খোঁজ

খোঁজ

ঘড়ির কাঁটা ছ’টার ঘর ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি, নীচের রাস্তা থেকে ভেসে এল ভ্যানরিকশার প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন অমিয়বাবু। ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। প্রাতঃকৃত্য সেরে, পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিলেন এতক্ষণ। রিকশা ঠিক সময়ে আসবে তো? একেবারে কাঁটায় কাঁটায় চলে এসেছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে আসেন অমিয়বাবু। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখেন, ভানুয়া ভ্যানরিকশার সিটে বসে ওপরের দিকে চেয়ে আছে। অমিয়বাবুর কথামতো বাঁশ নিয়েছে রিকশায়, শাবলও নিশ্চয়ই এনেছে, চার তলা থেকে ঠিক ঠাহর হচ্ছে না। হাতের ইশারায় ভানুয়াকে অপেক্ষা করতে বলে, অমিয়বাবু ফিরে আসেন। সাইড ব্যাগে জিনিসপত্র সব গোছানোই আছে। টেবিল থেকে ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পাশে পল্লবের ঘর। একবার ভাবেন, ছেলেকে ডেকে বলবেন, বেরোচ্ছি। পরক্ষণেই নিবৃত্ত করেন নিজেকে। কী দরকার। ছুটির দিনে বেচারা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অন্য দিন তো সকাল থেকেই অফিসের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। বউমারও ঘুম হয় না। অমিয়বাবু সকালে যে বেরোবেন, ছেলেকে তো বলাই আছে।

ফ্ল্যাটের দরজা টেনে লিফটের দিকে এগোলেন অমিয়বাবু। আধুনিক লকিং সিস্টেমের কারণে এখন আর বেরোনোর সময় কাউকে বলতে হয় না, দরজাটা দিয়ে যাও।

হাউজিং-এর গেট ভোর থেকেই খোলা থাকে। মর্নিং ওয়াকে যান অনেকে। অমিয়বাবু এসে বসলেন ভ্যানরিকশায়। দেখে নিয়েছেন ভানুয়া শাবল নিয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করল। মেঘলা আকাশ। রাস্তা ভেজা। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ভাল করে আলো ফোটেনি। পনেরোই অগস্ট দিনটার আবহাওয়া প্রায় সময় এরকমই থাকে। অমিয়বাবু ভানুয়ার উদ্দেশে বললেন, তুমি তো বেশ রাইট টাইমে চলে এলে! অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলে নাকি ঘড়িতে?

না, বাবু। প্যাসেঞ্জার একবার টাইম দিলে মাথার মধ্যে ঢুকে যায়। সময়মতো উঠে পড়ি। ভানুয়ার কথায় খুশি হন অমিয়বাবু। লোক বাছতে ভুল হয়নি তাঁর। ভানুয়া রীতিমতো সিনসিয়ার মালুম হচ্ছে। যে কাজে বেরিয়েছেন, এরকম একটা সঙ্গী খুবই দরকার ছিল।

ভানুয়ার সঙ্গে অমিয়বাবুর আলাপ মাত্র চার দিনের। বিষম একটা সমস্যায় পড়ে কাঠগোলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ-ছ’জন রিকশাওলার মধ্যে একে বেছে ছিলেন। শরীরস্বাস্থ্য ভাল, রিকশার অবস্থা নতুন। সমস্যাটা অমিয়বাবুর কাছে গুরুতর হলেও,

অন্যের বিচারে নিতান্ত বুড়োমানুষি মনে হবে। বউমা পলি তো বলল, কী দরকার বাবা এইসব ছেলেমানুষি করার। আসলে ‘ভীমরতি’ কথাটাই ঘুরিয়ে বলেছিল আর কী। পল্লব অবশ্য জোরালো কোনও আপত্তি তোলেনি। বলেছে, দেখো, যা ভাল বোঝো। নিজের বয়সটার দিকে একটু খেয়াল রেখো।

অমিয়বাবুর বয়স এখন পঁচাশি প্লাস। শরীরে কোনও স্থায়ী অসুখ নেই। চল্লিশের পর থেকেই পল্লবের ব্লাডপ্রেশার। বাবাকে ‘না’ বলবে কোন মুখে। অমিয়বাবুর স্ত্রী বেঁচে থাকলে অবশ্যই বাধা দিতেন। প্রত্যেক স্ত্রী যেমন স্বামীর প্রতি অতি সাবধানী হন। পনেরো বছর হল উনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। অমিয়বাবু যে কাজে বেরিয়েছেন, তা খানিকটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও, তিনি নিরুপায়। ব্যাপারটা হয়েছে কী, পনেরোই অগস্ট এলেই অমিয়বাবুর হাত নিশপিশ করে। ধাক্কা মারে জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস। স্বাধীনতা দিবসে নিজের হাতে পতাকা তুলতে পারলেই বুক ভরে যায় অনির্বচনীয় আনন্দে।

গত বছরেও তুলেছেন। নতুন ফ্ল্যাটে আসার পরই সব গন্ডগোল হয়ে গেল। আগে ছিলেন কোন্নগরের নবগ্রামে। পঞ্চাশ বছরের বাস। নিজের উপার্জনে তৈরি করা বাড়ি। পাড়ার লোকের সঙ্গে দারুণ সম্ভাব। সকলেই জানত, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা ছিল। তারা একে একে প্রয়াত হওয়ার পর গত কুড়ি বছর ধরে অমিয়বাবু পাড়ার ক্লাবে পনেরোই অগস্টের দিন পতাকা উত্তোলন করে আসছেন। পল্লবের চাকরিতে ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েছে। প্লেনে হামেশাই হিল্লিদিল্লি করতে হয়। বিদেশেও যায় মাঝে মাঝে। অমিয়বাবুর মেয়ে সুলেখা বড় সন্তান। স্বামীর চাকরিসূত্রে থাকে বেঙ্গালুরুতে। বাপের বাড়ি আসে আকাশপথেই। পল্লব বলল, বাবা, এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকা যায়, এমন কোথাও ফ্ল্যাট নিই চলো। এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দাও। ট্র্যাফিক জ্যামে ফ্লাইট মিস হওয়ার টেনশন থাকবে না। দিদিরও যাতায়াতে সুবিধে হবে।

ছেলের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সায় দিয়ে ছিলেন অমিয়বাবু। কোনও পাড়া বা রাজ্যে নিজেকে আবদ্ধ করার প্রবণতা তাঁর নেই। গোটা দেশটাই তো আপনার। দেশভাগের আগে যৌবনের প্রারম্ভ অবধি কেটেছে শ্রীহট্ট জেলার সিলেটে। তারপর কিছু বছর অসম। এখন পশ্চিমবঙ্গে। পল্লব ফ্ল্যাট পছন্দ করল বালি ব্রিজের কাছে উত্তরপাড়ায়। গঙ্গার ধারে। ব্রিজ শেষ হলেই নতুন একটা হাইওয়ে হয়েছে, কুড়ি মিনিটে এয়ারপোর্ট পৌঁছোনো যায়। ফ্ল্যাট বুকিং-এর খবরটা নবগ্রামের পাড়ার লোকেদের বলেছিলেন। তারা বলল, এই যাঃ, আপনি চলে গেলে ফ্ল্যাগ হয়েস্ট কে করবে?

অমিয়বাবু বলতে যাবেন, কেন, আমিই এসে করব। উত্তরপাড়া তো খুব দূরে নয়। ওঁকে বলার সুযোগ না দিয়ে ক্লাবের এক ছোকরা বলে উঠেছিল, নো প্রবলেম, দাদু থাকতে না পারলে আর কী করা যাবে! রাধানাথ পোদ্দারকে বলব, পতাকা তুলতে। বার খেয়ে ক্লাবে বেশি চাঁদা দেবে।

ঠোঁটে চলে আসা কথা গিলে নিতে হয়েছিল অমিয়বাবুকে। পোদ্দারের সঙ্গে চাঁদার ব্যাপারে পাল্লা টানা ভারী কঠিন। সে দুটো তেলকল আর ইটখোলার মালিক। অমিয়বাবু সিদ্ধান্ত নেন, পুরনো পাড়ায় না হোক, নতুন পাড়ায় চেষ্টা করতে হবে। এলাকার লোকেদের

সঙ্গে ভাব জমাবেন বেশি করে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিচয়টাও জানাবেন যেচে। বিশ্বাস উৎপাদন করতে কোনও একটা অজুহাতে সরকারের ঘর থেকে নেওয়া সংগ্রামী পেনশনের কাগজপত্রও দেখাবেন। তাতে নিশ্চয়ই ওরা আহ্বান জানাবে পতাকা তোলার। হাতের কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামী পাওয়া এখন দুষ্কর। বেশির ভাগই মারা গেছেন। প্ল্যান মাফিক এগোচ্ছিলেন অমিয়বাবু। সংগ্রামীর পরিচয় জেনে তারা বিশেষ খাতিরও করল। পতাকা তোলার কথা বলল না। অগত্যা ক’দিন আগে অমিয়বাবু নিজেই মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন। তারা তো প্রায় ‘হায় হায়’ করে উঠল, এ কী বলছেন আপনি! এ পাড়ার ফ্ল্যাগ তোলেন কাউন্সিলার। উনি বহিরাগত। এখানে একটা বাড়ি আছে বটে, থাকেন কলকাতায়। মধুদাকে ইলেকশনে জেতাতে কালঘাম ছুটে যায় আমাদের। ওই একটা দিনই ওয়ার্ডের ভোটারদের সঙ্গে ওঁর মোলাকাত হয়।

দমে গিয়েছিলেন অমিয়বাবু। রাজনৈতিক ভাবে কাউন্সিলারকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা তাঁর নেই। এখনকার রাজনীতি থেকে তিনি অনেকটাই দূরে সরে গেছেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে পাড়ার লোকেদের তিনি বলেছিলেন, আমি কি নিজের মতো ফাঁকা জায়গা দেখে এখানে ফ্ল্যাগ তুলতে পারি?

ফুৎকারে উড়ে গিয়েছিল আবেদন। ওরা বলেছে, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে, এক

পাড়ায় দুটো ফ্ল্যাগ! বাইরের লোক ভাববে আমরা ডিভাইডেড হয়ে গেছি। ক’টা দিন খুব মন খারাপের মধ্যে কাটল অমিয়বাবুর। স্মৃতির সরণি বেয়ে উঠে আসছিল সিলেট, উনিশো চৌত্রিশ অথবা পঁয়ত্রিশ সাল। সেদিন ছিল ছাব্বিশে জানুয়ারি। দিনটিকে তখন ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে পালন করা হত। কংগ্রেসের সাইক্লোস্টাইলড প্রচার পুস্তিকা এসেছিল বড়দার হাতে। গোপন সভা বসল শিমুলতলার মাঠে। কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করল সতীশদা। বক্তৃতা দিল দারুণ। সতীশদার হাবেভাবে চেহারায় একটা বেশ মহামানবের ভাব ছিল। কিশোর অমিয়বাবু সতীশদাকে আইডল করেছিলেন। জনা কুি ছেলের জমায়েত থেকে সেদিন পাড়া কাঁপিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল ‘বন্দেমাতরম’। যথাসময়ে টাউন দারোগা গোপাল ঘোষ চার জন লাল পাগড়ির কনস্টেবল নিয়ে হাজির। সতীশদা, বড়দা, অমিয়বাবু ছাড়া সবাই দে দৌড়। সেদিনই কারাগারে যেতে হত তিনজনকে। যদি না বড়দা বুদ্ধি করে বাবার পরিচয় দিত। বাবা ছিলেন সরকারি পক্ষের জাঁদরেল উকিল। গোপাল ঘোষ বললেন, স্যরের ছেলে হয়ে কিনা তোরা ‘ভারতমাতা কী জয়’ করিস! এখন পালা। কাল বিকেলে তোদের বাড়ি যাচ্ছি।

এতেও দমেননি অমিয়বাবুরা। ছোটরা মিলে ‘বানর সেনাবাহিনী দল’ তৈরি হল। বিদেশি দ্রব্য বর্জন অভিযানে নেমে পড়লেন। গৃহস্থের ঘরে কেরোসিন লন্ঠন জ্বলতে দেখলেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নিভিয়ে দিয়ে আসতেন। ব্রিটিশ সরকার কেরোসিনের ওপর কর ধার্য করেছিল। বানর সেনার দাপটে অচিরেই সিলেটের ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকল সরষের বা রেডির তেলের প্রদীপ। যার ক্ষীণালোকে জমা হত স্বাধীনতার স্বপ্ন।

সেই বয়সে জেলে না গেলেও, সাকুল্যে সাতবার কারাবরণ করেছেন অমিয়বাবু। চারবার হিজলি জেলে। বাকি তিনবার কমিউনিস্ট পার্টি করার অপরাধে সুনামগঞ্জে।

তারপর দেশভাগ। অসমে কিছুদিন স্কুলমাস্টারি করার পর চলে এলেন নবগ্রামে। সিলেটের সঙ্গীসাথীরা আগেই ডেরা বেঁধেছিল এখানে। ওদের আগ্রহেই আসা। চাকরি করতে ঢুকলেন বার্ন কোম্পানিতে৷ রিটায়ারমেন্টের পর বন্ধুদের জোরাজুরিতে সংগ্রামী পেনশন নিতে শুরু করলেন। ওরা বলেছিল, এটা একটা সম্মানের ব্যাপার। বন্ধুরা সব চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। অমিয়বাবু পড়ে রয়েছেন একা। ‘স্বাধীনতা দিবস’ এলেই এখনও হাতটা বড় নিশপিশ করে। বাবু, কোথায় থামতে হবে বলবেন।

ভানুয়ার কথায় সংবিৎ ফেরে অমিয়বাবুর। ভাবনার মধ্যে হারিয়ে গেলেও তিনি কিন্তু আশপাশটা লক্ষ রাখছেন। তাই বললেন, কোথায় দাঁড় করাবে বলো তো? সব গায়ে গায়ে বাড়ি। যেখানে যতটুকু ফাঁকা দেখছি, বেদি বানিয়ে বাঁশ পোঁতা রয়েছে।

ভানুয়া বলল, তা হলে চলুন, চৈতলপাড়া দিয়ে ঢুকি। ওদিকে অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। অনুমতির অপেক্ষা না করে ভানুয়া গলির রাস্তা ধরল। ভানুয়াকে নিজের উদ্দেশ্য বলে রেখেছেন অমিয়বাবু। প্রায় বাধ্য হয়েই তাঁকে এই রাস্তা নিতে হয়েছে। নতুন পাড়ায় যখন পতাকা তোলা যাবে না বুঝলেন, ছেলেকে হতাশ গলায় বলেছিলেন, এবার তো মনে হচ্ছে স্বাধীনতার দিন বাড়িতে বসেই কাটাতে হবে।

পল্লব জানতে চেয়েছিল, কেন?

সংকট সবিস্তারে জানিয়ে ছিলেন অমিয়বাবু। পল্লব বলল, এটা কোনও প্রবলেমই নয়। তুমি এই কমপ্লেক্সের ছাদে ফ্ল্যাগ হয়েস্ট করবে। ছাদের অধিকার সব ফ্ল্যাট ওনারের সমান।

উপায়টা মনে ধরে ছিল অমিয়বাবুর। বিষয়টার মধ্যে যৌক্তিকতাও খুঁজে পেয়েছিলেন। এত ক’টা ফ্ল্যাট এক ছাদের তলায় হলেও, এটাও তো এক প্রকার পাড়া। গিয়েছিলেন কমপ্লেক্সের সেক্রেটারি শান্তিবাবুর কাছে। উনি বললেন, কোনও অসুবিধে নেই। পতাকা তুলতে কতটুকুই বা জায়গা লাগে। ফ্ল্যাট সি ফোরের সেদিন একটা বার্থ ডে পার্টি আছে। পুরো ছাদ জুড়ে প্যান্ডেল পড়বে। আপনি একটু নিজের মতো করে সাইডে পতাকাটা খাটিয়ে দেবেন।

স্বাভাবিক কারণেই মন সায় দেয়নি অমিয়বাবুর। উৎসব বাড়ির প্যান্ডেলের পাশে জাতীয় পতাকার এমত অবস্থান মোটেই সম্মানজনক নয়। সেই কারণেই আজকের এই অভিযান। কোথাও ফাঁকা জায়গা পেলে খুঁটি পুঁতে ফ্ল্যাগ হয়েস্ট করবেন। পকেটে কিছু টাকাও নিয়েছেন। কিছু উৎসাহী মানুষ যদি জমে যায়, বোঁদে জিলিপি খাইয়ে দেবেন। প্ল্যানটা ছেলে বউমা ভাল মনে নেয়নি। অদ্ভুত ঠেকেছে। কিন্তু এ ছাড়া অমিয়বাবুর উপায় ছিল না। ক’টা দিনই বা আর বাঁচবেন! স্বাধীনতা দিবসে দেশের পতাকা তোলার এই যে অসাধারণ অনুভূতি, বেশিবার তো পাবেন না।

অমিয়বাবু বুঝেছিলেন আজকের কাজটা সফল করতে দু’জনই যথেষ্ট। খুঁজে নিয়েছিলেন ভানুয়াকে। বাঁশ, শাবল ভাড়া করে এনেছে ভানুয়া। অমিয়বাবুর ঝোলায় মাঝারি সাইজের নতুন পতাকা, বাঁশের মাথায় লাগানোর রিং, শালপাতায় মোড়া ফুল, ধূপকাঠির প্যাকেট, দেশলাই সবই আছে। এখন শুধু একটুকরো জমি দরকার।… ভাবতে ভাবতেই ফাঁকা মাঠের

পাশে চলে এসেছে রিকশা। অমিয়বাবু বলে ওঠেন, দাঁড়াও দাঁড়াও ভানুয়া। মনে হচ্ছে এখানেই হয়ে যাবে।

ভানুয়া রিকশা থামায়। অমিয়বাবু নেমে আসেন। মাঠের দু’পাশে গোলপোস্ট। ইলেভেন সাইড মাঠ। একটা পোস্টের পিছনে পুকুর, রাস্তার এক পাশে সারি সারি বাড়ি। পাড়ার ঘুম এখনও ভাঙেনি। ভানুয়া শাবল হাতে চলে এসেছে। জানতে চায়, বলুন, কোথায় গর্ত করব?

হাত পাঁচেক দূরে আঙুল তুলে অমিয়বাবু বলেন, এখানেই কোথাও একটা করো। ভানুয়া কাজ শুরু করে দিয়েছে, এমন সময় পুকুরঘাট থেকে উঠে এল ভেজা শরীরের

লুঙ্গি পরা একটি ছেলে। দূর থেকেই বলতে লাগল, এই যে মশাই, কী হচ্ছে এখানে? দ্রুত কথা গোছাতে থাকেন অমিয়বাবু। হাত থেমে গেছে ভানুয়ার। ছেলেটা এসে পড়ল সামনে। তিরিক্ষি ভাবে বলল, কী কেস?

অমিয়বাবু বললেন, আজ স্বাধীনতা দিবস তো। পতাকা টাঙাচ্ছি।

তা, এখানে কেন? জানেন না, এই চত্বরে লাল পতাকা ছাড়া কিছু চলে না। পরিবর্তন দেখাতে এসেছেন? ফুটুন এখান থেকে।

অমিয়বাবু বোঝেন, এখানে হবে না। ছেলেটিকেও বোঝানো যাবে না, তিনিও লাল পার্টি করতেন। ভানুয়াকে ডেকে নেন।

মেঘ কেটে রোদ উঠেছে ঝলমলে। এই রোদে তাপ হয় বেশ। ভানুয়া নিয়ে যাচ্ছে কদমগাছি। বলেছে, ওদিকটা গ্রাম মতো, কেউ বড় একটা আপত্তি করবে না। শহর ফুরিয়ে আসছে। টুকটাক ফাঁকা জমি, কাঁচা বাড়ি… ছেলের ফোন এল মোবাইলে, বাবা, পতাকা তোলা হল? না রে, এখনও জুতসই জায়গা পাইনি।

ফ্ল্যাগ হয়েস্টের পর ফোন কোরো। চা-ফা খেয়েছ?

এইবার খাব।

ঠিক আছে, খেয়ে নাও। রাখছি।

কদমগাছি এসে একটা চা-দোকানে বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছেন দু’জনে। পথে একটা সাদামাটা মিষ্টির দোকান পড়েছিল, দুপুরের জন্য কিছু মিষ্টি আর পাঁউরুটি নিয়েছেন। যেরকম গ্রাম সাইডে এসে পড়েছেন, কোথায় কী পাওয়া যাবে কোনও ঠিক নেই। চা-দোকানের পাশে এক চিলতে জায়গা দেখে অমিয়বাবু দোকানিকে বলেছিলেন, এখানে পনেরোই অগস্টের ফ্ল্যাগ তুলব ভাই?

দোকানি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলেছে, সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার। একেই পরের জমিতে দোকান চালাচ্ছি। এরপর আবার পতাকা ফতাকা টাঙাতে দিলে লোকে ধরে নেবে, চেষ্টা করছি পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে। এসব ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না।

এখানেও হল না। ইট পাতা এবড়োখেবড়ো রাস্তা, ভানুয়া একমনে রিকশা টেনে যাচ্ছে। একটা গেঁয়ো চার্চ পেরিয়ে গেলেন অমিয়বাবুরা। ইতস্তত ধানজমি দেখা যাচ্ছে। সেরকম ফাঁকা মাঠ মতো কিছু পাওয়া যায়নি। রং ওঠা স্কুলড্রেস পরে বাচ্চারা চলেছে স্কুলে, পতাকা

তোলা হবে। অমিয়বাবু ভ্যানরিকশার সামনে পিছনে লক্ষ রাখছেন, বাঁশ যেন ওদের গায়ে না লেগে যায়।

এই নিন বাবু। এখানেই পুঁতে দিন। রিকশা থামিয়ে বলল ভানুয়া।

সিলেকশন খারাপ নয়। ছোট্ট গোল মাঠ ঘিরে ঝোপজঙ্গল। বাঁশঝাড়। মাঠের ধারে বাঁশের ভাঙা মাচা। জায়গাটা পরিত্যক্তই মনে হচ্ছে। অমিয়বাবু বললেন, শাবল, বাঁশ দুটোই নামিয়ে নেওয়া যাক। তাড়াতাড়ি সারতে হবে কাজ।

গর্ত অনেকটাই খুঁড়ে ফেলেছে ভানুয়া। অমিয়বাবু উবু হয়ে বসে বাঁশের মাথায় রিং বেঁধে পতাকার দড়িটা লাগাতে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কোনও একজন ঈষৎ বিস্ময় আর ধমক মিশিয়ে বলে উঠল, কী হচ্ছে এখানে?

ঘাড় ঘুরিয়ে অমিয়বাবু দেখেন, বছর চল্লিশের একটি লোক। উঠে দাঁড়ান অমিয়বাবু। লোকটিকে বলেন, স্বাধীনতার উৎসব পালন করব। পতাকা টাঙানো হবে। সে না হয় বুঝলাম। আপনারা কারা, কোথায় থাকেন?

আমরা ভারতবাসী। এ দেশেই থাকি।

ধুর, সে কথা জিজ্ঞেস করেছি নাকি! বলছি, কোন পাড়ায় থাকেন? এখানে যে ফ্ল্যাগ লাগাচ্ছেন, পারমিশন নিয়েছেন পঞ্চায়েতের?

একটু নরম হলেন অমিয়বাবু। বললেন, এই সামান্য কাজের জন্য পারমিশন! এটা টাঙানোর খানিকক্ষণ বাদেই খুলে নিয়ে যাব।

কী করে বিশ্বাস করব। পতাকা বহুত ডেঞ্জারাস জিনিস। একবার পোঁতা হয়ে গেলে, অনেক কিছু হয়ে যায়। বলে একটু থামল লোকটা। কী যেন ভেবে নিয়ে ফের বলে, যদিও আমাদের পঞ্চায়েত আপনাদের জোটসঙ্গী, তবু একবার প্রধানকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া ভাল।

অমিয়বাবু মোটেই কোনও পার্টির নন, সঙ্গীও নেই। তবু জানতে চান, প্রধানকে কোথায় পাব?

আজকের দিনে তাকে কি আর পাবেন? কত জায়গায় কত রকম প্রোগ্রাম…

হল না। অমিয়বাবু চোখের ইশারায় ডেকে নেন ভানুয়াকে। পা দিয়ে গর্তের মাটি ভরাট করে, ভানুয়া বাঁশ, পতাকা, শাবল ভ্যানে তুলল।

সূর্য পাটে বসছে। অমিয়বাবুরা এখন যেখানে চলে চলে এসেছেন, চার পাশে জলা। অস্তরাগের রং ছড়িয়ে পড়েছে জলে। রাস্তাটা সুরকি ঢালা। এত সময় ধরে রিকশা টেনেও ভানুয়ার মুখে কোনও বিরক্তি নেই। এখন বেশ একটা ঝোড়ো টাইপ হাওয়া দিচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখি টাল সামলাতে পারছে না। এরকম হাওয়ায় পতাকা পতপত করে ওড়ে। মুক্তির উত্তেজনা ঠিকঠাক অনুভূত হয়।

এতক্ষণে মনের মতো জমি খুঁজে পেলেন অমিয়বাবু। জলার ধারে একটুকরো জমি। ভানুয়াকে বললেন, এখানেই ঠিক হবে। আশেপাশে জনমনিষ্যি নেই। কেউ ডিসটার্ব করতে আসবে না।

ভানুয়া সম্মত হল। বলল, চলুন, জলদি মালপত্তর নামিয়ে নিই।

অমিয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, জায়গাটার নাম জানো ভানুয়া? ভানুয়া বলল, না বাবু, কোনওদিন আসিনি এদিকে।

বাঁশ পোঁতা হয়ে গেছে। অমিয়বাবু ভাবছেন কয়েকটা ইট পাওয়া গেলে ভাল হত। বেদি বানাতে পারতেন। ছড়িয়ে দিতেন ফুল। হঠাৎই কানে ভেসে এল ‘রে রে’ আওয়াজ। অমিয়বাবু মুখ তুলে দেখেন মাঠ জলা ফুঁড়ে উঠে আসছে মানুষ। কিছু বোঝার আগেই খালি গায়ের কাদা মাখা মানুষগুলো ঘিরে ধরল অমিয়বাবুদের। বলতে লাগল, আবার এসেছেন দখল নিতে! গেল বার শিক্ষা হয়নি? হঠান এ সব, তুলুন। নইলে এখানেই পুঁতে শালা। দেব,

মার মার জনতার সামনে পড়ে অমিয়বাবু কথা হারিয়ে ফেলেছেন। ভানুয়া বাঁশ উপড়ে জিনিসপত্তর নিয়ে রিকশায় রাখল। ফের চালু করল তার গাড়ি। ভিড়টা পিছন পিছন খানিকটা এসে ফিরে গেল।

সূর্য গলা অবধি ডুবে গেছে। সন্ধে নামছে খুবই ঢিমেতালে। সিলেটে যেমন নামত কিশোরবেলায়। মোগল দিঘির ঘাটে বসে স্বাধীন দেশের কল্পনায় মশগুল হতেন অমিয়বাবুরা। বিপ্লবীদের বীরত্ব নিয়ে নানান গল্প হত… অমিয়বাবু ভানুয়াকে বলেন, তোমার তো খুব কষ্ট হচ্ছে ভানুয়া। পাঁউরুটি, মিষ্টি এতক্ষণে সব হজম হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

দম টানতে টানতে ভানুয়া বলে, আমার আর কী কষ্ট! আপনি বুড়ো মানুষ, সারাদিন রোদে-জলে ঘুরে বেড়ালেন। দুপুরে ভাত যায়নি পেটে…

ঝোলা ব্যাগে ফোন বাজছে। বার করলেন অমিয়বাবু। পল্লবের ফোন। কানে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বল।

কী ব্যাপার, এখনও ফিরলে না! তোমরা এখন কোথায়?

ঈষৎ এলানো লাগছে পল্লবের গলা। উৎসবের দিনে একটু পার্টিফার্টি করে, অমিয়বাবু এতে কিছু মনে করেন না। তিনিও মেতে থাকেন পনেরোই অগস্ট নিয়ে। পল্লব ফের বলে, কী হল চুপ করে আছ কেন? কোথায় আছ, ফ্ল্যাগ পোঁতা হয়েছে?

জায়গাটা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছি না রে। পতাকা তোলা হয়নি। আর-একটু যাই, মনে হচ্ছে পেয়ে যাব জায়গা।

ও প্রান্তে পল্লবের গলায় প্রবল আশঙ্কা, ও মাই গড! এখনও পতাকা তোলা হয়নি। যে সময় বেরিয়েছ, এতক্ষণে তো অনেক দূর পৌঁছে যাওয়ার কথা। আর বেশি দূরে যেয়ো না, এবার তো মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চলে গিয়ে পড়বে।

অমিয়বাবু বলেন, যেতে তো হবেই। দেশের এত দিনকার স্বাধীনতার জন্যও তো একটু মুক্তাঞ্চল চাই। কিছুটা খোলা বাতাস।

ফোনের ওপারে পল্লব নিশ্চুপ। সূর্যও ডুবে গেছে নিঃসাড়ে। রেখে গিয়েছে এক আকাশ আলো। পথঘাট দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না।

রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, অগাস্ট ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *