গঙ্গা-যমুনা – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সেবার পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়া যেখানে বাসা করিয়াছিলাম ঠিক তার সম্মুখে বাদশাহি আমলের একটা বাগিচা ছিল। প্রকাণ্ড বাগান; পাথরের প্রাচীরে চারিদিক ঘেরা, তারি মাঝে পাথরে গাঁথা গোল-গম্বুজ তিনটা কবর। বাগানের স্থানে স্থানে লাল পাথরে বাঁধান হৌজ, তার মাঝে জলের ফোয়ারা; বড় বড় নিমগাছের তলায় শ্বেত পাথরের চাতাল। স্থানটা জনশূন্য এবং অযত্নে এখন নষ্টশ্রী। বাগিচার খবরদারি করিতে কোম্পানি বাহাদুরের নিযুক্ত একজনমাত্র বৃদ্ধ মালী ছিল এবং তাহারই যত্নে দুইচারিটা ফুলগাছ ও কতকটা সবুজ ঘাস সেই স্থানটাকে মনোরম এবং সকালে সন্ধ্যায় হাওয়া খাইয়া বেড়াইবার মত করিয়া রাখিয়াছিল।
আমার বাসার ত্রিসীমানায় আর জনমানব ছিল না। খবরের কাগজ এবং দুই একখানা চিঠি লেখা ছাড়া হাতে কাজও বড়-একটা ছিল না, সুতরাং সেই বৃদ্ধ মালীর সঙ্গেই বন্ধুতা পাতাইলাম ও সিকি দুয়ানির লোভ দেখাইয়া তাহাকে আমার বাংলা ঘরের এক কোণ দখল করিতে রাজী করিলাম। সন্ধ্যাবেলা ঠিকা চাকর দুইজন কাজ শেষ করিয়া যখন আমায় একলা রাখিয়া চলিয়া যাইত তখন মালী আসিয়া গল্প জুড়িয়া দিত। আমি তাহার মুখে সিপাইবিদ্রোহ, কমিশনার সাহেবের বাঘ শিকার শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িতাম। শীতকালের সন্ধ্যাটা তামাকের ধূম আর গল্পের পর গল্পে বেশ গরম থাকিত।
নিষ্কর্মা মানুষের অনেক রকম বাতিক আসিয়া জোটে; আমারও তেমনি অনেকগুলা ছোট-খাটো বাতিক দেখা দিল; তার মধ্যে লেখা বাতিকটা সর্বপ্রধান। আমি প্রথম প্রথম ছোট গল্প এবং খণ্ড কবিতা লিখিয়া মাসিকপত্রে পাঠাইতে লাগিলাম। ছোট করিয়া লেখা যে সহজ নয় এ কাণ্ডজ্ঞান তখন আমার জন্মে নাই। যাই হোক নেশা ক্রমে জমিয়া উঠিল। ডিকিনসনের দোকানে রীতিমত হিসাব খুলিয়া মাসিকপত্রের জন্য আর একটা উপন্যাস আরম্ভ করিয়া দিলাম। উপন্যাসটা যে সেই সাহি-বাগের কবর তিনটার চারিদিক বেড়িয়া বেড়িয়া গজাইয়া উঠিতেছিল তাহা আর বলিতে হইবে না। কলসের মধ্যে আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মত গল্পটা আমার তিনটি মাত্র পরিচ্ছেদের ভিতরে দিবারাত্রি খাটিয়া বেশ ফেনাইয়া তুলিতেছিলাম।
সেই সময় একদিন বাদলার পরে দারুণ শীত পড়িল,—ঘরে আর বসিয়া থাকিবার যো রহিল না। উপন্যাসটার একটা পরিশিষ্ট সেই সাহি বাগিচার কবরের উপরে বসিয়া লিখিব মনস্থ করিয়া খাতা হাতে বাহির হইলাম।
উত্তর-পশ্চিম কোণ হইতে বরফের মত তীক্ষ্ণ হাওয়া বহিতেছিল। ঘাসের উপরে মেহুদী গাছের বেড়ার গায়ে গায়ে শিশিরের জাল পড়িয়াছে। বেলা আটটা; তখনও সূর্যদেবের দর্শন নাই। বাগিচার সান্বাঁধা রাস্তায় চলিতে পা যেন হিম হইয়া গেল। আমি নিঃশব্দে গিয়া বাগিচার মধ্যে বড় কবরটায় আশ্রয় লইলাম। কবর-স্থানের দেওয়ালের একদিকে আনার ফুলের জালি দিয়া বাহিরের আলোক আসিতেছিল, আমি তাহারই কাছে বসিয়া লিখিতে লাগিলাম। দিবসের আহার সঙ্গে লইয়া ঠিকা চাকরদের ছুটি দিয়া আসিয়াছিলাম। সুতরাং বাসায় যে ফিরিতে হইবে তাহা মনেই ছিল না। লেখা শেষ করিয়া যখন উঠিয়া দাঁড়াইলাম তখন সমাধি-গৃহটা অন্ধকারে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে;— চারিদিকের দেওয়ালে নানা বর্ণের প্রস্তরে লেখা বিচিত্র লতাপাতা, কার্নিসের কোলে কোলে পাথরে খোদাই করা আল্লার স্তোত্র স্পষ্ট আর দেখা যায় না। জালির ভিতর দিয়া একটুখানি চন্দ্রালোক কবরের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে—ঠিক যেন কে সেখানে বড় বড় রূপার ফুল ছড়াইয়া গিয়াছে।
আমি বাহির হইবার জন্য দ্বারের নিকট আসিয়া দেখিলাম দ্বার বন্ধ। মালী ঠিক নিয়মিত সময়ে বাহির হইতে শিকল টানিয়া চলিয়া গিয়াছে। শীতকালে জলে পড়িলে যেমন হয়, হিম অন্ধকারের ভিতর প্রাণটা আমার তেমনই হাঁফাইয়া উঠিল। পকেট হইতে দেশলাই লইয়া একটা জ্বালাইলাম এবং তাহারই ক্ষীণ আলোকে পথ চিনিয়া যেখানে বসিয়া লিখিতেছিলাম সেইখানে আসিয়া বসিলাম। অন্ধকার কবরে চামচিকা বাদুড় এবং কে জানে আরো কাহাদের সহিত একা প্রাণী রাত কাটাইতে হইবে ভাবিয়া মন চঞ্চল হইয়া উঠিল।
আজ রাত্রিটা জাগিয়া কাটাইবার মতলব করিয়া একটার পর একটা সিগারেট ধরাইতে লাগিলাম। এভাবে কতক্ষশ কাটিয়াছিল বলিতে পারি না। হঠাৎ এক সময়ে একটা ঝন্ঝন শব্দে চমকিয়া জাগিয়া উঠিলাম। প্রথমটা কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না, ক্রমে সকল কথা মনে আসিল।
মালী খুব প্রাতে আসিয়া কবরের দরজা খুলিয়া দিত, আমি ভাবিলাম সেই বুঝি শিকল খুলিল। তাড়াতাড়ি উঠিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু পারিলাম না—হাতপা যেন অবশ হইয়া গিয়াছিল। ঘোর অন্ধকারে কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। পকেটে হাতড়াইয়া দেশলাই বাহির করিলাম, আন্দাজে আন্দাজে একটা কাঠি ঘসিলাম—খস্ করিয়া বাক্সের গায়ে শব্দ হইল কিন্তু আলোটা যেরূপ হইল তাহাতে আমি অবাক হইলাম;—দেশলাই কাঠিকে এরূপ ব্যবহার করিতে জন্মে দেখি নাই! কাঠিটার মাথায় অগ্নিশিখা নাই অথচ সমস্ত গৃহটা যেন দিনের মত স্পষ্ট দেখা যাইতে লাগিল।
আমি দেখিলাম চারিদিকে শ্বেত পাথরের দেওয়ালে লেখা বিচিত্র বর্ণের লতা, পাতা, ফুল, ফল, মণিমানিক্যের মত ঝক্মক্ করিতেছে। দিনের বেলায় কতদিন এই কবরের ভিতর বেড়াইয়া গিয়াছি কিন্তু এত কারুকার্য তো কোনদিন চোখে পড়ে নাই! দেওয়ালগুলো যেন আয়নার মত মসৃণ—কোথাও বিন্দুমাত্র ময়লা ছিল না। বোধ হইল যেন আজ প্রস্তুত করিয়াছে! এক মুহূর্তে আমার চোখের সম্মুখে মোগল শিল্পের সমস্ত গৌরব উদঘাটিত হইয়া গেল। সামান্য একটা দেশলাই কাঠি যে এরূপ কাণ্ড ঘটাইবে আমি আশা করি নাই। সোনার কাঠির স্পর্শে যেন একটা মায়ারাজ্যের দ্বার খুলিয়া গেছে মনে হইল। বাহিরে বাগিচায় গোলাপ ফুল ফুটিয়াছিল কিনা কে জানে, কিন্তু একটা মৃদু গোলাপী গন্ধ এবং জলের ফোয়ারায় একটা শীতল ঝর্ঝর সংগীত স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম। কেবলি মনে হইতে লাগিল এখনি আমার চোখের সম্মুখ হইতে অতীতের একখানা পদা সরিয়া যাইবে। আমি একটা অনাবিষ্কৃত রহস্যের এক অঙ্ক পাঠ করিবার আশায় লোলুপ চিত্তে অপেক্ষা করিয়া রহিলাম। কতক্ষণ এরূপ অবস্থায় কাটাইয়াছিলাম বলিতে পারি না। হঠাৎ এক সময়ে সমস্ত আলোক নিভিয়া গিয়া চারিদিক অন্ধকার হইয়া একটা দারুণ শীত ও সঙ্গে সঙ্গে কম্প হাড়ে হাড়ে বিঁধিতে লাগিল। আমি গায়ের লুইখানা টানিয়া মুড়ি দিলাম এবং যে অভিনয়টি দেখিবার আশা করিতেছিলাম তাহাতে নিরাশ হইয়া নিদ্রার উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। হঠাৎ আমার খাতাখানার কথা মনে পড়িল—সেটাকে উপাধান করিব বলিয়া। কিন্তু খাতা নাই! অন্ধকারে আশপাশ হাতড়াইয়া দেখিলাম খাতার চিহ্নমাত্র নাই! তখনই একটা দেশলাই জ্বালিয়া খাতার সন্ধানে উঠিলাম। এবার দেশলাইটা আর পূর্বের মত ব্যবহার করিল না—সহজভাবেই জ্বলিতে লাগিলে।
আমি যেখানে বসিয়াছিলাম তাহার এককোণে অনতিগভীর একটা শূন্য কবর ছিল, আমি সেই স্থানটায় ভাল করিয়া খুঁজিবার জন্য আলোক হাতে ঝুঁকিয়া পড়িলাম। সহসা সেই সময়ে কে যেন পশ্চাৎ হইতে আসিয়া আমাকে স্পর্শ করিল এবং চমৎকার উর্দুতে বলিয়া উঠিল—বাবুজী, এই যে তোমার কেতাব! আমার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ ছুটিয়া গেল! চিৎকার করিবার শক্তি ছিল না—কণ্ঠরোধ হইয়া গিয়াছিল। যন্ত্রচালিতের মত আমি ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। মাথার ভিতরটা ঝাঁঝাঁ করিতেছিল, চোখে ভাল দেখিতে পাইতেছিলাম না। সম্মুখে দেখিলাম অস্পষ্ট ছায়ার মত মোগলাই পাগড়ি এবং জামাজোড়া পরনে এক পুরুষমূর্তি! সে ধরনের কাপড় এবং শিরস্ত্রাণ এখন চলিত নাই কিন্তু তবু লোকটি যেন চেনাচেনা বোধ হইল। তাহার শ্মশ্রুহীন মুখে এমন একটা কমনীয়তা ও রাজভাব বিদ্যমান ছিল যে, তাহাকে দেখিয়াই আমি বুঝিলাম, ইনি কোন বড় লোক হইবেন।
পশ্চিমে অনেক দিন থাকিয়া আমার মুসলমানি আদব কায়দা ও উর্দুভাষাটায় বিলক্ষণ দখল জন্মিয়াছিল। আমি লোকটিকে রীতিমত সেলাম ও সম্ভাষণ করিয়া খাতাখানির জন্য হাত বাড়াইলাম।
লোকটি একটু হাসিয়া বলিলেন—খাতাতে কী লিখিয়াছেন পড়িয়া শুনাইতে আপত্তি আছে কি?
রাত্রি এখনো অনেক আছে—খাতা শুনাইতে আমার আপত্তি দূরে থাক, শুনাইবার লোক পাইলে বাঁচি, তবু ভদ্রতার খাতিরে বলিলাম—যদি আপনার বিরক্তি না হয়—
‘তবে আসুন’ বলিয়া লোকটি আমাকে লইয়া সেই সমাধিগৃহের পূর্বদিকের এক অংশে প্রকাণ্ড একখানা শ্বেতপাথরের চৌকির উপরে গিয়া বসিলেন। ধরিয়া ধরিয়া লেখা শুনাইয়া অনেক মানব-আত্মাকে আমি নির্ভয়ে যন্ত্রণা দিয়াছি, এবার প্রেতাত্মার সঙ্গে আলাপটা এই সূত্রে কীরূপে জমিবে সেটি একটা ভাবনার বিষয়। যাহা হউক, গল্প শুরু করিয়া দিলাম এবং যত শীঘ্র পারা যায় তিনটা পরিচ্ছেদ শেষ করিলাম। গল্পের পরিশিষ্টটাও শুনাইয়া দিবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু শ্রোতার মুখে উৎসাহের লক্ষণ বড়-একটা দেখা গেল না, সুতরাং খাতা বন্ধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম—গল্পটা আপনার কেমন লাগিল? উত্তর হইল—মন্দ নয়। কিন্তু সাহিবাগের ইতিহাসটা আপনি যেরূপ দিয়াছেন সত্য ইতিহাসটা তাহা অপেক্ষা আরও হৃদয়বিদারক এবং আমিই সেই বিয়োগান্ত নাটকের প্রধান অভিনেতা ছিলাম। তবে বলি শুনুন:
‘দিল্লীর রাজ-তক্তের ঠিক নিচেই আমার আসন ছিল। হিন্দুস্থানের বাদশাহি একদিন আমাকেই করিতে হইবে এ কল্পনাও সময়ে সময়ে করিতাম। বাদশাহি প্রথামত এক হিন্দু রাজকুমারীর সহিত আমার প্রথমে বিবাহ হয়। আমি ২১ বৎসরে ছয়-হাজারি শাসনকর্তার পদ ও হিন্দুবেগমকে লইয়া বাংলাদেশে গেলাম। সেইখানে আমাদের নব অনুরাগের মাঝখানে গোপন বিচ্ছেদের প্রথম সঞ্চার। যে মোগলকুমারী আমাদের দুই হৃদয়ের মাঝে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার রূপের সীমা ছিল না, আর যে রাজসুতাকে আমি আল্লার নাম লইয়া বরণ করিয়াছিলাম, তাঁহার গুণের স্মৃতি প্রেতলোক হইতে আজিও আমায় আকর্ষণ করিয়া আনে। বাংলাদেশে আসিয়া কেবল যে রাজ্যশাসনে ব্যস্ত নই একথা কে জানে কেমন করিয়া দিল্লীতে পৌঁছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে এই দরিয়াগঞ্জ ও তৎসন্নিহিত ভূখণ্ডের শাসনভার অনতিবিলম্বে লইবার জন্য জরুরী পরোয়ানা আমার নিকট পৌঁছিল। আমি বাধ্য হইয়া বাংলাদেশের বসন্তলীলা অসময়ে এবং অতি অশোভনরূপে অসমাপ্ত রাখিয়া সপরিবারে এই নিমগাছের দেশে চলিয়া আসিলাম। মনটা আমার যে নিমের মতনই তিক্ত হইয়া গিয়াছিল সেটা অধীনস্থ সকলে কিছুদিন ধরিয়া বেশ অনুভব করিতে থাকিল। ভাবিয়াছিলাম শাসনকার্যে আমার অতি মনোযোগ, শীঘ্রই দিল্লী দরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে এবং অচিরে পুনরায় আমাকে বাংলাদেশে নির্বাসনে যাইতে হইবে। কিন্তু যেরূপটা চাহিয়াছিলাম সেরূপটা ঘটিল না। স্থান বদলের তাগিদ না আসিয়া উল্টিয়া বরং দরিয়াগঞ্জে নৌ-সেতুটা ভাল করিয়া বাঁধিয়া গঙ্গা-যমুনার সংগম স্থলে প্রাচীন কেল্লাটাকে সুদৃঢ় ও নিজের বাসোপযোগী করিয়া লইবার জন্য তিন গাড়ি মোহর আসিয়া হাজির হইল। আমি বেশ বুঝিলাম দিল্লী হইতে আমার জন্য সোনার শৃঙ্খল আসিল এবং আমার নিজের কারাগার নিজেই প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে। বাংলাদেশ ছাড়া দুর্দমনীয় সাহাজাদাদিগের জন্য অন্য স্থানও ছিল, সেটা আমি বেশ জানিতাম। সুতরাং সেই তিন গাড়ি মোহরের জন্য দিল্লীতে একটা বিশেষ রকম ধন্যবাদ প্রেরণ করিয়া যতটা সম্ভব প্রফুল্লচিত্তে কাজে লাগিয়া গেলাম। হিন্দুবেগমের অনুরোধে যমুনা তীরে একটা হিন্দুর দেবমন্দির ঘিরিয়া আমি কেল্লা ও আমার মণি মাণিক্যে বিচিত্র অপূর্ব প্রাসাদ গাঁথিয়া তুলিলাম। সেখানে সেই গঙ্গা-যমুনার চিরমিলনের তীরে আমার বিবাহিত জীবনের দ্বিতীয় অঙ্কটা আরম্ভ করিলাম এবং সেটা যে চোখের জলে চিরবিরহের করুণ ক্রন্দনের মাঝখানে শেষ করিয়াছিলাম তার সাক্ষী এই কবর তিনটি। তারপর আমি ওই দক্ষিণ দিকের কবরটায় আমার হিন্দু বেগমকে বামদিকের ছোট গম্বুজটার নিচে আমাদের চারি বৎসরের স্নেহের ধনকে ফেলিয়া রাখিয়া দিল্লীর রাজতক্তে গিয়া বসিলাম। সেখানে ঐশ্বর্যের নেশা, রূপের লালসা কোনটাই অতৃপ্ত রহিল না। যাহার জন্য বাংলাদেশে নির্বাসনকামনা করিয়াছিলাম; সেই মোগলকন্যাকে একদিন সুতীক্ষ্ণ ছুরির বিদ্যুদ্দাম করাল রুধির বর্ষার অভিসার রজনীতে হিন্দুস্থানের অধীশ্বরীরূপে বাদশাহি তক্তে আমার পাশে আনিয়া বসাইলাম। তারপরে অভাবনীয় ভোগ এবং পিতৃদ্রোহী ভ্রাতৃহন্তা, সন্তানগণের হাতে মর্মান্তিক শোক ও যন্ত্রণার মাঝে জীবনের আমার তৃতীয় অঙ্কটা হঠাৎ একদিন শেষ করিলাম। এই যে মাঝের কবরটা দেখিতেছ এটা আমি নিজের জন্য প্রস্তুত করিয়াছিলাম। কিন্তু কে জানে, কেন তাহারা আমাকে এখানে আনিল না। লাহোরের আনারবাগে আমায় নিয়া সেই রূপবতী মোগলকুমারীর পাশে রাখিয়াছে, আর আমার প্রেতাত্মা এই সাহিবাগের শূন্য কবরটায় স্থানলাভ করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। গঙ্গা যমুনার চিরমিলনের মাঝে যেমন রেখামাত্র ব্যবধান কিছুতে মুছিবার নয়, আমি তেমনি মোগল সম্রাট আর আমার হিন্দুবেগম যমুনার দুই জনের মাঝে শূন্য কবরের বিচ্ছেদ চিরদিন অপূর্ণ রহিয়া গেছে! ওই ঘোড়া আসিয়াছে, আমি তবে চলিলাম, আপনি বিশ্রাম করুন।’
আমি কী একটা বলিতে যাইতেছিলাম, হঠাৎ বিজাতীয় ভাষায় Well, good morning শুনিয়া চমকিয়া দেখিলাম ঘোড়ায় চড়িবার সাজ পরিয়া দারাগঞ্জের ডাক্তার সাহেব। ইনি মাঝে মাঝে সকালবেলা অশ্বারোহণে সাহি-বাগিচায় বেড়াইতে আসিতেন।