খোদার কসম
ওদিক থেকে মুসলমান আর এদিক থেকে হিন্দুরা তখনো আসছে যাচ্ছে। ক্যাম্পের পর ক্যাম্প ভরে যাচ্ছে। তিল ধারণের জায়গা নেই। সবাইকে তবুও ঠাসা হচ্ছে যতক্ষণ একেবারেই অসম্ভব না হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যরক্ষার কোনো বন্দোবস্ত নেই। ক্রমাগত রোগ ছড়াচ্ছে। কিন্তু সেদিকে কারো হুঁশ নেই! কী অদ্ভুত সময়!
আটচল্লিশ সালের গোড়ার দিকের কথা। মার্চ মাস। দুদিকের স্বেচ্ছাসেবীর দল মহিলা আর বাচ্চাদের উদ্ধার করে যাচ্ছে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে যোগ দিয়েছে এই কাজে। এদের উদ্যম দেখে আমারই অবাক লাগত। মানুষই মানুষের ডেকে আনা সর্বনাশ দূর করার চেষ্টা করছে! হারানো সম্মান যাতে আর না হারায় তার চেষ্টা! কিন্তু কেন? যাতে নিজের গায়ে আঁচ না লাগে? যাতে হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে যায়? নাকি যাতে মনুষ্যত্ব দিয়ে ক্ষতে প্রলেপ লাগানো যায়? বুঝতে পারতাম না, কিন্তু এই নিরন্তর চেষ্টার প্রশংসা না করে থাকা যায় না।
এদেরকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হত। যারা মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত তারা কখনো এপ্রান্তে, কখনো ওপ্রান্তে। নাগাল পাওয়াই মুশকিল ছিল। আশপাশের লোকও সাহায্য করত না। অদ্ভুত সব ঘটনা কানে আসত। একবার একজন অফিসারের কাছে শুনলাম যে সাহারনপুরে দুজন মেয়ে পাকিস্তানে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকার করেছে। আরেকজন বলল, যখন জলন্ধরে জোর করে কোনো একটি মেয়েকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, বাড়ির লোক নাকি তাকে এমনভাবে বিদায় জানিয়েছিল যেন সে দূরদেশে স্বামীর কাছে যাচ্ছে। আরো শুনতাম, উদ্ধার হওয়া বেশ কিছু মেয়ে পরিবারে ফিরে যাওয়ার ভয়ে রাস্তাতেই আত্মহত্যা করেছে। কয়েকজন আঘাত বরদাস্ত করতে না পেরে পাগল হয়ে গেছে। কেউ কেউ মদে আসক্ত হয়ে পড়েছে; তারা তেষ্টা পেলে মদ চাইছে আর অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে।
এইসব মেয়েদের কথা মনে পড়লেই আমার মনে হত ওদের ভেতরে বাড়তে থাকা ভ্রূণগুলোর কথা। এই শিশুদের দায়িত্ব কার? হিন্দুস্তান না পাকিস্তানের? এই ন’মাসের শ্রমের পারিশ্রমিক দেবে কে? এসব কোন নরকের খাতায় লেখা হবে? সে খাতার কোনো পাতা কি আদৌ এখনও খালি পড়ে আছে!?
শত শত মহিলা আমদানি হচ্ছিল, শত শত রপ্তানি হচ্ছিল।
আমি ভাবতাম এদের অপহৃত কেন বলা হয়? আমার তো মনে হত অপহরণ বেশ একটা রোমান্টিক ব্যাপার! তাতে ছেলে-মেয়ে দুজনেই ভাগ নেয়। অনেকটা দুরুদুরু বুকে খাদে একসঙ্গে ঝাঁপ দেওয়ার মতো। এ কেমন অপহরণ! একটি নিরপরাধ নিরীহ মেয়েকে জোর করে ধরে নিয়ে কোঠায় বন্ধ করে দেওয়া! কিন্তু সেই সময়টা কোনো যুক্তি-বুদ্ধির ধার ধারছিল না। গরমকালেও লোকে যেমন দরজা-জানলা বন্ধ করে শোয়, আমরা তেমনই মনের সব দরজা-জানলা বন্ধ করে রেখেছিলাম; যদিও বোধহয় তখনই খোলার বেশি দরকার ছিল।
বেসাতির মতো শত শত মহিলা আমদানি হচ্ছিল, শত শত রপ্তানি হচ্ছিল।
আরেকদিকে লেখক, কবির দল কলমের আঘাতে এফোঁড় ওফোঁড় করছিল সমাজকে।
এক অফিসার একবার আমায় একটা ঘটনা বলল। ‘কী বলব কী মুশকিল! শহরে শহরে, গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে অনেক খোঁজ-তল্লাশের পর হয়তো কাউকে পাই। তোমায় একটা গল্প বলি শোনো।
আমরা বর্ডারের ওপারে অনেকবার ঘুরে এসেছি। বেশ কয়েকবার একজন মহিলার দেখা পেয়েছি। মাঝবয়সি মুসলমান মহিলা। প্রথমবার দেখেছিলাম জলন্ধরের বস্তিতে। পাগলাটে আচরণ, শূন্যদৃষ্টি, ধুলোমাখা নোংরা চুল, ছেঁড়াখোড়া কাপড়। বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যাওয়া চেহারা। শুধু চোখ দেখে বোঝা যায় যে সে কাউকে খুঁজছে।
আমায় অমুকে বলল, সে নাকি মানসিক চাপে পাগল হয়ে গেছে। পাটিয়ালায় বাড়ি। তার একমাত্র মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; বোধহয় মারা গেছে। কিন্তু মহিলা কিছুতেই মানতে চায় না।
দ্বিতীয়বার আমি তাকে দেখলাম সাহারনপুরে লরির আড্ডায়। তার অবস্থা আগের চেয়েও জীর্ণ। ঠোঁটের উপর ফাটা চামড়ার আস্তরণ, ধুলো আর নোংরায় চুল জটায় পরিণত হয়েছে।
আমি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম যাতে সে এই কাল্পনিক খোঁজ বন্ধ করে। আমি বললাম, ‘মা, তোমার মেয়েকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ সে আমার দিকে তাকালো…’মেরে ফেলেছে! আমার মেয়েকে!!’ তার গলায় পাষাণের দৃঢ়তা, ‘হতেই পারে না। ওকে কেউ মারতেই পারে না।’ বলে সে অন্যদিকে চলে গেল। আমি ভাবলাম, ‘আবার এই ভ্রান্ত খোঁজ।…ওর কেন মনে হয় যে ওর মেয়েকে কেউ মারতেই পারে না?! কেউ মেয়ের গায়ে তলোয়ার ছোঁয়াতে পারে না বা ছোরার আঘাতে তার গলা দু’টুকরো করতে পারে না?! মায়ের মমতা এতও হয়?!’
তৃতীয়বার যখন তার সঙ্গে দেখা হল, তখন তার প্রায় উলঙ্গ দশা। আমি কাপড় দিতে সে নিল না।
আমি আবার বললাম, ‘মা, সত্যি বলছি তোমার মেয়েকে পাটিয়ালাতেই মেরে ফেলেছে।’ পাগলী দৃঢ় গলায় বলল, ‘তুই মিথ্যে কথা বলছিস।’ আমি বিশ্বাস করানোর জন্য বললাম, ‘না মা, আমি সত্যি বলছি। অনেক খুঁজেছ, অনেক কেঁদেছো। এখন আমার সঙ্গে চলো। তোমায় পাকিস্তান পৌঁছে দেব।’ শুনেই সে বিড়বিড় করতে লাগল। করতে করতে হঠাৎ থমকে আমার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বললো, ‘না, আমার মেয়েকে কেউ মারতেই পারে না।’ আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কেন? কেন পারে না?’ সে এবার ধীরে ধীরে বলল, ‘ও ভীষণ সুন্দর যে! অপরূপা! ওকে কেউ প্রাণে কেন, চড়ও মারতে পারে না।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম, ‘এ আবার কেমন সৌন্দর্য! এত সুন্দর সত্যিই কেউ হয় নাকি! সব মায়েরই নিজের সন্তানকে অপূর্ব লাগে। হয়তো ওর মেয়ে সত্যিই সুন্দরী, কিন্তু এই অসময়ে কোন সৌন্দর্য মানুষের রুক্ষ কবল থেকে ছাড়া পেয়েছে!…মায়ের মন! দুঃখ হয়তো এভাবেই নিজের চারদিকে পালাবার অজস্র পথ খুলে দেয়…।’
বর্ডারের ওপারে আরো অনেকবার গেছি আর প্রতিবারই পাগলীকে দেখতে পেয়েছি। তার অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। শরীর যেন হাড়ের কাঠামোতে পরিণত হয়েছে। চলতে গিয়ে নিজের ভারসাম্য রাখতে পারছে না, কিন্তু খোঁজ চলছে। তার বিশ্বাস তখনো অটুট যে তার মেয়ে বেঁচে আছে কারণ সে অপরূপা আর তাই অবধ্য।
অমুকে আমায় বলল ওই পাগলীর সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। তাকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে কোনো পাগলাগারদে রাখাই শ্রেয়। কিন্তু তার জীবনের একমাত্র আশ্রয় এই খোঁজটাকে কেড়ে নিতে আমার মন চাইল না। তার ফোস্কা-পড়া পায়ে হেঁটে বেড়ানোর জন্য এই বিশাল উন্মুক্ত পাগলাগারদের চেয়ে চার দেওয়ালের ঘর আমার বেশি উপযুক্ত মনে হল না।
শেষবার তাকে দেখলাম অমৃতসরে। তার তখন এমনি মৃতপ্রায় অবস্থা যে আমার চোখে জল চলে এল। আমি ঠিক করলাম এবার তাকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদেই ভর্তি করে দেব। সে ফরিদের মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রায়ান্ধ চোখে এদিক-ওদিক দেখছিল।
আমি একজনের সঙ্গে একটা দোকানে বসে অপহৃত মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তারা কোনো হিন্দু ব্যবসায়ীর বাড়িতে আছে এরকম খবর পেয়েছিলাম। কথাবার্তার পর আমি উঠে দাঁড়ালাম পাগলীর কাছে যাওয়ার জন্য, যদি কোনওক্রমে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাকিস্তান নিয়ে যেতে পারি। এমন সময় এক দম্পতি সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। মেয়েটার মাথায় ঘোমটা। সঙ্গে এক উচ্ছল শিখ যুবক। ধারালো, বলশালী চেহারা। পাগলীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যুবক হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। দু’পা পিছিয়ে সে মেয়েটার হাত ধরল। মেয়েটা চমকে ঘোমটা খুলে ফেলল। সেই মুখের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।
আমি ওদের একদম কাছেই ছিলাম। পাগলীর দিকে দেখিয়ে যুবক তার অপ্সরার মতো সঙ্গিনীকে বলল, ‘তোমার মা!…’
মেয়েটা এক মুহূর্তের জন্য সেদিকে তাকিয়েই ঘোমটা দিয়ে নিল আর যুবকের হাত ধরে বলল, ‘চলো।’
দুজনে রাস্তা দিয়ে জোরকদমে হেঁটে চলে গেল।
পাগলী অস্থির হয়ে চিৎকার করতে লাগল, ‘আমার মেয়ে!! আমার মেয়ে!!’
আমি তার কাছে গেলাম। জিগ্যেস করলাম, ‘কী বলছ মা?’
সে উত্তেজনায় কাঁপছিল, ‘দেখলাম…আমি দেখলাম…’
আমি আবার জিগ্যেস করলাম, ‘কাকে দেখলে?’
তার কোটরে বসা চোখ দুটো চকচক করে উঠল, ‘আমার মেয়েকে… আমার মেয়েকে দেখলাম…’
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘সে মরে গেছে মা।’
পাগলী আর্তনাদ করে উঠল, ‘তুই মিথ্যে বলছিস!’
আমি ধীরে ধীরে দৃঢ় গলায় বললাম, ‘সে মরে গেছে মা। আমি সত্যি বলছি। খোদার কসম।’…
পাগলীর চোখ দুটো আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ল।