চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

খোলকত্তাল

খোলকত্তাল

একজন—তার জীবনটা যেন ‘হল না হল না’—এই রব তুলছে জীবনের ব্যঙ্গে,—খোলখত্তালে। লোকটার বউ, স্মৃতি, পরিবেশ যেন সারা জীবন ধরে তাঁর সঙ্গে রঙ্গ-বিদ্রূপের খেলাই খেলে গেল। মধ্যবিত্ত আটপৌরে সংসারের প্রতীক সেই লোকটিকে নিয়েই এই রচনা।

কী করলে কী হয়, সেই নিয়েই আমার এই রচনা। উদ্দেশ্য একটাই, আমার জাতভাইরা যদি কিঞ্চিৎ সচেতন হন। তাঁদের যদি সামান্য বোধদয় হয়। এই যে জাতভাই বললুম, তার মানে জাতের কথা উঠল। আমার জাত কী! প্রথমত আমি মানুষ। দুটো হাত, দুটো পা। চারটেই পা নয়। আমার লেজ নেই। বাইরেও নেই, ভেতরেও নেই। অনেকের লেজ ভেতরে গোটানো থাকে। অহঙ্কারের লেজ। বেরিয়ে পড়ে কথা হয়ে। কথার আস্ফালন লেজের আস্ফালনের মতোই। অহঙ্কার কীসের! সে বাবা অনেক জটিল ব্যাপার। একটু বোঝার চেষ্টা করে যা বুঝেছি বলা যেতে পারে। যেমন ধরুন টাকার অহঙ্কার। টাকা একটা বিলক্ষণ লেজ। ব্যাংকের টাকা মগজে গিয়ে ঢোকে। তখন সে সবজান্তা হয়ে যায়। সে মনে করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার নির্দেশেই চলছে ও চলবে। সব ব্যাপারের শেষ কথা একমাত্র সে-ই বলতে পারে।

 সে সব কি চালের কথা। একটা নমুনা পেশ করা যায় ‘বুঝলে পার্থ, আমার মতে এ দেশে সবার আগে ধর্মটাকে ব্যান করা উচিত। ভাবছি নরসিমা রাওকে একটা সাজেশান দেব।’

‘বুঝলে প্রকাশ, তুমি একটা গাধা, এই বাজারে লেখাপড়ার কোনও দাম আছে? এম.এ., পি.আর.এস, পি.এইচ.ডি. সব ফালতু। ছেলের পেছনে টাকা ঢালছ ঢাল, পুরোটাই ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট।’ এই হল লেজের কথা। টাকার লেজ, রূপের লেজ, বিদ্যার লেজ, পদের লেজ, মাস্তানির লেজ। যার টাকা নেই তারও অহঙ্কার আছে, দারিদ্র্যের অহঙ্কার।

আমার ভাই ওসব কিছুই নেই। আমার দুটো চোখ, দুটো কান, একটা মুখ একটা মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যা থাকা দরকার সবই আমার আছে। সেটা কিছু নয়। আসল কথা হল আমি মধ্যবিত্ত। অত্যন্ত অলস। কেবলই মনে হয় শুয়ে থাকি। সংসারের আকুপাংচার না থাকলে জীবনটা আমার বিছানাতেই কেটে যেত। সকালে সাতটা বাজল, আটটা বাজল, তখনও গড়াচ্ছি। চোখ খুলতে ভয় করে। কেন, সেই কথাটাই বলি।

চোখ খোলা মাত্রই দেখা, আধময়লা নীল মশারির চাল। চালের মাথায় শ্রী হীন একটা পাখা। তিনটে ব্লেড কখনই পরিষ্কার করা হয় না। সে উৎসাহ, উদ্যোগ আমার নেই। যেহেতু আমার নেই, সেই হেতু কারো নেই। চোখ খোলা মাত্রই এই দৈন্যের দৃশ্য চোখে পড়বে। ১৯৭২, ৮২, ৯২ -এই এক দর্শন। মশারির চাল, চালের মাথায় বিবর্ণ পাখা, পাখার মাথায় হাত। হরেক কায়দার ঝুল ঝুলছে। তারপর চোখে পড়বে একটা জানালা। জানালার বাইরে এই পাড়ার যত সব বাড়ির। কোনাটারই চেহারা তেমন ভালো নয়। পড়তি পাড়া। সকলেরই অবস্থা দিনে দিনে পড়ছে।

একেবারে পাশের বাড়ির অনিলবাবু রিটায়ার করেছেন। বাড়িটা তাঁর ঠাকুরদার আমলের। অবস্থা পড়ছে। সঞ্চয় রোজই কমছে। তিন ছেলেই বেকার। মেয়ের বিয়ে হয়নি। এইবার কি হবে। মশারির ভেতর থেকে সকালের রোদের দিকে তাকালে মনে হয়, আবার আমার টাইফয়েড হয়েছে। একবার আমার হয়েছিল, তখন সবাই যখন কর্মের জগতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমি শুয়ে আছি, দুর্বল, বিবর্ণ। শুয়ে শুয়ে কটকটে রোদ দেখছি। আর ভাবছি এক মাস শুয়ে আছি, এ জীবনে বিছানা ছেড়ে ওঠা বোধহয় হল না। সেই অসুস্থতার বেবিটা আজও ফিরে আসে। সত্যি কথা বলতে কী, জীবন তো এখন একেবারেই শয্যাশায়ী। দেহটাকে যদিও ঠেলেঠুলে তুলতে পারি, বৈষয়িক অবস্থাটাকে তো তুলতে পারব না। রোজগার যা আছে তাই থাকবে। আর কয়েক বছর, তারপর শূন্য হয়ে যাবে। চাকরির মেয়াদ ক্রমশ কমছে, সেই সঙ্গে কমছে জীবনের দিন। এই অবস্থায় জীবনের আর একটা সকাল মানে সমাধানহীন যাবতীয় সমস্যার জেগে ওঠা।

ঘরের রংচটা দেওয়াল। যে যেখানে পেরেছে গজাল গজাল পেরেক পুঁতে দেবদেবীর ছবি, নিজেদের ছবি আর ক্যালেন্ডার ঝুলিয়েছে। কোনওটা ডানপাশে, কোনওটা বাঁপাশে হেলে আছে। কাচে ময়লা জমেছে বহু বছরের। সব ছবিই অস্পষ্ট, জীবন্ত মানুষও তো এইরকম অস্পষ্ট হয়ে আসছে দিনে দিনে। মানুষের কাচের আবরণ নেই তাই বোঝা যায় না। বোঝা যায় চোখের দিকে তাকালে। ওইটাই তো দু-রঙের কাচ। সাদা আর কালো। সাতরাজার ধন এক মাণিক। সেই চোখ ক্রমশ সরে আসে। মরা মাছের চোখের মতো। একই দৃশ্য একই জীবন দেখতে দেখতে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে আসে। চোখের মানে জীবনের আকাঙ্ক্ষা। লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, সবই আমার ছিল। তখন আমি টগবগে এক ঘোড়া। এখন আর কিছুই নেই।

আমাদের একটা বেড়াল আছে। খাবার সময় পাতের কাছে বসে থাকে। প্রথমে মিউমিউ করে। তারপর থাবা বাড়ায়। এক চড়। এর কিছুক্ষণ পরে আবার। আবার এক চড়। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বেড়ালটা মুখ ঘুরিয়ে চোখ বুঝে বসে থাকে। বুঝে যায় ভাগ্যে থাকলে এক আধ টুকরো মাছ জুটবে, নয়তো নয়। আমিও ওই বেড়াল। থাবা বাড়াতুম। মার খেতেখেতে, একপাশে সরে এসে চোখ বুজিয়ে বসে আছি।

সাত সকালেই যার কণ্ঠস্বর বড় বেশি কানে এসে বাজে, তিনি আমার দুই সন্তানের জননী। ছিলেন প্রেমময়ী, এখন হয়েছেন জ্বালাময়ী। আমার জীবনে যাঁর আসার কথা ছিল, তিনি কবিতা হয়েই রয়ে গেলেন। সে ছিল আমার সহপাঠী। চৌত্রিশটা বছর পেছতে পারলেই আবার তাকে পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে সেই পুরোনো কলকাতা, আমার সেই কলেজ, আমার সেই তরুণ বয়সের শরীর, আমার সেই স্বপ্ন, বন্ধুবান্ধব, সেই রেস্তোরাঁ, পার্ক। জীবনের মজাই হল, একমুখী চলা। এ এমন এক ট্রেন যার ডাউন লাইন নেই, কেবল আপেই চলে। হাওড়া থেকে ছেড়েছিল সকাল পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ ইলেভন আপ। সে চলছে, চলেই চলছে। ইলেভেন ডাউন আর হবে না। কোনও মানে হয়! একটা মানুষ তার অতীতে ফিরতে পারবে না, সময়ের সম্রাটের এ কেমন বিচার। অতীতের চেয়ে বেড়াতে যাওয়ার ভালো জায়গা আর কী আছে। মনে মনে যেতে পারি ছায়াপথ ধরে সেই ভৌতিক স্টেশনে, যেখানে সবই অশরীরী। এক গান বারেবারে গাওয়া যায়। এক জীবন বারেবারে যাপন করা যায় না। শুরু থেকে শুরু করতে হলে মরে জন্মাতে হবে। তার অর্থ, অসম্ভব।

সেই যে ছলনাময়ী, তার সঙ্গে এখনও আমার ডায়ালগ হয় মাঝে মাঝে। তুমিও বুড়ি হলে, আমিও বুড়ো হলুম। তোমার খুব প্রেম ছিল, ফ্রেমটাও ছিল জবরদস্ত। বাঙালি মেয়েরা সাধারণত অতটা লম্বা হয় না। মুখটাও খুব ধারালো ছিল। ড্যান্সার হতে পারতে। কেন হলে না, সে তুমিই জানো। খুব চোটপাট, বলিয়ে কইয়ে মেয়ে ছিলে। তোমার ব্যাবসায়িক বুদ্ধিটা যথেষ্ট খোলতাই ছিল। সেটা এখন বুঝি। আমাকে বিয়ে করলে তোমার কী দশাই না হত। ক্লাইভের আমলের এই নোনাধরা বাড়ি। বছরে মাইনে বাড়ে পঁচাত্তর টাকা। বুকে ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। চোখে মায়োপিয়া। যৌবনের সীমানা পেরোবার আগেই চুলে পাক ধরেছে। বেশ খেলিয়ে বাঁচার জন্যে যে রোজগার দরকার তা আমার সাধ্যে কুলোল না। কেরিয়ারিস্ট হতে পারলুম না। আমার স্থায়ী বিশেষণ—অপদার্থ। একটা ভেড়া। জীবনের জুয়াখেলায় পরাজিত। যে দানই ফেলি, তাইতেই হেরে মরি। এইরকম একটা ভাগ্যহীন মানুষ দেখা যায় না।

কে বলেছিলেন, সততাই সাফল্যের চাবিকাঠি। সিনসিয়ারলি কাজ করে যাও, দেখবে তোমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। বলেছিলেন, আমার শিক্ষক, আমার পিতা। বিশ্বাস করেছিলুম। অফিসে আমার তলার তিনজন, আমাকে টপকে, আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের আলাদা চেম্বার, বাইরে নামের ফলক। একটা করে মারুতি গাড়ি। তাদের হাঁটাচলা সব বদলে গেছে। সাজ পোশাকের বেজায় কেতা। আড়চোখে তাকাবার কী কায়দা। আমি জানি তিনটেই অপদার্থ। অসৎ সব রকমের চারিত্রিক দোষে দুষ্ট।

তাহলে! তাহলে আমাদের অফিসের সামনে বটতলার সেই আতরওয়ালা। জরির কাজ-করা জ্যাকেট। চোখে সুর্মা। হাতে একটা কাঠি। কাঠির মাথায় তুলো। তুলোয় আতর কায়দা করে এগিয়ে দিচ্ছে, এর তার হাতে। ওই আতরওয়ালার কায়দায় তেল দিতে হবে। বড় মানুষকে ভেড়াবার নামই কেরিয়ার। ওই বিদ্যেটা যে আমার জানা নাই। ফলে আমি যা ছিলুম তাই আছি। অতএব আমি অপদার্থ।

আশেপাশে সকলের সব কিছু হয়ে যাচ্ছে, আর আমার গৃহিনী ততই হয়ে উঠছেন কাঁসরঘণ্টা। আমার দেবালয়ে অবিচ্ছিন্ন আরতি। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। কার কী হল তার একটা ফিরিস্তি মনে মনে করতে গিয়ে নিজেই ঘাবড়ে যাই। মলয়বাবু সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনছেন। সৌমিত্রদের বাড়িতে ফোন এসেছে। স্বরূপ একটা বখা ছেলে, প্রেশারকুকার আর ওয়াটার ফিল্টার, ফ্লাস্ক, ক্যাসিরোলের ব্যাবসা করে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে। স্রেফ সিটি মেরে পাড়ার সেরা সুন্দরীকে ঘরে এনে তুলছে। ছাতে ডিস্ক অ্যান্টেনা। প্রকাশবাবুর ছেলে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেল। বিমানবাবুর মেয়ে ডাক্তার হয়েছে। নগেন গেট গ্রিলের কারবার করে পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন করছে। সোমেন কেটারিং বিজনেস করে ফুলে ফেঁপে ঢোলকের মতো চেহারা হয়েছে। অসিত ফ্যাফ্যা করে ঘুরছিল, হঠাৎ নেতা হয়ে পাড়ায় লাঠি ঘোরাচ্ছে। তাবড় তাবড় সব লোক এখন অসিতদা অসিতদা করে পেছন পেছন লাইন দিয়ে ঘুরছে। কার্তিকবাবু মেয়ের বিয়ে দিলেন ছ-লাখ টাকা খরচ করে। এক একটা ঘুসি এসে পড়ছে আমার মুখে—তুমি পারো না, তুমি কিচ্ছু পারো না। খাচ্ছ দাচ্ছ আর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ছ। একই অফিসে একই পোস্টে বছরের পর বছর। কোনও রকম একটা চেষ্টা নেই।

এই কারণেই আমি সকালে চোখ খুলতে চাই না। যতক্ষণ পারা যায় চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকি। সেই তো একই দিন, একই বরাত। একই ব্লাড প্রেশার ষাট, একশো থেকে চল্লিশ কম। কিছুতেই বাড়ে না। আগে দু-চার ফাইল ওষুধ খেয়েছিলুম। নো রেজাল্ট। চোখ বুজলেই দুনিয়া ঘুরছে। যেন ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি থইথই অন্ধকারে। নিজেকে ঠেলে তুলতে হয়। সামনে এগোবার জন্যে পেছন থেকে ঠেলতে হয় তেল-ফুরনো গাড়ির মতো।

সেই সকালের কথা ভাবি, যখন কলেজে পড়ি। তখন কে আর খবর রাখত সংসার কী করে চলে, কে কীভাবে চালায়। দিনগুলো সব পাখির মতো উড়ে যেত। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি। আমার সেই সহপাঠীর নাম ছিল শর্মিলা। তার লেখা একটা দুটো চিঠি এখনও আমার কাছে আছে। অসফল লোকদের এইটাই স্বভাব, চলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া যত তুচ্ছ জিনিস স্যুভেনিরের মতো সংগ্রহ করে রাখে। বর্তমানটা যাদের তেজী ঘোড়া, সেই ঘোড়সওয়ারা সব সময় কেল্লা জয় করতে ছোটে। গোটাকতক পাখির পালকের দিকে তাদের আর নজর থাকে না। এইসব মানুষকে আমি রাতের সরাইখানায় দেখেছি। সামনে মদের গেলাস, দুহাতে ধরে দাঁত দিয়ে মুরগির ঠ্যাং ছিঁড়ছে। পাথর-কোঁদা মুখ। গোলার মতো চোখ। তারা কেবল ছুটছে, লাখ বেলাখের ধান্দায়। তাদের জগতে প্রেম নেই, গান নেই। দেহ আছে, শব্দ আছে। ঘোড়া ছোটানোর টগবগ শব্দ।

একটা পাখি উড়ে এসেছিল, আবার উড়ে চলে যাওয়ার সময় দুটো পালক ঝরিয়ে গিয়েছিল। শর্মিলা সেই পাখি। গোটাকতক চিঠি যেন সেই পালক। সেসব কলেজ দিনের কাব্যময় কথা! ছোট ছোট নির্দেশ। ‘ হেদোর দক্ষিণে সোজা হেঁটে যাও, কোথাও থামবে না, ব্রাহ্মসমাজের সামনে চলার গতি কমাবে, আমি তোমাকে পেছন দিক থেকে ধরে ফেলব। তারপর টপ করে একটা ট্রামে।’ অন্যের নজর এড়াবার জন্যে এইসব লুকোচুরি। পঁয়ত্রিশ বছর আগের কলকাতার ট্রাম ধর্মতলার দিকে ছুটছে, একটা ছেলে একটা মেয়ে, প্রেমিকারা ঠিক মেয়েও নয়, অশরীরী একটা ভাব। চাঁদের আলোর সুতো দিয়ে বোনা ওড়নার মতো। ধর্মতলায় তখন কত ভালো-ভালো সিনেমা হল। ময়দান তখন কত সুন্দর। গঙ্গার ধারে কত মায়া।

তখন কে জানত, সংসারের ভিত হল টাকা। ধমনীর রক্তস্রোত হল টাকা। সম্পর্ক হল টাকা। সম্মান হল টাকা। আলো হল টাকা। প্রেম হল পানমশলা। পেট-টেট বেশ ভরে যাওয়ার পর মুখে ফেলা যেতে পারে। এক ধরনের মৌজ। আমাদের কালের প্রেম ছিল পূজার মতো। সসম্ভ্রমে মেলামেশা। অনেক কথা, অনেক বেড়ানো। অনেক বিস্ময়। শরীরে শরীরে ঘষাঘষির চেষ্টাটা মনে হত দানবীয়। সেকালের প্রেম মানুষকে দেবদূত করে তুলত।

কলেজ থেকে বেরোবার পর কে কোথায় চলে গেল। শর্মিলা চলে গেল বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। কেন গেল সেই জানে। মনে হয়, সাফল্যের আনন্দে তার দিগন্ত অনেক বড় হয়ে গেল। কলকাতা তাকে আর ধরে রাখতে পারল না। বড় ঘরের মেয়ে। কলকাতার মতো শহরে চার বিঘে জমির ওপর বিশাল বাড়ি। গ্যারেজে ভকসহল গাড়ি। তার কি আর কলকাতায় থাকা সাজে। যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিটাও আমার কাছে আছে। পড়ে পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে। মেয়েরা কত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারে, ছেলেরা তত তাড়াতাড়ি পারে না। মেয়েদের মন পদ্মপাতার জলের মতো টলটলে। একটু কাত হলেই গাড়িয়ে পড়ে যায়। সেই শর্মিলার শেষ চিঠি। শুরু হয়ে গেল তার নতুন জীবন। আমি কিন্তু খবর রেখেছিলুম। তাদের সেই চার বিঘে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়াতুম। বড়লোক আত্মীয়স্বজনের যাওয়া-আসা চোখে পড়ত। গাড়ি ঢুকছে, গাড়ি বেরোচ্ছে। তাদের মুখচোখের হাবভাবই আলাদা। বাড়িটার সামনে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে আসতুম। তখনই বুঝেছিলুম, আমরা যে জাতিভেদ, বর্ণভেদের কথা বলি সেটা একরকম, আসল, ভেদাভেদটা এইরকম, বড়লোক, মধ্যলোক, ছোটলোক অর্থাৎ ধনী মধ্যবিত্ত, দরিদ্র। এই তিনের এক পংক্তিতে বসা আদৌ সম্ভব নয়। কলেজে শর্মিলা আমার সঙ্গে যতটুকু পাগলামি করেছে সেটা আর কিছুই নয়, একটা অ্যাডভেঞ্চার। একটু মুখ পালটানো, তা ছাড়া ছাত্রদের মধ্যে অর্থনৈতিক বিভেদটা তেমন চোখে পড়ে না। কেউ তেমন পাত্তা দেবে না। ছাত্রদের মধ্যে জাতিভেদটা এইরকম, ভালো ছেলে, মাঝারি ছেলে, খারাপ ছেলে। ভালো ছেলে বলে আমার সামান্য সুখ্যাতি ছিল। আমার ওপরে আমার সংসার বাজি ধরে রেখেছিল। ধার-দেনা করে পড়ানো। ভালো রেজাল্ট আমাকে করতেই হবে। পরে অবশ্য বোঝা গিয়েছিল, ভালো রেজাল্টের সঙ্গে সফল জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। তার জন্যে দরকার কানেকশন। তার জন্যে হতে হবে স্মার্ট, চোখেমুখে কথা কইতে হবে। এর টুপি ওর মাথায় পরাতে হবে। অভদ্র, ইতর, ছোটলোক হতে হবে। আদর্শ বিসর্জন দিতে হবে। সংস্কার বদলাতে হবে। একটা শিক্ষিত অমানুষ হতে হবে।

হঠাৎ শর্মিলাদের বাড়ি একদিন আলোর মালায় সেজে উঠল। সানাই বেহাগে তান ধরল। গাড়িতে গাড়ি ছয়লাপ। বেশ ভারী ভারী লোকজনের আনাগোনা। আমার হুকে-ঝোলা জীবন খুলে পড়ে গেল। আঘাত তো একটা লাগবেই, স্থায়ী আঘাত। প্রথম প্রেম বড় সাংঘাতিক। শর্মিলা আমার জীবনে সরে গিয়ে আর একজনের জীবনে বউ হয়ে বেঁচে উঠল। তিনি এখন কলকাতার খুব নামি একজন হার্ট স্পেসালিস্ট। মানুষের হৃদয়ের খবর রাখেন। এই হৃদয়ে অবশ্য প্রেম থাকে না, একটা পাম্প মাত্র। শরীরের রক্ত টেনে তোলে, ঠেলে নামায়। এই পাম্প তিনি মেরামত করেন। বছরে একবার সস্ত্রীক বিলেতে যান। শর্মিলা তাঁকে একটি ছেলে একটি মেয়ে উপহার দিয়েছে। দুজনেই বিলেতে। এই পোড়া দেশ তাদের জন্যে নয়।

খারাপটা কী হয়েছে? যাকে তুমি ভালোবাসো তার সর্বাধিক ভালোই তো তুমি চাইবে। তোমার প্রেম ছিল, কিন্তু ক্ষমতা ছিল না। জীবন একটা মই। যে তরতর করে উঠতে পারে, সে একটা সুখের ছাদ পায়। সেখানে আলো, খোলা বাতাস, ফুলগাছের টব, দূর দৃশ্য, শীতের কমলালেবু রোদ, পুণির্মার চাঁদ, পাখির গান। যে উঠতে পারে না, সে পড়ে থাকে নোনাধরা বারো বাই দশ ঘরের আধময়লা বিছানায়। সকাল থেকেই সংসার তার কানের কাছে অভাবের খোলকত্তাল বাজাতে থাকে— ‘হল না হল না’। যা অনেকটা বলো হরি, হরি বোলের মতোই শোনায়।

 কাক অতিশয় চতুর পক্ষী কখনো ঠোকরায় না

 মানুষ অতিশয় নির্বোধ বারেবারে বেলতলায় যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *