[গ্রাম বাংলার আর পাঁচটা মন্দিরের মতােই এক ভৈরবী মন্দির। তফাতের মধ্যে দেবীমুর্তিটির পায়ের একটা আঙুল ভাঙা। খুঁতাে হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কারণে সেই মূর্তিই স্থাপন হয়েছিল গ্রামের কল্যাণার্থে। হঠাৎ একদিন সেই প্রাচীন ভক্তি-বিশ্বাসের আশ্রয়স্থলে ঘনিয়ে এল অশনি সংকেত। কার রক্ত দেবীর গায়ে ? কেন পরপর মারা পড়ছে গ্রামের বাসিন্দারা? রাতে ফেরার পথে পথিকদের উপর কিসের বিপদ ঘনিয়ে আসে এই মন্দির সংলগ্ন মাঠে? কে এই বিস্রস্ত-আঁচল অস্ত্রধারিণী—সে-ই কি পা টেনে টেনে হেঁটে ফিরছে শিকারের সন্ধানে ?…প্রতি পদে গায়ে কাঁটা দেওয়া রুদ্ধশ্বাস কাহিনি খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ।]
কৈফিয়ত
‘খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ’ উপন্যাস নয়, উপন্যাসিকা বলা যেতে পারে। কর্মসূত্রে আমাকে পূর্বভারতের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হয়। সেভাবেই বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে একটি পরিত্যক্ত মন্দির দেখে আমার কৌতূহল জেগেছিল। তার পিছনের জনশ্রুতি শুনে গড়ে তুলেছিলাম ‘খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ’-এর কাহিনি। দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার শ্রদ্ধেয়া রূপা মজুমদার নবকল্লোলের ২০১৮-র পৌষালী সংখ্যায় এটিকে স্থান দেন। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
কৃতজ্ঞতা জানাই বন্ধু ও সুহৃদ মৌপিয়ালি দে সরকার এবং অনুষ্টুপ শেঠকে। এই দুজনে আমার প্রায় সব লেখার প্রথম পাঠিকা, এবং সবচেয়ে বড় সমালোচকও বটে। কৃতজ্ঞতা রইল বন্ধুবর অর্ক পৈতণ্ডীর প্রতি, এক অখ্যাত কলমচির লেখা পূজাবার্ষিকীতে স্থান দেওয়ার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার পাঠক ও পাঠিকাদের। তাঁরাই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
অভীক সরকার
রথযাত্রা ১৪২৬
কলকাতা
.
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ
ঠিক সন্ধেটা লাগার মুখে গ্রামের খোঁড়াভৈরবী মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন মুখুজ্জে বাড়ির বাসন্তীপিসি। পিসির বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। পৃথুল ও মেদবহুল মুখে ঘামতেলের মতো একটা আলগা তৃপ্তির জেল্লা সবসময়ই লেগে থাকে। নিত্যই মায়ের থানে পুজো দিতে আসেন তিনি, শনি আর মঙ্গলবারে ঘটাটা একটু বেশিই হয়। তা হয় হোক, এই ভৈরবীমায়ের কৃপাতেই তো গঞ্জের বাজারে এত বড় চালকল আর দু’দুখানা অয়েলমিল চলছে ওদের।
কর্তা কাজকম্ম থেকে অবসর নিয়েছেন বছরখানেক হল, এখন সবকিছু ছেলে নিতাই সামলায়। চালাকচতুর ছেলে নিতাই, এই তো মাস খানেক হল তার বিয়েও দিয়েছেন পিসি, মেয়ে বর্ধমানের, পালটি ঘর। ভারি লক্ষ্মীমন্ত বউমা পেয়েছেন বাসন্তীপিসি। সেদিন তো সামন্তগিন্নি গ্রামের গিন্নিদের মজলিশে সবার সামনে বলেই দিলেন, ‘মুখুজ্জেগিন্নির কপাল আছে গো, ভারি ভাগ্যি করে বউ পেয়েছে। ডিগ্রিপাশ হলে কী হবে, বউয়ের স্বভাবচরিত্তির যেমন ঠান্ডা, তেমন কাজকর্মেও ভারি চটপটে,’ শুনে বুকে বাতাস লেগেছিল বাসন্তীপিসির। আহা, সুখ যেন ভিয়েনে বসানো কড়াইয়ের দুধের মতো উথলে উথলে পড়ছে। দু-হাত জড়ো করে নমো করলেন বাসন্তীপিসি, ‘মা মাগো, রক্ষে করো মা। তুমিই সব।’
আজ পূর্ণিমা, আকাশজুড়ে মস্ত বোগিথালার মতো চাঁদ উঠেছে। হেমন্তের বাতাসে বেশ শিরশির একটা ভাব। গ্রামের শেষে যোগেন চাকলাদারের বাড়ি, তারপরেই কালীর মাঠ, আর মাঠের পাশেই ভুষুণ্ডিকাকের আমলের বড় বটগাছটার নীচে এই ভৈরবকালীর মন্দির। তালদিঘির ভৈরবীকালীর সুনাম আছে ভারি জাগ্রত দেবী বলে, দূরদূরান্ত থেকে লোকে পুজো দিতে আসে। আর আসবে নাই বা কেন? এই মন্দির নিয়ে বেশ ভয়ধরানো কাহিনিও আছে যে একটা।
লোকে বলে এ মন্দির নাকি তিনশো বছরের ওপর পুরোনো, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের খাজাঞ্চি রায়রায়ান রামভূষণ দে সরকারের আদেশে বানানো। কামাখ্যা থেকে বিখ্যাত অঘোরী সাধক কালীগিরি তান্ত্রিককে আনা হয়েছিল মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।
প্রতিষ্ঠার দিন সরকার মশাইয়ের এক বিশ্বস্ত প্রজার অসাবধানতায় মায়ের ডানপায়ের বুড়ো আঙুলটা ভেঙে যায়। প্রবল প্রতাপশালী রায়রায়ান সে হতভাগাকে কাটতেই চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু হাতের কাছে চটজলদি একটা তলোয়ার বা সড়কি খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ অনিচ্ছার সঙ্গেই সেই প্রজাকে সড়ালে কুত্তা দিয়ে খাওয়ানোর বিধান দেন।
কিন্তু তাতে বাধ সাধেন কালীগিরি তান্ত্রিক স্বয়ং। তাতে রামভূষণ বেজায় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, সচরাচর তিনি এসব ক্ষেত্রে জ্যান্ত পুঁতে দিয়ে থাকেন, কুত্তা দিয়ে খাওয়ালে কষ্টটা কিছু কম হত বলেই তাঁর ধারণা। তাছাড়া অবোলা প্রাণীগুলো পেটপুরে খেতেও পারত, সে পুণ্যটার কথাও না ভাবলে চলবে কেন? তবে তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে যে, খুঁতো মূর্তি নাকি পুজো দিতে নেই, এই নিয়ে কিছু গাঁইগুঁই করছিলেন দে সরকার মশাই। অট্টহাসিতে সে আপত্তি উড়িয়ে দেন কালীগিরি তান্ত্রিক, ‘কাল তোর মেয়ের পায়ের একটা আঙুল কাটা পড়লে তাকে ফেলে দিয়ে নতুন মেয়ে আনতি নাকি রে?’ প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। ‘মূর্তি তো শুধু সাধন ভজনের সুবিধা হবে বলে রে পাগল, যে বেটির পায়ের তলায় স্বয়ং মহাকাল শুয়ে আছেন তার কী এসে যায় রে এই সবে?’
‘কিন্তু গুরুদেব…,’ চিন্তিত প্রশ্ন তুলেছিলেন রামভূষণ, ‘এতে করে যদি সেবায়েত বা গ্রামের অমঙ্গল হয়?’
কথাটা কালীগিরি তান্ত্রিককে ভাবিয়েছিল ঠিকই। তা নইলে তিনি সেই রাতেই শ্মশান থেকে এক চণ্ডালের শব এনে তন্ত্রমতে শবসাধনায় বসবেন কেন?
কালীগিরি তান্ত্রিক শ্মশানসিদ্ধাই ছিলেন, ভোর হওয়ার আগেই লোকচক্ষুর অগোচরে সেই চণ্ডালের দুটি হাতের আর দুটি পায়ের হাড় দিয়ে মন্দির আর গ্রামের চৌদিক ঘিরে ভূমিবন্ধন করে যান তিনি। সেই থেকেই তালদিঘির কালীঠাকুর খোঁড়াভৈরবী বলেই এদিগরে প্রসিদ্ধ। তালদিঘি গ্রামের লোকে জানে যদ্দিন ভৈরবী মা আছেন, তদ্দিন মায়ের আশীর্বাদে তালদিঘির ওপর বড় কোনও অপঘাত আসতে পারে না। এক যদি না…
ভারী মন দিয়ে পুজো দিচ্ছিলেন বাসন্তীপিসি, ভক্তিতে মনটা ভরে উঠছিল তাঁর। এরকমই রসেবশে রেখো মা, এরকমই রেখো। হাত জড়ো করে মাথায় ঠেকিয়ে বিড়বিড় করছিলেন তিনি, সবই তো হল মা, এবার একটা কোলজোড়া নাতি দিও, যাওয়ার আগে যেন বংশের প্রদীপ দেখে যেতে পারি। সামনের কালীপুজোয় সোনার নথই মানত করে ফেলেন তিনি। জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী…ইত্যাদি বলে টলে আরতি করার সময় প্রদীপটা যেই না ভৈরবীমূর্তির মুখের সামনে এনেছেন, সেদিকে একঝলক তাকিয়েই মুহূর্তখানিক স্তম্ভিত হয়ে রইলেন তিনি, আর তারপরই আঁ-আঁ আওয়াজ তুলে দড়াম করে পড়ে মূর্ছা গেলেন গাঁয়ের মুখুজ্জে বাড়ির দাপুটে গিন্নি বাসন্তীরানি মুখুজ্জে।
মন্দিরের সেবাইত যোগেন ভশ্চাজ্যি মশাই তখন মন্দিরের বাইরে লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো তেলতেলে রোয়াকে বসে পুজো দিতে আসা আরও জনাকয়েক পুরুষ ও মহিলাকে কৌশিকী অমাবস্যায় মহাভৈরবীকালী পুজোর মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিলেন। অন্তত চারটে পুজো বা যজ্ঞ পাকড়াও করে ফেলেছিলেন প্রায়, মাস দুয়েকের জন্যে বাংলা আর চাটের বন্দোবস্ত হাতে আসি আসি করছে প্রায়, তার মধ্যেই এই!
মন্দিরের ভেতরে ছুটে যেতে দেরি হয়নি কারোরই। লোকে প্রথমে ভেবেছিল মুখুজ্জেগিন্নির ফিটের ব্যামোটা বোধহয় ফিরে এসেছে। কিন্তু গ্রামের মহিলারা যখন মুখুজ্জেগিন্নির বিশাল শরীরখানি ঘিরে জলের ছিটে আর হাওয়া দিতে ব্যস্ত, তখন যোগেন ভশ্চায্যি কাঁপতে কাঁপতে ভৈরবীমূর্তির দিকে ডান হাতের তর্জনী তুলে, ‘এ কী, এ কী করে হল! এ যে মহা সর্বনাশ, মায়ের কোপদৃষ্টি জেগেছে রে!’ বলে দড়াম করে পড়ে যেতে লোকজনের মনে হয় যে ব্যাপারটা অন্যকিছু হলেও হতে পারে।
তখন সমবেত লোকেদের নজর ঘুরে যায় মূর্তির দিকে। আর তারপরেই লোকজন ভয়ে আর আতঙ্কে একেবারে কাঠ হয়ে যায়।
সেই রাতেই প্রবল ঝড় ধেয়ে আসে তালদিঘির ওপরে আর খোঁড়াভৈরবীর মাঠের উত্তরদিকের প্রাচীন বটগাছটা উপড়ে পড়ে যায়। কেউ যদি সেই গাছের গুঁড়ির দিকের মাটি আর শিকড় সরিয়ে দেখত, একটা ঝুরঝুরে উরুর হাড় তার নজর এড়াতো না নিশ্চয়ই!
গ্রামে ঢোকার সময়েই একটা কিছু টের পাচ্ছিল দনু, ওরফে দনুজদমন সেনাপতি। হপ্তা দুয়েক হল এখানেই তালদিঘি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যায়তনের সায়েন্সের টিচার হিসেবে জয়েন করেছে সে।
কলকাতা শহর ছেড়ে এই গণ্ডগ্রামের দিকে চাকরি করতে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না দনুর। এসএসসি-র পরীক্ষাটা দিয়ে এদিকওদিক প্রাইভেট কম্পানিগুলোতে চাকরির চেষ্টাই করছিল সে। কিন্তু দু-একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দনু দ্রুতই বুঝে যায় যে, চাকরির বাজারের হাল সে যতটা ভেবেছিল তার থেকেও খারাপ, খুব খারাপ। বউদিও এদিকে ঠারেঠোরে ঈঙ্গিত দিচ্ছিল যে দাদার সংসারে বেশিদিন গলগ্রহ হয়ে থাকলে এখনও যে ডিমটা, দুধটা জুটছে সেটা ভবিষ্যতে নাও জুটতে পারে।
ফলে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো এই স্কুলমাস্টারির চাকরিটা পেয়ে আর দুবার ভাবেনি দনু। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে সে একপ্রকার স্টেশনে এসে রেলগাড়ি চেপে বসে বললেই চলে। গ্রামের একদম কোনায় সস্তায় একটা বাড়ি ভাড়াও স্কুলের পক্ষ থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল তাকে।
গত দুদিন গ্রামে ছিল না দনু, সপ্তাহান্তের ছুটিতে কলকাতা গেছিল দাদা বউদির সঙ্গে দেখা করতে, আর টুকটাক কিছু কেনাকাটা করতে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে দৌড়ঝাঁপ করে শেষ পর্যন্ত সে যখন স্টেশনে পৌঁছয় তখন আটটা চল্লিশের লোকাল দিয়েছে ছেড়ে। ফলে সে লাস্ট ট্রেনটাই ধরতে বাধ্য হয়।
স্টেশন থেকে টোটো ধরেছে দনু, বরাবরই যেমন ধরে। সারা স্টেশন চত্ত্বর ফাঁকা দেখেও তেমন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু টোটোটা যখন ভেতরে ঢোকার বদলে গ্রামের বাইরেই তাকে নামিয়ে দিল তখনই খটকা’টা লাগে তার।
‘কী রে, ভেতরে যাবি না?’ বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেছিল দনু।
‘না বাবু,’ চাপা স্বরে জবাব দেয় মফিজুল, ‘এখন রেতের বেলা গাঁয়ে ঢুকতে পারবুনি। আব্বু মানা করে দেছে।’
‘কেন রে?’ আরও অবাক হয়েছিল দনু, ‘আগের হপ্তাতেই তো বাড়ি অবধি ছেড়ে দিয়ে এসেছিস, আজ কী হল?’
‘সেসব বলতে পারবুনি বাবু, বলা বারণ। অ্যাই তো একটুখান রাস্তা, হাঁটি চইল্যে যান না কেন। টর্চ আনিছেন?’
বিরক্ত হয়েছিল দনু, ‘টর্চ আনব কেন? আগে যদি জানতাম আজ এসব ফালতু বাহানা মারবি তাহলে ব্যবস্থা করতাম। যত্তসব’, বলে হাঁটা দিতে যাচ্ছিল দনু, এমন সময় মফিজুল একখানা ছোট টর্চ হাতে ধরিয়ে দেয় ওর। ‘বাড়ির ভিতরি ঢুকবার আগতক টর্চ খান নেভাবেন না বাবু, আর পেছন বাগ থিকে কেউ ডাকলে খবদ্দার ফিরে তাকাইয়েন না কিন্তুক। আল্লার নাম, থুড়ি রামের নাম নিতে নিতে চইল্যে যাবেন। টর্চ খান কাল বাজার করতি আসবেন যখন, তখন সাধনের মুদিখানায় দিয়্যা দিয়েন।’ বলে আর দাঁড়ায় না মফিজুল। টোটোখানা ঘুরিয়ে সেখান থেকে প্রায় পালিয়েই যায় যেন।
রাস্তা দিয়ে আসতে আসতেই একটা পচা আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিল দনু, তার সঙ্গে পাথরচাপা নৈঃশব্দ। গ্রামের রাস্তা এমনিতেই একটু নির্জন থাকে, তার ওপর শীতের রাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারিদিক এত চুপচাপ কখনও দেখেনি সে। রোজই রাতে খাওয়া দাওয়ার পর একটু হাঁটতে বেরোয় দনু। তখন হাটফেরতা চাষিদের দল থাকে রাস্তায়, থাকে সাইকেলের সামনের রডে মেয়ে বসিয়ে ঘুরতে বেরোনো বখাটে ছোঁড়াদের দল। এছাড়াও শহর থেকে রাতের ট্রেনে আসা অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায় তার।
আজ তবে সবকিছু এত চুপচাপ কেন?
দুদিন আগেই পূর্ণিমা গেছে। আকাশে দ্বিতীয়ার চাঁদ, অল্প একটু মেঘও করেছে। আবছা আলোছায়ায় সামনে পড়ে থাকা কালো ফিতের মতো সরু রাস্তাটাকে সাপের খোলসের মতো লাগছিলো দনুর। যেখানে টোটো তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে সেখান থেকে তার বাড়ি বেশ খানিকটা রাস্তা। যেতে যেতে খেয়াল করে সে, চারিপাশে একটুও শব্দ নেই কোথাও, মানুষজন বা নেড়ি কুকুর কারও পাত্তা নেই, এমনকী গাছের পাতা অবধি নড়ছে না! শুধু চারদিকে আলগা অভিশাপের মতো লেগে আছে কটু আঁশটে গন্ধটা। আরও কী যেন একটা নেই, ভাবছিলো দনু, তাই এত অস্বস্তি হচ্ছে আজ। একটু পরে সেটা খেয়াল করতে তার হাঁটাটা আস্তে হয়ে এল।
ঝিঁঝির ডাক। একটা ঝিঁঝিপোকাও ডাকছে না আজ।
গ্রামে আসা ইস্তক এই দুই সপ্তাহে এমন একটা রাতও যায়নি যখন এই বিপুল শব্দ ব্রহ্মতালা লাগায়নি তার কানে। আজকাল তার অনেকটা অভ্যেস হয়ে গেছে শব্দটা, তাই এই চুপচাপ থাকাটা কেমন যেন অশরীরী লাগল তার। দনুর মনে হচ্ছিল এই চুপজোছনার রাত যেন ভারী পাথরের মতো তার বুকে চেপে বসেছে।
শীতের রাতেও একটু ঘেমে উঠছিল দনু, হাঁটার বেগটা বাড়িয়ে দিল সে। সামনের তেমাথার মোড় থেকে একটা রাস্তা বেঁকে গেছে ডানদিকে। সেই রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই গ্রামের পাশের বড় বাঁশবনটা। তার গা দিয়ে একটা শর্টকাট আছে দনুর বাড়ির দিকে যাওয়ার। রাস্তাটা খোঁড়াভৈরবীর মাঠের ধার ঘেঁষে। সেই রাস্তাটাই ধরল দনু, তাড়াতাড়ি হবে। আর এক মুহূর্তও খোলা জায়গায় থাকতে চাইছিল না সে।
বাঁশবনের মাঝামাঝি যেই এসেছে সে, সেই পচাটে গন্ধটা যেন হঠাৎ করে বেড়ে উঠে একঝলক দমকা হাওয়ার মতোই ঝাপটে গেল তার চোখেমুখে। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বার করে নাকে দিতে যাবে দনু, এমন সময় বাঁদিকে কী যেন একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে।
ঝোপের আড়ালে কী ওটা? ওই যে নড়াচড়া করছে? মাথা নীচু করে হাতের পাতাটা কপালের ওপর ধরে ঠাহর করার চেষ্টা করল সে, মুরলীদের বাড়ির কেলে গাইটা না? এখানে বসে আছে কেন এত রাতে? গোয়ালে নিয়ে যায়নি কেউ?
রাস্তা ছেড়ে সন্তর্পণে বাঁশবাগানে ঢুকল দনু, বুকটা দুরুদুরু করছিল তার। একটু এগিয়েও থমকে গেল সে।
কারণ সে স্পষ্ট দেখতে পেল যে গরুটা আসলে বসে নেই, শুয়ে আছে। আর যেভাবে ঘাড় কাত করে শুয়ে আছে তাতে বোঝা যায় যে তার গলাটা মুচড়ে দিয়েছে কেউ। একটা হাড় চিবোনোর মড়মড় আওয়াজ কানে এল নাকি তার?
আর মরা গরুটার পাশে কালো ছায়ার মতো কে ওটা? জ্বলজ্বলে চোখ?
ঠিক এই সময়েই মেঘ সরে গিয়ে একটুকরো চাঁদের আলো যেন বজ্রপাতের মতোই আছড়ে পড়ল তার গায়ে।
তারপর আর কিছু মনে নেই দনুর।
বাথরুমে ঢুকে বেসিন ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল শামু, মানে এ বাড়ির নতুন বউ শাম্ভবী। বাথরুমে বউয়ের জন্যে একটা বাহারি ওয়াশ বেসিন বসিয়ে দিয়েছে নিতাই, তার ওপরে একটা ছোট আয়নাও লাগিয়ে দিয়েছে। ঝটপট মুখেচোখে জল দিয়ে উত্তেজনাটা কমাবার চেষ্টা করছিল শামু। হাতে লেগে থাকা শাশুড়ি মায়ের রক্তটা শুধু একবার জিভের ডগায় ঠেকায় সে, আহ, কী স্বাদ!
বাথরুমের বাইরে থেকে দরজায় টোকা দেয় পিসতুতো ননদ শ্যামলী, ‘ও বৌদি, একবারটি এসো না। ডাক্তারবাবু কী সব বলবেন বলে ডাকছেন তোমাকে।’ শুনেই যতদূর সম্ভব গলার স্বর স্বাভাবিক করে ফেলে শামু, তারপর উত্তর দেয়, ‘যাই।’ দ্রুত গামছা দিয়ে মুখটা মুছে ফেলে সে।
বাসন্তীপিসি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে ছিলেন বিছানায়। মাথায় মস্ত বড় ব্যান্ডেজ, পড়ে গিয়ে অনেকটা কেটে গেছে মাথায়। পাশে ভিড় করে আছেন গ্রামের ছোটবড় গিন্নিদের দল।
ডাক্তারবাবু গম্ভীরমুখে প্রেশার মাপছিলেন বাসন্তীপিসির। আশেপাশের মহিলাদের মুখে উদ্বেগ ছাপিয়েও যেটা ফুটে উঠছিল সেটার নাম ভয়, হাড় কাঁপানো ভয়!
‘সত্যি দেখেচিস তুই?’ সামন্তদের বড় গিন্নি ফিসফিস করে প্রশ্ন করেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নির্মলাকে। নির্মলা হল ঘোষেদের ছোট মেয়ে।
‘হ্যাঁ গো পিসি,’ নির্মলার চাপা স্বরে উত্তেজনা ফুটে বেরোচ্ছিল, ‘পষ্ট দেখলুম মায়ের জিভটা লাল, টকটকে লাল। অক্ত গড়িয়ে পড়ছে যেন।’
বাকিরা শিউরে উঠলেন সে কথা শুনে, জোড়হাত কপালে ঠেকালেন কেউ কেউ। এর মধ্যেই ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে সরকারদের বড় বউ টুম্পা, ‘ধুর, কি দেখতে কি দেখেছে, ও বাচ্চা মেয়ে…।’
‘অ, আমি বলে বাচ্চা মেয়ে।’ ক্ষোভে ফেটে পড়ে নির্মলা, ‘আর ঠাউরমশাই দেকলো, ন’পাড়ার দোক্তাদিদা দেকলো, নারানদের বড় জ্যেঠা দেকলো, বাচ্চুকাকু দেকলো, সেগুনো কিচু নয়, না?’
অকাট্য যুক্তির সামনে চুপ করে যায় টুম্পা। কান খাড়া করে এই কথোপকথন শুনছিল শামু আর ক্রমশই তার কৌতূহল চাগাড় দিয়ে উঠছিল। শাশুড়িমা’কে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসা ইস্তক একটা ফিসফিস চলছে, খেয়াল করেছে সে। নিতাইয়ের মুখটাও গম্ভীর, বাইরের বৈঠকখানায় শ্বশুরমশাই আর গাঁয়ের গণ্যমান্য লোকেরা বসে মিটিং করছেন। খুব সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেছে নাকি? প্রবল কৌতূহলে উশখুশ করছিল সে, অথচ নতুন বউয়ের পক্ষে আগ বাড়িয়ে কৌতূহল প্রকাশ করাটাও ভালো দেখায় না।
‘মায়ের জিভে রক্ত দেখলে কী হবে গো দিদি?’ প্রশ্ন করে সানাপাড়ার রাখাল মণ্ডলের বউ। বয়েস হলে কী হবে, বুদ্ধিশুদ্ধিতে মহিলাকে প্রায় নাবালিকা বললেই চলে।
‘সে কী রে বউ, কালীগিরি তান্ত্রিকের ওই গেরামবন্ধনের কতা শুনিসনি তুই?’ অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন সামন্তগিন্নি, ‘কালীগিরি তান্ত্রিক যে বলে গেসল, খুঁতো ভৈরবীর পুজো করে যাতে গেরামের কোনও অনিষ্ট না হয়, তাই সে নাকি মন্তর দিয়ে গেরাম বেঁদে দিয়ে যাচ্ছে। যে রাতে মায়ের পিতিষ্ঠে হয়, সেই রাতেই শ্মশান থেকে এক ডোম না বাগদী কার একটা মড়া এনে, তাকে তন্তরমন্তর করে, সেই মড়ার হাতের দুটো আর পায়ের দুটো, এই চারটে হাড় গেরামের চার কোনায় পুঁতে বাঁদন দিয়ে দেয়। কিন্তু কালী তান্ত্রিক এও বলে গেসলো যে তার মন্তরের জোর থাকবে মাত্তর তিনশো বচর।’
‘তারপর?’ নির্মলা গ্রামেরই মেয়ে, এসব কথা তার কমপক্ষে একশোবার শোনা। তবুও ব্যাপারটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রশ্ন করে সে, ‘তারপর কী হবে?’
‘তারপর কী হবে জানতে চাইছিস মেয়ে?’ থুত্থুরে গলায় বলে ওঠেন এক বৃদ্ধা, এতক্ষণ এক কোনায় একটা মোড়াতে নির্জীব হয়ে বসেছিলেন তিনি।
কান থেকে প্রেশার মাপার যন্ত্র খুলে শামু’র দিকে চাইলেন বর্ষীয়ান ডাক্তারবাবুটি। চিন্তিতস্বরে বললেন, ‘প্রেশারটা অ্যাবনর্মালি ফল করে গেছে বুঝলে, কোনও একটা সাডন শক থেকে এরকম হয় মাঝেমাঝে। মাথার কনককশনটাই চিন্তায় ফেলেছে যদিও। হপ্তাদুয়েকের কমপ্লিট বেড রেস্ট লিখে দিয়ে গেলাম, হালকা মুরগির স্টু আর দু-পিস করে সেঁকা পাঁউরুটি খাওয়াবে দুবেলাই। যা যা ওষুধ লিখে দিয়ে গেলাম আজ দুপুর থেকেই খাওয়ানো শুরু করে দিও। দুদিন অন্তর ব্যান্ডেজ পালটে ড্রেসিং করে দিতে হবে। পাঁচদিন বাদে একবার খবর দেবে অবস্থা জানিয়ে।’ এই বলে খসখস করে খবরের কাগজের ওপরে রাখা প্যাডে ওষুধ লিখতে থাকেন ডাক্তারবাবু।
‘তারপর?’ এইবার হাল ধরেন এঁদের মধ্যে যিনি বয়স্কতম, মণ্ডলদের সেই ঠানবুড়ি। যে প্রজার অসাবধানতায় তালদিঘির ভৈরবীর নাম খোঁড়াভৈরবী, তিনি এই মণ্ডলদেরই পূর্বপুরুষ। ফলে পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি বংশপরম্পরায় তাঁর জানা, ‘ডোম বা বাগদি নয় রে মেয়ে, কালী তান্ত্রিক যার মড়া নিয়ে তুক করেছিল তার নাম ছিল রামাই, সেকালে নাকি নাম করা ডাকাত ছিল সে। তার ভয়ে এই পরগনা থরথর করে কাঁপত।’ বলে একটু দম নেন ঠানবুড়ি, তারপর ফের শুরু করেন, ‘কালীতান্ত্রিক বলে গেছিল যে, তিনশো বছর পর এই বাঁধনের জোর নাকি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসতে আসতে শেষ হয়ে যাবে। তখন নাকি ঠিক এক পূর্ণিমা থেকে পরের অমাবস্যার মধ্যে ওই চারটে হাড়ই এক এক করে মাটির উপর উঠে আসবে।’ বলে চুপ করে যান ঠানদি।
‘কী করে বুজব জোর ফুরিয়ে এসেচে কি না?’ ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে রাখাল মণ্ডলের বউ।
ফিসফিসে হয়ে আসে ঠানদি’র গলা, ‘কালীগিরি তান্ত্রিক বলে গেছল, যে রাতে মায়ের জিভে আপনা আপনি রক্ত দেখা যাবে, জানবি যে সেইদিন থেকেই এই চণ্ডালবন্ধনের জোর শেষ। মায়ের জিভে রক্ত আসা মানে, মা বলি চাইছেন। সেই রাতেই মাটির ওপরে উঠে আসবে প্রথম হাড়।’
‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নির্মলা। বাকিরাও শ্বাস বন্ধ করে শুনতে থাকে।
‘তারপর যে রামাই ডাকাতের হাড় নিয়ে তন্তর করেছিল কালীতান্ত্রিক, সে নাকি সেই রাতেই নরক থেকে জেগে উঠে ফের ফিরে আসবে তালদিঘিতে’, বলে থামেন ঠানদিদি।
‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে কেউ।
চুপ করে থাকেন ঠানদিদি। তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘সে ফিরে আসবে পিশাচ হয়ে। তারপর এক এক করে গাঁয়ের সব্বার রক্ত মাংস চুষে খাবে সেই দানো। এক একটা করে মন্তরের হাড় উঠে আসবে, আর সেই পিশাচের গায়ে দুনো বল আসবে, আরও তেজি হবে শয়তানটা।’ হাঁপাতে থাকেন ঠানদিদি। খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফের যোগ করেন, ‘আর যেদিন শেষ হাড়টা উঠে আসবে সেদিন…’ এই বলে চুপ করে যান সেই প্রাজ্ঞ বৃদ্ধা।
‘সেদিন কী, ঠানদি?’
‘সেদিন এই তালদিঘিতে বাপ পিতেমো’র ভিটেতে পিদিম জ্বালানোর জন্যে একটা লোকও থাকবে না রে মেয়ে,’ রহস্যময় শোনায় ঠানদি’র গলা, ‘সেই পনেরো দিনের পর নাকি এই গাঁয়ে শুধু কুকুর আর শকুন ছাড়া আর কোনও প্রাণীটির ছায়াও দেখা যাবে না।’ এই বলে চুপ করেন ঠানদিদি।
এই আলাপচারিতা শামুর সঙ্গে মন দিয়ে শুনছিলেন আরেকজনও। ডাক্তারবাবু। সব শুনেটুনে তিনি নাকের ভেতর একটা ঘোঁৎ করে শব্দ করে বললেন, ‘যত্তসব বুজরুকি আর আজগুবি গালগপ্পো, হুঁ। মেলা রাত হয়েছে, এবার আপনারা যে যার বাড়ি যান দেখি, আর এসব গল্পগাছা বলে রোগীর টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। আর তুমি শোনো বউমা,’ এই বলে শামুর দিকে ফেরেন তিনি, ‘যে ক’টা ওষুধ বলে দিয়ে গেলাম টাইমে টাইমে খাইও কিন্তু। অসুবিধা হলে একটা কল দিও নিতাইকে বলে। ফোন নাম্বার তো জানোই।’ এই বলে ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়েন তিনি।
ডাক্তারবাবু বেরিয়ে যাওয়ার ঘণ্টাচারেক পর ডাক্তারবাবুর খোঁজে মুখুজ্জেবাড়িতে লোক আসে, তিনি নাকি বাড়ি ফেরেননি তখনও। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পরের দিন ভোরবেলা নাগাদ ডাক্তারবাবুর পাত্তা পাওয়া যায় কালীর মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণে।
অবশ্য ডাক্তারবাবু নয়, ডাক্তারবাবুর বডি পাওয়া গেল বললেই ঠিক হয়।
আর তার কোমর থেকে নীচের অংশটা কে যেন খেয়ে গেছে!
‘ও হে গোকুল, আছো নাকি?’
‘আছি কাকা, সুবল কই?’
‘এই তো আমার বাঁ-পাশে। কই হে জগন্নাথ, সাড়াশব্দ নাই কেন?’
‘আছি ঠাকুর। কুয়াশায় আশেপাশে কিছু ঠাওর হয় না যে।’
‘হাঁকার দিতে থাকো হে, এর ওর নাম ধরে ডাকতে থাকো। ও মনসুর মিঞা, বলি গাড়িই চালাবে না দুটো কথাও বলবে?’
জবাব দেয় না মনসুর মিঞা, একমনে গাড়ি চালাতে থাকে। চারিদিকের যা আবহাওয়া, তাতে এই গোপপে লোকটাও থুম মেরে গেছে মনে হয়।
মাচান গোপীনাথের হাট থেকে ফিরছিল ওরা জনা ছয়েক লোক। বেরিয়ে পড়েছিল অবশ্য বেলা থাকতে থাকতেই। কিন্তু গরাণহাটার মোড়ে মনসুর মিঞার ভ্যানটা বেগড়বাঁই করতে চোখে অন্ধকার দেখে ওরা। আর অন্ধকার দেখার যথেষ্ট কারণও ছিল।
যেদিন সকালে ডাক্তারবাবুর আধখাওয়া শরীরটা পাওয়া যায়, সেই দিনই রাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজে দাসপাড়ার মালতীর ঘুমটা ভেঙে গেছিল হঠাৎ করেই। খানিকক্ষণ কান পেতে রাখার পর তার ঠাহর হয় যে আওয়াজটা আসছে সেটা তাদের গোয়ালঘর থেকে। এদিককার গাঁয়েগঞ্জে হামেশাই রাতবিরেতে বুড়ো ভাম বা বনবিড়াল হানা দেয়, অথবা সাপখোপও হতে পারে। মোটমাট গোয়ালঘরে কিছু তো একটা ঢুকেছেই, এই ভেবে ঘরের কোণে রাখা খেটো বাঁশের টুকরোটা এক হাতে আর কেরোসিনের কুপিটা অন্য হাতে ধরে গোয়ালঘরের দিকে রওনা দেয় সে।
পরের দিন শুধু চুটকি পরা পায়ের আঙুল আর কয়েকটা হাড়গোড় পাওয়া গেছিল মালতীর, বাঁশবনের দক্ষিণ কোণে।
সেইদিন থেকেই লোকজনের মনে ভয়টা পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসতে থাকে। সত্যি সত্যি রামাই ডাকাত ফিরে এল নাকি পিশাচ হয়ে?
‘কথা কও না ক্যান মিঞা’, এইবার হাল ধরেন কার্তিক সমাদ্দার। সম্পন্ন ব্যবসায়ী, পাঁচটা সর্ষের তেলের মিল আছে আশেপাশের গঞ্জে, তার মধ্যে একটা আবার মাচান গোপীনাথের হাটে। তাগাদায় বেরিয়েছিলেন সমাদ্দার মশাই। নিজের অ্যাম্বাসাডারটা মাঝরাস্তায় জবাব দেওয়াতে নেহাত বাধ্য হয়েই এই ভ্যানোতে চড়তে হয়েছিল তাঁকে। এতক্ষণ ধরে মনে মনে ইষ্টনাম জপ করছিলেন তিনি। একে রাত বিরেতে বাইরে থাকা তাঁর সখত না পসন্দ, তার ওপর আজকাল গাঁয়ে যা চলছে তাতে সোয়াস্তিতে থাকার কথাও নয়। চারিদিকের এই এর-ওর নাম ধরে ডাকার মানেও ভালোই বুঝছিলেন সমাদ্দারমশাই, মনের জোর বজায় রাখা আর কি!
‘ও মিঞা, কাল বাজারে তোমার পোলাডার লগে কথা হইল গিয়া, বোঝলা? ছ্যামড়ার কথাগুলান ভারি মিষ্ট, সহবত শিখসে খুব। ওরে টোটো চালাইতে কও ক্যান? গঞ্জের বাজারে একখান দুকান দিতে কও না পোলারে, আমি তো আসি এহনও’, সাহস যোগানোর চেষ্টা করেন কার্তিক সমাদ্দার, বোধহয় নিজেরই।
জবাব দেয় না মনসুর মিঞা। সেই যে গাড়ি সারিয়ে টারিয়ে তারপর পাশের জঙ্গলে পেচ্ছাপ করতে গেছিল লোকটা, তারপর ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন থুম মেরে গেছে সে। চোখ দুটো সামান্য লাল, কারও সঙ্গে কথা বলছে না, কাঁধ দুটো সামান্য উঁচু হয়ে আছে। সমাদ্দারের কথার জবাবে সামান্য একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে সে। আর ঠিক সেই সময়েই একটা মাংসপচা গন্ধ যেন মাছধরা জালের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল সবার ওপরে।
দরজা বন্ধ করে বসে ছিল রাখহরি সাধুখাঁ। এখন পরম ভক্ত বৈষ্ণব হলে কী হবে, এককালে তার নাম করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হতো আশেপাশের গাঁয়ে, এমনই প্রতাপ ছিল তার। একখানা লাঠিগাছ সম্বল করে চার চারটে পাঠানকে ঘায়েল করার গল্প এখনও আশপাশের পাঁচ গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে। চিরকালই তার ভয়ডর কম, বুকে দুর্জয় সাহস। যখন বলি দেওয়ার চল ছিল, তখন খোঁড়া ভৈরবীর সামনে এক কোপে জোড়া মোষের গলা নামাত রাখহরি। লোকে এখনও নীচু গলায় বলাবলি করে এককালে যারা রাখহরি’র হাতে বলি হয়েছে তাদের সবাই চারপেয়ে নয়। এহেন ডাকসাইটে রাখহরি নবদ্বীপের রাসের মেলায় ঘুরতে গিয়ে মদনমোহন গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নিয়ে ফেলে এখন বিলকুল শুধরে গেছে। দু’বেলাই নিরামিষ খায়, একাদশীতে হবিষ্যি করে, পূর্ণিমা অমাবস্যায় তার বরাদ্দ শুধু ফলাহার আর সাবু।
সেই দিন ঠাকুরের নামগান করার জন্যে কত্তালটা নিয়ে বসেছে রাখহরি, ভক্তিগীতি লহরীতে ডুবে গেছে সে, ‘গুরু, তোমার চরণ পাব বলে রে’ দিয়ে শুরু, শেষতক ‘গুরুদেবো দয়া করো দীনজনে’ গাইছে, ভক্তিবিনত চোখদুটি থেকে অবিরল নেমে আসছে প্রেমাশ্রুধারা, এমন সময় বাড়ির চালে খড়খড় আওয়াজ হতে একটু অসন্তুষ্টই হয় সে। ছেলে ছোকরার দল চালকুমড়ো চুরি করতে উঠেছে নাকি? সবে দু’খান চালকুমড়ো পেকে উঠেছে, রাখহরির ইচ্ছে যে সামনের বেস্পতবার পূর্ণিমা, সেইদিন বড়ি দিয়ে চালকুমড়োর তরকারি আর অন্যান্য পঞ্চব্যঞ্জনে রাধাকৃষ্ণের ভোগ দেবে সে, শেষ পাতে একটু দই, সঙ্গে মালপোয়া। আহা মহাপ্রভু বড় ভালোবাসতেন। নষ্টচন্দ্রের দল সেসবও করতে দেবে না?
লুঙ্গিটা দু’ভাঁজ করে কোমরে গুঁজে উঠোনে নেমে আসে রাখহরি। হাতে একটা নিভু নিভু টর্চ, ব্যাটারি শেষ হয়ে এসেছে তার। চালের দিকে চেয়ে একটা হাঁকার দেয়, ‘কে রে ওখানে?’
জবাব আসার বদলে একটা শব্দ ভেসে আসে তার কানে, চালের ওপার থেকে কী যেন একটা খড়মড় করে ওদিকের চাল বেয়ে নেমে যায়।
হালকা পায়ে একটু দ্রুতই ওদিকে দৌড়ে যায় রাখহরি। ঠাকুরের ভোগের সামগ্রী যায় যাক, কিন্তু রাখহরি সাঁপুইয়ের বাড়ি থেকে কিছু একটা চুরি করে ভেগে যাওয়ার মতো চোর যে এই জেলাতে এখনও আছে সেটা ভেবেই আশ্চর্য হচ্ছিল সে।
বাড়ির পেছন দিকে যেতেই একটা মাংসপচা গন্ধ যেন ভেজানো গামছার মতোই দমবন্ধ করা ভাব নিয়ে তার মুখ-চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখানে এই গন্ধটা এল কোত্থেকে?
হঠাৎ করেই থমকে গেল রাখহরি, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল যে এখানে কিছু একটা আছে যেটা তার বোধবুদ্ধির বাইরে। এক মুহূর্তে সমস্ত স্নায়ু সতর্ক হয়ে উঠল তার, নীচু হয়ে একটু আড়াল হল সে। নিজের অজান্তেই হাতের তালু ঘেমে যাচ্ছিল তার, তলপেটটা খালি খালি লাগছিল এককালে ডাকাতে কালীর সামনে মানুষ বলি দেওয়া রাখহরি সাধুখাঁর। ঘাড়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে পড়ছিল তার।
বাড়ির পেছন দিকে সামান্য ঝোপজঙ্গল হয়ে আছে। এককালে এসব নিয়মিতভাবে সাফসুতরো রাখত রাখহরি। আজকাল তারকব্রহ্ম নামগানে তার এত সময় যায় যে এসব দিকে মন দেওয়ার সময়ই পায় না সে…
ভাবতে ভাবতেই আমগাছটার গোড়ার দিকে নজর পড়ে তার, ওটা কী ওখানে? একগাদা কালো ছায়া জড়ো হয়ে আছে কেন ওখানে? আর জ্বলজ্বলে ওই আগুনে দুটো কী? কারও চোখ?
খোঁড়া ভৈরবীর মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনসুর মিঞার ভ্যানোটা যেন হঠাৎ করেই ফের একটা হেঁচকি তুলে থেমে যায়। সবার আগে লাফ দিয়ে নামেন কার্তিক সমাদ্দার, ‘হালায় কিয়ের ভ্যান লইয়া বাইরাও তুমি? থাইক্যা থাইক্যা থাইম্যা যায়? মশকরা করো তুমি পেসেঞ্জার লইয়্যা, মশকরা?’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সমাদ্দারমশাই, কাঁপা কাঁপা হাতে তার মুখটা চেপে ধরে সুবল। একটু অবাক হয়েই পাশে তাকান সমাদ্দার মশাই, জগন্নাথ বাচ্চা ছেলে, সে তখন গোকুলকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে।
আকাশে পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ, তার ম্লান আলোয় বাঁশবনের ছায়া পড়েছে রাস্তার ওপর, সেই আলোয় কার্তিক সমাদ্দার দেখলেন যে মনসুর মিঞা ভেবে যার গাড়িতে এতক্ষণ চড়ে এসেছেন, তার কাঁধ দুটো আরও উঁচু হয়ে উঠেছে, শরীরটা দুনো হয়ে উঠেছে, হাতদুটো বেড়ে গেছে প্রায় দেড়গুণ, মুখের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুটো কুকুরে দাঁত, আর একটা পচা গন্ধে তাঁদের বমি উঠে আসবার জোগাড়!
এইবার আস্তে আস্তে বাঁ-দিকে ঘাড়টা ঘোরালো সেই প্রাণীটা। না, ভুল হল, শুধু ঘাড়টা ঘুরল তার, আর হাত দুটো কাঁধ থেকেই যেন উলটে গেল। টকটকে লাল চোখ দুটো দিয়ে একবার যেন প্রাণভয়ে ভীত কয়েকটা লোককে দেখে নিল সে। তারপর সামনের লোকটাকে বাঁ-হাত দিয়ে খপ করে ধরে মাটির উপরে আধহাত তুলে খানিকক্ষণ দেখল, তারপর যেভাবে বাচ্চারা খেলনা পুতুলের মাথাটা খুলে ফেলে, ঠিক সেভাবেই ডানহাতটা দিয়ে তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে আনল একটানে।
বাকিরা আর দাঁড়াবার সাহস পায়নি, পিছনবাগে ফিরে দৌড় দেয়। শুধু দৌড়তে গিয়ে পড়ে যান সমাদ্দারমশাই।
সাহস করে আরও কিছুটা এগোয় রাখহরি। পচা বিশ্রী একটা গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উঠে আসছিল তার, কাঁধের গামছাটা নাকে চেপে ধরে সে। আরও একটু এগোতেই নরম নরম কী যেন একটা তার পায়ে ঠেকতে থেমে গিয়ে সেদিকে টর্চ মারে রাখহরি।
একটা মানুষের হাত, কনুইয়ের নীচ থেকে কাটা। না, ভুল হল।
কাটা নয়, ছেঁড়া! তার গায়ে এখনও রক্ত লেগে!
খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে রাখহরি, বুকটা ধ্বক করে ওঠে তার। মানুষের কাটা হাত-পা দেখার অভ্যেস বহুদিন নেই রাখহরির, তার ওপর জ্যান্ত মানুষের হাত যে ওভাবে মুচড়ে ছিঁড়ে আনা যায় সে কথা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
দরদর করে ঘামতে থাকে রাখহরি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল তার। কাঁপতে কাঁপতে সামনের দিকে টর্চ ফেলে সে, আর স্ট্যাচু হয়ে যায়।
কী ওটা, কোন প্রাণি? থরথর করে কাঁপতে থাকা আলোয় রাখহরি দেখে প্রকাণ্ড একটা উলঙ্গ শরীর কীসের ওপর যেন ঝুঁকে পড়েছে, সারা শরীর বড় বড় কালো লোমে ঢাকা, কান বলে কিছু নেই আর বড় বড় বাঁকানো নখওয়ালা দুটো মোটা মোটা হাত দিয়ে কী একটা যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। মাংসের গন্ধ ছাড়াও এবার আরও একটা উগ্র গন্ধ নাকে এল রাখহরি’র।
কাঁচা রক্তের গন্ধ।
এইবার সেই প্রাণীটা লাল টকটকে চোখ তুলে তাকাল ওপরের দিকে। আর সেই অমানুষিক বিভীষিকার দিকে তাকিয়ে ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল রাখহরির, পেছন ফিরে পড়ি কি মরি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল সে।
পালাবার আগে শুধু আর একটা জিনিসই চোখে পড়েছিল তার।
প্রাণীটা যেটার ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল সেটা যে একটা শরীর তা চিনতে ভুল হয়নি রাখহরির। তারই কাটা মাথাটা আয়েশ করে খাচ্ছিল সে। আর ওই আতঙ্কের মধ্যেও শরীরটা কার সেটা দেখামাত্র চিনতে দেরি করেনি রাখহরি।
ওটা কার্তিক সমাদ্দারের শরীর।
মণ্ডলবাড়ির লোকজন অবশ্য এত কথা জানত না। পরদিন রাতভোরে মণ্ডলের ছোট মেয়ে তাপসী ঘুম থেকে উঠে তাদের বাড়ির পাশের ছোট পুকুরটায় মুখ ধুতে গিয়ে দেখে সারা পুকুরের জল টকটকে লাল, আর তাতে কাঁচা রক্তের গন্ধ।
কেউ যেটা দেখেনি, কখনও দেখবেও না, সেটা হচ্ছে যে পুকুরের নীচে পাঁক থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এসেছিল একটা প্রায় গলে পচে যাওয়া হাতের হাড়!
বৈঠক বসেছিল মুখুজ্জেবাড়ির বাইরের ঘরে। গাঁয়ের পাঁচজন গণ্যমান্যরা উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন যোগেন ভটচায্যি মশাই। ছিল আরও দুজন যারা সামনাসামনি দেখেছে সেই পিশাচকে, তারা।
রাখহরি আর দনু!
সারা গ্রাম জুড়ে একটা থমথমে সন্ত্রস্ত পরিবেশ। ভোরের আলো ফোটার আগে কেউ ঘরের বাইরে বেরোয় না, আর সন্ধে নামতে না নামতে ঘরের দরজায় খিল! তারপর চিল্লিয়ে গলা ফেড়ে রক্ত তুলে ফেললেও কাউকে পাওয়া যাবে না। গত দশদিনে আটজন শিকার করেছে তালদিঘির পিশাচ! তার সঙ্গে গেছে বছিরুদ্দি আর নাসিরের দুটো দুটো করে চারটে ছাগল, তারিণী কর্মকারের একটা বাছুর আর পাড়ার বোসেদের গোয়াল থেকে দুটো দুধেল গাই। আজকাল সন্ধের পর মানুষ তো দূর, কুকুরও দেখা যায় না তালদিঘির পথে। আশেপাশের গাঁ তো বটেই, এই গাঁয়ের বাসিন্দা যারা তাদের আত্মীয়স্বজনরাও আজকাল সভয়ে এড়িয়ে চলছে তালদিঘিকে।
পুলিশে অবশ্য প্রথামাফিক খবর দেওয়া হয়েছিলো, তারা চৌকিও বসিয়েছিল একখান। মস্ত একখান ভুঁড়ি দুলিয়ে আর মোটা গোঁফজোড়া মুচড়ে হাবিলদার রতনলাল চৌবে এসে বসেছিলো চৌকিতে। ‘কওনো বদমাশ উদমাস কর রহা হোগা ইয়ে সব। আনে দো সালেকো হামরে সামনে,’ ভজুয়ার দোকানের হিং দেওয়া গরমাগরম একধামা কচুরি বেশ আয়েশ করে চিবোতে চিবোতে সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা জনা দশেক লোককে বলেছিল রতনলাল। তারপর একঘটি ঘন সর পড়া দুধ গলায় ঢেলে তৃপ্তির উদগার তুলে বাকি কথাটা একটু ভারী গলায় শেষ করেছিল সে, ‘একবার হামরে হাথ লগ যায়ে তো দেখনা। উলটা টাংগকে মারেঙ্গে সালেকো।’
পরদিন ভোরে চৌবেজি’র বেল্টটা আর একপাটি জুতোই শুধু পাওয়া গেছিল বাজারের মধ্যে, তখনও রক্ত লেগে ছিল দুটোতেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বডির কোনও হদিস পাওয়া যায়নি।
‘পুলিশ কী বলছে?’ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করেন রায়বাবু। এককালে উঁচু পোস্টে সরকারি চাকরি করতেন পরিমল রায়, তাঁর মতামতের একটা দাম আছে।
‘লোকাল থানা হাত তুলে দিয়েছে,’ হতাশ স্বরে বলেন মুখুজ্জেমশাই, ‘বড়বাবু বললেন ভূতপ্রেতের কারবার ওনার আন্ডারে পড়ে না। উনি রিপোর্ট লিখে সদরে ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরপর যা করবার ওপরওয়ালারা করবেন।’
‘তাহলে উপায়?’ শুকনো মুখে প্রশ্ন করেন সাঁপুইদের বড়কত্তা অধীররঞ্জন সাঁপুই, লোকে বলে গেঁড়ে সাঁপুই, ‘তদ্দিনে তো গাঁ ফাঁকা হয়ে যাবে দাদা। আট আটজন লোক…’
‘আট নয় কাকা, নয়জন,’ চিন্তিত মুখে বলে রাখহরি, ‘গতকালই গরাণহাটার জঙ্গলে পচাগলা শরীর পাওয়া গেছে মনসুর মিঞা’র। মাথার আধখানা আর একখানা পা পাওয়া গেছে মাত্র…গাড়ি সারাই করে যখন জঙ্গলে গেছিল পেচ্ছাপ করতে, তখনই বোধহয়…’
ওদিকে নিতাই খুঁজছিল শামুকে। বউকে চোখে চোখে রাখে নিতাই, নতুন বিয়ের ক্ষেত্রে সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কারণটা অন্য, তার মনে একটা সন্দেহ পাকিয়ে উঠছে কয়েকদিন ধরেই।
মা যেদিন মন্দিরে পড়ে গেলেন, তবে থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে মেয়েটা। কথা নেই কারও সঙ্গে, চুপচাপ থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়ে, কথা বলতে গেলে এমন চোখে তাকায় যে দেখে বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়।
তার থেকেও সাঙ্ঘাতিক ঘটনাটা ঘটে কয়েকদিন আগে।
প্রথম প্রথম এতসব খেয়াল করেনি নিতাই। তার ঘুম খুব গাঢ়, একবার বালিশ ছুঁলে তার আর সাড় থাকে না। তবে সেইদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছিল নিতাইয়ের, উঠে অভ্যেসবশে পাশে হাত বাড়িয়ে যে দেখে পাশে বউ নেই! প্রথমে ভেবেছিল হয়তো বাথরুমে গেছে শামু, এসে পড়বে এখুনি। বেশ কিছুক্ষণ পরেও শামু আসছে না দেখে উঠে যায় নিতাই, গিয়ে দেখে বারান্দায় গ্রিলের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে অদ্ভুত সুরে মন্ত্রের মতো কীসব যেন চাপা গলায় নাকি কান্নার মতো আউড়ে যাচ্ছে তার নতুন বিয়ে করা বউ।
সেইদিন হঠাৎ অকারণেই শীত করে উঠেছিল নিতাইয়ের। চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছিল সে। তারও ঘণ্টাখানেক পরে ভোররাতে দিকে ফিরে আসে শামু।
কী করছিল সে অত রাতে? কোথায় গেছিল তার বউ?
‘শামু, ও শামু, গ্যালে কই?’ চাপাস্বরে ডাকতে ডাকতে বাড়ির অন্দরমহলে বউকে খুঁজছিল নিতাই। একটা কুটিল সন্দেহ তার মনে কয়েকদিন ধরে ক্রমেই ঘোট পাকিয়ে উঠছে। শুধু সেইদিন নয়, তারপর থেকেই রোজ রাতে ঘুমোবার পর বেশ কিছুক্ষণের জন্যে শামু যায় কোথায়? আর সেইসব রাতেই একটার পর একটা অঘটন ঘটে যায় কী করে?
‘শামু, শামুউউ, কই গ্যালে গো? লোকজন এসেছে, চা’টা করে দাও দিকি। বলি নিমকি-টিমকি আছে কিছু?’ বলতে বলতে রান্নাঘরের পেছনে এসে উপস্থিত হয় নিতাই। আর তারপর সামনের দৃশ্যটা দেখে শিরদাঁড়ায় একটা বরফের স্রোত নেমে যায় তার।
সেখানে তখন শামু পিঠ ফিরিয়ে বসে একটা অদ্ভুত কাজ করছিল। তার সামনে কঁক কঁক করে ছটফট করছে বাজার থেকে কিনে আনা দু-চারটে মুরগি, স্পষ্টতই ভয় পেয়েছে তারা। আর আছে একটা সদ্য কাটা পাঁঠা। এ-বাড়িতে মুরগি বা পাঁঠা বাজার থেকে কেটে আনা হয় না, জ্যান্ত আনা হয়। তারপর এই বাড়িতেই কেটেকুটে রান্না করা হয় তাদের। পাঁঠা কাটার জায়গাটা একটু দূরে।
খানিকক্ষণ আগে বিশু কামার এসে পাঁঠাটা কেটে দিয়ে গেছে, মাটিতে শোয়ানো আছে কাটা পাঁঠাটা। আর নিতাইয়ের বউ, সদ্য বিয়ে করা বউ সেই পাঁঠার রক্ত দু-হাতে তুলে নিজের সারা মুখে মাখছে আর রামদাটার ওপর আঙুলে করে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে! সঙ্গে সেই দুর্বোধ্য ভাষায় সুরেলা মন্ত্র আউড়ানো!
ধীরে ধীরে সরে আসে নিতাই, বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল তার। হা ঈশ্বর, এ কী দেখল সে? সে যা ভাবছিল তাহলে কী সেটাই সত্যি?
‘কিন্তু এর প্রতিকার কী মুখুজ্জেমশাই?’ আর্তনাদ করেন বগলাচরণ শিকদার, ‘কাজ কারবার সব লাটে উঠতে চলল যে। ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়ে তো গাঁয়ে বাস করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেখছি। আপনিই বলুন, এভাবে বাঁচা যায় নাকি?’
রাখহরি একটা কথা ভাবছিল, ভ্রু’টা কুঁচকে ছিল তার, ‘আচ্ছা মণ্ডলদের ঠানদিদিকে একবার জিগ্যেস করলে হয় না? মানে কালীগিরি তান্ত্রিক এসব থেকে বাঁচবার কোনও কিছু মন্তর বা উপায় টুপায় কিছু বলে গেসলো কি না ঠানদিদির ওই সেই পূর্বপুরুষকে?’
কথাটা মনে ধরে সবার, এই কথাটা কারও মনে আসেনি কেন এতক্ষণ! তার ওপর ঠানদিদি এখন এ বাড়িতেই, বাসন্তীপিসির পরিচর্যার তদারক করছেন। মুখুজ্জেমশাই কাজের লোক কানাইকে ডেকে বলেন অন্দরমহলে খবর দিতে।
আধ হাত ঘোমটা টেনে একটু কুঁজো হয়ে এলেন ঠানদিদি। এঁদের সক্কলের থেকে বয়সে বড় হলে কী হবে, প্রাচীন যুগের লোক তিনি, ঘোমটা টোমটা বিলক্ষণ মানেন। দনু উঠে গিয়ে ঠানদিদির হাত ধরে যত্ন করে একটা মোড়ায় বসিয়ে দেয়, ‘বেঁচে থাকো বাবা,’ থুত্থুরে গলায় নাতির বয়সি নবীন মাস্টারমশাইটিকে আশীর্বাদ করেন ঠানদিদি। তারপর সমবেত ভদ্রজনের প্রশ্নটা শুনে অনেকক্ষণ ভুরু কুঁচকে টুচকে ভেবে বলেন, ‘কই না তো! এরম কিছু তো বাবা আমাকে বলে যায় নি রে ভাই।’
‘কিছুই বলে জাননি কালী তান্ত্রিক? ও ঠানদিদি, একটু চেষ্টা করো না, যদি কিছু মনে টনে থেকে থাকে তোমার’, অনুনয় করেন এক-দুজন।
ভুরু কুঁচকে কী সব যেন ভাবতে থাকেন ঠানদিদি। সেইদিকে সাগ্রহে চেয়ে থাকে সক্কলে। বেশ কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে বলতে থাকেন তিনি, ‘একবার…একবার অবশ্য…বুঝলি ভাই…আমি তখন খুব ছোট…রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি…মা এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে এসে বাবার সঙ্গে গল্প করছে…এমন সময় কথায় কথায় এই খোঁড়া ভৈরবীর কথা ওঠে, বুঝলি? আমি…আমার তখন ঘুম আসি আসি করছে…মা ঠিক এটাই জিগ্যেস করল…চোখটা জুড়িয়ে আসার আগে…ঠিক শুনিনি…মনে হল বাবা বলছে…কী যেন বলল?’ বলে উদ্ভ্রান্ত চোখ দুটো তুলে সবার দিকে চাইলেন…’কী বলেছিল বলত বাছা! মনে পড়ে না কেন?’
এতক্ষণ সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল ঠানদিদির কথা। কারও কিছু বলতে সাহস হচ্ছিল না। শুধু রাখহরি ফিসফিস করে বলল, ‘আরেকটু মনে করার চেষ্টা করো না ঠানদিদি। কী বলেছিল তোমার বাবা?’
চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করেন ঠানদিদি, কপালটা কুঁচকে যায় বুড়ো মানুষটার, ‘বাবা বলছিল…বাবা বলছিল যে…যে…আমাদের যে পূর্বপুরুষের জন্যে মায়ের মূর্তির আঙুল ভেঙেছিল…তিনি নাকি খুব ভয় পেয়েছিলেন…তখন তাঁকে নাকি কালী তান্ত্রিক সাহস দিয়ে বলে…কালীগিরি বলে গেছিল যে…কী যেন…হ্যাঁ …মনে পড়েছে…কালী তান্ত্রিক বলে গেছিল যে…’
‘কী বলে গেছিল কালী তান্ত্রিক?’ ফিসফিসিয়ে জিগ্যেস করে দনু।
‘বলে গেছিল যে…মায়ের যদি ইচ্ছে হয় তাহলে নিজের পুজোর ব্যবস্থা মা নিজেই করবেন।’
শুনেই লাফিয়ে ওঠেন অধীর সাঁপুই, ‘ধুর, এটা একটা সমাধান হল?’ হতাশা ঝরে পড়ে তাঁর স্বরে, ‘এ তো একটা কথার কথা, এরকম তো আমরা হামেশাই বলে থাকি। বলি উনি কি কোনও কাটান বা মন্তর বলে গেছিল তোমার ওই পূর্বপুরুষকে? যেটা কিনা তাঁর ছেলে, ছেলের ছেলে এই করে করে তোমাদের কারও কাছে জানা আছে?’
অসহায়ের মতো মাথা নাড়েন ঠানদিদি, ‘না রে ভাই, এমন কিছু তো বাবা আমাকে বলে গেছে বলে মনে পড়ে না!’
‘আপনার আর কোনও ভাই বা বোন নেই ঠানদিদি?’ প্রশ্ন করেন মুখুজ্জেমশাই।
‘না রে ভাই, আমার তো আর কোনও জ্ঞাতিগুষ্ঠি কেউ নেই।’
‘তাহলে আর কী মুখুজ্জেমশাই, এই গাঁ থেকে বাস ওঠাতে হবে মনে
হচ্ছে,’ হতাশ শোনায় রায়বাবুর গলা, ‘গিন্নি কথাটা অনেকদিন ধরেই বলছিলেন বটে। কালই তবে আমরা পাটনা চলে যাচ্ছি মেয়ের কাছে। মা যদি চান তবেই ফিরব, নচেৎ নয়। চললাম মুখুজ্জেমশাই, চললাম ভাইসব, সাবধানে থাকবেন, ভৈরবী মা সবার মঙ্গল করুন।’ বলে চাদরটি কাঁধে দুলিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দেন রায়মশাই।
সেই শেষ দেখা রায়বাবুর। পরের দিন ভোরবেলা পাশের গ্রাম জগতবল্লভপুরের একজন মুনিষ এসে খবর দেয় যে দুই গাঁয়ের মধ্যিখানে যে শুকনো খালটা আছে তার মধ্যে রায়বাবু পড়ে আছেন। রায়বাবু বলতে তাঁর শরীরটার কথাই বলেছিল সে। কোমরের নীচ থেকে অর্ধেক খাওয়া, মাথাটা উলটো করে ঘোরানো। তবে তার থেকেও যেটা ভয়ানক সেটা হচ্ছে যে বাকি শরীরটা কে যেন ধারালো রামদা জাতীয় কিছু একটা দিয়ে প্রবল আক্রোশে কুপিয়ে খণ্ড খণ্ড করে রেখে গেছে।
আর খালের মাটি ভেদ করে, রায়বাবুর খুলি ফাটিয়ে মুখ ফুঁড়ে উঠেছিল একটা পুরোনো, শ্যাওলা ধরা হাড়ের টুকরো!
নিঃসাড়ে ঘুমিয়েছিল নিতাই। মানে ঘুমের ভান করে একপাশ ফিরে শুয়েছিল বিছানায়। আজ অমাবস্যা, যেদিন তার মা ভৈরবী মন্দিরে পড়ে গেছিল তারপর ঠিক পনেরো দিন হল আজ। তার ওপর আজ সূর্যগ্রহণও বটে। কালী তান্ত্রিকের কথা সত্যি হলে আজই একটা এসপার বা ওসপার হয়ে যাওয়ার কথা।
আজ খোঁড়াভৈরবীর মন্দিরে ধুমধাম করে অমাবস্যার পুজো হওয়ার কথা ছিল, প্রতি অমাবস্যাতে তাই হয়। কিন্তু এইবার আর কেউই সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকার ঝুঁকি নেয়নি, সবার কাছেই ভক্তির থেকে ভয়ের দাম বেশি। ফলে গত তিনশো বছরের মধ্যে এই প্রথম অমাবস্যার পুজোয় নিষ্প্রদীপ থাকবে খোঁড়া ভৈরবীর মন্দির।
মাঝরাত শেষ হয়েছে কি হয়নি, বাইরে একটা শনশন হাওয়া উঠল। তারই মধ্যে নিতাইয়ের মনে হল কে যেন দূর থেকে মেয়েলি গলায় একবার ‘আয় আয় আয়’ করে ডেকে গেল, সেই ভূতুড়ে ডাকে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। চোখ বুজে শুয়ে আছে নিতাই, ঠিক এমন সময় বাইরের হলঘরের বড় ঘড়িটায় ঢং করে একটা শব্দ হল।
রাত একটা।
এইবার বিছানায় একটা মৃদু নড়াচড়া টের পায় নিতাই। চোখ বুজে থাকলেও শরীরের বাকি সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে ওঠে তার, পেশিগুলো টানটান হয়ে যায়।
শামু উঠছে বিছানা ছেড়ে।
নাক ডাকার শব্দটা বাড়িয়ে দেয় নিতাই। বুঝতে পারে যে উঁচু খাট থেকে হালকা পায়ে ঘরের মেঝেতে লাফিয়ে নামল শামু। ঝুন করে একটা আওয়াজ হল নুপূরের।
মিনিট তিনেক অপেক্ষা করে উঠে পড়ে নিতাই। বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে সে। সারা বাড়ি চুপচাপ, কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে নুপূরের শব্দ আসছে তার কানে। কোনদিকে গেল শামু? বারান্দার দিকটা একবার দেখে নেয় নিতাই, নাহ একদম ফাঁকা।
খিড়কি দরজার দিকে আসতেই ঝুন ঝুন ঝুন শব্দটা ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যায়। মানে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো শামু। ওদিকে যেতেই সিঁড়ির নীচ থেকে ছায়ার মতো বেরিয়ে আসে দুইজন। তাদের একজনকে ফিসফিস করে প্রশ্ন করে নিতাই, ‘কাকা, তোমার বউমাকে দেখলে নাকি?’
সেইভাবেই চাপাস্বরে উত্তর দেয় রাখহরি, ‘এই তো এখান থেকে খিড়কি দরজার দিকে গেল। নুপূরের আওয়াজ তো শুনলামই…আর…’, কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় সে।
‘আর কী কাকা?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিতাই।
‘বউদির চোখ দুটো না কেমন যেন জ্বলছিল, বুঝলে নিতাইদা…কয়লায় আগুন লাগলে যেমন লাগে…’ উত্তর দেয় দ্বিতীয়জন, দনু।
শিকারে বেরিয়েছে শামু? বুকটা ধ্বক করে ওঠে নিতাইয়ের। একটা চাপা কষ্টও যেন বুকে গুমরে উঠতে থাকে তার, তার বউই তাহলে সেই পিশাচ? এদ্দিন ধরে একটা পিশাচীকে নিয়ে ঘর করেছে সে?
তারপর চোয়াল শক্ত করে সে, আজ এর শেষ দেখে ছাড়বে নিতাই মুখুজ্জে।
‘অস্তর কিছু নিয়েছো?’ প্রশ্ন করে নিতাই।
রাখহরি নিয়েছে একটা আধহাতি তলোয়ার, আর দনু নিয়েছে একটা পাকা বাঁশের লাঠি। সব দেখেশুনে নিতাই বলে, ‘চলো যাওয়া যাক।’
খিড়কি দরজাটা ভেজানোই ছিল, অর্থাৎ শামু এখান থেকে এখনই বেরিয়েছে। ধীরে সন্তর্পণে ওরা তিনজন বাইরে আসে। এবার ওরা যাবে কোনদিকে? নুপূরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না কেন?
বাঁদিকে এগোলে একটা ছোট মতন ফাঁকা জমি, আর ডানদিকে একটু এগোলে একটা বটগাছ। তার পেছনে মণ্ডলদের পুকুর, যে পুকুরের জলই সেদিন রক্তে ভেসে গেছিল। প্রথমে ওরা ডানদিকে যাওয়াই মনস্থ করে।
বটগাছের কাছে এসে ওরা হদিস পায় না যে কোনদিকে যাবে, দুদিকে দুটো রাস্তা গেছে। এমন সময় হাতের ছোট টর্চটা মাটির দিকে নামিয়ে একবার জ্বালিয়েই বন্ধ করে দেয় নিতাই, সেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে জ্বলে ওঠা আলোয় ওরা দুটো জিনিস দেখতে পায়।
এক, দুপাটি নুপূর কে যেন খুলে রেখে গেছে তেমাথার মোড়ে, তাতে সিঁদূর লাগানো।
আর দুই, মাটিতে জলপায়ের ছাপ। জলের ফোঁটায় আর পায়ের ছাপে মিলেমিশে একটু অস্পষ্ট হয়ে গেলেও বোঝা যায় যে এই পুকুরে পা ডুবিয়ে কেউ হেঁটে গেছে দক্ষিণমুখো।
ওইদিকেই খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ, তিনজনে চুপচাপ হাঁটা দেয় সেদিকে।
রাখহরির মনে হচ্ছিল টর্চের চকিত আলোয় আরও কী যেন একটা দেখল ও, কিন্তু সেটা যে ঠিক কী সেটা মাথায় বসছিল না তার। কী যেন দেখল ও? কী যেন একটা অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না? এই দমবন্ধ করা ভূতুড়ে পরিবেশে অস্বস্তি হতে থাকে রাখহরির।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা টের পাচ্ছিল যে সেই পচা মাংসরক্ত মেশানো গন্ধটা ধীরে ধীরে বাতাসে পাক খেয়ে খেয়ে মিশছে। চারিদিকে অমাবস্যার মিশমিশে কালো অন্ধকার, তারার আলোও দেখা যায় না আকাশে। তার মধ্যেই কাঁচা পথ ছেড়ে পাকা রাস্তায় ওঠে ওরা। রাখহরি আর নিতাই গ্রামের মানুষ, আঁধারে তাদের চোখ জ্বলে। অসুবিধা হচ্ছিল দনুর, শহরের লোক সে, রাতের অন্ধকারে রাস্তাঘাটে চলা অভ্যেস নেই। পদে পদে হোঁচট খাচ্ছিলো সে।
মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর বাঁ-পাশে বাঁশবাগান এল, সেটা পেরোলেই মাঠ। আর সেখানে আসতেই একটা অবয়ব নজরে পড়ল ওদের!
এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে যে একটা ছায়ামূর্তি রাস্তার শেষ দিকে ওদের আগে আগে হাঁটছে, রাস্তা পেরিয়ে মাঠে নামবে এবার। সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও সেই কালো ছায়াটির অবয়ব চিনতে ভুল হয় না ওদের।
ওটা শামু।
কিন্তু শামুর হাতে লম্বা মতো ওটা কী ঝুলছে?
তিনজনেই চট করে একটু রাস্তার বাঁ-পাশে বাঁশবাগান ঘেঁষে সরে আসে। ধীরে ধীরে পিছু নিতে হবে শামুর। দেখতে হবে যে, ও কোথায় যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র শব্দ হলেই সর্বনাশ।
ঠিক এইসময় পিশাচের গায়ের পচা গন্ধটা যেন এই অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ দপ করে বেড়ে উঠল। প্রবল বেগে বমি উঠে আসতে লাগল ওদের। যদিও শামুর দিক থেকে নজর সরাচ্ছিল না ওরা। শামুও যেন মাঠে নামার আগে একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর শিয়াল যেমন নাক উঁচিয়ে বাতাসে গন্ধ শোঁকে ঠিক সেইভাবে মাথা উঁচু করে কী যেন শুঁকতে লাগল সে।
নিজের বুকের ধক ধক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল নিতাই। কী করছে শামু? তাদের গায়ের গন্ধ শুঁকছে? এইবার শামু পিশাচীর শিকার কী ওরা? নিতাইয়ের পিঠটা খামচে ধরেছিল দনু বা রাখহরির মধ্যে কেউ একজন, সে হাতটা থরথর করে কাঁপছিল। শ্বাস বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে ছিল ওরা, ঠিক সেইসময়ে একটা অঘটন ঘটে গেল। পাশে সরতে গিয়ে একটা ছোট গর্তে পা পড়তে ‘আহ’ করে উঠল রাখহরি।
সেই শব্দ শুনে ধীরে, অতি ধীরে পিছনে ঘুরল শামু। আর তারপর টকটকে চোখদুটি মেলে সোজা তাকালো তাদের দিকে।
এরপর সেই ঘোর অন্ধকারের আকাশ আর আর মাঠ পিছনে রেখে, ধীরেসুস্থে হাতের লম্বা জিনিসটার মাথা মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে আস্তে আস্তে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল সেই অবয়ব, একটু আগেও যাকে নিতাই চিনতো শামু বলে। নিতাইয়ের চোখের তারা নড়ছিল না বিন্দুমাত্র, সেই অন্ধকার রাতে তার চোখের সামনে ফুটে উঠেছিল এক আশ্চর্য ভয়াল ছবি। শামুর পিছনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে এক শব্দহীন নীলকালো রঙের আকাশ, আকাশের শেষে একপ্রান্তে নিঃসাড়ে ফুটে আছে একটি অসহায় আলোহীন মন্দিরের ছায়া, আর মন্দিরের পায়ের কাছে বিছিয়ে আছে একটি ধূ-ধূ করা মাঠ, খোঁড়াভৈরবীর মাঠ!
সেই মাঠের সামনে সরু পথ ধরে এগিয়ে আসছে একটি নারীমূর্তি, যার হাতে ধরা জিনিসটার মাথা রাস্তার মাটিতে পাথরে ঠেকে ভীতিপ্রদ আওয়াজ তুলছে,
ঠংং ঠংং ঠংং…
ভয়ে যেন পাথর হয়ে গেল নিতাই, তার কাঁধ খামচে ধরা হাতের ব্যাপারে তার মনেই রইল না আর। অজগরের চোখের দিকে যেমন তাকিয়ে থাকে ছাগলছানা, ঠিক তেমনই সামনের দিকে চেয়েছিল সে।
ধীরে ধীরে সেই ছায়ামূর্তিটা আরও কাছে আসে তার। এতক্ষণে তার হাতে ধরা জিনিসটির আন্দাজ পায় নিতাই! যে রাম’দাটা দিয়ে তাদের বাড়িতে জ্যান্ত পাঁঠা কাটে বিশু কামার, সেইটাই শামুর হাতে!
আজ আর তাহলে খালিহাতে নয়, অস্ত্রহাতে শিকারে বেরিয়েছে তালদিঘির পিশাচ!
পা’টা আটকে গেছিল নিতাইয়ের, চারপাশের আর যেন কিছু তার নজরে ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনের দিকে চেয়ে আছে সে, ঠিক সেই একটাই ঘটনা ঘটল।
নিতাইয়ের চোখের সামনে হঠাৎ করে একটা কুয়াশার মিহি পর্দা যেন নেমে এল রাস্তার মধ্যিখানে। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়, কয়েক সেকেন্ডের বেশি হবে না। পরক্ষণেই সরে গেল পর্দা, আর দেখা গেল যে ওর সামনে আর কিচ্ছু নেই, সব ফাঁকা!
শামু উধাও!
ব্যাপারটা এত চকিতে ঘটে গেল যে ধাঁধা লেগে গেল নিতাইয়ের। মনে হল হঠাৎ করেই যেন উবে গেল সামনের লোকটা।
আস্তে আস্তে বাঁশবনের মধ্যে আরও খানিকটা সেঁধিয়ে গেল নিতাই। আর ঠিক তখনই খেয়াল হল যে তার পাশে দনু বা রাখহরি, দুজনের কেউ নেই।
চাপাস্বরে এক বার দুজনের নাম ধরে ডাকল নিতাই। অন্ধকার হাওয়া যেন বাঁশপাতার মধ্যে বয়ে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলতে লাগল নিতাইয়ের চারপাশে। নিতাইয়ের মনে হল যেন সেই অন্ধকার বাঁশবন তাকে গিলে খেতে আসছে। এই প্রথম ভয় পেল নিতাই, তীব্র ভয়!
বাঁ-দিকে একটু সরলো নিতাই, তার পায়ের নীচে মড়মড় করে উঠল শুকনো পাতার দল। অন্ধকারের মধ্যেই ঠাহর করে বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে অন্যদিকে যেতে চাইছিলো সে। ধীরে, খুব ধীরে পা ফেলতে লাগল সে।
আর ঠিক সেই সময়েই ব্যাপারটা কানে এল তার।
ঠিক যখনই সে পা ফেলছে পাতার ওপর, ঠিক তখনই আরেকজনও পা রাখছে শুকনো পাতার স্তূপের ওপর। যেন নিতাইয়ের পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দে লুকোতে চাইছে নিজের পায়ের শব্দ। সেই নির্জন অন্ধকারের মধ্যে কে যেন অতি যত্নে, অতি সন্তর্পণে অনুসরণ করছে তাকে!
প্রবল ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল নিতাই। শীতের রাতেও দরদর করে ঘামতে লাগল সে। তবুও তার মধ্যেই এক-পা দু-পা করে এগোচ্ছিল নিতাই। মাঝে মাঝে তাকে অনুসরণ করার শব্দটা দূরে সরে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে একেবারে কাছে চলে আসছি, কিন্তু নিতাইয়ের সবসময়েই মনে হচ্ছিলো যে একজোড়া লাল টকটকে চোখ যেন অনুসরণ করছে তাকে। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল নিতাইয়ের, নিজের শ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল সে।
হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে একটা বড় ঝোপ পায় নিতাই, ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলতে খেলতে এখানে বহুবার লুকিয়েছে সে। তার আড়ালে বসে একটু জিরোতে যাবে নিতাই, ঠিক সেই সময় আকাশ বাতাস শিউরে দিয়ে কে যেন ডেকে উঠল খোনা গলায়, ‘আয় রে আয়, আয় রে আয়…’
সেই ডাক শুনে বুকটা খালি হয়ে গেল নিতাইয়ের। কোনও দিকে না তাকিয়ে দিগ্বদিক জ্ঞান হারিয়ে দুদ্দাড় করে দৌড়তে লাগল সে। তার গায়ে সপাং সপাং করে বেত মারতে লাগল কচি বাঁশের ডগাগুলো। সেসব গ্রাহ্য করল না নিতাই, পাগলের মতো দৌড়তে লাগল। এক একটা মুহূর্ত অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল তার।
মনে নেই কতক্ষণ পাগলের মতো দৌড়েছে সে, এমন সময় হঠাৎ করেই যেন বাঁশবনটা শেষ হয়ে গেল তার সামনে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।
সামনে খোঁড়া ভৈরবীর মাঠ।
আর সেই মাঠের পাশে, বাঁশবনের ধার ঘেঁষে ওটা কী?
বা, ওটা কে?
একদলা আঁধার যেন কীসের ওপর ঝুঁকে বসেছিল তার দিকে পেছন ফিরে। নিতাইয়ের পায়ের শব্দ শুনে সেই ঘোর কালো অন্ধকার ফিরে তাকালো তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার টকটকে লাল চোখদুটো দেখে ধ্বক করে বুকটা যেন মুহূর্তের জন্যে গলায় আটকে গেল নিতাইয়ের।
লাল টকটকে জিভ বার করে একবার যেন ঠোঁট চেটে নিল সেই জমাট কালো অন্ধকার, তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল সে…সেই অপার্থিব হাসি শুনে শরীরের প্রতিটি রক্তের ফোঁটা জমে গেল নিতাইয়ের। হাতে পায়ে আর বল পেল না সে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। আর ঠিক তখনই তার চোখে পড়ল কার ওপর এতক্ষণ ঝুঁকে পড়ে ছিল সেই অন্ধকারের পুঞ্জ।
রাখহরির শরীর।
আস্তে আস্তে চোখ ওপরে তোলে নিতাই, দেখে যে আগুনের ভাঁটার মতো চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সেই দলা দলা কালো ছায়া। তারপর নিতাইয়ের পিছনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে খিল-খিল করে হেসে উঠে ডানহাতে কী একটা যেন তুলে ধরে সে!
তাদের বাড়ির রামদা’টা!
আর সহ্য হয় না নিতাইয়ের, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সে।
আর ঠিক সেই সময়েই চোখ খুলে তাকায় রাখহরি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে কয়েক মুহূর্ত ভোম মেরে ছিল বটে, কিন্তু তারপরেই হুঁশে ফিরে আসে সে। আর দেখে যে অপার্থিব ছায়ার ডেলা তাকে টেনে এনেছিল এই বাঁশবনের কিনারে, সেই-ই একটা বড় রাম’দা তুলেছে সামনে অজ্ঞান হয়ে থাকা নিতাইয়ের দিকে।
আর থাকতে পারল না রাখহরি। এককালে মুখুজ্জে পরিবারের অনেক নুন খেয়েছে তার পরিবার। আজ প্রাণ থাকতে তাদেরই এক সন্তানকে বেঘোরে মরতে দেবে রাখহরি? তার রক্তে ঘুমিয়ে থাকা ভয়ডরহীন আধা ডাকাতটি যেন হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠে রক্তচক্ষু মেলে চাইল চারিদিকে। পিঠের দিকে গুঁজে রাখা আধহাতি তলোয়ারটা হাতড়ে হাতড়ে বার করে সেই অন্ধকারের রাক্ষস, থুড়ি রাক্ষসিটার পায়ে বসিয়ে দিল রাখহরি সাধুখাঁ।
প্রথমে তলোয়ারটা অনেকটাই গুঁজে দিতে পেরেছিল বটে রাখহরি। কিন্তু তারপরই তাকে এক লাথিতে দশ হাত দূরে ফেলে দেয় সেই পিশাচিটা, তাতে তার অমানুষিক জোরটা টের পায় রাখহরি। তার গুরুদেব তাকে শিখিয়েছিলেন যে মারামারির সময় কখনও মাথা গরম করতে নেই। এতদিন বাদে বোধহয় গুরুর শিক্ষাটা কাজে দিল তার। উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়তেই কিছুটা গড়িয়ে যায় রাখহরি, তারপর দ্রুত উঠে একটা ঝোপের আড়ালে চলে যায় সে।
সেখানে বসে দম নিচ্ছে সে, ঠিক তখনই একটা মোটা মোটা নখওয়ালা থাবা দিয়ে কে যেন তার গলাটা চেপে ধরে পেছন থেকে!
আতঙ্কের থেকেও বেশি হতবাক হয়ে গেছিল রাখহরি, এ আবার কার হাত? তবে কিনা চোদ্দো বছর ধরে জামালউদ্দিন ওস্তাদের কাছে মিছেই দেহবন্ধন আর নানান শারীরিক কসরৎ শেখেনি সে এককালে। এক ঝটকায় সেই অমানুষিক থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করে পাশের ঝোপে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে রাখহরি।
যে থাবাদুটো রাখহরির গলা টিপে ধরেছিল, সে হাতদুটো থমকে যায় একটু, তারপর এক-পা এক-পা করে ইতিউতি হাওয়ায় গন্ধ শুঁকতে থাকে সে হাতদুটোর মালিক, যেন বোঝার চেষ্টা করে যে রাখহরি ঠিক কোথায় আছে।
ধীরে ধীরে নীচু হয়ে একটা ঢিল কুড়িয়ে নেয় রাখহরি, তারপর সেটা ছুঁড়ে দেয় দূরের একটা ঝোপের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল যে পিশাচটার দৃষ্টি ওদিকে ঘুরিয়ে দিলে সে যদি এক দৌড়ে নিতাইয়ের শরীরটা টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। মানে যতক্ষণ এই অসম লড়াইতে সে বেঁচে থাকতে পারে ততক্ষণই তার জিত। ভোর হতে আরও ঘণ্টা দু-আড়াই। এই সময়টা পার করতে পারলেই…
প্রথম দিকে রাখহরির মতলবটা খেটেও গেছিল বটে, ঢিলটা অনেক দূরেই তাক করে ফেলেছিল রাখহরি, পিশাচটা দৌড়েও গেছিল সে দিকে। মুশকিলটা হল যখন নিতাইয়ের শরীরটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই অস্বাভাবিক দ্রুততায় ঝড়ের মতো সেই বাঁশবন তছনছ করে তার সামনে এসে দাঁড়াল সেই দানব!
ধীরে ধীরে নিতাইয়ের অচৈতন্য নিথর শরীরটা মাটিতে শুইয়ে ফেলে পিছনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল রাখহরি। মাথা আর বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছিল তার। দরদর করে ঘামছিল সে, তার মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছিল এতক্ষণে। জীবনে এত বীভৎস আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়নি তার।
তাকে কে টেনে আনল সেই বাঁশবনের দিকে? আর আনলোই যদি তো মারল না কেন? আর পরে তার গলাটা আঁকড়ে ধরলই বা কে? তার সামনে এখন কে? আর তখনই বা কে ছিল?
নরক থেকে উঠে আসা সাক্ষাৎ কালপিশাচটা তখন এক-পা এক-পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছিল, তার মুখের থেকে রক্তের ফেনা উড়ে যাচ্ছিল আশেপাশের বাতাসে। সেই অমানুষিক ভয়াল বীভৎসতার সামনে এতক্ষণ ধরে জমিয়ে রাখা যাবতীয় সাহস একেবারেই উড়ে গেল রাখহরির। তবু তার মধ্যেই তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নরকের জীবটিকে চিনে নিতে অসুবিধা হল না তার! নিজেরই দু’চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না! তাহলে সে যা ভেবেছিল, সত্যিই তাই?
অসহায় আতঙ্কে পালাতে গিয়েও পালাতে পারে না রাখহরি, উলটে পড়ে যায় মাঠের ওপর। স্থিরভাবে সে দেখে যে ধীরে ধীরে এসে তার ওপর দুদিকে দুই পা মেলে দাঁড়ায় সেই পিশাচ। উগ্র রক্তমাংসের গন্ধে আর ভয়ে বমি উঠে আসে রাখহরির।
ঈশ্বরের নাম জপছিল রাখহরি, তার মধ্যেই পিশাচটা তার বড় হাতদুটো নামিয়ে আনল রাখহরির কণ্ঠার ওপর। নারকীয় দুটো বড় বড় বাঁকানো নখ সবে নেমে এসেছে গলা বরাবর, চোখের সামনে তার ভয়াবহ মৃত্যু নেমে আসতে দেখে প্রায় অজ্ঞান রাখহরি, এমন সময় মনে হল পিছন থেকে কে যেন মাথাটা টেনে ধরল সেই পিশাচের।
আর তার পরেই শুধু একটা জিনিসই দেখতে পেল রাখহরি, একটু ওপর থেকে একটা বড় রামদা নেমে এল দনুর গলায়। ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে গেল দনু পিশাচের।
আর নিতে পারল না রাখহরির স্নায়ু। শুধু অজ্ঞান হতে হতে দু’চোখ বুজে আসার আগে সে দেখল যে তার একপাশে তখনও পড়ে আছে ধড়ফড় করতে থাকা দনুর লাশ, আর বাঁ-হাতে সেই কাটা মাথাটা ধরে, ডানহাতে রক্ত চুঁইয়ে পড়া রামদা’টা টানতে টানতে মন্দিরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মুখুজ্জেবাড়ির নতুন বউ!
কিন্তু অজ্ঞান হতে হতেও একটা জিনিস দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় রাখহরি!
প্রথম থেকেই যে খটকাটা তার মাথায় ঘোরাফেরা করছিল, এক মুহূর্তে যেন সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। প্রথমে সেই পুকুরের পাড়ে নিতাইয়ের টর্চের একঝলকের আলোয় জলপায়ের ছাপ দেখা ইস্তক এটাই তার মাথায় আটকে ছিল, কিন্তু তখন সেটা বোঝেনি সে। বুঝল এখন।
তার চোখের সামনে একের পর এক পা ফেলে খোঁড়াভৈরবীর মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে শামু, ওরফে শাম্ভবী। আর সেই পায়ের ছাপের মধ্যে ডানপায়ের বুড়ো আঙুলের ছাপের কোনও চিহ্ন নেই! তার জায়গায় শুধু রক্তের দাগ।
চোখ বুজল রাখহরি, ঠানদিদির কথা মনে পড়ে গেল তার। কালীগিরি তান্ত্রিক বলে গেছিলেন যে মায়ের যদি ইচ্ছে হয় তাহলে নিজের পুজোর ব্যবস্থা মা নিজেই করবেন। সেই কথাই খেটে গেল আজ, তালদিঘির খোঁড়াভৈরবী আজ নিজের পুজোর নৈবেদ্য নিজেই জোগাড় করে নিয়েছেন!
শামুর ডান পায়ের আঙুল কী প্রথম থেকেই ছিল না, নাকি তারই তলোয়ারের ঘায়ে আজ খোয়া গেল সেটা? সেটা মাথায় ঢোকার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাত রামাই সাধুখাঁ’র উত্তরাধিকারী, রাখহরি সাধুখাঁ!
অসাধারন একটা গল্প! আজকালকার গল্প গুলোয় কোনমতে এরকম গেঁয়ো রহস্যের দেখা মেলে!! পড়তে গিয়ে অনুভব করার মতো গল্প খুব কমই পাই! এটা তার মধ্যে একটা!