খেলেন দই রমাকান্ত

খেলেন দই রমাকান্ত

ইহুদি যাজক সম্প্রদায়ের সুপুত্র শ্রীযুক্ত লেভির সঙ্গে তার বাড়িতে খানা খেতে যাচ্ছি। তার আছে গল্পের অফুরন্ত ভাণ্ডার। তারই একটা ছাড়লেন :

“জারের আমলে রোববার দিন গির্জেয় গেছে গ্রামের সবাই। রুশ জাতটা একদা ছিল বড়ই ধর্মানুরাগী! কুলোকে বলে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভূতপ্রেত-তাবিজ-কবচে-বিশ্বাসী উজবুকের ভায়রাভাই। এবং সাতিশয় পাষণ্ডেরা বলে, সেই প্রাচীন কুসংস্কারই আজ তাদের টেনে নিয়ে যায় লেনিনের দর্গায় শিরনি চড়াতে। তা যে যা গে– মোদ্দা কথা : তারা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করে, তাদের গাঁয়ের পাদ্রি সায়েব যা বলেন তাই আপ্তবাক্য। যদ্যপি এসব পাদ্রিদের অনেকেই নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে পারে না–”

আমি শুধালুম, “নিরক্ষর জন গির্জায় ধর্মোপদেশ দেয় কী প্রকারে?”

বললেন, “আশ্চর্য! রাসপুতিন যে কী মাথার ঘাম পায় ফেলে কুল্লে আড়াই আউন্স বাইবেল গলাধঃকরণ করতে পেরেছিলেন সে না হয় পড়োনি, তাই জানো না। নিচ্চেভো– অর্থাৎ কুছ পরোয়া নেহি। সেই আড়াই আউন্স বাইবেল ডাইলুট করে তিনি মহারানি জারিনা মায় জার প্রাসাদ জয় করলেন। তাঁকেও নাম সই করতে হলে ঘেমে নেয়ে কাঁই হতে হত।

আর এরই উলটো দিক– অর্থাৎ ভালোর দিকের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ খুঁজতে হলে অন্তত তোমাকে তো আর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি মাকু মারতে হবে না। তোমার নবী পয়গম্বর তো ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর! তা সে যাক্ গে।

সে রোববারে পাদি সায়েবের সারমন বা বক্ততার বিষয়বস্তু ছিল ইহুদিরা কী অন্যায়ভাবে প্রভু যিশুকে ক্রুশের উপর খুন করল। এ বিষয়ে বক্তৃতা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পাদ্রিই দেন। তফাৎ শুধু এইটুকু যে, শিক্ষিত পাদ্রি জানেন, প্রভু যিশু ক্রুশের উপর থেকে তার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে গিয়েছিলেন। তাই তিনি বক্তৃতা দেবার সময় সতত সতর্ক থাকেন, অজ্ঞ খ্রিস্টানগণ যেন উত্তেজিত হয়ে ইহুদি নির্যাতন আরম্ভ না করে। কিন্তু ওই যে রুশ পাদ্রির কথা বলছিলুম, তিনি সেদিন উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন, কী প্রকারে মূঢ় জনতাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলা যায়। অবশ্য তার জন্য অত্যধিক বাগ্মিতাশক্তির কোনও প্রয়োজন নেই কারণ রুশ দেশে আবহমান কাল থেকে ইহুদিবৈরিতা বংশানুক্রমে চলে আসছে। কাজেই সারমন শেষেই বিক্ষুব্ধ চাষিরা একজোট হয়ে ধাওয়া করল মাঠের অন্য প্রান্তের খাস ইহুদি গ্রামটার দিকে। দূর থেকে তাদের চিত্তার হুঙ্কার শুনে ইহুদিরা ব্যাপার কী জানবার জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এল। তাদের চিৎকারে তখন পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ‘খুন করব, ব্যাটাদের খুন করে রক্ত দিয়ে রক্তের দাদ নেব! ’

সবাই একে অন্যকে চেনে। তাই ইহুদি গাঁওবুড়ারা করজোড়ে শুধালে, ‘আমরা কী অপরাধ করেছি যে আমাদের খুন করবে, এতকাল ধরে পাশাপাশি গ্রামে বাস করছি—’

উত্তেজিত জনতা বললে, ‘চালাকি রাখো। তোমরা আমাদের প্রভুকে খুন করেছ, তার দাদ আমরা নেবই নেব।’

যেন পরদিনের ঘটনা! লেভি গল্প বলা ক্ষান্ত দিলেন। কারণ হঠাৎ পিটির পিটি করে বৃষ্টি নামল। এই পোড়ার দেশে মনসুন নেই বলে বারো মাসের যে কোনও দিন আচমকা বৃষ্টি নামে। আমি বললাম, ‘চলুন, হার ডক্টর, ট্রাম শেড-এ আশ্রয় নিই।’

বললেন, “ছোঃ! কিসসু জানো না। ইহুদিরা ছাতা কেনে না কেন, তার খবর রাখো? খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, ইহুদিরা এমনই দুর্দান্ত চালাক যে, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে জামাকাপড় বাঁচিয়ে দিব্য চলাফেরা করতে পারে। তার পর কী বলছিলুম? সেই রুশ ইহুদিদের কথা। তারা ছিল সত্যই চালাক! চট করে ভেবে নিয়ে দেখলে, ওই সব জড়ভরত কেরেস্তান রুশদের বোঝানো হবে অসম্ভব, ঘটনাটা ঘটেছে দু হাজার বছর পূর্বে, রুশ দেশে নয়– বহু দূর-দুরান্তের প্যালেস্টাইনে– যারা মেরেছিল, তারা সেই দেশ ছেড়ে কবে কোন আদ্যিযুগে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র, বিয়ে করেছে জাতেবেজাতে– এখন যাদের ঠ্যাঙাতে যাচ্ছ–”

আমি বললুম, “বুঝেছি। খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলা গোবদ্দন!”

 লেভি বললেন, “লাখ কথার এক কথা!”

অতএব ইহুদি ডাঙরিয়ারা হন্তদন্ত হয়ে বললে, ‘ইহুদিরা প্রভু যিশুকে না হক খুন করেছিল, এ তো অতিশয় সত্য কথা–বিশ্ব-সংসার জানে। কিন্তু ভাই, তোমরা করেছ ভুল। আমরা, এ গাঁয়ের লোক, ওঁকে মারিনি– তা কখনও পারি! মেরেছে–’  বলে আঙুল দিয়ে দেখালে পাশের গাঁ। বলল, ‘মেরেছে ওই ও–ই গাঁয়ের ইহুদি রাস্কেলরা। বুঝলে তো ভায়া?” বলে লেভি গম্ভীর হয়ে গেলেন।’

আমি একগাল হেসে বললাম, “যা শত্রু পরে পরে। কিন্তু গল্পটা তো সে রকম ঝাঁঝালো না –আপনার সেদিনকার রাব্বি, জানালার শার্সি আর আয়নাতে তফাৎ নিয়ে গল্পটার মতো?”

লেভি বললেন, “ক্যারেকটারিস্টিক গল্পের ফানকশন হচ্ছে কোনও বিশেষ জাত বা শ্রেণি বা যা-ই হোক না কেন, তার ক্যারেকটার, তার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা। ভেড়ার বাচ্চা আর নেকড়ে বাঘের মতো তর্কাতর্কি নিয়ে যে গল্প ঈশপ লিখেছেন সেটাতে ঝাঁঝ কোথায়? কিন্তু গল্পটা সাতিশয় ক্যারেকটারিস্টিক– অর্থাৎ ভেড়া আর নেকড়ের ক্যারেকটার ওতে চমৎকার ফুটে উঠেছে– নইলে গল্পটা দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল কী করে, আর এত যুগ ধরে বেঁচে আছেই-বা কী করে? আমি রুশ ইহুদিদের সম্বন্ধে যে গল্প বললুম– গল্প না হয়ে সত্য ঘটনাও হতে পারে সেটা কিন্তু সর্ব-ইহুদিদের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। বিপদকালে তারা এক হতে তো জানেই না, বরঞ্চ নিজেকে বাঁচাবার জন্য জাতভাই অন্য ইহুদিকে বিসর্জন দিতেও তার বাধে না।”

আমি বললুম, “উঁহু।”

 “মানে?”

আমি বললুম, “আমার দেশ বাংলার উত্তর প্রান্তে এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে বলা হয়, স্বার্থ থাক আর নাই থাক তারা একে অন্যের সাহায্য কস্মিনকালেও করেন না। একটা নদী পেরুবার সময় নাকি পর পর পাঁচজন ব্রাহ্মণ একটা পাথরে ঠোক্কর খান, কিন্তু কেউই পরের জনকে হুঁশিয়ার করে দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। শেষটায় একজন যখন ‘বাপ রে’ বলে অন্যদের সাবধান করে দিলে, তখন তারা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘ব্যাটা নিশ্চয়ই আমাদের শ্রেণির ব্রাহ্মণ নয়।’ তখন ধরা পড়ল, সত্যি সে অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণবর্ণচোরা আঁবের মতো এদের সঙ্গে মিশে এদেরই একজন হতে চেয়েছিল। গল্পটা আপনারই সংজ্ঞা অনুযায়ী খুবই ক্যারেকটারিস্টিক বটে, কিন্তু আমার মনে এ বাবদ একটা ধোঁকা রয়ে গেছে।”

লেভি বললেন, “তুমি দেখি হেরোডকেও হেরোড শেখাতে চললে অর্থাৎ যারে বলে গুরুমারা বিদ্যেতে ওস্তাদ হয়ে উঠছ। বুঝিয়ে বল।”

আমি বললাম, “যে ব্রাহ্মণ শ্রেণির গল্পটি আপনাকে বললাম, তাঁরা যে অতিশয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এবং বুদ্ধিমান জীব মাত্রেই ঐক্যে বিশ্বাস করে। তাই আমি বহুকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলুম, এঁরা একে অন্যকে খুবই সাহায্য করে থাকেন– যে রকম ফ্রিমেসনরা একে অন্যের প্রতি বড়ই সদয়– কিন্তু সে সাহায্যটি করেন অতিশয় সঙ্গোপনে। এবং অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণরা যাতে করে এ-তত্ত্বটি আবিষ্কার না করতে পারেন, তাই তারা নিজেরাই বাজারে একাধিক কামুফ্লাজ গল্প ছেড়েছেন এই মর্মে যে, তাদের ভিতর মারাত্মক ঐক্যাভাব। তাই আমার মনে হয়, আপনি যে গল্প দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন, ইহুদিরা সবদ্ধ হয় না, সেটা স্বয়ং ইহুদিরাই তৈরি করেছেন, খ্রিস্টানদের সন্দেহ না জাগানোর জন্য।”

ইহুদি আর স্কচম্যানের একটা মহৎ গুণ–তাদের নিয়ে কেউ রসিকতা করলে সেটা তারা উপভোগ করতে পারে। লেভি আমার সত্য-সিদ্ধান্ত শুনে হেসে বললেন, “এটা আজ খানা-টেবিলে আমি পেশ করব। দেখি, ঠাকুন্দা-বাবা কী বলেন। কিন্তু জানো, এর থেকে একটা গুরুতর সমস্যায় উপনীত হওয়া যায়। তুমিই সেদিন প্রশ্ন করেছিলে, ইহুদিরা যে প্যালেস্টাইনে ‘হোম’ বানাতে চায়, সেটা ভালো না মন্দ? আমি বলেছিলুম, সময় এলে আলোচনা করা যাবে। তাই এ-স্থলে প্রশ্ন শুধানো যায়, পৃথিবীর সব ইহুদি এই হোম চায় কি না? এই দাবির পিছনে কি তারা ঐক্যবদ্ধ? তোমার প্যারা কবি হাইনে একদা এই আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক ঠিক বলতে গেলে ওই আন্দোলনের আলোচনাচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের ভিতরই তিনি সে-চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেন। তার থেকে অবশ্য এটা বলা চলে না, প্যালেস্টাইনে ইহুদি হোম নির্মাণের ব্যাপারে তার কোনও ঔৎসুক্য ছিল না। আসলে ব্যাপারটা অন্য ধরনের; সংখ্যালঘুদের ভিতর একরকম লোক থাকে, যারা আপন সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতর নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় না– তারা ভাবে, বাড়িতে বাপ-ভাই তো সে-গণ্ডি বানিয়ে রেখেছেনই, বাইরে গিয়েও তাদেরই জাতভাইদের সঙ্গে মিশে কী লাভ? আমার মনে হয়, হাইনের বেলা হয়েছিল তাই।” তার পর হঠাৎ রাস্তার উপরই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার দেশে তুমিও তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। তুমি দেশে কাদের সঙ্গে মেলামেশা কর?” উত্তর দেবার পূর্বেই তিনি বললেন, “এ বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলতে পারে, অতএব এটা এখন মুলতুবি থাক, কারণ বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।”

বাউমশূল আলের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একখানা ছিমছাম তেতলা বাড়ি।

ল্যাচ-কি দিয়ে দরজা খুলে বললেন, “স্বাগত জানাই তোমাকে। মঙ্গল হোক, জয় হোক তোমার। তোমার বংশধর যেন অসংখ্য হয় ॥”
২১/৫/৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *