খোট্টাই শরবত

খোট্টাই শরবত

হাতের লেখা খারাপ, নিজের লেখা দেখে নিজেরই লজ্জা হয়৷ সেই লজ্জা নিবারণের জন্যই একটা বাংলা টাইপরাইটার কিনেছিলাম৷

হাতের কাছে গুডফ্রাইডের ছুটি পেয়ে পুরীতে গিয়েছিলাম বেড়াতে৷ ইচ্ছে ছিল একটা বড়ো গল্প ওইখানেই আরম্ভ করব, আর ওইখান থেকেই একেবারে ছাপতে দেব৷ কাজেই সঙ্গে টাইপরাইটারটাও নিতে হয়েছিল৷

বেশ সুন্দর টাইপরাইটার, বেশ স্পষ্ট হরফ৷ সেই মুক্তোর মতো বাংলা হরফগুলো দেখে আমার মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠত! আমি কয়েকদিন আহার নিদ্রা ত্যাগ করে রোজই তার হরফগুলো কাগজের উপর তুলে, লাইনের পর লাইনের মালা গেঁথে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর তন্ময় হয়ে যেতাম৷ এমনই আমার নেশা চেপেছিল যে অনবরত ঠুকে ঠুকে কলটাকে প্রায় বিগড়ে তোলবার জো করেছিলাম৷

পুরীর সমুদ্র থেকে একটু দূরে আমার এক বন্ধুর একটি ছোট্ট বাড়ি আছে৷ আমি পুরীতে গেলেই সেইখানে আড্ডা মারি৷ এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ বাড়িখানি অনেক দিনের পুরোনো কিন্তু বন্ধুবর সেখানিকে মেজেঘষে বেশ ঝকঝকে করে রেখেছেন৷ বাড়ির তত্ত্বাবধান করে এক উড়ে চাকর৷ বন্ধুবরের অতিথিরা কেউ গেলে সেই ঘরদুয়ার খুলে দিয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করে৷ এ ছাড়া বাড়িতে আর কেউ লোক থাকে না৷

বন্ধুবর এই বাড়ি কাউকে ভাড়া দেন না৷ তিনি নিজেও খুব অল্পই সেখানে গিয়ে থাকেন, এবং আমার মতো দু-টি-একটি অন্তরঙ্গ বন্ধু অবরে- সবরে সেই বাড়িতে প্রবেশ করবার অধিকার পায়৷ কাজেই বাড়িখানা প্রায় সব সময় বন্ধই থাকে৷ বোধ হয় এই জন্যেই আশেপাশের লোকেরা বাড়িখানাকে পোড়োবাড়ি বলে৷ আগে ভাড়া নেবার জন্যে অনেক খোঁজ আসত, কিন্তু এখন কেউ আর খোঁজও করে না-বল ওটা হানাবাড়ি৷

আমি অনেকবার এ বাড়িতে এসেছি৷ কিন্তু বাড়িখানা যে হানা তার কোনো পরিচয় কখনো পাইনি৷ কিন্তু অনেকে নাকি পেয়েছে তার গল্প মাঝে মাঝে আমার কানে আসত৷ আশপাশের অভ্যাগতরা আমাকে সকাল বেলা সেই বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে প্রায়ই খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন-“হ্যাঁ মশাই, কিছু দেখলেন কি?” আমি বলতাম-“কই না, এমন আশ্চর্য কিছুই তো দেখিনি৷” তাঁরা আমার উত্তরে হতাশ হয়ে আড়ালে পরস্পর বলাবলি করতেন-“খেস্টান যে! ওরা কি ওসব দেখতে পায়!” আমি খ্রিস্টান হলাম কী করে বুঝতে পারতাম না৷ বোধ হয় বাড়িতে মাঝে মাঝে মুরগির যে সব পালক উড়ত তারাই ওই খবর রটিয়েছে৷

বাড়িতে তিনখানি মাত্র ঘর৷ আমি দু-খানি ব্যবহার করতাম৷ একখানি একেবারে আষ্টেপৃষ্টে বন্ধ থাকত৷ কোথাও এমন ফাঁক ছিল না যে দেখা যায় তার মধ্যে কী আছে৷ উড়ে চাকরটার মুখে শুনেছি সে ঘর কখনো খোলা হয় না, তার চাবিও তার কাছে থাকে না, এবং তার মধ্যে যে কী আছে তাও সে জানে না৷

বাড়িটাকে নয়, এই ঘরটাকে কেমন আমার হানা বলে মনে হত৷ বাড়িটার আর দু-খানি ঘর বেশ পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন চুনকাম করা কিন্তু এই ঘরটার সামনে দাঁড়ালে বেশ বোঝা যেত যে অনেকদিন থেকে এর গায়ে সংস্কারের হাত পড়েনি৷ নোনা লেগে এর গায়ের বালি জায়গায় জায়গায় একেবারে খসে পড়ে ভেতরের ইটগুলি জরজর হয়ে উঠছে৷ দেখলে ঠিক মনে হত যেন কোনো একটা ভীষণ জন্তু তার তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে এর গায়ের মাংস স্থানে স্থানে খুবলে নিয়েছে, সেখানকার ঘাগুলো দগদগ করছে৷ রাত্রের অন্ধকারে হঠাৎ এই লাল লাল ক্ষতগুলোর দিকে চোখ পড়লে সর্বাঙ্গ কেমন চমকে উঠত৷ এই ঘরখানার এমন দুর্দশা কেন, বুঝতে পারতাম না৷ বন্ধুবরকেও কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি-কেমন একটা সংকোচ হত-মনে হত যে এর সঙ্গে যে কথা জড়িত আছে, তা যেন চাপা থাকাই ভালো৷

সকাল বেলা পুরী পৌঁছে, টাইপরাইটার প্রভৃতি জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে, আহারাদি সেরে সারাদিনটা ঘুমিয়ে কাটানো গেল৷ কারণ গত রাত্রে গাড়ির ভিড়ে মোটেই ঘুম হয়নি৷ বিকেলে টাইপরাইটারে খানিকক্ষণ হাতটা সড়গড় করে নিয়ে, সন্ধ্যা বেলা সমুদ্রের ধারে একটু ঘুরে এসে রাত্রে গল্প লেখা আরম্ভ করা যাবে ভেবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া গেল৷ সঙ্গে ইকমিক কুকার ছিল, তাতে ডাল চাল আর দুটো ডিম চাপিয়ে দিয়েছিলাম৷ ও আপনিই তৈরি হয়ে থাকবে, ইচ্ছে মতো খাওয়া যাবে৷ বলা বাহুল্য বিদেশে চাকর বামুন নিয়ে যাবার সাধ্য আমার নেই-নিজের সব কাজ আমায় নিজেকেই চালিয়ে নিতে হয়৷

সমুদ্রের ধার থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরছি এমন সময় বিনোদের সঙ্গে দেখা৷ সে মাসখানেক সপরিবারে পুরীতে এসে বাস করছে৷ বিনোদের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে অনেকদিন একসঙ্গে কাটিয়েছি, তারপর অনেকদিন ছাড়াছাড়ি৷ সে এখন বিহারের কোন জায়গায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটি করে৷ বিনোদ আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল, আমারও খুব আনন্দ হল৷ দুই বন্ধুতে গল্প করতে করতে আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম৷ বিনোদ বলল- “তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, বাড়ি গিয়ে এখন কী করবি? আমার বাড়ি চল, দুই বন্ধুতে খানিকটা গল্প করা যাবে৷” অনেকদিন পরে দেখা, বন্ধুর অনুরোধ, তার উপর তার সঙ্গ আমারও ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না, কাজেই বিনোদের বাড়ির দিকে চলতে লাগলাম৷ গল্প লেখার আশা কিছুক্ষণের জন্য বিসর্জন দিতে হল৷ টাইপরাইটারটার গায়ে হাত বুলানোও আজ হবে না দেখছি৷ বিনোদের বাড়ি পৌঁছে দেখি একটা মহাভোজের আয়োজন লেগে গেছে-বাড়ির ছেলেরা গুডফ্রাইডের উৎসবকে কালিয়া-পোলাওর গন্ধে আমোদিত করে তোলবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেছে৷ বিনোদ বলল- “তাহলে তুই খেয়ে যা-অনেকদিন একসঙ্গে বসে দুই বন্ধুতে খাইনি!” আমি বললাম-“বেশ!” ইকমিক কুকারে চড়ানো আমার ডাল ভাতটা নষ্ট হবার কথা একবার মনে পড়ল কিন্তু তাদের বড়োলোক জ্ঞাতিদের সামনে সেই তুচ্ছ কথাটা আর তুলতে পারলাম না৷ খানিক বাদে বিনোদের চাকর দুই গ্লাস শরবত নিয়ে এসে হাজির৷ বিনোদ গ্লাসটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল- “পশ্চিমে থাকি বলে এই খোট্টাই শরবত খাওয়াটা আমার কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে-সন্ধ্যা বেলা এক গ্লাস না হলে চলে না৷ তুইও খেয়ে দেখ শরীরটা বেশ ভালো বোধ করবে!” কী সুমিষ্ট সুগন্ধ শরবত-আমি প্রায় এক চুমুকেই গ্লাসটা শেষ করে ফেলাম৷ বিনোদ বলল-“কেমন খেতে লাগল?” আমি বললাম-“চমৎকার!” সে বলল-“খানিক বাদে আরও চমৎকার বোধ হবে, বেশ খিদে পাবে-শরীরে বেশ স্ফূর্তি বোধ হবে৷ চমৎকার দাওয়াই৷”

দুই বন্ধুতে বসে নানা সুখ-দুঃখের গল্প চলতে লাগল৷ বিনোদের চাকর এসে আলবোলাতে অম্বুরি তামাক দিয়ে গেল৷ আমার তামাক খাওয়া অভ্যেস নেই; বিনোদ বারবার করে বলতে লাগল-“টেনে দেখ হে, বেশ লাগবে! কোনো ভয় নেই!” তার পীড়াপীড়িতে নলটা তুলে নিয়ে ফুড়ুক ফুড়ুক করে টানতে শুরু করে দিলাম৷ প্রথমটা দু-একবার একটু কাশি এল, তারপর কিন্তু টানতে টানতে বেশ মিঠে লাগতে লাগল৷ তামাক টেনে চলেছি, গল্পের স্রোতও চলছে-ছেলেবেলাকার এক কথা একশোবার বলেও যেন আশ মিটছে না! কেবলই মনে হচ্ছে আজ যেন কী আনন্দের দিন! কী আনন্দের দিন! বিনোদের এক-একটা কথাতে কখনো মনটা দুলে দুলে উঠছে, কখনো আবার হো-হো কের হেসে উঠছি৷ বিনোদের সব কথাই ভালো লাগছে, সব কিছুতেই স্ফূর্তি হচ্ছে! বন্ধুর সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা কিনা! বিনোদ বলল-“খিদে বোধ করছিস কি? কিছু খাবি?” বিনোদের প্রশ্নে হঠাৎ পেটের দিকে নজর পড়তেই দেখলাম খিদেটা চনচনে হয়ে উঠেছে৷ আমি বললাম- “এত শিগগির কি আর খাবার তৈরি হয়েছে?” বিনোদ বলল-“খাবারের এখন ঢের দেরি, তুই ততক্ষণ কিছু জলযোগ করে নে৷” এই বলে সে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেল৷ তারপর চাকরকে সঙ্গে নিয়ে একটা থালায় একগাদা কচুরি ও রসগোল্লা এনে হাজির করল৷ আমি সেই খাবারের ডাঁই দেখে বলে উঠলাম-“আমি কি রাক্ষস নকি হে! এত খেলে রাত্রে আর খেতে পারব কেন?” বিনোদ বলল-“যা পারিস খা না৷” বলে সে থালা থেকে একটা রসগোল্লা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে বলল-“এমনি করে মেসের বাসায় এক থালা থেকে দু-জনে কাড়াকাড়ি করে কতদিন খেয়েছি মনে পড়ে?” আমি বললাম-“খুব মনে পড়ে! সে সব আনন্দের দিন কী করে আর ভোলবার হে৷”

কচুরি আর রসগোল্লা মনে হতে লাগল যেন অমৃত! অনেক রসগোল্লা খেয়েছি কিন্তু এমনতর জীবনে কখনো খাইনি৷ যতই খাই, ততই মনে হয় আর একটা খাই৷ দেখতে দেখতে সেই রসগোল্লার ডাঁই শেষ হয়ে গেল, আমার নিজের খাওয়া দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম৷ তবু যেন মনে হতে লাগল, যেমন পেটের খিদে ঠিক তেমনই আছে-একী ভেলকি নাকি! বিনোদ বলল-“আজ ভারি একটা মজা হয়েছে”-আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললাম-“তাই নাকি!” মজা এই কথাটা শুনেই আমার যতগুলো মজার কথা জানা ছিল যেন সবগুলো একসঙ্গে মনে পড়ে কেবলই হাসি পেতে লাগল৷ বিনোদ বিরক্ত হয়ে বলল-“আঃ, শোন না মজার কথাটা৷” আবার ওই মজা! শুনেই আমার পেট থেকে খিলখিল করে হাসি বেরিয়ে আসতে লাগল- বিনোদের মজার কথাটা যে কী তা আর শোনা হল না৷ বিনোদ আমার হাসিটা দেখে শেষে নিজেই হাসতে শুরু করে দিলে৷ দু-বন্ধুতে একসঙ্গে খুব খানিক হেসে যখন থামলাম, ছ্যাঁৎ করে কে যেন মনে করিয়ে দিল তখন-এ কী ব্যাপার! এত হাসছি কেন?

রাত অনেকখানি এগিয়ে চলে গেল-খিদেটাও খুব প্রচণ্ড বোধ হতে লাগল, কিন্তু তখনও খাবার আসে না৷ মনটা একবার খুঁতখুঁত করে উঠল- গল্প লেখাটা আজ আর আরম্ভ হয় না দেখছি! তারপরই মনে হল গল্পটা কী? কী তার প্লট? দেখলাম প্লটটা একেবারেই ভুলে গেছি-কে যেন মাথা থেকে একেবারে চেঁচে বার করে নিয়ে গেছে৷ সেটাকে খুঁজে বার করতে গিয়ে বিড়বিড় করে অনেকগুলো নতুন প্লট চোখের সামনে বেরিয়ে এল৷ তার মধ্যে কোনটা আমার এবারকার গল্পের প্লট তাই খুঁজে ঠিক করছি এমন সময় বিনোদ আমার পিঠে একটা থাবড়া মেরে বলে উঠল-“কীরে হঠাৎ অমন গম্ভীর হয়ে গেলি কেন?” আমি চমকে উঠে বললাম, “না, গম্ভীর হব কেন?” সে বলল-“নেশা হয়েছে বুঝি?” আমি বললাম-“নেশা কীসের?” “ওই যে শরবতের৷” বলতে বলতে মাথাটা কেমন যেন বোঁ করে একবার ঘুরে গেল! বিনোদ বলল- “শরবতে একটু সিদ্ধি ছিল রে৷”

কথাটা শুনে আমার কেমন সন্দেহ হল৷ বোধ হল যেন একটু নেশা হয়েছে৷ আমি কখনো সিদ্ধি খাইনি-সিদ্ধির নেশা কীরকম তাও জানি না, এই কি সিদ্ধির নেশা? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ আমি যেমন মানুষ ঠিক তেমনই তো আছি; ঠিক ঠিক কথা বলছি৷ তবে আবার নেশা কোথা থেকে হল? এইসব কথা ভাবছি, বিনোদ বলে উঠল-“তুই বড্ড গম্ভীর হয়ে উঠছিস, নিশ্চয় তোর নেশা হয়েছে; কী ভাবছিস বল তো?” আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম-“দুর, ভাবনা আবার কীসের৷” বললাম বটে কিন্তু সত্যি নানা রকমের আবোলতাবোল ভাবনা মাথার ভেতর ক্রমাগতই আসতে লাগল৷ বিনোদ বলল-“তবে বুঝি তোর খিদে পেয়েছে৷” আমি বললাম-“তা ভাই পেয়েছে৷” বিনোদ বলল-“রোস খাবার জায়গা করতে বলি৷” বলে সে উঠে গেল৷ আমি একলা বসে রইলাম৷ বসে বসে ভাবছি, হঠাৎ মনে হল বিনোদ তো অনেকক্ষণ গেছে, বোধ হয় ঘণ্টা দুই হবে, এখনও ফিরল না কেন? তবে কি আমায় খাবার দিতে ভুলে গেল? ওরা কি বাড়িসুদ্ধ সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? তাহলে এখন উপায়? আমি তবুও বসে বসে বিনোদের অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ কিন্তু বিনোদ ফিরে এল না৷ বসে বসে দেখতে লাগলাম ঘরে যে আলো জ্বলছে তার প্রদীপের তেল একটু একটু করে কমে আসছে, ক্রমেই আলো মিটমিটে হয়ে আসতে লাগল-এই নিভে যায় যায়! নিভে গেলেই তো একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে৷ সর্বনাশ! জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখলাম ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, আকাশে একটুও আলো নেই-বোধ হয় মেঘ করেছে৷ না মেঘই তো করেছে!

বিনোদ ধাঁ করে এসে বলল-“চল খবার তৈরি!” খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলাম৷ চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়-নানা জাতীয় খাবার প্রস্তুত৷ দেখে জিভে জল আসতে লাগল৷ তার সুগন্ধটা নাকের ভেতর দিয়ে একেবারে পেটের মধ্যে প্রবেশ করে পাকস্থলিকে নানা ভঙ্গিতে নাচিয়ে তুলতে লাগল৷ বিনোদ বলল-“খিদেটা কেমন বোধ করছিস?” আমি বলাম-“খুব!” সে বলল-“দেখলি খোট্টাই শরবতের গুণ!”

সত্যি বটে, এত রাক্ষুসে খিদে কখনো বোধ করিনি৷

এক মনে খেয়ে চলেছি, হঠাৎ মনে হল চোরে যদি নতুন টাইপরাইটারটা চুরি করে নিয়ে যায়? বাড়িতে তো কেউ নেই৷ একটা সামান্য তালা দিয়ে দরজা বন্ধ করে এসেছি, সে তালা ভাঙতে কতক্ষণ! এই কথাটা মনে হতেই মাথার ভেতরের রক্তটা চনচন করে উঠল৷ অনেক সাধের এই টাইপরাইটারটি আমার৷ অনেক কষ্টে সংগ্রহ, তাকে বড়ো ভালোবাসি আমি! শেষে সেটা চুরি যাবে? এই কথাটা মনে হতেই আহারের সমস্ত স্বাদ যেন একেবারে চলে গেল৷ বিনোদ বলল-“কীরে হাত গুটিয়ে বসলি কেন?” আমি আবার খেতে শুরু করলাম বটে, কিন্তু তেমন উৎসাহ আর রইল না৷ ঘুরেফিরে কেবলই টাইপরাইটার জন্যে উৎকন্ঠা মনের মধ্যে জাগতে লাগল৷

মনে হতে লাগল বিনোদের খাওয়ার পালা যেন আর ইহজন্মে শেষ হবে না! এখনও গেলে বোধ হয় টাইপরাইটারটাকে চোরের হাত খেতে রক্ষা করা যায়, কিন্তু বিনোদ স্টুপিড কি তা হতে দেবে? খাবারের পর খাবারই আনছে, আর খাবারগুলো চিবোচ্ছে তো চিবোচ্ছেই-যেন আর গিলতেই পারে না৷ খেতে আমার আর মোটেই রুচি হচ্ছিল না৷ আমি হাত গুটিয়ে নিয়ে বললাম- “আমার উদরে আর তিল ধারণের স্থান নেই ভাই!” বিনোদ তবুও “খা খা” করে আরও একটু খাওয়ালে৷ শেষে আমার পীড়াপীড়িতে খাওয়া শেষ করে বিনোদ যখন বলল-“আর এক ছিলিম তামাক খেয়ে যা”-আমি আর সে কথায় কর্ণপাত না করে বাড়ি থেকে হনহন করে বেরিয়ে পড়লাম৷ টাইপরাইটারের জন্যে আমার মন ভারি ছটফট করছিল৷ একটু অগ্রসর হতেই দেখি একটা লোক একটা লন্ঠন হাতে করে পিছন থেকে ছুটে এল৷ অন্ধকার রাত্রি দেখে আমার জন্যে বিনোদ আলো পাঠিয়ে দিয়েছে৷ কালো কালির মতো অন্ধকার রাত্রি-লন্ঠনের আলোয় হাত দুই মাত্র জায়গা একটু একটু দেখা যায়, আর বাকি সমস্ত পৃথিবীটা মিশ অন্ধকারে ডুবে আছে৷ মনে হতে লাগল যেন সেই অন্ধকার সমুদ্র পেরিয়ে তবে বাড়ি পৌঁছোতে পারব৷ চলেছি তো চলেছি৷ অনেকখানি চলে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মনে হল এখনও বাড়ি পৌঁছোলাম না কেন? বিনোদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি এক রশি পথও তো নয়৷ চাকরটাকে জিজ্ঞেস করলাম-“হ্যাঁরে পথ হারালাম নাকি?” সে বলল-“না বাবু এই তো সোজা পথ; হারাব কেন?” আবার চলতে লাগলাম-কতদূর চলে গেলাম-পা দুটো যেন ভেঙে পড়তে লাগল, তবুও বাড়ি পৌঁছোলাম না৷ এ কী হল? এইটুকু পথ আজ এতখানি হয়ে গেল কেমন করে? ভেবে যেন কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না৷ চাকরটাকে জিজ্ঞেস করতেও কেমন লজ্জা হতে লাগল৷ কেবলই মনে হতে লাগল আজ সারারাত হেঁটেও বুঝি বাড়ি পৌঁছোতে পারব না৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, যেমন এই কথা মনে হওয়া অমনি চক্ষের নিমেষে কে যেন আমাকে সটান তুলে নিয়ে সোঁ সোঁ করে আকাশপথে উঠতে লাগল৷ কত উচুতে যে তুলে নিয়ে গেল তা বলতে পারি না৷ যেখানে নক্ষত্রগুলো আছে বোধ হয় ততটা উঁচুতেই হবে৷ তারপর ওই অতটা উঁচু থেকে আমায় টুপ করে ফেলে দিল৷ আমি ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে নীচের দিকে পড়তে লাগলাম৷ যেমন মাটিতে এসে পা দিয়েছি অমনি বিনোদের চাকরটা লন্ঠনটা উঁচু করে তুলে ধরে বলে উঠল-“এই যে বাবু আপনার বাড়ি৷” চেয়ে দেখি সত্যিই তো বাড়ি৷

আমি বাড়ি পেয়ে যেন বর্তে গেলাম৷ তাড়াতাড়ি চাবি খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ বিনোদের চাকরটা চলে গেল৷ অতখানি উঁচু থেকে পড়াতে আমার মাথাটা তখনও বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল, আমি চোখে কানে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না৷ সেইজন্যে রোয়াকে ওঠবার সিঁড়িটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল, অনেকক্ষণ খুঁজে পেলাম না৷ তারপর হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি বার করে রোয়াকে উঠলাম৷ এই রোয়াকে উঠে প্রথমেই সেই হানাঘরটা, যাতে দিনরাত চাবি বন্ধ থাকে, সেইটে সামনে পড়ে৷ আমি তার কাছে আসতেই মনে হল দরজা যেন এতক্ষণ খোলা ছিল, আমি আসতে খুট করে কে বন্ধ করে দিল! বুকের ভেতরটা যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় ধক করে উঠল৷ আমি দরজার গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে একবার ঠেললাম-দরজাটা ফুস করে খুলে গেল৷ এ কী ব্যাপার? দরজা আজ দশ বছর খোলা হয়নি, যাকে কেউ কখনো খুলতে দেখেনি, সেটা আজ হঠাৎ এভাবে খুলে গেল কেমন করে? আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করব কি না৷ গাটা কেমন ছমছম করতে লাগল৷ পকেট হাতড়ে দেখলাম একটা দেশলাই নেই যে আলো জ্বালি৷ অন্ধকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখতে লাগলাম৷ ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না-সব জিনিসগুলো শুধু আবছায়ার মতো বোধ হচ্ছিল৷

এই চিরদিনের বন্ধ ঘরের ভেতর না জানি কী অদ্ভুত জিনিস আছে, তাই দেখবার জন্যে ভারি একটা কৌতূহল হচ্ছিল৷ অথচ ঢুকতে কেমন ভয়ও করছিল, কাজেই যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেইখানেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম৷ দেখতে দেখতে অন্ধকারটা চোখে অনেকখানি সয়ে এল৷ তখন ঘরের ভেতরের জিনিসগুলো একটু একটু স্পষ্ট হয়ে দেখা যেতে লাগল৷ ঘরের একধারে একখানি ছোট্ট খাটিয়া-তাতে চাদর, বালিশ দিয়ে সুন্দর বিছানা পাতা রয়েছে৷ সেই বিছানার উপর কেউ শুয়ে আছে কি না ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না৷ একবার মনে হল কে যেন ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরল৷ একটা কোণে একটা তোরঙ্গ রয়েছে, তার গায়ে একখানা সাদা টিকিট মারা৷ তার পাশেই একটা আলনা, তার গায়ে কাপড়, চাদর, তোয়ালে, গামছা ঝুলছে- একটা আঁকড়িতে একটা ছাতা ও একটা লাঠি, নীচে এক জোড়া চটি জুতো৷ একটু দূরে একটা কুঁজো, তার মুখে একটা গ্লাস চাপা৷ আরও টুকরোটাকরা জিনিস রয়েছে, ঠিক বুঝতে পারলাম না৷

ঘরের ভেতরটা দেখে মনে হল, নিশ্চয় এখানে কেউ বাস করে৷ নইলে দশ বচ্ছর যে ঘর দিনরাত বন্ধ থাকে সে ঘরে লোকের প্রতিদিনের ব্যবহার্য এই সব জিনিস নিয়ে এমন পরিপাটি করে সাজানো হবে কেমন করে? কিন্তু কে বাস করে? সে গেলই বা কোথায়? এর চাবিই বা সে পেল কেমন করে? আজ দিনের বেলায় তো এ ঘর দেখেছি তাতে তো একবারও মনে হয়নি এর মধ্যে কোনো জ্যান্ত মানুষ আছে বা থাকতে পারে? এ ঘরের চেহারা দেখলে বোধ হয় যেন এ একেবারে গালামোহর করা ঘর৷ তবে এর মধ্যে মানুষ ঢুকলো কেমন করে? এ কী ভৌতিক কাণ্ড৷

এই বাড়ির সম্বন্ধে আশপাশ থেকে যত ভূতুড়ে গল্প শুনেছিলাম, সব একে একে মনে পড়ে বুকটা কেমন দুরদুর করতে লাগল৷ মনে হতে লাগল, চোখের সামনে বোধ হয় এখনই একটা বিকট আকৃতির পুরুষ দেখতে পাব৷ কিংবা ধবধবে সাদা কাপড় পরা এতখানি ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়ে ছায়ার মতো পাশ দিয়ে চলে যাবে৷ হয়তো কারা এখনই বিকট অট্টহাসি হেসে উঠবে, নয়তো খোনা গলাতে কেউ বলতে থাকবে আমাকে-“এখানে কী করতে এঁসেছিস? দূঁর হঁ৷ বেঁরোঁ৷”

কিন্তু ভয় পাওয়া নয়! ভয় পেলেই ভূতের ভয় আরও চেপে বসে! সেই জন্যে বুকে সাহস নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম৷ কিন্তু তবু পা দুটো আমার কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল৷

হঠাৎ কেমন একটা শিরশিরে বাতাস এসে গায়ে লাগল, তারপর দেখি একটা বিশ্রী কিঁ-ই-চ শব্দ করে দরজাটা কে বন্ধ করে দিল৷ সে কে রে বাপু? অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ কোনো সাড়া পেলাম না৷ তারপর আস্তে আস্তে দরজাটাকে ঠেলে আবার খুলে দিলাম৷ ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে৷ দরজা যে বন্ধ করেছিল, তাকে কই দেখতে পেলাম না৷ ভূতই হোক, মানুষই হোক, নিশ্চয় কেউ ঘরের মধ্যে আছে, নইলে দরজা বন্ধ করে কে? আমি একটু গলা বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম-ওই কোণের দিকটায় কাউকে দেখা যায় কি না, কাউকে দেখতে পেলাম না৷ কিন্তু চোখে পড়ল আমার টাইপরাইটারটা৷ একটা টেবিলের উপর সেটা বসানো রয়েছে৷ আমাকে দেখে সেই অন্ধকারে তার ধবধবে সাদা দাঁতগুলো হাসিতে ঝকঝক করে উঠল৷ মনে হল বেচারা যেন কী একটা সঙিন বিপদে পড়েছিল, আমায় দেখে বাঁচল৷

তখনই আমি বুঝতে পারলাম, এ ভূত নয়, ভেলকি নয়-এ চোরের কাণ্ড! আমি গোড়াতে যা ভয় করেছিলাম, এ তাই৷ চোর ব্যাটা টাইপরাইটার চুরি করে পালাচ্ছিল, আমার সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি এইখানে রেখে পালিয়েছে, নয় লুকিয়েছে৷ আমি জোর গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম- “ঘরের ভেতর লুকিয়ে আছিস, এখনই বেরিয়ে আয়৷ নইলে আমি খুন করব-খুন করব৷”

আমি অনেক চেঁচালাম, কিন্তু কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে এল না৷ আমার হাতে খুন হবার জন্যে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রইল৷ তবে করি কী? কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারলাম না৷ একবার ভাবলাম নিজের ঘর থেকে একটা আলো জ্বেলে নিয়ে আসি, কিন্তু তখনই মনে হল সেই ফাঁকে চোর যদি টাইপরাইটারটা নিয়ে পালায়৷ টাইপরাইটারকে বাঁচাতেই হবে৷ আমি আচ্ছা করে মালকোঁচা এঁটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম৷ মনে হল গায়ের কাছ দিয়ে হাওয়ার মতো কী একটা সরে গেল৷ যাক চোরটা তাহলে চুপিচুপি পালিয়েছে৷ আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল৷ আমি ধুঁকতে ধুঁকতে খাটিয়ার উপর গিয়ে বসে পড়লাম৷

খাটিয়ার ওপাশে ছোট্ট একটা টেবিল-তার উপর টাইপরাইটারটা বসানো, তার সামনে একখানি ছোট্ট টুল৷ আমি সেইদিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম৷ যাক, টাইপরাইটারটা তাহলে বাঁচল৷

শরীর অত্যন্ত শ্রান্ত বোধ হচ্ছিল৷ খাটিয়ার উপর নরম বিছানা পেয়ে মনে হচ্ছিল এইখানেই চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ি৷ কিন্তু কার এ বিছানা কে জানে? সে হয়তো শেষ রাত্রে ফিরে এসে চ্যাংদোলা করে তুলে কোথায় ছুড়ে ফেলে দেবে৷ তা দিক গে৷ আর এখান থেকে উঠতে পারি না৷ সর্বশরীর ঝিমিয়ে আসছে৷ খট খট খট খট৷ খট খট খট! খট খট! টুং! আমি ধড়মড় করে সোজা হয়ে গেলাম৷ খট খট খট! খট খট খট! একী, টাইপরাইটার আপনি আপনি এরকম হরফ লিখে চলেছে কীরকম? তাকে ভূতে পেল নাকি? আমি চোখ দুটো বড়ো করে টাইপরাইটারের এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি, হঠাৎ নজরে পড়ল, টাইপরাইটারের সামনে টুলের উপর কে যেন বসে রয়েছে৷ ঠিক মানুষ নয়, ছায়াও নয়, ছবিও নয়, তাকে দেখাও যাচ্ছে না, তবু স্পষ্ট বোধ হচ্ছে সে বসে রয়েছে টাইপরাইটারের উপর ঝুঁকে টুলের উপর৷ এত বড়ো সাদা দাড়ি বুকের উপর লুটিয়ে পড়েছে, মাথায় প্রকাণ্ড টাক, বেশ বড়ো বড়ো উজ্জ্বল কালো দু-টি চোখ, দু-জোড়া খুব ঘন ভুরু-একেবারে সাদা হয়ে গেছে৷ খুব প্রশস্ত কপাল, তা থেকে একটি শ্বেত পাথরের স্নিগ্ধ সাদা আভা যেন বেরিয়ে আসছে৷ দেখলে ভক্তি হয়৷ আমি কথা কইবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না৷ মনে মনে প্রশ্ন করলাম-“কে আপনি?” সেই বুড়োর হাত চলল আর টাইপরাইটারটা বলে উঠল-“খট-খট-খট!” আমি আবার বললাম-“কে আপনি?”

বুড়োর হাতের টিপনিতে এবার আরও জোরে টাইপরাইটার শব্দ করে উঠল- “খট-খট-খট!”

মানুষ যেমন টাইপরাইটারের হরফ দেখে লেখা পড়তে পারে, সেই অন্ধকারে শুধু তার শব্দ শুনে হঠাৎ আমি তার লেখা বেশ বুঝতে পারলাম৷ চোখ বুজে হরফ না দেখে টাইপরাইটারে আমি স্বচ্ছন্দে লিখতে পারতাম৷ এখন বোধ হল না দেখে শুধু শব্দ শুনে পড়তেও পারি৷

আমার প্রশ্নে টাইপরাইটারের মারফত বৃদ্ধ জবাব দিলেন-“আমি ব্যোপদেব৷”

আমি বললাম-“ও, যিনি ব্যাকরণ লিখেছেন, সেই ব্যোপদেব আপনি?”

“খট-খট-খট-খট!-না, না, না!”

“তবে আবার কোন ব্যোপদেব?”

“তুমি লেখাপড়া শিখেছ, ব্যোপদেবকে চেন না?-যিনি গল্প লেখকদের আদিম পুরুষ!”

আমি বললাম-“ব্যোপদেব ঠাকুর কী গল্প লিখেছেন?”

“তুমি কথাসরিৎসাগরের নাম শুনেছ? সে ব্যোপদেবেরই লেখা৷”

আমি বললাম-“সে কী মশাই, সে যেন না আর কার লেখা, শুনেছি!”

“সে ভুল, ভুল! তোমাদের মূর্খ অর্বাচীন ঐতিহাসিকদের ভুল৷” আমি বললাম-“এতো ভারি অন্যায়, আপনার খ্যাতি চুরি করে অন্য লোকে যশস্বী হবে?”

“তা হোকগে, তার জন্য আমি ভাবি না, আমার ভাণ্ডারে এখনও অনেক গল্প আছে, তা দিয়ে আমি দশটা সরিৎসাগর তৈরি করতে পারি, যা গেছে তার জন্য আমি দুঃখ করি না৷”

এই কথা শুনে সত্যি বলছি ব্যোপদেব ঠাকুরের উপর আমার একটা অসীম ভক্তি এল৷ আমি তাঁকে প্রণাম করে বললাম-“হে গল্প লেখকদের আদিম পুরুষ, এই সামান্য গল্প লেখকের প্রণাম গ্রহণ করুণ৷”

হঠাৎ দেখলাম বৃদ্ধের চোখদুটি আর কপালটি আরও কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ তিনি তাঁর দীর্ঘ হাতখানি উপর দিকে তুলে আমায় যেন আশীর্বাদ করলেন৷

টাইপরাইটার আবার খট খট করে উঠল-“তুমি গল্প লেখো? বেশ! বেশ ভালো! তুমি তাহলে আমার কদর বুঝবে৷”

আমি বললাম-“আপনি বুঝি এই বদ্ধ ঘরে আস্তানা নিয়েছেন- এইখানেই বুঝি থাকেন?”

“রাঃম! আমি এখানে থাকতে যাব কেন? তবে একজন গল্প লেখক যখন পেলাম তখন হয়তো দিনকতক তোমার কাছে এখানে থেকে যেতেও পারি৷ কী বলো, থাকব নাকি?”

আমি বললাম-“তা বেশ তো৷ কিন্তু সচরাচর আপনি কোথায় থাকেন?”

-“কেন, তুমি জান না, আমরা সবাই গল্প গোলোকে থাকি-যত সব ভালো গল্প লিখিয়ে-একদিন তুমিও সেখানে আসবে নিশ্চয়! কী বলো৷”

আমি বললাম-“সে আপনার আশীর্বাদ৷ গল্প গোলোকে আর কে আছেন?”

বুড়ো বলল-“আরে, কত লোক আছে! কত নাম করব, সবাইকে আমি আবার চিনিও না৷ তুমি যখন আমাকেই চিনতে পারলে না, তখন আর কাকে চিনবে?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম-“ইশপ সাহেবকে চেনেন?”

-“ইশপ? ইশপ কে?”

-“যিনি কথামালা লিখেছেন?”

-“ও, আমাদের ইউসুফ৷ চিনি বই কী, খুব চিনি৷ একসময়ে সে আমার শত্রু ছিল, এখন আমার পরম বন্ধু! আহা বড়ো রসিক লোক, ওস্তাদ লিখিয়ে!”

আমি বললাম-“আরব্য উপন্যাস যিনি লিখেছেন তাঁকে জানেন?”

-“আরব্য উপন্যাস? আরবি গল্প? খাসা গল্প হে, খাসা গল্প! অমন গল্প আর কেউ লিখতে পারল না-পড়ে আমারও হিংসে হয়৷”

-“তাঁকে দেখেছেন?”

“দেখেছি বই কী, খুব দেখেছি! ইয়া লম্বা সাদা দাড়ি, চোখে সুর্মা, গাল দুটি যেন পাকা দাড়িম ফেটে পড়েছে! মুখের বুলি-আহা যেন মিঠে শরবত! আর খোশগল্প যা জানেন!” আমি বললাম-“এখনকার গল্প লেখকদের মধ্যে কারও সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি?”

“হ্যাঁ, একজন ছোকরার সঙ্গে আলাপ হয়েছে বটে৷ শুনেছি সে নাকি ‘শকুন্তলা’ বলে একখানা খুব চমৎকার বই লিখেছে৷ চারিদিকে নাকি তার প্রশংসা! একদিন আমাকে প্রণাম করতে এসেছিল৷ দেখে মনে হল, হাঁ শক্তিমান পুরুষ বটে! তবে কী জানো, ওরা সব নিতান্ত ছেলেছোকরার দল!”

কবি কালিদাসই যখন নিতান্ত ছেলেছোকরার দলে পড়লেন, তখন তার পরে আর কারও কথা তুলতে আমার সাহস হল না৷ আমি চুপ করে রইলাম৷

টাইপরাইটার আবার খট খট করে উঠল-“তোমার এ কলটি তো বড়ো চমৎকার হে, যা খুশি তাই লেখা যায়৷”

আমি বললাম-“আজ্ঞে হ্যাঁ, ভারি সুন্দর কল বেরিয়েছে৷ আর গল্প লেখবার কষ্ট নেই!”

-“অ্যাঁ, এই কল থেকে কি আপনিই তৈরি গল্প বার হয় নাকি? যেমন কাপড়ের কল, আটার কল, গানের কল?”

আমি বললাম-“আজ্ঞে না-এতে শুধু লেখা হয় মাত্র-গল্পটা মনে মনেই তৈরি করতে হয়৷”

বৃদ্ধ বললেন-“তবু ভালো, আমি মনে করছিলাম হাতে লেখা গল্প উঠে বুঝি কলের গল্প চলতে আরম্ভ হয়েছে৷”

আমি বললাম-“আজ্ঞে না, সে কল এখনও বার হয়নি৷”

বৃদ্ধ বললেন-“দেখো বাপু তোমার এই কল দেখে আমার আবার গল্প লেখবার সাধ হচ্ছে-আমাদের তো আর কলম নিয়ে লেখবার উপায় নেই- এ দিব্যি টিপে যাব, আর লেখা হয়ে যাবে৷”

আমি বললাম-“বেশ তো, আপনি লিখুন না, আমি প্রকাশ করে দেব৷”

বুড়োর চোখ দুটো আবার যেন প্রদীপ্ত হয় উঠল৷ তিনি আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন-“দেবে বাবা, দেবে-প্রকাশ কার দেবে? তোমায় আশীর্বাদ করি তুমি দীর্ঘজীবি হও, যশস্বী হও৷”

বৃদ্ধ একটু থেমে আবার বললেন-“এই তো আমার দুঃখ-আমিই গল্প লেখার সৃষ্টি করলাম, আর আমাকে সবাই ভুলে গেল৷ আমি আবার পৃথিবীকে দেখাতে চাই, আমি কত বড়ো গল্প লিখিয়ে! এখনও আমার সে শক্তি আছে!”

কথাগুলো বলতে বলতে টাইপরাইটারের চাবিগুলো যেন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল৷ এমন করে আওয়াজ করতে লাগল যেন বুক ঠুকে ঠুকে এই কথাগুলো বলছে!

আমি বললাম-“স্বচ্ছন্দে আপনি গল্প লিখে যান, প্রকাশ করার ভার আমার রইল৷”

বৃদ্ধের মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বুঝতে পারলাম৷ কতখানি ব্যথা তাঁর বুকে লুকানো আছে৷ তাঁর সেই ব্যথার ভারে আমার বুক সমবেদনায় ভরে উঠল৷ মনে হল এ তো আমারই কর্তব্য৷ বৃদ্ধের এ দুঃখ লাঘব করবার দায় আমার৷ আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই দায় নিজের মাথায় তুলে নিলাম৷

বৃদ্ধ বললেন-“তাহলে আমি লেখা আরম্ভ করি?”

আমি বললাম-“নিশ্চয় আরম্ভ করবেন৷”

টাইপরাইটার দ্রুতগতিতে চলতে লাগল-“খট খট খট! খট খট খট!” -আমি শুনতে লাগলাম-“অবন্তিপুরের রাজা দিগ্বিজয় করে নিজ রাজ্যে ফিরে আসছেন, সঙ্গে লক্ষ পদাতিক, দশ সহস্র অশ্বারোহী; তারা অর্ধচন্দ্রাকারে রাজাকে বেষ্টন করে অগ্রসর হচ্ছে৷ বাদ্যকররা উৎফুল্ল বাদ্যধ্বনি…” শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম-জানতেই পারলাম৷ সকালে উঠে দেখি নিজের ঘরে, নিজের খাটিয়ার উপর শুয়ে রয়েছি৷ অনেক বেলা হয়েছে, অনেকখানি রোদ ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে৷ আমি সামনের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম সেই বন্ধ-ঘর যেমন বন্ধ ছিল, তেমনই বন্ধই রয়েছে৷ আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম-ও ঘর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে আমার নিজের বিছানায় শুইয়ে দিল কে? তবে কি আমি নিজেই ঘুমের ঘোরে উঠে এসেছি৷ আর আমার টাইপরাইটার? পাশ ফিরে দেখি টেবিলের উপর যেমন বসিয়ে রেখেছিলাম ঠিক তেমনই আছে৷ কিন্তু তার হরফের চাবিগুলো একেবারে তেউড়ে মেউড়ে একাকার হয়ে গেছে৷ চাবি টিপলাম, কল চলল না৷ টাইপরাইটারের অবস্থা দেখে আমার কান্না আসতে লাগল৷ বুড়ো শেষে এই করল! হয়তো ও ঘর থেকে তুলে আনবার সময় হাত থেকে ফেলে এই অবস্থা করেছে৷ হঠাৎ মনে হল বুড়ো কী গল্প লিখছে দেখি টাইপরাইটারের গায়ে যে কাগজ আঁটা ছিল, সেখানা খুলে নিয়ে দেখলাম মাত্র একটি লাইন লেখা-অি চ ক মী র হ৷ এর মানে কী, কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ হয়তো বা কোনো ভূতুড়ে সংকেত হবে৷

বসে বসে ভাবছি, এমন সময় বিনোদ এসে হাজির৷-“কী করে এখনও বেড়াতে বেরোসনি!” আমি বললাম-“না, আজ আর বেড়াতে যাব না৷ বোধ হয় বিকেলের গাড়িতেই বাড়ি ফিরব৷” বিনোদ আশ্চর্য হয়ে বলল-“কেন? কেন?”

আমি টাইপরাইটারটা তাকে দেখিয়ে বললাম-“দেখ না কী হয়েছে! আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গেছে৷”

বিনোদ টাইপরাইটারটা নেড়েচেড়ে বলল-“তাই তো রে কেমন করে এমন হল?”

আমি কাল রাত্তিরের সমস্ত ঘটনা তাকে বলতে সে হো-হো করে হেসে উঠে বলল-“ওরে, ও খোট্টাই শরবতের গুণ!”

আমি বললাম-“কাল রাত্রে যে আমি ও ঘরে গিয়েছিলাম, সে কি তুই বলতে চাস স্বপ্ন-খেয়াল?”

বিনোদ বলল-“নিশ্চয়৷ ও পাশের সিঁড়ি দিয়ে না উঠে এই পাশের সিঁড়ি দিয়ে রোয়াকে উঠেছিস, আর মনে করেছিস ওই দিক দিয়েই উঠলি৷ তাইতে মনে হয়েছে এ ঘরে না এসে ওই ঘরে গেছিস৷ এ বাবা খোট্টাই শরবতের গুণ না হয়ে যায় না৷” বলে সে হাসতে লাগল৷ আমি চটে উঠে বললাম-“আমি যে সিঁড়ি ভুল করেছিলাম, তার প্রমাণ?”

সে বলল-“তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ তুই ও ঘরে ঘুম থেকে না উঠে এ ঘরে ঘুম থেকে উঠেছিস৷ আর ও ঘরের যে আসবাবপত্রের বর্ণনা করলি, মিলিয়ে দেখ দেখি এ ঘরের সঙ্গে ঠিক মেলে কি না৷ এই খাটিয়া, এই আলনা, এই তোরঙ্গ?”

এতক্ষণ যেন নিজের ঘরের কথা ভুলেই ছিলাম৷ বিনোদ দেখিয়ে দিতে মনে হল জিনিসগুলো মেলে বটে৷ কিন্তু ও ঘরেও যে এমনই জিনিস নেই তার প্রমাণ কী? বিনোদ বলল-“প্রমাণ করে দিতে পারি, যদি ও ঘরের চাবিটা কোনো রকমে খোলা যায়৷”

আমি বললাম-“আর এই টাইপরাইটার? এর এমন অবস্থা কেমন করে হল? দেখছিস না বুড়ো ব্যাটা আনাড়ি হাতে টিপে টিপে এর দফা রফা করে দিয়েছে!”

বিনোদ গম্ভীর মুখে আর একবার টাইপরাইটারটার দিকে এগিয়ে গেল৷ ঠিক সেই সময় টেবিলের নীচে থেকে একটা মস্ত সাদা বেড়াল হাই তুলে পালাল৷ বিনোদ নেড়েচেড়ে টাইপরাইটারটাকে পরীক্ষা করতে লাগল৷ খানিক পরেই বলল-“এই হয়েছে, দেখ চাবির গায়ে বেড়ালের রোঁয়া সব জড়িয়ে রয়েছে-এ ওই বেড়ালটারই কাজ৷ ও টাইপরাইটারের চাবি নিয়ে খেলা করেছে, আর তুই ব্যোপদেবের খেয়াল দেখছিস৷”

বিনোদ বলল বটে, বেড়ালের রোঁয়া, কিন্তু আমার মনে হল এ যেন ব্যোপদেব ঠাকুরের সেই সাদা দাড়ির একটু টুকরো৷ যাই হোক, এখন এর ঠিক জবাব দেওয়া যাবে না, আগে টাইপরাইটার মেরামত হোক, তারপর বুঝে নেব, ব্যোপদেব ঠাকুর গল্প লিখতে আসে কি না৷

টাইপরাইটার মেরামত না হলে আমার মন স্থির হচ্ছে না৷ কাজেই গল্প লেখাও এখন হবে না৷ অতএব এইখানেই শেষ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *