মিনু বলল, জানো, আজ কেমন বাবার কথা মনে পড়ছে! 

ও বেজায় ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিকে চাইল। নাঃ, কেউ নেই। 

ও ব্যস্ত হয়ে বলল, প্লাসটিক সারজারির আজকাল যা উন্নতি হয়েছে, জানো, তোমার তালু দুটো সহজেই আগের মত করে তোলা যাবে। 

মিনু বলল, জানো, বাবার ইচ্ছে ছিল, আমার বিয়েটাও খুব ঘটা করে দেবেন। ও ক্রমশ ভড়কে যাচ্ছে। 

তাড়াতাড়ি বলল, তুমি কিছু ভেবো না। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার মোলায়েম হাত আমি আবার ফেরত দিয়ে দেব। 

মিনু বলল, বাবা সমস্ত রকম দান-সামগ্রী কিনে রেখেছিলেন। আমার জন্যে একপ্রস্ত, ছুটকির জন্যে আরেক প্রস্ত। 

ও বলল, আজকাল নানারকম লোশনও পাওয়া যায়, বুঝেছ। নিউ মার্কেটে আমরা গিয়ে খোঁজ নিতে পারি। 

মিনু বলল, বাবা তো সেকেলে লোক। গহনা, পণ, মেয়ের সুখের জন্য, তার মান বজায় রাখার জন্য এসব দেওয়া উচিত বলে মনে করতেন। কর্তব্য বলে জানাতেন। 

ও বলল, বিলিতি জিনিসও আজকাল ঢের পাওয়া যায়, বুঝলে। এ ছাড়াও তুমি এক কাজ করতে পারো। সকালে বোতলে করে যে দুধ আসে, তার ননিটা তুমি হাতে মাখতে পারো, কাঁচা হলুদের সঙ্গে বেশ করে বেঁটে। কিংবা ধরো, লেবুর খোসা বেশ করে হাতে বোলাতে পার। দশ মিনিট লেবুর খোসা হাতে ঘষলে, তারপর ঠাণ্ডা জল একটা পাত্রে ঢেলে দশ মিনিট হাত ডুবিয়ে বসে থাকলে। তারপর রাত্রে ডিমের সাদা অংশটার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বোরিক অথবা সোডি-বাইকারর্ মিলিয়ে হাতে মেখে হাতটা শুকিয়ে নিয়ে শুতে গেলে। এতে হয় কি, সারাদিন কাজ করার দরুন, যেসব টিস্যু নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং যার ফলে হাতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, সেসব আবার সতেজ হয়ে ওঠে এবং হাতের স্বাস্থ্য এবং লাবণ্য আবার ফিরে আসে। 

মিনু বলল, কিন্তু তুমি জেদ ধরলে তুমি কিছু নেবে না। তুমি জেদ ধরলে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হবে। আমার বাবা তো হতভম্ব হয়ে গেলেন। মন্ত্র পড়া হবে না, সাত পাক হবে না, অগ্নিসাক্ষী, বরণ, কিছুই হবে না, এ আবার কেমন বিয়ে? 

ও বলল, হ্যাঁ, আমাকেও তাই বলেছিলেন, এ আবার কেমন বিয়ে? 

মিনু বলল, বাবা একটু ভয়ও পেয়েছিলেন। 

ও বলল, হ্যাঁ। আমাকেও তাই বলেছিলেন। যদি আমার মেয়েকে কিছুদিন পরে ফেলে পালাও, তা হলে? আমি বললাম, বউকে ফেলে যদি পালাবই তবে আর বিয়ে করছি কেন? 

মিনু বলল, তারপর? বাবা কী বললেন? 

—বললেন, হ্যাঁ, তাও তো বটে! আমি বললাম, শুধু তাই নয়, মন্তরপড়া বিয়ে করেও যদি ফেলে পালাই, তখন? 

মিনু বলল, তারপর? বাবা কী বললেন? 

—বললেন, হ্যাঁ, তাও তো বটে। আমি বললাম, এটায় বরং গভর্নমেন্টের খাতায় দু’জনের সই থাকবে। পালালেও নিস্তার নেই। পুলিশ পেয়াদা পাঠিয়ে আপনার মেয়ে বা আপনি যখন-তখন আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে আনতে পারবেন। 

মিনু হেসে ফেলল। বলল, আমার দায় পড়েছে বেঁধে আনতে। তারপর হাসতে হাসতে বলল, শুনে বাবা কী বললেন? 

—অবাক হয়ে বললেন, সত্যি? রেজিস্ট্রি বিয়ে এত কড়া? আমি বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, তিন আইনের পাক সাত পাকের চাইতে আরও কড়া পাক। অথচ দেখুন, খরচা কম। মেয়ের বাবার কত ঝামেলা কমে যাচ্ছে। 

মিনু হাসছে। বলল, হ্যাঁ, বাবা তোমার কথায় খুব নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। মাকে বাড়ি ফিরেই বলেছিলেন, ছেলেটা ভালই, তবে 

ও বলল, তারপর? কী বললেন? 

মিনু বলল, বললেন, তবে কী জানো, আমার মনে হয় মাথার দোষ আছে। 

ও বলল, যাঃ! 

—আমি কি মিছে কথা বলছি! তোমার মত আমি বানিয়ে কথা বলতে পারিনে।

ও বিষণ্ণ হয়ে বলল, তোমার বাবার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা ছিল। 

মিনু একেবারে ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর প্রবোধ দিল, বাবা তোমাকে খু-উ-ব ভালবাসতেন জানো। তারপর খুব নিচু স্বরে বলল, আমিও তোমাকে ভালবাসি। আমার কী মনে হয় জানো, আমরা খুব বোকা। আমি তো গ্রামের মেয়ে, লেখাপড়া জানিনে, বড় বড় কথা বলতে পারিনে, তা সত্ত্বেও আমি তো তোমার কথায় ওভাবে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। গয়নার লোভ, করিনি, ফার্নিচারের লোভ করিনি। আমিও যদি এটা পেরে থাকি, তবে শিক্ষিত মেয়েরা তা পারে না কেন? 

ও উৎফুল্ল হয়ে মিনুর হাত দুটো টেনে নিল। বলল, মিনু, তোমার হাত আমি সারিয়ে দেব। 

মিনু অবাক হয়ে বলল, কেন, আমার হাতে আবার কী দোষ হল? 

ও অধীর আবেগে বলল, তোমার হাতে আমি লাবণ্যের ফুল ফোটাব। যজ্ঞেশ্বরের বউয়ের কি কেয়ার— কেয়ার নামটা মনে হতেই ঢোক গিলে সেটা আবার নামিয়ে দিল—হাত দুটো যেমন স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যে লাবণ্যে পূর্ণ, তোমার হাতও আমি তেমনি– 

বাধা দিয়ে মিনু বলল, বাবা কিন্তু খুব মিথ্যে বলেননি, তোমার মাথায় সত্যিই দোষ আছে। 

.

ওর এক লহমার স্বগতোক্তি 

হায়, মানুষ, বিশেষত পুরুষ কতটা অসহায়! পুরুষের ভালবাসাকে স্ত্রীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করার পন্থা কী? 

.

সমাজের জটিলতা 

মেয়েদের ব্যাচটা ওঠবার আগেই অনেকগুলো সমস্যার কথা ও জেনে ফেলল। প্রাক্তন সংগ্রামী মন্ত্রী জানালেন, কলকাতার আইন-শৃঙ্খলা ধ্বংসের পিছনে কেন্দ্রের সুস্পষ্ট হাত আছে। প্রশাসক জানালেন, এই খুনোখুনি রক্তারক্তি, এটা নূতন কিছু নয়, এটা বৈদিক যুগ থেকেই চলে আসছে। অহিংসা জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই প্রধানত জাত। এবং বাংলাদেশে তার বিশেষ শিকড় গজায়নি। শচী এক সময় ওকে বলল, ধারিয়ার পদে তার অভিষেক হয়ে গেছেই প্রায় এবং যজ্ঞেশ্বর তার নতুন দুশ্চিন্তার কারণ। যজ্ঞেশ্বরের এক ভাই এসে ভুবনবাবুকে বলল, যজ্ঞেশ্বরের অফিসের ড্রাইভার কয়েকজন, যারা আবার ওদের ইউনিয়নের খুঁটি, অনেকক্ষণ ধরে খেতে বসবার চেষ্টা করে জায়গা না পেয়ে বেজায় চটে গেছে। ওরা জায়গা হতেই বসে পড়েছিল, কিন্তু ওটা মেয়েদের ব্যাচ, মেয়েদের বসানো হবে ইত্যাদি বলে তাদের তুলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুরবাড়ি থেকে যারা তত্ত্ব এনেছিল, তাদের ফেরবার তাড়া থাকায়, বাইরের ঘরে তাদের জন্য একটা জায়গা করে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা বসবার আগেই সেখানে যজ্ঞেশ্বরের অফিসের ড্রাইভার ক’জন বসে পড়ে এবং ফলে তত্ত্বওয়ালাদের সকলের জায়গা হয় না। এই নিয়ে ড্রাইভারদের সঙ্গে তত্ত্বওয়ালাদের বচসা শুরু হয় এবং অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ড্রাইভাররা বলে, তারা হয় ওই ঘরেই খাবে, না হলে জলগ্রহণ না করেই চলে যাবে। তত্ত্বওয়ালারাও জানায়, তাদের সকলকে এক সঙ্গে যদি বসানো না হয়, তবে চলে যাবে। পুলিশের বড়কর্তা বললেন, ডিমোক্রেটিক সিসটেমে যদি সেমি ইনসারজেন্ট অবস্থা দেখা দেয় তা হলে ল অ্যান্ড অরডারের অরডারটা বদলে আগে অরডার এবং পরে ল-কে নিয়ে আসতে হয়। অর্থাৎ আইন ও শৃঙ্খলা নয়, শৃঙ্খলা ও আইন। না হলে সমস্যার সমাধান করা যায় না। শান্তি স্থাপন করা যায় না। যজ্ঞেশ্বর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, একটা বিয়ে যে এতরকম প্রবলেম সৃষ্টি করতে পারে, এটা জানলে বিয়েই করতাম না। 

যজ্ঞেশ্বরের দাদার বন্ধু বললেন, ও পাড়াটা ছেড়ে এসেছিস, ভালই হয়েছে। ওইভাবে কি থাকার কোনও মানে হয়? প্রথম দিন, তোদের বাড়ি গিয়ে তো আমি ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। নীচে পুলিশ। দোতলায় তালা। বলি, ব্যাপারটা কী! ভুবন কি আবার অন্তরিন হল নাকি? কংগ্রেসি গণতন্ত্রকে তো বিশ্বাস করা যায় না। 

যজ্ঞেশ্বর তার দাদার বন্ধুকে বলল, ও শুনছিল, আসলে দাদার জন্যই আমাদের চিন্তা হয়েছিল খুব। আমাদের কমরেডরা ডেফিনিট খবর এনেছিল, দাদার নাম ওদের লিস্টে উঠে গেছে। 

যজ্ঞেশ্বরের দাদার বন্ধু বললেন, এস-বি ওয়ার করেনি? যজ্ঞেশ্বর বলল, ওরাই তো প্রথম জানায়। যজ্ঞেশ্বরের দাদার বন্ধু বললেন, তারপর বুঝি সি-পি পুলিশ পিকেট পাঠাল? যজ্ঞেশ্বর বলল, দাদা অবশ্য চাননি। যজ্ঞেশ্বরের দাদার বন্ধু বললেন, সমাজবিরোধীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য আরম্ গার্ড দরকার বই কী। যজ্ঞেশ্বর বলল, ও পাড়ার ও সি এ বিষয়ে সব সময় কো-অপারেট করেছে। দাদা তাঁকে বলে দিয়েছেন, পুলিশ দিতে চান দিন, কিন্তু খবরদার, কেন্দ্রের পুলিশ যেন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে। দাদাকে জানেনই তো, কী রকম স্ট্রিক্ট প্রিনসিপ্‌লের মানুষ! আমাদের কমরেডরাও তৈরি ছিল। তবে অমিয়দা সেদিন বলছিল, ও পাড়ায় আমাদের বেসটা নাকি উইক হয়ে পড়েছে। পুলিশের একজন কর্তা প্রশাসনের একজন কর্তাকে বললেন, স্যার, এই যে দেখছেন, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যাতায়াত কমে যাচ্ছে, এটা স্যার, সেমি ইনসারজেনসির একটা সুস্পষ্ট লক্ষণ। এর ফলে হচ্ছে কি, লোকের মনে সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ইনফরমেশন-এর উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ভুবনবাবু জনৈক সংগ্রামী মন্ত্রীকে বললেন, অমিয়র স্টাডি তাই, ও সেদিন এসেছিল, বুঝলে। বলে গেল, আমরা উঠে আসার ফলে কমরেডদের মর‍্যাল স্ট্রেংথ বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। মাত্র চারটে ছেলে এসে নাকি আমাদের বাড়ির কাছের পারটি অফিসটা পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। প্রাক্তন মন্ত্রী বললেন, দুঃখের কথা কি, পুলিশ এখন আর তেমন সহযোগিতা করছে না। ভুবনবাবু বললেন, আমি অমিয়কে বললাম, ব্যাপারটা টোটাল পারসপেকটিভে খতিয়ে দেখতে হবে। ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক, এই নীতির জনক স্বয়ং লেনিন। তারপর অবিশ্যি অমিয় শান্ত হল। প্রশাসনের কর্তা পুলিশের এক নবীন অফিসারকে বললেন, তোমাদের বয়েসটা যে কম, তাই সহজেই বিচলিত হয়ে পড়ো। ল অ্যান্ড অরডারের প্রশ্নটি আমাদের হেরিটেজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়। আমাদের হেরিটেজ কী? রামায়না অ্যান্ড মাহাভারাথা। নরমেধ, নরবলি, দিজ সস্ অব থিংকস্। তুমি কালকের আই পি এস, তুমি ছোকরা চাইলেই এসব বন্ধ হয়ে যাবে। ছকু বকশি হস্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, চলুন, জায়গা হয়ে গিয়েছে। ভুবনবাবু বললেন, আপনাদের হয়ত দেরি হয়ে গেল। প্রশাসনের কর্তা বললেন, বেটার লেট দ্যান নেভার। সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন। ও উঠতে উঠতে কেয়াকে বলল, জানো কেয়া, হাসির এই একটি দমকাই সব টেনশনকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। কেয়া বলল, কচু! 

.

হ্যাভলক এলিস, কামসূত্র ও মারক্‌স্ : কঃ পন্থা 

শচী ওদের পৌঁছে দেবে বলল এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত। মিনু রাজি হল না। শচী আজ ভাল মুডে আছে। বলল, এসো না একদিন দু’জনে। নতুন বাসাটা তো দ্যাখোইনি। কেয়া আর ও মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মিনু ফস করে বলল, ওদিক থেকে এদিক যতদূর, এদিক থেকে ওদিকও ততটা। শচী সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, মিনু, ডারলিং, তোমার সঙ্গে আমার মিল কোথায় জানো, এইখানে আমরা দু’জনেই খুব সৎ, ভালমন্দ ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অকপটে প্রকাশ করে ফেলি। ভণ্ডামিকে ঘৃণা করি। তুমি কি জানো, তোমার স্বামীর সঙ্গে আমার এখন প্রায় বাক্যালাপই নেই। আই হেট্‌ হিম্ সামটাইম্‌স্। 

মিনু বলল, তবে গাড়িতে তুলতে চাইছিলেন যে বড়! আমি যাকে পছন্দ করিনে, তার ছায়াও মাড়াইনে। 

শচী হা হা করে হাসল। বলল, আজ কিছুক্ষণ থেকে ওকে আর তেমন খারাপ লাগছে না কিনা, তাই। তুমি, আই মাস্ট সে, আমার থেকেও অনেস্ট্। এসো না একদিন। তোমাকে আরও কমপ্লিমেন্ট দেব। না সত্যি, একদিন এসো। আমাদের পাড়াটা অ্যাবসলিটলি ফ্রি অব ট্রাব্‌ল। 

কেয়া আর শচী বেরিয়ে গেল। শচী হাসতে হাসতে, কেয়া শান্ত। ও বলল, চলো তবে আমরাও যাই। 

মিনু বলল, বেশ খাইয়েছে কিন্তু। মাংসটা কিসের বলো তো? 

ও বিস্মিত হল, কেন, খাসির! 

কেয়া বলল, যাক, আমিও তাই ভাবছি, হিন্দুর বাড়িতে কি আর অন্য কিছু দেবে? তবে হোটেলে হলে আমার কিন্তু বাবা খুঁতখুঁত করত। 

ও বলল, তোমরাও যেমন! আরে এ হচ্ছে গ্রামফেড খাসি। রেজালার মাংস। স্পেশাল টাইপ। চলো যাই। 

যজ্ঞেশ্বর হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পথ আগলে দাঁড়াল। সারাদিনের ধকলে তার মুখ চোখ এরই মধ্যে কেমন চুপসে গেছে। মিনুকে বলল, বউদি প্লিজ, কিছু মনে করবেন না, দাদার সঙ্গে (যজ্ঞেশ্বর যে কী পরিমাণ নারভাস তা বোঝা গেল, ওকে এই প্ৰথম দাদা বলছে) আমার অত্যন্ত প্রাইভেট একটা কথা আছে, বিশেষ জরুরি, প্লিজ, আপনি আসুন না বউদি, রত্নার সঙ্গে একটু আলাপ করবেন, এখন আর ভিড় নেই, আপনাদের মোটেই দেরি করাব না বউদি, আসুন! ত্বরিৎগতিতে মিনুকে নিয়ে চলে গেল এবং তক্ষুনি ফিরে এল। বলল, এসো আমার সঙ্গে। 

যজ্ঞেশ্বর ওকে মেরাপ থেকে বের করে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠল। ও যেতে যেতে দেখল, একজন মেরাপ থেকে ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাইরে এসে এক ঝুড়ি এঁটোকাঁটা গেলাস খুরি ঝপ করে ছুড়ে দিল। একটা কুকুর কেঁউ করে উঠল। গোটা কয়েক ভিখিরি তার উপর এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সানাই তখন পিলুতে ঠুংরির তানগুলো লতিয়ে দিচ্ছে। 

যজ্ঞেশ্বরের কোনও কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে যেন নিমজ্জমান এক ব্যক্তি, হাতের মুঠোয় ওকে কুটোরূপে পেয়েছে। ঘরে ঢুকেই সে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলে। ফুলশয্যের ঘরখানা আলোয়, নতুন সব আসবাবে ঝকঝক করছে। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, মায়াবী শেড পরানো টেবিল ল্যাম্প। হঠাৎ ফুলসাইজ ড্রেসিং আয়নার মুখোমুখি হল। অভ্যাসবশে দাঁতগুলো পরিষ্কার আছে কি না টুক করে একবার দেখে নিল। এই অভ্যাসটা ওর হয়েছে বাসের আয়নায় মুখ দেখে। চাস্ পেলেই আয়নার সামনে দাঁতগুলো মেলে ধরে। যজ্ঞেশ্বরের চোখে চোখ পড়তেই সট করে চোখ ঘুরিয়ে ও সিলিং-এ চাইল। ফুল। গোটা সিলিং থেকে তোড়া তোড়া ফুল ঝুলছে লাল শাদা হলুদ গোলাপী বেগুনি—রজনীগন্ধা, পদ্ম, গোলাপ। বিছানায় বিস্তীর্ণ বাহারি বোম্বে ডাইং-এর বেড কভার। ধপ ধপ করছে শিথেনের জোড়া জোড়া বালিশ। ঢাউস দুটো পাশ বালিশ ডবল বেডের সীমানা নির্দেশ করছে। 

যজ্ঞেশ্বর বলল, বোসো। 

ও বসল। ডানলোপিলোর সুখদ প্রশ্রয় ওর নিতম্বদেশে শিহরন জাগাল।

যজ্ঞেশ্বর ঝপ করে ওর পাশে বসে পড়ে কোনও ভণিতা না করেই ওর হাত দুটো চেপে ধরেই বললে, দাদা একটা উপায় করো। আমার দ্বারা বোধহয় কিছু হবে না। 

ও বলতে যাচ্ছিল, যজ্ঞেশ্বর, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত, প্রাপ্যবরাণ- 

তার আগেই যজ্ঞেশ্বর বলে উঠল, কাল এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেছে, মানে, করে ফেলেছি— 

যজ্ঞেশ্বর চুপ করে গেল। তার চোখ-মুখের ভাব দেখলেই মনে হয়, সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। 

যজ্ঞেশ্বর বলল, আচ্ছা তুমি হ্যাভলক এলিস পড়েছ? কামসূত্র? ওসব বইতে কি সত্যিই স্ত্রীকে মানে ইয়ে 

যজ্ঞেশ্বরের কান মুখ লাল হয়ে উঠছে। 

ও বলল, সুখী করবার- 

যজ্ঞেশ্বর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সুখী করবার কোনও প্র্যাকটিক্যাল পথ দেখানো আছে, নাকি সবটাই তাত্ত্বিক আলোচনা? 

ও বলল, আমি ওসব বই চোখেই দেখিনি। 

যজ্ঞেশ্বর অবাক হল। সত্যি? সত্যি বলছ? তবে তোমরা রাইটাররা এইসব ব্যাপার-ট্যাপার নিয়ে লেখো কী করে? যজ্ঞেশ্বর হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ভগ্নকণ্ঠে বলল, আচ্ছা সেশুয়াল ডিঅরডার সারিয়ে দেয় বলে রাস্তায় রাস্তায় যে বড় বড় সব সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে, ওগুলো কি রিলায়েবল্? সত্যিই কি ওরা পুরুষের দৌর্বল্য সারাতে পারে? পারে? 

ও বলল, কী জানি ভাই, আমি তো ওদিকে কখনও যাইনি, যাবার দরকারও পড়েনি। তবে তুমি একবার গিয়ে দেখতে পারো, যদি সত্যিই তেমন প্রয়োজন বোধ করে থাকো। 

যজ্ঞেশ্বর বলল, কাল রাতে একা শুয়েছিলাম তো। কালরাত্রি। স্বামী স্ত্রীতে নাকি মুখ পর্যন্ত দেখতে নেই। তোমাদের এই রটন্‌ সিসটেম না, উঃ, শালা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হয়। তোমরা রাইটাররা যে এর বিরুদ্ধে রিভোল্ট না করে কী করে থাকতে পারো, তা আমি বুঝতে পারিনে। 

ও বলল, রিভোল্টের কথা থাক। কাল রাতে কী হয়েছিল বলো? 

যজ্ঞেশ্বরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, সে ভাই বলা যায় না। 

ও উঠে পড়ল। আচ্ছা ভাই তা হলে চলি। অনেকটা পথ যেতে হবে তো। যা দিনকাল! 

যজ্ঞেশ্বর পাগলের মতো ওকে টেমে বসিয়ে দিল। বলল, দাদা দোহাই, একটা কিছু বিহিত করে দিয়ে যাও। আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যেও না। প্লি-ই-ই-জ। 

ও ধপ করে বসে পড়তেই স্থিতিস্থাপক ডানলোপিলো ওর নিতম্বদেশে অনাস্বাদিত এক পুলকের শিহরন আর একবার বিতরণ করল। যজ্ঞেশ্বর বিভ্রান্ত এবং কিছুটা উন্মনা। সিলিং ফ্যান জোরে ঘুরছে। এই মিশ্রিত পুষ্পের ঘ্রাণে, ওর মনে হল, এই বাসরশয্যার মোহ, এই সজ্জিত ঘরের প্রগল্ভ মদিরতার মধ্যে আর কিছুক্ষণ থাকলে ওকে আবিষ্ট করে ফেলবে! 

যজ্ঞেশ্বর ধরা ধরা গলায় বলল, কাল একা একা শুয়েছিলাম তো। এই প্রথম টের পেলাম আমার কোথায় যেন একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বাসরঘরের কথা ভাবছিলাম। জীবনে কাউকে কোনওদিন পরোয়া করিনি। কিন্তু বাসরঘরে বউ-এর দিকে কিছুতেই চাইতে পারলাম না। সারারাত এক গাদা মেয়ে হুল্লোড় করছিল। বার বার আমার হাত ধরে নানা ছুতোয় টানছিল। গায়ের উপর এসে পড়ছিল। যতই সাবধানে থাকি, এদিক-ওদিক এটা-ওটায় ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাচ্ছিল। আর ক্রমশ একসাইটেড হচ্ছিলাম। বিস্তারিত আর তোমাকে কী বলব? বাসরঘরে তোমাকেও যখন বসতে হয়েছে, তখন তো সবই জানো। 

ও বলল, বাসরঘরে আমাকে বসতে হয়নি। 

যজ্ঞেশ্বর অবাক হয়ে বলল, তার মানে? 

ও বলল, আমার একটা সুবিধে ছিল কি যজ্ঞেশ্বর, আমার তো দাদা নেই। তাই তাঁর সেনটিমেন্ট নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়নি। আমরা বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে করেছিলাম। কালরাত্রি-ফালরাত্রির ঝামেলা আমরা রাখিইনি। কাজেই বিয়ের প্রথম রাত থেকেই আমরা দু’জনে দু’জনকে জানতে কোনও বাধা পাইনি। 

যজ্ঞেশ্বর ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল, একটা টানা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, দাদা, তুমি লাকি। তবে ওই সঙ্গে যদি সিসটেমটাও চেন্‌জ করে দিতে তা হলে আজ আমার মত ইনোসেন্ট লোকের আর সিসটেমের ভিকটিম হতে হত না। আজ দ্যাখো থার্ড নাইট, অথচ আজও দু’জন দু’জনকে জানার স্কোপ পেলাম না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলে উঠল, আর এখন স্কোপ পেলেই কী আর না পেলেই বা কী? ইট ইজ টু লেট নাউ। 

ও উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে যজ্ঞেশ্বর, আপত্তি না থাকলে খুলে বলো তো ভাই। 

[ও এইবার বলল, সুধী পাঠক! সত্যি বলছি, যজ্ঞেশ্বরের এখন যে ভেঙেপড়া চেহারা দেখছেন, এটা দেখে তার সম্পর্কে কোনও ধারণা গড়ে তুলবেন না। যজ্ঞেশ্বর কী তা যদি জানতে চান, তবে আমি আপনাদের সামনে তিনজন সাক্ষী হাজির করছি, তাঁদের মুখ থেকে শুনুন। প্রথম সাক্ষী মিঃ ধারিয়া। মোহতা ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার। 

ও বলল, মিঃ ধারিয়া, অনুগ্রহ করে শপথবাক্য উচ্চারণ করুন। 

মিঃ ধারিয়া শপথবাক্য পাঠ করলেন—যাহা বলিব সত্য বলিব। কাহারও ভয়ে, উস্কানিতে অথবা প্রলোভনবশত মিথ্যা বলিব না। 

তারপর মিঃ ধারিয়া এদিক ওদিক চাইলেন। এবং বললেন, আমার নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দেবেন? 

সবাই নিরুত্তর। 

তখন মিঃ ধারিয়া বললেন, ওয়েল, তা হলে আমি আমার শপথ ইন টোটো রাখতে বাধ্য নই। 

সওয়াল : মিঃ ধারিয়া, যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আপনার যতটুকু পরিচয় তার ভিত্তিতে তার সম্পর্কে আপনার যে ধারণা গড়ে উঠছে, তদনুসারে যজ্ঞেশ্বরকে আপনি কী ধরনের লোক বলে মনে করেন? 

জবাব : ওয়েল, আমার নিরাপত্তা যদি অ্যাসিওর করা হয় তা হলে আই মে সে, হি 

ইজ টাফ অ্যান্ট ন্যাসটি। অ্যান্ড ওয়েল, হি ইজ এ ন্যুইসেনস্। তা না হলে আমাকে বলতে হবে, হি ইজ এ হার্ড বারগেনার। 

সওয়াল : আর কিছু বলতে পারেন ওর সম্পর্কে? 

জবাব : অবশ্যই। ও কোনও যুক্তি মানে না। সব সময় বল দেখাবার জন্যই যেন ব্যগ্র। 

সওয়াল : যজ্ঞেশ্বরের মধ্যে কখনও কি দ্বিধা দ্বন্দ্ব, ইতস্তত ভাব লক্ষ করেছেন? জবাব : কখনওই দেখিনি। 

ও বলল, ধন্যবাদ মিঃ ধারিয়া। 

দ্বিতীয় সাক্ষী ধরণীধর মান্না ওরফে মাস্তা। যজ্ঞেশ্বরের পুরনো পাড়ার মাস্তান। পার্টির অ্যাকশন স্কোয়াডের মেম্বার। 

ও বলল, সাক্ষী ধরণীধর মান্না ওরফে মাস্তা, আপনি অনুগ্রহ করে শপথবাক্য উচ্চারণ করুন। বলুন, যাহা বলিব সত্য বলিব- 

সাক্ষী : ওসব রংবাজি ছাড়ো গুরু। যাহা বলিব সত্য বলিব, শালা যুধিষ্ঠির! তারপর যখন রাস্তায় লাশখানা গড়াবে তখন গিয়ে কে ফুঁ দেবে, তুমি? 

সওয়াল : সাক্ষী, আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তার জবাব দিন। আপনি যজ্ঞেশ্বরকে চেনেন? 

জবাব : এক পাড়ায় এতদিন ছিলুম, চিনব না? এই মাত্তর ক’দিন হল ও ওদিকে উঠে গ্যাচে। এদিকে হাওয়া গরম হতেই ওদিকে হাওয়া দিয়েছে। 

সওয়াল : যজ্ঞেশ্বর সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? 

জবাব : ধারণা-ফারণা বুঝিনে। কী জানতে চাইচ, ঝেড়ে কাশো না? 

সওয়াল : যজ্ঞেশ্বর কেমন লোক! 

জবাব : গুরু আমাদের একখানা মাল। শুরুতে ছিল আমার মত অর্ডিনারি মাল, তারপর ক্রমে ক্রমে এখন জেনটে মাল হয়ে গ্যাচে। বাসট্যাসি, পুরো মালদার। 

ও বলল, ধন্যবাদ শ্রীধরণীধর মান্না ওরফে মাস্তা, এবার আপনি আসুন। 

ও বলল, তৃতীয় সাক্ষী বলরাম ঘোষ। যজ্ঞেশ্বরের ইউনিয়নের অন্যতম মাতব্বর। 

ও বলল, শপথবাক্যের আর দরকার নেই। বর্তমানে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে যেহেতু কোনও সাক্ষীরই নিরাপত্তার গ্যারানটি দেবার যোগ্যতা আমাদের নেই, তাই শপথবাক্যের কেতাটা না রাখাই বাস্তবতা-সম্মত। সাক্ষী, আপনার সঙ্গে তো যজ্ঞেশ্বরের খুবই ঘনিষ্ঠতা! 

সাক্ষী : আজ্ঞে হ্যাঁ। 

সওয়াল : ওঁকে কি কখনও আপনার দুর্বলচিত্ত লোক বলে মনে হয়েছে? 

জবাব : না। 

সওয়াল : সংকটের মুখে ওঁকে কি কখনও দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখেছেন? 

জবাব : আজ্ঞে না। 

সওয়াল : আপনার কথার সমর্থনে আপনি কি কোনও ঘটনার উল্লেখ করতে পারেন? 

জবাব : কেন পারব না, বহু ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি। 

সওয়াল : একটা উদাহরণ দিন। 

জবাব : আমাদের জেনারেল ম্যানেজার মিঃ ধারিয়াকে ঘেরাও-এর কথাটাই বলি। যজ্ঞেশ্বরবাবুর নেতৃত্বে ওকে আমরা ষাট ঘন্টা আটক করে রেখেছিলাম। মিঃ ধারিয়ার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এসে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিল। যজ্ঞেশ্বরবাবু টলেননি। বলেছিলেন, আমরা এখন সংগ্রামে লিপ্ত। হয় আমরা জিতব নয় উনি। আমাদের এখন জেতা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। 

ও বলল, পাঠক! যেসব সাক্ষীকে এখানে ডাকা হয়েছে, আপনারা সকলেই দেখলেন তাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক। এবং যজ্ঞেশ্বরকে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চেনেন। এই কারণেই আমি এঁদের সাক্ষ্যকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। এঁদের সাক্ষ্যে যজ্ঞেশ্বরের যে চেহারা ফুটে উঠল, দেখছেন তো সুধী পাঠক এবং সুশীলে পাঠিকে, তার সঙ্গে এখনকার যজ্ঞেশ্বর, যে কিনা আমার সামনে ফুলশয্যার জোড়া খাটে ভয়ে, দুর্ভাবনায় একেবারে সলতেটির মত নেতিয়ে পড়েছে, কোনও মিল নেই। এবং এ ধরনের লোক অকারণে বা সামান্য কারণে মুষড়ে পড়ার ছেলে নয়। তাই ওর এই রকম অবস্থা দেখে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। ] 

যজ্ঞেশ্বর হতাশভাবে বলল, আর দাদা আমার বারোটা বেজে গেছে। আমি বোধ হয় আমার বউ-এর সুখের কারণ হতে পারব না। আমি, আমি—আমি দাদা সিওর ফেল করব। আর গোপন করে কী হবে? তোমাকে খুলে বলি। 

যজ্ঞেশ্বর বলল, কাল একা একা শুয়ে ছিলাম। শুয়ে শুয়ে বাসরঘরের কথা ভাবতে ভাবতে বোধহয় ঘুম এসে গিয়েছিল। স্বপ্নে বাসরঘরটা জীবন্ত হয়ে উঠল। সেইসব মেয়েগুলো, তাদের ছোঁয়াছুঁয়ি…দারুণ উত্তেজনা এসে গেল। আর সেই  একসাইটমেন্টের মাথায় একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেল। 

যজ্ঞেশ্বর এবার উদ্বেগে অধীর হয়ে বলে উঠল, যত রাত বাড়ছে, আমি ততই ভয়ে শিটিয়ে যাচ্ছি। সারাক্ষণ কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে ব্যাপারটা চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। এখন? কী উপায় করি বলো? ওকে ফেস করতেই আমার ভয় করছে, আবার যদি ওই রকম বিশ্রী ব্যাপার কিছু ঘটে? 

.

যজ্ঞেশ্বরের যৌন শিক্ষা 

ও বলল, বৎস যজ্ঞেশ্বর! তোমার যে সমস্যা তাতে হ্যাভলক এলিস বা কামসূত্র বা যেসব চিকিৎসক সেশুয়াল ডিঅরডার মেরামত করার জন্য বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে কারখানা খুলেছেন, তাঁরা কোনও পথ দেখাতে পারবেন কি না, আমার সন্দেহ। 

যজ্ঞেশ্বর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল, তা হলে কি কোনও উপায় নেই? 

আত্মবিশ্বাসের ও বলল, বৎস, হতাশ হোয়ো না। তোমার যে সংকট, তা হল মূলত সংকট। তাই সর্বাগ্রে তোমাকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং একমাত্র ডায়েলেকটিক্‌সই এ যুগে হতাশের প্রাণে আশা, অবলের বল। তাই আমার মনে হয়, তুমি কমিউনিস্ট মেনিফেসটোর শরণ নাও। তোমার দাম্পত্য জীবনে সার্থকতা নেমে আসবে। 

গিয়েছে সযত্নে। যজ্ঞেশ্বর বামুন, সে বামুনের মেয়েই বিয়ে করেছে। আবহমান কাল ধরে বামুনের বিয়ে যেভাবে হয়, যজ্ঞেশ্বরের বিয়েও সেইভাবে হয়েছে। সেই অধিবাস, নান্দীমুখ। সেই গায়ে হলুদ, হাতে যজ্ঞসূত্র বাঁধা। সেই মায়ের কোলে বসে বলা, ‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ নিশ্চয়ই উপোস করে ছিল যজ্ঞেশ্বর। ভোর রাতে এয়োদের সঙ্গে দধিমঙ্গল সেরেছিল, সারাদিন দু-একটা সন্দেশ আর কাপ কয়েক চা খেয়েও থাকতে পারে। অর্থাৎ যতটুকু নিয়মভঙ্গ আচারসম্মত, সেটুকু সে ভেঙে থাকতে পারে। এইরকম সংলাপও হয়ে থাকবে, যজ্ঞেশ্বরকে ও যতটুকু জানে, তাতে হওয়া সম্ভব বলেই ও মনে করে, যথা : 

যজ্ঞেশ্বর (কপট ক্রোধে) : দ্যাখ, ফাজলামি করলে মার খাবি। 

যজ্ঞেশ্বরের বোন (বিবাহিত) : ফাজলামি নয় সেজদা, এটা করতে হয়। 

যজ্ঞেশ্বর : আমি ওসব পারব না। 

যজ্ঞেশ্বরের বউদি : যা বলছি করো ঠাকুরপো, নইলে বউ বশে থাকবে না। বুড়ো বয়সে বিয়ে করছ তো। 

যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : নে বাবা নে, হাঁ করো, কয়েক দলা মেখে রেখেছি, আস্তে আস্তে মুখে তুলে দিই। সোনা ছেলে, লক্ষ্মী ছেলে, ওগুলো খেয়ে ফ্যালো! এ তো দই আর চিড়ে বাবা। 

যজ্ঞেশ্বর : এই ভোর রাত্রে ওসব খেতে হবে! পেট গুলোবে আজু-মা। 

যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : নিয়ম-রিত তো মানতে হবে বাবা। সারাদিন নিরম্বু উপোস যাবে যে। 

যজ্ঞেশ্বর (খেতে খেতে) : এইজন্যই তো এদেশে একটা বিপ্লব এত জরুরি হয়ে পড়েছে। তোমাদের এইসব বস্তাপচা নিয়ম রীতি আর কতকাল পুষে রাখবে। (সেজো খুড়ির হাত মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে) আর না আজু-মা, প্লিজ, এবার সব পেট থেকে উঠে আসবে বলছি। 

অথবা (বিকালে)— 

যজ্ঞেশ্বর (কপট ক্রোধে) : এইবার সত্যিই এক থাপ্পড় খাবি! 

যজ্ঞেশ্বরের বোন (তিন-চার ছেলের মা–। নাকি নাকি আধো-আধো সুরে) : ওমা, দ্যাখো, সেজদা মারবে বলচে। বোস না সেজদা, মায়ের কোলে তো বসবি! 

যজ্ঞেশ্বরের বউদি : যা বলছি করো না ঠাকুরপো। সেই সকাল থেকে খামোকা জ্বালাচ্ছ। 

যজ্ঞেশ্বর : আমি জ্বালাচ্ছি না তোমরা জ্বালাচ্ছ! 

যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বেশ, আমরাই জ্বালাচ্ছি বাবা, আমরাই জ্বালাচ্ছি। কিন্তু আজ রাতেই তো তোমার সব জ্বালা জুড়িয়ে যাবে। 

মেয়েরা সব খিলখিল করে হেসে উঠল।

যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : বোসো বাবা বোসো, মায়ের কোল জুড়ে বোসো। বলো, ‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ শুভদিনে কাউকে কষ্ট দিতে নেই। এ বাড়ির রিত-কানুন একটা যখন আছে— 

যজ্ঞেশ্বর : আচ্ছা, এ সবের কোনও মানে হয়! সিলি। 

যজ্ঞেশ্বর মায়ের কোলে বসল। হুলুধ্বনি। মায়ের চোখ দিয়ে জল ঝরছে। 

যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বলো ঠাকুরপো—‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’

যজ্ঞেশ্বর : এই টোয়েনটিয়েথ সেনচুরিতে মানুষ যখন চাঁদে যাচ্ছে—তোমরা না-

যজ্ঞেশ্বরের বোন : বল না সেজদা- 

যজ্ঞেশ্বরের বউদি : বলো, ঠাকুরপো বলো-

যজ্ঞেশ্বরের সেজো খুড়ি : বলো বাবা আমার-

যজ্ঞেশ্বর : মা, তোমার বউ আনতে যাচ্ছি—

যজ্ঞেশ্বরের বোন ও বউদি : ও কী, ও কী! 

যজ্ঞেশ্বরের মা ও সেজো খুড়ি : থাক থাক, আজকালকার ছেলে- 

.

যজ্ঞেশ্বর ওকে বলল, মেনু-টেনু সব ছকুদার, বুঝলে। একেবারে চয়েসেস্ট। খাও ভাই, আমি ওদিকটা দেখি। 

সত্যিই ভাল খাবার। ফিশ ফ্রাই, মিহি মুগের ডাল, পটলের ভিতর ডিম পুরে দোরমা, রাধাবল্লভী লুচি, চিংড়ির মালাইকারি, রুই মাছ, ফ্রায়েড রাইস, ফার্স্ট ক্লাস রেজালা, আনারসের প্লাসটিক চাটনি, পাঁপর, দই, রসগোল্লা, সন্দেশ আর তবক মোড়া পান। একেবারে নিট। 

আসলে কাছ থেকে না দেখলে, ওর মনে হল, মানুষ সম্পর্কে ধারণা সাফ হয় না। ওর সামনে বসে প্রাক্তন সরকারের সংগ্রামী মন্ত্রীরা বেশ তারিয়ে তারিয়েই নেমন্তন্ন খাচ্ছেন। তাঁদের পাশে বসে সরকারি অফিসারেরা, তাঁদের পাশে যজ্ঞেশ্বরের শ্বশুর এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং এদিকে শচী, তার পাশে কেয়া এবং তার পাশে ও। বেশ সুন্দর পরিবেশ। 

হঠাৎ কেয়া (মনে মনে) : কে সরকারি অফিসার আর কে সংগ্রামী নেতা—ওদের এই ভোজের আসরে দেখে তা বোঝা যায়? 

ও চমকে উঠে (মনে মনে) : না, কেয়া প্লিজ, খক্‌ খক্ খক্‌ 

কেয়া ওর দিকে মুখ তুলে চাইল। 

বলল, জল খাও, জল খাও। বিষম লেগেছে। 

ও লজ্জিত হয়ে কয়েক চুমুক জল খেয়ে নিল। 

ও (মনে মনে) : আসলে আমরা মানুষকে দেখি পরে, আগে তার পোশাক, পদবি এইসবই দেখি তো। তাই সব সময় বুঝতে পারিনে, কে কী। 

কেয়া (মনে মনে) : এখন দেখলে কে বলবে ওদের এত তেজ? 

ও (মনে মনে) : আসলে আমরা তো ওদের দেখছি বর্তমানের সামাজিকতার পটভূমিতে। নয় কি? যখন আবার অন্য— 

কেয়া (মনে মনে) : ওঁরা কে কী দিয়েছে জানো? 

ও বিপন্ন হয়ে (মনে মনে) : সামাজিকতা মানুষকে- 

কেয়া (মনে মনে) : একজন দিয়েছেন চূড়, আরেকজন দিয়েছেন কড়িয়াল, আরেকজন দিয়েছেন বেনারসি। দাম কত জানো? 

ও (মনে মনে) : আসলে মানুষকে— 

কেয়া (মনে মনে) : তবে আমাদের সঙ্গে ওঁদের তফাত কোথায়? 

ও ভাল করে লক্ষ করে তাঁদের খাওয়া দেখতে লাগল। 

একজন : আরে আরে, করছ কী ছকু, মেরে ফেলবে নাকি?

ছকু : সি-আর-পি যা পারেনি, তা কি আমি পারব? হো হো করে সবাই হেসে উঠলেন। 

আর একজন : না না, আর একদম না। একটাও না। 

ছকু : এক পিস। মাছটা একেবারে ফ্রেশ। সোনারপুরের মাছ। 

ছকু বকশি যে কেন এত ভাল শ্রমিক নেতা, এই ভোজের আসরে বসে ও তা যেন উপলব্ধি করল। প্রাক্তন মন্ত্রী মহোদয়েরা হাত গুটিয়ে নিয়েও রেহাই পাননি। ছকুর অনুরোধে আরও কয়েক পিস ফিশ ফ্রাই (কারণ মাছটা খুবই ফ্রেশ) কি মালাইকারি (কেননা বাগদা চিংড়ি ছকু একটা একটা করে নিজে বেছে এনেছে) কি রেজালা (বেস্ট মোগলাই রেস্তোরাঁর বাবুর্চিকে ছকু এনে কাজে লাগিয়েছে) তাঁদের নিতেই হয়েছে। এবং না না, আর না ছকু, দিস ইজ এ ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট, এসব বলতে বলতেও বাড়তি একটা দুটো রসগোল্লা কি সন্দেশও নিতে হয়েছে। তাঁদেরও, প্রশাসনের ও শান্তিরক্ষার কর্ণধারদেরও এবং অন্যান্য অভ্যাগতদেরও। 

একমাত্র কেয়া আর ও, ওদের ব্যাচে ও দেখল, ওরা দু’জনই রেহাই পেয়ে গিয়েছিল। পরিবেশক এসে কেয়াকে এক পিস কি একটা নেবার জন্য উপরোধ করতেই সে গলা দিয়ে অদ্ভুত রকম একটা স্বর বের করে এমনভাবে বলল, আমি ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা’ অমান্য করে বিপদে পড়ি, আপনি নিশ্চয়ই এটা চান না—সে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে পিসটা শচীর পাতে ফেলে দিল। 

ছকু তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ব্যাপারটা হালকা করে দেবার জন্য বললেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা—এটা সত্যমেব জয়তের মতোই বিরাট একটা রসিকতা, ও কথা মনে রেখে রেজালার স্বাদ গ্রহণ না করলে আমরা খুব দুঃখ পাব মিসেস্ বাগচি। 

কেয়া বলল, রসিকতাটা আপনার কাছে খুবই হালকা, কিন্তু আমার পক্ষে অত্যন্ত গুরুপাক। অতএব মাফ করবেন। 

শচী কেয়ার ভাবগতিক দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে বলল, ও খুব স্ট্রিক্ট ডায়েটে থাকে, জানেন ছকুবাবু। একটু এদিক ওদিক হলেই ভয়ানক আপসেট হয়ে পড়ে। 

তা-ই বলুন। ছকু হাসতে হাসতে ওধারে চলে গেলেন। যাবার সময় শচীকে বলে গেলেন, আপনি আবার যেন স্যার ওই অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। 

খেপেছেন ছকুবাবু! নিয়মগুলো আছেই তো মাঝে মাঝে ভাঙবার জন্য। শচী হা হা করে হেসে উঠল। 

.

বিয়েবাড়িতে আসবার আগে শচীর সংকল্প 

শচী বেশ ভাল করে চান করে নিল। পরিষ্কার করে কামানোর ফলে ওর গাল দুটো বেশ মোলায়েম হয়ে উঠেছে। সে ওলড্ স্পাইসের বোতল খুলে দু’ আঁজলা আফটার-শেভ লোশন তার দু গালে থাবড়ে দিল। ওল্ড স্পাইস আফটার-শেভ লোশন…ব্রিস্ক অ্যাজ অ্যান ওশ্যান ব্রিজ। কুলস্, স্টিমুলেটস, রিফ্রেশেস, মেকস্ ইউ ফিল ওয়াইড অ্যাওয়েক অ্যান্ড ভেরি মাচ ইন কম্যান্ড। হ্যাজ দি ক্লিন ওলড্ স্পাইস অ্যারোমা এভরিওয়ান এনজয়েস। 

আফিসের টেনশন অনেকটা কমে এল। ভুরভুরে গন্ধটা তাকে বেশ খানিকটা একটা হাল্কা উৎফুল্লও করে তুলল। সে অভ্যাসবশে পোশাকের আলমারিটা খুলল; স্যুট বেরও করে ফেলল। 

এতক্ষণ পর্যন্ত তার কোনও সমস্যা ছিল না। তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপে তার চেনা ছিল। এবং যে প্রত্যয় থাকলে মানুষ অনায়াসে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, সে প্রত্যয়টুকু তাতে বর্তমান ছিল। তারপর অকস্মাৎ যে মুহূর্তে তার মনে হল যজ্ঞেশ্বরের বিয়েতে কী স্যুট পরে যাওয়া তার ঠিক হবে, ব্যস, সেই মুহূর্ত থেকেই তার মনের প্রশান্তির ভিতটা টলমল করে উঠল। ননসেন্‌স, সে নিজেকেই ধমক দিল, হোয়াই অ্যাম আই সো শেকি? 

কেয়াকে সে বলল, কেয়া, ধুতি পাঞ্জাবিই দাও। 

এবং সে হুইসকির বোতলটা নিয়ে বসল। 

কেয়া তৈরি হয়ে এসে শুধু বলল, এখন ওটা কি না-খেলেই নয়! 

গেলাসে ঢালতে ঢালতে শচী বলল, জাস্ট এ স্মল ওয়ান। ফর দি রোড। ঠিক করলাম বিয়েবাড়িতে ধুতি পরেই যাক। বেশিক্ষণ থাকব না, বুঝলে। ও দ্যাট ক্রাউড! আজকাল একদম সহ্য করতে পারিনে। অ্যাভয়েড করা ঠিক হবে না, তাই যাচ্ছি। কারসি কল আর কি। 

কেয়া বলল, গগন মুখুজ্জের মেয়ের সঙ্গে তো ওর বিয়ে হল। বিয়েতেই যেতে বলে গিয়েছিলেন। সেদিন যেতে পারলাম না তাই আজ যাচ্ছি। নইলে আমারও তেমন যাবার ইচ্ছে ছিল না। 

শচী বলল, আমারও তা-ই। গগন মুখুজ্জে কে? 

কেয়া বলল, বাবার কে মক্কেল। তবে এক সময় এক পাড়ায় ছিলাম। কাছাকাছি। বেশ যাতায়াত ছিল তখন। এখন গগনবাবুর বিরাট অবস্থা। 

আয়েশ করে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে শচী বলল, আচ্ছা! শচীর আবার টেনশন কমে এসেছে। 

কেয়া বলল, বেশ দিয়ে-থুয়েই মেয়ের বিয়ে দেবেন। বড় জামাইকে তো কারখানাই করে দিয়েছিলেন। রত্না ওঁর মেজো মেয়ে। 

শচী আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বলল, ওঁর আর মেয়ে নেই? 

কেয়া বলল, না বোধহয়, কেন? 

শচী বলল, না এমনি। বড় জামাই কারখানার মালিক। মেজো জামাই শ্রমিক নেতা। বেশ খুঁজে বের করেছেন তো! 

কেয়া বলল, তা উনি কী করবেন! যজ্ঞেশ্বরবাবু কী করেন তোমাদের অফিসে? শচী আবার একটা ঢালছে দেখে কেয়া বলল, আরও খাবে? 

শচী বলল, দিস ইজ দি লাস্ট। এটা গগনবাবুর জামাই-ভাগ্যের জন্য। যজ্ঞেশ্বর ইজ এ নাইস চ্যাপ। এমনি একটা কাজ করে আমাদের ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানে হি ইজ মোর দ্যান এ জেনারেল ম্যানেজার। 

আসলে শচীর অস্বস্তির এইটেই কারণ। কেননা শচী সম্ভবত মিঃ ধারিয়ার জায়গায় জেনারেল ম্যানেজার হতে যাচ্ছে। অফিসের হাওয়া থেকে তা-ই মনে হয়। গত দু’ বছর ধরে ধারিয়াকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছে যজ্ঞেশ্বর তাতে তার কথা মনে হলেই শচীর টেনশন বেড়ে যায়। 

শচী ঠিক করল, যজ্ঞেশ্বরের বউভাতে যাবে। যতটা সৌজন্য দেখাতে হয় দেখাবে, উপহারটা দেবে, তারপর শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। 

.

কেয়া আর ওর কথোপকথন : (মনে মনে) 

কেয়া : আচ্ছা, শচী এত ড্রিংক করে কেন? 

ও (অবাক হয়ে) : বাঃ! আমি তার কী জানি? কেয়া : কেন, জানো না? 

ও : তুমি ওর বউ, তোমারই তো জানা উচিত। 

কেয়া : প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? তুমিও তো ওর বন্ধু। 

ও : বন্ধু! ও হ্যাঁ। সে তো কবেকার কথা। তখন শচী তো আর এ-শচী ছিল না, আমিও আর এ-আমি ছিলাম না। 

কেয়া : শচী কী শচী ছিল আর তুমিই বা কোন তুমি ছিলে? 

ও : এটা তো আমার জানা কথা কেয়া। সে শচী ছিল কবি। ব্রিলিয়ান্ট কবি। তুমি যার প্রেমে পড়েছিলে। আমিও তার প্রেমে পড়েছিলাম, সে তো অনেকদিনের কথা। 

কেয়া : হ্যাঁ, অনেকদিনের কথা। অনেক কষ্ট সহ্য করেছিল ভাল কবি হতে গিয়ে। আমাদের চাঁদা করে বিয়ে হয়েছিল। বাবা অনেক করে বুঝিয়েছিলেন শচীকে। বিয়ের সব খরচ দিতে চেয়েছিলেন। আমি বাবার কথা শুনিনি। শচীর কথাই রেখেছিলাম। 

ও : হ্যাঁ। শচীর কথা আমিও অমান্য করতে পারতাম না। 

কেয়া : আমরা কেউ পারতাম না। ও সবাইকে বাগ মানিয়েছিল। 

ও : ওর চরিত্রের সেইটেই সব থেকে বড় আকর্ষণ। ও যেন কঠিন পাথরে দুটো পা রেখে কথা বলত, আর আমাদের পা যেন শূন্যে ভাসত, তাই মনে হত ও যা বলছে, তার উপরে আর কথা নেই। 

কেয়া : তারপর? 

ও : তারপর! 

কেয়া : তারপর কী হল? 

ও : তারপর আবার কী হবে। আমাদের সকলের বয়স বেড়ে গেল। 

কেয়া : বয়েস বেড়ে গেল বলে বন্ধুত্ব ফুরিয়ে গেল! বাঃ! 

ও : এতে অবাক হবার কী আছে? 

কেয়া : অবাক হচ্ছি তোমার বুজরুকি দেখে। সত্যি কথাটা তুমি কিছুতেই বলতে চাইছ না। 

ও : কোন্ সত্য গোপন করছি? 

কেয়া : শচীর পায়ের তলায় এখন আর কোনও শক্ত মাটি নেই, এই সত্যটা। এটা ও জানে। তাই ও ভয় পায়। কোনও সিদ্ধান্ত আর নিতে পারে না। 

ও : শচী কাকে ভয় পায়? 

কেয়া: মিঃ মোহতাকে, যজ্ঞেশ্বরকে, পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেদেরকে, তোমাকে, আমাকে, এমন কি ওর নিজেকেও। সে এক ছেলেমানুষি ভয়। জানো তো, এক সময় ওর কাগজ পড়া কী রকম নেশা ছিল। আদ্যোপান্ত কাগজ না পড়লে ওর ভাত হজম হত না। এখন আমাদের বাড়িতেই আর কোনও কাগজ আসে না। সব বন্ধ করে দিয়েছে। 

ও : কেন? 

কেয়া : রোজ রোজ খুনের খবর বেরোয়। পাছে তাতে চোখ পড়ে, তাই। 

.

ব্রিজের উপরে দু’জনে : গার্হস্থ্য চিন্তা 

শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে এলে ওর বউ-এর কথা বলার ইচ্ছে জাগে। মিনুর এই একটা বরাবরের ক্ষোভ। সে তার স্বামীর সঙ্গে কিছুতেই আশ মিটিয়ে কথা বলতে পারে না। তার সংসারে হাড়ভাঙা খাটুনি তার গায়ে লাগে না। কিন্তু তাকে কেউ গ্রাহ্য করছে না, এটা তার ভীষণ মনে লাগে। বিশেষ করে সে যখন তার স্বামীর সঙ্গে দুটো কথা বলতে যায়, এমন হাতি-ঘোড়া কথা কিছু নয়, সাধারণ সাদামাটা কথা, সে দেখে তার স্বামী হয় বই মুখে করে বসে আছে, না হয় হাই তুলছে, তখনই তার উৎসাহ নিবে যায়। তার প্রচণ্ড অভিমান হয়। সে কি তবে কিছু না? আর যখনই তার মনে হয় সে কিছু না, তখনই তার মনে পড়ে ওদের জন্য সে কত করে। ওরা তার দান দু হাত ভরে নেয় এবং এক কানাকড়ি প্রতিদান কেউ দেয় না। ওরা এতই স্বার্থপর! এসব কথা যখন তার মনে হয় তখন সে বোধ করে সংসারটা একটা দড়ি হয়ে তাকে দ্রুত পেঁচিয়ে ধরছে। তার দেহে, তার গলায় ফাঁস পড়েছে। ফাঁসে ক্রমে টান পড়ছে, সে গলগল করে ঘামতে 

টান পড়ছে। অনেক রাতে আতঙ্কে তার ঘুম ভেঙে যায়। থাকে; তার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। অথচ আশ্চর্য, সে শুয়ে শুয়ে দেখে, সে যে যন্ত্রণা পাচ্ছে, সে মরছে তিলে তিলে, এ নিয়ে কোথাও কোনও চাঞ্চল্য নেই। 

খুব কম সময় আসে তার জীবন যখন তার ভাল লাগে। যেমন এখন। তাই তার কথা বলার ইচ্ছে জাগে। মিনু তার স্বামীর মুখের দিকে চাইল। ওর চোখ দুটো কোন সুদূরে চলে গেছে। একেবারে তন্ময় হয়ে কী ভাবছে। ওর মুখখানা বেশ নরম, বেশ করুণ হয়ে এসেছে। কী যেন বলছিল একটু আগে ফিসফিস করে। কোথায় যেন যেতে বলছিল তাকে। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, লেকে যেতে চাইছিল তাকে নিয়ে। মিনুর তাপদগ্ধ বয়স্ক শরীরটাতেও একটা শিহরন খেলে গেল। লেকে যেতে চাইছিল মিনুর স্বামী তাকে সঙ্গে নিয়ে। ভরপেট নেমন্তন্ন খেয়ে। কিন্তু সে কলকাতা কি আর আছে বউদি! যজ্ঞেশ্বরের এক বোন মিনুকে বলেছিল। 

হঠাৎ যেন একটা ভয়ানক জরুরি কথা মনে পড়ে গিয়েছে, মিনু সেইভাবে বলল, যজ্ঞেশ্বরবাবুর এক বোনকে আমি চিনি, জানো? 

আচমকা ওর বউ-এর কথাটা ও ধরতে পারল না। আসলে অন্যমনস্ক ছিল। কেয়া তখন ওর মগজে। ও খুব বিব্রত হয়ে উঠল।

কেয়া বলল, শচী যজ্ঞেশ্বরদের বাড়িতে জাস্ট এ কারস্ িকল দিয়ে সরে পড়বে বলে এসেছিল। তুমি কি তা জানো? 

ও বলল, তাই নাকি! 

মিনু বলল, হ্যাঁ। ও যে আমাদের সমিতিতে আসত। ও যে যজ্ঞেশ্বরের বোন তা আমি অবিশ্যি এখানে এসেই জানলাম। মেয়েটা বেশ ভাল। ওরই মধ্যে বেশ যত্ন করে আমাকে কে কী দিয়েছে, দেখাল। পেয়েছেও খুব। 

কেয়া বলল, শচী আসবার আগে তো আমাকে তা-ই বলল। 

ও বলল, তাই বুঝি! 

মিনু বলল, ওরা তো ওপাড়া থেকে চলে এসেছে। ওদের বাড়িতে তো খুব বোমা-টোমা পড়েছিল। যজ্ঞেশ্বরের ভাইকে একদিন পাইপগান নিয়ে তেড়েও এসেছিল। ওর বোন বলল, অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এলাম বউদি। না হলে কত বড় বাড়ি ছিল আমাদের। আর জলের দরে ভাড়া। যুদ্ধের মধ্যে আমার বাবা ওই বাড়ি ভাড়া করেছিলেন। পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় আটখানা ঘর। আমাদের জন্মকম্ম সবই ওখানে। ওর বোন বলল কী জানো, এ পাড়াটা ওর দাদাদের দলের মুঠোয়। তাই এদিকে ওরা নিশ্চিন্ত। 

কেয়া বলল, সেই শচীকে দেখলে তো। এল, ঘুরে ঘুরে গল্প করল, রসিকতা শুনল, রসিকতা করল, কত খেল। ও এত খায় না। মিঃ মোহতাকে খুশি রাখার ব্যাপার এটা নয়। ও যেন যজ্ঞেশ্বরের গুড বুকে ওঠার চেষ্টা করছে। 

ও বলে উঠল, কী যে বলো! 

মিনু বলল, হ্যাঁ। ওর বোন বলল যে। ওরা ভয়ে চলে এসেছে। 

কেয়া বলল, আমি বলছি, শচী ভয় পেয়েছে। যজ্ঞেশ্বরকে, কেন জানিনে, ওঁ ভয় করছে। 

ও বলল, এ তোমার নিছক কল্পনা। এতে ভয়ের কী দেখলে! 

মিনু বলল, ওর বোন বলল। আমি কি বানিয়ে বলছি। ওর বোন বলল, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ওদের চলাফেরা অবধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিনেমায় যেতে পারত না, বাজারে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল ওরা। শুধু যজ্ঞেশ্বর আর তার দাদাকে ওদের দলের ছেলেরা পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। একা বেরোতে ওরা সাহস পেত না।

কেয়া বলল, বিয়েবাড়িতে আসার আগে শচী হঠাৎ দুটো হুইস্কি খেয়ে নিল। যাতে ও এখানে আসতে সাহস পায়। 

মিনু বলল, আমার তো মনে হয়, এ পাড়ায় এসেও ওরা খুব একটা নিশ্চিন্ত নেই। বাড়ির বাইরে কত পুলিশ, দেখেছিলে! 

কেয়া বলল, পুলিশের বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে শচী কীরকম ভাব জমাচ্ছিল, লক্ষ করেছিলে! 

ও বলল, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে! 

ও একথা বলল বটে, কিন্তু অকস্মাৎ নিজেই একটা অস্বাভাবিক কাজ করে বসল। ব্রিজের রেলিংটায় দু’হাতে ভর দিয়ে গোরিলার মত ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর আকাশ ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠল। তারপর যাতে আকাশ-পাতাল কেঁপে ওঠে, মনে মনে তেমনিভাবে চেঁচিয়ে বলল, আর যাদের দলের ছেলে নেই, পুলিশ অফিসার নেই, হুইস্কি নেই, তারা কী করবে! ইউ বাস্টারস! 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *