গঙ্গার ধারে চৌধুরী বাড়ি
আমাদের ক্লাবে ক্রিকেট খেলায় একটা বেশ শক্ত নিয়ম ছিল৷ মাঠটা তেমন বড় নয়, তার আবার একপাশে গঙ্গা৷ আশেপাশে অনেক নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে, ফাঁকা জায়গা ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷
তবু আমাদের সবুজ সঙ্ঘের মাঠটা কোনোরকমে আটকে রেখেছি৷ এখানে বাড়ি-ঘর বানাতে দেওয়া হবে না৷ একবার কারা যেন এখানে কয়েকটা দোকানঘর তৈরি করতে চেয়েছিল, আমরা হৈ-হৈ করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছি৷
এই ক্লাবটা আগে ছিল আমাদের বাবা-কাকা আর তাঁদের বয়েসিদের৷ এখন এটা আমাদের৷ হারুকাকা প্রায়ই আমাদের বলেন, দেখিস যেন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে ক্লাবটা তুলে দিস না৷ তাহলেই মাঠটা চলে যাবে৷
আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হয় বটে, কিন্তু খুব বেশি না৷ আমরা সবাই ক্লাবটাকে ভালোবাসি৷
সারা বছরই এখানে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল কিংবা ব্যাডমিন্টন খেলা হয়৷ একপাশে একটা ছোট টালির ঘরও আছে, খুব বর্ষার সময় সেটার মধ্যে বসে খেলা হয় পিং পিং আর ক্যারাম৷ আমাদের একটা ছোট লাইব্রেরিও আছে৷
ক্রিকেট খেলার সময় মুশকিল হয় এই, ব্যাটসম্যান কোনো বল জোরে হাঁকড়ালেই বলটা এদিক-ওদিক চলে যায়৷ অনেক সময় বলটা আর পাওয়াই যায় না৷ তাই নিয়ম করা হয়েছে, যে বাউন্ডারি কিংবা ওভার বাউন্ডারি মারবে, বলটা তাকেই খুঁজে আনতে হবে৷ যদি না আনতে পারে, তাহলে সে আউট তো হবেই, বলের দামও দিতে হবে তাকে৷
সেই জন্য প্রায় সবাই ঠুক ঠুক করে মেরে এক-দু’ রান নেয়৷ কিন্তু বাউন্ডারি- ওভার বাউন্ডারি ছাড়া কি খেলা জমে!
গঙ্গায় পড়ে যে ক’টা বল গোল্লায় গেছে, তার ঠিক নেই৷
আমরা সবাই সাঁতার জানি, এই গঙ্গাতেই সাঁতার শিখেছি৷ কিন্তু গঙ্গায় বল পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা উদ্ধার করার আগেই সেটা স্রোতে ভেসে যায়৷
ক্লাব ঘরের পেছন দিকে কিংবা মাঠের ডান পাশের নতুন বাড়িগুলোর দিকে বলটা পড়লে তবু খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু বাঁ পাশে কেউ বল পাঠাই না৷
বাঁ পাশে টানা উঁচু দেওয়াল, তার ওপাশে পুরোনো একটা বাড়ি৷ সবাই বলে চৌধুরী বাড়ি৷ এককালে এই চৌধুরীরা নাকি বড় জমিদার ছিল, এই সবুজ সঙ্ঘের মাঠটা তাঁরাই দান করেছেন, ক্লাব ঘরটাও বানিয়ে দিয়েছিলেন৷
এখন ওই চৌধুরী বাড়িতে যে কারা থাকে তা বোঝাই যায় না৷ অনেকেই চলে গেছে কলকাতায়, কেউ কেউ বিলেত-আমেরিকায়৷ একজন বুড়োবাবু নাকি এখনো রয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁকে আমরা কখনো দেখিনি৷ মর্চে পড়া লোহার গেটের সামনে বসে থাকে একজন পাহাড়ি দারোয়ান, মাঝে মাঝে একটা গাড়ি সেই গেট দিয়ে বেরোয়, সে গাড়ির কাচগুলো কালো৷
মাঝে মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে শোনা যায় একটা হিংস্র কুকুরের ডাক৷ সে কুকুরটাও কখনো বাইরে বেরোয় না, তবে মাঝে মাঝে সে-বাড়ির ছাদে কুকুরটাকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখা যায়৷
আমাদের খেলার সময় ক্রিকেট বল যদি বাঁ দিকের পাঁচিল পেরিয়ে কখনো ওই চৌধুরী বাড়ির মধ্যে পড়ে, তবে আর সেটা ফেরত পাবার আশা থাকে না৷
আমাদের দলে বাপ্পাই ছিল সবচেয়ে আনাড়ি খেলোয়াড়৷ কয়েকমাস আগে ও এসেছে কলকাতা থেকে৷ ওর বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে চন্দননগরে এসেছেন, বাপ্পাও ভর্তি হয়েছে আমাদের স্কুলের ক্লাস নাইনে৷
বাপ্পা বল করতে পারে না, ব্যাট হাতে দাঁড়ালে গোল্লা খায়৷ কোনো দিন যদি চার-পাঁচ রান করে, তাতেই সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়৷ অথচ বাপ্পার খেলার খুব আগ্রহ৷
আমাদের উইকেট কিপার প্রশান্ত দিল্লি চলে যাওয়ায় সেই জায়গায় নামানো হল বাপ্পাকে৷ সেটা বাপ্পা মোটামুটি চালিয়ে দিল৷ সব ক্যাচ ধরতে না পারলেও বুক দিয়ে কিংবা হেড মেরে বল আটকে দেয়!
কিন্তু উইকেট কিপারকে তো ব্যাট করতেও হয়৷ যখন আর পনেরো-কুড়ি রান করলেই জেতা যায়, তখন উইকেট কিপারের কাছ থেকে এই কটা রান আশা করা যায় না? কিংবা আমাদের টিমের ক্যাপ্টেন রণজয়দা যখন পঁচানব্বই করেছে, ওদিকে নাইনথ উইকেটে বাপ্পা ছাড়া আর কোনো পার্টনার নেই, তখন বাপ্পা কোনোক্রমে টিঁকে থাকতে পারলেই রণজয়দার সেঞ্চুরিটা হয়ে যায়৷ আমরা সবাই বলছি, বাপ্পা, ঠুকঠাক করে যা, কোনোরকমে এক রান নিয়ে এদিকে চলে এসে রণজয়দাকে মারতে দে!
কিন্তু বাপ্পা আনতাবড়ি এমন জোর ব্যাট হাঁকড়াল যে বল গিয়ে পড়ল গঙ্গায়৷ ব্যস, খেলা বন্ধ!
আর একটা বল জোগাড় করে যদিও বা খেলা শুরু হল একটু পরে, কিন্তু পরের বলেই বাপ্পা আউট৷ একেবারে বোলড!
অনেকেই এখন বাপ্পাকে খেলা থেকে বাদ দিতে চায়, কিন্তু বাপ্পা খুব কাকুতি-মিনতি করে৷ প্রত্যেকবার একটা কিছু গন্ডগোল করেই ও রণজয়দার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলে, এর পরের বার ঠিকঠাক খেলব, দেখবেন!
এর মধ্যে বাপ্পাকে পাঁচবার বলের দাম দিতে হয়েছে৷
আমরা বাঁ দিকের চৌধুরী বাড়ির দিকে কখনো জোরে বল মারি না৷ উঁচু পাঁচিল বলে সেদিকে বল তেমন বাইরেও যায় না৷ একদিন বাপ্পা হঠাৎ দারুণ উৎসাহ পেয়ে পর পর দুটো ওভার বাউন্ডারি মেরে বসল৷ দুটো বলই উঁচু পাঁচিল পেরিয়ে চৌধুরী বাড়ির মধ্যে৷
আমাদের ক্লাবে দুটোর বেশি বল থাকে না৷ খেলা তো বন্ধ হলই, রণজয়দা দারুণ রেগে গিয়ে বাপ্পাকে বললেন, কালকের মধ্যে তোকে চারটে বল কিনে আনতে হবে, নইলে তোকে সাসপেন্ড করা হবে তিন মাসের জন্য! আমি নিজেই উইকেট কিপার হব!
দুটোর বদলে চারটে বল৷ অনেক টাকা দাম!
খেলা বন্ধ, বিকেলও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ক্লাবের অনেক ছেলেই বাড়ি ফিরে গেল৷ শুধু বাপ্পা করুণ মুখ করে বসে রইল গঙ্গার ধারে৷
বাপ্পাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি৷ রোজ দুজনে একসঙ্গেই ফিরি৷ একসময় ওর কাছে গিয়ে বললুম, কী রে, বাড়ি যাবি না?
বাপ্পা বলল, একটু পরে যাব৷ নীলু, তুই আমার পাশে একটু বসবি?
আমাকে ঠিক সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়, না হলেই বাবার কাছে বকুনি৷
এখন প্রায় সাড়ে ছ’টা বাজে, আরও পনেরো-কুড়ি মিনিট বসা যেতে পারে৷
বাপ্পা বলল, হ্যাঁ রে, নীলু, আমার দ্বারা ক্রিকেট খেলা হবে না, তাই না?
আমি বললুম, তুই তো আগে কখনো খেলিসনি! তোর কবজিতে ঠিক মোচড় লাগছে না৷ ওটা শিখতে অনেকদিন সময় লাগে৷
বাপ্পা জিজ্ঞেস করল, আমি কি শিখতে পারব?
ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললুম, হ্যাঁ, পারবি না কেন? অনেক প্র্যাকটিস করতে হবে৷ বাড়ির উঠোনেও প্র্যাকটিস করতে পারিস৷
এবার বাপ্পা জিজ্ঞেস করল, এই চৌধুরী বাড়িটায় কি বাঘ-ভাল্লুক থাকে? কিংবা ভূত বা দৈত্য? ও-বাড়িতে বল পড়লে ফেরত আনা যায় না কেন?
আমি বললুম, আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি৷ গেটে একটা দারোয়ান আছে, সে কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেয় না৷ একবার তো রণজয়দা ঠিক করেছিল, সবাই মিলে দারোয়ানটাকে সরিয়ে দিয়ে জোর করে ঢুকব৷ কিন্তু হারুকাকা বললেন, ছিঃ, ওসব করো না৷ চৌধুরীরা আমাদের ক্লাবের জমি দিয়েছেন, ওঁদের সঙ্গে ঝগড়া করা উচিত নয়৷ ওদিকে বল না মারলেই হয়!
বাপ্পা বলল, গেট দিয়ে ছাড়া অন্য কোনো দিক দিয়ে এ বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায় না?
—এত উঁচু পাঁচিল৷
—পাঁচিলটা গঙ্গার ধারে শেষ হয়ে গেছে৷ আমি একদিন সাঁতার কাটতে কাটতে দেখেছিলাম, গঙ্গার দিকে পাঁচিল নেই৷ ওদিকে শুধু ঘাট রয়েছে৷ ওই ঘাট দিয়ে তো বাড়ির মধ্যে ঢোকা যায়৷
—বাড়িটার মধ্যে মস্ত বড় একটা কুকুর আছে৷
—তুই কুকুরকে ভয় পাস? দ্যাখ নীলু, চারটে বল কেনার পয়সা আমি জোগাড় করতে পারব না৷ আমি ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকব, বল দুটো খুঁজে আনব৷ তুই আমার সঙ্গে যাবি?
—না৷
—যাবি না?
—না, ভাই৷ আমাকে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে৷ তা ছাড়া আমি কুকুরকে ভয় পাই!
—ঠিক আছে, তাহলে আমি একাই যাব৷
বাপ্পা উঠে দাঁড়িয়ে ওর প্যান্ট গুটিয়ে নিল হাঁটু পর্যন্ত৷
হঠাৎ সন্ধে হয়ে গেছে, আকাশ অন্ধকার৷ এই সময় আমাদের ক্লাবের মাঠে কেউ থাকে না৷
বাপ্পা নেমে পড়ল জলে৷ তারপর পাঁচিলটার পাশ দিয়ে চলে গেল অন্যদিকে৷
আমার তো এখন ফিরে যাওয়া উচিত৷ কিন্তু কিছুতেই যেতে পারছি না৷ বাপ্পা একটা বিপদের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে, ওকে ফেলে আমি যাই কী করে?
একজন কেউ দুঃসাহস দেখালে অন্যরাও সাহসী হয়ে ওঠে৷
শুধু কুকুরের ভয় নয়, আমার একটু একটু ভূতের ভয়ও আছে৷ এই চৌধুরী বাড়ির মতন পুরোনো বাড়ি রাত্তিরবেলা দেখলেই গা ছমছম করে৷ বন্ধুরা আমাকে বলে ভীতুর ডিম!
তবু আমি নেমে পড়লুম জলে৷
এই সময় গঙ্গায় বেশ স্রোত৷ আমার ডুবে যাওয়ার ভয় নেই, কিন্তু টাল সামলাতে না পারলে জামা-টামা ভিজে যেতে পারে৷
বাপ্পা এর মধ্যে চৌধুরী বাড়ির ঘাটের কাছে পৌঁছে গেছে৷ একসময় এটা ছিল এ বাড়ির নিজস্ব ঘাট, এখন ভাঙা-চুরো অবস্থা৷ অনেকদিন এ ঘাট দিয়ে কেউ নামে না, বোঝাই যায়৷ আগাছা আর শ্যাওলায় ভরে গেছে৷
বাপ্পা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ঘাটের কাছে৷
বাড়িটার সব ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ৷ কোথাও আলো জ্বলছে না৷ এক দিকের একটা বারান্দা ভেঙে গিয়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে, যে-কোনো সময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে৷
মনে হয় যেন এ বাড়িতে কোনো জন-মনুষ্য নেই৷ কিন্তু শুনেছি একজন বুড়োবাবু থাকেন৷ মাঝে মাঝে গাড়িতে চেপে বাইরে যান৷ অন্য সময় তিনি দরজা-জানলা বন্ধ করে ভেতরে একলা থাকেন কেন?
কাছে গিয়ে বললুম, বাপ্পা, চল, ফিরে চল৷ এ বাড়ির মধ্যে কেউ ঢোকে না৷
বাপ্পা খানিকটা অভিমানের সঙ্গে বলল, তুই এলি কেন? তুই বাড়ি যা৷ ভালো ছেলের মতন পড়তে বোস গিয়ে৷ আমি ভেতরে যাবই৷
বাপ্পা সিঁড়ির কয়েক ধাপ ওপরে উঠে গেল৷
ঘাটের দিকের দরজাও বন্ধ৷ তবে পাঁচিলের পাশ দিয়ে একটা সরু গলি আছে৷ বল দুটো নিশ্চয়ই ওখানেই পড়েছে৷
বাড়িতে যখন কারুর সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন বল দুটো চট করে খুঁজে নিয়ে কেটে পড়লেই তো হয়৷
আমিও ঘাট দিয়ে উঠে এসে খুঁজতে লাগলুম বল দুটো৷
যদিও জায়গাটা বেশ অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু আমরা দু’জনে মিলে পা ঘষটে ঘষটে পুরো গলিটা দেখলুম, বল থাকলে আমাদের পায়ে তো লাগতই৷
একটাও বল সেখানে নেই৷
তাহলে বল কোথায় গেল?
বাপ্পা ফিসফিস করে বলল, ছাদে পড়তে পারে৷ দ্যাখ, দোতলায় একটা ছোটো ছাদ আছে৷
আমি বললুম, তা হলে তো আর আশা নেই৷ ছাদে তো আর ওঠা যাবে না!
বাপ্পা বলল, এতদূর এসে ফিরে যাব?
—তা ছাড়া আর কী করবি? সব দরজা বন্ধ৷
—জলের পাইপ বেয়ে উঠতে পারবি?
—মাথা খারাপ! ধপাস করে যদি পড়ে যাই!
—তা হলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক, নীলু৷ আমি ছাদটা একবার খুঁজে আসি৷
—বাপ্পা, ছাদটায় যদি কুকুরটা থাকে?
—কুকুর থাকলে এতক্ষণ ডাকাডাকি করত না? আমার মনে হয়, বুড়োবাবু কুকুরটা নিয়ে বেরিয়ে গেছেন৷ কোথাও একটুও আওয়াজ নেই৷
বাপ্পা জলের পাইপ বেয়ে উঠতে লাগল৷
হঠাৎ সেই আবছা অন্ধকারের মধ্যেও চোখে পড়ল একটা লোহার ঘোরানো সিঁড়ি৷
আগেকার দিনে অনেক বাড়িতে এরকম সিঁড়ি থাকত বাড়ির পেছন দিকে, মেথরদের ওপরে ওঠার জন্য৷
সেই সিঁড়ি দিয়ে আমিও পৌঁছে গেলুম দোতলার ছোট ছাদে৷
এখান থেকে গঙ্গা দেখা যায়, আমাদের ক্লাবের মাঠটাও পুরোটা দেখা যায়৷ কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে কেউ কোনোদিন আমাদের ক্রিকেট খেলা দেখেনি৷
এ ছাদটা ছোট, ওপরের তলায় আর একটা ছাদ আছে৷
এখানেও বল দুটো নেই৷ দুজনে দু’দিক দিয়ে কয়েকবার খুঁজেও কোনো লাভ হল না৷ বল দুটো একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি?
ভেতর দিকে একটা দরজা আছে, সেটা বন্ধ৷
কিন্তু একটু জোরে ঠেলতেই খুলে গেল দরজাটা৷
ভেতরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ সেদিকে তাকিয়েই আমার দারুণ ভয় লেগে গেল৷ এই অন্ধকারের মধ্যে কী রহস্যময় ব্যাপার আছে কে জানে৷
আমি বাপ্পার জামা টেনে ধরে বললুম, চল, এবার ফিরে যাই৷
বাপ্পা বলল, না, আমি একবার ওপরের ছাদটা দেখে আসব৷ বল যাবে কোথায়?
আমি বললুম, অন্ধকারে ওপরের সিঁড়ি খুঁজে পাবি কী করে?
বাপ্পা বলল, ঠিক পেয়ে যাব৷
তবু আমি বললুম, বাপ্পা, বাড়ির মধ্যে ঢুকে…যদি আমরা ধরা পড়ে যাই…
বাপ্পা জোর দিয়ে বলল, তুই ফিরে যা নীলু! আমি শেষ পর্যন্ত দেখবই!
বাপ্পা ভেতরে ঢুকে পড়তেই আমাকেও সঙ্গে যেতে হল৷ আমি কিছুতেই ফিরতে পারছি না৷ বাড়িতে গেলে খুব বকুনি খেতে হবে, তাও মনে পড়ছে৷ তবু বাপ্পা যেন আমাকে চুম্বকের মতন টানছে৷
এবারে কেমন যেন একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ কিসের শব্দ বোঝা গেল না, কিন্তু গা-টা ছমছম করে উঠল৷
অন্ধের মতন এক পা এক পা করে এগোচ্ছি৷ হঠাৎ কোনো চেয়ার বা টুলে ধাক্কা খেলুম আমি, সেটা জোর শব্দ করে পড়ে গেল মাটিতে৷
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুট করে সুইচের শব্দ হয়ে আলো জ্বলে উঠল৷
সেই আলোতে সামনের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠল বুক৷
একটু দূরে, একটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন লম্বা মতন মানুষ৷ কালো আলখাল্লা পরা, ধপধপে সাদা চুল, সেইরকমই সাদা দাড়ি৷ চোখ দুটো এত কোটরে ঢোকা যে প্রায় দেখাই যায় না৷
মানুষ, না অন্য কিছু?
আমি পেছন ফিরে পালাবার চেষ্টা করতেই সে খনখনে গলায় বলে উঠল, যাচ্ছিস কোথায়? দাঁড়া৷ নইলে গুলি করব!
এবার দেখি, সেই বৃদ্ধের হাতে একটা দো-নলা বন্দুক৷
বন্দুকটা তুলে তাক করে বৃদ্ধটি আবার বললেন, চুরি করতে এসেছিস? অ্যাঁ? আমি কি মরে গেছি? এবার তোরা মরবি!
এবারে বাপ্পাও ভয় পেয়ে গেছে৷ সে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, না, না, আমরা চোর নই, চোর নই৷ আমরা স্কুলে পড়ি৷
আমি বললুম, আমরা পাশের সবুজ সঙ্ঘের মেম্বার৷
বৃদ্ধ বন্দুকটা উঁচিয়ে রেখেই বললেন, পরের বাড়িতে না বলে কারা ঢোকে? তাদেরই তো চোর বলে!
বাপ্পা বলল, আমরা ক্রিকেট বল খুঁজতে এসেছি৷ আপনার বাড়িতে আমাদের অনেক বল হারিয়ে যায়৷
বৃদ্ধ বললেন, বল খুঁজতে আসো তো সামনের গেট দিয়ে কেন আসো না?
বাপ্পা বলল, আপনার দারোয়ান ঢুকতে দেয় না৷
বৃদ্ধ বললেন, আমি একা থাকি৷ যাকে-তাকে ঢুকতে দেবেই বা কেন?
বাপ্পা বলল, তা হলে আমরা কী করব? দামি দামি বল—
বৃদ্ধ বললেন, তোমরা একটু দাঁড়াও, বেশিক্ষণ আমার চোখে চড়া আলো সহ্য হয় না৷
তিনি সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলেন৷ আবার অন্ধকার৷ আমরা আবার শুনতে পেলুম সেই ফোঁস ফোঁস শব্দ৷
বৃদ্ধ আর একটা সুইচ টিপলেন৷ এবারে জ্বলে উঠল হালকা নীল আলো৷ তাতে বৃদ্ধকে আরও অস্পষ্ট দেখাচ্ছে৷
হাতে এখনো বন্দুকটা ধরা, তিনি বললেন, কাছে এগিয়ে এসো৷
বৃদ্ধের মতিগতি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ বন্দুকের সামনে এগোতে বুক ঢিপ ঢিপ করবে না? কিন্তু উপায়ও তো নেই৷
বৃদ্ধ বললেন, বুড়ো হয়েছি, কিন্তু আমার হাতের টিপ খুব ভালো৷ একবার একটা চোরকে এক গুলিতে মেরে ফেলেছিলাম৷ তোমরা কোন সাহসে ঢুকলে?
বাপ্পা বলল, ঠাকুর্দা, আমরা তো চোর নই!
বৃদ্ধ এবার হি হি করে হেসে বললেন, ঠাকুর্দা? আমি আবার তোমাদের ঠাকুর্দা হলাম কবে থেকে? আমার নিজের নাতি-নাতনিরা কেউ আর আমার খোঁজ নিতে আসে না৷ আমি একদিন মরে যাব তারপর এ বাড়িটাও শেষ হয়ে যাবে৷
তারপর তিনি বাপ্পাকে বললেন, বল নেবে? ওইখান থেকে নিতে পারবে? দেখি তোমার কত সাহস?
তিনি পাশের ঘরের দিকে আঙুল দেখালেন৷
বারান্দার নীল আলোই ঘরের মধ্যে খানিকটা পড়েছে৷ তাতে দেখা গেল, দরজার কাছেই চেন দিয়ে বাঁধা আছে একটা বিশাল কুকুর৷ সে-ই ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে৷
সেই কুকুরটার মুখের সামনে পড়ে আছে আমাদের দুটো বল৷
বৃদ্ধ বললেন, আমার কুকুরটাই তোমাদের বল নিয়ে খেলা করে৷ দেখ যদি ওর কাছ থেকে বল নিতে পারো!
কুকুরের মুখের গ্রাস থেকে বল নেওয়া যায়? হাত বাড়ালেই তো ঘ্যাঁক করে কামড়ে দেবে৷ আমরা ওর অচেনা৷
কুকুরটা বাঁধা না থাকলে বোধহয় এতক্ষণ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত৷ আশ্চর্য, কুকুরটা কিন্তু ডাকছে না একবারও৷
বাপ্পা কুকুরটার দিকে এগোতে যেতেই আমি ওর হাত টেনে ধরলুম৷
বাপ্পা ঝট করে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিল৷ তারপর মুখ দিয়ে আঃ আঃ শব্দ করতে-করতে এগোতে লাগল একটু একটু৷
কুকুরটা জ্বলজ্বল করে দেখছে৷ একেবারে কাছে গিয়ে বাপ্পা বসে পড়ল ওর সামনে৷ তারপর ওর মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে লাগল৷ কুকুরটা ডাকলও না, কামড়াবার চেষ্টাও করল না৷
বৃদ্ধ বললেন, সাবাশ! সত্যিই তোমার সাহস আছে দেখছি৷
বাপ্পা বলল, কুকুররা মানুষ চেনে৷ ও ঠিক বুঝতে পেরেছে, আমি চোর নই৷ আমাদের বাড়িতে আগে দুটো অ্যালসেশিয়ান ছিল৷ এই কুকুরটা নিশ্চয়ই আমার গায়ে সেই গন্ধ পেয়েছে৷
বৃদ্ধ বললেন, আমার বাঘা আমারই মতন বুড়ো হয়ে গেছে৷ ওর বয়েস ঠিক আমার সমান৷ আমরা কে আগে মরব জানি না৷
বাপ্পা বল দুটো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল৷
আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল৷ বাববাঃ! সত্যি সাহস আছে বটে বাপ্পাটার!
বৃদ্ধ বললেন, এর পরে বল খুঁজতে হলে সামনের গেট দিয়ে আসবে৷ আমি দারোয়ানকে বলে রাখব৷
বাপ্পা বলল, দাদু, তা হলে আমরা যাই?
বৃদ্ধ বললেন, যাবে? আগেকার দিনে চৌধুরী বাড়িতে কেউ এলে কিছু না কিছু খেতে দেওয়া হত৷ এখন তো কিছু নেই৷ কে-ই বা দেবে৷
তিনি একটা ড্রয়ার খুলে কী সব ঘাঁটাঘাঁটি করতে-করতে একটা মাউথ-অর্গান বার করে বাপ্পাকে বললেন, তুমি এটা নাও৷ দেখো তো বাজে কিনা!
বাপ্পা সেটা মুখে দিতেই প্যাঁ করে আওয়াজ হল৷
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও তো একটা কিছু দিতে হয়৷
এবার তিনি ড্রয়ার থেকে বার করলেন একটা পেন৷
আমি বললুম, না, না, আমার লাগবে না৷
বৃদ্ধ বললেন, তোমার লাগবে কি লাগবে না তা আমি জানি না৷ কিন্তু আমার তো কিছু দেওয়া উচিত৷
পেনটা তিনি আমার হাতে গুঁজে দিলেন৷
তারপর বহু বছর কেটে গেছে৷ সেই চৌধুরী বাড়ি ভেঙে এখন নতুন বাড়ি উঠেছে, সবুজ সঙ্ঘ ক্লাবটাও আর নেই৷
আমি কিংবা বাপ্পা কেউই ক্রিকেট খেলোয়াড় হইনি৷ কলকাতায় কলেজে পড়তে এসে আর ক্রিকেট খেলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকেনি৷
বাপ্পা মাউথ অর্গানটা নিয়ে দিনকতক প্যাঁ পোঁ করতে-করতে ভালো বাজাতে শিখে গেল৷ তারপর তার খুব ঝোঁক হল গান-বাজনার দিকে৷ এখন বিখ্যাত গায়ক হিসেবে বাপ্পাদিত্য বর্মনের নাম সবাই জানে৷
চৌধুরীবাবুর দেওয়া কলমটা আমার কাছে এখনো আছে৷ সেই কলমে আমি প্রথম কবিতা লিখি৷ তারপর সারা জীবন ধরে লিখেই চলেছি৷
—