ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

খ্যাঁকশিয়াল

খ্যাঁকশিয়াল

সকালে উঠিয়া আমি মনে-মনে বলি, সুর করেই বলি, আর কতকাল, আর কতদিন? এখনও পাক্কা কুড়িটা বছর একই ভাবে টেনে যেতে হবে। এমন জানলে কে জন্মাত। অবশ্য জন্মের ওপর আমার কোনও হাত নেই। কেউ কারুর ইচ্ছেতে জন্মায় না। জন্ম একটা রহস্য। এ রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। এটার সঙ্গে ওটা মিলে কী একটা হয়, এইটুকু বেশ পরিষ্কার; কিন্তু আমি লাখোপতির ঘরে না হয়ে কেন মধ্যবিত্তের ঘরে হ্যাংলামি করতে এলুম সেইটুকু অপরিষ্কার। তখনই আসে ভাগ্যের কথা, পুনর্জন্মের কথা। রহস্য তখন আরও জটিল।

মাঝে মধ্যে ভাবতে বসি, আমি কে? আমাকে আমি ছাড়া কে আর ভালো করে জানবে। দেহের খোলে কোন বস্তুটি ঢুকে বসে আছে একটু খোঁচাখুঁচি করে দেখতে ইচ্ছে করে। তিনি নিজে কোনওদিনই ধরা দেবেন না। তিনি হাবা এবং কালা। কিন্তু বেশ খেলোয়াড়। ‘কে খেলায় আমি খেলিবা কেন? জাগিয়ে ঘুমাই অঘোরে যেন।’ এ প্রশ্ন সব ভাবুক মানুষই জীবনের কোনও না কোনও সময় করে থাকেন। প্রশ্ন আছে উত্তর নেই। এই উত্তরটাই আমাকে জানতে হবে।

অনুমান বলে একটা প্রক্রিয়া আছে। এ জন্মের ব্যাপারস্যাপার দেখে পূর্বজন্ম সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা। পূর্বজন্মে আমি এক হাতুড়ে ডাক্তার ছিলাম। অর্থলোভী। অনেকটা হায়নার মতো। টাকার লোভে এলোপাথাড়ি চিকিৎসা করে বহু মানুষের সর্বনাশ করেছিলুম। তার ফলে, কিংবা সেই পাপে এ জন্মে আমার শরীরে সমস্ত কলকব্জা বেগোড়বাঁই। হার্টের পাম্প ঠিকমতো চলে না। ফুসফুসের তেমন জোর নেই। লিভার দুর্বল। দৃষ্টি ক্ষীণ। মাথা জোড়া টাক। গায়ের চামড়া খসখসে। গ্রীষ্মের ঘামাচি। চব্বিশ ঘণ্টা খেঁসোর খেঁসোর চুলকানি। হাত পা কাঁপে। আবহাওয়ার সামান্য উনিশ বিশে ফ্যাঁচোর-ফ্যাঁচোর হাঁচি। বদহজম। ঊর্ধ্ববায়ু। অম্বল। পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল ভুগছি এ জন্মে। শরীরে নোনা ধরে গেছে। নিত্য ডাক্তার, নিত্য ওষুধ। গত জন্মে আমি কান মলে নিয়েছি এ জন্মে আমার কান মলে নিয়ে যাচ্ছে।

গতবারে শেষ জীবনে আমি একটা বাড়ি করেছিলুম। জায়গাটা ছিল আমার এক রুগির। তাকে মেরে, বিধবাকে ফাঁকি দিয়ে সম্পত্তিটা হাতিয়েছিলুম। বাড়িটাও মন্দ করিনি। ফাঁকি দিয়েই করেছিলুম। ইট, চুন, বালি, সুরকি, সিমেন্ট, লোহা যেখান থেকে যা কিনেছিলুম, সব ধারে। আজ দোব, কাল দোব করে পরপারে চলে গেলুম। পাওনাদারদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেবারে পালালে কী হবে, এবারে ধরা পড়ে গেছি। রোজগারের টাকা জমিয়ে-জমিয়ে, না খেয়ে না দেয়ে একটি বাড়ি শুরু করেছিলুম। প্রথমে জমিতেই চোট। কে জানত পুকুর বোজানো, ঘেঁস ফেলা জমি।

কনট্রাক্টার বললেন, ‘নিন মশাই এবার ম্যাও সামলান। ওই দেখুন খুঁড়ে রেখেছি। ভিত গাড়তেই দেউলে হয়ে যাবেন। লোহার খাঁচা করে, সিমেন্টের শ্রাদ্ধ করে কংক্রিট ঢালাই মেরে গাঁথনি তুলতে হবে।’ হয়ে গেল, নাচতে নেমে তো আর ঘোমটা দেওয়া চলে না। এস্টিমেট ফেস্টিমেট মাথায় উঠে গেল। স্ত্রীর গয়না বেচে বাড়ি মাটি ছেড়ে হাত চারেক উঠেই থেমে গেল। রেস্ত ফাঁক। কনট্রাক্টার মেরে হাওয়া হয়ে। সে যুগে আর এ যুগে আকাশ জমিন ফারাক । এখন লেবার ক্লাস শ্লাই ফকসের মতো সেয়ানা। দ্যাখ তো না দ্যাখ। আমার ফাঁদা বাড়িতে আগাছার জঙ্গল গজিয়েছে। যেটা বসার ঘর হবার কথা ছিল, সেখানে আসশেওড়া। শোবার ঘরে শেয়ালকাঁটা। রান্না ঘরে গাব ভেরেন্ডা। যেমন বোট্যানির মিউজিয়াম রে!

এখন মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে সস্ত্রীক সেই অর্ধসমাপ্ত বাড়িতে হাওয়া গাড়ি চেপে বেড়াতে যাই। শিশুর মাড়িতে সদ্য যেন দাঁত উঠেছে। জমি থেকে অল্প মাথা তুলেই থেমে পড়েছে সাধের ইমারত। ঝোপ জঙ্গলে সর্পাঘাতের ভয় উপেক্ষা করে আমরা দুজনে সেই ভিটেয় দাঁড়িয়ে কল্পনার চোখে দেখি কোথায় কী হতে পারে। ড্রইংরুম? ওই সব সারি-সারি সোফা, সেন্টার টেবল? একটা বুক কেস? চৌকো এক টুকরো কার্পেট? মাথার ওপর এখন যেখানে আকাশ, সেখানে থাকত সিলিং। সাদা, পংখের কাজ করা। সেই সিলিং থেকে ঝুলবে সুদৃশ্য ঝাড়। অনেক দিনের শখ ঝাড়বাতির তলায় আরাম কেদারায় আরাম করে বসে প্রেমের গল্প পড়ব, জমিদারদের কাহিনি পড়ব। আর ওই যেখানটায় ভাঁট ফুলের জঙ্গল হয়েছে, ওই জায়গাটা পরিষ্কার করলেই আমাদের বেডরুম। এখন সবটাই জানালা, কারণ দেয়াল ওঠেনি। দেয়াল যদি উঠাতে পারতুম তা হলে চারপাশে বড়-বড় জানালা হত। দুটো দরজা থাকত, একটা ড্রয়িংরুমের দিকে আর একটা প্যাসেজের দিকে। বাহারি পর্দা ঝুলত। ইংলিশ টাইপ সিংগল খাট। দুটো জুড়ে ডবল। রাজস্থানী চাদর পাতা। ঘোড়া ছুটছে, হাতি ছুটছে, রাজস্থানী বীর লাইন দিয়ে চলেছে। চার দেয়ালে চার রকমের হালকা রঙ। কর্নার টেবিলে ফুলদানি। ফুলদানিতে রজনিগন্ধা। সবশেষে সন্ধ্যা যখন প্রায় নেমে আসে তখন আমার স্ত্রী ফোঁস করে একটি দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বলে, আর এইখানটায় পোঁতা আছে আমার বারো গাছা সোনার চুড়ি, বিছে হার, এক জোড়া দুল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আদর করে সহধর্মিণীর কাঁধে হাত রেখে বলি, ভালোই তো, ভালোই তো। অঙ্গে রাখলে ছিনতাই, গৃহে রাখলে ডাকাতি। প্রাচীন প্রথাই ছিল মূল্যবান যা কিছু মাটিতে পুঁতে গুপ্তধন করে রাখা। মনে করো তোমার স্বর্ণালঙ্কার এই ভাবেই গুপ্তধন হয়ে রয়ে গেল।

এরপর রিকশা চেপে প্যাঁক-প্যাঁক করে আমরা সেই জঙ্গল মহল থেকে আমাদের কপোত-কুঞ্জে ফিরে আসি। ভাঙা চেয়ারে নড়বড়ে টেবিলে হিসেবের খাতা খুলে বসি। জমার ঘরে কিছুই নেই, খরচের ঘরে সংখ্যার পর সংখ্যা, লম্বা হয়ে চলেছে এলোকেশীর চুলের মতো। এ জন্ম তো আর পূর্বজন্ম নয় যে একবার স্টেথিসকোপ ঠেকালেই বুকপকেট ঠেলে উঠবে কারেনসি নোটে। গত জন্মে ডাক্তার ছিলুম, এ জন্মে রুগি। আমরা সবকটাই রুগি। বাছা বাছা গোটা চারেক রুগি এক ছাদের তলায় সংসার করতে নেমেছি। স্ত্রী হাই প্রেসার, অ্যানিমিয়া। পুত্রের জিয়ার্ডিয়া। কন্যার অ্যানিমিয়া। খরচের ঘর হনুমানের ল্যাজের মতো সাধে লম্বা হচ্ছে! ওষুধে ডাক্তারে লম্বা করে দিচ্ছে। বাড়ি তো আর ওষুধে তৈরি হয় না, থান ইট চাই, চুন, সুরকি আর সিমেন্ট চাই, লোহা চাই।

গত গন্মে খুব সুলুক সন্ধানী ছিলুম। সেই গুণটা যাবে কোথায়? মাথায় নানা ফন্দি গিজ-গিজ করছে। ছেলেটাকে নিলামে চড়াই। কোনও শাঁসালো শ্বশুর যদি কিনে নেয় বাড়িটা কমপ্টি করা যাবে। পথ তো খোলাই আছে স্পষ্ট বলতে হবে; আপনার মেয়ে, আমার পুত্রবধূ তো আর শেয়ালকাঁটার জঙ্গলে আপনার দেওয়া ইংলিশ খাটে শুতে পারে না। মাথার ওপর একটা ছাদ চাই। দেয়াল আমার, ফাউন্ডেশান আমার, ছাদ আর পলস্তারা আপনার। মেঝেটাও আপনার। মেয়েকে মোজেকে হাঁটাতে চান মোজেক, লাল পেটেন্ট স্টোন তো তাই। যেমন আপনার অভিরুচি! আর দরজা, জানলা, গ্রিল তো বসাবেনই। নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে না! লোকে কথায় বলে ভালো ঘরে মেয়ে দেবে। তা ঘরটা যাতে ভালো হয় সেটা আপনি নিশ্চয়ই দেখবেন! পিতার একটি কর্তব্য আছে তো! এই দেখুন মণিবাবু। ছেলের বিয়ে দিলেন। অসম্পূর্ণ একতলা বাড়ি। মণিবাবু বললেন, বেয়াই মশাই এতকাল ছেলে আর আমি একঘরে শুয়ে এসেছি। এখন তো আর সেটি হবার উপায় রইল না। বেয়াই মশাই বললেন, বুঝেছি বুঝেছি। মণিবাবু বললেন, তা ছাড়া আপনি যেসব ফার্নিচার দিলেন সে সব রাখব কোথায়? বেয়াই মশাই বললেন, বুঝেছি বুঝেছি। ব্যবসায়ী লোক, কম কথার মানুষ মণিবাবুর একতলা দুতলা হয়ে গেল। ফাশক্লাশ বাড়ি।

তা মণিবাবুর কায়দায় আমারও একটি বেয়াই জুটে গেল। কাঠ গোলার মালিক। অষ্টপ্রহর সাঁই-সাঁই করে করাত চলচে। শব্দ শুনলে বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। মনে হয় ছেলের বাপকে পয়সা দিয়ে কিনে এনে ফাঁড়াই চেরাই চলছে। বিয়ের বাজারে ছেলের কম ডিমান্ড! গ্যাস সিলিন্ডারের মতো। অলয়োএজ ইন শর্ট সাপ্লাই। বাজারে ছেলে ফেললেই বিক্রি হয়ে যায়। দামটা বেশ ভালোই পেলাম। যাক চালটা মাথায় বেশ ভালোই এসেছিল।

তর-তর করে বাড়ি উঠে গেল। ভেতরে কাঠের কাজ যা হল, দেখার মতো। বেয়াই মশাই একেবারে ঢেলে দিলেন। বাড়ি নয় তো প্যাগোডা। মন ভরে গেল। বছর তিনেক ভালোই চলল। তারপর সেই করাত কল মালিকের মেয়ে বিদ্যুৎচালিত করাতের মতোই প্রথমে শাশুড়িকে ফেঁড়ে ফেলল। সেই করাত শেষে তেড়ে এল শ্বশুরের দিকে। ছেলে বলল, আর কেন? তোমরা দুই ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট এবার কাশী কিংবা বৃন্দাবনে কেটে পড়। আমাদের একটু সুখে থাকতে দাও।

য পলায়তে স জীবতি। বুড়োবুড়ি এখন সন্ধেবেলা দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখি, ধর্মকথা শুনি। পূর্বজন্মে যা হয়েছে-হয়েছে। এ জন্মে যা হল হল। সামনের জন্মে আমরা দুজনে খ্যাঁকশিয়াল হয়ে জন্মাব। কত পোড়া ভিটে পাব। দুজনে সুখে যে কোনও একটায় দিন কাটাব, আর প্রহরে প্রহরে ডাক ছাড়ব হুক্কাহুয়া, হুক্কাহুয়া, হুক্কাহুয়া, কাহুয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *