খোলা ম্যানহোলের রাজনৈতিক অর্থনীতি
অর্থনীতিবিদ্রা সব কিছুরই বাজারদর জানেন, কিন্তু কোন কিছুরই মূল্য বোঝেন না—এ অভিযোগ সকল ক্ষেত্রে সত্য না হলেও শুধু মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে যারা জীবনকুশলতা পরিমাপ করতে চান তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য। স্থূল জাতীয় আয় নির্ভুল গাণিতিক সংখ্যা নয়—অনুমান-নির্ভর আসন্ন-মান মাত্র। এর ভিত্তিতে এক দেশের জনগণের জীবনকুশলতা অন্য রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করা মোটেও সঙ্গত নয়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে এ বক্তব্য আরও স্পষ্ট হবে। যদি মজুরির বিনিময়ে মহিলারা গৃহস্থালির কাজ করে তবে তা জাতীয় উৎপাদে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কন্যা জায়া জননীরা হাসিমুখে বিনা বেতনে উদয়াস্ত যে পরিশ্রম করে তা জাতীয় আয়ের হিসাবে আসে না। একজন অর্থনীতিবিদ্ তাই বলেছেন, যদি বাড়ির কর্তা চাকরানীকে বিয়ে করে তবে তাতে শুধু সামাজিক কেলেঙ্কারিই হবে না, তা হবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি। বিয়ের আগে চাকরানীর পারিশ্রমিক জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হত। বিয়ের পরে নতুন গিন্নি অর্থাৎ প্রাক্তন চাকরানী যদি নিজের সংসারে একই কাজ (অথবা ভালবেসে আরও বেশি কাজ) করে তবু তা জাতীয় উৎপাদে গণনা করা হবে না। চাকরানীর বিয়ের আগে ও পরে বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অপরিবর্তিত থাকলেও, চাকরানীর বিয়ের পর অর্থনীতির খামখেয়ালি নিয়মের ফলে জাতীয় আয় কমে যাবে। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করে, পক্ষান্তরে বাংলাদেশে মাত্র ২.৫ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, কিন্তু বাংলাদেশে মহিলাদের অবদান জাতীয় আয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে তাই জাতীয় আয়ের অবপ্রাক্কলন (underestimate) করা হয়। যদি অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ৪০ শতাংশ নারী কাজ করে এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের পুরুষদের ৫০ শতাংশ মাত্র, তবু বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের হিসাব কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশে দেশে দ্রব্যমূল্যের প্রভেদ রয়েছে। সাধারণত যে সব দেশে মাথাপিছু আয় উঁচু সে সব দেশের জিনিষের দামও বেশি। ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে জাতীয় আয় সংশোধন না করা হলে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে আন্তঃদেশীয় জীবনকুশলতার তুলনা অন্তঃসারশূন্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৯-২০০০ সনের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন (World Development Report) হতে দেখা যায় যে, দ্রব্যমূল্যের সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কমপক্ষে তিনগুণ বাড়াতে হবে।’ শুধু ক্রয় ক্ষমতার সমতা ও নারীদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংশোধন করা হলে, বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ১৯৯৮ সালে ৩৫০ ডলার হতে ১৪০০ ডলারে উন্নীত হবে।
সমস্যা শুধু হিসাবের নয়। হিসাব সঠিক হলেও মাথাপিছু আয় দেখে সমাজের ধন বণ্টন সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। যে সমাজে ধন সম্পদ বণ্টনে চরম অসাম্য রয়েছে সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি হলেও দরিদ্রের অনুপাত বেশি হতে পারে। অর্থনীতিবিদ্গণ এখন একমত যে মাথাপিছু আয় উন্নয়নের প্রকৃত সূচক নয়। কিন্তু এর বিকল্প সম্পর্কে কোন সর্বস্বীকৃত সমাধান এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মরিস ডি মরিস মাথাপিছু আয়ের পরিবর্তে গড় আয়ুর প্রত্যাশা, শিশু মৃত্যুর হার ও সাক্ষরতার হারের যৌগিক সূচকের ভিত্তিতে “জীভৌসূ” (জীবনযাত্রার ভৌতমানের সূচক —Physical Quality of Life Index) পরিমাপের চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী মাথাপিছু আয়, গড় আয়ুর প্রত্যাশা ও সাক্ষরতা হারের সূচকের ভিত্তিতে “মাউসূ” (মানব উন্নয়ন সূচক —Human Development Index) প্রচলন করে। কেউ কেউ “মাদসূকে” (মানব দারিদ্র্য সূচক —Human Poverty Index) অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে উন্নয়নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূচক হল “সঅপ” (সক্ষমতার অভাবের পরিমাপ —Capability Poverty Measure)। কিন্তু কোন সূচকই নিখুঁত নয়, কাজেই সূচক নিয়ে কোন ঐকমত্য সম্ভব হয়নি।
আমি অবশ্য মনে করি যে, উন্নয়নের সূচক পরিমাপ করা এত জটিল কাজ নয়। আমি অতি সহজ সূচক ব্যবহার করে অনেক ভাল ফল পেয়েছি। তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ দেখে এলে বন্ধুবান্ধবরা জানতে চায়, দেশটি বাংলাদেশের তুলনায় বেশি না কম উন্নত। এ প্রশ্নের জবাব আমি আমার নিজস্ব সূচকের ভিত্তিতে দিয়ে থাকি। যখনই আমি কোন বিদেশী শহরে যাই তখনই আমি রাস্তায় ম্যানহোলের কত ঢাকনা রয়েছে তা হিসাব করার চেষ্টা করি। যদি কোন শহরে শতকরা দশ ভাগের কম ঢাকনা থাকে তবে সে দেশটিকে বাংলাদেশ থেকে অনুন্নত গণ্য করি। যদি শতকরা দশ ভাগের বেশি ম্যানহোলের ঢাকনা থাকে তবে দেশটিকে বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত বলে মনে করি। আমার বন্ধুবান্ধবরা অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমার মৌলিক অবদান মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেন। তবে তাঁরা বলে থাকেন যে, আমি নেহাত শহরের বাইরে যাই না, তাই আমার সূচক নিয়ে অসুবিধা হচ্ছে না। গ্রামে ম্যানহোল নেই। কাজেই গ্রামাঞ্চলে আমার সূচক অচল। আমি অবশ্য তাঁদের বলে থাকি, গ্রামে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকতে পারে, কিন্তু অন্য অবকাঠামো রয়েছে। যদি অবকাঠামো (যেমন ধরুন বিদ্যুৎ) সঠিকভাবে কাজ করে তবে সে দেশ উন্নত। যদি অবকাঠামো কাজ না করে সে দেশ হল অনুন্নত। উন্নত দেশ হলে স্কুলে ক্লাসের সময় ক্লাস হবে, কিন্তু অনুন্নত দেশের বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময় ক্লাস ছাড়া অন্য কিছু হবে। উন্নত দেশ হলে চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা হবে; উন্নয়নশীল দেশে হাসপাতাল থাকলে ডাক্তার নেই, ডাক্তার থাকলে ঔষধ নেই, ঔষধ ও ডাক্তার থাকলেও ইউনিয়নের হাঙ্গামায় চিকিৎসা হয় না। উন্নয়নশীল দেশে টেলিফোনের তার চুরি হয়ে যায়, মেরামতের অভাবে সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে থাকে। পৃথিবীর সকল দেশেই সরকারের যোগ্যতার অভাব রয়েছে। মার্কিন রসিক উইল রজার্স তাই লিখেছেন, “I don’t make jokes. I just watch the government and report the facts” । (আমি কৌতুক বানাই না। আমি সরকারের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করি এবং আমার বিবরণে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করি।) ভাগ্যিস উইল রজার্স বাংলাদেশে জন্মাননি। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে সরকারের কর্মকাণ্ড দেখে উইল রজার্সের পক্ষেও হালকা রসিকতা সম্ভব হত না। আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি দেখলে উইল রজার্সকেও বিদ্রোহী কবির মত লিখতে হত:
বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ক্ষেপে যাওয়ার মত সামান্য কয়েকটি তথ্য নীচে পেশ করছি।
• বিশ্ব ব্যাংকের এক হিসাব অনুসারে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের সামগ্রিক ব্যবস্থায় ক্ষতির অনুপাত হল ৩০ শতাংশ।o নেদারল্যান্ডে এই হার মাত্র চার শতাংশ। উচ্চ আয়ের দেশসমূহে সামগ্রিক ব্যবস্থার ক্ষতির গড় হার হল ছয় শতাংশ। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ভারিত গড় (weighted average) হার মাত্র ৮ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশসমূহে গড়ে এই ক্ষতির হার মাত্র ১২ শতাংশ। এর মধ্যে কারিগরী ক্ষতি ও মনুষ্য সৃষ্ট ক্ষতি অথবা বিদ্যুৎ চুরি অন্তর্ভুক্ত। যদি উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের সবটুকুকেই কারিগরী ক্ষতি হিসাবে গণ্য করা হয় তবে উৎপাদিত বিদ্যুতের কমপক্ষে ১৮ শতাংশ বাংলাদেশে চুরি হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর শতকরা নব্বই ভাগ দেশে সামগ্রিক ব্যবস্থায় ক্ষতি (system loss) বাংলাদেশের চেয়ে কম। বাংলাদেশের একমাত্র সান্ত্বনা হল, পৃথিবীতে আরও আটটি দেশ আছে যেখানে বাংলাদেশের চেয়ে এই ক্ষতির হার বেশি। যথা বেনিনে এই ক্ষতির হার হল ৮৭ শতাংশ।
• বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ ছাত্রদের সাথে শ্রেণীকক্ষে যত কম সময় কাটান তেমনটি পৃথিবীর খুব কম দেশেই ঘটে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে চীনে বছরে ১২৩৫ ঘণ্টা ক্লাস হয়; ইন্দোনেশিয়াতে ১১০০ ঘণ্টা ক্লাস হয়; আর বাংলাদেশে মাত্র ৪৪৪ ঘণ্টা ক্লাস হয়। বাংলাদেশে তৃতীয় হতে পঞ্চম শ্রেণীতে শতকরা ৪৭ ভাগ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় না। সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৮ হতে ২০ শতাংশ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় না। বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় এক তৃতীয়াংশ ক্লাস হয় না। বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে বিদ্যা অর্জন করতে তিন বছর যথেষ্ট হওয়া উচিত তা অর্জন করতে বাংলাদেশে পাঁচ বছর লাগে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাতে কমপক্ষে ৪০ ভাগ সম্পদ অপচয় হচ্ছে। শুধু সরকারের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে না, নষ্ট হচ্ছে শিশুদের সময় এবং তাদের বাপ মায়ের বিনিয়োগ। মাত্র ৩৭.৮ ভাগ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজে কি ঘটছে তা হিসাব করার জন্য সমীক্ষার প্রয়োজন নেই, খবরের কাগজ খুললেই সেখানে কি ঘটছে দেখা যাবে। নকলবাজিতে বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষকরা অনায়াসে বিশ্বে চ্যাম্পিয়নশীপ দাবি করতে পারে। বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশের শিক্ষা খাত সমীক্ষার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে নকলবাজি হল সুসংগঠিত ও নির্লজ্জ।
• ১৯৯৫ সালে পরিচালিত সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে, কোন থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কখনও শতকরা ১০০ ভাগ ডাক্তার হাজির থাকেন না। অফিসের সময়ে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১৪.২৯ শতাংশ হতে ৫৭.১৪ শতাংশ ডাক্তার হাজির থাকে। অফিস সময়ের পর থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গড়ে ১১.১ শতাংশ হতে ২২.২ শতাংশ ডাক্তার পাওয়া যায়। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, ডাক্তাররা পয়সা কামাই করার জন্য রোগীদের ভয় দেখিয়ে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করেন। বাংলাদেশের সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তাররা গড়ে ২.৫৭ মিনিটে একজন রোগী দেখেন। এ খবর পেলে স্বয়ং ধন্বন্তরিও মূর্ছা যাবেন।
• বাংলাদেশে পরিবহনের একটি সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার মাত্র ৫ শতাংশ ভাল অবস্থায় রয়েছে। সড়ক ব্যবস্থার ৭৮ শতাংশ মোটেও সন্তোষজনক নয়, কোন মতে ব্যবহার করা যায়। বাকি ১৭ শতাংশ হল ব্যবহারের অনুপযুক্ত। গ্রামাঞ্চলে অনেক রাস্তা গ্রীক রূপকথার পেনিলোপির জালের মত। পেনিলোপি সারাদিন যে জাল বুনতেন, রাত্রে তা খুলে ফেলতেন। বাংলাদেশে বহু রাস্তা প্রতিবছর শীতকালে নির্মিত হয়, বর্ষাকালে ধুয়ে মুছে যায়, পরবর্তী শীতে আবার নির্মিত হয়।
• শহরাঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রচুর অপচয় ঘটছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে খুলনা শহরে সরবরাহকৃত পানির ৭৮ শতাংশ নষ্ট হয়। আরেকটি মফস্বল শহরে হিসাব নিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, ৫৪ হতে ৬৪ শতাংশ পানি অপচয় হচ্ছে। পানীয় জল সরবরাহের জন্য যে সব নলকূপ বসানো হয়েছে তার মাত্র ৪০ শতাংশ ঠিকভাবে কাজ করে, ৩০ শতাংশ একেবারে অকেজো; আর ৩০ শতাংশ কখনও কখনও কাজ করে।” হস্তচালিত নলকূপের ২০ শতাংশ একেবারেই কাজ করে না। প্রায় ৫০ শতাংশ হস্তচালিত নলকূপের পানি নিরাপদ নয়। আর্সেনিক দূষণের সমীক্ষা শেষ হলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে।
• বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে সৃষ্ট সেচব্যবস্থা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৪ শতাংশ অর্জন করেছে।o সৃষ্ট সেচ ক্ষমতার ৪৬ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন প্রকল্পে ৭৬৮,৭৭১ হেক্টর জমিতে সেচের সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গড়ে অগভীর নলকূপে সম্ভাব্য সেচ ক্ষমতার মাত্র ৪৯ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। একমাত্র শক্তিচালিত পাম্প গড়ে লক্ষ্য মাত্রার ৭০ শতাংশ অর্জন করেছে।
• সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের লোকসান ক্রমেই বেড়ে চলছে। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াই লোকসানকারী কর্পোরেশনসমূহ প্রায় সাড়ে তের শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। দুটো কারণে মনে হয় যে, এ হিসাবে লোকসান অবপ্রাক্কলন করা হয়েছে। এ হিসাবে অনুমান করা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের বকেয়া পাওনার সবটুকুই পাবে। প্রকৃতপক্ষে অনেক বকেয়া কোনদিনই আদায় হবে না। দ্বিতীয়ত, এ হিসাবে প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা কর্মচারিদের অবসর ভাতার সম্ভাব্য দায় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। লোকসানকারী এ সব প্রতিষ্ঠানের লোকসান বছরে জাতীয় আয়ের এক শতাংশ বা তার ঊর্ধ্বে হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
• ব্যাংকসমূহ রাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল যে, এ সব প্রতিষ্ঠানের লাভ থেকে উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ করা হবে। অথচ ব্যাংকসমূহই করদাতাদের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ প্রায় ২৮.৬ শতাংশ। অথচ একই দেশে বিদেশী ব্যাংকসমূহের শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ মাত্র ৩.৪ শতাংশ। কৃষি ও শিল্পের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহে খেলাপী ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশী। এ সব প্রতিষ্ঠানে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ৬৫ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুসারে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের পুঁজির ঘাটতির জন্য সরকারকে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হবে।১১ ইতোমধ্যে সরকার ব্যাংকসমূহকে ৪০৮৩ কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে।
সবাই বাঙ্গালীদের দোষ দেয় এরা ভাঙতে পারে, কিন্তু গড়তে জানে না। এমনকি পঞ্চদশ শতকে চণ্ডীদাসও দুঃখ করে লিখেছেন:
“গড়ন ভাঙিতে পারে আছে কত খল
ভাঙিয়া গড়িতে পারে যে জন বিরল।
আমার কিন্তু মনে হয় গড়াটাই বাঙ্গালীদের জন্য সমস্যা নয়। গড়তে পারলেও বাঙ্গালীরা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না। অর্থনীতিবিদ্ হার্ভে লাইবেনস্টাইন অবশ্য মনে করেন যে এ ধরনের রোগ সকল উন্নয়নশীল দেশেই রয়েছে। এ রোগের তিনি নাম দিয়েছেন “X-inefficiency”। ইংরাজি ভাষায় “X” অক্ষরটি অজানা সংখ্যা অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই “X-inefficiency”-এর বাঙলা অর্থ হল “অজানা অকার্যকারিতা”।১৩ উন্নয়নশীল দেশসমূহে যে পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার করা হয় সে অনুপাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, অথবা অনেক কম ফল পাওয়া যায়। লাইবেনষ্টাইন রোগটি নির্ণয় করেছেন—কিন্তু তার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করেননি।
পরিচালনা ও মেরামতের ব্যর্থতা অজানা অকার্যকরতার একমাত্র উৎস নয়, তবে অবশ্যই এর একটি বড় কারণ। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে পরিচালনা ও মেরামতের ব্যর্থতার একটি বড় কারণ হল এর জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ পাওয়া যায় না। দুটো কারণে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সম্পদের অপ্রতুলতা দেখা দেয়। প্রথমত, দাতারা রাজস্ব ব্যয় ও বিনিয়োগ বা উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে তফাৎ করতে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে বাধ্য করে। তারা চায় যে উন্নয়ন বাজেটে – যার মাধ্যমে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পসমূহ অর্থায়ন করা হয়—যেন তাদের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের জন্য সরকারের হিস্সার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকে। বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়নশীল দেশসমূহ রাজস্ব বাজেটে খরচ কমাতে বাধ্য হয়। যেহেতু রাজস্ব বাজেটে বেতন বন্ধ করা সম্ভব হয় না – সেহেতু রক্ষণাবেক্ষণ খাতকেই কৃচ্ছ্রতার বোঝা বহন করতে হয়। দ্বিতীয়ত, পরিচালনা ও মেরামত হল নৈমিত্তিক কাজ, এতে কোন রাজনৈতিক চমক নেই। কিন্তু নতুন প্রকল্পের প্রতি রাজনীতিবিদদের দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে। নতুন প্রকল্পে একবার ভিত্তি স্থাপন করা হয়, আবার প্রকল্প সমাপ্ত হলে ফিতে কাটা হয়। রাজনীতিবিদ্রা বার বার তাঁদের সাফল্য জাহির করার সুযোগ পান। আবার অনেক সময় ঠিকাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারেন। তাই উন্নয়নশীল দেশসমূহে মেরামত ও পরিচালন ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ থাকে না।
এ বক্তব্য অনেকাংশে সঠিক, তবে সর্বাংশে নয়। যাঁরা বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতাকে পরিচালনার ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে থাকেন তাঁরা সমস্যার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উপেক্ষা করে থাকেন। প্রথমত, সুদক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থা না থাকলে কোন সরকারই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ দিতে পারবে না। যদি হাসপাতালের বিদ্যুৎ ও পানি চুরি হয়ে পার্শ্ববর্তী বস্তিতে চলে যায় তবে সরকারের পক্ষে এ সব অপচয়ের কাফ্ফারা দেওয়া সম্ভব নয়। যদি হাসপাতালের ওষুধ চুরি হয়ে যায় তবে কোন দিনই হাসপাতালের জন্য যথেষ্ট ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। যদি মেরামতের টাকা হাসপাতালের বাইরের দেওয়ালের জন্য খরচ করা হয় তবে হাসপাতালের ছাদের পানি পড়া বন্ধ করা যাবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে মেরামত ও পরিচালনার জন্য ব্যয় বাড়িয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। উপরন্তু অনেক সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও যথাসময়ে ছোটখাটো মেরামতও করা হয় না। তার ফলে ছোট ছোট সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয়। জার্মানিতে বলা হয়ে থাকে যে, একটি ছোট্ট পেরেকের অভাবে একটি রাজত্ব হারিয়ে যেতে পারে। জার্মান ছেলেভুলানো ছড়াতে তাই বলা হয়েছে:
For want of a nail, the shoe was lost.
For want of a shoe, the horse was lost.
For want of a horse, the rider was lost.
For want of a rider, the battle was lost.
For want of a battle, the kingdom was lost.
And all for the want of a horseshoe nail.
একটি পেরেকের অভাবে ঘোড়ার খুর কাজ করেনি। খুরের সমস্যার ফলে ঘোড়া কাজ করেনি। ঘোড়া না থাকাতে অশ্বারোহী সৈন্য পাওয়া যায়নি। অশ্বারোহী সৈন্যের অভাবে যুদ্ধে হেরে গেল। যুদ্ধ হেরে যাওয়াতে রাজত্ব হারালো। এ সব কিছু ঘটল ঘোড়ার খুরের একটি পেরেকের অভাবে।
পেরেকের দাম বেশি নয়। কিন্তু যথাযথ প্রস্তুতি না থাকলে যখন দরকার তখন পেরেক খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সবার আগে দরকার হল সুশাসন।
দ্বিতীয়ত, কোন সরকারের পক্ষেই অবকাঠামোর মেরামত ও পরিচালনার সকল ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। যারা বিভিন্ন অবকাঠামোর সুবিধা ভোগ করে তাদের এ ব্যয়ের সম্পূর্ণ বা আংশিক দায়িত্ব নিতে হবে। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশেই গ্রাহকরা সব কিছু মাগনা চায়। বরং মাগনা চড়তে না দিলে বাসে, ট্রামে ও ট্রেনে মারপিট শুরু করে দেয়। খুশওয়ান্ত সিং লিখেছেন, তিনি দিল্লির বাসের গায়ে লেখা দেখেছেন”:
“আ না ফ্রি
জা না ফ্রি
আওর পাড় গিয়া
ত খানা ফ্রি”
(আসবে মাগনা, যাবে মাগনা এবং ধরা পড়লে (জেলে) খাবেও মাগনা।)
এ পরিবেশে বেশির ভাগ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃত পক্ষে উন্নয়নশীল দেশসমূহের বেশির ভাগ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে একটি দুষ্ট চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবহারকারীরা কোন মাশুল দেয় না, কাজেই সেবার মান নেমে যাচ্ছে; সেবার মান অসন্তোষজনক তাই ব্যবহারকারীরা মাশুল দিচ্ছে না। একই সাথে সেবার মান উন্নীত না করলে এবং মাশুল আদায় না বাড়াতে পারলে এ দুষ্ট চক্র ভাঙ্গা সম্ভব নয়।
পরিচালনা ও সংরক্ষণে ব্যর্থতা একটি অনভিপ্রেত সংকট – এ কথা মোটেও সত্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা এক ধরনের কর্মকর্তাদের জন্য লাভজনক ব্যবসা। টেলিফোন সব সময়ে ভাল থাকলে ঘুষ পাওয়া যায় না। ন্যায্য বিল দিলেই বিদ্যুৎ পাওয়া গেলে বিদ্যুৎ সংস্থার কর্মকর্তাদের কোন সমাদর হবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ একচেটিয়া ব্যবসা করে। তাদের কোন প্রতিযোগী নেই। সকল একচেটিয়া ব্যবসায়েরই প্রবণতা হল যত সম্ভব উৎপাদন হ্রাস করে সর্বোচ্চ মূল্য আদায় করা। কাজেই একদিকে সেবা কমে যায়, অন্যদিকে অনুপার্জিত মুনাফা বেড়ে যায়। অনেকে মনে করেন যে, সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণ হল অদক্ষ পরিচালনা। আসলে বাংলাদেশে যারা সরকারী প্রতিষ্ঠান চালায় তারা মোটেও বোকা নয়, তারা অতি চালাক। যা কিছু ঘটছে তা ইচ্ছা করেই ঘটানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে একটি গল্প মনে পড়ছে। একবার নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ঢাকা শহরের পুলিশের প্রধান কর্মকর্তারা এক বৈঠকে বসেন। তাঁরা প্রত্যেকেই দাবি করেন যে তাঁদের পুলিশ সবচেয়ে দক্ষ। তাঁদের দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে বলা হল। নিউইয়র্ক শহরের পুলিশ প্রধান দাবি করলেন যে, তাঁর পুলিশ বাহিনীর কাছে সর্বাধুনিক কম্পিউটারে আসামীদের সম্পর্কে সর্বশেষ উপাত্ত রয়েছে। কাজেই কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারা শতকরা ৯৯ ভাগ আসামী ধরে ফেলতে পারে। সুতরাং নিউইয়র্কের পুলিশ বিশ্বের সেরা। লন্ডনের পুলিশ প্রধান স্বীকার করলেন যে, তাঁর পুলিশ বাহিনীর এত যন্ত্রপাতি নেই, তবু তাদের এলাকার জনগণের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই ২৪ ঘণ্টাতে না হলেও ৭ দিনের মধ্যে ৯৯.৯৯ শতাংশ অপরাধী তাঁরা ধরে ফেলতে পারেন। ঢাকার পুলিশ প্রধান বললেন যে, তাঁর কম্পিউটার নেই; তাঁর পুলিশ বাহিনীর সাথে জনগণের যোগাযোগ নেই এবং তারা প্রায় ৯০ ভাগ আসামী ধরে না। তবু ঢাকার পুলিশ বিশ্বের সেরা কেননা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কমপক্ষে ৭ দিন আগেই তারা জানে কোথায় কি অপরাধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে। সর্বাধুনিক কম্পিউটার নিয়েও পৃথিবীর কোন পুলিশ বাহিনী এ ধরনের রেকর্ড সৃষ্টি করতে পারেনি। এ ধরনের গল্প কখনও সত্য হয় না, তবে এতে বাস্তবতার ছায়া থাকে। পুলিশে যা ঘটছে অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও তা ঘটছে। অনেক দেশেই সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে জনগণ নয় সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ আমলারাই অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে কিভাবে প্রশাসন চলবে। পরিচালনা ও মেরামতের ব্যর্থতা শুধু একটি আর্থিক বা প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা।
ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি একটি তুচ্ছ বিষয় নয় – এটি অত্যন্ত জটিল সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। অবকাঠামোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৯৪ সালের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন পাঁচটি সুপারিশ করেছে[১৫] :
– স্থানীয় অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
– জাতীয় অবকাঠামোর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা;
– সবাইকে ভর্তুকি না দিয়ে শুধু মাত্র দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা;
– সেবার মূল্য ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা;
– প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন করা।
স্থানীয় সেবার ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। কোন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেই গ্রামে গ্রামে স্কুল কিংবা হাসপাতাল চালানো সম্ভব নয়। তেমনি সম্ভব নয় সড়ক, সেচ অবকাঠামো, পানি সরবরাহ বা পয়ঃনিষ্কাশনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। স্থানীয় জনগণের জন্য নির্মিত অবকাঠামো জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। এ সব অবকাঠামোর মালিকানা স্থানীয় জনগণের গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু অর্থের সংস্থান না করে বিকেন্দ্রীকরণ কখনও সফল হবে না। স্থানীয় নেতৃত্বকে ব্যবহারের মাশুল আদায় ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করতে হবে। যদি ব্যবহারের মাশুল থেকে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় সম্ভব না হয় তবে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ রাতারাতি অংশগ্রহণ করবে না। জনগণের অংশগ্রহণের জন্য স্থানীয় উপকারভোগীদের সাথে প্রকল্পের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উপরন্তু সর্বশ্রেণীর জনগণ যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় বিশেষ কোন গোত্র অবকাঠামোর সকল সুবিধা নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলবে। বিকেন্দ্রীকরণ তাই সময়সাপেক্ষ। দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণ করতে গেলে লাভের চেয়ে লোকসানের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
পরিচালনা ও মেরামতের জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করতে গেলে মনে রাখতে হবে যে, একই সাথে নতুন প্রকল্পের জন্য ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বাড়ানো সম্ভব নয়। কাজেই যেখানে বেশি লাভ হবে সেখানেই বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। এমনকি সকল অবকাঠামোর মেরামত ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ সম্ভব না হলে যেখানে রক্ষণাবেক্ষণের সুফল বেশি সেখানে প্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পানি ও সেচের ক্ষেত্রে অনেক সময় দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ভর্তুকি সকলকে দেয়ার মত সম্পদ সংগ্রহ সম্ভব নয়। কাজেই ভর্তুকি দরিদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত গরীবরা কম পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কাজেই যে সব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারের পরিমাণ কম সে সব ক্ষেত্রে মূল্য হ্রাস করলে এর সুফল শুধু গরীবদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি।
পরিবেশগত প্রতিকূল প্রভাব এড়ানোর জন্য যারা পরিবেশ নষ্ট করে তাদের মাশুল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে সম্পদের অপচয় হয় সেখানে মূল্য বাড়াতে হবে। মূল্য বাড়ালে সম্পদের অপচয় কমানো সম্ভব হবে। সবশেষে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনবোধে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে হবে।
বর্তমানে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয় কারিগরী নির্ভরযোগ্যতার উপর। কিন্তু অবকাঠামোর সামাজিক ও আর্থিক গ্রহণযোগ্যতাও ভাল করে দেখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কারিগরী মান নামিয়ে আনলে প্রকল্পের আর্থিক গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্ব ব্যাংকের সুপারিশগুলো ভাল। কিন্তু ইচ্ছে করলেই এ সব সুপারিশ সকল ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যেখানে অবকাঠামোর একচেটিয়া ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল গড়ে উঠেছে সেখানে যে কোন সংস্কার প্রতিহত করার প্রচেষ্টা হবে। কলকে খুশি করে কোন সংস্কার সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে অপ্রিয় ব্যবস্থা নিতেই হবে। এ কথা সরকারের জন্য যেমন প্রযোজ্য বেসরকারী খাতের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের একটা ঘটনা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটি পুরানো স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন স্বাস্থ্য বীমা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়। নতুন স্বাস্থ্য বীমার জন্য নির্ধারিত কোম্পানী কর্মচারীদের একই বীমার হারে অনেক নতুন সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দেয়। তবে তাদের দুটো শর্ত ছিল। প্রথমটি হল প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারীকে এ বীমাতে অংশগ্রহণের জন্য দরখাস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবটি ত্রিশ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত করতে হবে। এক জন ছাড়া কোম্পানীর শত শত কর্মচারী এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। শুধু একজন কর্মচারী জিদ ধরে বসে যে এ প্রস্তাবে সে রাজি নয়। প্রথমে বীমা কোম্পানীর বিশেষজ্ঞদের পাঠানো হল তাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু সে কোনমতেই রাজি হল না। তারপর তার বিভাগের ছোট, মাঝারি ও বড় সকল কর্মকর্তারা চেষ্টা করল। কিন্তু সে কোন মতেই রাজি হল না। এর পর ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের পাঠানো হল। কিন্তু কর্মচারীটি তার অবস্থানে অনড়। ত্ৰিশ দিন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কোম্পানীর প্রেসিডেন্টকে এ সমস্যার কথা জানানো হল। প্রেসিডেন্ট ছিলেন লম্বা চওড়া দশাসই ব্যক্তি। তিনি বসতেন সবচেয়ে উঁচু তলায়। তিনি কর্মচারীটিকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। কর্মচারীটি তার কক্ষে এলে তিনি বললেন যে, কোম্পানীর সবাই যা চায়, সে কেন তা চায় না। কর্মচারীটি বলল যে এ ব্যবস্থা তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট রেগে বললেন, “হারামজাদা! সবাই যা চায় তুই তা চাস না। তোকে জানালা দিয়ে ফেলে দিলে কেউ তোর জন্য আসবে না। তুই এক্ষণি কাগজে স্বাক্ষর করবি অন্যথায় এই মুহূর্তে তোকে আমি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে মারবো।” কর্মচারীটি সুড়সুড় করে সব কাগজপত্র দস্তখত করে দিল। কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এবার কিভাবে সই করলি?” কর্মচারীটি জবাব দিল, “হুজুর আপনি যত প্রাঞ্জল ভাষায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন কেউ তা এর আগে করতে পারেনি।” সুশাসনের জন্য কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে অনেক সময়ই শুধু “প্রাঞ্জল ভাষাই” নয় “প্রাঞ্জল ব্যবহারের” ও প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় ম্যানহোলের হোল (ছিদ্র) বন্ধ হবে না।
.
তথ্যসূত্র
১. World Bank, World Development Report 1999/2000 (New York: Oxford University Press, 1999), p. 230
২. UNDP, Human Development Report, 1995. (New York: Oxford University Press, 1995), pp. 117 —124
৩. Webster’s Compact Dictionary of Quotations (Springfield: Merriam Webster Inc., 1992), p. 143
৪. World Bank,, pp. 264-265
৫. World Bank, Bangladesh Education Sector Review Report (mimeo, 1999)
৬. Ahmad, Muzaffer, “Health care : Problems of Quality Assurance” in Growth of Stagnation: A Review of Bangladesh’s Development 1996 (Dhaka: UPL, 1997), pp. 361-390
৭. World Bank, Bangladesh Public Expenditures Review 1997 (Washington: World Bank, 1997), p. 17
৮. Khan, A. A., “Institutional Aspects of Water Supply and Sanitation in Asia.” Natural Resources Forum, February 1988, pp. 45-46
৯. তথ্য Water Resources Planning Organization হতে সংগৃহীত
১০. অর্থ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ১৯৯৯ (ঢাকা: অর্থ মন্ত্রণালয়, ১৯৯৯), পৃষ্ঠা ১৩৭
১১. তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক হতে সংগৃহীত
১২. উদ্ধৃত, বসু, সজল, বাঙালী জীবনে দলাদলি (কলকাতা : কল্পন, ১৯৮৬), পৃষ্ঠা ১
১৩. Leibenstein, Harvey, General X-Efficiency Theory and Economic Development (1978)
১৪. Singh, Khushwant, The Best of Khuswant Singh (Delhi: Penguin Books of India, 1993), p. 458
১৫. World Bank, World Development Report 1994, (New York: Oxford University, 1994), pp. 73-88