“গজভুক্ত—”

“গজভুক্ত—”  

সকালে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশটা আবার ঘোর করিয়া আসিতেছে; যদি নেহাত এখন বৃষ্টি না-ই নামে তো রাত্রি পর্যন্ত যে একটা রীতিমত দুর্যোগ সৃষ্টি হইবেই, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

আকাশের গতিক দেখিয়া মেসের আর কেহ বাহির হয় নাই। দুই-একজন নিজের নিজের ঘরেই বসিয়া ছিল; বাকি মেম্বর সব শচীনাথের ঘরে আড্ডা জমাইবার উদ্যোগ করিতেছিল; আজকাল অবসরকালে এই ঘরেই বেশি জমায়েৎ হইয়া থাকে, কারণ ছোকরার নতুন বিবাহ হওয়ায় ঘরটি শ্বশুরবাড়ির সম্পদে ও ভাবে সমৃদ্ধ।

মেসের কবি কুলদাচরণ জানালার ধারে বসিয়া গুনগুন করিয়া গান করিতে করিতে মেঘের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল। মেঘ হইতে চোখ না ফিরাইয়া বলিল, “আচ্ছা শচীবাবু, বলুন তো আজকের রাত্তিরটা সার্থক হয় কি হ’লে?”

শচীনাথ লজ্জিতভাবে একটু হাসিল, উত্তর দিল না। গণপতি নিজের বাম বাহুর সুপুষ্ট পেশীটা পাকাইয়া নানা ভঙ্গীসহকারে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল, সেইরূপ ভাবেই বলিল, “এই খিচুড়ি আর গলদাচিংড়ির কালিয়া হ’লে।”

কুলদা তাহার দিকে একটা বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি হানিয়া আবার মুখ ফিরাইয়া মেঘের কাব্য উপভোগ করিতে লাগিল। কিন্তু গণপতির কথাটা মাঠে মারা গেল না, কারণ ঘরটায় কাব্যরসিকের চেয়ে ঔদরিকের সংখ্যাই অধিক ছিল; অন্তত এমন বর্ষায় সংখ্যাটা বাড়িয়া গিয়াছিল, এরূপ বলা যায়। কেহ বলিল, “বাঃ, খাসা মতলব!” আর একজন বলিল, “গণপতির মাথা আছে।” মৃত্যুঞ্জয় মাথা’র লোভে বলিল, “আমিও খিচুড়ির কথা বলব বলব করছিলাম।”

ফর্দ হইল। মেসের ভোজের ফর্দ—প্রত্যেক মেম্বারের পছন্দের কিছু কিছু রক্ষা করিতে করিতে টোটাল প্রথমে পঞ্চাশ টাকার কাছাকাছি দাঁড়াইল। যাহারা ঝুঁকিয়া দেখিতেছিল, একটু পিছাইয়া গেল। ‘সকলের মতানুযায়ী আবার কাটছাট করিতে করিতে সতেরো টাকায় দাঁড়াইল। তৃতীয় বারে সতর্কভাবে বাড়াইয়া বাড়াইয়া তেত্রিশ টাকার হিসাবটা কায়েম করা হইল। যাহার হাতে পেন্সিল ছিল, সে পেন্সিল ফেলিয়া হাত-পা গুটাইয়া বলিল, “এর কমে হ’লে ঝালচানা খেয়ে বর্ষার শখ মেটাতে হয়। ফিষ্টি হয় না।”

ষোলজন মেম্বার, দুই টাকা এক আনা করিয়া পড়িবে। মাসের ঊনত্রিশ তারিখ। সকলে মৌনভাবে বসিয়া রহিল। কেহ বেপরোয়া ভাবটা জাগাইয়া রাখিবার জন্য একটু শিস দেওয়ার চেষ্টা করিতে লাগল। একজন বলিল, “কেউ দুটো টাকা ধার দেন তো বাকি এক আনা পয়সা বাক্স ঝেড়ে বের করতে পারি।”

একজন উত্তর করিল, “আপনি তো তা হ’লে খুব সলভেন্ট মশায়, হিংসে করে।”

শচীনাথ মনে মনে অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িতেছিল। বিবাহ করার পর তাহার খাওয়ানো বাকি ছিল। অনেক তাগাদা ঠেকাইয়া আসিয়াছে; কিন্তু আজ মেসের এই দারুণ বুভুক্ষা এবং সেই সঙ্গে ততোধিক দারুণ দৈন্যের দিনে আর ঠেকানো অসম্ভব। তাহার বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করিতেছিল। ইহাদের একবার কাহারও মনে পড়িলে হয়; কেন যে পড়িতেছে না, সেইটাই আশ্চর্য!

যেমন বসিয়া ছিল, সেইরূপ থাকিয়া গেলে কি হইত বলা যায় না; সে পরিত্রাণ পাইবার জন্য আস্তে আস্তে বাহির হইয়া যাইতে চেষ্টা করিয়াই সব মাটি করিল। চৌকাঠের নিকট পা দিতেই একজন টেবিলে একটা প্রকাণ্ড চাপড় দিয়া বলিল, “হয়েছে। শচীবাবু।”

শচীবাবু বিমর্ষ মুখে ফিরিয়া চাহিল।

যে তাকিয়াছিল সে বলিল, “আসুন ফাঁকি দিলে চলবে না। বিয়ের খাওয়াটা আজই হয়ে যাক।”

সমর্থনস্বরূপ ঘরটাতে একটা ভীষণ আনন্দ-কলরব উঠিল। তাহাতে লাজুক বেচারার ক্ষীণ আপত্তিটুকু শোনাই গেল না। একজন আবার বলিল, “পরশু আবার একটা মনিঅর্ডার এসেছে—”

শচীন্দ্র নামক একজন মেম্বার বলিল, “শ্বশুর-বাড়ি থেকে। মবলগ আশিটি রজতখণ্ড—নামের একটু মিল আছে কিনা—তাই প্রথমে আমারই হাতে গিয়ে পড়েছিল। হায়, এমনই যদি অদৃষ্টেরও মিল থাকত!”

একজন বলিল, “তবে সেই পঞ্চাশ টাকা যেমন ধরা হয়েছিল, তেমনই থাক না কেন? শচীবাবু সেই খাওয়াচ্ছেন, অথচ চিরজন্মের মত ওঁর মনে একটা খুঁতখুঁতুনি থেকে যাবে, সেটা কি হতে দেওয়া উচিত আমাদের?”

শচীনাথ অকৃতজ্ঞভাবে তাহার দিকে একবার চাহিল, তাহার পর কাহারও দিকে না চাহিয়া বলিল, “সত্তর টাকা খরচ হয়ে গেছে; দশ টাকা আছে প’ড়ে; যাবার ভাড়া রেখে পাঁচ টাকা কোন রকমে বের ক’রে দিতে পারি।”

অনেক টানাটানি কষাকষির পর পঁচিশ টাকায় রফা হইল। শচীনাথকে কিন্তু আপাতত সেই তেত্রিশ টাকাই দিতে হইল। কেহ এক টাকা, কেহ আট আনা, কেহ বারো আনা, কেহ চারি আনা, কেহ তাহারও কম ঋণ লইয়া সমস্ত টাকাটা বাহির করিয়া লইল।

.

যাহাদের নূতন বিবাহ, নববধূর আবদার জিনিসটা যে কি, তাঁহারা মর্মে মর্মে জানেন; যাঁহাদের পুরানো হইয়া আসিয়াছে, তাঁহাদেরও দুই-একটা উদাহরণ মনে থাকিতে পারে; সুতরাং এ বিষয়ে অধিক বলিবার প্রয়োজন দেখি না।

শচীনাথের উপর অনেক হুকুম ছিল। বউটি নিতান্ত ছেলেমানুষ; তাহার আবদারের না আছে একটা বাঁধুনি, না আছে কিছু। বাড়িতে থাকিতে বেচারা পতিদেবতাটিকে কি কি ঝক্কি সামলাইতে হয়, সে সব কথা ছাড়িয়া দিই; আপাতত এইটুকু বলিলেই চলিবে যে বাড়ি ছাড়িবার সময় হুকুম হইয়াছিল যে এক বর্ষার দিন ছুটি লইয়া আসিয়া বধূর হাতের খিচুড়ি খাইয়া যাইতে হইবে এবং আসিবার সময় একখানা প্রেমপত্রাবলী ও মিত্তিরদের মেজো বউয়ের মত কলম চিঠির কাগজ আর খাম সঙ্গে আনিতে হইবে!

দুই-তিনটি বর্ষা কাটিয়াছে। বেচারা নিজের অসুখ, মৃত ঠাকুরমা মৃত্যুশয্যায় – সব রকমের দরখাস্ত দিয়া হারিয়া গিয়াছে। বধূটির পত্র আসিয়াছে—এক টুকরো ছেঁড়া শ্রীরামপরী কাগজের এক পৃষ্ঠে লেখা। তাহার অপর পৃষ্ঠে এক ইঞ্চি সাইজের অক্ষরের স্কুলের জন্য হাতের লেখা রহিয়াছে। মাস্টারের দস্তখতসুদ্ধ। পত্রের শেষে পুনশ্চ করিয়া লেখা আছে—’দেখছ? সত্যিই আমার কাগজ নেই। তাই ছোটঠাকুরপোর ইস্কুলের খাতা ছিঁড়ে কাগজ নিয়েছি। আচ্ছা, তুমিই বল না—এ কাগজে কি বরকে লেখা চলে? আমার যেমন কপাল!’

চিঠিটা পাইয়া অবধি শচীনাথ যেন বিপন্নভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। ‘আমার যেমন কপাল’—আহা, কথাটাতে যেন ছোট্ট বুকখানির সমস্ত বেদনা উজাড় করিয়া ঢালা। আবার আসিবার সময় সেই মিনতি-অভিমান-আবদার-মাখানো কচি মুখখানি মনে পড়ে। তাহার পর চিঠিখানিতে পাঁচ জায়গায় শুধু একবার যাইবার ফরমাশ; তাহাতে আবার নানান রকমের প্রায় গোটা দশেক শপথ দেওয়া। বিপদ কি আর গাছে ফলে?

এ অবস্থায় নানা চিন্তার পর সাধারণ যুবক যাহা স্থির করে, শচীনাথও সেইরূপই স্থির করিয়া বসিয়া আছে অর্থাৎ সে দুই-এক দিনের মধ্যে যাইবেই। চাকরি যায়? অমন শ্বশুর রহিয়াছে কি করিতে? আর নূতন বিয়ের কাছে চাকরি? হুঁঃ!

এই রকম গোছের প্রশ্নোত্তরে এই রকম মীমাংসা করিয়া আজ তাহার মনটা অনেক হাল্কা ছিল, তাই অল্প চাপের উপর নোট কয়খানা টেবিলের উপর খসখস করিয়া বিছাইয়া দিয়া তদুপরি তিনটা টাকা ঠনঠন করিয়া বাজাইয়া দিল।

ভজহরির হাতে এ মাসের ম্যানেজারি ছিল। দুইখানা পাঁচ টাকার নোট তুলিয়া লইয়া বলিল, “মৃত্যুঞ্জয়বাবু খাঁড়ি মুসুরের ডাল আর তরিতরকারিগুলা কিনে নিয়ে আসুন— হিসেবী লোক; আর কেউ গিয়ে হগ সাহেবের বাজার থেকে ভাল টেবিল-রাইস, বাছাই করা বোম্বাই-আম, ঘি, সের কয়েক গলদা-চিংড়ি আর পাউন্ড-দশেক গ্রামফেড মটন কিনে নিয়ে আসুন না। বাজে জায়গা থেকে ভূষি মাল কিনে আনা—সে আমার ম্যানেজারিতে হতে দোব না। আমি দই আর সন্দেশের ভার নিচ্ছি; সব বোঝা আমার ঘাড়ে চাপালে চলবে কেন? আর গণপতি—”

গণপতি গুলি পাকাইতেছিল তাহার স্বভাব-উগ্র চোখে চাহিয়া বলিল, “হ্যাঁ, গণপতি কি? ব’লে ফেল।”

ভজহরি সামলাইয়া লইয়া বলিল, “না, এই তোমার গিয়ে, বলছিলাম—তোর আর এই দুর্যোগে কোথাও বেরিয়ে কাজ নেই।”

কুলদা বলিল, “গ্র্যাম্‌ফেড মটন হ’লে আমি কোর্মা রাঁধবার ভার নিচ্ছি, একবার দেখাব আজ।”

গণপতি সকলকেই তুই-তোকারি করে, ঘুরিয়া বলিল, “আবার তুই ঢুকিস তো রান্নাঘরে তোর সেই বীরভদ্র কেতাবটা নিয়ে, তোকে তা’হলে আর আস্ত রাখব না। সেদিনকার পাঁঠার শোক আমার যায় নি। যতক্ষণ রান্না হবে, তুই ঘরে বসে—কি ব’লে গিয়ে—”

পাশ হইতে কে হুকুমের টোনে কথাটা পূরণ করিয়া দিল, “বউকে চিঠি লিখতে থাকবি।”

শচীনাথ কি ভাবিতেছিল, বলিল, “হগ সাহেবের বাজারের দিকে না হয় আমিই যাব, একটু কাজ আছে আমার ওদিকে।”

গণপতি বলিল, “আটকে যাবি না তো? কেউ সঙ্গে যাক না?”

শচীনাথ একটু অন্যমনস্কভাবে বলিল, “না, পাঁচ মিনিটের কাজ। সঙ্গে যেতে হবে না, একটা কুলী ক’রে নিয়ে আসব’খন।”

তাহাই ঠিক হইল। ভজহরি বলিল, “দেখবেন, বৃষ্টি হ’লে বরং একটা ট্যাক্সি ক’রে নেবেন। আপনি না আসা পর্যন্ত সমস্ত বন্ধ থাকবে। আজ আবার ঠাকুরের সেই শ্বশুরবেটা আর শালাটা এসেছিল; অনুরোধে প’ড়ে ঠাকুরকে তাদের জন্য দুটি ভাত ফুটিয়ে নিতে হুকুম দিয়েছিলাম—বেটারা পনরো জনের ডাল-ভাত সাবড়ে সটকে পড়েছে—থাকলে পুলিসে হ্যান্ডওভার করতাম। মাসের শেষ,—হদ্দ কাল সকাল পর্যন্ত চাল হ’ত—এখন মুঠোকয়েক পড়ে আছে। আর সবাইয়ের পকেটের অবস্থা তো দেখলেনই—কালও আপনারই ভরসা!”

শচীনাথ ফীস্টের দরুন নোট হইতে দশ টাকার দুইখানা নোট আর দুইটি টাকা পকেটে পুরিল, বাক্স খুলিয়া আরও একখানা নোট লইল, পাঞ্জাবিটা গায়ে দিল, আরশির সামনে দাঁড়াইয়া মাথায় দুইটা চিরুনির টান দিল, শ্বশুর-বাড়ির জুতাটা পরিল; তাহার পর ছাতা ভুলিয়া বাহির হইয়া পড়িল।

তাহার কাজ—বউয়ের জন্য চিঠির কাগজ আর একটা ফাউন্টেন পেন লইবে।

কুলদা ছাতার কথা বলিতে যাইতেছিল; ‘ছা—’ করিতেই গণপতি তাহার মুখটা চাপিয়া ধরিল, “আবার পেছু ডাকা কেন বাব্বা? একেই তো ওই লোক!”

.

শচীনাথ হনহন করিয়া রাস্তা দিয়া চলিল। মনশ্চক্ষুর সামনে ক্রমাগতই বধূর আবদার-ভরা ঠোট-ফোলানো মুখখানি জাগিয়া উঠিতেছে। শচীনাথ কল্পনায় নিজেও কত আবদার, অভিমান, লুকাচুরি করিল—মুখভার আর যায় না। তখন সে মন-ভোলানো কলমটা বাহির করিল। সাহেব-বাড়ির লেবেল দেওয়া চিঠির প্যাডটা সামনে ধরিল, সোহাগভরে দুইটাকে সোনার হাতে তুলিয়া দিতেই ঠোঁট দুইটি হাসিতে এলাইয়া পড়িল। শচীনাথ একটা চুম্বন বসাইতে যাইতেছিল—অবশ্য কল্পনাতেই, তার পূর্বেই একটা বাস্তব ল্যাংড়া আমের খোলায় পা পড়ায় শান-বাঁধানো ফুটপাথের উপর সড়াৎ করিয়া খানিকটা পিছলাইয়া গেল। ইহাতে মনটা কল্পনালোক হইতে আমাদের মরজগতে ফিরিয়া আসিলে শচীনাথ লক্ষ্য করিল, পথিকদের মধ্যে সকলেই যেন একটু সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে। সামনে চাহিয়া দেখিল, পশ্চিম দিক ঝাপসা করিয়া প্রবলবেগে বৃষ্টির ধারা ছুটিয়া আসিতেছে, লাটসাহেবের বাড়ির উপর পর্যন্ত পৌঁছিয়া গিয়াছে, আর মিনিটখানেকের মধ্যে ভিজাইয়া দিবে। এতক্ষণে মনে পড়িল, ছাতা আনা হয় নাই, সঙ্গে সঙ্গে এটুকু ভাবিয়াও অস্থির হইয়া পড়িল যে, পকেটে খান তিনেক নোট।

ধর্মতলা দিয়া আসিতেছিল, মোড় ঘুরিয়া চৌরঙ্গি হইয়া ছুটিল। হোয়াইটঅ্যাওয়ে কোম্পানির দোকানের সামনে যখন পৌঁছিল, তখন আর অগ্রসর হইবার জো নাই; পথের একটা থাম ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, “খেয়ো সব খিচুড়ি আজকে।”

খিচুড়ির কথায় আবার বধূর কথা মনে পড়িয়া গেল। যদিও সবে আষাঢ় মাস পড়িয়াছে, তথাপি এই বিরহ-বিধূর নূতন বরটি ভাবিতে লাগিল, বর্ষা তো হয়ে গেল, আমার খিচুড়ি খাওয়ার নেমন্তন্ন তো এখনও রক্ষা করা হ’ল না! কি করব বল সুরমা, এত পরাধীনের ভগবান কেন যে বিয়ে দেন, জানি না। সেখানেও নিশ্চয়ই এমনই বর্ষা পড়েছে; অভিমানে চাঁদমুখখানি ভার হয়ে আছে। মিত্তিরদের মেজো বউয়ের মত চিঠির কাগজ চাই? চিঠির কাগজ এমন নিয়ে যাব, মেজো বউ কখনও চক্ষেও দেখে নি, দেখবেও না।

হঠাৎ হুঁশ হইল—সে সবচেয়ে সেরা সাহেবী দোকানের সামনেই দাঁড়াইয়া। ভাবিল, হগ সাহেবের বাজারে গিয়া খরিদ করার চেয়ে এইখানেই লওয়া ভাল হইবে না কি? বাজারের উৎকৃষ্ট জিনিসই যদি প্রিয়ার হাতে তুলিয়া দিতে হয় তো এই তাহার জায়গা খরচ? হাঁ, তা একটু বেশি পড়িবে বইকি। শচীনাথ একটু ভাবিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল : কিন্তু দুইটি জিনিস মনটাকে নিরবশেষ করিয়া জুড়িয়া বসিল—মানের ভরে ঘাড় কাত করা একটি ডবডবে মুখ আর তাহার পাশে মিত্তিরদের মেজো বউয়ের কাল্পনিক ঐশ্বর্য। টাকাটাও শ্বশুরের, স্বভাবতই যাহার জন্য বেশি দরদ থাকে না। শচীনাথ ঘাড় বাঁকাইয়া দোকানের অপূর্ব পণ্যশ্ৰী খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করিল, তাহার পর গটগট করিয়া ঢুকিয়া পড়িল।

সাহেবের দোকানে এই প্রথম আসা; ভিতরে গিয়া একটু ভ্যাবাচ্যাক খাইয়া গেল। বাংলায় বেচা-কেনা বলিতে হুড়াহুড়ি চেঁচামেচির মধ্য দিয়া যে ব্যাপারটা বোঝায়, তাহার কিছুই দেখিতে পাইল না। বর্ষার জন্য সেদিন আবার দোকানে খরিদ্দার খুবই কম, কাজেই সচরাচর যেটুকু সজীবতা থাকে, সেদিন তাহারও অভাব ঘটিয়াছিল। রাশি রাশি জিনিস অত্যন্ত নিপুণতার সহিত গোছানো রহিয়াছে, সেগুলাকে স্থানচ্যুত করিয়া কখনও যে বিক্রয় করা হয়—এ কথাটা বিশ্বাস করা শচীনাথের পক্ষে শক্ত হইয়া উঠিল। তখন ধাঁ করিয়া তাহার মনে হইল, বড় দোকান, যদি পাটের কিংবা তিসির গদিয়ানদের মত শুধু পাইকারি বিক্রয় করে এরা?

‘না যযৌ ন তস্থৌ’ হইয়া এক জায়গায় দাঁড়াইয়া বিহ্বলভাবে চারিদিকে কাতর দৃষ্টি হানিতেছিল, এমন সময় একজন ফিরিঙ্গী আসিয়া প্রশ্ন করিল, “কি চাই আপনার?”

“কলম আর প্যাড।”

“স্টেশনারি ডিপার্টমেন্ট—ওই দিকে গিয়ে বাঁ দিকটা ঘুরে যাবেন। আচ্ছা, চলুন, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

শচীনাথ পিছনে পিছনে খুচরা-পাইকারির কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সন্দিগ্ধ মনে চলিল।

স্টেশনারি ডিপার্টমেন্টের চার্জে একজন যুবতী। ফিরিঙ্গী শচীনাথকে দেখাইয়া বলিল, “একজন খদ্দের তোমার।”—বলিয়া ধন্যবাদ লইয়া চলিয়া যাইতেছিল; একবার ঘুরিয়া হাসিয়া বলিল, “আমার কমিশন চাই কিন্তু, মনে থাকে যেন।”

মেয়েটি কৃত্রিম রাগ দেখাইয়া বলিল, “দুষ্টু কোথাকার!”—বলিয়া স্মিত মুখে শচীনাথের দিকে চাহিল। বর্ষায় আজ সমস্ত দিন একরকম তাহার বিভাগে বিক্ৰয় নাই; তাহার উপর এই যুবক খদ্দেরটিকে বেশ শাঁসালো বলিয়া বোধ হইল। ঘাড় হেলাইয়া বলিল, “এগিয়ে আসুন, কি চাই আপনার?”

বোধ হয় ইহুদি। ঢলঢলে দুইটি কালোচোখ। কালো কোঁচকানো ঘন চুল, হালফ্যাশানে কানের কাছে ঘোরানো জুলফি করিয়া ছাঁটা।

বেশী করিয়া ধরিলে বছর আঠারো কি উনিশ বয়স হইবে। সমস্ত শরীরটি এবং গতিবিধির মধ্যে একটি বেশ সুললিত স্বচ্ছন্দ ভাব মাখানো। চোখটা একবার পড়িলে ইচ্ছামতই সরাইয়া লওয়া যায় না।

শচীনাথ একটু অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, “একটা ফাউন্টেন পেন আর একটা প্যাড চাই।”

“দিই। আপনি ততক্ষণ এই চেয়ারটায় বসুন, ফ্যানটাও খুলে দিই এই।”

কথাবার্তা অবশ্য ইংরেজিতেই হইতে লাগিল। ইচ্ছা করে, মেয়েটির মিষ্টি মিষ্টি ইংরেজি উদ্ধৃতি করিয়া পাঠককে উপহার দিই; কিন্তু তাহা হইলে তাহার সঙ্গে শচীনাথের পেটেন্ট ইংরেজিও তুলিয়া তাঁহাদের বিড়ম্বিত করিতে হয়; সুতরাং বাংলাতেই তর্জমা করিয়া দিতেছি—

“আগে কলম দেখাই। কি রকম ধরণের কলম চাই বলুন তো?”

বধূর পদ্মকোরকের মত মুষ্টিতে কি রকমটি মানাইবে, শচীনাথ একটু কল্পনা করিয়া বলিল, “একটু দেখতে শুনতে বাহারে হয়—”

মেয়েটি খোলা কাঁধের উপর জামার পটি তুলিয়া বসাইয়া দিয়া একটু জেরা শুরু করিয়া দিল, “নিজের জন্যে, না উপহার?”

শচীনাথ একটু সঙ্কোচের সহিত বলিল, “না, উপহারের জন্যে।”

“মনিবকে, না বন্ধুকে?”

নববধূ কিসের পর্যায়ে পড়ে, একটু দেরি করিয়া মনে মন তাহার মীমাংসা করিয়া শচীনাথ বলিল, “না, মনিব না, এই একরকম বন্ধুকেই।”

“পুরুষ, না স্ত্রীলোক?”—মেয়েটি এখানে নিজেও একটু লজ্জায় রাঙিয়া উঠিল। শচীনাথ বলিল, “স্ত্রীলোককেই; বস্তুত আমার স্ত্রীর জন্যেই কিনতে এসেছি।” মেয়েটি উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। একটু অভিমানের সুরে বলিল, “দেখুন তো, তা এতক্ষণ বলতে হয়। আমায় উকিলের অভিনয় করিয়ে ছাড়লেন আপনি। ফিস চাই কিন্তু— হি-হি-হি। নিশ্চয়ই টুকটুকে ছোট্ট একটি মেয়ে সে। তার জন্যে জিনিস পছন্দ করা তো আপনার একলা নয়। আমি নিজে যা পছন্দ ক’রে দোব, তাই নিয়ে যাওয়া উচিত। আচ্ছা, দামের একটা আন্দাজ—”

শচীনাথের দামের বিশেষ একটা আন্দাজ ছিলই না; যাহা কিছু ছিলও বা, সেটুকু পর্যন্ত এই সুন্দরীর কথাবার্তা হাবভাবের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল। মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলিল, “এই একটু বাহারে, মানানসই—”

মেয়েটি ছোট্ট মাথাটি দোলাইয়া একটু হাসিয়া বলিল, “ঠিক ঠিক, মেয়েটি স্বামীভাগ্যে খুব ভাগ্যবতী দেখছি।”

শচীনাথ একটু ফুলিয়া উঠিল। ভাবিল, এই প্রশংসার বাণীটি—আবার এমন একখানি মুখের বাণী—যদি একবার বধূর কানে উঠিত তবে তো—

টেবিলের উপর কাগজের, ইমিটেশন লেদারের নানান রকম কেসে গোটা দশ-বারো কলম আসিয়া পড়িল। মেমসাহেব সুভঙ্গিম অঙ্গুলি দিয়া সেগুলো একে একে খুলিয়া সাজাইয়া দিল। রোল্ড-গোল্ডের, রূপার, সেলুলয়েডের—কালো, বাদামী, সোনার ব্যান্ড আর ক্লিপ আঁটা চমৎকার জিনিস সব। দুইটা কম-দামী এ মজলিসে হংসো মধ্যে বকো যথা গোছের কলমও ছিল। সে দুইটা যুবতীর স্পর্শসুখও ভাল করিয়া পাইল না।

শচীনাথ বিলাতী সোনার একটা কলম উঠাইয়া লইয়া বলিল, “এটা কত?”

“পঞ্চান্ন টাকা; তবে আজকাল গ্রান্ড ক্লিয়ারেন্স সেল চলছে, চুয়ান্ন টাকা পনরো আনাতে পাবেন। উপহারের পক্ষে এমন—”  

পঞ্চান্ন টাকা! শচীনাথের গলগল করিয়া কালঘাম ছুটিল। এই রকম দামের জিনিস সব বাহির করিয়াছে! সর্বনাশ! পকেটে তাহার বত্রিশটি টাকা পড়িয়া। তাহার মধ্যে আবার এতক্ষণ স্বর্গবাসে যে কথা সে বিলকুল ভুলিয়া গিয়াছিল, বাইশটা টাকা ফীস্টের দরুন। সে বেচারীরা তীর্থের কাকের মত হাঁ করিয়া বসিয়া আছে।

শচীনাথ ফ্যালফ্যাল করিয়া মেয়েটার দিকে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল। একবার মাথার উপর পাখাটা ঠিক ঘুরিতেছে কি না দেখিয়া লইল। তাহারপর কলমটা রাখিয়া দিয়া আমতা আমতা করিয়া বলিল, “ইয়ে—আর কিছু না—তার হাতের পক্ষে এটা নেহাত বড় হবে।”

মেয়েটি রোজ এই কাজ করিতেছে। বিজ্ঞের মত গম্ভীর হইয়া বলিল, “আমিও ঠিক সেই কথা বলতে যাচ্ছিলাম; তবে আপনি নেহাত তুলে নিলেন। আচ্ছা, এইটে দেখুন তো। ওরই জুনিয়ার, হাতে ঠিক মানাবে। কত বয়স? চোদ্দ? হয়েছে। আচ্ছা, বলুন তো, রঙটা আপনার মত, না কালো?”

শচীনাথ যেন অকূলে কূল পাইল। সে নিজেই বেশ কালো, বধূটি ঢের ফরসা। তথাপি রঙটা কালো বলিলে যদি এযাত্রা পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এ মোহিনীর মতে কালোর হাতে যদি খেলো কম-দামী জিনিসই মানানসই হয়–এই ভাবিয়া বলিল, “না, আমার চেয়ে বেশ একটু কালোই হবে।”

সে যে আবার কি বস্তু, তাহা ভাবিয়া চতুরা যুবতী একটি ছোট হাসিকে ঠোঁটে চাপিয়া মিলাইয়া লইল; তাহার পর একটু চিন্তিতভাবে বলিল, “তা হ’লে আপনাকে এই সোনারটিই নিতে হয়। কালো হাতে রূপোর জিনিসও মানাবে না, বাদামী সেলুলয়েড তো নয়ই; আর কালো? তা হ’লে আপনার স্ত্রী আপনাকে কখনই ক্ষমা করতে পারবেন না; এ তাঁকে সাংঘাতিক বিদ্রূপ করা হবে (It will be nasty joke at her expense)”।

যাঃ, একেবারে উল্টা উৎপত্তি! মিথ্যাটা যেন ফণা ঘুরাইয়া তাহাকে ছোবল দিল। যদিও বুঝিল, সত্য কথা বলিলেও মেমসাহেবের রায়টা সোনার কলমের দিকেই বাহাল থাকিত, তথাপি তাহার অনুতাপ-দুর্বল মনে একটা খটকা লগিয়াই রহিল—বোধ হয় ফরসা বলিলেই নিষ্কৃতি পাওয়া যাইত। আ-হা-রে!

.

মেসে সে বেচারারা এতক্ষণ মিনিট গুনিতেছে। এ জাঁতিকল হইতে পরিত্রাণের কোন উপায়ই না দেখিয়া শচীনাথ ছটফট্ করিতে লাগিল। হতাশায় মরীয়া হইয়া নিকৃষ্ট কলম দুইটার মধ্যে একটা তুলিয়া লইয়া বলিল, “এটা কেমন হবে?”

মেয়েটি শচীনাথের ফিটফাট বেশভূষার দিকে একটা সসম্ভ্রম দৃষ্টি বুলাইয়া অপরাধিনীর মত বলিল, “ওটা আমায় দিন, এ দুটো আপনার যোগ্য নয়। পাঁচ-সাত টাকা দামের নেহাত খেলো জিনিস—বের ক’রেই আপনার প্রতি অন্যায় করেছি, সে জন্য ক্ষমা করবেন।”

বেটাছেলে হইলে শচীনাথ বোধ হয় ঘুষি মারিয়া বসিত—অন্যায় করিয়া ফেলার জন্য নহে, তাহার প্রতি এই সৌজন্য দেখানোর জন্য। যুবতীকে শুধু বলিল, “না না, সে কি কথা! আপনি দয়া ক’রে এত আগ্রহ প্রকাশ করছেন আমার জন্যে—”  

যাদুকরী সুগন্ধী একটি রুমাল বাহির করিয়া কপালের উপর উড়িয়া পড়া একটা চুলের স্তবক মাথার উপর তুলিয়া দিয়া বলিল, “আপনার অভিমতের জন্য ধন্যবাদ। আমাদের কর্তব্যই খদ্দেরের জিনিস-মননে যথাসাধ্য সাহায্য করা। তার ওপর জিনিসটা আপনার বালিকা-বধূর জন্যে যখন শুনলাম, তখন আমি আপন ভুলেই একটু আগ্রহ দেখিয়ে ফেলেছি। যদি অপরাধ হয়ে তাকে—হ্যাঁ, দামটা—অর্থাৎ সেল প্রাইস আটাশ টাকা চার আনা। কৌটায় বন্ধ করিয়া কলমটা সে শচীনাথের সামনে সরাইয়া দিল।

.

একটা চলিত কথা ব্যবহার করিতেছি—শচীনাথ একেবারে ভেড়া হইয়া গিয়াছিল। কোনমতেই সে এই যাদুশক্তির বিরুদ্ধে আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে পারিতেছিল না। ফীস্টের ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট করিয়া মনে পড়িল। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, ছুটিয়া দোকান হইতে বাহির হইয়া যায়—কিংবা কমদামী কলমের মধ্যে একটা খুব মনের জোর দিয়া আবার তুলিয়া লয়; অথবা অন্ততপক্ষে এ অমানুষিক অত্যাচারের জন্য দুইটা কড়া কথা শুনাইয়া দিয়া মনটা হালকা করিয়া লয়। কিন্তু কার্যত সেসব কিছুই না করিয়া ভাল-মানুষের মত পকেট হইতে তিনখানা নোট বাহির করিয়া দিল। কথাটা কি খুব আশ্চর্য বোধ হইতেছে?

যুবতী হাসিয়া বলল, “মিসেস — মিসেস—”

শচীনাথ বলিল, “হালদার।”

“মিসেস হালদারকে বলবেন, এমন সুন্দর পছন্দ তাঁর স্বামীর যে, তাঁকে কনগ্রাচুলেট না ক’রে থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ, একটা প্যাড? সেটাও তাঁরই জন্যে নাকি?”

শচীনাথ ঢের মিথ্যা কথা বলিয়াছে; কিন্তু খুব প্রয়োজন হইলেও এক্ষেত্রে পারিল না। বলিল, “হ্যাঁ, তারই জন্যে; তবে প্যাড আপাতত না হ’লেও চলে।”

যুবতী আবদারের জবরদস্তি দেখাইয়া মাথাটি একটু দুলাইয়া বলিল, “না নেন, দাঁড়িয়ে একটু দেখুনই না; অবশ্য যদি আমার এক কোণটুকু আপনার নেহাত অপ্রীতিকর ব’লে না বোধ হয়।”

রঙ-বেরঙের পাঁচ-ছয়খানা প্যাড আসিয়া পড়িল। শচীনাথ কলমের যোগ্য ভাল ভাল তিনখানা উঠাইয়া লইল—এর আর কতই মূল্য হইবে? জিজ্ঞাসা করিল, “দাম এগুলোর?”

“এক টাকা চার আনা, এক টাকা বারো আনা, আর এটা দু টাকা ছ আনা।” শেষেরটার পাতা খুলিয়া সামনে আগাইয়া দিয়া বলিল, “এর কাগজটা দেখছেন? একেবারে নূতন জিনিস; ভারতবর্ষে আমরাই প্রথম আমদানি করেছি—আপনাদের মত অভিজাতদের জন্যে।”

শচীনাথ দেখিল, প্যাডেও তো বিপদ সামান্য নয়, অন্তত ইহার কাছে। সে ভাবিয়াছিল, যেখানে আটাশ টাকা লম্বা হইয়া গেল, সেখানে না হয় আরও গণ্ডা বার-চৌদ্দ, কি জোর একটা টাকাই যাইবে; বিশেষ করিয়া যখন কলমের সঙ্গে সঙ্গেই প্যাডের ফরমাশটা দিয়া ফেলিয়াছিল। তা নয়, কোথায় আড়াই টাকার একটা প্যাড! তাহাকে যেন পাইয়া বসিয়াছে বেটী!

শচীনাথের প্রপিতামহ একজন বিচক্ষণ মোক্তার ছিলেন; বোধ হয় সেই উত্তরাধিকারসূত্রে তাহার মাঝে মাঝে একটা আশ্চর্য রকম কূটবুদ্ধি যোগাইয়া যাইত। ইহার আগে যোগায় দেশে—একটা দুরন্ত হনুমানকে জব্দ করিতে। শচীনাথের ডান হাতের পেশীতে এবং বাঁ দিকের পাঁজরায় এখনও পর্যন্ত তাহার নিশানা আছে। এর চেয়ে ভাল প্যাড তো ইহার ভাঁড়ারে নাই। মনে মনে কহিল এইবার তোমায় আমার কাছে হারতে হবে চাঁদ।

বলিল, ‘প্যাডটার প্রশংসা করতে হয়; তবে আমি খুঁজছি এর চেয়ে সেরা জিনিস— দাম আর একটু বেশি হ’লেও ক্ষতি নেই। একবার আর্মিনেভির ওখান থেকে এক জোড়া কিনেছিলাম—চীফ জাস্টিসের স্ত্রীকে ভেট দেওয়ার জন্যে। এটা রেখে দিন, সেইখানেই একবার দেখি গিয়ে। আমার তা হ’লে হ’লতিরিশ থেকে আটাশ টাকা চার আনা গেল—”

মেয়েটি উৎসাহদীপ্ত চোখে শচীনাথের দিকে চাহিয়া বলিল, “একটু অপেক্ষা করুন মিঃ হালদার, আপনাকে আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে না। ক্ষমা করবেন, আপনার মত শৌখিন লোকের প্রতি অবিচার করেছি। আসি, দাঁড়ান

“আচ্ছা, এদুটো পরখ করুন তো; নিশ্চয়ই এ জিনিসের কথাই বলছিলেন আপনি।” বলিয়া দুইখানি নূতন ধরনের প্যাড শচীনাথের হাতে তুলিয়া দিয়া টেবিলে ভর দিয়া দাঁড়াইল; সফলতার আনন্দে মুখখানি রাঙা হইয়া উঠিয়াছে।

শচীনাথের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমিয়া উঠিল এবং সে অবসন্ন ভাবে সামনের টেবিলটায় একটু ঝুঁকিয়া পড়িল। পাপ কলিতে ধরণী আর দ্বিধা হয় না। শচীনাথ মনে মনে বলিল, হে অট্টালিকা, তুমি ভেঙে পড়–তোমার এই ঐশ্বর্যের মায়াজাল নিয়ে তুমি মর সম্মোহনের সহস্র বিদ্যা নিয়ে এই মায়াবিনী মরুক, আর মোহমুগ্ধ পদার্থ-লেশহীন আমিও মরি। হায় রে, ভেবেছিলাম, অন্তত চালটা কিনে নিয়ে যাব, বলব মটন গলদা-চিংড়ি ওসব পাওয়াই গেল না। কি কুক্ষণেই যে—

যুবতী দেহলতাটিকে একটু দোলা দিয়া বলিল, “কেমন, যা খুঁজছেন তাই নয় কি? দেখতে হবে না, আসল মরক্কো চামড়া ও ক্লিপটা চৌদ্দ ক্যারেট সোনা। প্যাডের কাগজগুলো যখন ফুরিয়ে যাবে, অন্য প্যাড কিনে—। আঃ, কি জ্বালা! দেখুন তো মিঃ হালদার, চুলের সঙ্গে কানের দুলের কি চিরকালই শত্রুতা থাকবে? আমি তো আর এদের মধ্যস্থতা ক’রে উঠতে পারি না।”—বলিয়া গ্রীবা বাঁকাইয়া দুল আর চুলের জট খুলিতে লাগিল। আর কোন উত্তর না পাইয়া ভাবিতে লাগিল, লোকটা কি বেরসিক রে; ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে এদের এইখানেই তফাত।

শচীনাথ বেচারার চক্ষে তখন পৃথিবীর সব সৌন্দর্যই নিবিয়া গিয়াছিল। শুষ্ক কণ্ঠে বলিল, “কত দাম?”

“গ্র্যান্ড ক্লিয়ারেন্স সেলে তিনটাকা সাত আনা, তিন টাকা ন আনা। কোটা দিই?”

শচীনাথ নিজের উপর বিজাতীয় রাগে তিন টাকা ন আনাটা বাড়াইয়া দিল। পকেটের টাকা বাহির করিয়া দিয়া অস্পষ্টভাবে বাংলায় বলিল, “ক্লিয়ারেন্স সেলটা কি আমার পকেট লক্ষ্য ক’রে? গাঁটকাটা সব ডাইনী!”

যুবতী ক্যাশ-মেমোর উপর তিন আনা পয়সা রাখিয়া সামনে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, “তা হ’লে আপাতত আসুন বাবু, নমস্কার।”

.

বাহিরে আসিয়া শচীনাথ একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল, তাহাতে তাহার বুকটা যেন পকেটের মতই খালি হইয়া গেল। ভাবিল, এখন উপায়?

অত্যন্ত ক্রোধ হইল মেয়েটার উপর, কিসের জন্য সে শয়তানী অমন করিয়া—

কিন্তু অমন করিয়া কি, তাহার কোন স্পষ্ট আকার না পাইয়া আরও চটিয়া উঠিল। একবারে সপ্তমে উঠিল, যখন মনের এক কোণে আবার তাহার বিবেকটা মুরুব্বিয়ানা করিয়া বলিল, কই, সে বেচারী তো মাত্র নিজের কর্তব্য—

শচীনাথ এই ক্ষীণ আওয়াজটুকু চাপিয়া দিয়া বলিল, কিছু না। আমি ওকে দেখে নোব একবার। ইহাতে একটু সান্ত্বনাও পাইল; আর রাগ হইল নিজের উপর। এমনই লক্ষ্মীছাড়া, কাণ্ডজ্ঞানহীন তুই! এত বড় একটা আমোদের ভার—! চুলোয় যাক আমোদ, অন্তত রাত্রে সবাইকে এক মুঠো ক’রে গিলতে তো হবে, আর তুই কিনা একটা তুচ্ছ মেয়ের—আরে ছ্যাঃ, ছাই সুন্দরী!

সবার শেষে ঝোঁকটা গিয়া পড়িল বউয়ের উপর। কি ভীষণ স্বার্থপর আর অবুঝ এরা! একটা সামান্য কলম আর খানকতক চিঠি। কাগজের জন্যে সময় নেই অসময় নেই—ঘ্যানর ঘ্যানর! শেষে একটা অঘটন ঘটিয়ে তবে ছাড়লে, মুখ তোলো হাঁড়ি তো হয়েই রয়েছে।—’এ কাগজে কি বরকে লেখা চলে? আমার যেমন কপাল!’ কেন, তোমার কপাল তো ঠিকই আছে; লক্ষ টাকা দামের কাগজকলমে দাগড়া দাগড়া অক্ষরে কাঁদুনি গাইবে’খন। কপাল পোড়া এই অভাগা বেটাছেলেগুলোর। সাতজন্মে কেউ যেন বিয়ে না করে।

এখন মেসে ঢুকিবে কি করিয়া সেই এক মহাচিন্তা। আষাঢ়ান্ত বেলা, এখনও একবার ট্যাক্সি করিয়া গিয়া টাকা লইয়া ফিরিয়া আসিবার সময় আছে; কিন্তু যাওয়ার নামেই তাহার বুকটা গুরগুর করিয়া উঠিল। মটন ঘি আর টেবিলরাইস আর গলদা-চিংড়ির বদলে যখন সে মরক্কো লেদার আঁটা প্যাড আর আটাশ টাকা দামের সোনার কলম লইয়া উঠিবে, তখন প্রথম ঝোঁকটায় সেই পনরোটা হন্যে কুকুরের হাতে তাহার কি নাকালটাই হইবে ভাবিয়া সে দমিয়া গেল। কিন্তু এ ভিন্ন আর উপায়ও নাই। শচীনাথ পাশের একটা দোকান গিয়া বড় গ্লাস শরবত পান করিল, তাহার পর আসিয়া আবার চার্চের নীচে দাঁড়াইল। প্রায় আধ ঘণ্টা তিন কোয়ার্টার চিন্তা করিয়া কোন জুতসই মতলব স্থির করিতে পারিল না। অবশেষে হার মানিয়া একটা ট্যাক্সি ডাকিতে যাইবে, এমন সময় হঠাৎ তাহার বাল্যবন্ধু নন্দর কথা মনে পড়িয়া গেল।

এই মিলটন স্ট্রীটে বাড়ি তাহার। বড়মানুষের ছেলে, এক কথায় পঞ্চাশ টাকা বাহির করিয়া দিতে পারে। ভাবিল, কেন যে কথাটা এতক্ষণ মনে পড়ে নাই!

দুর্ভাবনাটা কাটিয়া গিয়া শরীরটা হাল্কা হইল। কলমটা এবং প্যাডটার উপর দরদ জমিয়া উঠিল; যে বিক্রয় করিয়াছে তাহার সুন্দর সরল মুখখানি মনে পড়িল; আর যাহার জন্য কেনা, সে তো আবার হৃদয়-সিংহাসনে রাণী হইয়া জাঁকিয়া বসিলই। মনটা রসিকতা করিয়া নিজের প্রশ্নের নিজেই জবাব দিল, দু-দুটো সুন্দরীর পাল্লায় পড়েছে, বন্ধুদের কথা কি মনে থাকে?

বৃষ্টিটা একটু ধরিয়াছিল, শচীনাথ উৎসাহভরে বাহির হওয়ামাত্রই আবার মুষলধারে নামিল। বেচারী ফিরিয়া আবার আশ্রয়ে ঢুকিল ও ঝাড়া এক ঘণ্টা পরে বাহির হইয়া আসিয়া ডান হাতে প্যাড এবং বাঁ হাতে জুতা-জোড়াটা ও কোঁচা তুলিয়া ছপাৎ ছপাৎ করিয়া চলিল, এবং আরও গোটা দুই-তিন মাঝারি গোছের বর্ষণ কাটাইয়া রাত প্রায় আটটার সময় নন্দের বাড়ির ফটকে গিয়া প্রবেশ করিল।

বাড়ির দারোয়ান রামবৃছ দুবে বর্ষাজনিত ভাবুকতার উচ্ছ্বাসে দক্ষিণ কর্ণের উপর হাত চাপিয়া ও বামচক্ষুটা প্রাণপণে বুজিয়া হাঁ—আঁ—আঁ করিয়া সবেমাত্র তাহার ছাপরেয়ে মল্লারের তান উঠাইতে যাইতেছিল, শচীনাথকে দেখিয়া হঠাৎ থামিয়া গিয়া বলিল, “আরে আঁই আঁই, শচীনাথবাবু, আজকে ইন্দির মহারাজ গোস্স। হয়েছে, বাঙালি মাশাদের অমরাবত্তীকে পাতালে সেঁদিয়ে দিবে। আর নন্দবাবু কোথা আছে? কেমোন খাওয়া-দাওয়া বোনলো? নয়া সাদি করলে, গরিব রামবৃছের বক্‌শশ—”

শচীনাথ ভীতভাবে বলিল, “নন্দবাবু? নন্দবাবু যাবে কোথায়? বাড়িতেই আছে। রামবৃছ তাহার সমস্ত দত্তপাটি বিকশিত করিয়া বলিল, “হেঁ হেঁ, আছে বইকি, রামবৃছের কাছে চালাকি? সে তো তোমার বাড়ি বর্ষার নেওতা খেতে গেছে। হেঁ হেঁ, আমার সামনেই তো সে আর লগীনবাবু মতলব ঠিক করলে; আমাকে ফাঁকি দিতে আছো বাবু?”

শচীনাথ কাঠ হইয়া গিয়াছিল, তাহার এদিকে মনই ছিল না, কোনও উত্তরই দিল না। কি কুক্ষণেই তাহার নন্দের কথা মনে পড়িয়াছিল! এতক্ষণে সে বাড়ি হইতে টাকা আনিয়া জিনিসপত্র লইয়া ফিরিয়া যাইতে পারিত। কি কুগ্রহই পড়িয়াছে আজ! ওরে লক্ষ্মীছাড়া নন্দ, শেষ চোটটা তা হ’লে তুইই দিলি রে!

“এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পারো দুবেজী?”—বলিয়া সে হতাশভাবে চিন্তা করিতে লাগিল।

নিরাশার অন্ধকার যখন নিতান্ত ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছে, শচীনাথ মনের এক কোণে যেন একটা ক্ষীণ আলোক অনুভব করিল। বুঝিল, এ সেই তাহার প্রপিতামহের মোক্তারী বুদ্ধির সূক্ষ্ম রেখা, তাহার জন্মগত সংস্কার। আলোটি ক্রমে বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল এবং জলটা যতক্ষণে পান করিল, ততক্ষণে বেশ একটা চতুর প্ল্যান সেই আলোর মধ্যে রেখায় রেখায় ফুটিয়া উঠিল।

গ্লাস রাখিয়া শচীনাথ দরোয়ানকে বলিল, “রামবৃছ দুবের বকশিশটা অনেক দিন থেকে প’ড়ে আছে, না? আচ্ছা, কাল একবার ফুরসুত ক’রে সন্ধ্যার সময় মেসে যেয়ো, হ্যাঁ, আর দেখ, যাবার সময় এই মোড়াটা হাতে ক’রে নিয়ে যেয়ো, কি জানি বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারে। আর দেখ, নন্দ কি বাড়ির আর কাউকে মোড়াটা দেখিয়ে কাজ নেই, আর ব’লে কাজ নেই যে, শচীনাথ এসেছিল। এর মধ্যে একটু মজা আছে, তুমি সমঝদার লোক, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ?”

রামবৃছ অসমঝদার হইয়া পড়িবার ভয়ে কোন প্রশ্ন না করিয়া সেয়ানার মত ঘাড় দোলাইয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “সে আমি জবান কাটিয়ে দিলেও বোলবো না।”

“তা হ’লে কাল বকশিশটা নিয়েই এস। কই, তোমার ছাতাটা দেখি একবার, কাল নিয়ে এস’খন।”

“হ্যাঁ, এই বর্ষার ঠিক এই ছাতা, বাঃ!”

ফটক পর্যন্ত জুতা-পায়ে আসিয়া শচীনাথ আবার জুতা খুলিয়া পূর্ববৎ চলিল। হগ সাহেবের বাজারে যেখানে মটন কিনিবার কথা, তাহারই কাছাকাছি একটা মনিহারী দোকানে গিয়া প্রশ্ন করিল, “একটা ছোট কাঁচি পাওয়া যাবে?”

সমস্ত দিন বর্ষার জন্য বিক্রয়াদি না হওয়ায় দোকানী অনির্দিষ্টভাবে সারা দুনিয়ার উপর এবং নির্দিষ্টভাবে খদ্দের জাতটার উপর চটিয়া ছিল।

“দু আনা দেবেন।”—বলিয়া একটা এক আনা দামের মোড়া কাঁচি বাহির করিয়া দিল।

শচীনাথের আজ দোকানী জাতটার সঙ্গে বাক্যালাপ করিবার মেজাজ ছিল না; দুই আনা পয়সা ফেলিয়া দিয়া কাঁচিটা লইয়া বাহিরে আসিল এবং মেসের রাস্তা ধরিল।

মাঝামাঝি আসিয়া একটা কেরোসিন-ল্যাম্প-জ্বালা নিজন গলির মধ্যে প্রবেশ করিল এবং তাহারও মধ্যে যেখানে বেশি জমাট-গোছের অন্ধকার ছিল, সেখানটায় গিয়া দাঁড়াইল। বুকের ভিতর তাহার এমন ধড়াস ধড়াস করিতেছিল, যেন সদ্য খুন করিয়া ফেরার হইয়াছে।

একবার এদিক ওদিক চাহিল, তাহার পর বাঁ হাতে ডান দিকের পকেটের থলিটা টানিয়া ধরিয়া কাঁচি দিয়া কচকচ করিয়া এপার ওপার করিয়া দিল।

ঠিক এই সময় পাশের বাড়ির দরজা খোলার শব্দ হইল এবং শব্দকর্তা বাড়ির মালিককে বলিতে বলিতে বাহির হইয়া আসিল, “ওহে, কর্পোরেশনকে ব’লে তোমাদের গলিটার একটা কিনারা করতে পারলে না? একে তো ‘কমিট-নো-নুইসেন্স’ লিখে নরকের যোগাড় ক’রে তুলেছে, রাত্তিরে যে আবার গাঁটকাটার ভয় করে!”

শচীনাথ ত্রস্তভাবে হনহন করিয়া বাহির হইয়া আসিল। তাড়াতাড়িতে কাঁচিটা আর কাপড়ের টুকরাটা যে বাঁ দিকের পকেটেই রাখিয়া দিল, তাহা আর জ্ঞান হইল না।

.

মেস এদিকে আগুন হইয়া আছে।।

মাঝে মাঝে এক-একজন মেম্বারের উগ্র অভিমতের আকারে এক-একটা শিখা উঠিতেছে, কিন্তু সকলেরই পূর্ণ উত্তাপ লইয়া দুরাচার শচীনাথকে দগ্ধ করিবার ইচ্ছা থাকায় কেহ আর উত্তাপের অপব্যয় করিতে চাহিতেছে না। প্রায় সকলে গোঁজ হইয়া বসিয়া আছে কিংবা একদৃষ্টে কোনদিকে চাহিয়া ক্রোধটাকে পরিস্ফুট করিতেছে।

কুলদাচরণ নিজের ঘরে বসিয়া প্রথম উৎসাহে তাহার ‘বাবুর্চি’ নামক বইটার মাংসের অধ্যায় প্রায় মুখস্থ করিয়া ফেলিল। তাহার পর শচীনাথের ব্যবহারে মনটা করুণ-রসসিক্ত হইয়া উঠায় বউয়ের নামে খানিকটা বিরহগাথা লিখিল। এখন আবার মনের অবস্থা বদলাইয়া যাওয়ায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পড়িতেছে। গণপতি ক্রমাগত বাহিরে যাইতেছে আর শচীনাথের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া বলিতেছে, “এ দমবাজির সাজা যদি না দেওয়া হয় তো বুঝব সব ভেড়ার দল, কাওয়ার্ডস।”

রান্নাঘরের অবস্থাটা খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায়—পটলভাজা নামিয়াছে, চাটনি নামিয়াছে; আর কিছু চড়েও নাই, নামেও নাই। এদিক মাংস, গলদাচিংড়ি আর ভূনিখিচুড়ির জন্য বাটা-মসলা তাল তাল পড়িয়া আছে। কোণে দই সন্দেশ ঢাকা!

মৃত্যুঞ্জয় এই তৃতীয় বার সকলের নিকট চাল আর ডালের জন্য পয়সা চাহিয়া হারিয়া বসিয়া আছে। দুই-একজন একটু উষ্মার সহিতই বলিয়াছে, “জেনেশুনে আর ঠাট্টা করবেন না মশায়; আজ মেজাজ ঠিক নেই।”

গণপতি কি এক রকম মুখ করিয়া শচীনাথের বরবেশে তোলা যুগল ফোটোর দিকে চাহিয়া ছিল, টেবিলে ঘুষিটা টিপিয়া ধরিয়া বলিল, “উঃ, পাই একবার এই সময়!”

এমনসময় রাস্তার দুয়ারে দুইটা লঘু আঘাত পড়িল এবং জড়িতকণ্ঠে আওয়াজ শোনা গেল, “ঠাকু—র!”

“ওই এসেছে।”—বলিয়া সমস্ত মেস কাঁপাইয়া একটা হিংস্র রব উঠিল এবং গণপতি দুয়ারের দিকে ছুটিল, “আমি দরজা খুলে দোব।”

দুই-তিনজনে তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। দুই-একজন ক্ষমাশীল মেম্বার বলিল, “যাক্ জিনিস তো এসে পড়েছে, ফৌজদারী ক’রে আর কি হবে?”

সকলে হুড়াহুড়ি করিয়া নামিয়া আসিল। ওদিক হইতে শচীনাথও আসিয়া উঠানে দাঁড়াইয়াছে। প্রথম ঝোঁকে যাহার যাহা মনে আসিল, শ্লীলতা অশ্লীলতা বিচার না করিয়া একচোট বলিয়া লইল। কুলদা ‘বাবুর্চি’ বইটার ভিতরে একটা আঙুল দিয়া নামিয়া আসিল, বলিল, “উঃ, মস্ত একটা জিনিস বাদ প’ড়ে গেছে। এতে বলছে, কোর্মা রাঁধতে হ’লে—। কই, কুলি ব্যাটা কোথায়? চম্পট দিলে না তো? সেটাকে চোখের আড়াল—”  

শচীনাথ এতক্ষণে কথা কহিল, বলিল, “কুলি নেই, জিনিস কিছুই আসে নি।’ “অ্যাঁ, জিনিস আসে নি! মটন! গলদা!—” ইত্যাকারে আবার একটি নারকীয় কলরব উঠিতেছিল। শচীনাথ আপনার কাটা পকেটের মধ্যদিয়া সমস্ত হাতটি চালাইয়া দিল ও অঙ্গুলি পাঁচটা ছড়াইয়া দিয়া সকলের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল, বলিল, “একটি আধলা ছেড়ে যায় নি।”

কলরবটা একেবারে ঠাণ্ডা হইয়া গেল এবং প্রথম বিস্ময়ের মূঢ়তায় সকলে পরস্পরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল।

এ পর্যন্ত শচীনাথের প্ল্যানটা বেশ খাটিয়া গেল এবং সে মনে মনে মোক্তার প্রপিতামহের স্মৃতির উদ্দেশে পরম ভক্তিভরে একটা প্রণাম ঠুকিয়া দিল।

ওদিকে কিন্তু আদ্দির ফিনফিনে পাঞ্জাবির অন্য পকেটের দুই কান দিয়া কাঁচির দাঁড়া দুইটা বহির হইয়া ঝকঝক করিতেছিল। মোক্তার প্রপিতামহের বুদ্ধির সহিত কেরানী শচীনাথের নিজের বুদ্ধিও খানিকটা মিশিয়া গিয়াছিল। তাড়াতাড়িতে কাঁচিটা পকেটে রাখিয়া দিয়াছিল, সেটা যে ফেলিয়া দিওয়া দরকার, সমস্ত রাস্তায় সে হুঁশটাই একেবারে হয় নাই। প্রথমে নজরে পড়িল ঠাকুরের। সে পকেট হইতে কাঁচিটা সযত্নে টানিয়া বাহির করিল এবং নিজের বিচার অনুযায়ী রহস্যটার মীমাংসা করিয়া বিস্ফারিত নেত্রে কহিল, “এঃ, ফিন ই পকেটভি কাটতে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি কাঁচিটা ফেলিয়ে গিয়েছে।”

শচীনাথ শুষ্ক কণ্ঠে বলিল, “তাই তো দেখছি।”—বলিয়া ভূতগ্রস্তের মত আস্তে আস্তে উপরে উঠিয়া গেল।

সকলে আবার একবার অন্যভাবে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতে লাগিল। গণপতি যেন হঠাৎ ঘুমের ঘোর হইতে জাগিয়া বলিয়া উঠিল, “কাঁচি—কাঁচিই সই—দাও তো ঠাকুর, দেখি একবার—”  

কয়েকজন সতর্ক ছিলই, তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।

সেই ঠাণ্ডা বর্ষারাত্রে দই-সন্দেশের সহিত পটলভাজা আর আলু-বোখরার চাটনির নূতনবিধ এবং অতি-সংক্ষিপ্ত ফীস্টের সময় নানান রকম গাঁটকাটার গল্প চলিল; তাহার মধ্যে নিজের গাঁট নিজেই কাটার দুই-একটা রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর গল্পও শোনা যাইতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *