গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর থেকে, দুজনে – ৩

ওর পাগলামির লম্বা কৈফিয়ত 

মিনু বেশ ভয় পেয়ে গেছে। ওর চোখে মুখে বেশ উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি জানি, ও ভাবছে আমার মাথা খারাপ হয়েছে। এখনই ও বাড়ি যেতে চাইবে। তার আগেই আপনাদের আমার কথাটা জানিয়ে দিতে চাই। আপনারা, যারা আমাদের দু’জনকে এই ব্রিজের উপর উঠে আসতে দেখেছেন এবং এতক্ষণ ধরে আমাদের হাবভাব বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করছেন, সেই তাদের কাছেই আমার প্রশ্ন, আপনারা নিশ্চয়ই মিনুর মত, মানে আমার বউ-এর মত আমাকে পাগল ভাবছেন না। ভাববার কোনও কারণ নেই। আমি সত্যিই স্বাভাবিক। আপনাদের মতই সাধারণ। অনেক দূর থেকে, উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণে বউভাতের নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলাম। এটা নিশ্চয়ই পাগলামি নয়। এসেছিলাম বউকে সঙ্গে নিয়ে। বউকে একটু সঙ্গ দেবার ইচ্ছে জেগেছিল। এটা কি পাগলামি? এ বাড়িতে আসার ইচ্ছে ওর ছিল না। কাউকে চেনে না তো। তাই আসতে ও চায়নি। আমি একরকম জোর করেই ওকে নিয়ে এসেছি। মিনুর অসুখ আমি বুঝতে পারি। সংসারের সমস্ত ঝক্কি সে সামলায়। আর আজকাল কলকাতা শহরে যেখানে দ্রব্যমূল্য সতত অস্থির সেখানে একমাত্র অর্থমন্ত্রী ছাড়া আর সকলের পক্ষেই সংসারের লগি ঠেলা রীতিমত স্নায়ুবিধ্বংসী ব্যাপার। মিনু যেহেতু একেবারেই সাধারণ মেয়ে কাজেই তার পক্ষে এই ব্যাপারটা ভারতের বৃহত্তর পটভূমিকার প্রেক্ষিতে বিচার করে দেখা সম্ভব নয়। তার কাছে এটা আশা করা অন্যায়। আমি আশা করিও না। তাকে সংসার চালাতে হয়। এবং সে সংসার চালায় বলে সকলেই তার কাছে অযৌক্তিক দাবির ফর্দ তুলে ধরে, এমন কি, আমিও কবুল করছি, আমিও। স্বভাবতই সে কাউকে খুশি করতে পারে না। এবং সে সঙ্গতভাবেই ভেবে দ্যাখে, তার কোনও দোষ নেই। সত্যিই নেই। আমার কাছ থেকে সে যেরকম টাকা পাবে, সে তো সেইভাবেই চালাবে। অতএব দোষ যদি কাউকে দিতে হয় তবে আমাকেই দিতে হয়। এবং আমাদের সংসারে এক মিনু ছাড়া আমাকে কেউ দোষ দেয় না। সবাই মিনুকে দোষে। 

এবার অনুগ্রহ করে আমার দিকটা দেখুন। আমি বেতন যেরকম পাব, সেইমতো টাকাই তো সংসারে দেব। তাতে যদি আমার সংসারের অভাব না মেটে তো আমার আর কী করার থাকতে পারে। কথাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। এইরকম যুক্তি-শৃঙ্খল ধরে আমরা যদি ক্রমশ এগোই তবে দেখবেন, আমরা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংকটের সামগ্রিক এক মসীময় চিত্র এঁকে ফেলতে পারব। এবং এই জটিল গোলকধাঁধা আমাদের উত্তরোত্তর হতাশ করে তুলতে সহায়ক হবে। এবং এই বিরাট কৃষ্ণবর্ণ এক হতাশার আকাশতলে দাঁড়িয়ে আমাদের কারওই আর বাঁচার ইচ্ছা থাকবে না। কিন্তু তথাপি আমরা বেঁচে থাকছি। এবং আছি সংসার নামক এক অতি বাস্তব আধারের মধ্যে, যার আপাত অস্তিত্ব যন্ত্রণাদায়ক। আচ্ছা, এবার বলুন, কেউ যদি এই সংসারে থেকে বলে, আমি ভালবাসব, সেটা কি পাগলামি? 

এটা যদি পাগলামি হয়, তবে যথার্থই আমি পাগল। কারণ সর্বদাই আমি আমার বউকে, বউ-এর শরীর আর মন আর সত্তাকে, কীভাবে ভালবাসব তার ফাঁক খুঁজছি। আমি মিনুকে আগলে রাখতে চাই, কারণ আমার সংসারের দাবিদাররা ওকে ঠিকমত বুঝতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেই বা কাকে বুঝতে পারে। সবাই তো আমরা আন্দাজেই চলি। 

যাই হোক, আমি ব্যতিক্রম কিছু ঘটাতে চাই না। বউকে সঙ্গে নিয়ে অফিসের সহকর্মীর বউভাতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে আসা যে ব্যতিক্রম, আশা করি সে কথা আপনারা কেউ বলবেন না। সত্যি বলতে কি, যজ্ঞেশ্বরের বউভাতে আমার না এলেও চলত। আমি আর সে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি, একই কো-অপারেটিভ সোসাইটির সদস্য, আর যেহেতু সে আমাদের অফিসের ইউনিয়নের অবিসংবাদী নেতা, তার অফিসের কাজ প্রায়ই জমে থাকে এবং শচীর নির্দেশে প্রায় তার বকেয়া কাজ আমাকেই করে দিতে হয়, যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের প্রাথমিক ভিত্তি হল এই। এর বেশি নয়, কমও নয়। তবে কিছুকাল হল যজ্ঞেশ্বর আমার সঙ্গে দু-একটা ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলতে শুরু করেছে। ফলে কিছুটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি। সেই সূত্রেই আমরা পরস্পর তুমি-তুমি করতে শুরু করেছি। ব্যস এই। 

তবে এর জন্য তার বউভাতে আসতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আমার ছিল না। আমার পজিশনটা যে এত বিস্তারিতভাবে বোঝাতে হল তা এই কারণে যে, আমি সত্যিই মিনুকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছি, ওর সঙ্গে একটু একা থাকব বলে, একথাটা না-হলে বোঝাতে পারতাম না। এবার দেখুন, আমরা যে এই ব্রিজে এতক্ষণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি, এটা আপনাদের কাছে আর অস্বাভাবিক ঠেকবে না। 

এসেছিলাম কীভাবে তাও আপনাদের বলি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ভিড়ের বাসে ঝুলতে ঝুলতে ন’ নম্বর বাস টারমিনাসে গিয়েছিলাম। দোতলায় একেবারে সামনের সিটে বসব বলে। মাত্র একটাই বাস দাঁড়িয়ে ছিল। চটপট তার উপরে উঠেই আমাদের মনোমত জায়গা পেয়ে গেলাম। কলকাতায় এ একটা বলার মত ঘটনা। যেন রূপকথা। কেননা, ও বাসটা ছাড়ল না। একটু পরে যে বাসটা বোঝাই হয়ে এল, কোথা থেকে জানিনে, শুনলাম সেইটেই ছাড়বে। সে-বাসে মনোমত সিট ছিল না। তাতে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, ততক্ষণে আমার সংকল্প স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আজ শুধু আমি আর মিনু। কোনও ঘটনাকেই আজ আমাদের দু’জনের মধ্যে আড়াল রচনা করতে দেব না। 

তাই অপেক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে নীচে নেমে গিয়ে স্টেট বাসের পোশাক পরা যাকে পেলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, এই বাসটা কখন ছাড়বে? তিনি বললেন, ওদিকে জিজ্ঞেস করুন। ওদিকের জন আবার আরেকদিকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি আবার আরেকজনের কাছে। কলকাতা শহরে আপনারা আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, স্টেট বাস কর্মীদের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। তাই আমি অসহিষ্ণু হলাম না। কেননা আজ আমি সংকল্পে স্থির। আজ আমি আর মিনু। ব্যস। 

আরও একটা বাস এল। মিনু তখনও আমার মতলব বোঝেনি। সে তখনও জানে, নেমন্তন্নে যাওয়াটাই আমাদের এই যাত্রার লক্ষ্য। তাই সে বাস ছাড়ার সময়টায় উসখুস করে উঠছিল। 

আমি মিনুকে তার পাশে বসে শুধু অনুভব দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম, ব্যস্ত হয়ো না মিনু। আমরা অন্য বাসে যাব না। আমাদের বাস এইটেই। এ যদি আমাদের কোথাও পৌঁছে দিতে চায়, যাব। না চায়, এইখানে বসে থাকব, দু’জনে। যতক্ষণ ভাল লাগবে, ততক্ষণ। তারপর না হয় নেমে যাব। এসো আজ আমরা এই বাসটায় বসে বসে ভাল লাগার চাষ শুরু করি। মিনু হয়ত বুঝতে চেষ্টা করছিল, হয়ত বুঝত, যদি না উপহার দেবার জন্য কেনা শাড়িটা ওর কোলের উপর পড়ে থেকে বিরক্ত করত। তবু সে কিছু বলেনি। শুধু দু’জনে পাশাপাশি বসে থাকার জাদুটা, হয়ত তাকে খানিকটা আচ্ছন্ন করে থাকবে। আমি ওকে বলতে চাইলাম, ব্যস্ত হয়ো না মিনু। সব বাসই ঠিকানায় পৌঁছায়, কেউ আগে, কেউ পরে। এসো, আমরা তার উপর নির্ভর করি। তবে হয়ত আমরা সুখ পেতে পারি। 

আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, অতীতে আবেগের মাথায় আমি মিনুকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, একা ওকে নিয়ে কোথায় যাব, যাব কোনও ভাল জায়গায়, নির্জনে, স্বল্পখ্যাত বা অখ্যাত সমুদ্রতীরে, অথবা শৈলশহরে বা কোনও গভীর অরণ্যবর্তী এক ডাকবাংলোয়। শুধু পরখ করতে, মানুষ থেকে দূরে, সংসার থেকে দূরে, শুধু দু’জনে থাকলে কেমন লাগে। 

সত্যি বলতে কি, আসলে আমি চেয়েছিলাম আমার অলিখিত কোনও উপন্যাসের জন্য মনোরম একটি অধ্যায় রচনা করতে। ওঃ, আপনাদের বলা হয়নি যে, আমি একজন পার্ট-টাইম লেখক! 

এবার বুঝেছেন তো, আমার স্ত্রীকে নিয়ে অনিচ্ছুক এক বাসের দোতলায় সামনের সিটে নিশ্চিন্ত মনে সওয়ার হয়ে থাকার মধ্যে কেন কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। 

আমি যে মিনুকে প্রতিশ্রুত কোনও নন্দনকাননে নিয়ে যেতে পারিনি, তার কারণ আমার তরফের কোনও অনিচ্ছা নয়, সোজাসুজি আর্থিক অক্ষমতা। আমি যে যজ্ঞেশ্বরের রাজনীতি অপছন্দ করা সত্ত্বেও তার দিকে ঝুঁকেছিলাম, তার কারণ এই যে, আমার কর্মজীবনে সে-ই একমাত্র লোক যে কিনা যখন-তখন আমার চোখে একটা অতিরিক্ত প্রাপ্তিযোগের ছবি এঁকে দিতে পারত। যে ছবিটা কখনও হত বর্ধিত মাগগি ভাতার, কখনও বা আটমাসের বোনাসের। বা এই জাতীয় অন্য কোনও কিছুর। এসব কথা যে মুহূর্ত থেকে শুনতাম সেই মুহূর্ত থেকেই শুধু আমার আর মিনুর নির্জন বাসের সম্ভাবনাটা যেন স্বচ্ছ এবং নিকটবর্তী হয়ে আসত। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর যেমন শেষ পর্যন্ত থোক থোক টাকা পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিটা রাখতে পারত না, আমিও তেমনি মিনুকে নিয়ে ক’দিনের জন্য কোথাও চলে যাবার প্রতিশ্রুতিটা রাখতে পারতাম না। 

আরেকটা উপায় অবশ্য ছিল। আমার মাকে বা বোনেদের কিছুদিনের জন্য মেজদা কি বড়দি, কি অন্য সব বিবাহিত বোনেদের বাড়িতে যদি পাঠিয়ে দেওয়া যেত, তা হলেও ক’দিন এই বাড়িতেই শুধু আমি আর মিনু শুধু দু’জন দু’জনের সঙ্গ লাভ করতে পারতাম। কিন্তু যদিও অন্যেরা মায়ের ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করত এবং মিনুর হাতে মায়ের যত্ন তেমন হচ্ছে না, এ বিষয়ে প্রায় সবাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এসে পৌঁচেছিল, তবু মাকে কয়েক দিনের জন্যও কেউ অধিকতর শান্তির নীড়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাত না। মাও কোথাও যেতে চাইত না। যদিও মেজো বউদি বা অন্যান্যদের সম্পর্কে মা অনেক সময় স্নেহবাচক নানাবিধ উক্তি করত কিন্তু তাদের কারও কাছে গিয়ে থাকবার কথা উঠলেই মায়ের উৎসাহ নিবে যেত। 

কাজেই বুঝতে পারছেন, আমি আর মিনু ক’টা দিন একা থাকব, এই ন্যূনতম অভিলাষটাও কেন চরিতার্থ হয়নি। ব্যাপারটা পীড়াদায়ক এবং অসুখের উৎস। অথচ সাধারণ সাদামাটা ঘটনা। শর্ত শত পরিবারে এই ধরনের বা অনুরূপ অচরিতার্থ অভিলাষজনিত পীড়ায় শত শত নর এবং নারী ভুগছেন বলেই আমার ধারণা। এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, কারও কোনও বিশেষ দোষ না থাকা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র বাইরের ঘটনার অনিবার্য চাপে ক্রমশ পীড়াদায়ক এবং তিক্ত হয়ে উঠছে। এসব ঘটনা এত সাধারণ এবং এত সাদামাটা বলেই সম্ভবত আমরা এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিই। এবং এসব ঘটনার মোড় ফেরাবার জন্য আদৌ কোনও চেষ্টা করিনে। এইটেই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

কিন্তু আমি নিষ্ক্রিয়তায় বিশ্বাসী নই। আমি ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। উদ্যোগে বিশ্বাসী। ঈশ্বরের দান হিসাবে ভালবাসা পেলাম না তো কী হল? আসুন না, আমরা ভালবাসার চাষ শুরু করি। হিমঘরে যারা একবার ছত্রাক উৎপন্ন করতে শিখে গেছে তারা কি ঈশ্বরের পরোয়া করছে? 

এই মন নিয়ে আমি ন’ নম্বর বাস টারমিনাসে পৌঁচেছিলাম মিনুকে নিয়ে। এই মন নিয়েই আমরা বাসটার দোতলায় একেবারে সামনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম দু’জনে। মিনুকে ধৈর্য ধরতে মিনতি করছিলাম। ওকে বলেছিলাম, বাসের উপর নির্ভর করো, আমাদের ও পৌঁছে দেবেই। এবং সত্যিই প্রায় অলৌকিক ঘটনা, আমাদের প্রার্থনা পূরণ করতে হঠাৎ বাসটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। আমরা উপরে বসেই টের পেলাম, ও বার দুয়েক যেন কাশল, তারপর থরথর করে উঠল ওর প্রাণের স্পন্দন। এবং কী আশ্চর্য, মাইল মাইল পথ গিলে গিলে ও আমাদের পৌঁছে দিল যোধপুর পার্কের স্টপে। 

মিনু এতক্ষণ ধরে আমার পাশে ছিল। আমার কাছে। এত কাছে তাকে অনেকদিন পাইনি। পথে নামতে আমি মিনুকে বলতে চাইলাম, দেখলে মিনু, নির্ভর করলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। অতএব এসো, আমি তোমার উপর নির্ভর করি, তুমি আমার উপর নির্ভর করো, দেখবে তোমার বা আমার কোনও অসুখই থাকবে না। নির্ভরতাই ভালবাসার সোপান। 

কী বলেন আপনারা, এটা পাগলের প্রলাম? অথচ দেখুন, এই সাদা কথাটা কেউ বুঝছে না। নিজেদের মুছে ফেলে দিয়ে কেউ নির্ভর করছে দলের ছেলেদের উপর, কেউ পুলিশের উপর, কেউ বা হুইসকিকে মনে করেছ তার নিজের থেকেও আপন। কী নিদারুণ হাস্যকর ব্যাপার! 

ও গোরিলার মত দু’হাতে গড়িয়াহাট ব্রিজের রেলিং-এ ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর হা হা করে হেসে উঠল। তারপর বলল, বাস্টাডস্। সব শালা মুখোশ। 

.

মিনুর সাময়িক চঞ্চলতা 

তোমার কি শরীরটা খারাপ লাগছে? মিনু তখন সেই গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠল। তোমার কি শরীরটা খারাপ লাগছে? চোখে মুখে জল দেবে? জল খাবে একটু? একটু বসবে? রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়াবে? চলো না-হয় বাড়ি যাই। বুঝলে? 

মিনু আবার ভয় পাচ্ছে। এতক্ষণ বেশ শান্ত এবং সমাহিত ছিল সে। এবং এখন, এই মুহূর্তে বিচলিত বোধ করছে। এর পর ক্রমশ উদ্বেগে আক্রান্ত হয়ে উঠবে মিনু। তার পক্ষে ক্রমাগত উদ্বেগ, ডাক্তাররা বলেছেন, হানিকর। তার শরীরে এবং মনে যে-সব যন্ত্রণাদায়ক বেদনাদি রয়েছে, উদ্বেগ বৃদ্ধি ঘটছে বলেই সেগুলির বৃদ্ধি ঘটছে—ছ’বছর ধরে নানারকম চিকিৎসা করে মিনুকে একটুও উপশম দিতে না পেরে বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা অবশেষে উপরোক্ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। বুঝলেন, ‘ব্যাপারটা সাইকোসোমাটিক।’ মিনু অনেকদিন ধরে, যখন যন্ত্রণায় সে অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়ত, ওকে বলে আসছিল মাতনগাছির পীরের কাছে তাকে নিয়ে যেতে। ও আজও নিয়ে যায়নি। উভয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটার এও একটা কারণ। 

এই ধরনের অস্বস্তিকর দৃশ্যে বারকতক উভয়কে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে। যথা : স্থান—শয়নকক্ষ, বিছানা। কাল—মধ্য রাত্রি। মিনু যন্ত্রণায় এপাশ ওপাশ করছে। তার স্বামী একখানি ইংরেজি পুস্তকে প্রাণপণে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে। মলাটে কামোদ্রেককারী এক রমণীর রমণীয় ছবি। এবং ললাটে যে ইংরেজি শব্দটি লেখা, তার অর্থ উপপত্নী। 

মিনু (গলায় ঝাঁজ) : আলোটা নিবোবে না কী? 

ইংরেজি পুস্তক : 

Unlike almost any other prostitutes I have known, Edith possessed the frankness to confide her thoughts and feelings in me without rescrvations. 

মিনু : যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি। সেই কখন থেকে দু-চোখ বুজতে চেষ্টা করছি—

ইংরেজি পুস্তক : 

“After all, why shouldn’t I have my fun?” She often grinned at me. “Do you begrudge me my amusement?” 

মিনু (অত্যন্ত তিক্তস্বরে) : যেন কাকে বলছি! তোমরা কি মানুষ? 

“NO, I’m thinking of the evil consequences it may have for your physical and mental health. “ 

মিনু : ছি ছি ছি।’ বাড়িতে কুকুর-বেড়াল পুষলেও লোকে তার যত্ন নেয়। আর তোমরা কী! একটা মানুষ পাশে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তার মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। আর তোমার হুঁশই জাগছে না। জানোয়ার! 

(মিনু ডুকরে কেঁদে উঠল। ) 

মিনুর স্বামী (সংবিৎ পেয়ে এবং অপ্রস্তুত হয়ে) : অ্যাঁ, একী! মিনু কাঁদছ কেন? কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার? 

(মিনু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ) 

মিনু : বাবা বাবা! উস্ উস্। তোমার মনে আঘাত দিয়ে বিয়ে করেছিলাম। উস্ উস্। তার ফল আজ পাচ্ছি। উস্ উউ-উস্। 

মিনুর স্বামী (বেশ ঘাবড়ে গিয়ে) : মিনু, এই মিনু, কী হল তোমার! বলো বলো, প্লিজ! 

(মিনু উঁ উঁ উঁ, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ) 

মিনুর স্বামী (নিরুপায়ভাবে মিনুর প্রতি) : কোনও কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তার ডাকব? (মিনু কাঁদছে। ) 

মিনুর স্বামী (নিরুপায়ভাবে দর্শকদের প্রতি) : কিছু একটা বলুন আপনারা। কী করব আমি? ডাক্তার ডেকে আনব একটা? একটা চুমু খাব ওকে? 

মিনু কাঁদছিল। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : মিনু, মিনু, প্লিজ! 

মিনুর স্বামী (নিজেকে) : পাষণ্ড, নরাধম, ক্ষমার অযোগ্য তুই! এমন সাধ্বী স্ত্রী তোর, এত পতিব্রতা, এবং সে যন্ত্রণায় কাতর। আর ধিক তোকে, তুই কিনা তাকে উপেক্ষা করে তারই পাশে শুয়ে ‘উপপত্নী’ নিয়ে মজে আছিস। ছিঃ। 

মিনুর স্বামী (বিব্রত, বিপন্ন হয়ে দর্শককে) : দেখুন, ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে আমাকে বলতে সুযোগ দিন। আজকাল কলকাতার এই নিদারুণ অনিশ্চিতির মধ্যে আমার ভয়টা কিছু বেড়ে গিয়েছে এবং ক্রমশ আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন ভীত ত্রস্ত একটি হরিণ শাবক এবং আমার স্ত্রীর সহনশীল শরীরটা নিরাপদ আশ্রয়। কোনওক্রমে যদি স্ত্রীর শরীরে একবার আশ্রয় গ্রহণ করতে সমর্থ হই, তবে আমি, একমাত্র তখনই আমি নিরাপদ। কোনও নৃশংস ব্যাধই আর আমাকে অতর্কিতে হত্যা করতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি, স্ত্রীর শরীরে যতই আমি মিশে যেতে থাকি, ততই আমি, একমাত্র তখনই আমি সেই অভয় আহ্বানটা জল স্থল অন্তরীক্ষ থেকে শুনতে পাই, ‘ন হস্তব্য, ন হন্তব্য’–হত্যা কোরো না, হত্যা কোরো না। 

মিনু (তিক্তস্বরে) : জানোয়ার! জানোয়ার! 

মিনুর স্বামী (নিজেকে) : নরাধম; পাষণ্ড!

মিনু : স্বার্থপর! নীচ! 

মিনুর স্বামী (দর্শককে) : কিন্তু হায়, আজ আর আমার অভয়ারণ্যে আশ্রয় নেবার উপায় নেই। আমার সাধ্বী স্ত্রী আজ যন্ত্রণায় কাতর। তার শরীর আজ ব্যবহারের অনুপযুক্ত বিধায় একখানি ইংরেজি পুস্তকে কিঞ্চিৎ মনোনিবেশ করেছিলাম। আমি স্বীকার করছি, বইটি যৌন উত্তেজনা উদ্রেককারী। আমি স্বীকার করছি, আমার কিঞ্চিৎ চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেছিল। আমি স্বীকার করছি আমি–আচ্ছা আমার এই কাজ কি আমার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ? 

মিনু (তার স্বর্গত পিতাকে) : তোমার মনে কষ্ট দিয়েছিলাম বাবা! তাই ভুগছি।

মিনুর স্বামী (মিনুকে : মনে মনে) : ব্যথাতুরা কপোতী আমার! 

মিনু (স্বামীকে) : বাপ-মায়ের মনে আঘাত দিয়ে বিয়ে করে যে পাপ করেছি– 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : মিনু প্লিজ, এটা আমার প্রতি নিদারুণ অবিচার– 

মিনু : এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত সারা জীবন দিয়ে করে যেতে হবে। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে : হঠাৎ রেগে) : আবার পুরনো রেকর্ডটা চাপালে। কতদিন বলেছি মিনু, এ তোমার মিথ্যে ধারণা। তোমার বাবা পরে আমাদের আশীর্বাদ করেছিলেন। 

মিনু (চেঁচিয়ে) : মিথ্যে কথা। 

মিনুর স্বামী : মিথ্যে নয় মিনু, সত্যি, আমি তো তোমাকে তোমার বাবার লেখা চিঠি দেখিয়েছি। বলো, সে চিঠিটা জাল? 

মিনু (খানিকটা নরম হয়ে 🙂 আমি কি সে কথা বলেছি! 

মিনুর স্বামী (এবার বেশ গরম হয়ে) : তা হলে কি বলবে তিনি মিথ্যে কথা লিখেছেন? 

মিনু (আরও খানিকটা নরম হয়ে) : আমার বাবা তোমাদের মত মিথ্যে কথা বলতেন না। তুমি বারে বারে আমার বাবার চিঠিটা তুলে খোঁটা দাও কেন, বলো তো। 

মিনুর স্বামী (নরম হয়ে) : আমি তোমাকে খোঁটা দিইনে মিনু। তোমাকে একটা কথাই বোঝাতে চাই, আমরা ভালবেসে বিয়ে করে কোনও পাপ করিনি। না মিনু, আমার কাছে আর সরে এসো না, আমি তোমার উপযুক্ত নই। কাল থেকে আলাদা ঘরে শোব। 

মিনুর স্বামী (দর্শকদের) : আমি জানি স্বামী হিসাবে আমি অতিশয় গৃধু। আমার স্ত্রী যে অসুস্থ, হাতে পিঠে ঘাড়ে ছুঁচ ফোটার মত নিরন্তর তীব্র যন্ত্রণায় তিনি কাতর, আমার চেয়ে একথা আর ভাল কে জানে? এও জানি, এতৎসত্ত্বেও আপনারা যখন জানবেন, আমার এখন, এই মুহূর্তে, কী করতে ইচ্ছে করছে, তখন আপনারাও আমাকে পাষণ্ড বলে ধিক্কার দিয়ে উঠবেন। হৃদয়, উদ্বেল হোয়ো না। 

মিনুর স্বামী (মিনুকে) : না মিনু, না, প্লিজ, তুমি আর আমার গায়ে গা ঠেকিয়ো না। সরে যাও। ওকী, অত কাছে তোমার মুখ এনো না। আমার গায়ে হাত রেখো না। না না। আমি তোমার অধম স্বামী। 

মিনুর স্বামী (দর্শকদের প্রতি) : ভদ্রমহোদয় এবং মহিলাবৃন্দ! আমি স্ত্রীর প্রশ্রয় পেয়ে এখন রিরংসা রিপুর দ্বারা সাংঘাতিকভাবে আক্রান্ত এবং আত্মরক্ষায় অসমর্থ। এমতাবস্থায় একটি দুর্বল নর এবং অবলা নারীকে রক্ষা করার কোনও উপায় যদি আপনাদের জানা থাকে, সত্বর বলুন! 

মিনু (সরে এসে : গদ্‌গদ স্বরে) : রাগ তো আমারই করার কথা। মুখ ফিরিয়ে তো আমারই শোয়ার কথা। এ যে দেখি উল্টো চাপ। আঃ, ফেরো না, লক্ষ্মী সোনা! 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনারত) : হে দেব, গন্ধর্ব, হে অন্তরিক্ষবাসী পিতামহ-মাতামহগণ, তোমরা সকলে সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী ব্লাউজের একটা বোতাম খুলল )। 

মিনু (সরে এসে আধো-আধো সুরে) : ও কী, আঃ, অসভ্যতা করছ কেন? 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনা) : ভূচর খেচর জলচর চরাচরব্যাপী জীব সকল, তোমরা সবাই সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী আরেকটা বোতাম খুলল। ) 

মিনু (আরও ঘনিষ্ঠ আধো-আধো স্বরে) : না! খালি এইসব সময়ে অঢেল আদর। অন্য সময়ে আর চোখ তুলে দেখারও ইচ্ছে হয় না। 

মিনুর স্বামী (মনে মনে আকুল প্রার্থনা) : চেতন ও অচেতন, বিরাট ও অণুপ্রমাণ, দৃশ্য ও অদৃশ্য, বস্তু ও অবস্তু, হে যাবতীয় অস্তিত্ব সকল, তোমরা সাক্ষী। 

(মিনুর স্বামী একটি হুক ধরে টানাটানি করতে লাগল। ) 

মিনু (গদ্‌গদভাবে) : আঃ ছিঁড়ে যাবে, ছাড়ো। 

(মিনু অনায়াসে হুক খুলে দিল। ) 

মিনু (আবেগে অস্থির) : আমাকে একটু দ্যাখো, আমাকে একটু দেখো, আমাকে একটু আগলে রেখো। আমি যে শেষ হয়ে গেলাম। আমি যে শুকিয়ে উঠলাম। 

মিনুর স্বামী (সমবেদনায় গলা ধরে এল) : আমি তোমাকে দেখি মিনু। 

মিনু (অভিমান উথলে উঠল) : ছাই দ্যাখো। এই যে যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি, একবারো জিজ্ঞেস করো? 

মিনুর স্বামী : কেন মিনু, আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। 

মিনু (অভিমান আরও উথলে উঠল) : তোমার ডাক্তার ছাই করছে। এত করে বলছি মাতনগাছির পিরের কাছে একবার নিয়ে চলো। 

মিনুর স্বামী (হঠাৎ দর্শককে) : নাউ দিস ইজ টু মাচ। বিষয়টা আমার পক্ষ থেকে একটু পরিষ্কার করে রাখা দরকার। মাতনগাছির পির। মিনু আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছে। যেখানে ডাক্তারের চিকিৎসায় ওর কোনও উপশম হচ্ছে না, সেখানে মাতনগাছির পির ওকে কী করে ভাল করতে পারে? আমি তো বুঝিনে। বিজ্ঞান যেখানে ব্যর্থ, দৈবও সেখানে নিষ্ফল। আমার বরাবরকার সিদ্ধান্ত তাই। সেই কারণেই পির-ফিরের কাছে মিনুকে কখনও নিয়ে যাইনি। অনেক বুঝিয়েছি। বলেছি, চিকিৎসা বিজ্ঞান আজ হয়ত এই যন্ত্রণার কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ বের করতে পারেনি, কিন্তু পৃথিবীর দিকে দিকে মানুষের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা অবিশ্রান্ত চলছে। ওষুধ একদিন বের হবে। আমি তাই মিনুকে মাতনগাছির পিরের কাছে নিয়ে যাইনি, সেই অনাবিষ্কৃত ওষুধের জন্য পকেটে টাকা রেডি করে বসে আছি। আমার ইচ্ছা মিনু বিজ্ঞানের সেবায় নিজেকে নিবেদন করুক। 

মিনু (গলায় ঝাঁজ ফুটিয়ে) : আমার বেলায় তোমার সময় হয় না। বন্ধুর বউকে নিয়ে সিনেমা যাবার সময় তো ঢের থাকে। 

(মিনুর স্বামী আরেকটা বোতাম খুলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল। ) 

মিনুর স্বামী (বিপন্ন হয়ে) : সময়ের অভাব নয় মিনু, তুমি বোঝো না কেন যে, আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনে। আমি তো বলেছি, পিরের জলপড়া বুজরুকি। 

মিনু : কিন্তু সেদিন ডাক্তারবাবু কী বললেন? 

মিনুর স্বামী : মিনু শোনো, একটু ধৈর্য ধরো। আমি জানি তো কষ্টের সীমা নেই। তুমি— 

মিনু : ডাক্তারবাবু কী বললেন সেদিন? বললেন না একবার গিয়ে দেখতে পারেন? বিশ্বাস থাকলে অনেক সময় ফল পাওয়া যায়। বলেননি? 

মিনুর স্বামী (দর্শককে) : মিনুর কোনও দোষ নেই। সেই রাসকেলটা বলেছিল বটে। সিগারেটে টান দিয়ে গোল গোল ধোঁয়া ছেড়ে কেমন অম্লান বদনে বলে গেল, উনি যখন এত ইনসিস্ট করছেন, একবার নিয়ে যান না। হয়তো জলপড়া খেলে সেরে যেতেও পারে। আফটার অল, ব্যাপারটা যখন সাইকো সোমাটিক। আমাদের মেডিকেল সায়েন্সটাই বা কী? এক কানা আরেক কানাকে পথ দেখাচ্ছে। ছ’মাস ধরে আমাকে ক্রমাগত দোহন করার পর, আজ তার এই উক্তি! 

মিনু : ডাক্তারবাবু কী বললেন, বলো? 

মিনুর স্বামী (বিরক্ত হয়ে) : ও শালা হাতুড়ে, কিচ্ছু জানে না। 

মিনু (হিসটিরিয়া রোগীর মত চেঁচিয়ে উঠল) : ওই ডাক্তারের ভিজিট কত জানো? চৌষট্টি টাকা। বিলেত ফেরত। উনি কিছু জানেন না, আর তুমি আপিসের কেরানি, যত জানো তুমি! 

মিনুর স্বামী (হতাশভাবে দর্শককে) : মিনু এক ঝটকায় সে রাতের মত সরে গেল। আমি জানি সে আর ফিরবে না! আমি বিজ্ঞানের বেদীমূলে নিবেদিত। হায়! আজ বিজ্ঞানের সঙ্গেই শোব। 

আজ, এখন, এই ব্রিজের উপরে, এই সঞ্জীবনী হাওয়ায়, আবার মিনু ওর খুব কাছে। আজ মিনু খুব বিচলিত। আজ মিনু যে শাড়িটা পরে এসেছে, সেটাতে ওকে ভাল মানায়। 

ও হাসতে হাসতে বলল, তুমি কী ভয় পেয়েছ মিনু! সত্যিই হাসিটা আমার বড় জোরেই হয়ে গিয়েছে। আসলে কী জানো, ছকু বকশির মুখটা মনে পড়ে গেল। 

মিনু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই বলো। সত্যিই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। 

ও বলল, আরে দূর, এই কলকাতা শহরে ভয় পেলেই ভয়, না হলে কোনো ভয় নেই। আজ তা বুঝে গেলাম। এই দ্যাখো না, এই হুকু বকশি, যজ্ঞেশ্বরের দাদা, যে-সব মন্ত্রীরা এসেছিলেন, পুলিশের জাঁদরেলরা, ওঁদের থেকে যে ভয় পাবার কিছু নেই, আজ এত কাছে বসে নেমন্তন্ন খেলাম বলেই বুঝতে পারলাম। এঁরা যে সাধারণ স্তরের মানুষের মতই হাসেন, কাশেন, ফেলে ছড়িয়ে খান, এটা দেখে বুঝতে পারলাম, আমরা যারা প্রতিদিন সংবাদপত্র মারফত এঁদের বাণী পাই, মাইকের মারফত এঁদের বিরাট আহ্বান শুনি এবং তারপর ধারণা করে নিই এঁদের আকার কত বিরাট! কত কম জানি, কত বোকা। নিজের বোকামির কথা মনে পড়ল, তাই হো হো করে হেসে উঠলাম। 

.

যজ্ঞেশ্বরের প্রাইভেট সমস্যা 

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাচের মধ্যবর্তী সময়টায় যখন মিনু মেয়েদের ভিতরে গিয়ে বসেছিল এবং কেয়াও আসেনি, ও একা বসে বসে যখন অভ্যাগতদের যাওয়া-আসা হাসা কথা বলার ভঙ্গিসকল খুটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল, এবং শচীর ভাবভঙ্গিতে বেশ মজা পাচ্ছিল, ইদানীং শচী ওর সঙ্গে কথা বলে না, অফিসে দেখা হলে পাশ কাটিয়ে চলে যায় অথচ বিব্রত বোধ করে, আজও এখনও পর্যন্ত শচী ওর চোখে চোখ ফেলেনি, যদিচ কেয়া দেখা হওয়ামাত্র তার পাশে দাঁড়িয়েই ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে নিয়েছিল, শচীর স্পষ্টতই ওকে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে, দৃশ্যটা যখন এই রকম অবস্থায় এসে পড়েছে এমন সময় যজ্ঞেশ্বর ভি আই পি অতিথি কয়েকজনকে নিয়ে তার বধূর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাইরে এনে খাতির করে বসাল, কিছুক্ষণ তাঁদের সঙ্গে হোস্ট্-সুলভ শিষ্টাচার বিনিময় করে ও একা বসে আছে দেখে পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল। দেখে মনে হল, যজ্ঞেশ্বর ঈষৎ ক্লান্ত এবং কিছুটা অন্যমনস্কও।

ঘামে যজ্ঞেশ্বরের বিয়েতে পাওয়া দুধ-গরদের পাঞ্জাবি গলার কাছে ল্যাদলেদে হয়ে উঠেছে। যজ্ঞেশ্বর মাঝে মাঝে বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের অনামিকার অনভ্যস্থ ঢাউস আংটিটা এধারে ওধারে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। ওর পাশে বসে যজ্ঞেশ্বর, মনে হল, একটু স্বস্তি পেল। 

যজ্ঞেশ্বর ওর কানে কানে বলল, আচ্ছা, তোমরা রাইটাররা বেশ কড়া করে লিখে এই বস্তপচা বিয়ের সিসটেমটা বদলে দিতে পারো না? দ্যাখো, আমাদের একটা কালচারাল রেভলিউশন দরকার। এই, তোমার কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে না তো? নেক্‌স্ট ব্যাচটা মেয়েদের। তার পরের ব্যাচেই তোমাকে বসিয়ে দেব। 

তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় পিঠ মুছে যজ্ঞেশ্বর বলল, অমিয়দা বোধ হয় আর এল না। ওঁদের পাড়ায় যা শুরু হয়েছে না, এ মার্ডার এভরি ডে, ওঁকে বোধ হয় ও-পাড়া ছাড়তে হবে। দিন দিন যা হচ্ছে না! এর ভিতর গভীর একটা ষড়যন্ত্র আছে। একটা কোক খাবে? 

বলেই যজ্ঞেশ্বর একটা হাঁক দিল, সুরজ, এদিকে একটা ঠাণ্ডা নিয়ে আয়। তারপরই সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। একটু ইতস্তত করল যেন। তারপর ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, একটা সমস্যায় পড়েছি ভাই। একান্তভাবে প্রাইভেট। একটু পরামর্শ চাই। 

ও বলল, তুমি তো জানো ভাই, পলিটিক্সে আমার কোনও ইনটারেস্ট নেই। 

যজ্ঞেশ্বর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আরে না না, পলিটিক্যাল কোনও ব্যাপার নয়।

ও বলল, ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত ব্যাপারে তোমাকে আমি আর কী পরামর্শ দেব! সে ব্যাপারে তো তুমিই অথরিটি। 

যজ্ঞেশ্বর বিপন্ন হয়ে বলল, আরে ওসব কোনও ব্যাপার নয়। একেবারে প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেনশিয়াল। আমি এখন কী করব তাই বলো? কী স্টেপ আমার নেওয়া উচিত? 

ও অবাক হল। বলল, তোমার সমস্যাটা কী, তাই তো জানলাম না। 

যজ্ঞেশ্বর এবার বেশ বিব্রত বোধ করতে লাগল। রুমাল দিয়ে বারকয়েক ঘাড় পিঠ মুখ মুছল। ঘষে ঘষে নাক মুখ কান লালচে করে তুলল। সিগারেট বের করে ওকে বলল, একটা খাও। নিজে একটা ধরাল। বারকয়েক ধোঁয়া ছেড়ে একটু সাহস সঞ্চয় করল। তারপর সত্যিই অতি সুন্দর এমন একটা ছেলেমানুষি লাজুক লাজুক হাসি এই সংগ্রামী শ্রমিক নেতার মুখে ফুটে উঠবে ও আশা করেনি। ও অবাক হয়ে যজ্ঞেশ্বরের মুখের দিকে চেয়ে রইল। 

যজ্ঞেশ্বর আমতা আমতা করে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি তো রাইটার, হয়ত সমস্যাটা বুঝতে পারবে। অমিয়দা বলেছিল কনজুগাল লাইফের ভবিষ্যৎ প্রথম রাত্রেই সেট্‌ হয়ে যায়। শাদির পয়লা রাতেই যে বিড়াল মারতে না পারে, সে সারাজীবন পস্তায়। কিন্তু আমার ভাই সেক্‌স্‌ লাইফ সম্পর্কে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। দুটো রাত ফসকে গেল। প্রথম রাতটা তো বিয়ের ঝামেলাতেই কাটল। সারা রাত মেয়েগুলো যেন ঘেরাও করে রাখল। ন্যুইসেনস্। তারপর তো কালরাত্রি। সেদিন নাকি কেউ কারও মুখ দেখে না। বুঝলে, কী বস্তাপচা সিসটেম! আমি কোনও, মানে বুঝলে তো, স্টেপ নিতে পারিনি। অমিয়দাই গাইড করবে বলেছিল। কিন্তু কাল থেকে ওদের পাড়ায় যে-কাণ্ড শুরু হয়েছে। অমিয়দা একেবারে বেপাত্তা। কাল বোম পড়েছে, গুলি চলেছে, খুন হয়েছে। আজ পুলিশ মিলিটারি পাড়া ঘিরেছে। অমিয়দাই আমাকে ডোবালে। আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু আমার প্রবলেমটা বুঝতে পেরেছ তো। দিস ইজ্জ্‌ দি থার্ড নাইট এবং অত্যন্ত ক্রুশিয়াল নাইট। আমি অমিয়দার গাইড্যানসের ভরসায় চুপ করে বসে আছি, কী স্টেপ নেব বুঝতে পারছিনে! 

খুব করুণ দেখাচ্ছিল যজ্ঞেশ্বরকে। ওর খুব মায়া হল। যজ্ঞেশ্বরকে চান করিয়ে গা মুছিয়ে দুধ খাইয়ে বেল্ট বেঁধে ধুতি পরিয়ে তার দুধু-দুধু গালে গোটা কতক হামি খেতে ইচ্ছে করছিল ওর। 

যজ্ঞেশ্বর বলল, অমিয়দা তো বলে খালাস, শাদির পয়লা রাতে মারিবি বেড়াল। বাট্ হাউ? 

ভুবনবাবু, যজ্ঞেশ্বরের দাদা, হুড়মুড় করে এসে বললেন, জগা, যারা তত্ত্ব নিয়ে এসেছে, আমাদের বাইরের ঘরটায় জায়গা করে ওদের বসিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর দিকি। 

অনিচ্ছুকভাবে উঠে পড়ল যজ্ঞেশ্বর। তারপর ওর দিকে বিপন্নভাবে চেয়ে বলল, হুট করে চলে যেয়ো না ভাই, এখন তুমিই ভরসা। 

.

ও আর কেয়া : সর্বদাই মঞ্চে 

একটি দৃশ্য : 

ও আর কেয়া পাশাপাশি বসে আছে দুটি চেয়ারে। কিন্তু দু’জনেই চেয়ে আছে অগণিত দর্শকের দিকে। ওরা পরস্পর কথা বলছে, কিন্তু শোনাতে চাইছে দর্শকদের। ওদের দু’জনের আশপাশ দিয়ে বিয়ে বাড়ির লোকজন যাতায়াত করছে। ওদের ভূক্ষেপ নেই। 

কেয়া : শচী এত ড্রিংক করে কেন? 

ও : কেয়া এ প্রশ্ন আগেও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল এবং আপনারা তা জানেন। আমাকে বার বার এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার মানে কী? কেয়া কি মনে করে শচীর মদ্যপান বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও ভূমিকা আছে? কেয়ার এই প্রশ্নটা কি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগমূলক? অথবা কেয়া মনে করে শচীর মদের প্রতি আসক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য সে নিজেই দায়ী এবং এই প্রশ্ন তার অনুশোচনার প্রকাশ? আপনারা কী মনে করেন? 

কেয়া: শচীকে আমি ভালবেসেছিলাম। এবং ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। কাজটা খুব সহজে হয়নি। সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন আমরা বোধ হয় স্বাধীনতা পাচ্ছি- পাচ্ছি। আমি আইনত সদা সাবালিকা হয়েছি। শচীর কবিতা পত্র-পত্রিকায় সবে প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়েছে। শচী তখন দারুণ সংগ্রামী আর কী প্রচণ্ড আকর্ষণ তার! সে যেন আরব্য রজনীর সেই চৌম্বক পর্বত। তার পাশ দিয়ে যে জাহাজ যেত, তারই সমস্ত জোড় খুলে যেত। আর আমার বাবা ছিলেন প্রচণ্ড রক্ষণশীল এবং অতিশয় কড়া। শচী আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বাবার রাশ আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। এসব ব্যাপারে যিনি প্রধান সাক্ষী এবং আমার আর শচীর প্রধান মসৃণাদাতা, এই যে তিনি আপনাদের সামনে, আমার পাশের চেয়ারে বসে আছেন। নির্বিকার, নিরাসক্ত, নির্বিকল্প এক পুরুষের ভূমিকায়। আর অশান্তির আগুনে আমার আর শচীর জীবন দাউ দাউ করে জ্বলছে। যাঁর সক্রিয় ভূমিকায় একদিন আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল, আজ মাঝপথে এসে তাতে যখন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তাঁর কি এমন নির্বিকার থাকা সাজে? তিনি কী করে এমন নিরাসক্ত থাকতেই বা পারেন? 

ও : তবে এটা অভিযোগ? 

কেয়া : না, একটা সঙ্গত প্রশ্ন। আপনারা সকলেই আশা করি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন। 

.

আরেকটি দৃশ্য : 

ময়দানে গলফ্ কোরসের কাছে কোনও এক নাতিশীতোষ্ণ অপরাহ্ণে ওরা। তিন-চারটি আমগাছ এক কুঞ্জ রচনা করেছে, ওরা তারই ভিতরে ঘাসের উপরে বসে। কিন্তু ওরা পরস্পরের দিকে চাইছে না। সোজা দর্শকদের দিকে চেয়ে আছে। দূরে ভিকটোরিয়া স্মৃতিসৌধ পড়ন্ত আলোয় উজ্জ্বল। দূরে রেস ময়দানের সাদা নিচু বেড়ার গতিশীল বক্ররেখা। গলফার মেম সাহেবরা জাঙ্গিয়ার মত শর্ট পরে সুললিত পদবল্লরী প্রকট করে ইতস্তত গল্ফ খেলছেন। ক্বচিৎ ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, পিছনে এক গাদা গদণ্ড ভর্তি তৃণ পিঠে বয়ে পরিচারক। গোরু চরছে, কোথাও আত্মহারা নবীন মিথুন, চলমান ট্রাম-বাস পিপীলিকা যথা। 

কেয়া (অতীত স্মৃতিতে আচ্ছন্ন) : এই কুঞ্জটা শচীর খুব প্রিয় ছিল। 

ও (অতীত স্মৃতিতে আচ্ছন্ন) : কেয়ার সঙ্গে তখনও আলাপ হয়নি শচীর, আমরা তখন থেকেই দু’জনে এসে বসতাম। শচী টান টান হয়ে শুয়ে পড়ত 

কেয়া : ঘাসের শিষ ছিঁড়ে তার ডগা চিবুত। 

ও : প্রখর স্মৃতিশক্তি ছিল তার। কবিতা আবৃত্তি করে যেত ঘন্টার পর ঘণ্টা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, এলিয়ট, অডেন অমিয় চক্রবর্তী—মেলাবেন তিনি মেলাবেন। কী আশ্চর্য, এই লাইনটা কতকাল পরে মনে পড়ল! জানি জানি এই অলাতচক্রে চংক্রমণ—শচী বলত, কে বলো? আমার কাছ থেকে উত্তর পেত না। নিজেই বলত, বিষ্ণু দে। হয়ত ঈশ্বর নেই; স্বৈর সৃষ্টি আজন্ম অনাথ; কালের অব্যক্ত বৃদ্ধি শৃঙ্খলার অভিব্যক্ত হ্রাসে-বলো কে? বিমূঢ় আমার মুখের দিকে চেয়ে শচী মুখ টিপে হাসত। সুধীন দত্ত। স্টুপিড! মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমাকার ডাইনোমার পরে। চোখে একরাশ স্বপ্ন ভাসিয়ে গাঢ়স্বরে শচী বলত, জীবনানন্দ। অথবা কখনও : 

O dark dark. They all go into the dark, 
The vacant interstellar spaces, the vacant into the vacant,
The captains, merchants, bankers, eminent men of letters,
The generous patrons of art, the statesmen and the rulers,
Distinguished civil servants, chairmen of many committees,
Industrial lords and petty contractors, all go into the dard,
And dark the Sun and Moon, and the Almanach de Gotha,
And the Stock Exchange Gazette, the Directory of Directors,
And cold the sense and lost the motive of action.
And we all go with them, into the silent funeral,
Nobody’s funeral, for there is no one to bury. 

শচীর কন্ঠে ঝঙ্কত ইংরেজি শব্দের অন্তর্লীন সঙ্গীত আমাকে এক বোঝা না-বোঝার আলো-আঁধারি তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। মুগ্ধ করত। নিমগ্ন করে দিত এক মহৎ অনির্বচনীয়ের ভিতরে। শচীকে আমার ঈশ্বর বলে মনে হত। অনেকক্ষণ পরে রেশ যখন প্রায় কেটে উঠেছে, সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠত, এলিয়ট, ফ্যানটাসটিক! 

And we all go with them, সে ততক্ষণে আবার বলতে শুরু করেছে, into the silent funeral. Nobody’s funeral, for there is no one to bury. 

কেয়া (বিলাপের সুরে) : শচী এখানে আর আসে না। 

ও (বিলাপের সুরে) : শচী আর কবিতা বলে না। 

কেয়া (বিলাপের সুরে) : শচীই আমাকে এখানে এনেছিল। 

দু’জনে (সমস্বরে) : শচী আজ আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। অনেক দূরে। অথচ আমরা কত কাছে কাছে থাকি! 

কেয়া : আমি ওর সংসারে, ওর বিছানায়। 

ও : আমি আর সে একই অফিসে। ওরই বিভাগে। ওরই অধীনে। 

.

আরও একটা দৃশ্য : 

পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে ওরা দু’জনে। বেশ রাত হয়েছে। ওরা দু’জনেই মদ খেয়েছে। মাঝে মাঝে ক্যাবারের মেয়েটা বিরক্তিকর গান গাইছে। মাঝে মাঝে থামছে। ওরা বিরতির সময়টাতে কথা বলে নিচ্ছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। ওরা দর্শকদের ওদের কথা শোনাচ্ছে। 

ও (নিরুপায়ের ভাব করে) : আপনারা সবই দেখছেন। আপনারা সাক্ষী, আমি কেয়াকে মদ খেতে বারণ করেছিলাম। ও তবু জোর করে খেল। সত্যি বলতে কি, আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম কেয়ার এই ছেলেমানুষি একগুঁয়েমিতে। এবং খুবই বিব্রত। এমন কি, এক সময় উঠেই যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি জানি এবং আপনারাও দেখেছেন, ও একটা সিন ক্রিয়েট করত তা হলে। এমনিতে ও শান্ত কিন্তু রাগলে ও চণ্ডাল। তাই বাধ্য হয়েই আমাকে নতি স্বীকার করতে হল। এবং ওর সঙ্গে মদ খেতে হল। তবে সত্যের খাতিরে এও স্বীকার করতে হবে, আমি স্বীকারই করছি, আমার এখন ঘোর লেগেছে এবং বেশ ভাল লাগছে। কেয়ার দিকে আপনারা ভাল করে চেয়ে দেখুন, ওর চোখ দুটো যে এক রূপসি দিঘিতে ভাসছে, ওর মুখটা কেমন তরল হয়ে এসেছে। ওর কঠিন ভাবটা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে। কেয়া আমার কিশোরের বন্ধু। আজ এই ভরা মধ্যাহ্নে এসে ওকে যেমন আশ্চর্য রূপসি লাগছে, এমনটি আর কখনও লাগেনি। এ কি মদ খেয়েছি বলে? অথবা এতদিনের এক আবরণ খুলে ফেলে আজ হঠাৎ ও নিজের সাজে বেরিয়ে এল? না কি যে ব্যবধানটা আমাকে আর কেয়াকে বরাবর আড়াল করে রেখেছিল, সেই প্রথম বয়েস থেকে, সেটা অকস্মাৎ ধসে পড়ল বলে এই প্রথম আমি ওর পূর্ণ রূপটি দেখতে পাচ্ছি? 

কেয়া : এই আমি প্রথম ড্রিংক করছি, তা নয়। তবে বারে এসে প্রকাশ্যে এই প্রথম। যদিও জানি কোনও সূত্রে শচী যদি আজকের কথা জানতে পারে বা এটা আবিষ্কার করে যে, আমি আজকাল ওর বোতল থেকেই মাঝে-মধ্যে ড্রিংক করা শুরু করেছি, তা হলে ও খুব শক্ পাবে। পাবে না? বিচলিত হয়ে উঠবে না? স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে, তা হোক না সে অতীতের বন্ধু, বারে বসে মাতলামো করছে, এ দৃশ্য দেখে কোনও স্বামী, হোক না সে নিজেও মাতাল, অবিচলিত থাকতে পারে, বলুন? কিন্তু আমি তাতে ভয় পাইনে। শচী আসুক এখানে, দেখুক আমাকে, আমি তো তাই চাই। শচী বিচলিত হয়ে উঠুক, আমি তো তাই চাই। এমনি একটা আকস্মিক দুর্বিপাকে প্রচণ্ড ঝাপটায় আমার আর শচীর ভিতর গড়ে ওঠা পাঁচিলটা ভেঙে যাক, গুঁড়িয়ে যাক, আমি চাই। আমি তাই চাই। হয় আমরা কাছে আসি, নয় আমরাও গুঁড়িয়ে যাই। 

ও : কোনও কারণে কেয়া ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। অনেক সময় ও এমন সব কথা বলে, এমন সব আবদার ধরে, যার মানে বোঝা যায় না। যেমন ধরুন, আজকের ব্যাপারটা। ও কেন এখানে মদ খেতে এল? আমাকেই বা কেন টেনে আনল? শুধুমাত্র একটা খেয়াল? না কি, ও কোনও কিছু মতলব হাসিল করতে চাইছে? আমাকে কি কোনও কিছুতে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে? আমি কি সতর্ক হব? না কি কেয়া আমার প্রতি আকৃষ্ট? বরাবর ও আমাকেই চেয়েছে, জানতে দেয়নি আমাকে, হয়ত নিজেও জানতে পারেনি আগে, আজ এই প্রথম জানাল। ভাবতে আমার ভাল লাগছে। আমি কেমন উত্তেজনা বোধ করছি। আমি কি সুযোগ নেব? 

কেয়া : লোক কত বদলে যায়! শচী যেমন বদলেছে। যেমন বদলাচ্ছে এই লোকটা, যে আমার পাশে বসে আছে। ওর চোখ-মুখের দিকে চেয়ে দেখুন আজ কী সাংঘাতিক ভাবান্তর। ওর পরিণত বয়সের চোখে, ওর ব্যবহারজীর্ণ ঠোঁটে অপরিণত মনের কামনা ঝিলিক মেরে উঠছে। আজ এই প্রথম ওকে এই রূপে দেখছি। ওর এই চাঞ্চল্য আমাকে আজ, অনেকদিন পরে নাড়া দিচ্ছে। আমার ভাল লাগছে। সাড়া দিতে প্রবল একটা ইচ্ছে করছে। দয়া করে ভুরু কোঁচকাবেন না। আগে সবটা শুনুন। আগেই আমাকে পথভ্রষ্টা বা স্বৈরিণী ইত্যাদি জাতীয় কিছু ভেবে বসবেন না। আমি শচীকে ভালবাসি এবং আমি তার স্ত্রী এবং আমাদের বিবাহিত জীবনের জয়ন্তী দিবস পেরিয়ে গিয়েওছে। (শচী সে রাত্রে বাড়ি ফেরেনি, আমাদের পাড়ায় বোমা পড়েছিল, বাড়ির সামনে গুলি চলেছিল। আমি বাড়িতে একা। কী করব? এমন সময় কলিং বেল বাজল। দরজার ‘আই’-এ চোখ দিয়ে দেখি এক রাশ ফুল নিয়ে হাজির, এই যে যাকে দেখছেন আমার পাশে বসে। আশ্চর্য, মনে রেখেছে। প্রায় ছ’মাস পরে দেখা। আমার চোখে জল এসে গেল, ইচ্ছে হচ্ছিল সারারাত ওকে ধরে রেখে দিই। কিন্তু ও থাকল না। সেই বোমা, সেই গুলির মধ্যে ও ওর বউ-এর কাছে ফিরে গেল। ওদের পাড়াটা ভাল না। আমি একা। যতক্ষণ পারলাম, ফুলগুলোকে এমন একটা জায়গায় সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম, যেন শচী আসা মাত্র তার নজরে পড়ে। কতবার জায়গা বদলালাম, তারপর শ্রান্ত হয়ে বিছানায় এসে বসলাম। তারপর? হ্যাঁ, ড্রিংক করলাম। ) অতএব বুঝতেই পারছেন, আমি আর নিতান্ত খুকিটি নেই। শরীরেও ভাঁটার টান শুরু হয়েছে। তাই—আচ্ছা, আপনাদের কি মনে হয় না, আমার আর শচীর এতদিনের সম্পর্কটা শুধুমাত্র স্বামী এবং স্ত্রীর নয়, প্রভু এবং সেবাদাসীর? প্রেম, আনুগত্য, পরিচর্যা–শুধু একতরফা নিবেদন? এবং আমরা অনায়াসে যা পাই, তার সম্পর্কে আমাদের কোনও বিশেষ কৌতূহল বা সচেতনতা থাকে না? যা আমাদের অর্জন করতে হয়, তার ব্যাপারেই শুধু আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি? ঠিক বুঝতে পারিনে। একদিন শচীকে আমার সর্বস্ব সমর্পণ করে সুখে টই-টম্বুর হয়ে থাকতাম। শচীও। তারপর শচীর সুখ একদিন ফুরিয়ে গেল। অনেক সংগ্রাম করে শচী প্রতিষ্ঠা পেল। না, আদায় করে নিয়েছিল সে। ছিল কবি, এখন সে বেশ বড় একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বড় একজিকিউটিভ। তবু তার সুখ নেই। আমার অবিশ্যি কোনও প্রোমোশন হয়নি। আমি এখনও শচীর স্ত্রী, মিসেস বাগচি। আমাদের ভিতরে যে উষ্ণতা ছিল, তা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে এল। দীর্ঘকাল পরে, আজ, এখন আবার সেই উষ্ণতা, সেই চাঞ্চল্য, সেই কেমন একটা অস্থির বোধ মনের ভিতরে জেগে উঠছে। 

ও : আমি কেয়ার হাতখানা একটু ধরছি। প্রগল্ভতা হচ্ছে কি? কখনও আমি কেয়ার শরীর স্পর্শ করিনি। আজ শুধু ওর হাতখানা আমার হাতে তুলে নিলাম। কী আশ্চর্য, নরম স্পর্শ। মিনুর হাত ক্ষতবিক্ষত। সংসারের দাবি তার হাতের তালুর কমনীয়তাকে একেবারে কুরে খেয়েছে। বেচারি! 

.

মৃত শ্বশুরের সঙ্গে ওর কথোপকথন 

ওরা দু’জন, ও আর মিনু যখন গড়িয়াহাট ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আকাশের শোভায় স্বপ্ন দেখছিল, আর মিনু ওর গায়ে গা ঠেকিয়ে বলছিল, জানো, এটা হচ্ছে চন্দ্রশোভা, তার মানে বৃষ্টি হবে, তখনই এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটল। একটা হালকা মেঘ চাঁদের উপর থেকে সরে যাচ্ছিল, আর উল্টোদিক থেকে একটা গাঢ় মেঘ চাঁদকে ঢেকে দেবার জন্য ধেয়ে এল। মেঘটা চাঁদকে ঢেকে দিল। তারপর হঠাৎ ওকে ডাকল, এই যে বাবাজি, তোমরা কেমন আছ? ও খুশি হয়ে বলল, ভাল। আপনার খবর? মেঘটা বলল, ভাল। তারপর মিনুমা’র খবর কী? ও হেসে বলল, এই তো, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মিনু, তোমার বাবা। 

মিনু শুনতে পেল না। বলল, নদীতে বান ডাকবে। চন্দ্রশোভা হলে বান ডাকবে। 

ওর শ্বশুর বললেন, থাক থাক, ঘুম ভাঙিয়ো না। 

ও বলল, মিনু আপনাকে যত ভালবাসে, এমন আর কাউকে না। আপনার শোকে ও অধীর হয়ে পড়েছিল। ও এখনও আপনার নাম করে কাঁদে। 

ওর শ্বশুর গম্ভীর স্বরে বললেন, তার মানে তোমাতে ওর মন বসেনি। 

ও কাঁচুমাচু হয়ে বলল, না, হ্যাঁ, মানে ওর মনটা সেই থেকে খালি হয়ে গিয়েছে কি না। আপনাকে তো খুবই 

ওর শ্বশুর উপর থেকে গর্জন করে উঠলেন, বটে? তুমি ওর সব ভার নেবে কথা দিয়েছিলে, তা হলে সে-মেয়ে আমার জন্য কাঁদে কেন? চালাকি পেয়েছ! অ্যাঁ? 

মিনু বলল, বাবা, কী হাঁক গো! চলো, চলো, বৃষ্টি আসবে। 

ও একেবারে ধরা পড়ে গিয়েছে। তাই কোনও রকম চালাকির চেষ্টা করল না। হাত জোড় করে বলল, আজ্ঞে, অকপটে মার্জনা চাইছি। আমি কথা রাখতে পারিনি। 

আবার গর্জন, কেন পারোনি, অ্যাঁ? 

মিনু বলল, এই চলো। বৃষ্টি এলে একেবারে ভিজে যাব। 

ও হাত নেড়ে বলল, আজ্ঞে, অপরাধ ইচ্ছাকৃত নয়। সব সময় ওকে আগলে রাখতে পারিনি, ওর প্রতি নজরও দিতে পারিনে। ওকে যত্ন করতে পারিনে। খাটতে খাটতে ওর হাত দুটো খসখসে হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি, আমি ওকে ভালবাসি। ওকে আমি আগলে রাখব। ওর খসখসে হাত দুটো, আমি কথা দিচ্ছি, আমি রিপেয়ার করে দেব। প্রমিজ্। 

কথা দিচ্ছ তো? ওর শ্বশুর কিঞ্চিৎ নরম হলেন। বাস্ বাস্, তবে আর কিসের চিন্তা। ওইটেই তো হল আসল। ওর শ্বশুর খুশি হলেন। –আচ্ছা চলি। 

ও ব্যস্ত হয়ে মিনুকে বলতে গেল, মিনু তোমার বাবা, কিন্তু দেখল মিনু ওকে ঠেলছে! 

ও বলল, বাবা, সত্যি বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। 

মিনু বলল, মাঝে মাঝে তোমার কি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়? মাথায় যে আকাশ ভেঙে পড়েনি, এই রক্ষে। 

ও মিনুর খসখসে হাত দুটো খপ করে চেপে ধরে বলল, মিনু, আমি তোমায় ভালবাসি। আরও বাসব। 

মিনুর মুখখানা করুণ হয়ে এল। বলল, ও-সব পরে হবে, এখন চলো চলো, বৃষ্টি আসবে। 

ও মিনুর হাতে চাপ দিয়ে প্রচণ্ড বিশ্বাসে মিনুকে বলল, আমি যদি তোমাকে প্রকৃতই ভালবাসি তবে বৃষ্টি হবে না, অন্তত এই মেঘটা আমাদের বিপদে ফেলবে না। তুমি দেখো। 

ও উপরে চেয়ে দেখল, মেঘটা ওদের ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে। ও মনে মনে বলল, মিনু কিছুই জানল না। 

মিনু বলল, দেখেছ, ব্রিজটা একেবারে ফাঁকা। 

ততক্ষণে চাঁদের চারদিকের রামধনু বলয়টা আবার ফুটে বেরিয়েছে। 

ও শুধু বলল, দ্যাখো দ্যাখো মিনু, আকাশে দ্যাখো। এই অপূর্ব বাহার হয়ত এখনই মুছে যাবে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *